বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৫২
মীরা একটানে কাগজটা ছিড়ে কুচি কুচি করে ফেলল, তারপর একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। রাগে, দুঃখে, অভিমানে ওর সমস্ত শরীরের অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি পড়েছে। বাতাসে ঠান্ডা ভাব, তবু মীরা তোয়াক্কা করল না। শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঠান্ডা জলের স্পর্শে শরীর কেঁপে উঠলো। অনেকক্ষণ ভেজার পর যখন কাঁপুনি ধরে গেল, তখন হঠাৎ করেই মনে পড়ল, এমনি এমনি নিশ্চয়ই এই কথাটা লেখেনি আশিক। নিশ্চয়ই এটার কোন মানে আছে। মীরা তাড়াতাড়ি শাওয়ার বন্ধ করে মাথায় তোঁয়ারে পেঁচিয়ে, পোশাক পাল্টে বেরিয়ে এল।
ঘরের ভেতর তাকিয়ে চমকে উঠলো। পুরো ঘর পরিপাটি। দৌড়ে লাইব্রেরীতে ঢুকে দেখল ছিড়ে ফেলা কাগজের চিহ্নমাত্র নেই। মীরা দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে নেমে গেল। রোজিনা ওকে দেখে এক গাল হসে বলল
– ভাবি নাস্তা খাইবেন না?
– রোজিনা আমার ঘরে কতগুলো কাগজ পড়ে ছিল, সেগুলো কোথায়?
– বুয়া আসছিল, ঝাড়ু দিয়া ফালাইয়া দিছে
ওর ইচ্ছা হল রাগে হাত কামড়াতে। কি যেন ছিল শব্দটা? কি, কিতা ফিতা কিছু একটা হবে। ধুর! কেন যে রাগ দেখিয়ে ছিঁড়তে গেল। মীরা বিরস মুখে উপরে চলে গেল। নাস্তা খেতে ইচ্ছা করছে না। ফোন চেক করে দেখলো আশিকের কোন ফোন আসেনি। ও নিজেই কি একটা ফোন করবে?
মীরা সারা বিকেল ছটফট করলো। সন্ধ্যার পর আর থাকতে না পেরে আশিককে ফোন করল। ওর ফোন সুইচ ওফ বলছে।
আশিক ঘরে ঢুকলো সাড়ে এগারোটা নাগাদ। ঘরের আলো জ্বলছে। বালিশে মুখ গুজে মীরা ঘুমিয়ে আছে। আশিক আলো নেভালো না। স্নান সেরে পাঞ্জাবী
পায়জামা পরে একটা সাল জরিয়ে নিল। তারপর বিছানার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে একদৃষ্টিতে মীরার মুখের দিকে চেয়ে রইল। আজ সারাদিন ও অফিসে বসে অপেক্ষা করেছে। কখন মীরা ওর জবাব পেয়ে ফোন করবে। কিন্তু ওর ফোন আসেনি। আশিক একটা দীর্ঘ শ্বাসফেলে বাতি নিভিয়ে বিছানায় এসে বসল।
৫৩
মাথার উপর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে। ঘরটাতে বোধহয় এসিও চালানো আছে, তবু রাসেল টের পাচ্ছে ওর জুলফির কোন বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে ঘাম ঝরছে। এই বাড়িতে ও আগেও বহুবার এসেছে তবে এই ঘরটিতে ঢোকার সৌভাগ্য কখনো হয়নি। ছোটবেলা থেকে কৌতুহল ছিল অনেক। কিন্তু সেটা এইভাবে নিবৃত্ত হবে তা কল্পনাতেও ছিল না।
রাসেলের সামনে যে মানুষটি বসে আছে তাকে সে যথেষ্ট সমীহ করে ছোটবেলা থেকেই, তবে এই মুহূর্তে শ্রদ্ধা সমীহ সব বাদ দিয়ে যে অনুভূতিটা মনের মধ্যে কাঁপন ধরাচ্ছে সে এক অপরিসীম ভয়। আরিফ সাহেব রাসেলের দিকে তাকিয়ে আছেন চিলের দৃষ্টি নিয়ে, অবশ্য কথা শুরু করলেন অত্যন্ত অমায়িক ভঙ্গিতে ।
– কেমন আছো রাসেল? আজকাল তো আসোই না
অত্যন্ত সহজ আলাপচারিতার ভূমিকা, যদিও রাসেল জানে এ আলাপ এত সহজ হবে না। গতরাতে উনি নিজে ফোন করে রাসেলকে আসতে বলেছেন। ব্যাপারটা এত সহজ হলে নিশ্চয়ই আশিককে দিয়ে খবর পাঠাতেন। রাসেল আলতো হাতে কপালের ঘাম মুছে বলল
– জি আঙ্কেল ভালো আছি
– খুব গরম পড়েছে তাই না ?
আরিফ সাহেব বেল বাজালেন। রফিক দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে এক কোনায় মাথা নিচু করে দাঁড়ালো। রফিক কখনোই চোখে চোখে তাকায় না । কোন প্রশ্ন ও করে না।
– দুই গ্লাস আমের জুস দিয়ে যাও তো রফিক
রফিক বেরিয়ে গেলে আরিফ সাহেব আবার কথা শুরু করলেন
– আমের জুস যে এত মজার খাবার আগে কখনো বুঝতে পারিনি। এই শীতে আম পাওয়াটা কঠিন। আমার এক ক্লায়েন্ট পাঠিয়েছে ইন্ডিয়া থেকে । এ বছর দেশে ও ভালই আম হবে মনে হচ্ছে। যেরকম বৃষ্টি হচ্ছে । তুমি কি বলো?
– জি আঙ্কেল? ঠিক বুঝতে পারছি না
– বৃষ্টির কথা বলছিলাম আরকি
– ও আচ্ছা, জ্বি .. মানে..
– সেদিন বৃষ্টির সময় তুমি কোথায় ছিলে?
– জ্বি , কোন দিন?
– যেদিন আশিকের ওখানে ইন্সিডেন্টটা হয়
– আঙ্কেল আমি রাইফেল স্কয়ারের পাশে বনফুল মিষ্টির দোকানে আটকা পড়েছিলাম। আমার সঙ্গে আরো অনেকেই ছিল।
আশিক তো তোমাকে ওর ওখানে যেতে বলেছিল তাই না? মিরাকে পিক করতে ।
– জি আঙ্কেল। আমি ওখানেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু ওই, পথের মধ্যে রিকশা থেকে পড়ে গেলা্ তারপর মোবাইল ভেঙে গেল আর…..
– তারপর বাড়ি ফিরলে কি করে?
– ওই আশেপাশের লোকজন একটা রিক্সা করে তুলে দিল আর কি। পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম…
– বলো কি! ওই বৃষ্টির মধ্যে আশেপাশের লোকজন তোমাকে রিক্সা করে দিল? বাংলাদেশের মানুষের মানবিকতা বোধ একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি দেখছি।
তা বাসায় পৌঁছেছ কটায়?
– সাড়ে বারোটা নাগাদ
– সরাসরি বাসায় গিয়েছিলে?
– জি আঙ্কেল
– তোমার বাসাতো শ্যামলী তাই না?
– জি, রিং রোড
– সেক্ষেত্রে তো তুমি মিরাকে নিতেই পারতে। তুমি ওই পথেই যাচ্ছিলে
– আসলে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম খুব
আরিফ সাহেব ব্যাথিত মুখে বললেন
– ও তাহলে আর কি করে যাবে। তা ডাক্তার দেখিয়েছিলে?
– জি দেখেছিলাম
– কোন ডাক্তার?
রাসেল একটু ফাপড়ে পড়ে গেল। এতসব প্রশ্ন উত্তর ভেবে আসেনি ও। একটু গুছিয়ে রেখেছিল কিভাবে কি বলবে কিন্তু এখন সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আমের জুস এসে গেছে। আরিফ সাহেব ইশারায় খেতে বলছন। রাসেল গ্লাস তুলে চুমুক দিল। অতি সুস্বাদু জুস কিন্তু খেতে চিরতার রসের মতন মনে হচ্ছে। কোনমতে গলা দিয়ে নামিয়ে বলল
– পাড়ার ডাক্তার। সামনে ফার্মেসিতে বসে
– ও আচ্ছা। মীরা যে ওখানে ছিল এই খবরটা তুমি, সুমন আর মারুফ ছাড়া তো আর কেউ জানতো না। তাই না?
– ইয়ে মানে মিরা যদি কাউকে বলে থাকে
– সেই সম্ভাবনা কম। যাইহোক, সুমনের অ্যালিবাই আছে। ও প্রিন্টিং প্রেসে ছিল সারারাত। বাকি রইল মারুফ। তোমার কি মনে হয়, মারুফ এই কাজটা কেন করেছে?
– কোন কাজটা আঙ্কেল?
– ও তোমাকে তো জানানো হয়নি। পুলিশ দরজাটা পরীক্ষা করে জানতে পেরেছে যে দরজা আটকে যায়নি। কেউ বাইরে থেকে লক করে দিয়েছিল এবং এটা কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছে। এখন প্রশ্নটা হচ্ছে কে করেছে? এখানে কার স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে ইনফরমেশনটা কার কাছে ছিল। তোমার কি মনে হয় মারুফ এই কাজটা কেন করেছে?
– আঙ্কেল আমার মনে হয় মারুফ মীরাকে পছন্দ করে। ওরা একই এলাকার……
আরিফ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন
– যদি সেটাই হয়ে থাকে, সেই ক্ষেত্রেতো মারুফের সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে মীরাকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার কথা। বন্ধুর সঙ্গে ওকে এক ঘরে আটকে দেয়ার কথা নয়।
আমি ঠিক …
রাসেল মনে মনে অনেক কিছু ভেবে রেখেছিল। অনেক যুক্তি দাড় করিয়ে রেখেছিল কিন্তু এই লোকটার সামনে সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। তবে ও মনে মনে একটা খুশির ঢেউ টের পাচ্ছে। যাক, সন্দেহের তীরটা ওর দিক থেকে ঘুরে মারুফের দিকে গেছে।
আশিককে তোমার কেমন লাগে রাসেল?
আচমকা এই প্রসঙ্গ পরিবর্তনে রাসেল একটু হকচকিয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
– জি? জি মানে …। ভালো
– হ্যাঁ, আশিক আসলে ওর মায়ের মতন হয়েছে। হুট করে রেগে যায়। আবার সহজে ক্ষমাও করে দেয়। একেবারেই আমার মতন হয়নি। আমি আইনের লোক তো, ক্ষমা টমা করতে পারি না। দোষ করলে শাস্তি পেতে হবে এই নীতিতেই বিশ্বাস করি। যদিও আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কিছু যায় আসে না, যেটা সত্য সেটা তো বের হয়ে আসবেই। গেটের বাইরে একটা ক্যামেরা লাগানো ছিল। কেউ একজন উঠে দরজাটা লক করেছে। অন্ধকারে তার মুখ ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না, তবে একটা স্পেশাল টিম গঠন করা হয়েছে। দ্রুতই তারা বের করে ফেলবে।
রাসেল কাঠ হয়ে বসে রইল। আরিফ সাহেব আবার বেল বাজালেন। রফিক এলে দাড়িয়েছে। তিনি থম্থমে গলায় বললেন
– আর এক গ্লাস আমের জুস দিয়ে যাও তো
রাসেল কুল কুল করে ঘামতে লাগলো।
চলবে…………
বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৫৪
আশিকের ঘুম ভাঙল একটা মিস্টি ফুলের গন্ধে। গন্ধটা কেমন মাতাল করা আর খুব চেনা। আশিক বুকের উপর কিছু একটা টের পেল। চোখ নামিয়ে দেখল ওর বুকের মধ্যে মুখ গুজে শুয়ে আছে মীরা। গন্ধটা আসছে ওর চুল থেকে। ওর বুকের কাছে পাঞ্জাবির একটা অংশ ভেজা। হয়েতো মীরা কাঁদছিল এতক্ষণ। এই বোকা আর আবেগি মেয়েটাকে নিয়ে ও কি করবে ভেবে পেল না।
আশিক মুখ নামিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল, তারপর একহাতে মীরার চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে খুব আস্তে করে ডাকল
মীরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ডাক শুনে ধড়মড় করে উঠল। তারপর ভীষণ লজ্জা পেয়ে সরে যেতে চাইল। আশিক ওকে দুই হাতে আগলে নিয়ে বলল
– মীরা চলে যেও ন প্লিজ
মীরা আবারো ওর বুকের মধ্যে মুখ গুজে বলল
-চলে তো আপনি যাচছেন, আমাকে ছেড়ে
আশিক বিস্মিত হয়ে বলল
-আমি কোথায় যাচ্ছি?
-কেন, আপনি ইন্ডিয়া চলে যাচছেন না?
-কে বলল?
-আমি জানি। আপনার চিঠি এসেছে। বাবা বলেছে আমাকে
আজ বিকেলে মীরা যখন আশিকের ফোনের জন্য ছটফট করছিল, নিচে নেমে জানতে পারল রাসেল এসেছে। চেম্বারে আছে বাবার সঙ্গে। মীরা একটু অবাক হয়েছিল। পরে মনে হয়েছিল হয়তো সেদিনের কেসের ব্যপারে কোন কথা আছে।
মীরা রাসেলের মুখোমুখি হতে চায়না। ও জানে একমাত্র রাসেলের কারনেই আশিকের সঙ্গে ওর এতটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। রাসেল ওকে ফোন করে যা বলেছে আশিক জানতে পারলে কি হবে ভেবে, ভয়ে ওর বুক কাঁপে। সেদিন টিএসসিতে ও দেখেছে আশিক কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। তখন মীরা ওর কেউ ছিলা না। তাতেই ও এতটা রেগে গিয়েছিল। এখন সবটা জানলে ও রাসেল কে কি করবে সেটা ভাবতেও ওর ভয় করে।
মীরা ইচছে করেই রান্নাঘরে ঢুকে গেল। সাতটা বেজে গেছে। আরিক সাহেব এই সময় দুধ চিনি ছাড়া এক কাপ ব্ল্যক কফি খান। আজকাল মীরাই সেটা তৈরি করে দেয়। রাসেল চলে গেছে বুঝতে পারার পর ও কফির মগ নিয়ে চেম্বারে ঢুকল। আরিফ সাহেব আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলেন। তারপর একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন
-আশিকের একটা চিঠি এসেছে। ওকে দিয়ে দিও
-কিসের চিঠি বাবা?
-ও কোলকাতায় একটা ওয়ার্কশপ এর জন্য অ্যাপ্লাই করেছিল। কিছু লেখা ও পাঠিয়েছিল। সেটারই আপ্রুভাল লেটার এসেছে। মে মাসে যেতে হবে। ভালই হল ততদিনে ওর পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে।
মীরার বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য মনে হল। এজন্য আশিক ওকে এড়িয়ে যায়। ও আর মীরার সঙ্গে থাকতে চায় না। রাগ , কষ্ট, হতাশা, অভিমান মিলে মীরার মিশ্র অনুভুতি হল। ও দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষন কাঁদল। তারপর উঠে দরজা খুলে শুয়ে পরল। বাতি ও নেভালো না। আশিক যখন ঘরে ঢুকলো মীরা ইচছা করেই বালিশে মুখ গুজে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। একসময় টের পেল আশিক বিছানায় এসে বসেছে। আলো না নিভিয়েই শুয়ে পরেছে মাথার নিচে হাত রেখে। ওর ভাড়ি নিশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচছে। তার ও আরো অনেক, অনেকক্ষণ পর যখন ও টের পেল আশিক ঘুমিয়ে পড়েছে, মিরা আস্তে আস্তে ওর কাছে এগিয়ে গেল। তারপর বুকের উপর মাথা রাখল। মীরা নিরবে কাঁদল অনেকক্ষণ। তারপর কখন ঘুমিয়ে পরল নিজেই টের পেল না। যতক্ষণে ঘুম ভাঙল আশিক ওকে ওই অবস্থায় দেখে ফেলেছে । লজ্জায়, সংকোচে ও কুঁকড়ে গেল। সরে যেতে চাইলেও সে যেতে দিচছে না। ভারী বাজে লোক তো! নিজেই চলে যাছহে আবার ওকে যেতে নিষেধ করছে। মীরার ইচছা করছে ছুটে পালিয়ে যেতে কিন্তু আশিক ওকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে আছে, যেন বাধন একটু আলগা হলেই ও পালিয়ে যাবে। মীরার কান্না পাচছে। কি ভীষণ কান্না পাচছে। মীরা ওর বুকের মধ্যে মুখ গুজেই ডুকরে কেঁদে উঠল।
আশিক কিছুই বুঝতে পারছে না। মীরা কোথায় চলে যাওয়ার কথা বলছে? ইন্ডিয়ায়? কিসের চিঠি এসেছে? কোলকাতায় একটা ওয়ার্কশপ এর জন্য আপ্লাই করেছিল। সেটা কি ? উফ! এটা আসার আর সময় পেল না ? এতদিন যেটার জন্য এত অপেক্ষা করছিল এখন সেটাই অসহ্য লাগছে। মীরা এইভাবে কাঁদছে কেন ? ও কি ধরেই নিয়েছে আশিক ওকে ছেড়ে চলে যাচছে? আশিকের ভীষণ আসহায় লাগছে। এই বোকা মেয়েটাকে ও কি করে বোঝাবে এখন?
-তুমি চাও না আমি যাই?
-আমার চাওয়া না চাওয়ায় কি যায় আসে? আপনি তো আর আমাকে ভালবাসেন না। দয়া করে বিয়ে করেছেন।
আশিক খুব অসহায় কন্ঠে বলল
-যার জন্য একশ তেরটা কবিতা লিখলাম সে কিনা বলছে আমি তাকে ভালবাসিনা?
মীরার চোখ জলে ভরে আছে। ও মুখ তুলে বলল
-কি বললেন?
আশিক জবাব দিল না। দুই হাতের তালুতে ওর টুল্টুলে মুখটা তুলে ধরে ঠোটে
ঠোট ডুবিয়ে দিল।
বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কাটতেই একরাশ লজ্জা এসে গ্রাস করল মীরাকে। ঘর ভর্তি এত আলোর মাঝে ও কেমন কুকড়ে গেল। কোনমতে বলল
-শুনুন আলোটা নিভিয়ে দিন না প্লিজ
-তুমি শিওর আলো নেভাতে চাও
-হু
আশিক বাতি নিভিয়ে তাকিয়ে দেখল মীরা খাটে বসে আছে। একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাইরে থেকে আসা নীলাভ আলো এসে পরেছে ওর চুলের উপর । আশিক চোখ ফেরাতে পারছে না। দৃশ্যটা কেমন অপার্থিব লাগছে। যেন এ মীরা নয়, কোন স্বর্গের অপ্সরী, যাকে ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না, কামনা করা যায় না। যে শুধু স্তবগানের, শুধু বন্দনার।
আশিক ওর হাত ধরল না। এগিয়ে এসে ওর চুলে হাত ছুঁয়ে বলল
– কে তুমি?
মীরার চোখে জল এসে গেল। বাড়িয়ে দেয়া হাত নিস্তেজ হয়ে এলিয়ে পরল। এসব কি বলছে ও? আশিক আরো কাছে এগিয়ে এলো তারপর দুইহাতে ওকে কাছে টেনে নিল। বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে বলল
-তুমি কি সত্যি, না আমার কল্পনা?
-মানে? এসব কি বলছেন?
আশিক মীরার ঘাড়ে মুখ গুজে হাসলো তারপর গালে ঠোট ছুঁয়ে বলল
-তোমার জবাব পেয়েছ?
-না, পাইনি
-পাওনি? আমি যে লিখে রেখে গেলাম
-কি ছাতা মাথা লিখেছেন আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আমি কি আপনার মতন অত জ্ঞানী।
মীরার কন্ঠে অভিমান ঝড়ে পরল। আশিক দুই হাতে ওর মুখটা তুলে ধরে বলল
– আচছা, আমি আমার এই বোকা বউটাকে নিয়ে কি করি বলতো?
মীরার সব রাগ অভিমান মুহূর্তে গলে জল হয়ে গেল। মীরা ওর বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বলল
-আপনাকে একটা কথা বলব?
-বল
-আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে ওই কথাগুলি বলা আমার উচিত হয়নি। আমি ক্ষমা চাইছি।
– ইটস ওকে। এখন ভুল ভেঙ্গেছে?
-হু
-তুমি কি তোমার জবাব চাও?
-চাই
আশিক ওকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল
ভুল ভেঙে গেলে ডাক দিও,
আমি মৃত্যুর আলিঙ্গন ফেলে আত্নমগ্ন আগুন
ললাটের সৌমতায় তোমার
লিখে দেবো একখানা প্রিয় নাম – ভালোবাসা।
চলবে…………
বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৫৫
এতো সুন্দর একটা রাত এইভাবে শেষ হবে মীরা ভাবতেও পারেনি। নির্ঘুম মিস্টি রাতটা যেন নিমিষেই কেটে গেল। ভোরের আগে মীরা যখন আশিকের বুকের সাথে লেপ্টে ছিল, আশিক ওর চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আচমকাই প্রশ্ন করেছিল
-আচছা মীরা, সেদিন তুমি আমাকে ওই কথাগুলো কেন বলেছিলে?
মীরার বুকটা ধক করে উঠল। ঠিক এই প্রশ্নটা আসতে পারে এটা ধারণা করেছিল তবু মনে মনে আশা করেছিল হয়তো আশিক এই নিয়ে আর কথা বলবে না। ও আদুরে গলায় বলল
বলেছি তো আমার ভুল হয়েছিল
তুমি ভুল করে এই কথাটা বলনি। নিশ্চয় কোন একটা কারণ ছিল। আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি
মীরা মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বলল
আমি বলব কিন্তু আগে কথা দিন আপনি এটা নিয়ে কোন ঝামেলা করবেন না
আশিক হেসে ফেলল, তারপর বলল
ঝামেলা করবো কেন ?
আমাকে রাসেল ভাই ফোন করেছিল, বিয়ের দিন রাতে। বলেছিল ওই লোকগুলিকে আপনি পাঠিয়েছেন।
আশিক চমকে উঠলো, এরকম কিছু শুনতে হবে ও মোটেও আশা করেনি। সবটা শোনার পর ও কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। মিরা এগিয়ে এসে বলল
আপনি কোন ঝামেলা করবেন না তো ?
আশিকর জবাব দিল না। ভয়ে মীরার বুক কাঁপতে লাগলো। আশিককে কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে, একটু আগের সেই কোমল মুখটা আর নেই।
——-
-বাবা আমি চাই এই কেসটা তুলে নেয়া হোক
আরিফ সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, যেন তিনি জানতেন যে আশিক এমনি কিছু একটা বলবে। ঘোড়া তার চাল দিলে নৌকা পিছিয়ে যায়। পেয়াদা কে এগিয়ে দেয়া হয় আত্মাহুতি দেয়ার জন্য। নিজের ছেলেকে উনি কিছুতেই পেয়াদা হতে দেবেন না। ঊনি হাতের ইশারায় ওকে বসতে বললেন।
– কফি খাবে আশিক?
আশিক জবাব দিল না। একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এর মধ্যে কফি কোথা থেকে এলো। আরিফ সাহেব ভ্রুক্ষেপ করলেন না, বেল বাজিয়ে রফিককে ডাকলেন । রফিক যথারীতি এসে ঘরের কোনায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছে। আরিফ সাহেব ওকে কফির কথা বলে আশিকের দিকে ফিরে বললেন
ব্রাজিল থেকে খুব ভালো ব্রান্ডের কফি আনিয়েছি, খেয়ে দেখো ভালো লাগবে। কি বলছিলে তুমি? আমি কেসটা তুলে নিতে চাও? এর কোন বিশেষ কারণ?
আশিক আমতা আমতা করে বলল
আপাতদৃষ্টিতে যে সমস্যা গুলো তৈরি হয়েছিল সেগুলো তো মিটে গেছে এখন শুধু শুধু আর ঝামেলা রেখে কি লাভ।
আরিফ সাহেব চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন, তারপর ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন
অপরাধ করলে শাস্তি কেন পেতে হয় জানো? দুটো কারণে, প্রথমত অপরাধকারী যেন পরেরবার অপরাধ করার সময় সেই শাস্তির কথা ভেবে পিছিয়ে যায় আর দ্বিতীয়টা হল শাস্তি না পেলে একটা সময় তার আর সেটাকে অপরাধ বলে মনে হয় না এবং সে সেই কাজ বারংবার করতেই থাকে। তুমি কি চাও যেটা ঘটেছে সেটার পুনরাবৃত্তি হোক?
না সেটা চাই না, কিন্তু এই কেসটার কারণে আমার আশেপাশের মানুষজন সমস্যায় পড়ুক সেটাও চাই না।
যারা সমস্যায় পড়ছে তারা নিজের কৃতকর্মের কারণেই পড়ছে। এটা তাদের প্রাপ্য
আশিক একগুয়ে কন্ঠে বলল
তবুও আমি চাইনা। আমি চাই কেসটা তুলে নেওয়া হোক
আরিফ সাহেব হাসলেন। বেশ প্রশ্রয়ের হাসি। ছোটবেলায় আশিক ওনার কোট গায়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে রেগে যাবার বদলে যে রকম হাসি হাসতেন অনেকটা সেই রকম। তারপর বললেন
তুমি যাকে সেভ করতে চাচ্ছ তার মোটিভ জানলে হয়তো তুমি এটা বলতে না
মোটিভ তো একটাই, আমাকে নিয়ে একটা স্ক্যান্ডেল তৈরি করা, এর বেশি তো কিছু না। সেটা তো মিটে গেছে।
ব্যাপারটা কে তুমি যত সহজ ভাবছো ততটা সহজ নয়। সেদিন পুলিশ না এলে কি হতো তোমার কোন ধারণা আছে?
আশিক ভুরু কুচকে তাকিয়ে রইল। আরিফ সাহেব আবারও বললেন
ওরা মোট এগারো জন ছিল, আর তুমি একা। যদি ওরা মীরার কোন ক্ষতি করত?
আমি বেঁচে থাকতে সেটা সম্ভব হতো না। আমি মিরার কিছুই হতে দিতাম না
আর তুমি বেঁচে না থাকলে?
আশিক চমকে উঠলো
ওরা যদি তোমাকে মেরে মিরাকে তুলে নিয়ে যেত?
আশিকের চোয়াল শক্ত হলো। নিজের অজান্তেই হাত মুঠো পাকিয়ে এলো। আরিফ সাহেব আবারো বললেন
– ওদের উপর সেই রকমই ইনস্ট্রাকশনই ছিল। জীবনটা সরল অংক নয় আশিক। ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও।
– কিন্তু বাবা কেউ যদি অনুতপ্ত হয় তাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া উচিত না?
– অবশ্যই উচিত। তাকে বলো নিজের দোষ স্বীকার করে এভিডেন্স দিতে।
– কিন্তু সেটা হলে তো তৌহিদের লোক ওকে ছাড়বে না
– এটা ওর প্রাপ্য। ওর কাছে এখন দুটো অপশন আছে। স্বাভাবিক ভাবে কেস কোর্টে উঠবে এতে ওর যা শাস্তি হবে সেটা ওকে মেনে নিতে হবে। প্রয়োজনে জেল খাটবে, অথবা দোষ স্বীকার করে এভিডেন্স দেবে। পরে যদি তৌহিদ ওর সাথে কোন ঝামেলা করে সেটা ওকে নিজেরই ট্যাকেল করতে হবে। ধরে নিতে পারো এটাই ওর শাস্তি। এখন ও কি করবে সেটা ওকে ঠিক করতে দাও।
রফিক কফি নিয়ে চলে এসেছে। আরিফ সাহেবের মাঝে মাঝে মনে হয় রফিকের কাছে আলাদিনের চেরাগ আছে। এত দ্রুত আলাদিনের জিন ছাড়া আর কেউ কাজ সম্পন্ন করতে পারবেনা। আরিফ সাহেব কফিতে চুমুক দিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। আশিক কিছু একটা মনে পড়েছে এই ভঙ্গিকে বলল
-বাবা আমি এখন কফি খেতে পারব না। আমার খুব জরুরি একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে।
আশিক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সকালে রাসেলের কথাটা শোনার
পর ওর মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। এরপর মিরার সঙ্গে আর একটাও কথা বলেনি ও। মীরা অনেকবার ফোন করেছে, ধরেনি। ও নিশ্চয়ই খুব মন খারাপ করে আছে। এক্ষুনি ওর কাছে না গেলেই ন। আশিক ঘরে ঢুকে মিরাকে দেখে চমকে উঠল।
চলবে………।