বইছে আবার চৈতী হাওয়া পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
664

বইছে আবার চৈতী হাওয়া
২৫.

-চোখে চোখে রাখব মানে?
-বুঝস না? সুন্দরী গার্লফ্রেন্ডরে এত রাতে একজনের অফিসে রাইখা নিশ্চিন্তে ঘুমাস কেমনে?
-বুঝলাম না
-ঐদিন কয়টা পর্যন্ত মীরা আশিকের অফিসে ছিল জানোস?
– না, কয়টা?
– রাত দশটার সময় আমি যায়া দেখি দুজনে একসাথে দাঁড়ায়ে আছে
-ও
– দেখ, তোরে বন্ধু ভাইবা কথাটা বললাম। তুই আবার কিছু মনে করিস না। আমি জানি আশিক খুব ভালো ছেলে। তারপরেও আমার গার্লফ্রেন্ড হলে তো আমি দিতাম না।

রাসেল বিদায় নিয়ে চলে গেল। শুভ আর কিছু বললো না, তবে ওর মনটা খচখচ করতে লাগলো। আশিক আর মীরার মধ্যে একটা সহজ সাবলীল ব্যাপার আছে, এটা শুভ লক্ষ্য করেছে। কেন যেন কিছু ভালো লাগছে না। শুভ ফোন বের করে মীরাকে ফোন করল। বন্ধ দেখাচ্ছে। বাধ্য হয়ে মেসেজ করলো। কোন রিপ্লাই এলোনা।

লাইব্রেরিতেও মন বসাতে পারলো না শুভ। বাধ্য হয়ে উঠে গিয়ে সেকেন্ড ইয়ারের রুমে খুঁজে এলো। রুম ফাঁকা, কেউ নেই। করিডোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ছেলেমেয়ে গল্প করছে। শুভ একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো আজকে ওদের পরীক্ষা ছিল। ক্লাস আর নেই। মীরা পরীক্ষা শেষ করে চলে গেছে। শুভর মেজাজ খারাপ হলো। একবার একটু বলে যেতে পারলো না।

মীরার পরীক্ষা ভালো হয়নি; যদিও এটা নিয়ে ওর মন খারাপ নয়; কারণ দারুণ মন ভালো করার মতন দুটো ঘটনা ঘটেছে। ছোট খালা ফোন করে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন; তারপর কি হয়েছে ও জানে না, তবে সুমনার কাছ থেকে শুনেছে বড় চাচা সৌরভের বিয়েতে মত দিয়েছেন। আর দ্বিতীয় ঘটনাটা হলো মীরা একটা বড় অর্ডার পেয়েছে। একটা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য তিরিশটা সেট তৈরি করে দিতে হবে। সবাই একই রকম হলুদ আর লাল পাড়ের শাড়ি পরবে। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে সেট তৈরি করে দিতে হবে। ওরা কয়েকটা স্যাম্পল দেখতে চেয়েছে।

মিরা একটু বিপাকে পড়েছে। কয়েকটা ডিজাইন তৈরি করে দেখাতে হবে। এর মধ্যে যেটা সিলেক্ট হবে সেটাই তৈরি করতে হবে। মীরা ঘড়ি দেখল। আড়াইটা বাজে। এখনই বেরোতে পারলে নিউমার্কেট থেকে একটু কেনাকাটা করে তারপর টিউশনিতে যেতে পারত। কিভাবে কি করবে বুঝতে পারছে না। কারো সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে ভালো হতো। সাধারণত হলের কারো সাথে ও এসব বিষয়ে কথা বলে না। সবাই ঠিক সহজ ভাবে নিতে পারে না ব্যাপারটা।

প্রথম দিকে যখন শখের বসে এই কাজগুলো করতো অনেকেই আগ্রহ দেখিয়েছে। ওকে বাণিজ্যিকভাবে কাজগুলো করার পরামর্শ কেউ দেয়নি, একমাত্র টুম্পাই একদিন চোটপাট শুরু করেছিল। ধমকা ধমকি করে বলেছিল আর কতদিন ফ্রি ফ্রি সবাইকে সার্ভিস দিবি? আজ টুম্পা থাকলে ভালো হতো। একমাত্র ওর সঙ্গেই এগুলো নিয়ে একটু কথা বলে মীরা ; কিন্তু ওর একটা দাওয়াত থাকায় তাড়াতাড়ি পরীক্ষা শেষ করে চলে গেছে।

মীরা দ্রুত তৈরি হয়ে নিউমার্কেটের রিক্সা নিয়ে নিল। কেনাকাটা করতে বেশি সময় লাগলো না, মোটামুটি মাথার মধ্যে ছিল কি কি লাগবে সেই মতই কিনে নিল। চারটা স্যাম্পল তৈরি করবে ঠিক করল। তারপর ছবি তুলে পাঠিয়ে দেবে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। তিরিশটা সেট করতে বেশ অনেকগুলো টাকা লাগবে। জমানো টাকা যদিও আছে ওর কাছে, তবু কেমন একটু ভয় ভয় করছে। ঠিক কিভাবে কি করলে ভালো হয় বুঝতে পারছে না। কারো সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে পারলে ভালো হতো। একবার আশিক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারলে কাজ হতো। উনি এখন কোথায় আছে কে জানে? কদিন ইউনিভার্সিটিতেও দেখেনি ওকে মীরা। আশিককে ফোন করার জন্য মোবাইল বের করে দেখল ফোনে চার্জ নেই। এই ফোনটা আর ব্যবহার করা যাবে না, অনেক পুরনো হয়ে গেছে। একেবারেই চার্জ থাকে না।

মীরার স্টুডেন্টের বাসা শংকর। ভেবেছিল ওখানে গিয়ে ফোনের চার্জ দেবে তারপর আশিককে একটা ফোন করবে। কিন্তু স্টুডেন্টের বাসায় গিয়ে জানতে পারল আজকে ওর একটা দাওয়াত আছে তাই তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। মিরা দ্রুত পড়ানো শেষ করে দিল। তাড়াহুড়ায় আর মোবাইল চার্জ করা হলো না। একবার আশিকের অফিস থেকে ঘুরে আসা যায়, যদি তাকে পাওয়া যায়।

মীরা ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠলো। যদি আশিক ভাই না থাকে ? যদি অফিস তালা বন্ধ থাকে? তাহলে আর কি করবে, ফিরা যাবে। সদর দরজা খোলাই ছিল। মীরা আস্তে করে ঢুকে পড়ল। সামনের ঘরটাতে কেউ নেই।ভেতরের ঘরটাতেও কাউকে দেখা গেল না। কি আশ্চর্য! অফিস খোলা রেখে কোথায় চলে গেল? মিরা একবার রান্না ঘরে উঁকি দিল। সেখানেও কেউ নেই। আর একটু এগিয়ে দেখল ছাদ বারান্দার দরজাটা খোলা। আশিককে দেখা যাচ্ছে, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, দূরে লেকের দিকে তাকিয়ে । মীরা কাছাকাছি এসে আস্তে করে ডাকলো
– আশিক ভাই
আশিক চমকে পেছন ফিরে তাকালো। মীরা হতভম্ব হয়ে গেল। আশিক ভাইয়ের চোখ ভেজা। ওর হাতে একটা কিছু ছিল। মিরাকে দেখে চট করে সেটা লুকিয়ে ফেলল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
-মীরা , তুমি এখানে?
মীরা মাথা নিচু করে ফেললো। ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছে, বোধহয় আশিক ভাইয়ের কোন কারনে মন খারাপ ছিল। এরকম অবস্থায় এখানে আসাটা উচিত হয়নি। মীরা মাথা নিচু করেই বলল
-আমি আজকে যাই। হুট করে এসে বোধহয় আপনাকে বিরক্ত করে ফেললাম।
মীরা আর দাঁড়ালো না। কথা শেষ করে উল্টো দিকে ফিরে হাঁটা ধরল
– মীরা দাঁড়াও
মীরা দাঁড়ালো তবে পেছন ফিরে তাকালো না।
আশিক হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল
-এক কাপ চা বানিয়ে দেবে। খুব চা খেতে ইচ্ছা করছে।
মীরা পেছন ফিরে হেসে ফেলল। হাসছে আশিক ও। ওরা দুজনই জানে যে একে অপরকে সহজ করতে চাইছে। মীরা বলল
-এক্ষুনি দিচ্ছি
মীরা চলে যাবার পর আশিক ওর ওয়ালেটটা পকেটে পুরে ফেলল। ওটাতে ওর মায়ের একটা ছবি ছিল। সাধারণত নিচের দিকে খুব লুকিয়ে রাখে ও।

বছরের এই সময়টা এলে মায়ের কথা অসম্ভব মনে পড়ে। এরকমই পৌষের এক রাতে মা চলে গিয়েছিল। মায়ের মৃত্যুটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি ও। বেশ অনেকদিন অসুস্থ ছিল তারপর। এইরকম শীতের ঝকঝকে বিকেলে যখন সবার মন ভালো হয়ে যায় তখন ও চোখ মেলতে পারে না। মাথার ভেতর ভীষণ যন্ত্রণা হয়।

মিরা চা নিয়ে চলে এসেছে। আশিকের সামনে রেলিং এর উপর কাপটা রাখল মীরা। আজকের বিকেলটা খুব ঝকঝকে। চারিদিকে আসরের আজান দিচ্ছে। মীরা ওড়নার আঁচল মাথায় তুলে দিয়েছে। আশিক আড়চোখে একবার তাকালো। কি অদ্ভুত মিষ্টি লাগছে ওকে। কেমন বউ বউ লাগছে। আচ্ছা, মিরাকে বউ সাজলে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর লাগবে। আশিক বুকের ভিতর একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। গত দুদিন ধরে ও কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। ক্লাসে যেতে ইচ্ছা করছে না, পড়াশোনা ভালো লাগছে না, প্রিয় বইগুলো ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে না, মাথায় কোন কবিতা ও আসছে না। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। ছোটবেলায় ও সব কিছু মায়ের সঙ্গে শেয়ার করত। এখন যদি মা বেঁচে থাকতো, জানলে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেতো। কেন ওর সঙ্গেই এমন হলো? এই পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে কেন মীরাকেই ওর ভালো লাগলো? কেন সব সময় ওর সঙ্গেই এমন হয়? ওর ভালবাসার মানুষগুলো ওর কাছ থেকে দূরে সরে যায়। কেউ কি জানে কেন এমন হয়? বোধ হয় না। কেউ জানে না।

কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।

জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।
লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।

চলবে………

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
২৬.

-আশিক ভাই
আশিকের ধ্যান ভাঙলো। কবিতার জগৎ থেকে বেরিয়ে আনমনে তাকালো। বলল
-হ্যাঁ, বলো মিরা
-আমি আজকে যাই আশিক ভাই
– তুই কি আমার কাছে কোন কাজে এসেছিলে?
– না তেমন জরুরী কিছু না। অন্য সময় বললে ও হবে
আশিকের একটু খারাপ লাগলো, হয়তো মীরা কোন কাজে এসেছিল কিন্তু এখন অস্বস্তি বোধ করছে। আশিক অনেকটাই সামলে উঠেছে। খুব অদ্ভুত কারণে কেন যেন মীরা আসাতে ওর খুব ভালো লাগছে। মন খারাপ ভাবটা কেটে গেছে। আশিক কৌতুহলি হয়ে বলল
– তোমার পেজের খবর কি মিরা? নতুন কোন অর্ডার পেয়েছো?
– আসলে সেটা বলতেই এসেছিলাম। একটা বেশ বড় অর্ডার পেয়েছি। কিভাবে কি করব বুঝতে পারছি না
– কিরকম অর্ডার?
মিরা অর্ডারের ব্যাপারটা বলল; তারপর বলল
-কেমন একটু ভয় ভয় লাগছে, এত বড় অর্ডার। কাজগুলো করতে অনেক সময় লাগবে। এত কষ্ট করার পর, কোন কারনে যদি ক্যান্সেল হয়ে যায়?
-একটু রিস্কতো আছেই। আমি বলব যে, তুমি ডিজাইনটা একটু ভালো করে কর; তারপর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করো। ডিজাইন ফাইনাল হলে তুমি এস্টিমেটেড কস্ট দাও আর ওদেরকে বল ফিফটি পার্সেন্ট এডভান্স করতে।
– এডভান্স করতে বলব? মীরা অবাক হয়ে জানতে চাইল
-দেখো এতগুলো জিনিস তৈরি করতে তোমার যথেষ্ট খরচ হবে। খরচের চেয়েও বড় কথা তোমার অনেকখানি সময় নষ্ট হবে। এরপর যদি কোন কারনে অর্ডারটা ক্যান্সেল হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে এতগুলো আইডেন্টিক্যাল সেট নিয়ে তুমি কি করবে?
– উনারা যদি রাজি না হয়?
– বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই রাজি হবে। তুমি তো আর এডভান্স হিসেবে চাইবে না। তুমি বলবে তোমার মেটেরিয়াল কিনতে টাকা লাগবে। তুমি স্টুডেন্ট। এতে করে ওদেরও একটা লাইবেলিটি আসবে।

মীরা বেশ আশ্বস্ত বোধ করল। বলল
-আমি কয়েকটা ডিজাইন ঠিক করে রেখেছি কোনটা ফাইনাল করবো বুঝতে পারছি না। তারপর খুব আবদারের গলায় বলল
-আপনাকে একটু দেখাই?
ওর বলার ধরন দেখে আশিক হেসে ফেলল। বেচারা বোধহয় কারো সঙ্গে এগুলো শেয়ার করতে পারেনা; তা নাহলে এসব মেয়েদের গয়নার ডিজাইন ওকে দেখাচ্ছে? আশিক হাসতে হাসতে বলল
-দেখাও
– এক মিনিট ফোনটা নিয়ে আসছি।
চা বানাতে যাবার সময় ওর ফোনটা চার্জে দিয়েছিল। দৌড়ে নিয়ে এসে তিন-চারটা ছবি দেখালো। আশিক বিশেষ মনোযোগ দিতে পারল না। কেমন যেন আচ্ছন্ন লাগছে। মীরা খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার সেই মিষ্টি গন্ধটা পাচ্ছে ও। প্রসাধনের গন্ধ, সাবানের কিংবা তেলের গন্ধ ; অথবা হয়তো ওর শরীরের গন্ধ। আশিক নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
-আমাকে একটু বের হতে হবে
মীরা একটু অপ্রস্তুত বোধ করল। তাড়াতাড়ি করে বলল
-আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। আপনাকে অনেক বিরক্ত করলাম। আসলে এগুলো নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারি না তো, তাই….
– এত অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই। কোন সাহায্য লাগলে আমাকে বলবে
– থ্যাঙ্ক ইউ

অফিস তালা বন্ধ করে নিচে নেমে এলো দুজন। আশিক বলল
-তুমি কোথায় যাবে? হলে?
-না একটু নিউ মার্কেটে যাব। কয়েকটা জিনিস কিনতে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি কোথায় যাবেন?
আশিকের আসলেই কোথাও যাবার নেই। মিরাকে এড়ানোর জন্য বলেছিল। হুট করে কিছু মাথায় আসছে না।
– আজিমপুরে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাব
– ও, তাহলে তো ওই দিকেই। চলেন একসঙ্গে যাই।
আশিক আর কোন অজুহাত খুঁজে পেল না। অগত্যা একটা রিকশা নিয়ে নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিল দুজন। অনেকক্ষণ দুজনের কেউ কোন কথা বলল না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে নিয়নের আলো জ্বলে উঠেছে। নিউ মার্কেট প্রায় চলে এসেছে। আশিকের একটু মন খারাপ লাগছে, আর হয়তো এভাবে কখনো মীরার সঙ্গে রিক্সায় ওঠা হবে না। না হলেই ভালো, কি দরকার অহেতুক মায়া বাড়িয়ে। মীরা হঠাৎ করেই বলল
– আমার মন খারাপ হলে আমি কেনাকাটা করি এতে মন খুব দ্রুত ভালো হয়ে যায়।
– তাই নাকি?
-আপনিও ট্রাই করে দেখতে পারেন। চলুন আপনাকে একটা দোকানে নিয়ে যাই। আমি ওখানে প্রায়ই যাই।

মীরা ওকে একটা বইয়ের দোকানে নিয়ে গেল। এই দোকানটায় আশিক প্রায়ই আসে। দোকানিরা ওকে ভালই চেনে। দেখেই সালাম দিল। জানতে চাইলে কি লাগবে। আশিক একটা হাত তুলে বুঝিয়ে দিল আজকে কিছু নেবে না। মীরা ঝটপট দুটো বই কিনে ফেলল। তারপর বলল
-আপনি কিছু কিনবেন?
-ঠিক আছে
-তাহলে চলেন যাই
বাইরে বেরিয়ে একটা বই আশিকের হাতে দিয়ে বলল
-এটা আপনার জন্য
-তোমারও মন খারাপ নাকি
– না আমার মন খারাপ না। আমার মন খুবই ভালো; তবে মাঝে মাঝে মন ভাল থাকলেও বই কিনলে আরো ভালো হয়ে যায়।
মীরা হাসছে , হাসছে আশিক নিজেও। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল সময়টা যদি এখানেই থমকে যেত।

আশিকের চমক ভাঙ্গল ফোনের রিংটোন এর শব্দে। মীরার ফোন বাজছে মীরা হাতের ব্যাগ পত্র গুছিয়ে ফোনটা কানে গুঁজে বলল
– হ্যাঁ শুভ বলো
– তুমি কোথায় মীরা?
-নিউমার্কেটে, কেন?
– একা?
– না আশিক ভাই আছেন সঙ্গে
শুভর চোয়াল শক্ত হলো , তবে ও সেটা প্রকাশ করল না ,আন্তরিক কণ্ঠে বললো
– আমিও এখানেই আছি। পেছন ফিরে দেখো

মীরা পেছন ফিরে অবাক হয়ে গেল। শুভকে রিকোয়েস্ট করলেও ও এখানে আসতে চায় না। শুভ হাসতে হাসতে হাত নাড়ছে। মীরার মুখে একরাশ হাসি ফুটে উঠলো। আজকের দিনটা সত্যিই খুব ভালো। শুভ এগিয়ে এসে আশিকের সঙ্গে হাত মেলালো; তারপর বলল
-কিরে দোস্ত কি খবর?
– এইতো, এখানে একটা কাজে আসছিলাম। তোরা থাক আমি গেলাম।
আশিক এগিয়ে গেল। মীরার কাছ থেকে বিদায় ও নিল না। মীরার একটু খারাপ লাগলো।কি হতো একবার বলে গেলে।শুভ বলল
-চলো কোথাও বসি
-আচ্ছা

মার্কেট থেকে বেরিয়ে আশিক আর রিক্সা নিলো না, হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে পড়ল। আজ আবার একটু শীত পড়েছে। শীতের সাথে বিষন্নতার কি একটা গভীর সম্পর্ক আছে? আছে বোধ হয়। শীতের রাতে মন খারাপ হলে তা যেন আরো প্রকট হয়ে যায়। আশিক আরে অন্ধকারে হাটতে হাঁটতে একা একাই বললো

মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন, মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি, কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়

মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কী আছে অথবা কী ছিল
আমার কী আছে অথবা কী ছিল
ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই

চলবে…..

বইছে আবার চৈতি হাওয়া
২৭.

-আশিকের সংগে তোমার কোথায় দেখা হল?
-আমি উনার অফিসে গিয়েছিলাম
-আজকে তো তোমাদের মিটিং ছিলো না?
-না আমি অন্য একটা কাজে গিয়েছিলাম।
-কি কাজ? শুভ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল।
-আমার পেজ-এর একটা অর্ডার নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। কি হয়েছে জানো, একটা খুব বড় অর্ডার পেয়েছি। একটা অনুষ্ঠানে….
– ফোনে কথা বলতে পারতে!
– চার্জ ছিল না।
– আচ্ছা যাই হোক, তোমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা আছে।

মীরা একটু থমকে গেল; ও খুব আগ্রহ নিয়ে অর্ডারের ব্যাপারটা শুভকে বলতে চাইছিল, কিন্তু শুভ পাত্তাই দিল না। তার ভালো লাগা নিয়ে কেন যেন শুভর কোন মাথা ব্যথা নেই। মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– বল কি জরুরী কথা।
-দাঁড়াও আগে কিছু খাবার অর্ডার করি।
শুভ অর্ডার দেবার জন্য উঠে গেল। মার্কেট থেকে বেরোনোর পরে ওরা একটা রেস্টুরেন্টে বসেছে। মীরার অবশ্য ওখানেই ভালো লাগছিল; আলো ঝলমল মার্কেটে ফুটপাতে দোকান, কত রকমারি জিনিস বিক্রি করছে। পাশে বইয়ের দোকান; কেমন ঘোর লাগা অনুভূতি! এই সময় যদি খুব প্রিয়জন কাছাকাছি থাকে, তাহলে এই ঘোর যেন আর কাটতেই চায় না। কিন্তু শুভর এসব ভালো লাগেনা; ও নিরিবিলিতে কোন বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে বসতে চায় সবসময়।

মীরা মোবাইলে ওর পেজের আপডেট চেক করছিল; শুভ অর্ডার করে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে মীরাকে দেখছিল। মীরা কি একটু বদলে যাচ্ছে?

আজকের পুরো ঘটনাটা শুভ আগে থেকেই জানে; তারপরও মিরাকে এদিক ওদিককার প্রশ্ন করে একটু ঝালিয়ে নিচ্ছিল। দেখতে চাইছিল ও সত্যি বলছে, নাকি কিছু লুকাতে চাইছে।

সন্ধ্যের একটু আগে যখন লাইব্রেরী থেকে উঠতে যাচ্ছিল শুভ, ঠিক তখনই রাসেল ফোন করে জানিয়েছিল যে রাইফেলস স্কয়ারের সামনে আশিক আর মিরাকে রিকশায় দেখা গেছে। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়েছিল শুভর। ফোন বন্ধ করে আশিকের সঙ্গে রিক্সা করে কোথায় যাচ্ছে ও আর কেনই বা যাচ্ছে? অন্য একজনকে দিয়ে আশিককে ফোন করিয়ে জানতে পেরেছিল যে নিউমার্কেটে আছে; তাই সোজা চলে এসেছিল। বইয়ের দোকানগুলোর কাছে একটু খুঁজতেই পেয়ে গেল। আশিক অবশ্য বুদ্ধিমান ছেলে, ধরা খেয়ে সটকে পড়েছে নিশ্চয়ই। তবে শুভ ভেবেছিল মীরা হয়তো মিথ্যা কথা বলবে। ওদের ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। যাই হোক মিরাকে যে করেই হোক ওর সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।

শুভ ফিরে এসে বলল
-কি দেখছো?
– তেমন কিছু না।
এবার ইচ্ছা করেই মীরা ওর পেজের ব্যাপারে কিছু বলল না। ড্রিংকস আর স্প্রিং রোল দিয়ে গেছে মিরা আলতো করে পানীয়র গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল
– কিছু বলবে বলছিলে
– হ্যাঁ আমার স্কলারশিপটা কনফার্ম হয়ে গেছে
– বাহ! কংগ্রাচুলেশনস। তো কবে যাচ্ছ?
– যাচ্ছো না, বলো যাচ্ছি
– মানে?
– তোমাকে তো আগেই বলেছি, তোমাকে নিয়েই যাবো। তুমি তাড়াতাড়ি পরীক্ষাটা দিয়ে ফেলো।
– কি পরীক্ষা?
– আই ই এল টি এস
– তারপর, পরীক্ষা দিয়ে কি করব?
– তারপর ভিসার জন্য এপ্লাই করব।
– তোমার প্ল্যানটা ঠিক কি শুভ?
– দেখো, আমি প্ল্যান করেছিলাম আমার থিসিস শেষ করে তারপর স্কলারশিপের জন্য এপ্লাই করব; কিন্তু তুমি তো জানো সিনিয়র একজনের সঙ্গে কয়েকটা রিসার্চ প্রজেক্টে আমি কাজ করেছি। এই সুবাদে আমার দুটো পাবলিকেশন ও বের হয়েছে। তাই যখন সুযোগ পেলাম তখন আমি এপ্লাই করে ফেললাম এবং লাকিলি স্কলারশিপটাও হয়ে গেল। এখন আর সমস্যা নেই। একবারে ওখানে গিয়েই মাস্টার্স করব তারপর পিএইচডি।
-ও আচ্ছা। তাহলে তুমি বাসায় কথা বলে ফেলেছ?
– বাসায়?
– হ্যাঁ, তোমার বাসায় কথা বলোনি?
শুভ একটু আমতা আমতা করে বলল
– না , মানে বাসায় এখনও কথা বলিনি
– তাহলে কিভাবে হবে?
– আমরা নিজেরা বিয়ে করে চলে যাই, তারপর ওনাদের জানালেই হবে।
– আর আমি আমার বাসায় কি বলবো?
– সেটা তুই চিন্তা করে দেখো। তোমার বাসার লোকজনের তো খুশিই হওয়ার কথা। তোমার জন্য এর থেকে ভাল পাত্র তারা কোথায় পাবে?
মীরার কপালে ভাঁজ পড়ল
– ভালো পাত্র বলতে তুমি কি বুঝাচ্ছো?
– মানে ধরো সবাই তো এরকম ছেলেই চায়। ভালো স্টুডেন্ট, বাইরে সেটেল
– সেটা ঠিক আছে, কিন্তু ভাল পাত্রকে তো আমার বাসায় প্রপোজাল পাঠাতে হবে। তার সঙ্গে পালিয়ে গেলে নিশ্চয়ই আমার বাসার লোকজন খুশি হবে না। আর তাছাড়া আমার পড়াশোনার কি হবে?
– তুমি ওখানে কোন একটা কোর্স করে নিও।
– কোন একটা কোর্স ? সিরিয়াসলি ? তোমাকে কয়েকটা কথা খুব ভালো করে বুঝিয়ে দেই , আমার বড় চাচা অনেক বিশ্বাস করে আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন; এভাবে পালিয়ে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তুমি যদি তোমার ফ্যামিলিকে জানিয়ে আমাদের বাসায় প্রপোজাল পাঠাতে পারো তাহলেই কিছু হবে, তা না হলে না।
– এটা কোনদিনও হবে না
– কেন?
– এই সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না? তোমাদের যে ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড তাদের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে আমার বাবা-মা কখনোই রাজি হবে না।
– এক মিনিট, আমাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড বলতে কি বুঝাচ্ছো তুমি?
– দেখো আমি খারাপ ভাবে বলতে চাই না ; কিন্তু এটাই রিয়ালিটি।
– কি রিয়ালিটি?
– তোমার বাবা নেই। তুমি সাধারন একটা মফস্বলের মেয়ে; তাছাড়া তোমার চাচা একটা দোকানদার…
মীরা আর শুনতে পারল না। উঠে দাঁড়িয়ে থমথমে গলায় বললো

-এসব তোমার আমাকে প্রপোজ করার আগে চিন্তা করা উচিত ছিল। একটা দোকানদারের মেয়েকে যদি বিয়ে করতে না পারো তাহলে তার সঙ্গে প্রেম করতে যাওয়া তোমার উচিত হয়নি।

শুভ যেন সম্বিত ফিরে পেল। মীরা আশিকের সঙ্গে আছে শোনার পর থেকেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে ছিল। এখানে এসে দুজনকে একসঙ্গে দেখে আরো মেজাজ খারাপ হয়েছে। তারপরেও মাথা ঠান্ডা রেখে আজকে মিরাকে রাজি করাবে ঠিক করেছিল। কি থেকে যে কি বলে ফেলল। এখন আর কথা ফিরিয়ে নেওয়া ও সম্ভব না।
ওয়েটার খাবার সার্ভ করছে। শুভ সামনের দিকে তাকালো। মীরা গেটের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। একগাদা ধুমায়িত খাবার সামনে নিয়ে শুভ বোকার মতন বসে রইলো।

মিরা রিক্সার হুডটা শক্ত করে ধরে চোখে ওড়নার আঁচল চেপে ধরেছে। কি অসহ্যরকম কষ্ট যে হচ্ছে। একটা দিন এত সুন্দরভাবে শুরু হয়ে এত বিচ্ছিরিভাবে শেষ হয়ে যায় কেন ?

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে