বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৪৫.
আরিফ সাহেব তাকিয়ে আছেন। মীরা ব্যস্ত ভঙ্গিতে সকলের প্লেতে লুচি তুলে দিচ্ছে। লুচি গুলো আগে থেকে ভাজা হয়নি। মীরা গরম গরম ভেজে রান্নাঘর থেকে এনে সবার প্লেটে দিচ্ছে। লুচির সঙ্গে আলুর দম। ভাজা জিরা আর তেঁতুলের ক্বাথ দেয়াতে অন্যরকম স্বাদ এসেছে, কিন্তু সেই স্বাদ মুখে লাগছেনা আরিফ সাহেবের। উনি এক দৃষ্টিতে মিরাকে দেখছেন। মীরা খুব যত্ন করে আশিককে খাবার দিচ্ছে। তবে কি ওদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে? কিংবা এমনও হতে পারে আশিক অসুস্থ বলে এত যত্ন করছে। উনি নিশ্চিত বিয়ের রাতে মীরা ওকে কিছু বলেছে, যে কারণে পরদিন থেকেই আশিক বাইরে রাত কাটাচ্ছে। উনি নিজেও তো তাই করেছিলেন। বিয়ের দিন রাতে আসিয়ার সঙ্গে কি কুৎসিত ব্যবহারটাই না করেছিলেন। ওনার সঙ্গে যা ঘটেছিল তাতে আসিয়ারতো কোন হাত ছিল না, তারপরও উনি তাকে সহ্য করতে পারতেন না। সেই তুলনায় মীরার ঘৃণা থাকাটা তো স্বাভাবিক। আশিকের কারণেই ওর সম্পর্কটা ভেঙে গেছে।
এই মেয়েটার মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পান তিনি। যখনই দেখতে পান মনে মনে আতঙ্কে শিউরে ওঠেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন তার ছেলের জীবনটা যেন ওর মায়ের মতন না হয়।
– আপনাকে আর কিছু দেব বাবা? আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না
আরিফ সাহেব চমক ভেঙে তাকালেন।
– আর কিছু লাগবে না মা। তুমিও আমাদের সঙ্গে বসে যাও।
– আমি আর রোজি পরে খাচ্ছি।
আরিফ সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। খাবারে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলেন। অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার। অনেক বছর পর এ ধরনের পদ রান্না হয়েছে। আসিয়া বেঁচে থাকতে খুব করতো এসব। আশিকের খুব প্রিয় ছিল। মীরা কি জেনে শুনেই করেছে? না কি এটা কাকতালীয় ব্যাপার? আরিফ সাহেব আবারও মীরার দিকে তাকালেন। খাবারের মাঝখানেই মীরা আশিককে ওষুধ খাইয়ে দিচ্ছে। আশিকের হাতে আলুর দমের ঝোল, তাই মিরা ওষুধ মুখে তুলে দিচ্ছে। আশিক বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অর্থাৎ এটা স্বাভাবিক নয়। আশিকের দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতর একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণা অনুভব করলেন আরিফ সাহেব। মৃত্যুর কিছুদিন আগে আসিয়া খুব অসুস্থ ছিল। তখন এভাবেই তার যত্ন করার চেষ্টা করতেন তিনি। সে সময় ঠিক এরকমই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত আসিয়া। সেই দৃষ্টিতে কি বিস্ময়ের সঙ্গে আরও কিছু মিশে থাকতো? জানা হয়নি, আর জানার কোন উপায়ও নেই। আচ্ছা আশিক কি মিরাকে আগে থেকেই ভালোবাসতো? মেয়েটা ভালো। আশিকের ওকে ভালো লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। অবশ্য ভালো খারাপে কিছু আসে যায় না। ভালো তো আসিয়াও ছিল। কই তাকে তো ভালো লাগেনি বরং এমন একজনকে ভালো লেগেছিল যে তার ভালোবাসা পাওয়ার কোন যোগ্যতাই রাখে না।
কি এমন বয়স ছিল তখন তার। ওদের মতই, বা ওদের থেকে কমই হবে। তখন আরিফ সাহেব কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। দুই ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রামে। তেমন একটা আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় বোনের ছেলেমেয়েরা ওনাদের বাড়িতেই থাকতো। এটা অবশ্য নতুন কিছু ছিল না। আরিফ সাহেবের বাবা ছিলেন দিলদরিয়া মানুষ। কারো কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না, অথচ তার নিজের বোন মারা গেল অল্প বয়সে। বোনের একমাত্র মেয়ে আসিয়া ছোটবেলা থেকেই তাদের বাড়িতেই মানুষ। ভীষণ রকমের লক্ষীপনা আর সংসারী ছিল মেয়েটা। সবসময় মায়ের সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করতো। মামা বাড়িতে বড় হওয়া, আর দশটা অনাথ মেয়ের মতন জীবন ছিল না আসিয়ার। মামা-মামী তাকে নিজের সন্তানের মতন স্নেহ করতেন। আরিফ সাহেব অবশ্য কখনো এগুলি খেয়াল করতেন না। এইচএসসির পর তার স্বপ্ন ছিল ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হবার। চেষ্টা চরিত্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চান্সও পেলেন, কিন্তু ঢাকায় থাকার কোন জায়গা ছিল না তার। এখনকার মতন এত হোস্টেল ছিল না সে সময়। বাবা তার এক ছাত্রকে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন যেন একটু থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সেই ছাত্রের বাসায় যেয়ে আরিফ সাহেব হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। গুলশানের বিশাল বাড়ি, যদিও আরিফ সাহেবের জায়গা হয়েছিল মুলবাড়ির বাইরের দিকের কোয়ার্টারে। ড্রাইভারের সঙ্গে রুম শেয়ার করে থাকতে হতো। সেই বয়স থেকেই আরিফ ভীষণ বাস্তববাদী আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তিন জোড়া মোটে শার্ট প্যান্ট ছিল তার। সেটাই ধুয়ে ইস্ত্রী করে ঝকঝকে তকতকে করে পরে যেত সবসময়। এমনিতেই আরিফ দেখতে সুন্দর, কথাবার্তায় ও খুব স্মার্ট। অনেক মেয়ে মুগ্ধ হতো তাকে দেখে, কিন্তু সেই সময়কার মেয়েরা হুটহাট ছেলেদের সাথে এত মিশতো না। আগ বাড়িয়ে মুগ্ধতা ও প্রকাশ করত না। এ নিয়ে অবশ্য তার কোন অনুশোচনা ছিল না। ওর চোখে তখন বড় হবার স্বপ্ন। এই স্বপ্নের মধ্যেই আরেকটা স্বপ্ন যোগ হলো, যেদিন প্রথম সিলভিয়াকে দেখল।
একদিন বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখ পড়লো ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা মিষ্টি মুখ। চারিদিকে গোলাপি বাগান বিলাসের ঝাড়, মাঝখানে যেন একটা ছোট্ট পরী। আরিফের মাথা ঘুরে গিয়েছিল। একজন মানুষ এত সুন্দর কি করে হতে পারে? কেমন পুতুল পুতুল তুলতুলে বেড়ালের মতন। কিন্তু আরিফ নিজের সীমাবদ্ধতা জানে। এই ধরনের মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব কিংবা প্রেম তো দূরে থাকুক কথা বলতেও যথেষ্ট যোগ্যতা লাগে। আরিফ সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছিল।
সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হবার পর সিলভিয়ার বাবা একদিন নিজে থেকে এসেই বলেছিলেন
– তুমি তো কোন কোচিং না করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে গেলে শুনেছি। সিলভিয়া এবার ভর্তি পরীক্ষা দেবে। ওকে একটু দেখিয়ে দিও তো।
সেই থেকে শুরু হয়েছিল আরিফের অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার। আরিফ সাহায্য করেছিল আন্তরিকভাবেই। সেই সময়ে ওর চোখে মুগ্ধতা দেখেছিল আরিফ। দিনকে দিন সেই মুগ্ধতা বাড়তে দেখেছে ও। তবু সযত্নে এড়িয়ে গেছে। অনেকবার পড়ার ছলে ওর কাছে আসার চেষ্টা করেছে সিলভিয়া তবু আরিফ নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল।
সেবার ঈদের ছুটিতে সবাই বাড়ি গিয়েছিল। আরিফ পরীক্ষার কারণে যেতে পারেনি। ঈদের আগের দিন রাতে আরিফ ঘুমোতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেই সময় হুট করে সিলভিয়া ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছিল। আজ এত বছর পর মনে হয় যদি তার জীবনে সেই রাতটা না আসতো তাহলে আজ তার জীবনটা অন্যরকম হতো।
মীরা বিকেলের নাস্তা তৈরি করেছে পিয়াজু ঘুঘনি আর ডালপুরি। কাল রাতে আশিক খেতে চেয়েছিল। নিচে নেমে রোজিনাকে বলেছিল আটা মাখাতে আর ডাল সিদ্ধ দিতে কিছুটা ভিজিয়েও রাখতে। রোজিনা হাসতে হাসতে বলেছিল
– কেন ভাবি? ভাইজান ডালপুরি খাইতে চাইছে?
– হ্যাঁ, তুমি কি করে বুঝলে?
– ভাইজানের জ্বর আসলে এইসব খাইতে চায়। ফ্রিজে ফ্রোজেন পুরী আছে। ভাইজা দেই?
– না আমি বানাচ্ছি। বেশি সময় লাগবে না। তুমি একটু সাহায্য করলেই হবে।
রাতে আর খাবার তৈরি করা হয়নি। আশিক ঘুমিয়ে পড়েছিল। মিরা ঠিক করেছিল পরদিন বিকেল বেলা বানাবে।
রোজিনা খুবই চটপটে আর কাজের। মীরার পক্ষে একা এত কিছু বানানো সম্ভব হতো না। মীরা এই খাবারগুলো বানানো শিখেছে ওর বড় চাচীর কাছ থেকে। বড় চাচী এই সমস্ত খাবারগুলি অসাধারণ বানায়। এমনিতে বড় চাচি ওদের দেখতে পারেনা, মায়ের সঙ্গে নিত্যদিন ঝামেলা লেগে থাকে। কিন্তু কোন কিছু শেখানোর ব্যাপারে ভদ্র মহিলা ভীষণ রকমের উদার । মীরা রান্নাবান্নার হাতে খড়ি তার কাছেই। বাড়ির সবাই তার খাবারের স্বদে মুগ্ধ। এটাও আরেকটা কারণ, যে মা বড় চাচীকে দেখতে পারে না। বাবা কখনো মায়ের রান্না খেয়ে তৃপ্ত হতো না। সারাক্ষণ বড় চাচির সঙ্গে তুলনা করত। একমাত্র বড় চাচাই বলতেন
– খাবার হল বেঁচে থাকার জন্য। আমাদের নবীজি অত্যন্ত অল্প আহার করতেন। তার প্রিয় খাবার ছিল খেজুর এবং দুধ। এসব বাড়াবাড়ির কোন দরকার নাই। সাধারণ খাবার রান্না করো।
কিন্তু বাড়ি ভর্তি বাচ্চাদের যন্ত্রণায় তাকে আবারো এসব বানাতে হতো। এবং এটা তিনি আনন্দের সাথেই করতেন। মিরা ও আনন্দের সাথেই করে। তার ও খুব ভালো লাগে এসব নতুন নতুন মুখরোচক নাস্তা তৈরি করতে।
এই বাড়িতে খুব সুন্দর সুন্দর সিরামিকের প্লেট বাকি মগ আছে। কেউ তেমন একটা ব্যবহার করে না। মীরা খাবারগুলো সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়ে রোজিনা কে বলল
– যাও তোমার ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসো
রোজিনা দৌড়ে গেল। ফিরেও এলো দ্রুতই। মিরা ওকে চায়ের জল চাপাতে বলে পিয়াজু গুলো ভেজে ফেললো। চায়ের জল ফুটে গেছে। মীরা উঁকি দিয়ে দেখল আশিক এখনো আসেনি। মিরা কপালের ঘাম মুছে রোজিনাকে আবারও, আশিক আর আফসিনকে ডাকতে পাঠালো। আফসিনকে ডাকতে হলো না। ও নিজেই নিচে নেমে এসেছে। বোঝা যাচ্ছে ঘুমিয়ে ছিল। চোখ ডলতে ডলতে এসে বসল। খাবার দেখে চোখ বড় বড় করে বলল
– ভাবি এত কিছু তুমি বানিয়েছ?
– না, আমি আর রোজিনা দুজন মিলে বানিয়েছি। কিন্তু তোমার ভাইয়া কোথায়? এখনো আসছে না যে। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
– কি জানি, আমি তো বললাম
– ঠিক আছে, তুমি খাওয়া শুরু কর, আমি ডাকছি।
মীরা ঘরে গিয়ে দেখলো আশিক বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে একটা বই পড়ছে। মীরা কাছে গিয়ে বলল
– আপনাকে এতক্ষন ধরে ডাকছি, আসছেন না কেন? ওষুধ খেয়েছেন?
আশিক মুখ তুলে তাকাল। মীরার কপালে বিন্দু বিন্দুর ঘাম। আগুনের আচে মুখ লালচে হয়ে আছে। আশিক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিরা হেসে ফেলল। তারপর বলল
– আপনি এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, মনে হচ্ছে আমাকে খেয়ে ফেলবেন। আমি যখন রুমনকে ওষুধ খাওয়াতাম ও ঠিক এইভাবেই তাকিয়ে থাকতো।
আশিক ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো
– রুমন কে?
– আমার ছোট বোন রোমানা। আমি যখন ওর মুখ চেপে ধরে ওকে ওষুধ খাওয়াতাম ও ঠিক এভাবেই তাকিয়ে থাকতো। কিন্তু তাকিয়ে থেকে লাভ হবে না। ওষুধ আপনাকে খেতেই হবে। তাড়াতাড়ি নিচে আসুন।
মিরা বেরিয়ে গেল। ওই তো সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। আশিক তাকিয়ে আছে। ওর বুকের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করছে। খুব ইচ্ছা করছে মিরাকে হাত ধরে টেনে পাশে বসিয়ে….. বাকিটুকু আর ভাবতে পারছে না। আশিক হাতের বইটা রেখে বলল
আমারো আছে বুকের মধ্যে এক্ষুণি চাই ধ্বনি,
যখনই আমি তোমাকে ভাবি, তক্ষুণি তা শুনি।
সময় বসে ভেংচি কাটে- এক্ষুনি নয় সব,
আমিও বুঝি, তোমাকে পাওয়া একটু অসম্ভব।
চলবে……..
বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৪৬.
-কোথায় যাচ্ছেন?
– পাশের লাইব্রেরী রুমে, একটু পড়াশোনা করব
– এই জ্বর নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে না, ঘুমিয়ে পড়ুন। বারোটার সময় এন্টিবায়োটিকের ডোজ আছে, আমি ডেকে দেবো।
– আমি এখানে ঘুমালে, তুমি কোথায় যাবে?
– কোথায় আবার যাব? এখানেই থাকবো, রাতে যদি আবার জ্বর ওঠে।
– সমস্যা নেই, আমি ওষুধ খেয়ে নেব। তুমি ঘুমাও। তোমার উপর অনেক ধকল যাচ্ছে
– কিসের ধকল ?
– এই যে আমার জ্বরের জন্য ঘুমাতে পারছ না, এতসব রান্নাবান্না করছো।
– রান্নাবান্না আমি এমনিতেই করি, আমার ভালো লাগে, বাড়িতে থাকতেও করতাম।
– ও আচ্ছা
– শুয়ে পড়ুন। লাইট বন্ধ করে দেবো ?
আশিক আৎকে উঠে বলল
– না না, একেবারেই না
– আপনি এমন ভাবে ভয় পেয়ে গেলেন যেন মনে হল লাইট বন্ধ করলেই আমি আপনার ঘাড় মটকে দেব।
আশিক হেসে ফেলল। মীরা ও হাসলো। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের আর মাত্র দুই দিন বাকি। মীরা খুব করে চাইছে তার আগেই যেন আশিক সুস্থ হয়ে যায়। এই অনুষ্ঠানটার জন্য ও অনেক পরিশ্রম করেছে। পরিশ্রম মীরা ও করেছে কিন্তু আশিকের তুলনায় সেটা নগণ্য। তাছাড়া আশিকের এটা শেষ অনুষ্ঠান। আর একমাস পরেই ওর অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। কিন্তু যেভাবে ও অবহেলা করছে তাতে সুস্থ হয়ে ওঠাটা মুশকিল।
– জ্বর আছে? মীরা জানতে চাইলো
– না, একেবারেই না
মিরা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ওর দৃষ্টি দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে আশিকের কথা বিশ্বাস করেনি। আসলেই করেনি, ওকে থার্মোমিটার বের করে আনতে দেখা গেল। আশিক অপ্রস্তুত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মীরা কাছে এসে বলল
– বসুন
আশিক বাধ্য ছেলের মতন বিছানায় বসলো। মীরার এই অধিকার ফলানোটা কেন যেন খুব ভালো লাগছে। মিরা জ্বর মেপে চিন্তিত কন্ঠে বলল
– ১০১। আবারো জ্বর উঠছে। আরেকটা জ্বরের ওষুধ খেয়ে নিন তো।
– আচ্ছা আমি খেয়ে নেব
– না, এখনই
– এখন না, আগে তুমি নিচে থেকে রাতের খাবার খেয়ে এসো।
মীরা কথা বাড়ালো না আবারও মনে করিয়ে দিয়ে নিচে নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর উপরে এসে দেখল, যা ভেবেছিল তাই ঠিক আশিক কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে, এবং যথারীতি ওর জ্বর ১০৩ ছাড়িয়েছে। মীরা ওর কাপলে হাত রেখে বিরক্ত কণ্ঠে বলল
– শুনুন, ওষুধ খেয়েছেন?
আশিক অসফুটে কিছু একটা বলল বোঝা গেল না। মীরা আরো কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। আর কোন উপায় না দেখে জলপট্টি দিয়ে জ্বর নামানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আশিক এখনো প্রলাপ বকে যাচ্ছে। মীরার মাথায় হঠাৎ করেই প্রশ্নটা এলো। অনেকদিন থেকেই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু ঠিক সুযোগ হচ্ছিল না। আচ্ছা, জ্বরের ঘোরে তো মানুষ মিথ্যা বলে না। মীরা একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল
– শুনুন, আপনি আমাকে কেন বিয়ে করেছেন ?
আশিক আবারও বিড়বিড় করে কিছু বলল বোঝা গেল না। মীরা আরো একটু ঝুঁকে পড়ে বলল
– বলুন না
– উঁ
– কেন বিয়ে করেছেন আমাকে?
– কলঙ্ক হবে, কলঙ্ক হবে…
বলতে বলতে আশিকের গলা বুজে এলো। মীরা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল। যদিও এটাই স্বাভাবিক ছিল, তবু কেন যেন মেনে নিতে পারল না। অবচেতন মনে কি ও অন্য কিছু আশা করেছিল? মীরার গলার কাছে একটা কান্না কেমন দলা পাকিয়ে উঠলো। বাম হাতে চোখ মুছে ও জলপট্টি দিয়ে যেতে লাগলো। জ্বর নামতে বেশি সময় লাগলো না। জ্বর নেমে গেলে আশিক কেমন যেন বিধ্বস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, এ কদিনে এটা বুঝে ফেলেছে মীরা।
হাতের কাজ গুছিয়ে মীরা বারান্দার চেয়ারে এসে বসলো হেলান দিয়ে। আজ আকাশে চাঁদ নেই, কেমন অন্ধকার হয়ে আছে চারপাশ। মীরার বুকের ভেতরের অন্ধকারটা আরো জমাট বাঁধলো। তার মানে রাসেল ওকে মিথ্যে বলেছে। আশিক কখনো ওকে চায়নি। শুধু অপরাধবোধ থেকে, দয়া করে বিয়ে করেছে। মীরা প্রথমে মুখে হাত চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। তারপর দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পরল।
মীরা কতক্ষণ কাঁদলো ও নিজেও জানে না। একসময় মুখ থেকে হাত সরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। আশিক চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা একটু অপ্রস্তুত বোধ করল। আশিক বিস্মিত কন্ঠে বলল
– তোমার কি হয়েছে মীরা? মন খারাপ?
মীরা জবাব দিল না। তাকিয়ে দেখল আশিকের পাঞ্জাবি ভিজে গেছে। বোধহয় জ্বর ছেড়েছে। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– আপনার জামা ভিজে গেছে, চেঞ্জ করে নিন ঠান্ডা লেগে যাবে।
তারপর পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে গেল । আশিক আর কিছু জানতে চাইলো না। এগিয়ে এসে বারান্দার চেয়ারে বসল। ঠান্ডা হাওয়ায় বসতে ভালো লাগছে। ঘরের ভেতর কেমন গুমোট, দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মীরা আবার ফিরে এসে বলল
– চেঞ্জ না করে এখানে বসে আছেন যে। অসুখ না বাধিয়ে ছাড়বেন না, তাই না? তারপর রাগত কন্ঠে বলল
– যা ইচ্ছা করুন, আমার কথা কেন শুনবেন? আমি কে?
আশিক হতভম্ব হয়ে গেল। এই মেয়ের সমস্যা কি? আশিক বিড়বিড় করে বলল
– আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে,কলঙ্ক হবে তোর
কখন থেকে অকারণে এই লাইনগুলো মাথার মধ্যে ঘুরছে। ধুর!
চলবে……….
আজকের কবিতার লাইনটা হেলাল হাফিজের হৃদয়ের ঋণ থেকে নেয়া।
বইছে আবার চৈতি হাওয়া
৪৭.
মীরা আশিকের সঙ্গে চেঁচামেচি করে ওয়াশরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলো, তারপর চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখল আশিক ভেজা পাঞ্জাবী পাল্টে টি শার্ট পরেছে। ওয়াটার হিটারে কফির জন্য জল চাপিয়েছে। মিরাকে দেখে হালকা গলায় বলল
– কফি খাবে মীরা?
– না, এই রাত্রেবেলা কফি খাবো কেনো? এখন কফি খেলে ঘুম আসবে না
– তুমি তো এমনিতেও ঘুমাচ্ছ না
– আমি ঘুমাচ্ছি না অন্য কারণে
– কি কারণ?
– এত আলোতে আমি ঘুমাতে পারি না
– ও তাহলে আমি পাশের ঘরে গিয়ে কফি খাচ্ছি। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো
আশিক কফির মগ হাতে পাশের রুমে যেতে উদ্যত হলো।
– শুনুন, আপনার অ্যান্টিবায়োটিক খাবার সময় হয়ে গেছে
– ও আচ্ছা খাচ্ছি
– আগে কিছু খেতে হবে। কি খাবেন বলেন আমি এনে দিচ্ছি
– এতসব ঝামেলা করার দরকার নেই
– দরকার আছে। খাবারের পর খেতে বলেছে কি খাবেন বলুন?
– একটা কিছু হলেই হবে
– মুড়ি মাখিয়ে দেই?
– এত রাতে ঝামেলা হবে
– না, ঘুগনি করাই আছে। আমি নিয়ে আসছি।
মিরা ঝটপট মুড়ি মাখা বানিয়ে ফেললো। যত্ন করে বাটিতে ঢেলে উপরে ধনেপাতা কাঁচামরিচ দিয়ে গার্নিশ করল। আশিকের জন্য কিছু করতেও খুব ভালো লাগে। ও কি আশিককে একটু বেশি যত্ন করছে? আচ্ছা, এমন নয় তো যে ও আশিকের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে? আরে ধুর! মিরা মাথা নেড়ে হাসলো আপন মনেই। আগেও তো এমন ভাবেই করতো। মীরা ট্রেতে করে খাবারের বাটি, পানির গ্লাস নিয়ে উপরে চলে এল। ঘরে ঢুকে দেখল আশিক দুই মগ কফি বানিয়েছে। ওকে দেখে হালকা গলায় বলল
-একা একা খেতে ইচ্ছা করছিল না, তাই তোমার জন্য ও করলাম। তোমারটা
ডি-ক্যাফিনেটেড, ঘুমের সমস্যা হবে না।
মীরার অবশ্য এমনিতেই ইচ্ছা করছিল একটু আশিকের সঙ্গে থাকতে, তাই ও আর উচ্চবাচ্য করল না। কফির মগ নিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। একটা চুমুক দিয়েই বুঝতে পারল বেশ ভালো ব্র্যান্ডের কফি। কেমন ক্লান্তি কেটে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখল আশিক আয়েশ করে মুড়ি মাখা খাচ্ছে। ধূসর রংয়ের টি-শার্টটা এত মানিয়েছে ওকে। মীরা তাকিয়ে রইল। আশিক খেতে খেতে বলল
– মিরা, মুড়ি মাখানোর কোন কম্পিটিশন হলে তুমি নির্ঘাত চ্যাম্পিয়ন হতে
মিরা জবাব দিল না। ওর কেমন ঘুম ঘুম লাগছে। চা কফি খেলে মানুষের ঘুম পালিয়ে যায়, অথচ ওর মনে হচ্ছে চায়ের বদলে আফিম খেয়ে ফেলেছে। মীরা কফির মগ সাইড টেবিলে রেখে পা তুলে বিছানায় বসলা, তারপর বালিশে মাথা রেখে বলল
– আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি একটু ঘুমাই
আশিক ব্যস্ত হয়ে বলল
– হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই লাইট বন্ধ করে দেবো? আমি পাশের ঘরে চলে যাই?
– না সমস্যা নেই
– আচ্ছা ঠিক আছে, সিলিং লাইট বন্ধ করে টেবিল ল্যাম্প জেলে দিচ্ছি।
মীরা জবাব দিতে পারল না, তার আগেই গভীর ঘুমিয়ে তলিয়ে গেল। টেবিল ল্যাম্পের নরম আলোয় ওর মায়াবী মুখটা আরো মায়া-ময় লাগছে। আশিক চোখ ফেরাতে পারলো না। অপলক চেয়ে রইল।
৪৮.
– কিরে এরকম প্যাঁচার মতো মুখ করে রেখেছিস কেন? এখন তো মুখ থাকবে অল টাইম গ্লোয়িং।
মীরা জবাব দিলো না। মুখ ভার করে বসে রইল। মিরা হলে এসেছিল ওর কিছু জিনিসপত্র নেবে বলে। টুম্পা কে ও আসতে বলেছিল। কাল একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান। সাদা কালো শাড়ি পরতে হবে। মিরার কোন সাদা কালো শাড়ি নেই। কদিনের ব্যস্ততায় আর বেরোতে পারেনি। আজকে না কিনলেই নয়। একটু দেখেশুনে বেছে কিনতে হবে।সকাল সকাল ভালো মুডে বের হচ্ছিল, কিন্তু আসার আগেই মন মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে গেল।
– কি হল, কথা বলছিস না কেন?
– কিছু না, মাথা ধরেছে
– কেন
– ঘুম হয়নি
– এখন ঘুম না হওয়াটাই তো স্বাভাবিক
মীরা টুম্পার রসিকতা ধরতে পারল না, আনমনে বলল
-হু
– স্বীকার করছিস তাহলে ?
মীরা এবার বুঝতে পারল। কেন যেন ওর রাগ হচ্ছে না, অসম্ভব মন খারাপ লাগছে। আজ সকালে যখন ওর ঘুম ভেঙেছে কোথাও আশিককে খুঁজে পায়নি। তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে বলে মিরা ঝটপট রেডি হয়ে নিচে গিয়ে দেখল তখনও কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। হয়তো আফসিনের পরীক্ষা শেষ, তাই রোজিনা আর সকাল সকাল উঠে খাবার তৈরি করেনি। ভেবেছে আশিকে অসুস্থ তাই সবাই ঘুমিয়ে আছে। মীরা তাড়াতাড়ি দুজনের জন্য ব্রেকফাস্ট রেডি করে ফেলল। খাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল আশিক সবে ছাদ থেকে নেমে এসেছে। মীরা বলল
– তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন, ওষুধ খেতে হবে
আশিক আর কিছু বলল না, চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগলো। মিরা যতক্ষণ কাছে থাকে ততক্ষণই ভালো লাগে। কে জানে আর কতদিন থাকবে। মিরাকে তৈরি হতে দেখে আশিক একটু অবাক হয়ে বলল
– তুমি কি কোথাও যাচ্ছ?
-জি, একটু হলে যাব, কয়েকটা জিনিস আনতে হবে। তারপর একটু মার্কেটে যাবো।
– মার্কেটে? একা যাবে?
– না, টুম্পাকে আসতে বলেছি, ওর সঙ্গে যাব
– আমি তোমার সঙ্গে যাই?
মীরা এগিয়ে এসে ওর কপালে হাত রাখলো। তারপর বলল
– আপনার জ্বর আছে, তা না হলে আপনার সঙ্গেই যেতাম। আপনি বাসায় রেস্ট নিন। কালকের অনুষ্ঠানে না হলে সমস্যা হয়ে যাবে। আমি শাড়িটা কিনেই চলে আসব। দেরি হবে না।
– শাড়ি?
– হ্যাঁ, কালকের অনুষ্ঠানের জন্য সাদাকালো শাড়ি লাগবে।
– ও আচ্ছা
বেরোনোর সময় আশিক একবার ডাকলো। মিরা এগিয়ে এসে বলল
– কিছু বলবেন?
আশিক একটু অস্বস্তি দিয়ে বলল
– আমি যদি তোমাকে শাড়ি কেনার টাকাটা দেই তুমি কি কিছু মনে করবে?
মীরা হেসে ফেলল। বলল
– মনে করব কেন?
আশিক কেমন ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছিল। উঠতে গেলে মীরা বলল
– কোথায় আছে বলুন, আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি
– টেবিলের উপর আমার ওয়ালেটে আছে। যা আছে নিয়ে যাও।
মিরা ওয়ালেট খুলে হতভম্ব হয়ে গেল। ভেতরে একটা মেয়ের ছবি। বিষন্ন দুটি চোখ, হাসিটা খুব মিষ্টি, কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। মীরার বুক ধক করে উঠলো। চোখে জল এসে গেল। কোনোমতে চোখের জল লুকিয়ে ও বেরিয়ে গেল।
আশিক তাহলে অন্য কাউকে ভালোবাসে। এজন্য টুম্পাকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল। তাহলে ওকে কেন বিয়ে করল? এমনই তার অপরাধবোধ?
– কিরে, কথা বলছিস না কেন?
মীরা মুখ তুলে তাকালো। টুম্পা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। মিরর হঠাৎ করে কেমন কান্না পেল। হাঁটুতে মুখ গুজে ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। হঠাৎ করে এভাবে কেঁদে ওঠাতে টুম্পা প্রথমে কেমন হকচকিয়ে গেল, তারপর কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বলল
– কি হয়েছে? বল না আমাকে
মীরা মুখ তুলে, চোখ মুছে বলল
– উনি অন্য কাউকে ভালোবাসে
– কি? কে বলেছে তোকে আশিক ভাই?
– না
– তাহলে?
– আমি ওনার ওয়ালেটে ছবি দেখেছি।
– আরে ধুর ওয়ালেটে কেউ গার্লফ্রেন্ডের ছবি রাখে? দেখতে কেমন?
– শাড়ি পরা, মাঝখানে সিঁথি করা, পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
মীরার হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতন মনে পরল। এই ওয়ালেটটাই উনার হাতে ছিল সেদিন। অফিসের ছাদ বারান্দায় উনি কাঁদছিলেন। মিরা থেমে থেমে বলল
– এটা নিশ্চয়ই উনার মায়ের ছবি
– এইযে দেখলি তো, হুদাই ফ্যাচফ্যাচ করছিলি
মিরা চোখ মুছে বলল
– আচ্ছা টুম্পা, সেদিন কার্জন হলে উনি তোকে কি বলেছিলেন?
– উনি গে এই কথা বলেননি। ইম্পোটেন্ট এই কথা ও বলেননি কাজেই তুই নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস। অবশ্য উনি যে ইম্পোটেন্ট না এর প্রমাণ নিশ্চয়ই এতদিনে পেয়ে গেছিস।
মীরা জবাব দিল না, তাকিয়ে রইল। টুম্পা গা দুলিয়া হাসতে লাগলো।
চলবে………