#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ১৬]
একটি সুন্দর দিন সুন্দর সকাল শুরু হলো আরশাদের জন্য।তার মনটা আজ ভীষণ খুশি।ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের দিকে মূঢ় হয়ে রইল কিছুক্ষণ।খুশবুর সাথে রাতে তার কথা হয়নি এই মুহুর্তে কথা বলার ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে।মেয়েটাকে তিন চারবার ফোন করা হলেও মেয়েটা ফোন রিসিভ করেনি।নিশ্চয়ই ঘুমের সাগরে হুটোপুটি খাচ্ছে।আরশাদ দ্রুত মেসেজ টাইপ করলো,
‘ঘুমিয়ে নাও এটাই তো শেষ একা ঘুমানোর রাত।এরপর না তুমি ঘুমাবে না আমি।’
আরশাদ ফোন রেখে চলে গেল ওয়াশরুমের, আজকে হলুদের অনুষ্ঠান সব কাজ সেরে জলদি জলদি তাকে তৈরি হতে হবে।
.
খুশবুদের বাসাটা আজ আত্মীয়দের উপস্থিতিতে রমরমা।মামা-মামি,ফুফা-ফুফু,চাচা-চাচি সবাই আজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত।সবার ঘরে ছেলে মেয়ে আছে তারা হলুদ নিয়ে প্রচন্ড এক্সাইটেড।দুপুরের খাড়া রোদটা নামতে সবাই কাজে লেগে পড়ে।খুশবুর পরনে সবুজ পাড়ের হলুদ শাড়ি।মুখে তেমন কোন প্রসাধনী নেই ঠোঁট লাল করে লিপস্টিক দিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে আজ।হাতে বাহুতে গলায় মাথায় সবটাই কাঁচা ফুল।গোলাপ গাঁদা মিলিয়ে মেয়েটাকে আজ ফুলপরী সাজানো হয়েছে।বাড়ির ছাদে ফুল কলাপাতা দিয়ে ছোট খাটো স্টেজ সাজানো হয়েছে।
থালা ভরতি রং এনে সাজানো হয়েছে পুরোটা ছাদ।আরশাদরা ইতিমধ্যে চলেও এলো।আরশাদ আরিব দুজনে নিজেকে হলুদ পাঞ্জাবিতে সাজিয়ে তুলেছে।আফরোজ খুশবুর দিকে তাকিয়ে বলে,
” এত কম সাজলে কেন?একটু হাইলাইট লাগাও সুন্দর লাগবে।”
আফরোজ আর বাক্যব্যয় করলেন না।
নিজেই ঠিক করলেন খুশবুর সাজ।রোদটা একটু নেমে আসতে তারা চলে যায় ছাদে।আরশাদ এবং খুশবু দুজনে একসাথে বসেছে।আরশাদের এক্সাইটেড মুখখানি দেখে খুশবু নজর ফেরালো।
” দেখলে আমার চয়েজ শাড়িটায় কি সুন্দর লাগছে তোমাকে।শাড়িটা কিনে ভালোই করেছি।”
“মোটেই না।আমি সুন্দর বলেই শাড়িটা ফুটেছে।শাড়িটা একটুও সুন্দর না।”
” তুমিও তো আমার চয়েজ।”
খুশবু প্রত্যুত্তর করার আগে ইমরান ইহসান বসলেন তাদের সামনে।হাত ভরতি হলুদ নিয়ে মাখলেন আরশাদ এবং খুশবুর গালে।একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়ালো তাদের।আরশাদের কাছে এই নিয়মরীতি গুলো নতুন।এর আগে বাঙালি বিয়ে দেখেনি সে।তবে খ্রিস্টানদের বিয়েতে তার থাকা হয়েছে।গির্জায় গিয়ে সাদা ড্রেস পড়ে বিয়ে করা তাদের রীতি অপরদিকে বাঙালিরা বিয়ে করছে নানান সাজে, নানান রঙে ঢঙে।
আরশাদের খুশি আর ধরে না।এই খুশিতে চুমু খেলে মন্দ হয় না।কিন্তু তার আশা যে পূরণ হওয়ার নয় আশেপাশে সবাই সিসি ক্যামেরার মতো লেগে আছে।
গায়ে হলুদ শেষ হতে সবাই মেতেছে রং খেয়াল।যে যাকে পারছে ইচ্ছে মতো রাঙিয়ে তুলছে।গুরুগম্ভীর বাহারুল হককেও আজ ছাড় দেওয়া হয়নি আরিব ধরে এনে তাকে রঙ মেখেছে।ছাদে সাউন্ড বক্সে জোরে গান চলছে সেই গানের তালে রঙ খেলায় মেতেছে সবাই।আরশাদ সবার ভিড় পরোয়া করে খুশবুকে টেনে নিয়ে যায় আড়ালে।চিলেকোঠার ঘরটাতে সমস্ত পুরোনো মাল দিয়ে ভর্তি।আরশাদ চিলেকোঠার দেয়ালে ঠেসে খুশবুকে জড়িয়ে ধরে আচমকাই ঠোঁটে ঠোঁট মেশালো।যদিও এর অবস্থান দীর্ঘক্ষণ নয়।
আরশাদ মুখ সরাতে নজর গেল চিলেকোঠার পেছনে আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে খুশবুর ফুফাতো ভাই রিমন।ছেলেটা হা হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে
তার মানে এতক্ষণ কিসিং সিন সে দেখে ফেলেছে?সর্বনাশ!
আরশাদ থতমত খেয়ে গেল।রিমনের দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বলে,
” এই এখানে কী করছো তুমি?”
” ন..নেশা করছি দুলাভাই।একটু সিগারেট টানতে এলাম।আমার তো বউ নেই বউ থাকলে বউয়ের ঠোঁটটাই টানতাম।”
খুশবু রিমনকে দেখে থতমত খেয়ে গেল।এভাবে লজ্জায় পড়বে সে কখনো ভাবেনি।আরশাদের কি উচিত ছিল এই মুহূর্তে এসব করা!মেয়েটা ঘোমটা টেনে এক ছুটে পালালো।আরশাদ ঠোঁট কামড়ে তাকালো রিমনের দিকে।দু’দাঁতের পাটি পিষে বলে,
” অন্যের প্রেমে বাঁধা দিচ্ছো তো,তোমার কপালে বউ হবে না।”
.
বাড়ির মুরব্বিরা ছাদ থেকে চলে গেল।এখন শুধু ছাদে আছে ছেলে মেয়েরা।গানের তালে তালে কেউ নাচতে ব্যস্ত কেউ রঙ পানিতে মিশিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে সবার গায়ে।এই রমরমা মুহূর্তটা বন্ধুদের কাছে সেয়ার না করলে নয়।আরশাদের ভীষণ আফসোস বন্ধুরা তার বিয়েতে উপস্থিত নেই।
আরশাদ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ভিডিও কল দিল।তার বন্ধুরা তখন একসাথে আড্ডা দিচ্ছিলো সবাইকে পেয়ে গেল একদলে।আরশাদ সবাইকে দেখে একচিলতে হাসলো।ফোনের অপরপাশ থেকে বন্ধুর দল ডিলান,অ্যাডেন,কডি, এলোন সবাই চিৎকার দিয়ে উঠে।আরশাদের রঙ মাখামাখি অবস্থাটা দেখে তারা বুঝতেই পারছে কতটা আনন্দ করছে আরশাদ।
” আরশাদ তোমাকে চেনাই যাচ্ছে না।হোয়াট এ লুক।”
” এত আনন্দের মাঝে তোমাদের মিস করছি।লাভ ইউ অল।”
ডিলান বলে,
” মিস ইউ আরশাদ।আমাদের আফসোস তো বেড়ে গেল।কেন যে যেতে পারলাম না।”
পাশ থেকে এলোন বলে,
” আরশাদ আর কতকাল তোমার ফ্লুজিকে আড়াল রাখবে?এবার তো দেখাও আমাদের।”
সবাই সহমত জানালো।আরশাদ ফোন হাতে নিয়ে খুঁজলো তার ফ্লুজিকে।মেয়েটা তখন নিচে চলে যায় আর ফিরে আসেনি।আরশাদ ডেকে পাঠালো তাকে।মেয়েটা পুনরায় ছাদে এলো তবে তার মুখে এখন রঙ হলুদ কিছুই নেই নিচে নেমেই মুখ পরিষ্কার করেছে সে।
আরশাদ খুশবুকে ইশারা করলো,লজ্জা দ্বিধা নিয়ে ক্যামেরার সামনে আসে সে।খুশবুকে দেখে বন্ধুদের দলে হইহুল্লোড় বাড়লো।সবাই ইতালিয়ান ভাষায় তাদের উৎসাহ জানালো,এটা ওটা কত কি বললো কিন্তু খুশবু এসব কিছুই বুঝতে পারেনি।সে তো ইতালিয়ান ভাষা বুঝে না।অথচ আরশাদ কিছুক্ষণ পর পর তাদের চোখ পাকাচ্ছে।খুশবু শুধু হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে।
সবার হইহুল্লোড়ের মাঝে এলোনের কাজিন জন ফোনে চোখ রাখলো।সে এতক্ষণ গেমস খেলছিল কাকে নিয়ে এত মাতামাতি দেখতে ফোনে চোখ রাখে সে।খুশবুকে দেখা মাত্র ছেলেটার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়।এই মেয়েকে সে চেনে,না না শুধুই চেনে না, মেয়েটার শরীরের প্রতিটা ভাজে ভাজে নিজেকে ডুবিয়েছে জন।
জন এলোনের হাত টেনে বলে,
” হু ইজ শী?”
” আরশাদ’স ওয়াইফ।”
” হোয়াট!”
জন পুনরায় ফোনে চোখ রাখলো ঢোক গিলে এলোনের হাত টেনে সরিয়ে আনলো আড়ালে।ইতালিয়ান ভাষায় সে বলে,
” আরশাদের মতো একটা ছেলে এই মেয়েকে বিয়ে করছে!এর সাথেই কি তার প্রেম?তোমরা আগে দেখনি এই মেয়েকে?”
” কখনো না।সে সর্বদা তার ফ্লুজিকে আড়াল করেছে।আজ প্রথম দেখলাম তাকে,তবে মেয়েটাকে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে।”
” বোকা ছেলে চিনতে পারোনি?”
” না।”
জন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।হাতের ফোন নিয়ে চলে গেল গ্যালারিতে।একটি ছবি বের করে দেখালো এলোনকে।এলোন হতভম্ব,তার শ্বাস প্রশ্বাসের আন্দোলন ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো।মুখ থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে এলো,
” হোয়াট দ্যা..”
” শী ইজ কল গার্ল।প্রতি রাতে তার চার্জ কতো সেটা আশা করি বলতে হবে না।অনেক আগেই তোমাকে এই মেয়ের ছবি সহ সব বলেছিলাম।”
এলোন যেন কথা বলতে ভুলে গেল।মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো চেয়ারে।এলোনের অবস্থা দেখে বাকি বন্ধুরা এসে তার সামনে দাঁড়ালো এবং জানতে চাইলো হঠাৎ তার কি হয়েছে?জন সবার উদ্দেশ্যে বলে,
” আরশাদের ফ্লুজিকে আগে কেউ কোথাও দেখেছো?”
ডিলান বলে,
” না কেন?”
” শী ইজ কল গার্ল।”
” ভাইয়া এসব বলবেন না প্লিজ আরশাদ জানলে সমস্যা হবে।শুধু শুধু একজনের নামে এতবড় কথা তোলা কি ঠিক?ফ্লুজি যথেষ্ট ভালো মেয়ে।”
” ভালো!ভালো?এটা কি তবে?”
জন তার ফোন সবার সামনে ধরলো।মুহূর্তে সবার ভাব ভঙ্গিমা পালটে গেল।জনের বুকে শুয়ে থাকা লাস্যময়ী মেয়েটি দেখতে হুবহু ফ্লুজির মতো।মেয়েটির শরীরে কোন পোষাকের চিহ্ন নেই।জনের বুকের সাথে ঢেকে আছে তার বক্ষের ভাজ।সবাই চোখ ঘুরালো এবং চোখাচোখি করলো।জন সবাইকে সারপ্রাইজ দিয়ে যেন মজাই পেল।
” আমি আমার সাথের কয়েকজন সিনিয়র মিলে বিডিতে গিয়েছিলাম সেখানে এই মেয়েটাকে একেক জন একেক রাতের জন্য নিয়েছিল।তার চার্জ জান?ডিমান্ড আছে।”
অ্যাডনের শরীর কাঁপে।তার কাছে এসব ডালভাত সে নিজেও লিভ ইনে আছে কিন্তু…কিন্তু আরশাদের মতো একটি ছেলের ভাগ্যে এমন মেয়ে কিছুতেই মানতে পারছে না তারা।সে বলে,
” আরশাদকে জানানো উচিত এমন একটা মেয়েকে সে কি করে মেনে নিল।”
ডিলান বাঁধা দিয়ে বলে,
” কোন দরকার নেই।মনে আছে ফ্লুজিকে ছাড়তে বলায় কডিকে মে রে হসপিটাল নিয়েছে।এখন যদি আমরা এসব বলি তাহলে আমাদের খু ন করে ফেলবে।”
কডি সহমত জানায়।আরশাদ যখন ফ্লুজির জন্য পা গ ল প্রায় তখন সে বলেছিল ফ্লুজিকে ছাড়তে।সঙ্গে সঙ্গে কডিকে মে রে রক্তাক্ত করে আরশাদ।সেই দিনের কথা ভাবলে এখনো তার গা শিউরে উঠে।
অপরদিকে অ্যাডেন তাদের ঘোর বিরোধী,
” প্লিজ যা হবার আগে হয়েছে আরশাদকে জানানো উচিত।”
জন কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
” শুনো যে যার মতো চুপ থাকো।অন্ধ ভালোবাসা কতটা ভয়ংকর সে এবার টের পাবে।
.
খুশবুকে যখন শ্বশুর বাড়ি পাঠানো হয় মেয়ের শোকে চেতনা হারান অনিমা।অপরদিকে খুশবুর অবস্থা আরো করুন।আরশাদের বাড়িতে আসার পর থেকে তার হুশ জ্ঞান নেই।ডাক্তার দেখানো হয়েছে সুস্থ হতে না হতে রিসিপশন অনুষ্ঠানের দিন চলে আসে।রিসিপশনের পরের দিন সকাল সকাল খুশবুর ফ্লাইট।সে রাতটা খুশবু বাবা মায়ের কাছেই থেকেছে।
আজ সকালে তার বাংলাদেশ ছাড়ার দিন।এয়ারপোর্টে এসে ঝাপসা চোখে অনিমার দিকে তাকিয়ে আছে সে।বাহারুল হক মেয়েকে বুকে জড়ান কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি নিজেও।
ইমরান ইহসান তৎক্ষনাৎ সান্ত্বনার বানী ছুড়েন,
” মেয়েকে কি আমরা ফেলে দিব?নাকি অযত্ন করবো?কাঁদছেন কেন?মন ভরে তাদের জন্য দুআ করুন।”
আরিব ব্যাগপত্র হাতে তাড়া দিল এক্ষুনি তাদের যেতে হবে।খুশবুর ডান হাতটা ধরলো আরশাদ অপরদিকে বাম হাত জড়িয়ে আছে অনিমা।মায়ের সুতো ছিড়ে কিছুতেই যেতে মন চাইছে না তার।তবুও যেতে হলো। সবাইকে বিদায় জানিয়ে এয়ারপোর্টে প্রবেশ করলো তারা।
সব ফর্মালিটি শেষে প্লেনে চড়ে বসলো দুজনে।তাদের পাশাপাশি সিট হওয়ায় আরশাদ তার ফ্লুজিকে এটা ওটা বুঝিয়ে দিচ্ছে।ছেলেটার কথার ভঙ্গিমায় বোঝা যায় সে আজ কতটা খুশি কিন্তু খুশবু?সে তো এখনো পিছুটানে জড়িয়ে আছে।আরশাদ খুশবুর হাতের পৃষ্ঠে চুমু খায়।খুশবুকে করে বসে এক সরল প্রশ্ন,
” এত শত ভীড়ে আমার উদ্দীপ্ত চাহনি কেন তোমার দিকে যায়,বলতে পারো?”
চলবে….
#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ১৬ বাকি অংশ]
আরশাদ যতটা না ভেবেছিল তার থেকেও বেশি কিছু হয়ে গেল।টানা চৌদ্দ ঘন্টা জার্নি শেষে খুশবুর অবস্থা প্রচন্ড খারাপ।কিয়ৎক্ষণ বাদে বাদে উগড়ে দিচ্ছে পেটের সব।দাঁত খিচে বসে থেকে যাও নিস্তার পেল কিন্তু মাথা ব্যথা আচমকা প্রচন্ড বড় আকারে বাড়লো।এতটাই মাথা ব্যথা যে মেয়েটা চোখ খুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না।চোখে আলো এসে ছিটকে পড়লে কষ্ট দ্বিগুন হয়।তাই চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্থির রাখতে চাইছে।খুশবুর অবস্থা দেখে সবার মাঝে চলছে অস্থির দুশ্চিন্তার আনাগোনা।ইতালিতে মেয়েটার প্রথম দিন তারা ভেবেছিল কত কি করে তাকে সারপ্রাইজ দেবে অথচ হলো তার উলটো।
রোমের লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ফিউমিচিনো বিমানবন্দর এফসিও পৌঁছে সকল ফর্মালিটি শেষে আরিব দ্রুত গাড়ি ঠিক করে।খুশবু ভেবেছিল কত কি, এই দেশে পা রেখে সবটা দেখবে এয়ার্পোট থেকে শুরু হবে তার জীবনে অন্যরকম যাত্রা।কিন্তু মেয়েটা এই সুন্দর শহরটাকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে দেখতে পারছে না।
গাড়ি থেকে নেমে খুশবু আরশাদের হাত জড়িয়ে রাখলো।ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে চললো সে।আরশাদ তাকে নির্দেশ দিচ্ছে কোথায় কোথায় পা ফেলতে হবে।মেয়েটা একটুও চোখ খুলতে চাইছে না।এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে তার মুক্তি চাই মুক্তি।
খুশবু ভিলায় প্রবেশ করতে নাকে এসে ধাক্কা লাগে মিষ্টি সুভাস।হঠাৎ তার গায়ে কিছু ছিটানো হয় পিটপিট চোখ খুলতে সে দেখতে পায় ছিমছাম গড়নের একটি মেয়ে।মেয়েটির বাদামী চুল হেলেদুলে খুশবুর দিকে তাকিয়ে হাসছে আর গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছে খুশবুর দিকে।পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন বৃদ্ধা।কিন্তু তাকে বৃদ্ধা বললেও খুশবুর মুখে লাগবে এই বয়সে তিনি যতটা ইয়াং তা ভীষণ অবাক করা তার কাছে।
এলিনা জড়িয়ে ধরলো খুশবুকে হাতে দিয়ে দিল একটি ফুলের তোড়া ইতালিয়ান ভাষায় কত কি বললো তাকে কিন্তু খুশবু এসব কথার কিছুই বুঝতে পারে না।আরশাদ খুশবুকে নির্দেশ দেয় গ্র্যানিকে সালাম জানাতে খুশবু সালাম জানায়।গ্র্যানি আদুরে হাতে খুশবুকে জড়িয়ে ধরেন।খুশবুর গালের সহিত তার গাল মেশায়।গ্লোরিয়াকে না দেখে আরশাদ বলে,
” ফুফু কোথায়?”
এলিনা তার হাসি ধরে রেখে বলে,
” তোমার রেস্টুরেন্টে গেছে কিছু বাঙালি খাবার আনা হবে।ওসব তো মম রান্না করতে পারে না।”
আরশাদ আর দেরি করে না সবাইকে বোঝায় খুশবু অসুস্থ।ইমরান ইহসান আরশাদকে টিপ্পনী কেটে বলেন,
” তুমি কি তোমার গুহায় নিয়ে যাবে তাকে?আজকের দিনটায় এখানে থাকুক।”
” বাঘ গুহায় থাকলে বাঘিনী বাইরে থাকবে কেন?”
আরিব শব্দ করে হেসে ফেললো।আরশাদ তাকে নির্দেশ দেয় তাদের ব্যাকপ্যাক যেন ভিলায় রেখে আসে।আরিব দ্রুত ব্যাগপ্যাক নিয়ে আরশাদের ভিলায় যায় নিচ তলায় সব রেখে এসে সে পুনরায় ফিরে আসে।আরশাদ তার ফ্লুজির হাত ধরে ভিলার দিকে নিয়ে যায়।একটি সিড়ির সাহায্যে খুশবুকে ধরে আরশাদ নিচে নামাতে গেলে মেয়েটার দু’চরণ থেমে যায়।সে তো দোতলায় নয় এটাই তো নিচ তলা।তাহলে আরশাদ তাকে আরো নিচে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?এটা তো পাতালঘর মনে হচ্ছে।
” আরশার ওখানে কেন যাচ্ছেন?ওটা কি পাতাল ঘর?”
” হুম।পাতাল দিয়েই তো যাব।এই পাশটা স্টোর রুম,স্টোর রুম দিয়ে আমার ভিলার স্টোর রুমের কানেকশন আছে।”
” অন্ধকার কেন?”
” ভয় পেও না আমি আছি তো।লাইট অন করলে তোমার চোখে লাগবে এভাবেই চলো।”
খুশবুর ভয় বাড়লো।আরশাদের হাত আঁকড়ে ধরলো সে।এই অচেনা জায়গায় আরশাদ তার একমাত্র ভরসা কিন্তু আরিব যে একদিন বলেছে আরশাদ তাকে খু ন করতে চায় আরশাদ যদি ছলনা করে?নাকি ছলনা করছে?খুশবুর মাথায় এসব চিন্তা এলেও সে সবটাই সরিয়ে ফেলে।
সন্দেহ একটা সম্পর্কের বিষ। সে চায় না সন্দেহ করতে আরশাদ কখনোই তার ক্ষতি করবে না।
খুশবু যেন গহীন গহ্ববরে হারিয়ে গেল।অন্ধকারে খামচে ধরলো আরশাদের হাত।সেই অন্ধকারের মাঝে আরশাদ শিষ বাজালো।গুনগুন করে গাইতে থাকলো গান,Georgia wrap me up in all your
I want ya’, In my arms
Oh, let me hold ya’
I’ll never let you go again, like I did
Oh I used to say
“I would never fall in love again until I found her”
I said, “I would never fall unless it’s you I fall into”
I was lost within the darkness, but then I found her
I found you….
“আরশাদ প্লিজ থামুন।”
আরশাদ থেমে গেল।অন্ধকারে আরশাদের গানের সুর তার গায়ে কাটা দিচ্ছে।
” কি হয়েছে ফ্লুজি?”
” আমার বিশ্রামের প্রয়োজন।”
আরশাদ তার গতিবিধি বদলালো না।ফ্লুজিকে ধরে সে হাটলো আগের মতোই।আরশাদ তার ভিলার স্টোর রুমের দরজা খুলতে অন্ধকার চিরে দেখা মিললো আলোর।খুশবু স্বস্তি পেল।ছিমছাম সাজানো ভিলার নিচের তলাটা।কিচেন রুমটা বেশ বড়।দেয়ালের পাশ ঘেষে গেছে দোতলার সিড়ি।আরশাদ খুশবুর হাত ধরে সিড়ির কাছটায় যায় এবং খুশবুকে কোলে তুলে নেয়।আরশাদের এহেন আচরণে চমকে গেল খুশবু।নিজেকে সামলাতে জড়িয়ে ধরলো আরশাদের গলা।
” আরশাদ নামান আমি পড়ে যাব।”
” আমার উপর ভরসা নেই?”
” আপনি নামান আমি যেতে পারবো।”
” উহ পারবে না।”
আরশাদ নিজের চাওয়া বজায় রাখলো।ফ্লুজির ছোট্ট দেহখানী গুটিয়ে গেল আরশাদের মাঝে।আরশাদের বলিষ্ঠ হাতের বন্ধনীতে মেয়েটাকে শক্তপোক্ত করেই ধরে রেখেছে।যেন নেকড়ে তার শিকারকে নিজের কাছে বেঁধে রেখেছে একটু ছাড়া পেলেই পালিয়ে যাবে।
আরশাদ খুশবুকে না নামিয়ে সিড়ি বেয়ে চলে গেল নিজের রুমে।বিশাল রুমটা বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো গোছানো।হাতের বাঁধন আলগা করে বিছানায় ফ্লুজিকে শুইয়ে দিল আরশাদ।
” আমি লাইট অফ করে দিচ্ছি তুমি রেস্ট করো।না খেয়ে ঘুমাবে না।”
” না না আমার ভয় লাগবে।লাইট থাক আমি চোখ ঢেকে রাখব।”
আরশাদ চলে গেল নিচে।দুটো ট্রলি নিয়ে নিজের রুমে রেখে চলে গেল ফ্লুজির জন্য খাবার আনতে।তার বাসায় কোন খাবার নেই যাওয়ার আগে সব পরিষ্কার করে তবেই গিয়েছিল।
খুশবু ঘুমানোর আগে বাবা মায়ের সাথে কথা সেরে নিল।তারপর তলিয়ে গেল রাজ্যের ঘুমে।আরশাদ আজ তাকে বিরক্ত করলো না।দুটো ট্রলি থেকে সব জামা কাপড় গুছিয়ে রাখলো নিজের আলমারিতে।
খুশবুর জন্য ছেড়ে দিল তার আলমারির একাংশ।খুশবুর প্রতিটা জামা শাড়ি সে যখন গুছিয়ে রাখছিল মনের কোণে কোথাও যেন প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল।বিছানায় শুয়ে থাকা সফেদ ব্লাঙ্কেট জড়ানো ফ্লুজিকে দেখে আরশাদ তৃপ্তি নিয়ে হাসলো।এই তো নিজের কথা নিজে রেখেছে,এই তো তার আরেকটি চাওয়া পূরণ হয়েছে।
কাজ শেষে আরশাদ খুশবুর পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়লো।এই রাতে মেয়েটাকে জ্বালাতে একটুও মন সায় দিল না তার।
.
আচমকা খুশবুর ঘুমটা ভেঙে গেল। অন্ধকার রুমজুড়ে আরশাদের অস্তিত্ব খুঁজে পেল না সে।রুমে বাতি নেই জানলার কাছে বড় বড় পর্দা টেনে দেওয়া যার দরুনে সারাটা রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার অচেনা স্থানে খুশবুর ভয় বাড়লো।একটা জায়গায় থাকতে থাকতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায় কিন্তু নতুন স্থান নতুন পরিবেশে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
হাতড়ে হাতড়ে আরশাদকে বিছানায় খুঁজলো খুশবু কিন্তু বিছানায় যে ছেলেটার অস্তিত্ব নেই খুব সহজে বুঝতে পারলো সে।হাতড়ে হাতড়ে ফোন খুঁজতে গিয়েও নিজের ফোনটা পেল না।বেডের পাশে থাকা টেবিলে হাত রাখলো পুনরায় খুঁজলে ফোন পাওয়া তো দূরের কথা উল্টো তার হাতের ধাক্কায় ল্যাম্পটা ছিটকে পড়লো মেঝেতে তৎক্ষনাৎ ঝনঝন শব্দে খুশবু ভয় পেল।নিজেকে আর সাহস দিতে না পেরে শব্দ করে কেঁদে ফেললো সে।ঝনঝন শব্দে আরশাদ ছুটে এলো দরজা খুলতে দেখতে পেল খুশবু মুখ লুকিয়ে কাঁদছে।
দ্রুত রুমের বাতি জ্বালিয়ে বিছানায় বসলো আরশাদ।
” ফ্লুজি কি হয়েছে?কাঁদছো কেন?”
আরশাদকে পেয়ে খুশবুর সাহস বাড়লো দ্রুত হাতে জড়িয়ে ধরলো আরশাদকে,
” আপনি কোথায় ছিলেন আরশাদ।আমি ভয় পেয়েছিলাম।এভাবে রুম অন্ধকার কেন করেছেন?”
” তোমার চোখে আলো এলে ঘুম ভেঙে যাবে জান তাই তো অন্ধকার করলাম।ভয় পায় না আমি আছিতো।”
খুশবু স্থির হলো।আরশাদ উঠে গিয়ে অন্ধকার রুমটায় আলো ফিরিয়ে আনলো।বড় বড় পর্দা সরিয়ে খুলে দিল বড় জানলা।তার জানলা থেকে বাইরের এই দৃশ্যটা ভীষণ সুন্দর।আরশাদ হাত ইশারায় ডাকলো তার ফ্লুজিকে।জানলার কাছে দাঁড়াতে হীম হয়ে এলো দুজনের শরীর।খুশবু যখন আবেশিত নয়নে তাকিয়ে দেখছে বাইরের দৃশ্য আরশাদ তখন তার পেছনে দাঁড়িয়ে।
” সুন্দর না?”
” হুম।অন্যরকম সুন্দর।”
আরশাদ হাত বাড়ালো খুশবুর উদরে, থুতনি রাখলো মেয়েটার কাঁধে।
” এখন কয়টা বাজে আরশাদ?”
” সকাল এগারোটা জান।”
আরশাদ তাকে কোলে তুলে নিল ওয়াশরুমে গিয়ে দাঁড় করালো ফ্লুজিকে।দ্রুত হাতে ঝরনার নব ঘুরাতে ভিজে গেল মেয়েটার সমস্ত দেহ।খুশবু অবাক হলো চোখ বড় করে আরশাদের দিকে তাকাতে ছেলেটা কিঞ্চিৎ হাসলো,
” ড্রেস রেডি রেখেছি দ্রুত শাওয়ার শেষ করে বেরিয়ে এসো একসাথে নাস্তা করবো।বাই দা ওয়ে আমি কি জয়েন করতে পারি?”
আরশাদের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত দরজা বন্ধ করলো খুশবু।মেয়েটার কান্ডে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল আরশাদ।
.
ব্রেকফাস্ট আরশাদ আর খুশবু তাদের নিজের ভিলায় করছে।আরশাদের হাতে বানানো স্যান্ডউইচ এবং গরম গরম কফিতে চুমুক দিচ্ছে খুশবু এর মাঝে আরশাদ বলে,
“আগামীকাল ডিনার’টা আমার বন্ধুদের সাথে করবো ঠিক আছে?তারা তোমাকে নিয়ে ভীষণ এক্সাইটেড।”
” সবাইকি ছেলে আরশাদ?”
” হুম।”
” তাহলে আমি যাব না।”
” কিন্তু কেন?”
” সব ছেলের মাঝে আমার ইরেটেটিং ফিল হবে।প্লিজ আমাকে জোরাজোরি করবেন না।”
” তাদের গার্লফ্রেন্ডরাও আসবে প্রবলেম হবে না।”
” তারা তো বাঙালি নয়।যেকোন পরিস্থিতিতে আমার নিজেকে মানাতে সময় লাগে প্লিজ বোঝার চেষ্টা করুন।”
“ওকে জান।”
আরশাদ পুনরায় খাবারে মনোযোগ দিল।তাকে ফোঁড়ন কেটে খুশবু বলে,
” তাদের সবার গার্লফ্রেন্ড আছে আপনার নেই?”
” ছিল,আছে এবং থাকবে।দেখতে চাও?”
খুশবু ভ্রু কুচকালো।আরশাদ তার চেয়ার টেনে আরো কাছে আনলো।খুশবুর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা নসিলা আরশাদ নিজের ঠোঁটের দখলে নিল।স্তব্ধ পরিবেশটাকে আরো স্তব্ধ করে দিল দুজনে। সারাটা ঘরে কোন কথার শব্দ নেই শুধু পাওয়া যাচ্ছে দুটি মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ।খুশবুর দূর্বল শরীরটা আরশাদের দখলে যাওয়ার আগে আরশাদের বুকে হাত রেখে মৃদু ধাক্কায় সরিয়ে দেয় খুশবু।
” আমাদের গ্র্যানির কাছে যাওয়া উচিত আরশাদ।তারা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে।”
” পালাতে চাইছো?”
” একদমি না।”
” সত্যি?”
” সত্যি।”
” ওকে।গেট রেডি ফর দা নাইট,জান।”
” নো।”
” ইয়েস।”
চলবে….