#ফ্লুজি
#অনুপ্রভা মেহেরিন
[পর্ব ১]
__________
” আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে বিয়ে করে নেবে আর আমি কিচ্ছু জানতে পারবো না?খুব সহজ বুঝি?দেখলে তো সময় মতো এসে কিভাবে বিয়েটা ভেস্তে দিলাম।”
গায়ের ভারি লেহেঙ্গা নিয়ে ঘরের এক কোণে বিধস্ত অবস্থায় বসে আছে খুশবু।তার সামনে থাকা মানুষটি কেমন ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলে যাচ্ছে।এই পুরুষটি যে দেশি নয় তা এক পলকেই বুঝতে পারলো সে।মেয়েটার শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম থেকে রক্ত বেরিয়েছে সেই রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধেছে দীর্ঘক্ষণ।কৌতুহল নিয়ে খুশবু প্রশ্ন করে,
” আপনি কে?”
” তোমার জম।”
চমকে গেল খুশবু।আজ তার বিয়ে।বাবা মায়ের পছন্দ করা পাত্রের সহিত তার বিয়ে হচ্ছে এই বিয়ে নিয়ে কম স্বপ্ন বুনেনি সে।বাবা মাও একমাত্র মেয়ের বিয়েতে কোন কার্পণ্য করেনি।মেহেদী,হলুদ,অনুষ্ঠান শেষে আজ তার স্বপ্নের দিন অর্থাৎ বিয়ের দিন অথচ পার্লার থেকে ফেরার পথে তাকে তুলে আনা হয়েছে।
খুশবুর গলা শুকিয়ে চৌচির তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা।এখন বিকাল না সন্ধ্যা নাকি রাত এসেছে ধরণিতে সে তাও জানে না।অদ্ভুত এক প্রহেলিকায় ফেঁসেছে সে।
” পা…পানি দিন দয়া করে।”
বদ্ধ ঘরে থাকা পুরুষটি কুটিল হাসলো।উঠে গিয়ে অন্য কক্ষ থেকে একটি গ্লাস এনে খুশবুর মুখে ধরলো।পানি ভেবে ঢকঢক করে গিলে নিলো মেয়েটা।কিন্তু এই পানি যে পেটে যায় না অদ্ভুত এক স্বাদে মুখ থেকে সবটা উগড়ে দিল খুশবু।
” টেস্টলেস?”
” এটা কি ছিল?”
” এমন কিছুই ছিল যেটা তুমি পান করতে পারবে না।”
” আপনি কে?কেন করছেন আমার সাথে এমন।”
” তোমার সাথে এতক্ষণ যাবৎ যা যা করছি সবটাই ভালো করছি।এই মেয়ে তোমার সাথে তো আরো খারাপ কিছু করার দরকার ছিল।”
সম্মুখে থাকা লোকটির নাম আরশাদ।শেষোক্ত বাক্যটি বলে আরশাদ উত্তেজিত হয়ে পড়লো।পাশে থাকা চেয়ারটি পদাঘাতে সরিয়ে হাটু গেড়ে বসলো খুশবুর সামনে।
” বেইমান কোথাকার বেইমান নারী।”
” আমি কি করেছি? আপনি আমার সাথে এমনটা কেন করছেন?”
” এই এই আওয়াজ নিচে।”
খুশবুর মুখ চেপে ধরলো আরশাদ।তার চোখে যেন আগুনের ফুল্কি ধরছে দাঁতে দাঁত চেপে হিংস্রতা অবয়ে তাকিয়ে আছে খুশবুর পানে।এতক্ষণে আরশাদের চোখে চোখ রাখলো খুশবু।সুপুরুষটির বাদামি চোখের মনিতে ধরা দিয়েছে হিংস্রতা।চামড়ায় যেন এক কৌটা শ্বেত রঙ ঢেলে দিয়েছে কেউ।বাদামি চুলগুলোতে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে দু’একটা কালো চুল।
” কি এমন আছে তোমার মাঝে?যার জন্য আমাকে ছুটে আসতে হয়েছে এতদূর!চাইলে কি সবটা বোঝাপড়ায় ভালো হতো না।”
খুশবু ধাক্কা দিল আরশাদকে।প্রচন্ড ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেল সে।
” ক..কে আপনি?কিসব বলছেন?কি বোঝাপড়া করবেন আপনি?আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসুন আমার বাবা মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
খুশবু ভারী লেহেঙ্গা সামলে উঠে দাঁড়ালো।আরশাদকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে পালাতে চাইলে, পেছন থেকে তার দোপাট্টা টেনে ধরে আরশাদ যার দরুনে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে খুশবু।বেফাঁসে পড়ায় মারাত্মক ব্যথা পায় সে নিরবতা ছিন্ন করে হুহু শব্দে কেঁদে উঠলো মেয়েটা।তার কান্নায় হাসলো আরশাদ।দোপাট্টা ছেড়ে এগিয়ে বসলো খুশবুর কাছাকাছি।
“আটাশ দিন তল্লাশি চালিয়ে তোমাকে খুঁজে বের করেছি আর এক নিমিষে পালিয়ে যাবে!এত সহজ?জানো কয় চোখের পাহারায় আছো তুমি?মেয়ে তোমার কল্পনার বাইরে।”
” আমি করেছি কি?উন্মাদের মতো ব্যবহার করছেন আপনি।”
” উন্মাদ?হোয়াট?”
ভ্রু জোড়া সংকুচিত হলো আরশাদের।উন্মাদ শব্দের অর্থবহ’টা তার হয়তো জানা নেই।এমনিতে আরশাদের ভাঙা ভাঙা এলোমেলো উচ্চারণের বাংলা কথা শুনলে যে কারো মাথা ধরে যাবে।খুশবু ঘন ঘন শ্বাস নিলো যে করে হোক লোকটার সাথে তার বোঝাপড়া করতে হবে।
” আপনি কি চাইছেন?প্লিজ আমাকে বলুন।”
” আমি চাই তুমি বিয়ে করতে পারবে না ফ্লুজি।”
” ফ্লুজি!ফ্লুজি মানে।”
” এমন একটা অভিনয় চলছে যেন ফ্লুজি নামে তোমায় কেউ আগে ডাকেনি।”
” আমি বিয়ে করতে পারবো না কেন আগে সেটা বলুন।”
” এখন ওসব কথা বলতে চাই না।তোমার জন্য এতটাও সময় আমি বরাদ্ধ রাখিনি।যাই হোক আমি লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি ড্রেস চেঞ্জ করে নেবে।কাটা ছেড়া আঘাতপ্রাপ্ত স্থানের যত্ন নেবে।যা যা বলেছি ঠিক তাই তাই করবে এর বাইরে যদি নড়চড় হয় তবে তোমার কপালে দুঃখ আছে ফ্লুজি।”
হতভম্ব নয়নে আরশাদের পানে তাকিয়ে আছে খুশবু।কি এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে আটকে আছে সে।কে এই লোকটা?একবার বলছে ফ্লুজি,আবার বলছে বিয়ে করতে পারবে না।কেন ভাই কে তুই?কেন এলি আমার জীবনের সর্বনাশ হয়ে?এই অপ্রত্যাশিত আগমন আমার জীবনে যে ঝড় তুলে দিয়ে গেল এর শেষ কোথায়?
আরশাদ বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আগমন ঘটে একজন নারীর।মহিলাটির পরনে সাদা শাড়ি।উনার পরিপাটি সাজগোজ কথার বচন ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে এই মানুষটা প্রফেশনাল।খুশবু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো মানুষটার পানে।
” ম্যাডাম আপনার ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে।আমার হাত ধরে উঠে আসুন।”
” আপনি কে?”
” আমি আনজুম এখানকার একজন কর্মচারী।যতদিন আপনি এখানে আছেন আপনার দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত করেছেন আরশাদ স্যার।”
” আরশাদ!আরশাদ কে?”
” একটু আগে যিনি এই ঘর থেকে বের হলেন উনি আরশাদ স্যার।আপনার জন্য জামা কাপড়ের ব্যবস্থা আছে উঠে আসুন ম্যাডাম।”
” আগে বলুন এখন কয়টা বাজে?”
” এসব ইনফরমেশন আপনাকে দেওয়া বারণ।আপনার কক্ষের জানলাও খোলা বারণ স্যারের নিষেধ আছে।”
খুশবু ভারী লেহেঙ্গা জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো।শরীরের বিভিন্ন স্থানে তার জখমের চিহ্ন।পোশাক পালটে মেকাপ তুলে নিজেকে স্থির করার চেষ্টা চালালো সে।পেটের ভেতর ইদুর ঘুরছে সেই সকালে খেয়েছে আর তো তার খাওয়া হয়নি।আচ্ছা বাবা মা এখন কী করছে?বর যাত্রীরা কি তাদের খুব বেশি কথা শুনিয়েছে?এসব কথা ভাবতেও কেঁদে ফেললো খুশবু।বাবা মা তাকে যতটা ভালোবাসা দিয়েছে এই পৃথিবীর কেউ আর তাকে কখনো এতটা প্রায়োরিটি ভালোবাসা দেয়নি।স্বভাব সুলভ খুশবু ইন্ট্রোভার্ট মেয়ে তাই খুব বেশি মানুষের সাথে তার সখ্যতা নেই।তার পৃথিবীতে এই দুটো মানুষের বিচরণ সবচেয়ে বেশি।
আনজুম খুশবুর জখম স্থানগুলো পরিষ্কার করে মলম লাগালো।সাথে নিয়ে আসা খাবার সম্পূর্ণটা শেষ করতে তাকে বাধ্য করলো।যদিও খুব বেশি খেতে চাইলো না সে কিন্তু এই কতক্ষণে খুশবু বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলো আনজুম নামের ব্যক্তিটি নাছোড়বান্দা স্বাভাবের।
কাজ শেষে আনজুম প্রস্তান করলো।খুশবুর ভয় যেন আরো বাড়লো।সম্পূর্ণ কক্ষটা সে জহুরি চোখে পর্যবেক্ষণ করলো। আলিশান একটি কক্ষ প্রতিটি আসবাবপত্র কেমন যেন চকচক করছে।আরশাদ নামের মানুষটাকি এই বাড়ির মালিক!তবে তো তিনি বেশ ধনী।আচ্ছা উনি তো বাঙালি না উনার মাঝে বাঙালির ছিটে ফোটাও নেই সম্পূর্ণ ভিনদেশী।তবুও আরশাদ যেন বেশ কষ্টেই বাংলা বলে।তার এই বাংলা বলার ধরণ দেখে ভীষণ হাসি পাবে যে কারো কিন্তু খুশবু তো এখন হাসতে পারবে না তার যে ভীষণ কান্না পাচ্ছে।মায়ের কথা মনে পড়ছে।একাকিত্ব,ভয়,সংশয় ঘিরে ধরেছে তাকে।আগামী দিনে কি হবে?কেন হবে?সবটাই ঘুরঘুর করছে তার মাথায়।দরজা খোলার শব্দে চমকে গেল খুশবু।আরশাদ এসেছে গায়ের টিশার্ট’টা কেমন আঁটসাঁট ভাবে বেঁধে আছে ছেলেটার গায়ে।
” হেই কেমন লাগছে তোমার ফ্লুজি? ”
এই মুহূর্তে আরশাদকে ভীষণ ভয় লাগলো খুশবুর।কেমন করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
” ভ..ভালো।তবে কাজের কথায় আসুন, আমাকে এখানে আটকে রেখেছেন কেন?”
সাহস নিয়ে প্রশ্ন করলো খুশবু।আরশাদ ভ্রু নাচিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো।
” সিরিয়াসলি আমাকে তুমি চিনতে পারছো না?”
” কে আপনি?আপনাকে আমি কেন চিনবো?আপনি কোন হিরো?”
” প্রয়োজনের বাইরে বেশি কথা বলা আমি পছন্দ করি না ফ্লুজি।যাই হোক তোমাকে এখানে আনার একটাই উদ্দেশ্য তোমার বিয়ে ভেঙে দেওয়া।আমার কষ্ট দিয়ে যে ভুল তুমি করেছো এর শাস্তি তোমায় পেতেই হবে।”
” আমি আবার কাকে কষ্ট দিলাম?”
আরশাদ এবার বেজায় রেগে গেল।সামনে থাকা কাচের টেবিলটি পদাঘাতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল মেঝেতে।কাচ ভেঙে সারা মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
” গ্র্যানি ঠিকি বলে বাঙালি নারীরা অভিনয়ে পটু।এরা এমন ভাবে বশ করতে জানে একটা পুরুষের হৃদয়টাকে অবশ করে ছেড়ে দেয়।”
” এই গ্র্যানিটা আবার কে?”
নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছিল আরশাদ।কিন্তু তার ফ্লুজির বুঝেও না বোঝার ভান করার স্বভাবটা তার মোটেও সহ্য হলো না।মেঝে থেকে ভাঙা বড় একটি কাচের টুকরো হাতে তুলে অগ্রসর হলো খুশবুর পানে।ভয়ে দু’কদম পেছাতে গিয়ে বিছানাত হুমড়ি খেয়ে পড়লো সে।আরশাদ বাঁকা হাসলো।ধীরে ধীরে খুশবুকে আড়াল করলো তার চওড়া শরীরের আদলে।খুশবুর ছোট্ট শরীরটা চাপা পড়লো আরশাদ নামক পাথর মানবের নিম্নে।কাচের খন্ডটা খুশবুর গ্রীবায় চেপে ধরলো আরশাদ,তৎক্ষনাৎ চামড়া কেটে রক্তের দেখা মিললো।তীব্র ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করলো খুশবু তাতে আরশাদের হেলদোল হলো না।সে উঠে গিয়ে তুলা এবং ব্যান্ডেজ এনে লাগিয়ে দিল খুশবুর কাঁদে।
” তোমার এই ঘাড় ত্যারামো স্বভাবটা বদলালে আমরা সুখি হতাম ফ্লুজি।”
” কিসব বলছেন আমরা কেন সুখী হবো?কে আপনি?”
” তোমার হেমলোক।”
_চলবে?