ফুলশয্যা(সিজন-০২) পর্ব- ১৩

0
2883

ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ১৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

সাইমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নীলিমা আবিরের দিকে ফিরে তাকায়। আবির তখনও হা করে দাঁড়িয়ে বিষয়টা কি হয়েছে বুঝার চেষ্টা করছে।
এদিকে নীলিমা?!!!
রাগান্বিত দৃষ্টিতেই সাইমার দিকে তাকিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে টেনে তুলে দাঁড় করায়। সাইমা কিছু বলতে চাইছিল তার আগেই ঠোঁটের সামনে আঙ্গুল খাড়া করে চুপ করার জন্য ইঙ্গিত করে নীলিমা। সাইমা চুপ হয়ে নীলিমার দিকে তাকিয়ে আছে। নীলিমা সাইমার দু’বাহু ঝাকিয়ে বলা শুরু করে_
” এই মেয়ে! পৃথিবীতে এত ছেলে থাকতে তুই কেন একটা বিবাহিত ছেলের পিছনে লেগেছিস? এসব করে কি লাভ তোর? তোর এতে কি স্বার্থ লুকিয়ে আছে? কেন তুই এভাবে আমার বরের পিছনে লেগেছিস? কেন তুই অন্যের সম্পদের দিকে এভাবে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিস? নূন্যতম লজ্জাবোধও কি তোর মধ্যে নেই? ধূর! কাকে কি বলছি….?!!!
নীলিমা সাইমার দিকে একটু দুরে সরে যায়। তারপর আবারো বলতে থাকে,
নৈতিকতার যে শিক্ষা মানুষ তার পরিবার থেকে পায় সেটা মনে হয় তোর পরিবার তোকে দিতে পারেনি। তাই তোর এ অধঃপতন। তুই আসলে….(……)….???”

পুরো কথা বলতে পারেনি নীলিমা। তার আগেই রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায় সাইমা। পিছন থেকে ডাকতে থাকে নীলিমা-
” ঐ শয়তান মাইয়া! চলে যাচ্ছিস কেন? শুনে যা আরো কিছু কথা। যে শিক্ষা তোর পরিবার তোকে দিতে পারেনি সেটা আমার থেকে নিয়ে যা। বজ্জাতের হাড্ডি, কি হলো চলে যাচ্ছিস কেন?”

কথাগুলো বলতে বলতেই পিছনে তাকায় নীলিমা। আবিরের চক্ষুদ্বয় রাগে রক্তবর্ণ ধারন করেছে। যেই রেগে তেড়ে আসছিল নীলিমার দিকে, তখনি নীলিমা বলে উঠে-
” খবরদার! একদম সামনে আসবি না। এই মুহূর্তে তোর ছায়া পর্যন্ত আমি সহ্য করতে পারছি না। অনেক সহ্য করেছি। আর নয়! এই মেয়ের সাথে কিসের এত পিরিত তোর? ও কেন তোকে কিস করবে? চুল আচড়িয়ে দিবে? কোন শার্ট পরবি সেটা সিলেক্ট করে দিবে, ও কেন তুই কোন জুতা পরবি সেটা বের করে রাখবে? টাই বেঁধে দিবে? ও কেন তোর জন্য একেকদিন একেক রেসিপি তৈরি করে আনবে? কি হয় ও তোর? বউ?!!! তবে আমি কি??? কেন আমায় বিয়ে করলি? ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখার জন্য???”

গর্জে উঠে আবির।
Hey you! Listen…..(……)………
মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলে উঠে নীলিমা, চুপ! একদম চুপ। এটা তোর ক্লাস নয়, বেডরুম। সো, একদম লেকচার দিতে আসবি না। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে! বের হয়ে যাবে সুন্দর এই মুখটার আড়ালে লুকায়িত খোলস।

নীলিমা স্টাডিরুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দেয়। আবির ওর পরনের পাঞ্জাবী’টা খুলে ফেলে দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে হাতটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারে। তারপর দরজাটা টান দিয়ে বাইরে বের হয়। দরজা মিশছিল না দেখে দরজায় একটা লাথি মেরে নিচে সাইমার রুমের দিকে পা বাড়ায়।

” সাইমা! দরজা’টা খুল। প্লিজ, সাইমা দরজাটা খুল। লক্ষ্মী বোন আমার প্লিজ দরজাটা খুল…..”
কথাগুলো বলে আবির যখন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল তখন পিছন থেকে কেউ একজন আবিরের পিঠে টোকা দেয়। পিছন ফিরে তাকায় আবির। ঝালমুড়ি হাতে সাইমা দাঁড়িয়ে।
চমকে যায় আবির-
” তুই? তাহলে ভিতরে কে?”
ঝালমুড়ি খেতে খেতে সাইমা বলে,
কেউ নেই। দরজায় তালা ঝুলানো আছে কানা। আবির দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে জোরেশোরে নিশ্বাস ফেলে।
” উফফ!”
পাশ থেকে সাইমা বলে উঠে,
নাও! ঝালমুড়ি খেয়ে মাথা ঠিক করো…..
আবির সাইমার হাতদুটো চেপে ধরে। প্লিজ বোন আমার, আমায় মাফ করে দে।
সাইমা চেঁচিয়ে উঠে,
আরে আরে ভাইয়া! কি করছো এসব? ঝালমুড়ি তো পরে যাচ্ছে…..!!!
যাক আমি তোকে আবার কিনে দিব।
তুই প্লিজ বল আমায় মাফ করছিস কি না।
করুণ চোখে আবির সাইমার দিকে তাকিয়ে বার বার একই আকুতি করে যাচ্ছে। সাইমা অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, আমি তোমাকে ছুঁয়ে বলছি ভাইয়া!
আমি তোমার বউয়ের কথায় কিচ্ছু মনে করিনি। আর একটা বাচ্চা মেয়ের কথায় এতকিছু মনে করার’ই বা কি আছে?
আবির সাইমার হাত ছেড়ে দেয়। রাগান্বিত গলায় বলে উঠে, ভাবের বাচ্চা ও। ও তো আসলে একটা পাগল। উন্মাদ হয়ে গেছে ও। সবকিছু পেয়েও হারিয়ে ফেলেছে ও। সেই জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে ও…..
পাশ থেকে সাইমার জবাব, উন্মাদ!
হ্যা, উন্মাদ হয়ে গেছে ও। তবে সেটা ভুলের জন্য নয় তোমার ভালোবাসার জন্য। তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। তোমাকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারে না সেই জন্য…..
উত্তেজিত হয়ে আবির বলে উঠে,
তাই বলে ও আমার সাথে এরকম বাজে ব্যবহার করবে? এটা কিরকম ভালোবাসা সাইমা???
ঝালমুড়ির কাগজটা হাতে মুড়ে দুরে সরে ফেলে দিয়ে সাইমা বলে উঠে,
এটাই ভালোবাসা ভাইয়া!
খাঁটি ভালোবাসা….
মেয়েরা সবকিছু সহ্য করতে পারে কিন্তু নিজের স্বামীর পাশে অন্য কাউকে দেখতে পারে না। কারণ, ওরা স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে রাজি নয়।

ওকে ফাইন!
মেনে নিলাম তোর সব কথা। ও আমার পাশে তোকে সহ্য করতে পারেনি তাই আজ আমাকে যাচ্ছে তাই কথা শুনিয়েছে। কিন্তু ঐ সময়..?!!!
দুই বছর আগে ও কেন আমার সাথে এমন করেছিল? কেন আমায় চরমভাবে অপমান করে চলে গিয়েছিল? ঐদিন তো আমার পাশে কেউ ছিল না। তবে কেন আমায় এভাবে…..(…..)…..???

আবিরকে থামিয়ে সাইমার জবাব,
হতে পারে দুই বছর আগে কেউ ছিল না, কিন্তু তারও আগে হয়তো কেউ ছিল,
থাকতে পারে…..
হাত উঁচু করে আবির,
একমিনিট! তুই কার কথা বলছিস???
জবাব আসে, সেটা তো তুমি’ই ভালো জানো ভাইয়া। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছো?
উতলা কন্ঠে আবির বলে, হেয়ালি রেখে বল তুই খোচা মেরে কার কথা বলছিস? দুই বছর আগে কে ছিল আমার জীবনে?
সাইমা আবিরের সামনে গিয়ে উত্তর দেয়, সেটা রাত্রি নয়’তো???

আবিরের সুন্দর মুখটা মুহূর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ঢোক গিলে বলে,
” তুইও ওর কথা….(….)….???”
ক্ষাণিক হেসে জবাব দেয় সাইমা,
সবাই জানে আমার জানতে অসুবিধে কোথায়? কিছু মনে করো না রাত্রিকে রাত্রি বলে ডাকছি সে জন্য। আসলে ওকে আপু বলতেও আমার ঘৃনা করে। এমন একটা মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পাওয়ার পরও যে এত্ত বড় বেইমানি করতে পারে সে আর হোক আমার বোন হতে পারে না। আমার আপু হতে পারে না। ইন্ডিয়া থেকে এসে যখন শুনলাম ও তোমার আর ওর বিয়ের কথা বলে, গহনা কিনার কথা বলে ৪লক্ষ টাকা নিয়ে এক্স বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে পালিয়ে গেছে তখন কতটা কষ্ট যে পেয়েছি সেটা ঐ আল্লাহ জানেন! আমি তখন প্রতিদিন নিজেকে তোমার জায়গায় দাঁড় করাতাম, তোমার কষ্টটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করতাম। তোমাকে দেখলে আমার গর্ব হতো এতকিছুর পরও তুমি আমাদের সাথে সম্পর্ক রেখেছ। তোমার প্রতি শ্রদ্ধাটা তখন থেকেই বেড়ে গেছে। আর ঐ রাত্রির প্রতি ঘৃণাটা দিনকে দিন গাঢ় হয়েছে। তখন থেকেই দোয়া করতাম আমি, আল্লাহ যেন মানুষটার সাথে ঐরকম মানুষকেই মিলিয়ে দেয়। আর আল্লাহর অশেষ রহমতে পেয়েও গেছ। যেন এক হীরক খন্ড। একটা কথা কি জানো….(……)….???

পিছনে তাকিয়ে থেমে যায় সাইমা।
কারণ, আবির ততক্ষণে উদাও হয়ে গেছে।

৪,৫দিন পরের কথা__
সেদিন বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে আবির। ততক্ষণে নীলিমা চেম্বার থেকে বাসায় ফেরে। ক্লান্ত নীলিমা যখন বিছানায় গা টা এলিয়ে দেই তখনি দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় আবির-
” আদিবা ফোন দিয়েছিল। ও আসছে, আজকে আপনি আমার রুমে ঘুমোবেন।”

নীলিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পরে। রেডি হয়ে চলে যাচ্ছিল আবির। ফিরে আসে। দরজার কাছ থেকে বলে-
” বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে যাচ্ছি। ফিরতে একটু রাত হবে। আপনারা খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পরবেন।” এবারো নীলিমা পুরো কথাটা শুনে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে।

রাত্রি ৯টার দিকে আবিরের বোন আদিবা ওর ছেলে আদিত্যকে নিয়ে আবিরের বাসায় আসে। অবাক হয়ে নীলিমা প্রশ্ন করে, সেকি আপু! দুলাভাই আসে নি? মুখটা কালো করে উত্তর দেয় ননাস আদিবা, আর বলো না! ওর হসপিটাল থেকে জরুরী ফোন এসেছে। তারপর কি হয়েছে জানি না। ফোনটা কান থেকে নামিয়েই সবার থেকে বিদায় নিয়ে বিয়ে না খেয়েই চলে গেল। ওর মামা এজন্য অনেক রাগ দেখালো।
নীলিমা ননাস আসার পর থেকেই টেবিলে হরেক রকমের খাবার সাজিয়ে ফেলে। আদিবা হেসে বলে, ওরে পাগলি মেয়ে! এসব কেন করতে গেলা? পেটটা আমার একদম ভরা। পেটে জায়গা খালি নেই একটুও। এদিক দিয়েই নাকি তোমার দুলাভাই যাবে, তখন নিয়ে যাবে আমাদের মা ছেলেকে। মা ছেলেকে তাই এখানে ওয়েট করতে বলছে। ও আসলেই আমরা চলে যাব…..
” ওহ! চলে যাবেন? নীলিমার মুখটা কালো হয়ে গেল….”
একটা হাসি দিয়ে ননাসের জবাব,
যাও তো! আলমারি থেকে বিয়ের শাড়িটা নিয়ে আসো তো। দেখি বাচ্চা নীলিকে বউয়ের সাজে কেমন লাগে….!!!
বলা মাত্র’ই নীলিমা দৌঁড়ে গিয়ে একটা লেহেঙ্গা নিয়ে আসে।
ভ্রু কুঁচকে ননাসের জবাব,
সেকি! লেহেঙ্গা কেন???
নিচের দিকে তাকিয়ে নীলিমার জবাব,
” এখানে তো শাঁড়ি নেই। লেহেঙ্গা’টাই আছে।”
মুচকি হেসে ননাস আদিবার জবাব, সমস্যা নাই। এটাও লাল রঙের’ই। তাড়াতাড়ি কয়টা মুখে দিয়ে জটপট লেহেঙ্গা’টা পরে আসো। সাজাতে হবে তো। নীলিমা ডিনার সেরে নিয়ে তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে লেহেঙ্গা’টা পরে আসে। আদিবা নীলিমাকে ওর সামনে বসায়। হাতে লাল রঙের চুড়ি, চোখে গাঢ কালো কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে আদিবা নীলিমার চুলগুলো খোঁপায় বেঁধে দেয়। তারপর নীলিমাকে আয়নার সামনে দাঁড় করায়। আয়নায় নিজেকে নিজে দেখেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে নীলিমা। আহ্লাদী স্বরে আদিবা বলে উঠে, ওলে পুতুলবউ’টা লজ্জা পেয়েছেরে…..

ফোন বেজে উঠে আদিবার। কলটা রিসিভ করে কথা বলে। কান থেকে ফোন নামাতে নামাতে নামাতেই বলে, তোমার দুলাভাই এসে গেছে। যেতে হবে এখন। তাড়াতাড়ি এখানে একটু দাঁড়াও। কয়টা ছবি তুলি। নীলিমা ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আদিবা বিভিন্ন এঙ্গেলে নীলিমার অনেকগুলো ছবি তুলে নেয়। তারপর আদিত্যকে ধরে টান দিতেই বলে, দাঁড়াও আম্মু! আদিত্য ওর কাঁধে রাখা ব্যাগটা থেকে এক বিরাট গাধাফুলের মালা বের করে। আরো বের করে অনেকগুলো গোলাপ। এগুলো সে কান্নাকাটি করে ঐ বিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল। অথচ এখন অনায়াসে সেই ফুলগুলো একটা একটা করে ছিঁড়ে আবিরের বিছানায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। নীলিমাকে টানতে টানতে বিছানায় বসিয়ে ওর উপরও অনেকগুলো পাপড়ি ছড়িয়ে দেয়। তারপর মায়ের কাছে গিয়ে হাত তালি দিতে দিতে বলে, আজকে মামার বিয়ে! কি মজা, কি মজা….
লজ্জায় মাথানিচু করে ফেলে নীলিমা।আদিবা হেসে দেয়। মুচকি হেসে ছেলেকে কোলে নিয়ে নীলিমার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।

তারপর এলো সেই রাত……..

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে