ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ১২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
দুপুর হয়ে গেছে তা সত্ত্বেও বিছানা থেকে উঠেনি নীলিমা। সকাল থেকে একটার পর একটা বিরহের গান গেয়ে’ই যাচ্ছে সে। যদিও গান গাইলে ওর মন ভালো হয়ে যায়, তবে আজ কেন জানি গানেও কাজ হচ্ছে না। নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে নীলিমা। আর অঝোরে চোখের জল গড়িয়ে নিচে পরছে। বার বার আবিরের বলা রাত্রের কথাগুলো ওকে পীড়া দিচ্ছে, ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে ভেতরটা।
রাত্রে অনেক রিকোয়েস্টের পর আবির নীলিমার পাশে শুয়েছিল। আবির নীলিমার ঠিক বিপরীতমুখী হয়ে শুইলেও নীলিমার স্পর্শে ঘুমের মধ্যে সোজা হয়ে যায়। কেন জানি নীলিমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আবিরের বুকে মাথা রাখতে। ঐ বুকে কান পেতে শুনতে হৃদস্পন্দনগুলো কার কথা বলে? ওর নাকি রাত্রির? যার কথা আবির ওর ডায়েরীর প্রত্যেকটা পাতায় লিখে রাখছে। মনে পড়ে নীলিমার, আবির ওর ডায়েরীর প্রথম পাতায় লিখেছিল__
” আমার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন যার কথা বলে সে রাত্রি। আমার প্রথম প্রেম রাত্রি। আমার প্রথম ভালোবাসা রাত্রি।”
আচ্ছা, ও তো এখন ঘুমিয়ে’ই আছে। হৃদস্পন্দন একটু একটু করে উঠা-নামা করছে। এখন তো আমার ওর বুকে মাথা রাখতে কোনো বাধা নেই। আমি তো এখন কান পেতে শুনতে পারি ওর নিশ্বাস-প্রশ্বাস কার কথা বলছে!
নীলিমা আবিরের বুকে মাথা রেখে খুব করে শুনার চেষ্টা করছে আবিরের নিশ্বাস ঠিক কার কথা বলছে?!
কিন্তু পারছে না নীলিমা। শত চেষ্টার পরও নীলিমা শুনতে পায়নি রাত্রি নাম। তবে কি ও আমায়….(….)….???
না, না….!!!
ও তো রাত্রিকেই ভালোবাসে। ডায়েরীতে তো সেটাই লিখল। আচ্ছা, আরেকটু ভালো করে শুনে দেখি তো…..!!
নীলিমা কাঁপা হাতে আবিরের পরনের শার্টের বোতামগুলো একটা একটা করে খুলে ফেলে। মাথা রাখে আবিরের প্রশস্ত বুকে। কান পেতে শুনার চেষ্টা করে ঐ বুকে কে আছে….?!!!
এবারো ব্যর্থ হয়, হাফিয়ে উঠে নীলিমা। ক্লান্ত নীলিমা আবিরের লোমশ বুকে মাথা রেখে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। নড়ে উঠে আবির। মাথা তুলে তাকায় নীলিমা। চোখ যায় আবিরের বুকের প্রশস্ত লোমগুলোর দিকে। ছোট বেলায় দাদির মুখে নীলিমা শুনেছে, বুকে লোমওয়ালা লোকদের নাকি দয়া-মায়া বেশী থাকে। চোখের পানি মুছে নীলিমা আবিরের বুকের লোমগুলোর সাথে এক খেলায় মেতে উঠে। আবিরের বুকের প্রশস্ত লোমগুলোতে নীলিমা ওর হাত বুলাতে থাকে। একবার লোমগুলো হাত দিয়ে শুইয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে তো আবার বিপরীতমুখী থেকে হাত বুলিয়ে লোমগুলো দাঁড় করাচ্ছে। এ এক অদ্ভুত খেলা…!
হঠাৎ’ই আবিরের ঘুম ভেঙে যায়। মনে হচ্ছে বুকের ভিতর কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চোখ মেলে তাকায় আবির। নীলিমা তখনো আপনমনে আবিরের বুকে হাত বুলিয়েই যাচ্ছে। বুক থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় আবির নীলিমাকে। খাট থেকে উঠে বসে নীলিমা। ভীরু ভীরু চোখে আবিরের দিকে তাকায়। প্রচন্ড রাগ উঠে যায় আবিরের। খাট থেকে নিচে নেমে পরে। তারপর রাগান্বিত দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কি মনে করো তুমি নিজেকে? যখন খুশি আমায় লাথি মেরে ফেলে দিবে আবার যখন খুশি বুকে জড়িয়ে নিবে? আমাকে কি তোমার হাতের পুতুল মনে হয়? যখন যেভাবে বলবে, সেভাবেই নাচব আমি??? যদি এসব ভেবে থাকো না, তাহলে ভুল ভাবছো, ভুল….!!!
আমাদের মাঝে যে প্রাচীর তুমি তৈরি করে দিয়েছ তা কখনো ভাঙবার নয়। আর সে প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে তোমার আমার কখনো একত্রিত হওয়াও সম্ভব নয়। So, don’t cross your limit….
সেই যে আবির চলে গেল রুম থেকে, তারপর থেকে নীলিমা রুমে পরে আছে। সারা রাত্রি বালিশে মুখ লুকিয়ে কেঁদে সকাল থেকে বিরহের গান গাওয়া শুরু করছে…..
কলেজে গিয়েছিল আবির। দুপুরে বাসায় চলে আসল। ইতিহাসের শিক্ষক মামুন স্যারের বিয়ে ঠিক হয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষক তাদের নিজ নিজ সহধর্মীনিদের নিয়ে তৈরি হয়ে চলে আসছে। আবির’ই কেবল তৈরি হয়নি। তাই বেলা ১২টায় আবিরকে বাসায় পাঠানো হয় নীলিমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আবির যখন রুমে ঢুকে নীলিমা তখনো আপনমনে গান গাচ্ছে,
” দুরে কোথাও যাব চলে
যদি না মনের দোয়ার রাখো খুলে,
দুরে কোথাও যাব হারিয়ে
যদি না পাই তোমায় আপন করে।
আনমনা এ হৃদয় জুড়ে
ভালোবাসার হাওয়া বয়ে চলে,
গোপন যত মনের কথা
বলব তোমায় আমি সারাটি বেলা।
এ মনের চাওয়ায় শুধু তুমি আমার,
তুমি আমার;
দুরে কোথাও যাব চলে
যদি না মনের দোয়ার রাখ খুলে…..
দিশেহারা মন যে ব্যাকুল
চাইতে তোমার প্রাণের আকুল,
আঁধারে ডুবে থাকা
ভালো লাগে না আর দোটানা….!!
তুমি ছাড়া এ প্রহর কাটে না,
তুমি ছাড়া আর কিছু ভালো লাগে না।
দুরে কোথাও যাব চলে
যদি না মনের দোয়ার রাখো খুলে,
দুরে কোথাও যাব হারিয়ে
যদি না পাই তোমায় আপন করে….”
(গানটি অনেক ভালো। আমার অনেক অনেক প্রিয় একটা গান। সবাইকে নিজ দায়িত্বে গানটি শুনে নেয়ার অনুরোধ করা হলো।)
নীলিমার গান গাওয়ার মাঝেই আবির রুমে প্রবেশ করে। তাড়াতাড়ি শুয়া থেকে উঠে নীলিমা ওর ডান হাতটা ওড়নায় আবৃত করে ফেলে। ঢেকে ফেলে ওড়না দিয়ে। আবির একটা বিরক্তি ভাব নিয়ে বলে, আমি আপনার হাত কিংবা ঐ হাতের মাঝে লুকিয়ে থাকা কোনো রহস্য উদঘাটন করতে আসিনি। আমি এসেছি মামুন স্যারের বিয়ে, আপনি যাবেন কি না সেটা জানতে।
ওয়াও! দেবদাস স্যার বিয়ে করছে তবে? আমি যাব… আমি যাব… বলে লাফিয়ে উঠে নীলিমা। একনিমিষেই ভুলে যায় রাতের কথাগুলো। আবির ওর রুমে চলে যাচ্ছিল, ফিরে আসে আবার। ভ্রু-কুঁচকে নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলে যায়-
” আর হাত যদি এভাবে ঢেকেই রাখতে হয়, তবে মোজা পরে নিবেন। মোজা আছে তো?!!!”
নীলিমা মাথা ঝাঁকায়, হ্যাঁ! আছে…..
— ওকে, ফাইন! সেগুলো পরে নিবেন। দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে আবির ওর রুমে চলে যায়। তাড়াতাড়ি শুয়া থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে আসে নীলিমা। অতঃপর ঝটপট লেহেঙ্গা পরে আবিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। চেঞ্জ করছিল আবির। চোখের সামনে হঠাৎ এক সবুজপরীকে দেখে হাত থেকে পাঞ্জাবি পরে যায়। কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত আবির নীলিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ’ই চোখ চলে যায় নীলিমার হাতের দিকে। প্রচন্ড রেগে যায় আবির।
” আপনাকে আমি মোজা পরতে বললাম বলে, আপনি মোজা’ই পরলেন?”
ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলে নীলিমা, আমতা আমতা করে বলে, আপনি’ই তো বলেছেন। দ্বিগুন রেগে হুংকার দিয়ে বলে উঠে আবির, আপনার আর আমার সাথে বিয়ে বাড়িতে যেতে হবে না….
ঠিক আছে বলে জল টলমল চোখ নিয়ে মাথা নিচু করে স্টাডিরুমে চলে যায় নীলিমা। নিচ তলা থেকে আবিরের কাজিন সাইমা আসে। আবিরকে পাঞ্জাবী পরিহিত দেখে চিৎকার দিয়ে ওয়াও মাই ক্রাশ বলে আচমকা আবিরের গালে একটা চুমু দিয়ে দেয়। স্টাডিরুমের সোজাসুজি আবিরের বেডরুম। আবিরের গালে এভাবে চুমু দেয়া দেখে রেগে যায় নীলিমা। সাইমা সুন্দর করে আবিরের চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে নাক চেপে ধরে বলে, একদম হিরো হিরো লাগছে তোমাকে। রেগে একদম সাপের মত ফুসে উঠে নীলিমা। স্টাডিরুম থেকে দৌঁড়ে আবিরের রুমে যায়। সাইমা আবির দুজনের বুঝে উঠার আগেই নীলিমা আবিরের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ায়। তারপর আবিরের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে, আবিরের নাকটা ওড়না দিয়ে ঘষা শুরু করে। আবির নীলিমার এমন আচরণে অবাক হয়। অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায় আবির। যখন দেখল ওর’ই সামনে নীলিমা ধাক্কা দিয়ে সাইমাকে ফ্লোরে ফেলে দিয়েছে।
চলবে….