ফুলকৌড়ি পর্ব-৬+৭

0
14

#ফুলকৌড়ি
(৬)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

মায়ের কাছ থেকে হাজার বাহানা আর জোরাবাদী করে তারপর ফোনটা নিতে হলো মৌনতাকে।সেটার জন্যই ফিরে আসতে দেরী হলো তার।ছাঁদে দরজায় পা রাখতেই দেখতে পেল,ছোটোদাদাভাই কিছু বলে চলেছে আর তার সামনে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৌড়ি।

‘ছোটো দাদাভাই, তুমি এখানে?

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কৌড়ি।ইভানও পিছনে ফিরল।পকেটে হাত গোঁজা অবস্থায় সেভাবেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো–কেনো?ছাঁদটা কি তুই তোর নামে লিখে নিয়েছিস নাকি আছাড়ি বিবি?যে এখানে অন্য কার-ও প্রবেশ নিষেধ।

চঞ্চল পাজোড়া সহসা এগোলো মৌনতার।ফের গলায় তীক্ষ্ণতা ভর করে বললো।–ওসব বাজে নামে ডাকবেনা তুমি, আমায়।বলে দিলাম দাদাভাই।

মৌনতার বাজখাঁই গলায় কপাল আরও কুঁচকে ফেলল ইভান।ফের মৌনতাকে রাগাতে আবারও বললো–‘তোর ওই আছাড়ি বিবি নামটাই পারফেক্ট।কিন্তু ছোটো চাচা চাচিতো আর,তোর ওই বাচ্চা বেলার ভোলাভালা মুখটা দেখে বুঝে উঠতে পারেননি।তাই নাম রেখে ফেলেছিলেন মৌনতা।তুই নিজে বল, তোর সাথে তোর নামটা ঠিকঠাক যায়?নাকি আমি যে নামটা দিয়েছি, সেটা যায়?

ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ইভান।সেটা দেখে আরও ক্ষেপে গেলো মৌনতা।কিছু বলবে তার আগে আবারও ইভান বললো।–সেজন্য চাচ্চু আর চাচির ভুলটা শুধরে দিলাম আমি,নাম দিলাম আছড়েবিবি।কিন্তু তোর আছাড় খাওয়ার সাথে সাথে গলার যা জোর বেড়েছে।নাম আবারও চেঞ্জ করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

‘দাদাভাই ভালো হচ্ছে না বলে দিলাম।এবার কিন্তু আমি বড়মাকে গিয়ে বলবো।

মৌনতার কাঁদোকাঁদো গলার কথাগুলো শুনে বেশ মজা পেলো ইভান।মেয়েটা ক্ষেপাতে তার যা লাগে না।আর তার কথায় ক্ষেপে যায়-ও মেয়েটা,এটাতে আর-ও বেশি মজা লাগে তার।ঠোঁটে তীক্ষ্ণ হাসি ফুটালো ইভান।ফের বললো।–বাবাহ,তা তোর বড়মার ভয়ে আমি কোথায় গিয়ে লুকাবো সেটা তো বলে দে।তাহলে আমার সুবিধা হয়।

‘দাদাভাই…

এবার কেঁদে ফেললো মেয়েটা।আর মৌনতার কান্না দেখে ইভান এবার হো হো করে হেসে দিলো।আশ্চর্য হয়ে দুই ভাইবোনের ঝগড়া দেখে গেল কৌড়ি।এতোবড় একটা ছেলে হয়ে এক পুচকি মেয়ের সাথে কিভাবে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করলো!আশ্চর্য! এখন আবার মেয়েটাকে কাঁদিয়ে হো হো করে হেসে চলেছে।কি অদ্ভুত।

মৌনতার দিকে পা বাড়ালো ইভান।সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়িয়ে মৌনতার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো।–আচ্ছা ঠিক আছে তোর নামটা নাহয় আছাড়ি বিবিই রইলো।চেঞ্জ নাহয় নাই করলাম।তবুও তুই এরকম গলা বাজিয়ে কাঁদিস না।লোকে দেখলে আমার আর নাম চেঞ্জ করা লাগবেনা।তারাই তোর নামের বদৌলে কাঁদুনিবিবি বলে ডাকবে।

অতিরিক্ত রাগে এবার ইভানের পেটে ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো মৌনতা।যদিও শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহের ইভানকে এক ইঞ্চিও নড়াতে পারলোনা।সেটা দেখে ইভানের পেটে দু-হাত চেপে দিয়ে ছাঁদের দরজার সম্মুখে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেলো মৌনতা। যদিও ইভান সেটা নিজ ইচ্ছেতই এগোলো।নাহলে চিকনাচাকনা মৌনতার ক্ষমতা নেই তাকে এক ইঞ্চিও নড়ানোর। ঠেলেঠুলে দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পর মৌনতা অভিমানি স্বরে বললো।

‘তুমি খুব খারাপ।তুমি আমার দাদাভাই নও।তোমার চেয়ে বড় দাদাভাই ভালো।সে আমাকে কত সুন্দর করে ডাকে।তোমার মতো বাজে নামে ডাকে-না।

হঠাৎই নিভে গেলো ইভান।মৌনতার কথার উত্তর দিলো না।কিছু সময় মৌনতার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চুপচাপ সিঁড়ির পথ ধরলো।যদিও সে জানে, মেয়েটা এমনি এমনিই কথাগুলো বলেছে,তবুও।ওদের বড়দাদাভাই যে ওদের কাছে খুবই প্রিয়,এটাতো ইভান জানে।তবুও উহ্য করে বারবার কেনো বলে তার সামনে।

দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পর মায়ের ধমকের জন্য বাধ্য ছেলের মতো খেয়েদেয়ে ঘুমাতে হয়েছিলো নাফিমকে।সেই ঘুম থেকে সন্ধ্যার পর উঠেছে সে।মুলত উঠেনি সে,তাকে ডেকেডেকে উঠানো হয়েছে।কারনটা টিচার এসেছে,পড়তে হবে তাই।কোনোমতে পড়াটা কমপ্লিট করে কৌড়ির রুমে চলে এসেছে সে।ফুলকৌড়িকে তার কতো পছন্দ অথচ সারাদিনে একবার-ও তার সাথে দেখা করতে পারিনি সে।স্যারের কাছে কতো বাহানা দিয়ে তারপর আসতে পেরেছে।

‘ফুলকৌড়ি আজও কি তোমার মন খারাপ?

বিকালের তোলা ফুলের পিকগুলো কৌড়িকে দেখাচ্ছিল মৌনতা।হঠাৎ নাফিমের গলার স্বরে দুজনেই মাথা উঁচু করে তাকালো।কৌড়ি কিছু বলার আগে মৌনতা বললো।–ওই ফুলকৌড়ি কি!ওর নাম শুধু কৌড়ি।কতবার বলেছি তোকে?আর কৌড়ি আপু তোর বয়সের কতো বড় হয় তুই জানিস?নাম ধরে ডাকছিস কেনো?

‘ওর নাম যাই থাকুক,আমি তাকে ফুলকৌড়ি বলেই ডাকবো। তাতে তোর কি?

‘আমার কি মানে,আম্মুকে বলবো।বেশি পাক-না হয়ে গেছো তাইনা?

‘থাকনা মৌনতা।ওকে বকছো কেনো?ও যে নামে ডাকে ডাকুক না আমাকে।ও ফুলকৌড়ি বলে ডাকলে আমার নিজের আপন মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।দাদিআপা তো প্রায়সই এই নামেই ডাকতো আমাকে।আর মাঝে-মাঝে বাবা-ও ডাকতেন।ও ডাকলে আমার ভালোই লাগে।মনেহয় আপন কেউ ডাকছে।

কথাগুলো বলতে বলতে নাফিমকে কাছে টেনে নিলো কাৌড়ি।গোলুমোলু দেখতে ছেলেটা ভারী মিষ্টি।গোল ফ্রেমের চশমাটায় আরও দুষ্টমিষ্টি লাগে তাকে দেখতে।একদিনে, এবাড়ির ছেলেমেয়ে গুলো কি সুন্দর তাকে আপন করে নিয়েছে।নাফিম কে কাছে টেনে কোলের মধ্যে এনে বসাতেই,লজ্জা পেলো নাফিম।মাঝেমাঝে মায়ের কোলে বসার আবদার করলে,আপুরা তাকে বলে।তুই কোলে বসলে আম্মা ফেটে যাবে।রাগে ক্ষোভে সে আর মায়ের কোলে বসতে চায় না।এখন যদি ফুলকৌড়ি-ও সেই কথা বলে।তবে যে আর-ও লজ্জা পাবে।

‘ওকে কোলে নিয়েছো কেনো,চেপ্টা হয়ে যাবে তো তুমি!

‘বাজে কথা বলবিনা মৌনতার বাচ্চা।তুই আমাকে মোটু বলছিস,আমি যদি মোটু হই।তুই পাতলুর বউ বাতাসী।আমার চকলেট চুরি করে খাস আবার আমারই নিন্দা করিস।পাতলুর বউ কেথাকার।

‘কি বললি তুই?আর আমি তোর চকলেট খাইনা,তোর চকলেট ইঁদুর-বাদরে খায়।

‘সেই ইঁদুরটা- বাঁদরটা কে আমার জানা আছে।

দুজনের ঝগড়াটা সেই বিকালের ঝগড়ার মতো আশ্চর্য হয়ে দেখতে লাগলো।বিকালেরটা থামাতে না পারলেও, এবারের ঝগড়াটা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো কৌড়ি।তবুও দু’জনে কিছুতেই থামলো গেল না।মান্যতা এতোসময় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো,ওদের ঝগড়াতে বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিয়ে রুমে এলো।দুজনকে বকে ধমকিয়ে থামানোর চেষ্টা করলো,কাজই হলো-না।হঠাৎ জলদগম্ভীর বজ্রকন্ঠের আওয়াজে পুরো পরিবেশ মূহুর্তেই বরফ শীতল আবহাওয়ার মতো ঠান্ডা হয়ে গেলো।

‘এখানে হচ্ছেটা কি?পড়ালেখা বাদ দিয়ে এখানে এতো চিল্লাপাল্লা কিসের তোমাদের?হোয়াট ইজ রং উই….

নাফিমের মোটাতাজা শরীরের বাহুভেদ করে একজোড়া ডগরডগর ভয়ার্ত কম্পিত চোখ উঁকি দিতেই তীক্ষ্ণ বাক্যদ্বয় সেখানেই থেমে গেলো নিভানের।নজরে নজর পড়তেই তড়িৎ গতিতে নজর আবারও নাফিমের মোটাতাজা শরীরের পিছনে লুকিয়ে নিলো কৌড়ি।কাল আসার সময় একপলক দেখেছিলো শ্যামবর্ণ লম্বা চওড়া সুঠাম দেহী এই মানুষটাকে।আজ আরও একপল দেখে কৌড়ির মনেহলো,মানুষটা যেমন তেমন থাক।এই ভয়ংকর গলার স্বরের জন্য একদিনও তার বউ টিকবেনা।আর বিয়ের আগে যদি সেই মেয়ে এনার গলার স্বর শোনে তবে বিয়েতেও জীবনে রাজী হবেনা।মরে গেলেও না।

ডগর ডগর নজরজোড়া নাফিমের পিছনে লুকিয়ে যেতেই নিভানের মনেহলো,এঘরে তার ভাইবোন ছাড়া অন্য কারও বাস আছে।এ রুমে যে বাহিরের একটা মেয়ে আছে,হঠাৎই খেয়াল ছিলোনা নিভানের।বাড়িতে ঢোকার পর,সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে ড্রয়িংরুমের পাশ ঘেঁষে রুমটা থেকে তিনটা মানুষের এতোএতো হযবরল তর্কবিতর্ক ভেসে আসছিলো,মেজাজ শান্ত রেখে উপরে হয়ে উঠা হয়নি আর।তবে এটাও খেয়াল ছিলো না, তার অপরিচিত একজন মেয়ে এই রুমে আছে।পরিবেশ একদম শুনশান। পিছে মুড়ে গটাগট পা চালিয়ে চলে গেলো নিভান।পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই সশব্দে শ্বাস ফেললো সবাই।মান্যতা এবার দাঁতে দাঁত চেপে মৌনতাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘তোকে কতোবার বলছি নাফিম আর ছোটো দাদাভাই যেখানে থাকবে সেখানে তুই,থাকবি-না। যাবি-না।এখন হয়েছে তো!

‘আমি যাইনি তো,ও এসেছে।

‘আবার তর্ক করিস মুখেমুখে,ও এসেছেতো কি হয়েছে?ওকে খোঁচালি ক্যান তুই?

‘আমি খোঁচাই নি।আমি ভালো কথা বলেছিলাম,ও অযথা তর্ক শুরু…..

‘মৌন….

অতিরিক্ত রাগে মৌনতাকে ডেকে উঠায় আর কথা বাড়ালো না সে।চুপ হয়ে গেলো।সবাই শুধু তার দোষ দেখে,সবাই যে অকারণে তার পিছে লাগে এটা দেখেনা।
নিভানের গলার স্বর শুনে স্বান্তনা রহমান আর নীহারিকা বেগমও সেখানে হাজির হলেন।তবে নিভান চলে যাওয়ার পর।স্বান্তনা রহমান শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘কি হয়েছে এখানে।নিভান চিল্লালো কেনো?নিশ্চয় এই দুটোতে আবার ঝগড়া বাধিয়েছে।

মান্যতা কিছু বলতে যাবে।তাকে বলতে না দিয়ে বিলাপ করে ফের স্বান্তনা রহমান নললেন।

‘আল্লাহ, একই মা’র পেটের ভাইবোন তোরা।কোনো সৎ ভাইবোন নোস।তবুও এক জায়গায় হতে পারিসনা ঝগড়াঝাঁটি মারামারি শুরু হয়ে যায়।তবে একজায়গায় হোস কেনো?এ কেমন ছেলেমেয়ে আমার।নতুন একটা মেয়ে এসেছে,তার সামনেও ঝগড়া।তাকেও মান্য করলো না।একি ছেলেমেয়ে হয়েছে আমার।

‘তুমি আবার কিসব বলা শুরু করলে ছোটোমা।

‘কিছু হয়নি তো নিভান চিল্লালো কেনো?অতিরিক্ত কিছু না হলে তো ছেলেটা উফফ তাক শব্দ করেনা?আর এই দুটোকে তুই এখন আমাকে নতুন করে চেনাচ্ছিস!আমি চিনিনা বুঝি এদের।

মান্যতা এবার পড়লো মহাবিপদে।এই দুটো ছোটোমাকে জ্বালিয়ে পড়িয়ে তার মাথা নষ্ট করে দিয়েছে।আগের ছোটমা কতো শান্ত ছিলো,এখন বকতে শুরু করলে আর থামে-না।মায়ের দিকে অসহায় নজরে তাকালো মান্যতা।সেটা বুঝে নীহারিকা বেগম,স্বান্তনা রহমানকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে গেলেন।তবুও স্বান্তনা রহমান মৃদুস্বরে নীহারিকা বেগমকে উদ্দেশ্য করে আওড়ালেন।

‘এই দুটোর জ্বালায় দেখবে একদিন আমি পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো।বাপটা সারা বছর এদেশ সেদেশ আরাম করে ঘুরে বেড়াবে,আর আমার হয়েছে যতোসব জ্বালা।

নীহারিকা বেগম জানেন,এবার স্বান্তনা রহমান ছেলেমেয়ে ঝাঁঝ,ছেলেমেয়ের বাপের উপরে উঠাবে। মুখে বকেবকে শান্ত হতে না পারলে, ফোন দিয়ে শাহেদকে ইচ্ছেমতো বকেবকে তার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবে।

নীহারিকা বেগম আর স্বান্তনা রহমান চলে যেতেই নাফিম কৌড়ির দিকে ফিরে মুখটা অসহায় ভঙ্গিমাকরে বললো।—বিশ্বাস করো ফুলকৌড়ি আমি মোটেই দুষ্ট ছেলে নই।ও সারাক্ষণ আমাকে মোটু বলে ক্ষেপায়।আমার রাগ হয়না বলো?আর আমার চকলেট গুলোও চুরি করে নিয়ে নেয়।আমার চকলেট গুলো ফেরত চাইলে,ইচ্ছেকরে আমার সাথে ঝগড়া বাধায়।আমি ওর কোনো কিছুতে হাত দিলে আম্মুকে বলে আমাকে বকা শোনায়।তবে আমি কোনো ওকে ভালো বলবো।ওর কথা শুনবো?তুমি বলো আমি দুষ্ট ছেলে?

মান্যতা আবার-ও বেলকনিতে চলে গিয়েছে। মৌনতা চুপচাপ বসে ছিলো,নাফিমের কথাগুলো শুনতেই ফোঁস করে উঠলো সে।কিন্তু কৌড়ির নজরে নজর পড়তেই থেমে গেল।চুপচাপ উঠে রুম থেকে চলে গেলো।নিজের কোনো ভাইবোন ছিলোনা বিধায় এসব ঝগড়াঝাঁটির ঝামেলা হয়নি।নাফিমের গোলুমোলু মিষ্টি চেহারায় অসহায় ভঙ্গিমা ভালো লাগলোনা কৌড়ির।মিষ্টি হেসে, নাফিমের গাল দুটো টেনে দিয়ে বললো।

‘নাফিমতো মোটেই দুষ্ট ছেলে নয়,খুব ভালো ছেলে।তবে আপু তোমার বড় হয়না,তার সাথে এভাবে ঝগড়া করা ভালো ছেলে হয়ে মোটেই ঠিক হয়নি তোমার।আর আপু
তোমাকে দুষ্টমী করে উল্টাে-পাল্টা নামে ডাকে,যদি-ও ঠিক নয়।তাই বলে আপুর সিক্রেট তুমি সবার সামনে এভাবে বলে দেবে?আপু লজ্জা পায় না।

‘আমাকে মোটু বলে,আমার ভালো লাগে?

নাফিমকে জবাবে কি বলবে ভেবে পেলো না কৌড়ি।তবুও ভালোমন্দ কথা বলে এটাওটা বোঝাতে লাগলো তাকে।

ঝরঝরে নজর মুগ্ধ হওয়ার মতো একটা সকাল।নিজের আরামদায়ক বিছনায় বালিশ আঁকড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নিভান।চোখ বন্ধ থাকলে-ও,জেগে আছে সে।স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙেছে তার।একজোড়া মুগ্ধকর আঁখিদ্বয় অশ্রুবরণ করে চলেছে।অথচ সে নিটোল চোখে চেয়ে চেয়ে সেই চোখজোড়া দেখছে,কিন্তু কিছুই বলছেনা।শুধু যে আজ স্বপ্নটা দেখেছে,এমনটা নয়।এই স্বপ্নের উৎপত্তি হয়েছে,আজ থেকে তিনদিন আগে।হঠাৎ এরকম একটা স্বপ্নের মানে টা কি,বুঝে উঠতে পারছেনা নিভান।এমন স্বপ্ন এর আগে সে কখনো দেখেনি।অথচ আজ তিনদিন ধরে রাতে ঘুমালেই একই স্বপ্ন দেখে চলেছে।রাতে যেকাবার এই স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে,পুনরায় আবার ঘুমাতে গেলে সেই একই স্বপ্ন।
ওই একজোড়া ক্রন্দনরতা চোখ তাকে আজ তিনদিন ধরে অস্থির করে তুলেছে।রাতের আরামে ঘুমটা তার হারাম করে তুলেছে।আর সময় অসময়ে চোখ বুঁজলেই ওই একজোড়া চোখ ভেসে উঠছে,তার বদ্ধ দুয়ারের অন্তরিক্ষে।বিষয়টা বেশ অদ্ভুত লাগছে তার কাছে।এইযে চোখ বন্ধ করে আছে।সেই মোটামোটা ভেজা আঁখি জোড়া ভেসে বেড়াচ্ছে তার বদ্ধ আক্ষিপটে।

চেনা পরিচিত এরকম কোনো নজরে নজর পড়েছে বলে মনে তো হয়না নিভানের।তবে আকস্মিক এরকম একটা স্বপ্ন রোজ রোজ দেখে যাওয়ার মানেটা ঠিক কি?বালিশের পাশে থাকা ফোনের তীব্র ভাইব্রেশনে ভাবনা কাটলো নিভানের।চোখ না খুলেই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে ফোনটা হাতড়িয়ে নিলো।দেখার বিশেষ প্রয়োজন মনে করলোনা।কলটা কে করেছে,হয়তো বুঝে নিতে পেরেই চোখ বন্ধ রেখেই রিসিভ করে কানে ধরলো সে।

‘বল

গম্ভীর কণ্ঠটা আর-ও গম্ভীর।সেটা বুঝে ওপাশের মানুষটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো।

‘সকালে দৌড়াদৌড়ি না করে,এখনো শুয়ে আছিস যে?
ব্যাপার কি? শরীর ঠিক আছো তোর?
আজ তোর অফিস বাদে-ও রেস্টুরেন্টে সময় দিতে হবে মনে আছে তো।

‘হুমম।

‘রেস্টুরেন্টের দিকে কয়টায় আসবি?

এবার চোখ খুলে উঠে বসলো নিভান।বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো–‘যে সময়টাতে রোজ বৃহস্পতিবার যাই।

‘ওকে।আয় তবে।দেখ,আরও একটু সময় নিয়ে তাড়াতাড়ি আসতে পারিস কি-না।এক সপ্তাহের মতো দেখা হয়না,একটু আড্ডা দেওয়া হবে।আল্লাহ হাফেজ।

নিভানের কাছে সময় চাওয়াটা অহেতুক তবুও বললো তৃনয়।নিভানও তৃনয়ের কথার উত্তর সরূপ কোনো জবাব দিলোনা,শুধু আল্লাহ হাফেজ বলে ফোনটা কেটে দিলো।


নিজেকে ফর্মাল ড্রেসে রেডি করে নিয়ে উপর থেকে নিচে নামতেই, ড্রয়িংরুমে দীবাকে-ও রেডি হয়ে বসে থাকতে দেখলো নিভান।সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে ডায়নিং খাবার রেডি করতে ব্যস্ত মায়ের দিকে তাকালো নিভান।স্বামী সংসার প্রিয় কাকে বলে এই নারীটিকে না দেখলে কেউ বুঝবেনা।

‘মা,আমি বের হচ্ছি।আল্লাহ হাফেজ।

‘সে-কি,খেয়ে যাবিনা।এইতো খাবার প্রায় রেডি।খেয়ে যা।

সামনের দিকে এগোতেই নিভান,নিহারীকা বেগমেকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলবে।তার আগেই দীবার পাশে বসা ফাতেমা বেগম গম্ভীর কন্টে বললেন।–নিভান, দাদুমনিকে একটু তোমার গাড়িতে করে তার গন্তব্য মতো পৌঁছে দিওতো।

ভদ্রমহিলা সম্পর্কে নিভানের দাদি হলেও তারসাথে বিশেষ সম্পর্ক নেই নিভানের।না নিভান উনাকে দাদীমা বলে ডাকে।আর না উনি নিভানকে অন্য নাতীদের মতো দাদুভাই বলে সম্বোধন করে।তবুও দুজন দু’জনের জায়গা থেকে সম্পর্ক ঠিক রাখার প্রয়াস করে যাচ্ছে।বিধায় দাদির চেয়েও গম্ভীর গলায় মা’কে উদ্দেশ্য করে তখনের উত্তরে নিভান বললো।

‘আমার আজ খেয়ে যাওয়ার সময় হবেনা মা।অফিসে ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে।আমি বাহিরে খেয়ে নেবো।আর কারও বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে আমার গাড়ীটা বাদেও বাড়িতে আর-ও দুটো গাড়ী আছে।হাফিজ ভাইকে মাসে মাসে বেতনটা বেকার বেকার দেওয়া হয় না।

চলে গেলো নিভান।শ্বাশুড়ি আর ননদ ঝি’য়ের অসন্তুষ্ট মুখের দিকে নিষ্পলক কিছুসময় তাকিয়ে থেকে নিজের কাজে মন দিলেন নীহারিকা বেগম।জাহিদ সাহেবের খাবার নিয়ে কেটে পড়লেন সহসা।যদিও নিভানের এহেন ব্যবহার নিয়ে শ্বাশুড়িমা আগে অনেক অভিযোগ আর কথা শোনালেও,এখন যে শোনাবেন না।এটা তিনি জানেন।তবুও শ্বাশুড়ির এই অসন্তুষ্ট মুখটা ঠিক ভালো লাগলোনা উনার।দীবা হয়তো জানতো,সে বললে নিভান নিয়ে যাবেনা।তাই নানিমাকে হয়তো নিভানকে বলার জন্য হাত করেছে, বুঝিয়েছে।কিন্তু এটাতেও যে নিভান গলবে না।সেটা এতোদিন ধরে নিভানকে দেখার পরও বুঝিনি মেয়েটা!

সকাল সকাল বাড়ির পিছনের বাগানটাতে গিয়েছিলো কৌড়ি।মুলত রানীসাহেবা তাকে নিয়ে গিয়েছিলো, তার করা সবজি বাগান দেখাতে।সেখান থেকে ফিরছিলো কৌড়ি।বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে ড্রয়িংরুমের ঘটনাটা সদর দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেছে সে।মানুষটা এমন অদ্ভুত টাইপের কেনো?কাল যে ধমকটা দিলো,তারপর আর ওই মানুষটার সামনে পড়তে চায়না কৌড়ি।যদি কোনো কারনবশত মানুষটার সামনে সেও কোনো ভুল করে ফেলে,আর সেই ভুলের জন্য যদি ওরকম ঘর কাপিয়ে একটা ধমক দেয়,ওই অদ্ভুত মানুষটা।তবেতো সে শেষ।সেদিনই তার জানাজার ব্যবস্থা করতে হবে।তাই রানিসাহেবা ভিতরে চলে গেলেও সে ভিতরে ঢুকতে পারলো-না।নিভান সদর দরজার দিকে আসতে দেখেই তড়িৎ গতিতে ফের বাগানের দিকে চলে গেলো সে।
নিভানও বুঝতে পারলো,কেউ তাকে দেখে দৌড়ে চলে গেছে।

বাড়ির লন এরিয়াতে পা রাখতেই কাওকেই সেভাবে নজরে পড়লোনা নিভানের।আর এসময়ে তো মৌনতা, নাফিম কেউই বাড়িতে থাকে-না।তবে?ভাবনা আর সামনে এগোলো না নিভান,গাড়িতে উঠে বসলো।তবে তার তীক্ষ্ণ অনুভব শক্তি বলছে,কেউ তাকে সুক্ষ নজরে পর্যবেক্ষণের করছে।হয়তো তার চলে যাওয়ারই অপেক্ষা করছে।গড়ীতে বসেই আরও একবার সতর্ক নজর আশেপাশে বুলালো নিভান।হঠাৎ নজর উপরের দিকে যেতেই দেখলো,সদ্য ঘুম থেকে উঠা ইভান বেলকনির রেলিঙে দুহাত দুপাশে ভর করে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে।দুই ভাইয়ের মধ্যে গলাগলি টাইপের বিশেষ সম্পর্ক নেই।তবে যেটুকু আছে দুজনের ভিতরে পুষে রেখেছে। কেউ কাওকে সেই অনুভুতি দেখাতে রাজী নয়।নিভান মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগেই ইভান তারদিকে তাকালো।কৌড়ির লুকানোর ব্যপারটা হয়তো কিছু বুঝে ফেলেছে সে।তাই নিভানকে চোখ দিয়ে বাগানের পাশে পিলারের আড়ালে নজর দিতে ইশারা করলো।ইভানকে ইশারা করতে দেখে একটু আশ্চর্য হলেও, ইশারা বুঝতে সময় নিলো না নিভান।কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই নজর শিথিল হয়ে এলো তার।কাল রাতে নাফিমের মোটাতাজা শরীরের বাহুভেদ করে ডগরডগর যে নজরজোড়া উঁকি দিয়েছিলো,সেই ডগর ডগর নজরজোড়া আজ পিলারের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে।কাল কম্পিত ভয়ার্ত ছিলো আর আজ সে নজরজোড়া সতর্ক।কপাল এবার একটু নয় বেশ কুঁচকে গেলো নিভানের।

‘মানেটা কি?তাঁকে দেখে এরকম লুকানোর কি আছে?অদ্ভুত মেয়ে তো বটে,আশ্চর্য!তবে নিভানের মনেহলো ওই মেয়েটার ডগরডগর নজরজোড়ার সাথে কোথা-ও একটা খুব সাংঘাতিক মিল আছে।কাল রাতে-ও তার মনে হয়েছিল। তবে কোথায়?তার স্বপ্নে দেখা ক্রন্দনরত চোখজোড়া!

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সকাল থেকেই মায়ের পিছনে ঘ্যান-ঘ্যান করে চলেছে মান্যতা।শরৎকাল শুরু হতে না হতেই তার সব বান্ধবীগুলো,কি সুন্দর লাল পাড়ের সাদা শাড়ী পরে সেজেগুজে কাশফুলের রাজ্য থেকে ঘুরে এসেছে।ফেসবুকে কতো সুন্দর সুন্দর পিক আপলোড করেছে।আর দুটো ’মাস নিয়ে এক একটা ঋতু, অথচ শরৎ এর একমাস পার হয়ে গেলো।সে এখনো যেতে পারলো-না।পেঁজা তুলোর মতো শুভ্র কাশফুলের নরম পাপড়িগুলো কে ছুঁয়ে দেখতে পারলো-না।ভাল্লাগে না।নীহারিকা বেগম দুপুরের রান্নার বন্দোবস্ত করছিলেন।মেয়ের এমন ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিমাত্রায় বিরক্ত হলেন।এতোবড় মেয়ে এরকম কানের পাশে অযথা প্যানপ্যানানি করলে কার ভালো লাগে।ভার্সিটিতে যাওয়া বাদ দিয়ে,এখন তিনি কাশফুলের রাজ্য হারিয়ে যাওয়ার বাহানা জুড়েছেন।

‘এই তোদের ভার্সিটির পশ্চিম এরিয়াজুড়ে না কাশফুলের আগান-বাগান।তবে সেই জিনিসটা আবার আলাদা করে অন্যত্র দেখতে যাওয়ার মানেটা কি?

‘মা,আমাদের বাড়িটাতো জমিদার বাড়ি থেকে কোনো অংশে কম নয়,তবে আলাদা করে দিয়াবাড়ি,রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ি এগুলো দেখতে যাওয়ার দরকারটা কি? ব্যাপার তেমনই।জানো না, গোয়ালের দোরগোড়ায় ঘাষ গরুর মুখে রোচে না।

‘তা যা বলেছিস!খুব ভালো জিনিসের সাথে নিজের তুলনা করেছিস।নাহলে তোকে বোঝাতে এতো কাঠখড় পোড়ানো লাগে।

সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথাটা বললেও,কথার মধ্যে যে তাকে নিয়ে কঠিন অবজ্ঞা করা হলো।বেশ বুঝলো মান্যতা।নাকে কেঁদে জোরেশোরে মা’কে ডেকে উঠলো সে।

‘আম্মু।

নীহারিকা বেগম সে ডাকে গুরুত্ব দিলেন না। মান্যতা ফের বললো।

‘আমি কিন্তু আমার বান্ধবীদের সাথে যেতে পারতাম কিন্তু সেটা আব্বু শুনলে মনোক্ষুণ্ণ হতো।আর বড়ো- দাদাভাই জানলে রাগারাগি করতো।যা আমিও চাইনা।তাই বলে এসব বলবে তুমি?

‘বড় হয়েছো বলে এখনো এতোবড় হয়ে যাওনি,যে বাবা মায়ে’র অনুমতি ছাড়া বাঁধনহারা পাখির মতো উড়ে বেড়াবে।আর এবাড়ির মেয়েদের যে সেভাবে চলতে দেওয়া হয়নি,এটা তুমি-ও খুব ভালোভাবে জানো।

হঠাৎ মায়ের কন্ঠ গম্ভীর হয়ে যাওয়ার, নিজের বলাকে সংযাত করলো মান্যতা। ফের মিনমিনে গলায় বললো।

‘এজন্যতো তোমার অনুমতি চাইছি।তুমি, বাবাকে আর দাদাভাইকে বুঝিয়ে বলবে।অবশ্যই শুধু দাদাভাইকে বুঝিয়ে বললে হবে,দাদাভাই যেটাতে সম্মতি দেয়।সেই সিদ্ধান্তে তো বাবা আর কখনো অমত পোষন করেননা।
ও আম্মু?

এবার মান্যতার ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিমাত্রায় বিরক্ত হলেন নীহারিকা বেগম।বিরক্তি স্বরে বললেন।

‘যাবি ভালো কথা।তবে বাড়ির গাড়িতে করে।আর ভুলেও সাথে রানীকে না নিয়ে যাওয়ার বাহানা একটুও করবিনা।তবেই যেতে পারবি।

‘আমি তো একা যাবোনা সাথে দীবা আপুও যাবে। তবে রানীসাহেবাকে আবার কি দরকার?

‘রানীসাহেবাকে কি দরকার মানে?ও গেলে সমস্যা কোথায়?ওর বুঝি ঘুরতে মন চায়না।আর ওকে তোদের সাথে কোথাও পাঠালে আমি একটু স্বস্তিতে থাকতে পারি।যদি-ও সব আল্লাহ ভরসা।সন্তানদের নিয়ে বাবা মায়ের কতো দুশ্চিন্তা, জ্বালা ও তোরা কি বুঝবি।বিয়ে হোক,সন্তান জন্ম দে তারপর বুঝবি।মা কোনো অযথা অকারণে সন্তানের নিয়ে চিন্তা করে,বিশেষ করে মেয়ে সন্তানদের নিয়ে।একই পেটে লালিত হওয়া কোন সন্তানকে ছোটোবড় কেমন চোখে দেখে,আর কাকে কম-বেশি কতোটা ভালোবাসে।আর তাদের নিয়ে ভালোমন্দ কতো চিন্তা ভাবনা মায়ের।সময় হলে ঠিকই বুঝবি।

মান্যতা জানে,শেষের এমন কথাগুলো মা এতোটা আক্রোশ নিয়ে কিসের জন্য তাকে শোনালো।ছোটো দাদাভাই যে সবসময় বাবা মায়ের মুখের উপর বলে দেয়,বড়দাদা ভাইকে বাবা মা বরাবরই বেশি প্রায়োরিটি দেয়,বেশি ভালোবাসে।সেজন্য আম্মু মাঝেমধ্যে এরকম কথা তাকে উদ্দেশ্য করে শুনিয়ে থাকেন।মান্যতা মায়ের মন খারাপটা বুঝে নরম গলায় বললো।

‘আচ্ছা রানিসাহেবাকে নিয়ে যাবো।তবুও এরকম দুঃখী দুঃখী কথা বলবেনা তো।ও আম্মু, তুমি আর ছোটমা-ও যাবে নাকি আমাদের সাথে ঘুরতে?

অদ্ভুত নজরে মেয়ের দিকে তাকালেন নীহারিকা বেগম।
ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে, তা দেখে জোর করে মুখে হাসি টেনে কেটে পড়লো মান্যতা।তাকে রান্নাঘর ত্যাগ করতে দেখে নীহারিকা বেগম গম্ভীর গলায় বললেন।–তোদের সাথে কৌড়িকেও নিয়ে যাস।মেয়েটা সারাদিন মন খারাপ করে রুমে বসে থাকে।কারও ডাকে ছাড়া সহজে রুম থেকে বের হয়না।ও-কে ও সাথে করে নিয়ে যাস।বাহিরে একটু ঘোরাঘুরি করলে মেয়েটার মনটা একটু ভালো হবে।

কৌড়িকে এমনিতেই নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার প্লান ছিলো মান্যতার।মা বলতেই সেটা শিরোধার্য হয়ে গেল।

.

শরৎ ঋতুর পরিপূর্ণ সৌন্দর্যতার বিবরণ মনেহয় এক কাশফুলেই বহন করে।পৃথিবীতে নানাধরণের নজরকাঁড়া অপরূপ সৌন্দর্যময় ফুল আছে।তবে যে কারও মন কেড়ে নিতে মনেহয় শরৎ ঋতুতে ফোটানো কাশফুলের জুড়ি নেই।কাশফুল মানে অবাধ অপরূপ সৌন্দর্য।স্নিগ্ধ ভরপুর সাজানো একটা বিকেল।সেই স্নিগ্ধতায় ভরপুর বিকালটা কাশফুলের দুলে দুলে বয়ে যাওয়া অবাধ সৌন্দর্যে মন আরও সতেজতায় ভরিয়ে তুলছে।বিস্তৃত নীল আকাশটা যদিও মৃদুতর ছড়াছড়া কালো মেঘমন্দ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।বৃষ্টি আসবে কি-না কারও জানা নেই।তবুও চারপাশের পরিবেশটা নজর মন আবেশিত করে দেওয়ার মতোই স্নিগ্ধকর।নতুন নববধূবেশে থাকা বউয়ের রূপের মতো নজরকাঁড়া,মনোমুগ্ধকর।

উত্তরার দিয়াবাড়ির কাশফুল বাগানের পিচঢালা পথের প্রান্তরে ,পকেটে হাত গুঁজে হেঁটে চলেছে নিভান।পাশে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে তৃনয়।দায়িত্ব আর কাজ পাগল ছেলেটার কাজ থাকা সত্ত্বেও, এখানে একপ্রকার জোর করে নিয়ে এসেছে সে।প্রথম একটু রাগারাগি করলেও, শরতের এই মনোমুগ্ধকর বিকাল দেখে তার বন্ধু রূপে ছেলেটার রাগ পড়েছে মনেহয়।শ্যামবর্ণ মুখের শান্ত অবয়বটা দেখেতো অন্তত তাই মনেহচ্ছে।এতো সময় চুপচাপ দু’জনে হাটলেও এবার মুখ খুললো তৃনয়।

‘স্কলারশিপ পেয়েও নিজের স্বপ্নপূরণে পিছু হাটলি,বি সি এসটা তো অন্তত দিতে পারতিস?এখানে কিন্তু আঙ্কেলের দোষ দেওয়া যায় না।স্কলারশিপ পেয়ে তখন পরিস্থিতির খাতিরে আঙ্কেলকে সাপোর্ট দিতে বাহিরে যেতে পারিসনি, ঠিক আছে।কিন্ত যখন পরিস্থিতি ঠিকঠাক হলো তখনতো আঙ্কেল সাপোর্ট দিয়েছিলো তোকে।পিছুপা হলি কেনো?

সব জায়গায় নিজের আবেগ অনুভূতি দৃঢ়চিত্তে চেপে রাখার চেষ্টা করলেও,দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু যখন একজায়গায় হয়।দু’জনে মন খুলে কথা বলার চেষ্টা করে।যদি-ও নিভান কমই বলে।বিকেলের হিমেল হাওয়ায় সাদা কাশফুলের ভেলাগুলো দুলেদুলে চলছে।সেদিকে একপলক তাকিয়ে সামনের দিকে নজর দিলো নিভান।তৃনয়ের কথার উত্তরসরূপ কিছু সময় তাকে অপেক্ষা করালো।ফের বললো।

‘উনাকে ওই অবস্থায় রেখে,আমি নিজের স্বপ্নপূরণের কথা ভাবিনি।কারন আমার বিবেক ঋনি ছিলো উনার কাছে।সেটা শোধ করবার পালা এসেছিলো তখন।আর পরিস্থিতি ঠিক হলে পরবর্তীতে যাওয়ার কথা বলছিস, আমি,জে এস জে ইন্ডাস্ট্রির কর্নধরের চেয়ারে বসে সমস্ত কিছু পরিচালনা করলেও,সেখানের কোনো কিছুর দাবিদার,হকদার বলে নিজেকে মানিনা।আমি যা হতে চেয়েছিলাম,সেটা শুধুমাত্র নিজের মেধা আর চেষ্টাতে।সেখানে যখন বাঁধা পড়েছে, ইনাফ।আর বি সি এস।প্রিপেইড হয়েছিলাম,চেয়েছিলাম পরিক্ষা দেবো।কিন্তু সেভাবে সময়টা আর পেলাম কোথায়।উনি আর মা-ও নিষেধ করলেন।

নিভানের জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে মোটামুটি জানা তৃনয়ের,তাই আর ঘাটালো না সে।তবে ছেলেটার এই সারাদিনের ব্যস্ত লাইফ,দায়িত্ব, কাজ।সবকিছু ভালো লাগলেও,নিভানের এই অতি নিস্পৃহতা ভালো লাগেনা তৃনয়ের।কলেজ লাইফ থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড তারা,তৃনয়ের আগে নিভানের কোনো বেস্টফ্রেন্ড ছিলো বলে জানা নেই।শান্ত গম্ভীর ছেলেটার ভার্সিটি লাইফে এসে কিছু সংখ্যক বন্ধু হলেও,কলেজ লাইফ থেকে একমাত্র বন্ধু ছিলো তৃনয়।গম্ভীর ছেলেটার সাথে ফ্যামিলি, আর্থিক, সবদিক থেকে বেশ তফাৎ থাকলেও,কিভাবে কিকরে জেনো খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তারা।মায়া আর অদ্ভুত এক টানের সম্পর্ক তৈরী হলো।সেখান থেকেই নির্দ্বিধায় একে অপরের ভালো মন্দটা জানা,বোঝা।

‘তুই ভুল ধারনা পোষন করে আছিস।আঙ্কেলের নজরে তুই তার বড় সন্তান।মান্যতা, ইভান,সবার মতো সবকিছু পাওয়ার,সব অধিকারের যোগ্য সন্তান হিসাবে তোকে তিনি সেই সম্মাননাটা দিয়ে আসছেন তুই।তারপর উনার সবকিছু তোর কিছুই নয়,এটা কেনো ভাবিস। যে প্রায়োরিটিটা উনি তোকে দেয়,সেখান থেকে তোর মুখে উনি শব্দটা আমার তাই ভালো লাগে-না।সেখানে উনার কেমন লাগার কথা তোর আমার সবার জানা কথা।তবুও তিনি কিন্তু উনার সবকিছুর যোগ্য উত্তরাধিকারী মনে করে উনার ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত পরিচালনার ভার তোর হাতে তুলে দিয়েছেন।তোর ভালোমন্দ যেকোনো সিদ্ধান্তঃ বিনাবাক্যবয়ে মেনে নেন।তারপর ও তোর মনে হয়ে তুই উনার কিছুই না?

এই প্রথম নয় এর আগেও এমন বিভিন্ন কথা বুঝদার কথা দ্বারা ছেলেটাকে বোঝানোর চেষ্টা করে তৃনয়।কিন্তু যে বুঝদার তাকে কি অন্য কেউ শত বুঝিয়েও বুঝদারের কিনারার সন্ধান দিতে পারে।তৃনয়ের ভাবনার মাঝে নিভান দৃঢ় গলায় বললো।

‘আমি জানিনা, আমার সবসময় কেনো মনেহয় আমি ওবাড়ির কেউ না।শুধু মা আছে বলে তাই মনেহয় ওবাড়িতে থাকা।

‘এসব কেমন কথা নিভান।ইভান মান্যতা তোর ভাইবোন।ছোট থাকতে ইভান যা করেছে করেছে,এখন কিন্তু তোকে মানেও।যদি-ও সেটা ওর হাবভাবে বুঝতে দেয়না।আর মান্যতা,আঙ্কেলের মতো সে-ও তার দাদাভাইয়ের সমস্ত সিদ্ধান্ত চোখ বুঁজে মেনে নেয়।তবুও তুই এরকমটা কি করে বলতে পারিস?শুধু গুটিকয়েক মানুষের জন্য,তোর কাছের মানুষের অনুভূতি গুলো এভাবে ইগ্নোর করতে পারিস না।

নিভান উত্তর দিলোনা।দৃঢ় চোয়ালে সামনের দিকে এগিয়ে চললো সে।হয়তো তৃনয়ের কথাই ঠিক,সম্পর্কে এতো কঠোরতা ঠিক নয়।নিজেকেও বা এতো ছোটো করে দেখা ঠিক নয়,যেখানে সবাই তাকে মাথায় তুলে রেখেছে।ভাবনা সেদিকে আর এগোলোনা।না চাইতেও গম্ভীর মুখাবয়বের ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করল।প্রসঙ্গ এড়াতে বললো।

‘আমাদের বাঙালিয়ানা রেস্টুরেন্টের নামটা কিন্তু তোর হাতের দুধ চিংড়ীর রেসিপি,কলাপাতায় মোড়ানো ইলিশে ভাপা,আর সাধারণ ঘি পোলাওটা কিন্তু বেশ নাম-ডাক করিয়ে দিয়েছে।সপ্তাহে বৃহস্পতিবারে এই দিনটায় কি পরিমান লোকের সমাগম হয় এই রেসিপি গুলোর জন্য আমাদের রেস্টুরেন্টে।দেখেছিস? যদি-ও আমাদের বাঙালিয়ানা রেস্টুরেন্টের সব খাবারের মোটামুটি নামডাক আছে।তবে সিক্রেট শেফের হাতের এই রান্নাগুলো কিন্তু বেশ মজা করেই খায় খাদ্যপ্রিয় মানুষগুলো।

নিভান প্রসঙ্গ এড়াতে চাইছে।বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৃনয়।নিভান ফের বললো–যদিও রেসিপিগুলো কমন,তবুও তোর হাতের আলাদা স্পেশালিটি থাকায় রান্নার স্বাদগুলো আলাদা হয়।চেষ্টা তো আমিও করি।তবুও তোর রান্নার মতো স্বাদ আনতে পারিনা কেনো?কার হাতের স্পেশাল রেসিপি এই রান্নাগুলো,আজ আমাকে বলতো?যে হুবুহু তার হাতের গুনটা রপ্ত করেছিস?আন্টির হাতের?

‘যদিও মা রান্নাগুলো জানেন।এবং খুবই সুন্দর রান্না করেন। তবে আমি দাদিমা যেভাবে রান্না করতেন,সেটাই রান্নার সময় বেশি ফলো করি।উনার রান্নার হাতটা দারুন ছিলো।বাবা চাচারা,আমরা ভাইবোনেরা সবাই উনার হাতের রান্না খুবই তুষ্টতার সহিত ভোগ করতাম।

গম্ভীর মুখে এক টুকরো হাসি ফুটলো,সঙ্গে সঙ্গেই তা আবার মিলিয়ে গেলো।তৃনয়ের কথার উত্তর সরূপ ঘাড় বাকিয়ে শুধু একবার তারদিকে তাকালো নিভান।শীতল গলায় বললো।

‘আমাদের রেস্টুরেন্টেটা যেমন আমরা সাধারণভাবে উপস্থাপন করে,সেখানে নামীদামী নয় অতিসাধারণ সব বাঙালিয়ানা খাবারেরই জোগান দিতে চেয়েছিলাম।সেরকম সাধারণ ভাবে রান্নার মধ্যে অসাধারণ হয় তোর বানানো রেসিপিগুলো।যেটা আমাদের রেস্টুরেন্টেটাকে আরও উন্নতি সাধন করতে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

‘হয়তো।তবে সু-গৃহিনী হওয়ার কথা ছিলো আমার বউয়ের হয়ে গেলাম আমি।

হেসে দিলো তৃনয়।সেটা দেখে নিজের মুখের হাসিটা আরও একটু প্রসারিত করলো নিভান।বললো–সুগৃহিনী হওয়া কি শুধু স্ত্রীলোকের দায়িত্ব,নাকি এটা শুধু তাদেরই কর্ম?দেশ বিদেশের ছোটো বড় নামাদামী সব হোটেল রেস্তোরাঁ গুলোতে গিয়ে দেখ,সেখানে বড়বড় ডিগ্রীধারী শেফ-রা,অধিকাংশ পুরুষই।

‘হুম এজন্য তো স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশ থেকে ডিগ্রী অর্জন করে-ও,নিজের ইচ্ছেপূরনে নেমেছি।যদি-ও চাকরীর জন্য বিভিন্ন ভার্সিটিতে-ও এপ্লাই করছি।একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকেও অফার এসেছে।দেখি করা যায়।

দেশে চাকরীর বড় অভাব।চাইলে তৃনয় বাহিরের দেশে সেটেল্ড হয়ে যেতো পারতো।তবে আরও একটা কারনে সে ওই সূদুর বিদেশভুইয়ে থাকতে পারিনি।তবে সেটা নিভানের সামনে উহ্য করে বলতে সাহস পায়না,আর না সেই সাহস দেখাতে চায় সে।যদি না এতো বছরের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে যায়?আর যে প্রিয় মানুষটাকে পাওয়ার সাধনায় তার মন আকৃষ্ট হয়ে রয়েছে,যোগ্যতায় সেই মানুষটাকে মুখ ফুটে চাওয়া যে বড়োই অপরাধ।হঠাৎ নিভানকে থামতে দেখে ভাবনা কাটলো তৃনয়ের।নিভানের কুঞ্চিত নজরের দিকে তাকিয়ে সামনে তাকাতেই নিজের হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে উঠলো তার।সেই প্রিয় মুখটা।ফর্সা শরীরে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি জড়ানো, কি স্নিগ্ধ কি সুন্দর দেখাচ্ছে।শরতের কাশফুলে সাজানো বিকালটাও জেনো সেই সৌন্দর্যের কাছে ফিকে মনে হলো।নজর সরিয়ে নিলো তৃনয়।অবাক কন্ঠে শুধালো।

‘মান্যতারা এখানে আসবে তুই জানতিস না?দীবা আর মৌনতাও এসেছে দেখছি।

তৃনয়ের কথার উত্তর দেওয়ার আগে,প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করতে উদ্যোক্ত হলো নিভান,মা-কে ফোন দেবে তাই।তার আগে রানীসাহেবাকে গাড়ী থেকে বের হতে দেখে হাত থেমে গেলো,বুঝলো মায়ের অনুমতি নিয়েই বেরিয়েছে তারা।মান্যতারা আসবে সে জানতো না।উত্তরটা দিয়েই পিছে মুড়ে,গাড়ি যেখানে রাখা সেদিকে যাওয়ার জন্য এগোলো। তবে তৃনয়ের কথায় থেমে গেলো,তবে পিছে মুড়লো না।

‘এই নিভান, মান্যতাদের সাথে ওই নতুন মেয়েটা কে-রে?এতো অনিন্দ্য সুন্দরী?

চোখ বন্ধ করতেই,হঠাৎই সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া আবারও ভেসে উঠলো নিভানের বদ্ধ অক্ষিপটে।সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে ফেললো সে।ভুলে-ও পিছে মুড়লো-না।তবে নতুন মেয়েটা বলতে কে বুঝতে পারলো। তীক্ষ্ণ গলায় কথার বান ছুড়ে দিলো তৃনয়ের দিকে।

‘অনিন্দ্য সুন্দরীকে নজরে লেগেছে নাকি?

‘আল্লাহুম মাগফিরুলি।এগুলো কি বলিস!আমি-তো, তাকে দেখে এমনিতেই কথাটা বলে ফেললাম।যতো অনিন্দ্য সুন্দরি আমার সামনে দিয়ে যতোই ঘুরে বেড়াক না কেনো,আমার নজর সেখান থেকে কুঞ্চিতও নাড়াতে পারবেনা।

ঘাড় বাঁকিয়ে তৃনয়নের দিকে তাকাতেই,বোকা হেসে দিলো তৃনয়।বললো-ওরা হয়তো আমাদের দেখিনি।তাই বলে আমাদের যাওয়া উচিত নয়,ওদের দিকে?হঠাৎই দেখা যখন হয়ে গিয়েছে, চল কথা বলে আসি।

শীতল চোখে তৃনয়ের দিকে তাকাতেই সে ফের বললো-তুই এরকম হইছিস ক্যান ভাই।এতো অনুভূতি শূন্য।এরকম থাকলে বউ টিকবেনা তোর।

‘নিজেরটা টিকিয়ে দেখাস তারপর আমার কথা ভাবিস।আমারটা টিকবে কি টিকবেনা,সেটা আমি বুঝে নেবো।এখন চল আমার অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে।যেতে হবে।

সামনে এগোলো নিভান।কিন্তু তৃনয়ের পা কিছুতেই সামনে এগোতে চাইলো-না।প্রিয় নারীটাকে শাড়ী পরা অবস্থায় কাছ থেকে একটু দেখতে পেলো-না।কি আফসোস।পিছে ফিরলো আরও একবার।আফসোস জেনো আরও জোরালো হলো।ফের সামনে ফিরে, বিড়বিড় করে নিভানকে বকতে বকতে এগোলো সে।

‘নিজের অনুভূতি তো সব বিসর্জন দিয়েছে, এখন তাকে জুটি বানিয়ে তার গুলোও বিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছে।

বিকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যখন বাড়িতে বোনদের কাওকে দেখলোনা নাফিম।এমনকি কৌড়িকে-ও না। তখন কেঁদে কেটে স্বান্তনা রহমানকে অস্থির করে তুললো।কেনো বোনেরা তাকে নিয়ে গেলো-না, সন্ধ্যার পরে তারা বাড়িতে ফিরলেই নানা অভিযোগ জুড়লো নাফিম।মৌনতা সেই অভিযোগে একদম গুরুত্ব না দিলেও।দীবা বুঝালো তাকে।কাজ হলো-না।কৌড়ি বুঝালো তবু-ও মুখ ভার করে রইলো,কথা বললো-না তার সাথে।কৌড়ি যেতে চাইনি।মান্যতা একপ্রকার তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো।তাতে আবার শাড়ী পরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো,শেষে কৌড়ি যেতে চাইলেও।শাড়ী আর পরেনি।দীবা আপু আর মান্যতা আপু শাড়ি পরে গেলেও।সে আর মৌনতা সাধারনভাবেই গিয়েছিলো।

চেষ্টা করেও যখন নাফিমের গোমরা মুখের আদল কেউ পাল্টাতে পারলোনা।তখন মান্যতা,নাফিমের কাছে এসে তার ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো।

‘আচ্ছা ভুল হয়েছে তোকে নিয়ে যায়নি,কিন্তু এখনতো কিছু করার নেই।তবে ভুলের মাশুল হিসাবে আমি সুন্দর একটা অফার দিচ্ছি। কাল তোকে অনেকগুলাে চকলেট কিনে দেবো,আর আজ রাতে তুই ঘুমোনো অব্দি আমার ফোনটা তোরকাছে থাকবে।তুই যতো ইচ্ছে কার্টুন দেখ।

রাগ ভেঙে নাফিম উৎফুল্ল হয়ে বললো।—সত্যি বলছো বড়আপু।

‘তিন সত্যি।

নাফিমকে মানাতে পেরে খুশি হলো মান্যতা। নাফিম- ও খুশিমনে ফোন নিলো।কাল স্কুলে সাপ্তাহিক ছুটি,আর সপ্তাহের এই দু’দিন প্রাইভেট টিচার আসে না তার।এখন সে ইচ্ছেমতো কার্টুন দেখবে,গেইম খেলবে।ড্রয়িংরুমে বসেই ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।স্বান্তনা রহমান খানিক বিড়বিড় করে বকে নিজের রুমে চলে গেলেন।সারা বিকাল থেকে সন্ধ্যা ছেলের বকবকানিতে মাথা ধরেছে উনার।এখন একটু না শুয়ে পড়লে নয়।এরকম যে যার কাজে চলে গেলো।

রাত সাড়ে নয়টা বাজে তখনও নাফিম ড্রয়িংরুমে বসে ফোন দেখছে।স্বান্তনা রহমান আর নীহারিকা বেগম রাতের খাবার সাজাচ্ছেন ডাইনিং টেবিলে।সাথে রানিও এটাওটা এগিয়ে গুছিয়ে দিচ্ছে। এই চারটা মানুষ বাদে নিচে কেউ নেই।বাড়ির কলিং বেলটা বাজতেই রানি সাহেবা গিয়ে দরজা খুলে দিলো।সেদিকেও হুঁশ নেই নাফিমের।সে এতো সময় ফোনে গেইম খেললেও,এখন মান্যতা গ্যালারি ভরা পিকগুলো দেখতে ব্যস্ত।

হঠাৎ মনেহলো তার পাশে এসে কেউ বসেছে।পাশ ফিরে তাকাতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সে।উৎফুল্লতায় ডুবে থাকা মুখটা সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে গেলো।দাদাভাই কখন এসে পাশে বসলো!মা এতো সময় বারবার সাবধান করে যাচ্ছিলো।বলছিলো,তোর দাদাভাই আসার ডময় হয়ে গেছে ফোনটা রাখ।এসে যদি দেখে পড়া বাদ দিয়ে ফোনে গেম খেলছিস,দেখিস!সেই তাই হলো? হঠাৎ বোকার মতো কাজ করে বসলো নাফিম।পরাস্ত সৈনিকের মতো ফোন নামক অস্ত্রটা সসম্মানে নিভানের দিকে বাড়িয়ে দিল।সেটা দেখে কপাল কুঞ্চিত হলো নিভানের।হাত বাড়িয়ে সেটা নিতেই নাফিম দৌড়ে চলে গেলো।আশ্চর্য হয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নজর ফিরিয়ে আনতেই,নাফিমের রেখে যাওয়া ফোনের গ্যালারিতেই নজর স্থির হয়ে গেলো।

হালকা কলাপাতা রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটার।ফর্সা সাধাসিধা গোলগাল মুখটা আটকে আছে গাঢ় জলপাই রঙা একটা হিজাবে।সেভাব কিছুতে নজর আটকালো না নিভানের। নজর সোজা গিয়ে আটকালো মান্যতার পাশে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটার ডগরডগর কাজল-কালো চোখে।শীতল,স্থির নজরে সেই চোখে তাকিয়ে রইলো কিয়দক্ষন।নিঃসন্দেহে মায়াবীনি যাদুময়ী দু’টো চোখ।

ফোনটা রাখতে গিয়েও,রাখতে পারলোনা নিভান।মন টানলো।যে জিনিসটা কখনো করা হয়নি,সেটাই করতে বাধ্য করলো নিজের মন।মান্যতার ছবিটা একপাশে ফেলিয়ে কৌড়ির ছবিটা জুম করলো সে।সত্যিই তৃনয়ের ভাষ্যনুযায়ী অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়েটা।ছবিটা আরও জুম করতেই,কৌড়ির মোটামোটা চোখজোড়া স্কিনের উপরে আরও বড় হয়ে ধরা দিলো।কাছ থেকে সেই যাদুময়ী মায়াবিনী ডগরডগর চোখজোড়া,গভীর আর নিস্প্রভ নজরে দেখলো নিভান।হঠাৎই ফোনটা সোফার একপাশে রেখে দিয়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।আশেপাশে ভুলেও নজর না দিয়ে গটাগট সিঁড়ি পথ ধরলো।রুমের মধ্যে গিয়ে বাহিরের পোশাক ছেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ছিটা দেওয়ার সময় চোখ বন্ধ করতেই,সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া ভেসে উঠলো বন্ধ অক্ষিপটে।চোখ খুলে ওয়াশরুমের আয়নার নিজের প্রতিবিম্বের দিকে নজর দিলো নিভান।মনেমনে বিড়বিড়ালো।

‘নারী তুমি সত্যিই ছলনাময়ী।আর তোমার কঠিন ছলনা হলো,চোখের নোনাঅশ্রুদ্বারা পুরুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করা।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে