ফুলকৌড়ি পর্ব-১৬+১৭

0
8

#ফুলকৌড়ি
(১৬)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

‘বিশ্বাস করুন,আমি উনাকে কিছুই বলিনি বড়মা।আমি চুপচাপ কেনো বসে আছি,তাতেই নাকি উনি রেগে গেলেন।আর অত কথা শোনালেন।

কৌড়ির সহজ স্বীকারোক্তিতে কি বলবেন খুঁজে পেলেন না নীহারিকা বেগম।শুধু নিস্প্রভ নজরে কৌড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন।কাল কৌড়ির সাথে অকারণে ডালিয়া বাজে ব্যবহার করলো বলে তিনি কতোটা অসন্তুষ্ট হয়ে জাহিদ সাহেবকে কতো কথা শোনালেন। আজ ছেলের এই ব্যবহারে,তার হয়ে কাকে শোনাবেন কথা!নিভান তো এমন ধারার ছেলে নয়।তবে কেনো অকারণে মেয়েটার সাথে এমন ব্যবহার করল।নীহারিকা বেগমকে চুপ থাকতে দেখে কৌড়ি আবারও বললো।

‘উনি রেগে যাওয়ার মতো সত্যিই আমি কিছু করিনি বড়মা।

‘আমি বুঝতে পারছি,তারজন্য তোকে সাফাই দিতে হবে না।তবে হঠাৎ রেগে গেলো কেনো ছেলেটা,সেটাই বুঝতি পারছিনা।হঠাৎই কি এমন হলো,যে এতো রেগে গেলো!আর সেটা তোর উপরই ঝাড়লো।

কিছু সময় নীরব থেকে কৌড়ির মাথায় হাত রাখলেন নীহারিকা বেগম।ফের মুখ ছোটো করে অপরাধী কন্ঠে বললেন।–কিছু মনে করিস না, মা।ও যে ব্যবহারটা করলো,মোটেই ওরকম ছেলে নয় ও।হঠাৎ তোরসাথে ওরকম কেনো করলো বুঝতে পারছিনা।তবে এজন্য ও-কে আমি বকে দেবো।তবুও মন খারাপ করিস না।ঠিক আছে?

মৃদু হেসে মাথা নাড়ালো কৌড়ি।ফের মুখে বললো–ঠিক আছে।

নীহারিকা বেগম আবার’ও মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন। ‘তবে খেয়ে নে।

মন খারাপ করে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন নীহারিকা বেগম।ছেলেটা খাবার চাইলো,অথচ খেলো-না।তাতে আবার কৌড়ির সাথে ওরকম আচারন করলো। মনটা উনার খারাপ হয়ে গেলো।কৌড়ি খাবারে মনোযোগী হওয়ার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো ইভান।স্বভাব মতো চেয়ার টেনে ধপাত করে বসে পড়লো।ফের ভাবুক ব্যক্তির ন্যায় দুগালে হাত রেখ গলায় কৌতুক মিশিয়ে বললো — আসলে দাদাভাইতে তোমার সমস্যাটা কোথায় খুলে বলোতো,ফুলকৌড়ি?দাদাভাইয়ের মতো আমারও জানতে মন চাইছে,কেনো তাকে দেখলে, তোমার হাত পা থেমে যায়,নজর নুইয়ে পড়েে,লুকোচুরি লুকোচুরি খেলো?ব্যাপারটা কি?আমার মনেহয় দাদাভাইকে দেখলে তোমার সামথিং সামথিং ফিল হয়? ব্যপারটা কি খোলাখুলি তুমি বলোতো?আই প্রমিজ, আমি দাদাভাইকে কিচ্ছু বলে দেবোনা।

এসেছে দাদাভাই ভক্ত সাদা হনুমান।এই কতোদিন হলো এবাড়িতে এসেছে অথচ দুই ভাইকে কখনো এক জায়গায় বসতে দেখেনি,সেভাবে কথা বলতে দেখেনি।অথচ সারাদিন ভাইয়ের হয়ে উকালতি করে বেড়াচ্ছেন তিনি।মনেমনে কথাগুলো আওড়ে চললো,তবে মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করলো না কৌড়ি। এই সামনে বসা ইতুড়ে ছেলেটাকে যদি মনের মধ্যে চেপে রাখা কথাগুলো বলে দেয়,তবে তো আর উপায় নেই।সেই কথা নিয়ে সারাক্ষণ পিছে লেগে থাকবে তার।

‘কি হলো?বোবা মানুষের মতো চুপ হয়ে আছো কেনো?ঝটপট উত্তর দাও দেখি।দাদাভাই ছেড়ে দিলেও,আজ আমি ছাড়ছিনা।উত্তর আমার লাগবেই।যেহেতু তোমাকে দাদাভাইয়ের বউ বানাবো বলে ঠিক করেছি।সেহেতু উত্তর তো আমার জানা দরকার।লাগবেই লাগবে।বিয়েতে মেয়েপক্ষের সম্পূর্ন সম্মতি থাকার জন্য খুব প্রয়োজনীয় উত্তর এটা।সো ফটাফট উত্তর দাও।

সামনে বসা ইতুড়ে মানুষটার কথায় নিজেকে কেমন এলেবেলে লাগলো কৌড়ির।যার ধারালো মুখের দিকে তাকানোর আগেই পুরো শরীর ঝিমিয়ে আসে।যে মানুষটা আশেপাশে থাকলে,তার গায়ের কড়া সুঘ্রাণে নিজের অনুভূতি সব অবশ অবশ মনেহয়।সেই অদ্ভুত মানুষটাকে ঘিরে তাকে নিয়ে সব অদ্ভুত ভাবনায় নিজের মধ্যে কেমন এলোমেলো ঠেকলো।উত্তর দেওয়ার বদৌলে আগের ন্যায় মুখ ভার করে ইভানকে বললো।

‘আপনি মোটেই ভালো ছেলে নন।

উচ্ছল হাসলো ইভান।ফের বললো–সেটা আমি জানি।আর তোমার দেবর হিসাবে আমার মনেহয় আমি মোটামুটি ঠিকই আছি,অতশত পারফেক্ট হওয়া লাগবে না।তোমার বর হিসাবে পারফেক্ট দাদাভাই হলেই চলবে।এখন তাড়াতাড়ি বলে ফেলোতো,দাদাভাইতে মূলত তোমার সমস্যাটা কোথায় আর কি?

‘আপনার দাদাভাইতে আমার কোনো সমস্যা নেই।

‘তবে একটু আগে অকারণেই দাদাভাই তোমাকে বকলো? আমার দাদাভাই অকারণে গালের থুতু পর্যন্ত ফেলে না।সেখানে তোমাকে বকবে,নো নেভার।আমি মানিনা।তাড়াতাড়ি বলো?

নাছোড়বান্দা কাকে বলে,কত প্রকার, কি কি?উদাহরণ সহ ব্যাখা করলে হয়তো এই মানুষটার মধ্যে সবটা পাওয়া যাবে।আল্লাহ,এ কেমন মানুষ!এতো এনার্জি পায় কোথায় এই মানুষটা?বাড়ির প্রতিটি মানুষ তার ইতুড়েপনার কাছে অতিষ্ঠ হয়ে যায়।অথচ এই মানুষটা নির্বিকার।কৌড়ি বুঝলো,উত্তর না নিয়ে এই বান্দা আজ তার পিছু ছাড়বে না।এখন উত্তরটা না দিয়ে এড়িয়ে গেলেও,আজ সারাদিন এই উত্তর পাওয়ার আশায় তাকে এক কথা নিয়ে জ্বালিয়ে মারবে।

‘কি হলো।তাড়াতাড়ি বলো,তোমার আবার কলেজের দেরী হয়ে যাচ্ছেনা!

মুখ সেই আগের ন্যায় ভার করে,কিছুটা ইতস্তত করে বললো।–জঙ্গলের বাঘের গর্জন শুনেছেন কখনো?শুনেছি তেনার গর্জন শুনলে নাকি মানুষের অর্ধমৃত অবস্থা হয়ে যায়।যাওয়ারই তো কথা।বনের রাজা মহাশয় বলে কথা।তার হুঙ্কারে তো রাজ্য কাপবেই!
আর সেই বনের রাজা মহাশয় যদি সাক্ষাৎ সামনে এসে সরাসরি দেখা দেয়,তখন সেই অর্ধমৃত হৃদয় কি বাঁচে?
আপনার দাদাভাইয়ের কন্ঠ আমার সেই বনের রাজা মহাশয়ের গর্জনের মতোই মনে হয়।আর উনার সাক্ষাৎ আমাকে…

থেমে গেলো কৌড়ি।শব্দ করে হেসে ফেললো ইভান।বললো–বাহ দারুণ উদাহরণ।তবে সেই মানুষটার সাথে সারাজীবন থাকা লাগলে,তখন কি করবে? কিভাবে থাকবে?

অজান্তেই শরীর শিরশির করে,গায়ের সমস্ত লোম কাটা দিয়ে উঠলো।ওই মানুষটা আর সে!অদৃশ্য ভঙ্গিতে শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠলো।কখনোই না।ভাবতে গেলেও, নিজেকে কেমন নিজের নিঃশ্বাস নিজহাতে বন্ধ করে ফেলার মতো মরমর অনুভূতি হয়।ভাবনা মতোই তড়িৎ গতিতে মাতা নাড়িয়ে গড়গড় করে বললো।

‘কখনোই থাকা লাগবেনা আমার।ওই মানুষটার যেদিকে পথ হয়,আমি জেনো সেই পথের উল্টো দিকের যাত্রী হই।সবসময় আমার পথটা জেনো উল্টো পথেয় হয়।সৃষ্টিকর্তার কাছে সবসময় এই দোয়া আমার।

মুখ করুনদশা করে ফেললো ইভান।গলা খাদে নামিয়ে বললো–তুমি এভাবে আমার আশা ভরসা,মন ভেঙে দিতে পারো না ফুলকৌড়ি। আমি কনফার্ম করে ফেলেছি,তোমাকেই আমি দাদাভাইয়ের বউ বানাবো।আর তুমি তাতে অসম্মতি জানাতে পারো না কখনোই।

আবারও সেই জলদগম্ভীর মানুষটাকে একবার ভাবলো কৌড়ি।তার গম্ভীর কাটাকাট মুখের আদল,সেই আদলে কখনো সে হেসে কার-ও সাথে কথা বলেছে কি-না সন্দেহ?তার চিহ্ন মাত্রা অবলোকন কখনো চেহারায় প্রকাশ পায়না।ওই ধারালো দৃঢ় চোখ,সবসময় কেমন সু-গভীর নজরে তাকিয়ে থাকে?কৌড়ির যে-ক’বার ওই নজরে নজর পড়েছে,মস্তিষ্কের রক্ত ছলকে পায়ে নেমে গিয়েছে।আর ওই কন্ঠস্বর,যেখানে মিষ্টান্নতা বলে কোনো জিনিসই নেই।সেই মানুষ আর সে!রক্ষা করা প্রভু।তড়তড়িয়ে বললো।

‘অবশ্যই পারি।আর আপনার ওই ভাইয়ের বউ টিকবে না কখনো।কেমন অদ্ভুত মানুষ!

আবারও হাসলো ইভান।হাসি মুখে প্রানউচ্ছল কন্ঠে বললো—তুমি হলে গ্যারান্টিসহ হান্ড্রেড পার্সেন্ট টিকে যাবে,ফুলকৌড়ি।

এমনিতেই ভিতরে ভিতরে তুফান বয়ে যাচ্ছে। তারমধ্যে এই ছেলেটার থামার নাম নেই।বিরক্ত হয়ে ভয় দেখিয়ে বললো।

‘এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ইভান ভাইয়া।আমি কিন্তু বড়মাকে বলে দেবো।

চুপসে গেলো ইভান।মনও ভিষণ খারাপ হয়ে গেলো।এই মেয়ে না গললে হবে কিকরে?তার দাদাভাইয়ের জীবনে ফুলকৌড়ির মতো একটা শান্তশিষ্ট কোমল মনের মেয়ে যে খুব দরকার।কি হবে এখন?পাত্রী বেঁকে গেলে তো সবশেষ!অনেকক্ষণ চুপ থাকলো ইভান।তারমধ্যে কৌড়ির খাওয়া প্রায়ই শেষ।হঠাৎই কিছু ভেবে মুখে দুষ্ট হাসি ফুটলো ইভানের।আশেপাশের মানুষ শুনে ফেলবে এমনকরে কিছুটা হিসহিসিয়ে বললো।

‘আমি একটা সিক্রেট জানি ফুলকৌড়ি।শুনবে?

ইভানের বলার ধরন দেখে আশ্চর্য হয়ে মুখ ফসকে বলে ফেললো।–কি?

‘দাদাভাই তোমাকে চুরি করে-করে দেখে।

নিভান নামক আস্ত লোকটা মানে তারজন্য মারাত্মক বিষম।যেদিন থেকে এই লোকটার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে সেদিন থেকেই তার এই মরমর বিষম লাগা শুরু হয়েছে।ইভানের কথা শুনেই খালি গলায়ও বিষম খেলো কৌড়ি।পানি এগিয়ে দিলো ইভান।সেটা খেয়েই অল্পের উপর দিয়ে ছেড়ে গেলো।তবে ইভানের কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো, মানুষটা তাকে চুরি করে দেখে!তাকে চুরি করে দেখার কি হলো?তবে চুরি করে আর কোথায় দেখে,ওই মানুষটার পানে যে কয়বার তাকিয়েছে।সরাসরি মানুষটার ওই ত্রিশূল নজরে বিদ্ধ হয়েছে সে।আর সেই নজরটা যে স্থির তার উপরেই থাকে,এটাও অনুভব করেছে।তবে?ভাবনা আর এগোতে পারলোনা।তার আগেই ইভান ফের বললো।

‘যেদিন তুমি আমাদের বাড়িতে এসেছিলে,ওইদিন প্রথম আমি দাদাভাইকে দেখলাম নিষ্পলক কারও দিকে মুগ্ধ নজরে তাকিয়ে থাকতে।তোমার দরজার সামনে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো দাদাভাই।দেখেছিলাম আমি দাঁড়িয়ে থাকতে,তবে এতোটাও গায়ে মাখইনি।ক্লান্ত হয়ে পরিক্ষা শেষে বাড়িতে ফিরেছিলাম,বিষয়টা ওতোটাও গুরুত্ব দেই নি।ভেবেছিলাম,হয়তো কোনো কারনে দাদাভাই ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে।তবে তার মুগ্ধ নিষ্পলক নজরটা আমাকে খটকা লাগিয়ে দিয়েছিলো।তবে ক্লান্ত থাকায় বিষয়টা উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিলাম আমি।তুমি ও-রুমে জায়গা করে নিয়েছো বিষয়টা তখন আমি জানতাম না।পরে নাফিমের কাছ থেকে জেনেছি।যে আমাদের বাড়িতে ফুলকৌড়ি নামক একটা শান্তশিষ্ট সুন্দর মেয়ে এসেছে,আর সেই মেয়েটার জায়গা হয়েছে ওই রুমে।
তখন আমি দুইয়ে দুইয়ে এক করতে পারলাম।তবে
সত্যি বলছি,এরআগে দাদাভাইকে ওভাবে কখনো কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে দেখিনি আমি।বিলিভ্ মি ফুলকৌড়ি।

ঝড় উঠে গেলো কৌড়ির দেহ মনে।উথাল-পাতাল করে দেওয়া কালবৈশাখী ঝড়!তবে সেদিন যখন নামাজের বিছানায় চুপ হয়ে বসেছিলো,তখন মনে হয়েছিলো কেউ তাকে নিরোট নজরে দেখছে।তারপর আশেপাশে, দরজার সম্মুখে তাকাতেই দেখলো কেউ নেই।কৌড়ি মনে করেছিলো, তার মনের ভ্রম।তবে ইভান ভাইয়া যে বর্ননা দিলেন,বর্ননা অনুযায়ী মনে হচ্ছে তো ওই মানুষটা দাড়িয়ে ছিলো সেখানে।রন্ধ্রে রন্ধ্রে টগবগিয়ে উঠলো রক্ত।তোলপাড় শুরু হলো বুকের খাঁচাটার মধ্যে।
গোলগোল নজরে ইভানের মুখের দিকে তাকাতেই দেখলো,সিরিয়াস মুখাভঙ্গিমা করে বসে আছে ছেলেটা।
সবসময়ের সেই দুষ্টুমি মুখাভঙ্গিটা তার নেই।তবে কি কথাগুলো….আর ভাবতে পারলোনা।এদিকে কলেজে যাবার সময়টা গড়িয়ে যাচ্ছে সেদিকেও তার খেয়াল, হুঁশ,কিছুই নেই।

ড্রয়িংরুমে মধ্যে স্থলে দাঁড়িয়ে ডায়নিং টেবিলে বসা ছেলে মেয়ে দু’টোকে শান্ত নজরে কিছুসময় অবলোকন করলো নিভান।তখন রেগেমেগে বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসতেই দেখলো,গাড়ির চাবি আনিনি সে, সাথে ফোনটাও।আগে কখনো প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সঙ্গে নিতে ভুলেও ভুলতো-না সে।কিন্তু এখন অনায়সে ভুলে যায়।ইদানীং ভুলে যাওয়ার রোগ হয়েছে তার মন মস্তিষ্কের।মন মস্তিষ্কে তো আগে শুধু সে আর তার নিজের প্রয়োজনীয় ভাবনাগুলাে ছিলো,এখন সেখানে বাসা বেঁধেছে অন্যকেউ।মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে ডালপালা গজিয়ে ছড়িয়ে বাসা বেঁধেছেন এক যাদুকারিনী,না ভুলে উপায় আছে কি।অথচ সেই যাদুকারিনী তার যাদু ছড়িয়ে,বেখবর।তপ্ত শ্বাস ফেললো নিভান।সেই চাবি আর ফোন নিতে এসে দেখলো,কি সুন্দর গল্পে মেতে আছে ডায়নিং টেবিলে বসা দু-জন।অথচ সে সামনে গেলেই যতো সমস্যা শুরু হয়ে যায় সেই যাদুকারিনীর।কৌড়ির উপর রাগ তিরতির করে বেড় গেলো নিভানের।রাগে হনহনিয়ে চলে গেলো সে।

ডালিয়া বেগমকে ডেকে পাঠালেন জাহিদ সাহেব।চার ভাইয়ের একমাত্র বোন ডালিয়া বেগম।মা বাবা ছাড়াও সেই সুবাধে ছোটো থেকেই সবার ভিষণ আদরের তিনি। ভাইদের তো অতি আদরের।এই অতি আদরে আদরে মানুষ হওয়ায় ছোটো থেকেই কিছুটা গৌরবি স্বভাবের তিনি।নিজের ভুলত্রুটি আমলে নেন-না,অন্যের ত্রুটিগুলো খুঁজেখুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।আর ত্রুটি পেলে খোঁটা দিয়ে কথা বলতে দু’বার ভাবেন-না।শুধু নিজে আর নিজের মেয়ে বাদে আপন পরও ছাড়েন না।জাহিদ সাহেব ডাকতেই চটজলদি পায়ে না এগোলেও ধীরে ধীরে ভাবুক মনে ভাইয়ের ঘরের দিকে এগোলেন।অনুমতি নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই দেখলেন সেখানে ভাই ভাবি দু’জনেই আছে।রুমে ঢুকতেই পরিস্থিতি বুঝে ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলেন।ফের আহ্লাদী গলায় শুধালেন।

‘আপনার শরীর কেমন আছে ভাইজান?

জাহিদ সাহেব বরাবরই গম্ভীর স্বভাবেরই মানুষ। স্বভাব মতো গম্ভীর গলায় বললেন।–আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমার ওদিকের কি খবর?

যদি-ও প্রশ্নটা করতে চাননি জাহিদ সাহেব।তবে বাধ্য হয়ে প্রশ্নটা করলেন।বোন তো,সে যেমনই হোক তার ভালোমন্দের খোঁজখবর রাখাতো উনার কর্তব্য দায়িত্ব।

‘আলহামদুলিল্লাহ,সব ঝামেলা মিটিয়ে এসেছি।আমার ছেলে সন্তান নেই, শুধু মেয়ে বলে, জমিজায়গার হিসাব নিকাশে কম দিতে চেয়েছিলো ওরা।আমি ডালিয়া ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নাকি,দিবার বাপে যে সম্পত্তির ভাগিদার।সব হিসাবকিতাব করে গুছিয়ে নিয়েছি সাথে এক চাচা শ্বশুরের ছেলের কাছে বিক্রি করার ব্যবস্থাও করে এসেছি।

‘এসবের কোনো দরকার ছিলো না কিন্তু।তুমি অযথা ঝামেলা করলে।আর ছেলে সন্তান না থাকলে,শুধু মেয়ে সন্তান থাকলে নিজের ভাইয়ানা সম্পত্তির ভাগিদার হয়ে যায় অন্য ভাইয়ে-রা।সেই সূত্রে মেয়ে-রা সম্পত্তি কমই পায়।

‘তাই বলে ওরা আমার এতিম মেয়েকে বঞ্চিত করবে।তা আমি হতে দেই কিকরে?আমার মেয়েরটা ভাগ আমি কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নিয়ে এসেছি।একতিল ছাড় দেইনি কাওকে।

বোনের এই খেয়ালিপনায় মনেমনে বিরক্ত হলেও চোখে মুখে সেটা প্রকাশ করলেন না জাহিদ সাহেব।সেদিকে আর কথাও বাড়ালেন না।অযথা যুক্তিতর্ক বাড়বে।যতোই বোঝান না কেনো কাজ হবেনা।নিজে যা বুঝবে সেটাই করবে।তাই যেটা বলার জন্য বোনকে এখানে ডাকলেন।সেটা বলার জন্য মনস্থির করলেন।একপলক দেখে নিলেন,নিজ মনে আলমারির মধ্যে কিছু ঘাঁটতে থাকা নীহারিকা বেগমকে।ফের বললেন।

‘যে মেয়েটাকে এবাড়িতে দেখছো, সে এবাড়ির আশ্রিতা নয়।আমার খুব কাছের একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর মেয়ে।যার সাহায্যে তোমার ভাইজান সসম্মানে আবারও মাথা উচু করে দাঁড়াতে পেরেছে।তাই তাকে কখনো ছোটো করে কথা বলো-না।বাঁকা নজরে দেখো না।আমি কিন্তু সেটা কখনো মেনে নেবো-না।মেয়েটা আমার কাছে একপ্রকার আমানত সরূপ।সেই আমানতের শারীরিক বা মানসিক কোনো খেয়ানত আমি বরদাস্ত করবো-না।
বিষয়টা খেয়ালে রেখো।

অনাকাঙ্ক্ষিত অপমানে মুখাবয়ব থমথমে হয়ে গেলো ডালিয়া বেগমের।রোষানল নজরে একবার নীহারিকা বেগমকে দেখলেন।তিনি একমনে আলমারি খুলে কিছু একটা করছেন। আলমারির সামনে দাঁড়ানোতে দেখা যাচ্ছে না,মুলত তিনি কি করছেন।তবে ডালিয়া বেগম
বুঝে ফেললেন,ভাইজানের কানে কথা কে ঢেলেছে।মনেমনে ভিষণ ক্ষুব্ধ হলেন নীহারিকা বেগমের উপর।তবে চেয়েও মুখে কিছু প্রকাশ করতে পারলেন না।ভাবীর কান ভাঙাতে ভাইজান ডেকে এনে ঠান্ডা মাথায় অপমান করলেন,বিষয়টা আরও গায়ে লাগলো উনার।জাহিদ সাহেব ফের বললেন।

তোমার ‘মেয়ের কথা ভাবো।তার সংসার কিকরে টিকিয়ে রাখা যায়,সেটার চেষ্টা করো।অযথা অন্যের খাওয়া,পরার, থাকার,হিসাবে প্রেশার না নিয়ে মেয়ের বিষয়ে প্রেশার নাও।সংসার ছাড়া মেয়েটা কতোদিন এখানে পড়ে আছে,তার ভালোমন্দের খোঁজখবর নাও। কতো মানুষ কতোকিছু বলছে,সেটা থেকে মেয়েটাকে বাঁচাতে তার জীবনের একটা ভালোমন্দ সিদ্ধান্তে যাও।
অন্যের বিষয়ে খেয়ালি না হয়ে মেয়ের বিষয়ে খেয়ালি হও।তাতে আখের তোমারী ভালো হবে।সিয়ামের বাবা মা আসতে চেয়েছিলো,তাদের বৌমাকে নিয়ে যেতে।
তোমার মেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সেখানে থাকবে না।
তুমি থাকতে, তোমার মেয়ের সিদ্ধান্তে আমি মতামত রাখবো।সেটাতো ভালো দেখায় না, উচিতও নয়।তুমিও অসন্তুষ্ট হতে পারো।বিধায়,তুমি বাড়িতে নেই জানিয়ে তাদের আসাটা আঁটকে রেখেছি।এসেছো।মেয়ের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নাও।সে-ও প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে,নিজের ভালোমন্দ সব বুঝ তার আছে।আর তুমিও তার মা।ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত জানাও,আমি তাদেরকে আসতে বলি।একটা মিমাংসে তো যাওয়া উচিত।এভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় সম্পর্ক রাখা ঠিক নয়।আর এভাবে তো জীবনও চলতে পরে না।

ডালিয়া বেগম নিজের অপমানিত হওয়া বিষয়টা বাদ দিয়ে এবার মেয়ের জন্য ভাবতে বসলেন।মেয়েকে এতো করে বোঝালেন অথচ কাজ দিলো-না।পুরুষ মানুষের ওরকম একটু আধটু চারিত্রিক সমস্যা থেকেই থাকে তাই বলে, রাজপুত্রের মতো বর,প্রাচুর্যে ঘেরা সংসার ছাড়তে হবে!নাকি নিভানের ভুত আবার চেপেছে মাথায়।যেটা মেয়ে উনার কাছে প্রকাশ করতে চাইছে না।মনেমনে এবার মেয়ের প্রতি ভিষন ক্ষুব্ধ হলেন।নিভানকে ভেবে যদি মেয়ে নিজের পাহাড় সমতুল অর্থ বিত্তের সংসার ছাড়তে চায় তা কখনোই হতে দেবেননা।

সময় গড়াতে থাকলো,আর আস্তে আস্তে নিজেকেও সেই সময়ের সাথে সাথে মানিয়ে নিতে থাকলো কৌড়ি।এখন এই বাড়িটা তার খুবই পরিচিত জায়গা সাথে বাড়ির মানুষগুলোও।আর সবাই তাঁকে প্রচন্ড ভালোও বাসে।বিধায় এতো তাড়াতাড়ি বাড়ির মানুষগুলোর সাথে সহজ হতে পেরেছে সে,মিশতে পেরেছে।আর নিজেকেও মানিয়ে নিতে পেরেছে।সময়টা শুক্রবার বিকাল।শুক্রবার মানেই বাড়িতে একটা আলাদা হৈচৈ থাকে।তবে এবাড়িতে বিশেষ কিছু মানুষের জন্য সেই হৈচৈ আড্ডা দুষ্টমি না থাকলেও শুক্রবারের দিনটা বিশেষ ভাবেই কেটে যায় এবাড়ির বাচ্চাপাটিগুলোর।তারা নিজেদের মতো স্পেশাল করে নেয় শুক্রবারের দিনটা।

ছাঁদে দাঁড়িয়ে নাচের প্রিপ্রারেশন নিচ্ছে মৌনতা আর মান্যতা।দু-বোন বেশ ভালোই নাচে।এর-আগে কৌড়ি দেখেছে একবার।দর্শক হিসাবে আছে, সে আর নাফিম। দর্শক হিসাবে নাফিম শুধু দাঁড়িয়ে নেই।ইভানের কাছ থেকে ফোন এনে ভিডিও এর কাজে লেগে পড়েছে।আজ ছোটো দাদাভাইয়ের ফোনটা বাগে পেয়েছে,কতো ইনিয়ে বিনিয়ে ফোনটা নিয়েছে গেম খেলার জন্য।অথচ গেম খেলাই তার হলোনা। ছাঁদে এসে দেখলো, বোনেরা সব সেজেগুজে নাচের জন্য রেডি হচ্ছে।আর কি!মান্যতা আপুর ফোনে গান চলছে, তার হাতে ছোটো দাদাভাইয়ের ফোনটা দেখেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করলো ভিডিও করার জন্য।নাফিমও বাধ্য হয়ে গেম খেলা বাদ দিয়ে ভিডিও এর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।নাহলে অন্যসময় মান্যতা আপুর ফোন চাইলেও তাকে দেবেনা।

‘আকাশে বাতাসে চল সাথি উড়ে যাই চল ডানা মেলে রে।
ময়নারে ময়নারে যাবো তোর পিছু পিছু ডানা মেলে রে।
আকাশে ভেসে চল,রুপকথার চল।
ওই দেশে বাঁধবো ঘর।
পার হয়ে তেপান্তর।
সাত সাগর তেরো নদী পিছনে ফেলে।

গানটার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে মেয়ে দুটো দারুন নাচতে থাকলো।মুগ্ধ হয়ে তা দেখলো কৌড়ি।মনে পড়ে গেলো প্রিয় বান্ধবীটার কথা।তার স্কুল এন্ড কলেজে জীবনের ঘনিষ্ট বান্ধবী ছিলো বিথী।মেয়েটার বাড়িটা তাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে।বিথীও খুব সুন্দর করে নাচতে পারতো।কৌড়ি কলেজ ছাড়া-তো সেভাবে বাড়ির বাহিরে বের হতো না।দাদিআপার-ও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো।তাই মেয়েটা সময় পেলেই তার কাছে চলে আসতো।দু’জনে মাতিয়ে গল্প করতো আড্ডা দিত।মাঝেমধ্যে গান ছেড়ে,রুমের মধ্যে নাচতো।মেয়েটার কাছ থেকেই মোটামুটি নাচটা শেখা কৌড়ির।তবে মেয়েটা নাচতে পারতো প্রফেশনালদের মতো।বান্ধবীটা তার এখন কেমন আছে কে জানে।এখানে আসার পর আর কখনো তো কথা হয়নি।হয়নি বলতে সুযোগ হয়নি।যদি একটা নিজস্ব ফোন থাকতো তার,তবে অবশ্যই সে খোঁজখবর নিতো,রাখতো।

‘কি ভাবছো?

গান শেষ হতেই নাচ থামিয়ে, কিছুটা হাঁপিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো মান্যতা। কৌড়ি জেনো হুঁশে এলো।মৃদু হেসে বললো।—তেমন কিছু না আপু।আপনি কিন্তু দারুণ নাচতে পারেন।আমার একটা বেষ্টফ্রেন্ড ছিলো, জানেন সে-ও আপনার মতো দারুণ নাচতে পারতো।

ছোটো বেলায় শখ করে নাচ শিখছিলো।স্কুল প্রগামও করেছে বেশ।তবে বড় হওয়ার পর,বাড়ির কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে।বাহিরে কোথা-ও নাচের পারমিশন নেই।বিশেষ করে দাদাভাই আর মায়ের।একগাল হাসল মান্যতা। হাসিটা জেনো অমায়িক মানায় ওই ফর্সা মুখে।বললো–তাই।আমাকে দেখে তবে বান্ধবীর কথা মনে পড়ে গেলো।

‘হুম আপু।স্বভাবেও আপনার মতো মিশুকে আর ভারী মিষ্টি সে।

‘নাম কি তোমার বেষ্টফ্রেন্ডের?

উচ্ছল গলায় কৌড়ি বললো।’নাজিয়া বীথি।

‘খুব সুন্দর নাম।কথা বলতে ইচ্ছে করেনা তারসাথে?নিশ্চয় তাকে মিস করছো খুব?

হঠাৎই হাস্যোজ্জ্বল মুখে আধার নেমে এলো কৌড়ির।
মন খারাপ হয়ে গেলো।বললো–খুব মিস করি।আর কথাও বলতে ইচ্ছে করে খুব খুব।

ছাঁদের একপাশ ঘেঁষে করা সিমেন্টর তৈরী বসার স্থান। সেখানে বসা কৌড়ি।কৌড়ির পাশে গিয়ে বসলো মান্যতা।কোমল গলায় বললো–মন খারাপ করো-না। তার নাম্বার জানা থাকলে,আমার ফোন থেকে কথা বলে নিও।অথবা তার কোনো ফেসবুক আইডি থাকলে
আমার আইডি থেকে রিকুয়েষ্ট দিয়ে,যোগাযোগ করো।আর মা’কে বলে আমি তোমার ফোনের ব্যবস্থা করে দেবো।

হুট করে মান্যতাকে জড়িয়ে ধরলো কৌড়ি।ফের বললো–আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু।আর আমার ফোন লাগবেনা।আপনার ফোন থেকে মাঝে মাঝে একটু কথা বলতে দিলেই হবে।

খুশি হলো মান্যতা।এই মিষ্টি মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে,তার ভীষন মায়া হয়।কি আদূরে একখান মিষ্টি সুন্দর মুখ,চালচলন আদব কায়দায় ভারী সভ্য মেয়েটা।কোনো কিছুতে উগ্রতা নেই,বাড়াবাড়ি নেই।অথচ এই বয়সে সে কতো জেদ,কতো বাড়াবাড়ি করেছে।অবশ্যই এখন অনুতপ্ত হয় সেগুলোর জন্য।আর মনেমনে দাদাভাইকে ধন্যবাদ জানায়, তখন যদি দাদাভাই কড়া হাতে শাসন না করতো।কতোটা বিগড়ে যেতো,সেটা সেই কলেজ জীবনের কিছু বন্ধুবান্ধবদের এখনকার পরিস্থিতি জানলে বোঝা যায়।যাই হোক,আল্লাহ যেটা করেন ভালোর জন্য করেন।

‘এভাবে কাজ হবেনা।আমরা নাচছি তোমাকেও আমাদের সাথে নাচতে হবে।তোমার প্রিয় বান্ধবী যখন নাচতে পারে,নিশ্চয় তোমাকেও শিখিয়েছে।অল্পস্বল্প হলেও তুমিও নিশ্চয় জানো।তাতেই চলবে।চলো আমরা একসাথে নাচবো।

মান্যতা উঠে দাড়িয়ে কৌড়ির হাত চেপে ধরতেই কৌড়ি বললো—আপু,আমি আপনাদের মতো নাচতে পারিনা। প্লিজ আপু।

মান্যতা কিছু বলতে যাবে,তা আগেই মৌনতা বললো– আপু,কৌড়ি আপু নাচতে না পারলে-ও খুব ভালো গান গাইতে পারে।উনার গানের গলা বেশ,আমি শুনাছি।

লজ্জা পেলো কৌড়ি।লজ্জালু গলায় প্রতিবাদ করে বললোো।–মোটেই না।আমি মোটেই ভালো গাইতে পারিনা।ওরকম গুনগুন করে গান সবাই গাইতে পারে।

মান্যতা, মৌনতা কেউই ছাড়লো না।এমনকি নাফিম-ও নাছোড়বান্দার মতো চেপে ধরলো ও-কে।গান গাইতে স্বীকার না করা পর্যন্ত,কেউই ছাড়লোই না।বাধ্য হয়েই গান গাইতে স্বীকারোক্তি জানাতে হলো তাকে।কৌড়িকে গান গাইতে স্বীকার হতে দেখেই,সবাই চুপচাপ বসে পড়লো।লজ্জা পেলো কৌড়ি।তবে বিমুখ করলো না।চোখ বন্ধ করে গলায় সুর তুললো।আর সেটাও ভিডিও করলো নাফিম।

কার্নিশে ভুল,অবেলা বকুল,
থাকো ছুয়ে,একুল ওকুল।
থাকো ছুয়ে শহুরে বাতাস,
ছুঁয়ে থাকো নিয়ন আকাশ।
আবছায়া চলে যায় হিজলের দিন,
অভিমান জমে জমে আমি ব্যথাহীন।
আহারে জীবন, আহারে জীবন,
জলেভাসা পদ্মা জীবন… !!

আহা পারতাম,যদি পারতাম,
আঙুলগুলো ছুঁয়ে থাকতাম।
বিষাদের জাল টালমাটাল,
একোন দেয়াল,একোন আড়াল।
ছাই হয় গোধুলী কারে যে বলি,
একোন শ্রাবন আজ বয়ে চলি।
আহারে জীবন,আহারে জীবন
জলে ভাসা পদ্ম জীবন…!!

চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনোজল বয়ে গেলো কৌড়ির।দেখলো সবাই।তবে কি বলবে ভুলে গেলো।মেয়েটার গানের গলা সত্যিই বেশ।ধীরেসুস্থে চোখ খুলে হাসলো কৌড়ি।দু’হাতে ফটাফট চোখ মুছে নিলো।সেটা দেখে পরিস্থিতি সহজ করতে মান্যতা কৌড়ির হাত চেপে ধরে বললো —চলো একসাথে তিনজনে মিলে একটা নাচ দেই।যেমনই হয় হোক।

কৌড়ি বারবার না স্বীকার করলো,এবারেও কাজ হলো না।বাধ্য হয়ে কোমরে ওড়না বেধে,গানের সাথে তাল মিলিয়ে, মৌনতা আর মান্যতার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে নাচতে হলো তাঁকে।

রাতের খাবারের পর,নিজের আরামদায়ক বিছানায় হাত পা এলিয়ে দিয়ে ফোন নিয়ে বসলো ইভান।গ্যালারিতে ঢুকতেই দেখলো,অসংখ্য ভিডিও আর পিক।এটা নিশ্চিত নাফিমের কাজ।বিকাল বেলা কতো ইনিয়েবিনিয়ে ফোন নিয়ে কিসব আলতু ফালতু ভিডিও করেছে।সাথে ছাদের ফুলগাছ ফুলগাছ কোনো কিছুর পিক তুলতে বাকী নেই।সাথে মৌনতা আর মান্যতার ছবিতে ভরা।বিরক্ত নিয়ে একের পর এক পিক ডিলিট করতে গিয়ে দেখলো,দুই একটা কৌড়ির পিকও আছে।
কৌড়ির পিকগুলোও ডিলিট করতে থাকলো।দুটো পিক থাকতেই হঠাৎ মনেহলো কৌড়ির পিক তার ফোনে!তারপর মনেহলো,নাফিম কি ভিডিও করেছে?ভিডি-ও গুলো দেখতেই মন মস্তিষ্কে দুষ্টমী খেলে গেলো তার,অধোর কোণ প্রসারিত হলো বাঁকা হাসিতে।মূহুর্তেই হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো সে।কাঙ্ক্ষিত নাম, নাম্বারটা নজরে পড়তেই বেছেবেছে দুটো ভিডিও সঙ্গেসঙ্গে সেন্ড করে দিলো,সাথে একটা পিকও।টিকচিহ্নের গোলাকার চিহ্নটা মূহুর্তেই হালকা কালো রঙে ভরাট হয়ে যেতেই মুখের হাসি চওড়া হলো তার।দাদাভাই লাইনে আছে।একটু পরে পিক আর ভিডিও ডিলিট করে দিয়ে।মেসেজ দেবে সে।–স্যরি দাদাভাই,ভুল করে চলে গেছে।

ল্যাপটপে অফিসিয়াল কাজ করছিলো নিভান।হঠাৎ ল্যাপটপের পাশে রাখা ফোনটা,মেসেজ নোটিফিকেশন আসতেই জ্বলে উঠলো।গুরুত্ব দিলোনা।একমনে কাজ করে চললো।ফোনের আলো নিভে গেলো।বেশ কিছুক্ষণ পরে ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে লম্বা মিসড্ কল আসায়,মনোযোগ ফোনে দিতে বাধ্য হলো নিভান।।ফোনটা হাতে তুলে নাম্বার দেখলো।চেনা পরিচিত নয়।তবে কে দিলো?কিছুসময় অপেক্ষা করে দেখলো,আর কল দিচ্ছনা।হবে হয়তো রং নাম্বার!ফোনটা রেখে দিতে গিয়ে দেখলো ইভানের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে মেসেজ। ইভান তো কখনো তাকে নক বা কল করেনা।নম্বরটা সেভ থাকায় হোয়াটসঅ্যাপে এড হয়ে আছে।তবে বিশেষ কথা হয়না কখনো।তবে আজ,কি কারনে মেসেজ দিলো।আর কি মেসেজ?কৌতুহল বশত হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো নিভান।

বিকালের নরম আলোতে,হাঁটু সমান চুল ছেড়ে রাখা এক মায়াহরিনী এলোকেশী কন্যা।দুধে আলতা গায়ে হালকা কলাপাতা রঙের ড্রেসটা,সোনালী আদ্রের মতো জ্যোতি ছড়িয়েছে।মায়ামায়া মিষ্টি একখান লাবন্যময়ী মুখ।ডাগরডাগর আঁখি জোড়া দিয়ে দুরের কিছু জেনো একমনে দেখে চলেছে সে।রক্তিম চিকন ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে মিষ্টি হাসি।সুগভীর নজর স্থির হয়ে গেলো পিকটায়।সাধারণ একটা পিক।অথচ নিভানের নজর মুগ্ধতায় ছেয়ে গেলো।মন শান্তি পেলো।ছবির দিকে নির্মিশেষে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎই হাত লেগে ভিডিও অন হয়ে গেলো।মূহুর্তেই মিষ্টি স্বরের গানের ভিডিওটা চলতে শুরু করলো।গানের অর্ধ পর্যন্ত শুনতে পারলো না,তারমধ্যে ভিডিও ডিলিট।সঙ্গে পিক-ও।মূহুর্তেই এলোমেলো হয়ে গেলো নজর,তোলপাড় শুরু হলো শক্তপোক্ত বুকটার ভিতরটায়।ত্রস্ত হাতে বারবার ইভানের হোয়াটসঅ্যাপ আইডির ভিতর বাহির করতে থাকলো।কাজ হলো না।ক্ষন বাদেই ইভানের মেসেজ এলো–স্যরি দাদাভাই ভুলে তোমাী আইডিতে ওগুলো চলে গেছে।

মেজাজ অকারণেই প্রচন্ড খারাপ হলো নিভানের।
না চাইতেও ইভানের প্রতি মনেমনে বেশ ক্ষুব্ধ হলো সে।
এগুলো আজ বিকালের ভিডিও আর পিক।সেটা বেশ বুঝতে পারলো।তবে সারা বিকাল ইভান ঘুমে কাটিয়ে সন্ধ্যার পরে গিয়ে উঠলো।মা এই নিয়ে কতো চেচামেচি করলো।সারা সপ্তাহে শুক্রবারের জুমার নামাজ ছাড়া আর কোনো নামাজ নেই।নামাজ নিয়ে কতো কথা শোনালো।সেই ছেলে তার ফোনে এসব ভিডিও করলো কখন?আর কাকেই বা দিতে গিয়ে তার আইডিতে এলো?ফাজলামো করছে ছেলেটা তারসাথে।তবে কি ইভান বুঝে গিয়েছে তার দূর্বলতা?নাকি সে যেটা বলছে সেটাই ঠিক।

মনের হাজার ভাবনা,জলে ফেলার মতো ডুবিয়ে দিলো নিভান।ওই পিকটা তার চাই!সাথে ভিডিও গুলো।একটা অর্ধ দেখলো আরেকটাতো দেখতেই পেলোনা।সবগুলো তার চাই!চাই মানে লাগবেই।নাহলে এই ভিতরে বয়ে যাওয়া ঝড় শান্ত করবে কিকরে?তব এখন যদি ফর্মালিটি বাদ দিয়ে ইভানকে বলে,ভিডিওসহ পিকটা দিতে।ওই ফাজিল ছেলেটা তার পিছু লাগতেও ছাড়বে না।আবার যদি ইভান সত্যিসত্যি কৌড়িকে পছন্দ করে থাকে,তবে বিষয়টা কেমন দেখাবে?ভিষন বাজে!এখন কি করবে সে?জোরেজোরে কয়েকবার শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো।বাহিরে নিজেকে ধাতস্থ করতে পারলেও,ভিতরটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারলোনা।মন বসালো ল্যাপটপে।কিন্তু কাজ পাগল ছেলেটা তাতেও মন বশিভূত করতে পারলোনা।মন মেজাজ হঠাৎই উগ্র হয়ে গেলো তার।ইভানের রাগ দেখালো ল্যাপটপের উপর।ছুঁড়ে মারলো সেটা বেডের অন্যত্রে।বেডের নিচে গিয়ে পড়লে,জিনিসটা হয়তো গুড়িয়ে যেতো এতোক্ষণ।উঠে দাঁড়ালো সে।বেশ কিছুসময় হাসফাস করে,কিছু একটা ভেবে রুমের বাহিরের পানে পা বাড়ালো সে।থামলো,মান্যতার রুমের সামনে গিয়ে। দ্বিধান্বিত হয়েও,দরজায় নক করলো দু’বার। তৃতীয়বার নক করার আগেই দরজা খুলে গেলো।এইসময়ে দাদাভাইকে নিজের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো।প্রশ্ন করলো।

‘কিছু বলবে দাদাভাই?

‘ফোনটা কোথায় তোমার?ফাইভ মিনিট,ফোনটা আমার কাছে দাও তো।প্রয়োজন আছে,আমি আবার একটু পরেই দিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।

ফোনটা মোটেই দিতে চায়না মান্যতা।কারন তো অনেক।তবে এমন একজন ব্যক্তি চেয়েছে,না তো তার মুখ দিয়ে কখনো বের হবেনা।ভিষণ কান্না পেলো মান্যতার।সবকিছু বাদ,ফ্রেন্ডদের সাথে চ্যাটিং গুলো যদি দেখে দাদাভাই।তাহলে তো ইন্না-লিল্লাহ।তবে এতো রাতে তার ফোনের কি প্রয়োজন পড়লো, এটা বুঁজে আসলোনা তার।মন খারাপ করেও,হাতের ফোনটা বাড়িয়ে দিলো দাদাভাইয়ের দিকে।ফোনটা হাতে নিয়ে নিভান বললো।

‘পাচ মিনিট পরে দিয়ে যাচ্ছি।

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেও,মন বললো ফোনটা এখন দিয়ে যেতে তবে মুখ দিয়ে তা কখনো বলা হবেনা।নিভান নিজের ঘরে চলে এলো।নিভান রুমে ঢুকতেই, পাশের রুমের পর্দার ফাঁক থেকে বেরিয়ে এলো ইভান।
মুখ তার দুষ্ট মিষ্টি হাসি।মান্যতার রুমের সামনে এগিয়ে গেলো সে।মান্যতাকে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো।

‘কি ব্যাপার।এমন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে,তোর সাত রাজার ধনদৌলত দাদাভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিস মনে হচ্ছে!

মান্যতা মন খারাপ করে বললো–‘সেরকমই তো।

‘নিশ্চিত থাক।আজ দাদাভাইয়ের তোর সাত রাজার ধনদৌলত চেইক করার সময় নেই।তার কাজ সামাধান হয়ে গেলে,তুই ফোন পেয়ে যাবি।

কপাল কুঁচকে ইভানের মুখের দিকে তাকলো মান্যতা। সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিচে ড্রয়িংরুমের দিকে এগোলো ইভান।একটু পরে দাদাভাই বের হবে,মান্যতার ফোন দিতে।তাকে আরও একটু না জ্বালালে হয়!ড্রয়িংরুম থেকে নজর রাখলো,ইভান।কখন দাদাভাই বের হয়।নিজের কাজটা যতসম্ভব কমপ্লিট করে নিয়ে মান্যতাকে গিয়ে ফের ফোনটা দিয়ে আসলো নিভান।নিভানকে নিজের রুম থেকে বের হতে দেখেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকলো ইভান।রাত বিরাতেও গলা ছেড়ে গান ধরলো।

‘জ্বলে পুড়ে মরার মতো যদি কোনো সুখ থাকে তার নাম ভালোবাসা।তার নাম প্রেম।

একই লাইন বারবার গাইতে গাইতে নিজের রুমে চলে গেলো ইভান।নিজের কাজের জন্য ভিতরে ভিতরে এমনিতেই কেমন দ্বিধবোধ, অপ্রস্তুত কাজ করছিলো নিভানের।তার উপর ইভানের এই গানের কলি তাকে আরও অপ্রস্তুত করে দিলো।মান্যতার হাতে কোনো রকম ফোনটা দিয়ে চলে গেলো সে।দু-ভাইয়ের এই অদ্ভুত কথাকাজে কেমন কেমন লাগলো মান্যতার।তবে প্রশ্ন করবে কাকে সে?

মান্যতার রুমে ছিলো কৌড়ি।সেখান থেকেই নামছিলো।
সিঁড়ির মাথায় এসে হঠাৎ ড্রায়িংরুমের দিকে নজর যেতেই থমকে গেলো সে। সিঁড়ির প্রথম ধাপে ফেলা পা জোড়া তড়িৎ গতিতে উঠিয়ে, পিছে সরতে গিয়ে বলিষ্ঠ শক্তপোক্ত একটা বুকের সাথে ধাক্কা খেলো।সামনে হুমড়ে পড়ার আগেই পিছনের মানুষটার হাতজোড়া আঁকড়ে ধরলো তার কোমর।সেদিকে জেনো তার খেয়াল নেই,ড্রয়িংরুমে বসা মানুষ দুটোকে সে স্থির নজরে দেখতে থাকলো।এরা দুজন এখানে কি করছে?

নিজের সাথে আঁকড়ে নেওয়ার পর-ও যখন কৌড়ির কোনো প্রতিক্রিয়া অনুভব করলোনা।তখন কৌড়ির নজর লক্ষ্য করলো নিভান।ড্রয়িংরুমে বসা মানুষ দুটোকে কেমন চেনা চেনা লাগছে তার,কোথাও জেনো দেখেছে!হ্যা মনে পড়েছে।কৌড়ির চাচা আর চাচাতো সেই ভাই।যে কৌড়িকে সেদিন এখানে আসতে না দেওয়ার জন্য খুবই উগ্র আচারন করেছিলো।সেদিন ছেলেটার আচারনে নিভান বেশ বুঝেছিলো,কৌড়ির প্রতি ছেলেটার দূর্বলতা আছে।না-হলে আর-ও অনেক কাজিন ভাইবোন থাকতেও,ওই ছেলেটা কেনো এতোটা ডেস্পারেট আচারন করেছিলো।আজ আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছে।কিসের জেনো একটা রাগ,যেটা কৌড়ির প্রতি ভিতরে ভিতরে একটু একটু করে জন্মেছে।সেটা জেনো ড্রয়িংরুমে বসা ছেলেটাকে দেখে আর-ও চড়াও হলো নিভানের।গম্ভীর গলায় বললো।

‘নিজের মায়ার যাদুতে আর কাকে কাকে বশিভূত করে রেখেছো?আর কে কে বলি হয়েছে সেই যাদুতে?

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(১৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সেই আতঙ্কিত জলদগম্ভীর গলার আওয়াজ কর্ণগোচর হতেই, সম্বিৎ ফিরলো কৌড়ির।নিজের কোমল শরীরের অবস্থানটা ঠিক কোথায় ঠেকে রয়েছে, বুঝে উঠতেই ভূমিকম্প বয়ে গেলো সর্বাঙ্গে।মূহুর্তেই বিদ্যুৎ গতিতে ছিটকে সরে গেল সে।বিস্মিত নজর,নিভানের দৃঢ় মুখের পানে ফেললো।মানুষটা তাকে আঁকড়ে ধরে ছিলো আর সে বুঝে উঠতেই পারিনি,এমন বেখেয়ালিতে ছিলো সে!আশ্চর্য! এটাও হওয়ার ছিলো!আর ওসব কি বললো মানুষটা?সে তার মায়ায় যাদু করেছে!তাও আবার কাকে কাকে।মানেটা কি?নিভানের স্থির,শান্ত নজরে নজর পড়তেই ইভানের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো তার।মূহুর্তেই অস্বস্তিতে নজর এলোমেলো হয়ে পড়লো।নজর নামিয়ে নিলো।কার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল হতেই,বুকের ভিতরের যন্ত্রণাটার ধুকপুকানি দ্বিগুণ হারে লাফাতে থাকলো তার।নিঃশ্বাস ঘনো হলো।পা ছটফটিয়ে উঠলো,জায়গা ত্যাগ করার জন্য।হঠাৎ মন পড়লো,ড্রয়িংরুমে বসা খুব চেনা মুখদুটো।চোখের ভ্রম নয়তো,নাকি দিনে দুপুরে চোখ মেলেও স্বপ্ন দেখছে সে?না-হলে তারা আসবে কোথা থেকে?ভাবতেই সামনের মানুষটাকে ভুলে ড্রয়িংরুমের দিকে ফের তাকালো।নাহ,তার চোখের ভ্রম নয়।আর না দিবালকে দাড়িয়ে সে সপ্ন দেখছে।সত্যিই তারা এসেছে। কেনো এসেছে?তাঁকে নিয়ে যেতে।

ড্রয়িংরুমে বসা সুঠামদেহের ছেলেটার এলোমেলো নজর উপরে দিকে পড়তেই,মূহর্তেই কয়েক কদম পিছে সরে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলো কৌড়ি।আগে পিছে না তাকিয়ে এলোমেলো কদমে দ্রুত এগোলো মান্যতার রুমের পানে।ওই ড্রয়িংরুমে বসা লোকটা সম্পর্কে তার আপন চাচাতো ভাই।বাপের এক ছেলে হওয়ার সুবাধে ছোটোবেলা থেকে অতিরিক্ত রাগী,জেদী আর একগুঁয়ে স্বভাবের।যেটা বলবে সেটাই হতে হবে।নাহলে কে মা কে বোন কে আপনজন সব ভুলে,ব্যবহার হয়ে যায় হিংস্র পশুর ন্যায়।স্বভাবে লোকটার চরিত্র খারাপ না-থাকলেও,ব্যবহারে সে অমানুষ।বাজে ছেলেদের সঙ্গ পেয়ে সেই ব্যবহারের সাথে সাথে চরিত্রটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে।বাপের এক ছেলে হওয়ায়,যখন যেটা চেয়েছে।সেটাই পেয়ে পেয়ে বিগড়ে গেছে এমন।তেমন বাপও, কখনো শাসনবারন করেন নি।বংশের প্রদীপ,তাতে আবার পুত্র সন্তান।আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে এখন পরিনতি,ভরাডুবি নৌকা।আগে রাগ জেদ ব্যবহার খারাপ থাকলে-ও।চারিত্রিক বিষয়টা খারাপ ছিল না।এখন তো মদ গাঁজা আসক্ত হয়ে চারিত্রটাও নষ্ট করে ফেলেছে।আর সেই বাজে চরিত্রের প্রতিফলন ঘটিয়েছে তারসাথে।

কবে থেকে ওই উগ্র মস্তিষ্কের নাহিদ ভাই নামক ছেলেটা তাকে পছন্দ করে,এটা কৌড়ির জানা নেই।জন্মসূত্রে চাচাতো ভাই বোন হিসাবে জানা-বোঝা তাদের।সেই ভাইবোনের সম্পর্কের উর্ধ্বে গিয়ে কখনো কিছু ভাবতে হবে এটা কখনো আশা করেনি বাা ভাবিনি কৌড়ি।তবে জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে সেই ভাবনা তাদের ভাই বোনের সম্পর্কে দেয়াল উঠিয়ে, সেখানে জন্ম দিয়েছে একরাশ ঘৃনিত অনুভূতি।পাশাপাশি বাড়ি তাদের।কৌড়ি বুদ্ধি হওয়ার পর দেখেছে।সব চাচাদের সীমানা ভাগ করে নিয়ে আলাদা আলাদা বাড়ি করা।সব বাড়িতে কমবেশি যাতায়াত থাকলেও,মেজো চাচাদের বাড়িতে যাওয়ার বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো কৌড়ির।নিষেধাজ্ঞা বাবা এবং দাদির দু’জনের পক্ষ থেকে ছিলো।মেজোমা ও পছন্দ করতোনা,ওবাড়িতে যাওয়া।বিধায় কৌড়ি-ও যেতো না।তবে যখন আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলো,নাহিদের উগ্র আচারন সম্পর্কে জানতে বুঝতে থাকলো তখন কৌড়ি বুঝলো কেনো ওবাড়িতে তাকে যেতে দেওয়া হতো না। হয়না।

কারনে অকারণে মা বোনদের সাথে তুই তুকারি করে বাজে আচারন করা।এমনকি গায়ে হাত তোলা।মুখে অশালীন বাজে ভাষা ব্যবহার করা।বড়ছোটো কাওকে মান্য করে কথা না বলা।বখাটে ছেলেপুলেদের সঙ্গে মেলামেশা।পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাত নেই বিরাত নেই,সারাক্ষণ এই মোড়ে সেই মোড়ে আড্ডাবাজি করা।তা নিয়ে কেউ কথা বললে,তারসাথে উগ্র আচারন করা।ছোটো বেলা থেকে এগুলো করে এসেছে ছেলেটা।কখনো মুরুব্বি মানিনি।বাড়িতে অবাধ নালিশ এসেছে।রাস্তা ঘাটে বাবা,চাচাদের দেখলে চেনা পরিচিত বিভিন্ন ময়মুরুব্বিরা বলতো, ভালো বংশের ছেলে হয়ে এতো উগ্র মস্তিষ্কের কেনো ছেলেটা?কাওকে মান্য করে কথা বলেনা।আর যে ছেলে মুরব্বি মানেনা, সে ছেলে মানুষ হওয়ায় নয়।আর কতো কথা।আর সেই ছেলেকে কেই বা পছন্দ করবে?কৌড়ির বাবাতো নাহিদ বলতে ভিষণ অপছন্দ ছিলো!বিধায় ওবাড়িতে যাওয়াও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো।মেয়ে দেখতে শুনতে মন্দ নয়,কখন আবার নিজের মেয়ের প্রতি নজর চলে যায়।আর সর্বনাশী কি কান্ড ঘটে বসে!এই আশঙ্কায় ওবাড়িতে যাওয়াটা আরও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো।যেটা দাদীআপাও সরাসরি দিনে দু’বেলা মুখে আওড়াতেন।
আর তাই-ই ঘটেছিলো।কৌড়ি যখন ক্লাস এইটে পড়ে,তখন কৌড়ির বাবার কাছে হঠাৎই একদিন বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে নাহিদ।প্রস্তাব তো নয়,সে চড়াও গলায় জানিয়ে দিয়েছিলো।কৌড়িকে সে বিয়ে করতে চায়,তাকে জেনো অন্যত্রে বিয়ে দেওয়া না-হয়?কারন সে জানতো,তার সাধারন কথায় কখনো কৌড়ির বাবা মানবেন না।এমনিতেই মানতোনা এটাও জানতো।বিধায় হুমকিধামকি দিয়েছিল।আর এই হুমকিধামকির প্রস্তাবে কৌড়ির বাবা ভিষণ রেগে গিয়ে বাজে ব্যবহার করেছিলো নাহিদের সাথে।এমনকি গায়ে হাতও তুলেছিলো পর্যন্ত।ভাইকে ডেকেও,ছেলের হয়ে নানাবিধ কথা শুনিয়েছিলেেন।ছেলেকে উনার মেয়ের থেকে সাবধান থাকতে বলেছিলেন।নিজের বংশের ছেলে হলে কি হবে,যে ছেলের আচার ব্যবহার,ওঠবস ভালো নয়।সেই ছেলে,উনার মেয়েকে বিয়ে করার স্পর্ধা দেখিয়েছে।আবার উনাকেই হুমকিধামকি দিচ্ছে।এটা কখনোই মানবেনা তিনি।দরকার হলে মেয়েকে ফকির ভিখারির হাতে তুলে দেবেন,তা নাহলে মেয়ের পাত্র হিসাবে যদি কাওকে না পান নদীতে ভাসিয়ে দেবেন।তবুও ভাইয়ের ওই উগ্র মস্তিস্কের ছেলের হাতে কখনোই তুলে দেবেন না।একটা সময় গিয়ে এবিষয় নিয়ে দুই-পরিবারের মধ্যে ভিষণ মনোমিলন্য হয়।দুই পরিবার বলতে কৌড়ি বাবা ও চাচার মধ্যে।তারপর থেকে শুরু হয়,কৌড়ির জীবনে স্বাধীনভাবে চলাচলের প্রতিবন্ধকতা।

সেই ঝামেলা শেষ হওয়ার পর,কিছুদিন চুপচাপ ছিলো নাহিদ।তবে কৌড়ির ক্লাস নাইনে উঠার পর আবারও শুরু হয়ে যায়।তাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে।কনভিন্স তো নয়,সেই উগ্র মেজাজের হুমকি-ধামকি! কোনো মেয়ে কি আর সেই হুমকি-ধামকিতে কনভিন্স হয়?হওয়ার কথা নয়।কৌড়ির-ও সেসব হুমকি ধামকির আচারনে নাহিদের প্রতি কনভিন্স হওয়া তো দূর, আরও তীব্র ঘৃণা জন্মাতে থাকে।বাড়িতেতো বাবা আর দাদিআপার কারনে ঢুকতে পারতোনা ওই অমানুষটা।তাই স্কুল-কলেজে যাতায়াতের রাস্তায় উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলে হুমকিধামকি দিতো।বখাটে ছেলেদের মতো আচারন করতো।উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করার হুমকি ধামকি-ও দিয়েছে।সেসব দাদিআপাকে বাড়ি এসে বলতো কৌড়ি।তা নিয়ে আবার অশান্তি, ঝামেলা শুরু হয়।আর সেই ঝামেলার নতুন উৎপত্তি শুরু হয়, কৌড়ির বাবার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি ধামকিতে।কৌড়ির বাবা সেবার প্রচন্ড রেগে গিয়ে ভাইকে ডেকে বলে বসলেন,ছেলেকে সোজা করতে না-হলে এরপর যদি নাহিদ আর একবার-ও কৌড়িকে নিয়ে উগ্রতা দেখায় তবে তিনি আইনে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন।

কৌড়ির বাবা একজন হাইস্কুলের টিচার ছিলেন।ভালো
টিচার হিসাবে সবাই উনাকে বেশ সম্মান করতেন,মান্য করেও কথা বলতেন।বংশ পরিচয়েও সমাজে উনার একটা উঁচুস্তরের সম্মান ছিলো।গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বারদের সাথেও স্বাভাবিক ওঠবস ছিলো।বিধায় কৌড়ির বাবা আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাওয়ায়,উগ্র মেজাজের ছেলে হুমকিতে না দুললে-ও ছেলের বাবা হয়তো সেই হুমকিতে কিছুটা দুলেছিলেন।কিভাবে কি-করে জেনো ছেলেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠান্ডা রাখতে পেরেছিলেন।তবে নাহিদের বাজে নজর যে তখনও কৌড়ির পানে ছিলো,এটা কৌড়িও বেশ জানতো।সবসময় দাদিআপার আদেশ নিষেধ অনুযায়ী সাবধানে চলাফেরা করতো।তবুও কি কাজ হয়েছিলো?হয়নি!সেদিন যদি দাদিআপা সময় মতো না আসতো তবে আজ কি আর এখানে থাকা হতো।ওই অমানুষের বাজে স্পর্শের জন্য হয়তো ধর্ষিতা তকমা গায়ে লাগিয়ে ওই অমানুষটাকেই বাধ্য হয় বিয়ে করা লাগতো।যেমনটা ওই অমানুষটা প্লান করেছিলো,আর খালি বাড়িতে তাকে একা পেয়ে তার ঘরে ঢুকে মাতলামি করে কথাগুলো বলেছিলো তাকে।-তোর বাপের তোকে নিয়ে খুব দেমাগ তাইনা!হবেনা কেনো,বুড়ো বয়সের ফূর্তির সন্তান বলে কথা।দরদ তো উথলে উথলে থাকবেই।তবে আমি কি বলেছিলাম,তার ওই ফূর্তির সন্তানকে আমি আদর দেবো না!শয়তান বদমাশ হতে পারি,তাই বলে বউকে আদর করবোনা!এাটা হয়?আর এটা তোর বাপে বুঝলোনা কেনো,তাইআজ বুঝিয়ে দিতে আসছি আমি। তোকে আজ ভরপুর আদর সোহাগ দিয়ে তোর আর তোর ওই দেমাগধারী বাবাকে বুঝিয়ে দেবো যে,তোকে বিয়ে করার পর ঠিক কতোটা আদর ভালোবাসায় রাখতাম আমি।আর এমনিতেই আজ যদি তোকে একটু আদর সোহাগ দেই,কাল নির্দ্বিধায় তোর দেমাগিওয়ালা বাপ নিজ থেকে আমার হাতে তোকে তুলে দিতে বাধ্য হবেন।

সময়টা ছিলো ডুবডুব সন্ধ্যা।দাদিআপা পাশের বাড়িতে কোথায় একটা গিয়েছিলেন।আর বাবা আসরের নামাজ পড়তে গিয়ে বাড়িতে তখনও ফেরেননি। ফেরার কথাও ছিলোনা,কেননা তিনি আসরের নামাজ পড়ে বাহিরে উনার সমবয়সী মানুষদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা বলে একেবারে মাগরিবের নামাজ পড়ে ফেরেন।পাশাপাশি চাচাচাচিদের বাড়ি থাকতেও,সেদিন নাহিদের ড্রাগ নিয়ে চোখমুখ লাল-লাল করা মাতাল অবস্থা দেখে,আর ওসব নোংরামো আবোলতাবোল কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো কৌড়ি।চিৎকার চেচামেচি করবে,গলা দিয়ে জেনো আওয়াজ বের করতেও সেদিন ভুলে গিয়েছিলো।মন হয়েছিলো,সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নিত্যদিনের ন্যায় ওই অমানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু নাহ!নিজের গায়ের ওড়নায় যেই টান পড়েছিলো,গলা ছেড়ে চেচিয়ে উঠেছিলো সে।তারপর তার গলা ছেড়ে চিল্লাপাল্লা কান্নাকাটিতে,পাশের বাড়ি থেকে দাদিআপা সহ চাচীরা ছুটে এসেছিলেন।তখন ওই অমানুষটা তাঁকে হুমকিধামকি করে বাঘের থাবার ন্যায় গাল চেপে ধরে তার কান্না চেঁচামেচি বন্ধ করাতে ব্যস্ত!কি বিভৎস সন্ধ্যাটা ছিলো সেদিন!মনে উঠতেই গা শিহরে উঠে।

নিজের সাথে করা ওই অমানুষটার আচার ব্যবহারগুলো মনের দুয়ারে ভেসে উঠতেই তিক্ততায় ভরে উঠলো মন।রাগে ঘৃনায় রিরি করে উঠলো শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিচরিত রক্ত।ওই অমানুষটার জন্য বাড়ি ছাড়া হতে হলো,চলে এসেছে নিজের চেনা- পরিচিত সবকিছু ছেড়ে তারপরও পিছু ছাড়লোনা জানোয়ারটা।এলোমেলো পদচারণে মান্যতার রুমে ঢুকেই শব্দ করেই দরজা লাগিয়ে দিলো সে।সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে স্তব্ধ নজরে শুধু কৌড়িকে অবলোকন করে গেলো নিভান।মেয়েটাকে আজ অসম্ভব অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।লজ্জা, ভয়,জড়তামুলক আচারন প্রয়াসই কৌড়ির মধ্যে খেয়াল করেছ নিভান।তাই বলে এরকম অস্বাভাবিক আচরন তো করতে কখনো দেখিনি মেয়েটাকে।তবে আজ হঠাৎ কি হলো মেয়েটার?সামনে তাকালো নিভান।ড্রয়িংরুমে বসা ভদ্রসভ্য হয়ে বসা ছেলেটার পানে গিয়েই বিধলো নজর।তবে কি,কৌড়িকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়ার কারন,ড্রয়িংরুমে বসা ওই ভদ্রসভ্য ছেলেটা!

বিশাল বড় ড্রয়িংরুমটা নামীদামী জিনিস দিয়ে বেশ আভিজাত্যপূর্ণ সাজে পরিপাটি করে সাজানো গোছানো।যে কারও নজর বলে দেবে রুচিশীল হাতের কারুকায।অবশ্যই টাকা থাকলে কি-না করা যায়,যেখানে বাঘের চোখ মেলে।বড়ো ভাই আহসান হাবীবের কয়েকজন শহরে বন্ধু আছেন।তন্মধ্যে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছেনএটা আরশাদ হাসান জানতেন আর জাহিদ সাহেবকে দেখেছেনও।লোকটার অর্থ সম্পদ আছে,শহরে বাড়িগাড়িও আছে,এটাও জানতেন।তবে লোকটা এতো বিত্তশালী,এটা জানা ছিলো না উনার।ড্রয়িংরুমের সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন আরশাদ হাসান।ভিতরে ভিতরে অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে আছেন তিনি।কি দিয়ে কথা শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না।ছেলের জেদ মেনে একপ্রকার বাধ্য হয়ে এখানে আসতে হয়েছে উনার।যেটা মোটেও উচিত হয়নি,সেটা এখন বেশ বুঝতে পারছেন।কিন্তু কি করবেন?ছেলের একটাই জেদ।কৌড়িকে তার চাই!যে কোনো মূল্যেই চাই।হাতের নাগালে থাকলে নাহয় ছেলের বাসনা পূরণ করতে অসুবিধা হতোনা,রাজ্যসহ রাজকন্যা যেকোনো মূল্যে উশুল করা যেতো। কোনো ব্যাপার ছিলোনা।কিন্তু উনার মা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করে মেয়েটার বাপ মরতে না মরতেই উনাদের নাগাল থেকে বের করে দিয়েছেন।এখন এই ক্ষমতাধারী বৃত্তশীল পরিবার থেকে মেয়েটাকে বের করা সহজ হবেনা।বেশ বুঝতে পারছেন তিনি।তবুও মেয়ে যখন তাদের চেষ্টা করে দেখা যাক।আখেরি লাভ তো উনারই।রাজকন্যা পাবে ছেলে।আর রাজকন্যার বাপের রেখে যাওয়া রাজ্য হবে উনার।তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কোথায়!

‘আসলে আমরা এখানে এসেছি,আমাদের মেয়েটাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।নিজের সবকিছু থাকতে,পরের বাড়িতে এভাবে আর কতোদিন পড়ে থাকবে মেয়েটা?আত্মীয় স্বজন পাড়াপ্রতিবেশি সবাই জানতে ইচ্ছুক,বিয়ে নেই সাদী নেই হঠাৎ মেয়েটা কোথায় গায়েব হয়ে গেলো?না জেনে না বুঝে আমাদের প্রতি মেয়েটার প্রতি সবার একটা বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি!যার কোনো উত্তর দেওয়া যায়-না।আমরা চাচা চাচি থাকতে আম্মা কি বুঝে কৌড়িকে এখানে পাঠালেন,বুঝলাম না।

ড্রয়িংরুমের চার আসনের বসার সোফাটার মধ্যেবর্তী আসনে বসে আছেন জাহিদ সাহেব।খবর পেয়েছেন, সকাল সকাল উনার সাথে দেখা করতে কৌড়ির বাড়ি থেকে লোক এসেছেন।কারা আসতে পারেন বুঝতে সমস্যা হয়নি উনার।তবে সেদিন ফোনে কথাবার্তা বলার পরও যখন এবাড়িতে আসার স্পর্ধা দেখিয়েছেন, তখন তাে কথা বলাই দরকার।কথার প্রেক্ষিতে কথা বলতে যাবেন তিনি। তার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো ইভান।বাবার বাঁপাশের খালি জায়গাটায় বসতে বসতে বললো।

‘তা আপনার আম্ম কৌড়িকে এখানে কেনো পাঠিয়েছেন,বুঝতে যখন পারছেনই না।তখন কিন্তু আপনাকে আপনার আম্মার কাছ থেকে সুন্দর করে শুনে বুঝে তারপর এখানে আসা উচিত ছিলো।আর তার থেকেও ভালো হতো,যখন আপনার ভাই মারা গিয়ে কবরে শুতে পারলেন না,তার আগেই তড়িঘড়ি করে উনার মেয়েটাকে কেনো একটা অচেনা অজানা জায়গায় পাঠানো হচ্ছে?সেটা জানাটা।তখন আপনি এতো আদরের চাচা সাহেব কোথায় ছিলেন?

জাহিদ সাহেব সোজাসাপ্টা কথাবার্তা বলতে চেয়েছিলেন।কৌড়িকে নিতে এসেছে তার চাচা,আর তিনি জেনেশুনে মেয়েটটাকে নরকে ঠেলে দেবেন না।কিন্তু ইভান যেভাবে কথা শুরু করলো,উনার চিন্তা ভাবনার থেকে আরও একধাপ উপরে।নীরবে হাসলেন। ইভানকে শাসন বারন না করে আরশাদ হাসানের মুখের দিকে তাকালেন।নজর অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আরশাদ হাসানের।কে এই ছেলে না জানলেও,ছেলেটা যে মহা সেয়ানা সেটা বেশ বুঝতে পারলেন।কেমন উড়ে এসেই কথার মুখ মেরে দিলো।এখন তিনি উত্তর সরূপ কি বলবেন?ইভানের বা পাশের সিঙ্গেল সোফাটায় নাহিদ বসেছে।অল্পতে এমনিতেই মাথা গরম হয়ে যায় ছেলেটার।কারও ভালো কথা তার সহ্য হয়না।বরাবরই উগ্র মেজাজে আখ্যা পাওয়া ছেলেটা,ইভানের ইনিয়েবিনিয়ে বলা কথাগুলো শুনতেই মাথা গরম হয়ে গেলো।রাগে চোখমুখ কঠিন হয়ে এলো।হাতও মুষ্টিবদ্ধ হলো।দরদের লোকের দেখি অভাব নেই।এখানে এসেও রূপের জালে ফাঁসিয়ে দরদী লোকজন বানিয়ে নিয়েছে।এখানে আসার আগে বারবার বাবার দেওয়া সাবধানতা বানী মনে করে,নিজেকে আর নিজের তিরিক্ষি মেজাজ কে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলো।নাহিদকে লক্ষ্য করে ইভান একটু তারদিকে হেলে গিয়ে ফের বললো।

‘ফুলকৌড়ির বড়োভাই হিসাবে বোনকে নিতে এসেছেন?নাকি ব্যাপার অন্য কিছু ব্রো?আমার নজর তো বলছে,আপনি ঠিক সুবিধার মানুষ-নন।আর এই অসুবিধার মানুষজনদের কাছ থেকে ফুলকৌড়িকে ঠিকঠাক রাখার জন্য, তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে! আমার নজরের ধারণা ট্রু নাকি ফলস্?

ইভান শেষের কথাটার উত্তর চাইলো চোখের ইশারায়।
রাগে মাথা দপদপ করতে লাগলো নাহিদের।দাতে দাঁত চেপে যতোসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো।তবে ইভানের কথার উত্তর সরূপ ইভানের দিকে লাল লাল নজরে একবার তাকাতে ভুললো-না।সেটা দেখে কৃত্রিম অমায়িক হেসে ইভান ফিসফিসিয়ে বললো।

‘আরেহ কুল ব্রো।তবে ভুল জায়গায় চলে এসেছেন!যাকে পাওয়ার চিন্তা করে এখানে এসেছেন।ভুলে-ও আর তাকে পাওয়া তো দূর,চোখের দেখা দেখতে পাবেন বলে তো আমার অন্তত মনেহচ্ছে না।কোনোরূপ আশা দেখছিনা আমি।আপনি-ও আল্লাহর ওয়াস্তে আশা ছেড়ে দিন।তাতে আমার মনেহয় আপনারই ভালো হবে।

ঠান্ডার মাথার ঠান্ডা গলার হুমকি!তাতে অপর পক্ষের মানুষটা ভয় পেলো কি-না বোঝা গেলোনা।ঠাই যেভাবে বসে ছিলো সেভাবেই বসে আছে।উপর থেকে ইভানের আর নাহিদের আলাপন কপাল কুঁচকে দেখলো নিভান।
ইভান হাজির হতেই মন কৌতুহলী হয়ে উঠলো।সামনে নজর রেখেই একে একে প্রতিটি সিঁড়ির ধাপ পার করে ড্রয়িংরুমে এসে জাহিদ সাহেবের অন্যত্র পাশে বসলো।
তবে মনোযোগ বা আগ্রহ সামনের দু’জনের পানে মোটেও রাখলোনা।সামনের টেবিল থেকে পেপার হাতে নিয়ে সেটাতে মনোযোগ দিলো।মনেহলো,সে বিশেষ ভাবে এখানে পেপার পড়তে এসেছে এবং বসেছে।কিন্তু বিষয়টা মোটেই তা নয়,নজর পেপারে থাকলেও কান সজাগ পাশের মানুষগুলোকে ঘীরে।সেটা বুঝে হাসলো ইভান।তার কোলাহলমুক্ত শান্তি প্রিয় দাদাভাই,নিজের শান্ত পরিবেশের রুম রেখে,স্টাডি রুম রেখে এখানে মানুষের কথাবার্তার মধ্যে এসেছেন পেপার পড়তে!মহা আশ্চর্যের বিষয়!আর এই মহা আশ্চর্যের বিষয়টা ঠিক কি সেটা ইভানের ভালো রকম জনা আছে।আরশাদ হাসান এবং নাহিদ দুজনে দেখেই চিনতে পারলো,এই সেই ছেলেটা সেই ছেলে।সেদিন কৌড়িকে এখানে নিয়ে এসেছিলো।নাহিদের সুক্ষ নজর নিভানকে পর্যবেক্ষণ করলো।কারনটা সেদিনেরই,সে যখন কৌড়িকে এখানে আসতে দেবেনা বলে হুমকিধামকি মাতলামো শুরু করেছিলো,লম্বা চওড়া পেটানো শরীরের ছেলেটা তীক্ষ্ণ নজরে তারদিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলেছিলো–

‘কোথায় আর কার সামনে দাঁড়িয়ে হুমকিধামকি দিতে হয়,মাতলামো করতে হয়।এরপর জেনে-বুঝে করবেন।মৃতবাড়ি না হলে আপনি কে আর আমি কে আর কার সামনে দাঁড়িয়ে হুমকিধামকি দিয়ে কথা বলে চলেছেন, ঠিকঠাক জানিয়ে বুঝিয়ে দিতাম।বাবা যখন মেয়েটাকে নিয়ে যেতে বলেছেন,দ্বিতীয়বার জেনা আমার সামনে আর আপনার ফালতু চিল্লাপাল্লা না শুনি।তবে মৃতবাড়ি বলেও কিন্তু ধৈর্য্য সহ্যশক্তি সহবৎ বলে কিছু আছে,মনে রাখবো না।

নিভানের দিকে সূচালো তীক্ষ্ণ নজরে নাহিদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছু একটা বুঝে,তাকে উদ্দেশ্য করে ফের ফিসফিসিয়ে ইভান বললো।

‘আপনি ফুলকৌড়ির যেই হোন-না কেনো,আমি ইন্টারস্টেড নই।তবুও বলছি,তাকে নিয়ে ভালো-মন্দ যে ভাবনাটা মনের মধ্যে চলছে বা আছে অথবা ভাবছেন,সেই ভাবনাটা এখানেই বন্ধ করে দিন।ওই সদ্য এসে বসা পেপার হাতে নেওয়া মানুষটাকে দেখছেন না।সম্পর্কে উনি আমার দাদাভাই।ফুলকৌড়িকে নিয়ে ভালোমন্দ ভাবনার জন্য আপতত উনিই যথেষ্ঠ।আমার মনে হয়-না,এখন আর তাকে টপকিয়ে যে কেউ ফুলকৌড়ির ধরাছোঁয়ার কাছে ঘেঁষতে পারবে বা ফুলকৌড়িকে নিয়ে ভাবতে পারবে।আপনি যেই হোন না কেনো,মনেহয় আপনিও পারবেন না,ব্রো।সো ফুলকৌড়ি বলে আপনার লাইফে বোন অথবা বোনের বাহিরে কেউ ছিলো,এই ভাবনাটা মাইন্ড আউট করে ফেলুন।বুঝছেন কিছু?

আগুনে ঝলছে যাওয়ার মতো সমস্ত শরীর জ্বলে গেলো নাহিদের।ইভানের কথার অর্থ বুঝতে তার সময় লাগলো না।মাথার মধ্যের শিরা উপশিরা গুলো দপদপ করে উঠলো,কৌড়ির প্রতি রাগে।কাছে পেলে হয়তো মেয়েটাকে এতো সময় নিজের রূপ দেখিয়ে দিতো।আছড়ে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করতোনা।ভীতু,লাজুক, ঘরকুনো মেয়েটার বড়লোক ছেলে দেখেই মাথা ঘুরে গেলো।নিজের সৌন্দর্য দিয়ে পটিয়ে ফেললো তাকে।অথচ সে কতোকিছু করলো তাকে নিজের করার জন্য। কিন্তু তাকে শুধু ঘৃনার নজরেই দেখলো।আর সেই ঘৃনা নিয়ে তারসাথে সারাজীবন রেখে দেওয়ার জেদ চেপেছিলো একসময় নাহিদের।আর সেই জেদ বজায় রেখেই এখনো পিছে লেগে থাকা।মেয়ের দেমাগ ভেঙে দেওয়ার প্রয়াস।তবে এখানে বসে হুমকিধামকি দিলে নিজের পিঠ বাঁচনো যাবে না,এটা এবাড়ির ঐশ্বর্য আর ছেলেদের হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে।কৌড়িকে এখানে নিয়ে আসার দিনও বুঝেছিলো,ছেলেটার ওই শান্ত তীক্ষ্ণ চাহুনির কথাগুলো তার পষান্ড হৃদয় আর শরীরকেও কাঁপিয়ে তুলেছিলো।তবে এতো সহজে তো সে-ও ছাড়বেনা!

ছেলেটাকে শাসাতে পেরে মনেমনে বেশ মজা পেলো ইভান।সেদিন মা আর বাবাকে কৌড়ির বিষয়ে কথা বলতে শুনেছিলো।মেয়েটাকে এখানে কেনো পাঠানো হয়েছে।আর কৌড়ির বাড়ি থেকে লোক এসেছে শুনতেই এখানে এসে ছেলেটাকে দেখে বেশ বুঝেছে,এই খবিশ নেশাখোর ব্যাটার জন্য মেয়েটাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে।তবে খবিশ ব্যাটাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার।ব্যাটার জন্য কৌড়ি যদি বাড়ি ছেড়ে এখানে না আসতো।তবে সে দাদাভাইয়ের জন্য ওমন সুন্দর একটা শান্তশিষ্ট ফুলকৌড়ি নামক বউমনি পেতো কোথায়।দাদাভাই আর ফুলকৌড়ির বিয়ে হয়ে যাক।তারপর না-হয় একদিন যেচে গিয়ে মিষ্টি মিঠাই নিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে আসবে খবিশটাকে।এখন ধন্যবাদ জানালে ব্যাটার দেমাগ বেড়ে যেতে পারে।

‘আপনি মেয়েটাকে নিতে এসেছেন,তবে আমি দিতে চাইছি না তাকে।আপনার পাড়াপ্রতিবেশি আশেপাশের লোক, আত্মীয় স্বজনরা কে কি বলছে আমার জানার দরকার নেই।তবে এই আত্নীয় স্বজনের কথা নিয়ে যদি আপনি চিন্তিত থাকেন,মেয়েটার ভবিষ্যতের চিন্তা করে থাকেন। বিয়ে দেবেন কিকরে?তবুও বলছি কৌড়ির চিন্তা আপনাদের কারও করা লাগবেনা,ওর সবকিছুর দায়িত্ব আমার।এমনকি বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও।তবুও আমি আপনাদের সাথে ওকে পাঠাতে চাইনা।এটাই ফাইনাল।

এতোসময় পর জাহিদ সাহেবের স্ট্রেইট কথায় নিজের গ্রাম দাপিয়ে কথা বলা আরশাদ হাসান আরও মিইয়ে গেলেন। উনার দু’পাশে বসা সামর্থ্য দুই ছেলেকে দেখে আর কোনো কথা বলার স্কোপ খুঁজে পেলেননা।মেয়ে উনাদের অথচ কথা বলার জোর পেলেননা।বরং উনার ছেলের সম্পর্কে জেনেশুনেও ঠান্ডা মাথায় কথা বলছেন এটাতে জেনো কথার প্রতিত্তোর করতে আরও দ্বিধা করলেন উনি।তবে আরশাদ হাসানকে প্রতিত্তোর করতে না দেখে মনেমনে বাবার প্রতি বেশ ক্ষুব্ধ হলো নাহিদ।নিজেই এবার মুখ খুললো।গমগমে গলায় বললো।

‘কৌড়ি আমাদের সাথে যেতে চায় কি-না, সেটা একবার ওর থেকেই জানতে চাই আমি।আপনি না বললে তো হবে না,ওর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স হয়েছে।আমি ওর নিজের মুখ থেকে সিদ্ধান্ত জানতে চাই।

নাহিদের বিশ্বাস কৌড়ি তার চোখের দিকে তাকালে কখনো হ্যা না কথা বলতে পারবে-না।বাধ্য হবে তাদের সাথে যেতে।সেই মনস্কামনাতে কথাটা বললো।কপাল কুঁচকে ফেললো ইভান।ঘাড় কাত করে বাবার ওপাশে বসা ভাইয়ের দিকে তাকালো।একটু আগের সাবলীলভাবে ধরা পেপারটা এখন খামচে ধরার মতো করে ধরে আছে।নিশ্চয় মনেমনে নাহিদের কলিজাটা খামচে ধরেছে।হাসলো ইভান।ঠোঁটে প্রকাশ পেলো-না হাসিটা।তবে মনেমনে নাহিদকে উস্কিয়ে দিলো,আরও দুটো একটা বেফাস কথা বলার জন্য।জাহিদ সাহবকে চুপ থাকতে দেখে নাহিদ ফের বললো।

‘ওকে ডাকুন,আমি ওর থেকে জানতে চাই।ও যেতে চায় কি না,ওর মুখ থেকে শুনতে চাই….

জাহিদ সাহেব নিজের সামনে বসা ছেলেটার স্পর্ধা দেখে অবাক না হয়ে পারলেন না।যারজন্য মেয়েটাকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হলো,তারমধ্যে ভয় লাজলজ্জা, অনুতাপ কোনো কিছুই নেই।বরং লেজ উঠিয়ে মেয়েটাকে নিতে এসেছে।আবার উনার সামনে বসে গলা চড়িয়ে কথা বলার স্পর্ধাও দেখাচ্ছে।সবকিছু জেনেশুনেও ভদ্রভাবে কথা বলছেন বলে সাপের পাঁচ পা দেখেছে।তাই যদি হয় তবে সামনে বসা দুজনের ধারণা খুবই ভুল।তিনি ভালোরও ভালো। খারাপের আবার খুব খারাপ!কিছু বলতে যাবেন তারআগে চোখের ইশারায় নিভান থামিয়ে দিলো উনাকে।হাতে রাখা পেপারটা খুব সাধারণ ভঙ্গিতে টেবিলে উপর রাখলো ।সবার নজরে সাধারণ মনে হলে-ও ইভানের নজরে কিছুতেই সেটা সাধারণ মনে হলো-না।দাদাভাই সহজে রাগে-না।আর রেগে গেলে ভয়ংকর হয়ে যায়।মনেমনে একটু আতঙ্কিত হলো ইভান।তন্মধ্যে
ইভানকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় নিভান বললো—ইভান,বাবকে উনার রুমে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।উনি অসুস্থ, এতোসময় বসে থাকতে পারেন না।সেটা বাহিরের লোকজন না জানলেও,আমাদের মনে রাখা উচিত।ভিতরে নিয়ে যাও বাবাকে।

ফের জাহিদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো–আপনি নিজের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিন।আমি উনাদের সাথে কথা বলে নিচ্ছি।বিষয়টা আমি দেখছি।

নিভান মানেই যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটা চোখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য জাহিদ সাহেব।তাই আর না করলেন না।
প্রশ্নই উঠলো না,না করার।এখানে বসে থাকতেও উনার কষ্ট হচ্ছে।ছেলের কথা শুনে হুট করে উঠে যাওয়াটা কেমন দেখায়,তাই নিজের অসুস্থতার বিষয়টা জানিয়ে, ইভানের সাহায্যে হুইলচেয়ারে বসে চলে গেলেন।যাওয়ার আগে বলে গেলেন মেহমানদের নাস্তাপানির ব্যবস্থা করতে।জাহিদ সাহেব চলে যেতেই রাজকীয় ভঙ্গিতে গা এলিয়ে পায়ের উপর পা তুলে সোফায় বসলো নিভান।ফের ঠান্ডা গলায় শুধালো।

‘তো কি বলছিলেন যেনো,এবার বলুন।

নিভানের এই দায়সারা ভাবসাব মোটেই পছন্দ হলোনা নাহিদের।আরশাদ হাসান তো সেই থেকে চুপ।পাঙ্গা এমন মানুষের সাথে নেওয়া দরকার, যার সাথে পেরে উঠা যায়।হয়তো সমানে সমানে নয়তো নিজের ক্ষমতা অর্থসম্পদের থেকে নিচুস্তরের লোকের সাথে।নিজের ক্ষমতা আর দৌলতের উর্ধ্বে গিয়ে উঁচু স্তরের লোকের সঙ্গে পাঙ্গা নিলে তা হয়তো কখনো জেতা যায়না।আশা করাও বোকামি।তিনি বুদ্ধিমান অতি চতুর ব্যক্তি সেই বোকামীটা করলেন না।সাথে সামনে বসা ছেলেটার বাজপদখির ন্যায় তীক্ষ্ণ নজর!গমগমে গম্ভীর দৃঢ় গলার স্বর!রাজকীয় বসার ভাবভঙ্গিমা।এমনিতেই রুদ্ধ করে দিয়েছে উনার শ্বাসনালী।নিভান প্রশ্ন করলেও উত্তরের আশা করেনি।তবুও কিছুসময় চুপ থেকে দেখতে চেয়েছিলো,তার সামনে বসা মানুষের দুজনের ঠিক সাহস কতটুকু। তারপর মুখ খুললো সে।গমগমে গলায় বললো।

‘ওর মুখ থেকে উত্তর চাই, তাই তো?মনে করুন আমি নই ওই-ই বলছে,ও আসবে না এখানে।আর যাবেও-না আপনাদের সাথে।যদি বলেন ওর হয়ে উত্তর দেওয়ার আমি কে?আমি কেউ না!তবুও ওর হয়ে আমি যে সিদ্ধান্তটা নেবো সেটাই ওর জীবনের লাস্ট এন্ড ফাইনাল ডিভিশন হবে।শেষ কথা যাকে বলে।প্রশ্ন যদি হয় কেনো এবং কিসের জন্য!তবে তার উত্তর আমি আপনাদেরকে দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন বোধ করছি না।আর কোনো প্রশ্ন বা উত্তর চাই?

আরশাদ হাসান তো কোনো কথাই বলতে পারলেন না।
তবে এটা বুঝতে পারলেন,কৌড়ি তাদের নাগালের বহুত দুরে চলে গেছে। সাথে এই ছেলের নজরেও পড়ে গেছে মেয়েটা।তার সেখান থেকে মেয়েটাকে বের করা সহজলভ্য হবে না।ছেলের পানে চাইলেন।কাঠ হয়ে চুপচাপ বসে আছে সে।হয়তো সেও বুঝে গেছে,মেয়েটার নাগাল পাওয়া আর সম্ভব নয়।তবে ছেলের অহামিকায় আঘাত লেগেছে।এর যের ঠিক কিভাবে পোহাতে,প্রভুই জানেন।হঠাৎ টেবিলের উপর কিছু রাখার শব্দে খেয়াল ভঙ্গ হলো উনার।দেখলেন এক ভদ্রমহিলা চা কফির ট্রে-টা টেবিলে রাখায় মৃদু শব্দ হয়েছে।

‘রানীসাহেবা,উনাদেরকে ডায়নিংয়ে নিয়ে যান।খাবারের ব্যবস্থা করুন।কৌড়ির আপনজন বলে কথা,সে যেমনই হোক আপ্যায়ন তো এমনিতেও হোক আর ওমনিতে-ও।করতেই হবে।

কি উদ্দেশ্য করে কথাটা বলা হয়েছে বিশেষ না বুঝলেও নড়েচড়ে বসলেন আরশাদ হাসান।ছেলেকে গাঁট হয়ে বসে থাকতে দেখে,উঠতে চেয়েও উঠতে পারলেন না।
তন্মধ্যে রানী বললো।

‘আসুন,এমনিতেই আপনাদের খাবারের ব্যবস্থা টেবিলে গোছানো হয়েছে। তবে এখানে কথা চলছিলো বলে,ভাবী সাহেবা চা নাস্তা পাঠালেন।

উঠলেন আরশাদ হাসান।এমনিতেই সামনে বসা ছেলেটার সামনে বসে থাকতে কেমন অদ্ভুত লাগছে উনার।উঠলেই বাঁচেন এমন একটা অবস্থা। সেই হেতুই উঠে দাঁড়ানো।ছেলেকে ডাকলেন।তবে সাড়া না পেয়ে রানীসাহেবাকে অনুসরণ করলেন।তিনি আলে যেতেই কফির মগটা হাতে নিলো নিভান।চুমুক দিলো খুবই আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে।ফের সামনে বসা একগুঁয়ে তেজস্বী ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে শীতল গলায় বললো

‘আমাকে দেখলে সবাই খুবই চুপচাপ আর শান্ত মাইন্ডের ছেলে বলে মনে করে।তেমনটাই নাকি আমার ব্যবহারে আর চেহারায় প্রকাশ পায়।আপনারও কি আমাকে তাই বলে মনেহয় যে,আমি খুবই ভদ্রসভ্য আর শান্ত স্বভাবের ছেলে?

কথার উত্তর দিলো-না নাহিদ।তবে অনুধাবন করতে পারল,তার সামনে আছে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ধূর্ত একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। যাকে নিজের সহজ হোক বা দূর্লভ কথায় বশ করানো বা ভয় দেখনো সহজ হবে না।তাই কথা বলার প্রয়োজন মনে করলোনা।আর এটাও অনুধাবন করতে পারলো,তার সামনে বসা মানুষটা তাকে উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেও উত্তর নেওয়ার অপেক্ষায় নেই।নিশ্চুপ থাকা প্রতিপক্ষ ছেলেটা নিজের থেকে কম বুদ্ধিমান, এটা ভুলেও ভাবলো না নিভান।মনেমনে হাসলো।ফের বলতে শুরু করলো।

‘তবে আমি ছেলেটা মোটেও তেমনটা নই।শান্তশিষ্টতা আমার বাহিরের রূপ,যা দেখে সবাই সেভাবেই বিবেচিত করে আমাকে।আমার ভিতরের রূপটা বাহিরের রূপের প্রকাশভঙ্গির পুরো বিপরীত।অতিরিক্ত বাজে,খুবই ভয়ঙ্কর,নিন্মমানেরও বলা চলে।তবে সেটার বহিঃপ্রকাশের পরিচিতি আমি আবার সবার সাথে পরিচয় করাই-না।পরিচয় করাই শুধু তাদের সাথে,যারা আমার অতি অপছন্দের মানুষ।সেটাও মাত্রারূপ ছাড়িয়ে গেলে।বিশেষ করে আমার প্রিয় মানুষগুলোকে কেউ আঘাত করার চেষ্টা করলে।বলতে পারেন,তাদের কোনোরূপ ক্ষতি আমার ওই অতিরিক্ত বাজে নিন্মমানের ভয়ঙ্কর হিংস্র আত্মাটাকে জাগিয়ে দেয়।সেখানে কাকে আপনার প্রশ্নের কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করাতে চাইছেন,আপনার ধারনাও নেই।সুতারাং কোথায় বসে আছেন আর কার সামনে বসে আছেন, ভেবেচিন্তে একটু বুঝেশুনে কথা বলার চেষ্টা করবেন।

নাহিদের অপমানে রক্তিম হয়ে উঠা ক্রোধিত মুখাবয়বের দিকে আরও একপলক তাকিয়ে,কফির মগটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো নিভান।সামনে এগোতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎই ।ফের গম্ভীর কন্ঠে বললো।

‘আর দ্বিতীয়বার এবাড়িতে ও-কে নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবে পা রাখবেনও একটু সাবধানে!গভীর ভেবেচিন্তে!
মনে রাখবেন আমি মানুষটা যেমনটা সবাই দেখে ভাবে ঠিক তেমনটা নই।

মান্যতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে কৌড়ি।আর ওই নাহিদ নামক অমানুষটার আচারনগুলো বিবরণ করে চলেছে।মান্যতারও মন খারাপ হলো খুব,ছোট্টো মেয়েটা, তার এতটুকু বয়সে কি-না কি দেখে চলেছে।এতটুকু বয়সে মা চলে গেলো তারপর বাবা নামক ছায়াটা।তারপরও কতোকিছু সয়ে গেছে এইটুকু জীবনে। কান্না থামানোর জন্য এটাওটা বলে স্বান্তনা দিতে থাকলো কৌড়িকে।
ফের বললো –মন খারাপ করোনা,দেখবে বাবা কিছুতেই উনাদের সাথে তোমাকে যেতে দেবেন না।

‘আমার যেতে মানা নেই আপু।বরং আমার বাড়িতে যেতে খুব ইচ্ছে করে।ওখানে থাকতে খুব মন চায়।তবে ওই অমানুষটার জন্য উপায়হীন আমি।

ফুপিয়ে কেঁদে কথাগুলো বললো কৌড়ি।দীর্ঘশ্বাস ফেললো মান্যতা।কি বলে আর স্বান্তনা দেবে মেয়েটাকে বুঝে আসলোনা।হঠাৎ প্রানউচ্ছল কন্ঠটা কানে আসতেই সেদিকে ফিরলো মান্যতা।কান্না থেমে গেলো কৌড়িরও।

‘আরেহ.. শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যেতে চাওনা।সেটা বললেই হয়।এরকম ভ্যা ভ্যা করে কান্নার কি দরকার!আর যে কেউ তোমাকে নিতে চলে আসলে তোমার বর,সহজেই হোক বা যুদ্ধ বিদ্রোহ করে,তাকে তোমাকে দিয়ে দেবে ভাবছো কিকরে,?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে