#ফিরবে চেনা ঠিকানায়
#লেখনীতে-অনামিকা_ইসলাম_জেরিন
#পর্ব_৭
আজ সিয়ামের গাঁয়ে হলুদ।বাড়ি ভরা লোকজন।হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়েছে কাল থেকেই।সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে আসছে কিন্তু আকাশ একবারও মেঘলার দেখার পাইনি।কাল সারাদিনে একবার দেখা পেয়েছিল মেঘলার।শেষ কথা হয়েছে ওই দিন রাতে এরপর কথা বলার কোনো সুযোগ মেঘলা দেয় নি।নিদারুণ ভাবে এড়িয়ে গেছে আকাশকে।বারবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখছে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটার কোনো হদিস নেই।আকাশের ছটফটনি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।একমাত্র বোন হিসাবে কি এই মেয়ের কোনো কাজ নেই রুমের বাইরে?রুমের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকার কোনো মানে আছে?
জোনিতা আর মেঘলা রুমের ভিতর সকাল থেকে প্রায় ঝড় শুরু করেছে,মেঘলার সমস্যা না হলেও জোনিতার সমস্যা হচ্ছে শাড়ি পড়ে।হাঁটা দিলে বা একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালে জোনিতার মনে হচ্ছে শাড়ী সরে যাচ্ছে।মাঝেমধ্যে শাড়ি ধরে ‘ওহ নো’ বলে চিৎকার দিয়ে বসে পড়তেছে।কাল রাত থেকে এজন্য জোনিতা শাড়ি পড়ে হাঁটছে রুমে।জোনিতার সমস্যার কোনো সমাধান না করে মেঘলা বিছানায় বসে হাসছে।হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে।জোনিতা কখনো মেঘলার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে আবার কখনো কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকাচ্ছে।জোনিতার কোনো অনুনয়-বিনয় কানে তুলছে না মেঘলা।সবকিছু উপেক্ষা করে সে জানিয়ে দিয়েছে ‘শাড়ি না পড়লে হবে না।কথা না শুনলে খারাপ কিছু ঘটাতে মেঘলা এক মিনিট সময় নেবে না।চেষ্টা করলে সব সম্ভব,সেখানে শাড়ি একটা সামান্য জিনিস।’
জোনিতা চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
—“মেঘু আমি শাড়ী পড়ব না।”
মেঘলা চোখ বাঁকা করে বলল,
—“শাড়ী পড়তে হবে মানে শাড়ী পড়তে হবে,আর কোনো অপশন নেই।”
জোনিতা কিছু বলবে তার আগেই দরজার ওপাশ থেকে মেঘলার মা জোড়ে জোড়ে দু’জনকে ডাকছে।মেঘলা দৌড়ে দরজা খুলে দেয়।
মেঘলার মা চেঁচিয়ে বললেন,
—“তোরা কি নিজ পায়ে হেঁটে নিচে যাবি নাকি টেনে নামাব?”
মেঘলা কপাল ভাঁজ করে বলল,
—“আস্তে!চিল্লাচ্ছো কেন?”
মেঘলার মা মেঘলার কান টেনে ধরে রাগি গলায় বললেন,
—“একটু বেশি কথা বলা শিখে গেছিস তুই।আমাকে বলছিস কিভাবে কথা বলব।”
—“আম্মু কান ছাড়ো ব্যাথা পাচ্ছি।”
—“আদর করার জন্য ধরি নি।”
জোনিতা মেঘলার অবস্থা দেখে হাসছে।এতক্ষণ তাকে দেখে হাসছিল এবার তার পালা।মেঘলার মা জোনিতার দিকে তাকিয়ে দেখেন জোনিতার শাড়ি কিছুটা এলোমেলো।মেঘলার কান ছেড়ে দিয়ে কিছু সময় জোনিতার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
—“তোমার শাড়ি পড়ে চলাফেরা করতে সমস্যা হচ্ছে মা?”
জোনিতা কিছুটা অবাক হয়ে যায় মেঘলার মা’য়ের কথা শুনে।জোনিতা তো কিছু বলে নি ওনাকে তাহলে কিভাবে বুঝলো ওর সমস্যাটা।মেঘলার মা একই প্রশ্ন আবার করলেন,
—“তোমার কি সমস্যা হচ্ছে?”
জোনিতা নম্র গলায় বলল,
—“জ্বি আন্টি,একটু সমস্যা হচ্ছে।”
মেঘলার মা জোনিতার কাছে গিয়ে বললনে,
—“আচ্ছা আমি ঠিক করে দিচ্ছি।তাহলে শাড়ি পড়ে ভালো ভাবে হাঁটতে পাবরে তুমি।”
মেঘলা কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,
—“বাহ্!কি সুন্দর আমার সাথে মেরে কথা বলে আর ওর সাথে কি আদরের সাথে মা-মা করে কথা বলছে।”
জোনিতা হেসে বলল,
—“মেঘু তুমি এত হিংসুটে তা আমার জানা ছিল না।”
মেঘলা চোখ বড় বড় করে বলল,
—“তুমি আমাকে হিংসুক বলছো জোনিতা?তোমাকে যা খুশি তাই বলুক আমার সমস্যা নেই।সামান্য একটা কথা জন্য আমার কান টানতে হবে কেন?”
জোনিতার শাড়ি ঠিক করে দিয়ে মেঘলার মা চলে যায় আর তাড়াতাড়ি নিচে আসতে বলে।জোনিতার কাছে এবার সব কিছু ঠিকঠাক আছে বলে বোধ হচ্ছে।এবার শুধু তাকে সাবধানে হাঁটতে হবে।মেঘলা আর জোনিতা একসাথে নিচে নেমে সোজা বাগানে চলে যায়।বাগানে স্টেজ সাজানো হয়েছে।মেঘলা আর জোনিতাকে দেখে দুইজোড়া চোখ ধমকে গেছে।মেঘলা আর জোনিতা একই রংয়ের শাড়ি পড়ে একই ভাবে সেজেছে।মেঘলার ফর্সা গায়ে কাচা হলুদ শাড়ি এবযাওয়ার সাথেই আকাশের সামনে পড়ে যায়।আকাশ মেঘলাকে দেখে ধমকে যায়।ফর্সা গায়ে কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ী।এক হাতে কাচের চুরি অন্য হাতে গাঁদা ফুলের মালা প্যাঁচানো।চোখে গারো করে কাজল রেখা টানা।কালে দুল আর চুল খোঁপা করে ফুল দিয়েছে।মেঘলা তার কিছু কাজিনদের সঙ্গে কথা বলে জোনিতাকে সেখানে রেখে অন্যদিকে গেলো।
ফলের ডালা নিয়ে মেঘলা স্টেজে উঠতে তখন সামনে এসে দাঁড়ায় আকাশ।মেঘলাকে যাওয়ার পথ দিচ্ছে না।হাতের থেকে ফলের ডালা পড়লে স’র্ব’না’শ হবে।আবার কষ্ট করে সময় নিয়ে সব সাজাতে হবে।মেঘলা বিরক্ত হয়ে ‘চ’ শব্দ করলো।কপাল ভাঁজ করে তেজী গলায় বলল,
—“চোখের কি দেখেন না?সামনে থেকে সরে দাঁড়ান অন্যদের যাওয়ার জায়গা দেন।”
আকাশ হেসে চুপ করে সরে যায় মেঘলার সামনে থেকে।মেঘলা ভেবে ছিল আকাশ এখন না সরে তার সাথে ঝগড়া করবে।মেঘলা স্টেজ থেকে নেমে গেলে আকাশ বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে।
আকাশকে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সায়িদ এসে জিজ্ঞেস করল,
—“ভাইয়া ঠিক আছো তুমি?বুকে ব্যথা করছে নাকি?”
—“হ্যাঁ রে খুব ব্যথা করছে।”
সায়িদ বিস্মিত হয়ে বলল,
—“তাহলে ডাক্তারের কাছে চলো তাড়াতাড়ি।”
আকাশ ভ্রুঁ কুচকে বলল,
—“ডাক্তারের কাছে কেন যাব?”
—“বুকে ব্যথা সেজন্য।”
—“যার জন্য ব্যথা করছে সে-ই চিকিৎসা করবে।অন্য কাউকে দিয়ে হবে না।”
সায়িদ কিছু বুঝতে না পেরে মাথা চুলকিয়ে বলল,
—“ভাইয়া ঠিক করে বলো তো কেমন ব্যথা পেয়েছো যার কারণে ডাক্তার লাগবে না।”
—“মেঘুকে দেখে ব্যথা করছে।আজ মেঘুকে অন্যরকম লাগছে শাড়িতে।”
আকাশর কথা শুনে সায়িদ আহাম্মকের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে।তার বোনকে তারই চোখের সামনে টিজ করছে!আবার তার কাছে সুশ্রী ভাবে বর্ণনা করছে।এসব মানা যায়?চোখে মুখে কাঠিন্য ভাব এনে কিছু বলতে যাবে তখনই আকাশ তাকে থামিয়ে বলল,
—“আমি আমার হবু বউকে নিয়ে কথা বলছি এখানে কারোর কোনো কিছু বলার অধিকার নেই।বুঝলে ছোট শালাবাবু?”
কথাটা শেষ করে আকাশ সেখান থেকে চলে গেলো।সায়িদ অবাক হয়ে আতিফের দিকে চাইল।সে হেসে হেনরির ওপর দিয়ে উল্টে পড়ে যাচ্ছে।হেনরি হাসছে তবে আতিফের মতো না।সায়িদ দুই কাঁধ উঁচু করে বলল,
—আশ্চর্য!আমি কার শালা হলাম ভাই?মেঘু আমার ছোট বোন।আমার বোনকে নিয়ে উল্টো-পাল্টা কথা বলে আমাকে বলে কিছু বলার অধিকার নাই?”
আতিফ হাসার জন্য কোনো কথা বলতে পারছে না।সায়িদ আতিফকে ঠাস করে একটা চ’ড় মেরে চলে গেলো।আতিফ হাসি থামিয়ে মুখে হাত দিয়ে হেনরির দিকে তাকিয়ে বলল,
—“আমি কি করলাম?”
হেনরি কোনো জবাব না দিয়ে দূরে দাঁড়ানো কিছু মেয়েদের দিকে তাকালো।হেনরির দৃষ্টি অনুসরণ করে আতিফও সেদিকে তাকালো।এবার আতিফের মন চাচ্ছে দুনিয়া থেকে উঠে যেতে।কিছু সময় আগে এই মেয়েগুলোর সাথে ফ্ল্যাটিং করে এসেছে সে।আর এখন মেয়েগুলো তার অবস্থা দেখে হাসছে।মনে মনে সায়িদকে ভ’য়া’ব’হ গালি ছুঁড়লো।এখানে আর একমুহূর্ত থাকা মানে নিজের শেষ ইজ্জতটুকু বিসর্জন দেওয়া।মেয়েগুলোর তাকিয়ে বোকা বোকা হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।
সিয়ামকে হলুদ দেওয়া শুরু হয়ে গেছে।বড় মিলে ঠিক করছে কাকে কাকে পাঠাবে ঝিনুকদের বাসায় তাকে হলুদ দেওয়ার জন্য।ছোটেদের সবাইকে পাঠাবে বলে ঠিক করলো এবং তাড়াতাড়ি যেতে বলল।মেঘলা গাড়ির কাছে যাওয়ার সময় সামনে আকাশ এসে দাঁড়ালো।তার চোখে মুখে হাসি হাসি ভাব।এই হাসি মেঘলার সুবিধা মনে হচ্ছে না।ভালো করে আকাশকে দেখে নিলো।তার দুই হাত পিছনে দেখে খটকা লাগলো।মেঘলার ভাবনার মাঝে আকাশ ধপ করে তার হাত সামনে মেঘলার মুখ ছুঁয়ে দিতে গেলে মেঘলা বসে পড়লো।আকাশ হা করে মেঘলার দিকে তাকিয়ে আছে।বিষ্ময়ে কিংকত্রতব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে।মেঘলা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বলল,
—“আপনির দিন শেষ ভাইয়া।এখন আমার দিন।আপনি ডালে ডালে চললে আমি পাতায় পাতায় চলব এটাই নিয়ম।”
আকাশের পাশ কে’টে গাড়ির কাছে যেয়ে দেখে হেনরি আর জোনিতা আগে থেকে বসে গল্প করছে।তাদের যে বেশ ভাব চলছে তা মেঘলা বুঝতে পারছে।এদের বিরক্ত করতে ইচ্ছে করলো না তার।এই গাড়িতে আর জায়গাও নেই।সামনে গাড়িতে যেয়ে দেখে ড্রাইভিং সিট আর তার পাশের সিট খালি।ড্রাইভিং সিটে আকাশ এসে বসে পড়ল।মেঘলার দিকে তাকিয়ে ভিলেনের মতো হাসি দিয়ে বলল,
—“এবার পাতা ঝড়ে মাটিতে পড়বে বুঝি?”
মেঘলা চোখ ছোট ছোট করে পিছনের সিটে বসা সায়িদের দিকে তাকালো।সায়িদ একলাফে গাড়ি থেকে নেমে সামনের সিটে এসে বসলো আর মেঘলা পিছনে সায়িদের সিটে।সায়িদ যেন এমন একটা মূখ্যম সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।যা পাওয়া মাত্র সে লুফে নিলো।তার বোনের ব্যাপারে তার কোনো অধিকার নেই?আবার আতিফকে মেরে আকাশের ওপর রেগে।এজন্য আতিফের সাথে তার ঝগড়াও হয়েছে।বেচারা তো একটু হেসেছিল আর কিছু করে নি।সব দোষ যার তার কাজে বাঁধা দেওয়া সায়িদের কাছে অতি-উত্তম। মনে হচ্ছে।আকাশ রাগি চোখে সায়িদের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—“এটা কি করলি তুই?”
—“ভাইয়া ড্রাইভারকে বলে দেও বা’জে ভাবে এসে নিজেকে যেনো হিরো না মনে করে।আর আমার পাতা এত সহজে ঝড়ে পড়ছে না।মাথায় যেন কথাটা গেঁধে রাখে।”
সায়িদ হেসে দিলো আকাশের দিকে তাকিয়ে।গাড়িতে হাসির রোল পড়ে গেলো।আকাশ এক ধমক দিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে দিল।লুকিং গ্লাসে একপলক মেঘলাকে দেখে গাড়ি স্টার্ট দিলো।গাড়ি সোজা ঝিনুকদের বাসার সামনে গিয়ে থামলো।গাড়িতে সবাই কথা বললেও আকাশ কোনো কথা বলে নি।
ঝিনুকদের বাসায় যাওয়ার পর সবাইকে আপ্যায়ণ করা হয়।এরপর একে একে সবাই ঝিনুককে হলুদ লাগিয়ে দেয়।এদিকে আকাশ কোনোভাবে ঝিনুকের চাচাতো বোন শিমুকে নিজের থেকে দূরে সরাতে পারছে না।আঠার মতো তার সাথে চিপকে আছে।রাগে-ধমকে-অপমানে কোনো কিছু কাজ করছে না মেয়েটার ওপর।প্রথমে সে নিজে একটু-আধটু কথাবার্তা বলেছিল যাতে মেঘলা রেগে তার সাথে কথা বলতে আসে।কিন্তু এখন হিতেবিপরীত হচ্ছে।আজ যে তার খারাপ দিন তা মিনিটে মিনিটে অনুভব করতে পারতেছে।সকাল থেকে কিছু ভালো হচ্ছে না তার সাথে।যা ভাবছে তার উল্টোটা হচ্ছে।
আকাশের করুণ দশা দেখে সায়িদ মেঘলার পিছনে দাঁড়িয়ে আফসোসের সুরে বলল,
—“আকাশ ভাই তোকে জেলাস ফিল করাতে গিয়ে তেল ছাড়া কাঁঠাল ভেঙ্গে বসে আছে।”
—“অন্যের জন্য পুকুর খুঁড়তে গিয়ে নিজে পড়ে গেছে ভাই।তুই আফসোস কর না।হাত-পা ভা’ঙ্গু’ক তারপর চিকিৎসা করা যাবে।”
—“আমার ভাইকে নিয়ে এমন পরিকল্পনা আমি কোনো দিনও মেনে নিব না।”
আতিফের কথা শুনে মেঘলা আর সায়িদ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো।ওদের সাথে তাল মিলিয়ে আতিফও হেসে দিলো।
চলবে….