#ফিরবে চিনা ঠিকানায়
#লেখনীতে_অনামিকা_ইসলাম_জেরিন
#পর্ব_৯
সপ্তাহ খানেক আকাশ শহরের বাইরে ছিল অফিসের কাজের জন্য।আজ বাসায় ফিরছে।এর মাঝে মেঘলার সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করা হয় নি।সে চেষ্টা করলেও মেঘলা তাকে সুক্ষ্মভাবে এড়িয়ে গেছে।প্রথমে খারাপ লাগেছে পরে আবার ভেবেছে তার মেঘুর রাগ দিন-দিন কমছে সেটাই বা কম কিসে!তার প্রতি মেঘলার ভালোবাসা এখনো আছে।নাহলে তার জন্য জেলাস ফিল করতো কি?সিয়ামের বিয়ের দিন শিমুর সাথে ওইভাবে কথা বলতো?নিজের কথা সরাসরি না বললেও আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে।মেঘলা আর আকাশের বিয়ে কথা দুই পরিবারের মাঝে ওরা ছোট থাকতে থেকে চলছে।যা সম্পর্কে ওরা দু’জনে অবগত ছিল।শিমুর কাছে আকাশকে ‘হাফ বিবাহিত’ বলার মানে এই হয় না কি,যে মেঘলা তাকে ভালোবাসে!শুধু প্রকাশ করছে না।এটা স্বাভাবিক ভালোবাসার মানুষের পাশে অন্য কাউকে দেখলে জেলাস ফিল করবে।মেঘলা যত মুখ বলে ভালোবাসি না।মনের ভিতর ঠিক ততটা-ই ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছে।বাসায় ফিরে মাকে তাদের বিয়ের বিষয়ে তাড়াতাড়ি কথা আগাতে বলবে।এ নিয়ে সে আর দেরি করতে চায় না।
বাসায় এসে দেখলো বাসায় শুধু বুয়া আর আতিফ আছে।বাবা-মা জরুরি কাজে সিয়ামদের বাসায় গেছে।আকাশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুম গেলো।আকাশ এসেছে শুনে আতিফ তার রুমের দিকে পা বাড়ালো।অলস ভঙ্গিতে বিছানায় বসে দুই হাত পিছনে বিছানার ওপর রেখে,শরীরের ভর হাতের ওপর ছেড়ে দিল।পা দুলিয়ে শিশ বাজাতে লাগলো।আকাশ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আতিফকে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো।আতিফ শিশ বাজানো বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।তা দেখে আকাশ হাতের তোয়াল আতিফের মুখের ওপর ছুঁড়ল।আতিফ মুখের ওপর থেকে তোয়াল সরিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
—“ডুবে ডুবে তোমরা জল খাবা আর আমরা কিছু বলতে আসলে দোষ,তাই না?”
আকাশ বাম হাতে চুলের পানি ঝাড়া দিয়ে বলল,
—“কিসব বকছিস?কে বা কারা জল খাচ্ছে?বাই দ্যা ওয়ে জল পান করতে হয়।”
—“এখন নাটক করতেছো আমার সাথে?”
—“গলা ঝেড়ে কাশ?”
—“মেঘু আর তুমি রিলেশনে চলে গেছো আর আমাদের জানালেও না একবার?”
আকাশের কপালে ভাঁজ পড়ল।আতিফের মজা করছে নাকি সিরিয়াস বুঝার চেষ্টা করল।মুখের হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে সিরিয়াস।গম্ভীর স্বরে বলল,
—“আমি রিলেশনশিপে কেন যাব?সোজা বিয়ে করব।আর কোনো দেরি করতে চাই না আমি।আমি আজই মায়ের সাথে এই বিষয়ে কথা বলব।”
আতিফ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
—“এ্যাঁ!প্রোপোজ করে বসে আছে আর আমাকে বিয়ের কথা বলছে।আমি তো আর পর কেউ না তোমারই আপন ছোট ভাই।আমরা কখনো কিছু লুকাই একে অপরের থেকে?লুকাই না।প্রেম সংক্রান্ত কিছু ট্রিপস দিলে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।”
বিরক্ত হলো আকাশ।জার্নি করে এসে এখন কোনো উল্টো পাল্টা কথা শুনার ধৈর্য তার মাঝে নেই।দেয়াল ঘড়ির দিকে একপলক তাকাল।নয়টা বাজতে আট মিনিট বাকি।বাবা-মা কি আসবে,না ওখানে থাকবে আজ রাত?খাবার খেয়ে সে এখন ঘুমাবে যা কাল সকালের আগে ভাঙ্গবে না।আতিফের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
—“ফালতু কথার আর কোনো সময় পাস নি তুই?আমি এখন খেয়ে ঘুমাব।বিরক্ত করিস না।”
আতিফ দমল না।আকাশ টেবিলের ওপর থেকে মোবাইল নিয়ে বাবাকে ফোন করবে।তখন আতিফ নিজের মোবাইল নিয়ে ওর সামনে ধরল।
—“এটা কি?”
আকাশ প্রথমবার বেখেয়ালে তাকালেও দ্বিতীয়বার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।নিজের মোবাইল টেবিলের ওপর রেখে আতিফের মোবাইল হাতে নিলো।ভালো করে আইডির নাম দেখল ‘মেঘলা হাসান’।লাস্ট করা পোস্ট পূণরায় চেক করলো।ক্যাপশন দেখে থমকে গেলো।ইংরেজি অক্ষরে লেখা,
‘Finally he proposed to me.’
পোস্ট দশ দিন আগে করা।তার মানে সে শহর থাকতে এই পোস্ট করেছে।মেঘলার সাথে ফেসবুকে এড নেই সে।তার পোস্ট দেখার প্রশ্ন আসে না।ছবিগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলো।ব্রেকগ্রাউন্ড দেখে বুঝা যাচ্ছে কোনো রেস্টুরেন্টে গেছে।প্রথমে হাতের ছবি দেওয়া।অনামিকা আঙুলে সাদা পাথরের একটা আংটি জ্বলজ্বল করছে।দ্বিতীয় ছবিতে মেঘলার হাসি মাখা মুখ।হাতের গোলাপ ফুলের তোড়া।আর কোনো ছবি নেই।রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে ‘In a relationship’ দেওয়া।কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির আইডি,ছবি কিছু না পেয়ে রাগ হলো।কমেন্টে সবাই শুভ কামনক জানিয়েছে।কে প্রোপোজ করেছে প্রশ্ন মাথায় আসার সাথে সাথে হেনরির নাম আসলো।হেনরি ছাড়া আর কে মেঘলাকে প্রোপোজ করবে?স্থির চোখে ছবি দুটো দেখে যাচ্ছে।কয়েক মিনিটে আকাশ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।আতিফ এবার সিরিয়াস হলো।ভাইয়ের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বুঝার চেষ্টা করছে।কি হয়েছে?
—“কে প্রোপোজ করেছে?”
আকাশের প্রশ্নে আতিফ চমকালো।কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না।সে তো ক্যাপশন দেখে ভেবেছিল আকাশ প্রোপোজ করেছে আর মেঘলা একসেপ্ট করে নিয়েছে।অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
—“কে প্রোপোজ করেছে মানে?তুমি করো নি?”
আকাশ কোনো প্রত্যুত্তর করল না।নিজের মোবাইল হাতে তুলে নিয়ে মেঘলাকে ফোন করল।রিং হতে হতে কে’টে গেলো।স্তব্ধ অনুভূতি গুলো রাগে পরিণত হলো।মাত্র দেখেছে মেঘলা অনলাইনে আছে।ফোনের কাছে থেকেও ফোন ধরছে না।সামনে থাকলে নিশ্চিত কষে একটা চ’ড় মা’রত।আবার ফোন করল।প্রথমবার রিং হওয়ার সাথেই রিসিভ করল।ওপাশ থেকে হ্যালো আসার আগে আকাশ চোখ মুখ কঠিন করে বলল,
—“কার সাথে রিলেশন করছিস?”
মেঘলা অবাক হলো না।সে তো চেয়েছিল আরও আগে আকাশ এটা জানুক।হেসে বলল,
—“এত দেরিতে?”
—“এটা আমার প্রশ্নের উত্তর না।”
—“জানানো হলে আগেই জানাতাম।যেহেতু জানাই নি সেহেতু যেচে পড়ে আপনার জানতে চাওয়া উচিত না।”
আকাশ চিৎকার করে বলল,
—“উচিত অনুচিত এখন তোর কাছ থেকে আমার শিখতে হবে?”
চিৎকার শুনে মেঘলা ভয়ে কেঁপে উঠলো।আতিফ এক পা পিছনে সরে গেলো।সে যা ভেবেছিল কাহিনী তার পুরো উল্টো ঘটেঠে বুঝতে পেরে শুকনো ঢোক গিললো।তার ভাইয়ের সহ্যসীমা বোধহয় এবার পার হয়ে গেছে।মেঘলা বা কি করছে তার মাথায় ঢুকলো না।সাপের লেজে বারবার পারা দিচ্ছে কি কামড় খেতে?
মেঘলা কিছু না বলায় আকাশ জোরে আবার বলল,
—“কথা বলিস না কেন?”
মেঘলা নিজের ভয় চাপিয়ে রেখে তাড়া দেখিয়ে বলল,
—“আমাকে বিরক্ত করবেন একদম।আমি কি করব না করব এসবে আপনার নাক গলাতে আসবেন না।”
আকাশের কোনো কথা শুনার অপেক্ষা করল না।খট করে লাইন কে’টে দিল।আকাশ কান থেকে মোবাইল সরিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারল।রাগে ফোঁসফোঁস করছে।আতিফ তাড়াতাড়ি আকাশের পাশ থেকে নিজের মোবাইল নিয়ে নিলো।নতুন মোবাইলটা এদের ঝগড়ার কারণে হারাতে চায় না।আকাশ আতিফরে দিকে তাকাতেই সে রুম থেকে বিদায় নিলো।এখানে থাকলে মা’রও কপালে জুটতে পারে।
আকাশ জায়গায় বসে আছে।সব কিছুতে আগুন লাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।মেঘলার রাগ-জেদ-অভিমান যাতে কমে যায় সেজন্য সময় দিয়েছে।সব কিছু ঠান্ডা মাথায় মেনে নিচ্ছে বলে এটাও মেনে নেবে?মেঘলাকে নিজের করার জন্য সব করতে পারবে সে।এতদিন চুপচাপ অপেক্ষা করেছে কবে মেঘলা ফিরবে।এখন আর চুপচাপ থাকার মতো পরিস্থিতি মেঘলা রাখছে না।ক্লান্তি,রাগ মিশ্রিত হয়ে মাথা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে আকাশের।দুই হাতে চুলগুলো টেনে ধরল।কিছু একটা ভেবে শুয়ে পড়ল।রাতের খাবার খাওয়া হলো না।বেশ কিছু সময় চোখ দুটো লেগে আসলো ঘুমে।
_________________
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো আকাশ।মাথা এখনো ভার লাগছে।নাস্তা করতে এসে দেখলো বাবা-মা দুইজনেই আছে।
—“কখন এলে তোমরা?”
আকাশের বাবা বললেন,
—“রাতেই।তা সব কাজ শেষ হয়েছে?”
—“হুম।”
কিছু সময় নিরবতা চলল।সবাই চুপচাপ খেলেও আতিফ হাসফাস করছে।সে ঝড়ের অপেক্ষায় আছে।ঝড়ের কার কতটুকু ক্ষতি হবে সেই হিসাব কষছে।চিন্তার কারণে গলা দিয়ে খাবার নামছে না।মায়ের কন্ঠে তার অপেক্ষার অবসান ঘটল।চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে আল্লাহ আল্লাহ শুরু করল।
—“বুঝলি রে আকাশ!মেঘলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।কাজ কাম বাদ দিয়ে ওর বিয়ের কাজে হাত লাগা সবাই।আমাদের পরিবারের একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা।এত তাড়াতাড়ি আরেকটা বিয়ের আয়োজন করতে হবে তা কে জানতো?এখন সবাই মিলে হাতে হাতে কাজ করে মেয়েটাকে বিদায় করতে হবে।”
আকাশের মা খুশিতে গদগদ হয়ে কথাটা বললেন।আকাশের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো।বিস্ফোরিত নয়নে মায়ের দিকে তাকালো।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
—“কার সাথে?”
দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে তিনি বললেন,
—“হেনরির সাথে।ছেলেটা কিন্তু সব দিক দিয়ে মাশাআল্লাহ অনেক ভালো।মেঘু সুখে থাকবে।”
আকাশের বজ্রপাত হলো।ভাষা হারিয়ে বাক্যশূন্য হয়ে বসে আছে।তার ভাবনার উল্টো দিকে যাচ্ছে সব। এতদূর সব কিছু গড়াবে তার কল্পনার বাইরে ছিল।আতিফ বিষম খেলো।দ্রুত পানি খেয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল।সে স্থির আছে।এবার তার ভয় আরও বাড়ল।ঝড় বড় আকারে আসছে ভেবে ঘাম ছুটলো।
আকাশ শান্ত গলায় বলল,
—“আর আমি খুশী?”
সবাই তার দিকে তাকাল।এবার আকাশের বাবা বললেন,
—“দেখো আগের যা কথা ছিল সেসব ভুলে যাও।মেঘলা তোমাকে বিয়ে করতে চায় না।সে যাকে পছন্দ করে তার সাথে বিয়ে হলে সে সুখে থাকবে।তোমার জন্য আমরা অন্য মেয়ের দেখব।”
আকাশ প্রচন্ড রেগে টেবিল উঠে গেলো।সোজা নিজের রুমে যেয়ে বিকট শব্দে দরজা লাগালো।আতিফ এ নিয়ে বাবা-মার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখলো না।কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
চলবে…