#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫৮
#হুমাইরা_হাসান
_____________
“ সাল ১৯৯৫ ‚ আজহার আর আরহাম তখন তাগড়া যুবক। আজহারের বয়স পঁচিশ ছুঁইছুঁই আর বছর তিনেকের ছোট ভাই আরহাম বাইশে পা রেখেছে। দুই ভায়ের অত্যন্ত মেধাবী এবং পারিবারিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল হওয়ায় তাদেরকে পাঠানো হয় অস্ট্রেলিয়ার নামকরা ইউনিভার্সিটি পড়াশোনার জন্য। বাড়িতে তখন বাবা মায়ের সাথে রয়ে গেলো একমাত্র বোন রুকাইয়া। প্রথম দিকে অস্ট্রেলিয়াতে এসে দুই ভাই পড়াশোনা আর ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যাপক গুরুতর অগ্রগমণের উদ্দেশ্যে পরিশ্রম শুরু করে। কিন্তু তার মেয়াদসীমা খুবই স্বল্প ছিলো। বৈদেশিক সংস্কৃতি আর চাঞ্চল্যের ছোঁয়ায় আস্তে আস্তে নিজেদের নিজস্বতা হারিয়ে খুব সহজেই ওদের অভ্যাস, আচার আচরণ আয়ত্তে নিয়ে চালচলনের পরিমার্জিত ভাব খুইয়ে উগ্র জীবন জাপনের পথ ধরলো৷ আড্ডা, ক্লাব, পার্টি, ম’দ সবকিছুর নেশায় ধরেছিল। কিন্তু এসবের মাঝেও যে ভয়ংকর নে’শা ছিলো তা হলো ক্যাসিনো। ভিন্নধর্মী খেলা আর লোভনীয় টাকার সংখ্যা দেখে কৌতূহল বশত দুজন ওখানকার গুটি কয়েক বন্ধুদের সাথে ক্যাসিনোতে যাতায়াত শুরু করে। ছোট থেকেই আজহার আর আরহাম বয়সে ছোট-বড় হলেও ওদের বন্ধন ছিলো পিঠাপিঠি ভাইদের মতোই বন্ধুত্বপূর্ণ। তাই দুজনে মিলেই নিজেদের কৌতূহলীপূর্ণ শখ মেটাতে একই পথে ধাবিত হয়। আর জীবনের সবচেয়ে বড় পাপটা ওখান থেকেই শুরু হয়। আরহাম ছিলো ছোট থেকেই প্রচণ্ড ধূর্ত আর চৌকস মস্তিষ্কের অধিকারী। খেলায় হাতটা ওই আগে রেখেছিলো আজহার শুধু পরামর্শ আর পাশে থাকার কাজটাই করতো। প্রথম প্রথম খেলা শুরু করলে এক দুই করে হাজারো ডলার খুব সহজেই হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলো। তাগড়া শরীরের রক্ত যেনো টাকার নোটের গন্ধে খলবলিয়ে উঠলো। অদ্ভুত ভাবে সৌভাগ্যক্রমে একের পর এক দানে হাজার হাজার ডলার জিতে দুজনের লোভ হয় আকাশচুম্বী। ঝোঁকের বশে ক্যাসিনো নামক জু’য়া খেলাটাকেই নিজেদের ডেরা বানিয়ে নেয়। পড়াশোনা, পরিবার সব ভুলে দুই ভাই ডলারের নোটের ভাঁজে সর্বসুখ খুঁজে মৌজ, মস্তি করে মাসের পর মাস কাটালো। কিন্তু ওদের এই সৌভাগ্যের পাল্লা টা খুব বেশিদিন ভারী থাকেনি। নিজেদের উপর প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস আর অহংকারের দাপটে একের পর এক দান হারা সত্ত্বেও ঋণের মাধ্যমে খেলা চালিয়েই গেছে। কিন্তু বিপত্তি টা ঘটে সেখানেই যখন শরীরের গরম রক্তের উত্তাপে এতটাই মগ্ন হয়ে গেছিলো দুজন যে জেতার জন্য প্রবল উত্তেজনায় এদিকে যে লক্ষ সমান ঋণের বোঝা ঘাড়ে চেপে যাচ্ছে সে খেয়াল হয়নি। সে সময় ওদের জু’য়ার ময়দানে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গি ছিলো মাজহাব নামের এক যুবক। বয়সে ওদের চেয়ে বছর কয়েক বড়৷ ঘরে বউ সহ তিন বছরের একটা ছেলে সন্তান ও ছিলো। মাজহাব বহু আগে থেকেই এই নে’শায় আসক্ত ছিলো। আজহার আর আরহামের হাতেখড়ি মাজহাবের হাতেই হয়েছিলো। কিন্তু জু’য়ার নেশায় মত্ত হয়ে তিনজনেই যখন হাজার হাজার ডলারের ঋণে ডুবে গেছে তা ওরা যতক্ষণে উপলব্ধি করতে পেরেছে ততক্ষণে বহু দেরী হয়ে গেলো।৷
ক্যাসিনোতে উচ্চমাপের বিশেষ কিছু লোক থাকে যারা টাকা ঋণের নামে খেলোয়াড়দের হাতে টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দেয়, আর তা অত্যাধিক সু’দে উসুল করে। এতদিন খেলায় বড় বড় দানে জিতে এতটাই অহমিকা বেড়েছিল যে সেসব অঙ্ক ওদের কাছে নিতান্তই ক্ষুদ্র মনে হতো। তাই পরপর বিরতিহীন হারা সত্ত্বেও তাদের থেকে ঋণ নিয়ে খেলতেই থাকলো । আজহার, আরহাম আর মাজহাব তিনজনেই একটা দল ছিলো। সবশেষে কূল হারিয়ে যখন কোনো ভাবেই উঠে দাঁড়াতে পারলো না তখন উপরপদের লোকগুলো টাকার অঙ্ক সু’দসহ ফেরত চাইলো। হাতে আর গচ্ছিত যা ছিলো সব দিয়ে খেলেও নিজেদের স্থান ফেরাতে না পারায় বহু চেষ্টা করেও বৃহৎ অঙ্কের টাকার যোগাড় তিনজন মিলেও করতে পারেনি।
মাজহাবের মাতৃভূমি হলো বাংলাদেশ। কিন্তু ওর জন্মের অনেক আগে থেকেই ওর বাবা মা এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বান্ডাবার্গে একটা রেস্তোরাঁর মালিক তিনি। খুব বেশি স্বচ্ছলতা নেই, ছেলেকে উচ্চপদস্থ মানুষ গড়ে তোলার ইচ্ছে থাকলেও সে গুড়ে বালি দিয়ে মাজহাব বেছে নেয় উশৃংখল, উচ্ছন্ন জীবনযাপন। তাই পারিবারিক ভাবে কোনো সাহায্যের সম্ভাবনাও ছিলো না। সব কূল হারিয়ে দিশেহারা হয়ে দিশেহারা অবস্থা তখন ওদেরকে যিনি ঋণ দিয়েছিল সেই টাকার বদলে ওদের কাজ করার প্রস্তাব দেয়, তিনজনকেই জানের হু’মকি দিয়ে নিজের দলে টেনে নেয় আন্ডা’রওয়ার্ল্ড এর সকল অ’নৈতিক কারবারের সাথে সংযোগ করে দেয়৷ আজহার, আরহাম আর মাজহাব অন্য কোনো পথ না পেয়ে অগত্যা রাজি হয় তার প্রস্তাবে। ড্রা’গ সাপ্লাই, অস্ত্রপা’চার, অ’পহরণ সহ যতসব কু’কীর্তি আছে একে একে সবকিছুর সাথেই জড়িয়ে যায় তিনজনে। টাকার ঋণ শোধ করতে গিয়ে নতুনভাবে বড় অঙ্কের গন্ধ পেয়ে পুরোনো লোভ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তিনজনেরই। দুনিয়াবি নেশা’য় লোভে অন্ধ হয়ে নিজেদের শেষ মনুষ্যত্ব টুকুও জলাঞ্জলি দিয়ে কালো টা’কা, অ’নৈতিক কাজের সাথে নিজেদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলে।
ওদের মাঝে এসবে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছিল মাজহাব। অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় হওয়ায় ওর কাজ, প্রতিটা জায়গা সম্পর্কে ভালো ধারণা আর বুদ্ধির তীক্ষ্ণতার কারণে খুব অল্প সময়েই ও অ’নৈতিক কারবারে নিজের স্থান খুব ভালো ভাবে পাকাপোক্ত করে ফেলে। বছর তিনেকের মধ্যেই তিনজনেই টাকা নামক বস্তুর পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজেদের সমস্ত বিবেক, মনুষ্যত্ব বিলীন করে দিয়ে জীবন্ত অ’মানুষে পরিণত হয়। আজহার আর আরহামের বাবা ইয়াকুব মুর্তজা তখন রোগে আড়ষ্ট মৃত্যুপথযাত্রী। বাবার এই অবস্থায় বাড়ি থেকে বারংবার তলব এলে অগত্যা দুজনকেই ফিরতে হলো বছর চারেক চলাকালীন সময়। তবে ফিরে খুব একটা লাভ হলো না, দুই ভাই ফেরার এক মাসের মাথায় ওদের বাবা ইহলোক ত্যাগ করেন। স্বামী হারানো শোকাহত শাহারা বেগম সন্তানদের আর দূরে যেতে দিতে চাইনি। তবে আজহার আর আরহামের দেশে থাকতে ব্যাপক অনিহা। ছয় মাস পার হতেই ফেরার জন্য পারাপারি করলে শাহারা বেগম আজহার মুর্তজাকে বিয়ে দেন কম বয়েসী এক সুন্দরী মেয়ের সাথে। বউ এর টানে থেকে যাবে ভাবলেও সে ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে আজহার কোনো পদ্ধতিতে যে কয়েকদিনের মধ্যে পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং কার্যকর করে বউকেও সাথে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেললো তা ভাবতেও পারেনি শাহারা বেগম। মায়ের হাজারো বাঁধা নিষেধ অগ্রাহ্য করে আবারও ফিরে আসে ভিনদেশের বুকে। যেখানে হাজার হাজার ডলারের লোভ, উচ্চাকাঙ্খা আর বিলাসিতা আছে।
….কেটে গেলো আরও কতগুলো বছর, এর মাঝে বাড়ির সাথে যোগাযোগ করলেও একটা বারও ফেরার প্রয়োজন বোধ করেনি আজহার বা আরহাম কেও ই। তখন ওদের ব্যবসা আর টাকা সব মিলিয়ে রমরমা ভাব, গাড়ি বাড়ির বিলাসিতা প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ জীবন। হুট করেই একদিন ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কার অ্যাক্সিডেন্টে মাজহাবের বাবা মা সহ স্ত্রী ও গাড়িশুদ্ধ নদীতে পড়ে যায়। ভাগ্যের করুন পরিনতির কাছে হার মেনে তিন তিনটে প্রাণকে বেঘোরে হারাতে হয়। বাবা,মা, স্ত্রী হারিয়ে মাজহাবের পুরো দুনিয়াটায় পালটে গেলো চোখের পলকে। ওর জীবনে একটা মানুষকে ও সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে গেছে আর সে হলো ওর স্ত্রী রেজান বাহার কে। রেজান ছিলো তুরস্কের অধিবাসী । পড়াশোনার খাতিরে অস্ট্রেলিয়াতে এলে পরিচয় হয় মাজহাব আব্রাহামের সাথে। একই ইউনিভার্সিটিতে পড়তো দুজন, জীবনের একটা মোড়ে এসে মাজহাব খুব বেশি বেপরোয়া হয়ে পড়াশোনা শৃঙ্খলা নীতি ছেড়ে দিলেও রেজানকে ছাড়তে পারেনি আর নাইবা রেজান ওকে। এতদিনের সব ভুল আর পাপ গুলোর মধ্যে একমাত্র পবিত্র ছিলো ওদের ভালোবাসা। কিন্তু জীবনের শেষ সময় গুলোতে মাজহাবের সাথে রেজানের সম্পর্ক একেবারেই ভালো যাচ্ছিলো না৷ মাজহাব রেজানের মৃত মুখের দিকে তাকিয়ে যেন স্পষ্ট শুনতে পাই রেজানের ওকে বলা শেষ কথাটা ‘ আল্লাহর দোহাই তোমাকে, এসব ছেড়ে দাও। আমি ছেড়া কাপড়েও তোমার সাথে খুব সুখে থাকবো এসব গাড়ি বাড়ি আমার চাইনা তবুও এসব ছাড়ো মাজহাব এই পাপের শাস্তি অনেক করুন হতে চলেছে ’ রেজান চলে গেলেও ওর এই আকুতি আর্তচিৎকারের মতো কানে বাজতে থাকে মাজহাবের কানে। ওদের একমাত্র সন্তান, রেজানের আদরের দুলাল তখন মাত্র নয় বছরের। ছেলেকে মাজহাব নিজেও অসম্ভব ভালোবাসলেও কখনো তা প্রকাশ করেনি, অদ্ভুতভাবেই ছেলের সাথে অদৃশ্য একটা দূরত্ব কাজ করেছে। টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে ছেলেকেই যে পাইনি এটা উপলব্ধি করতে ভীষণ দেরী করে ফেলে মাজহাব। যতদিনে ও ছেলেকে ভালোবাসা, স্নেহ দিয়ে নিজের কাছে আগলে রাখতে এগিয়ে আসে ততদিনে ওর ছেলে অনেক দূরে চলে গেছে। মায়ের অন্ধভক্ত ছেলেটা একদিন স্কুল থেকে ফিরেই মায়ের প্রাণহীন শরীর টা দেখে ছুটে এসেছিলো। ওর ফর্সা টকটকে ছোট্ট হাত দুটোর আঁজলে মায়ের নিস্ক্রিয় মুখটা ধরে পাগলের মতো ডেকেছিলো ‘ Anne, anne, konuş. sana ne oldu! ‘। রেজান বেশিরভাগ সময় তুর্কী ভাষায় কথা বলতো ছেলের সাথে, যার দরুন ছেলেটাও ইংরেজি আর তুরস্কে সমান ভাবে স্পষ্ট ছিলো ছোট থেকেই। মাজহাবের বুক চিরে এসেছিল যন্ত্রণায় যখন ওর ছোট্ট ছেলেটা বিরতিহীনা বলেই যাচ্ছিলো ‘ আম্মা! আম্মা! ওঠো? কী হয়েছে তোমার? কথা বলো! ’
সেই থেকে ওর শান্তশিষ্ট ছেলেটা আরও বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। ভেঙে পড়লো মাজহাব। সমস্ত দিন দুনিয়া, ব্যবসা টাকা ভুলে ছেলেকে নিয়েই ঘরের কোণে পড়ে রইলো। রেজানের শেষ ইচ্ছেটাকে পূরণ করে ছেড়ে দিলো সমস্ত দূর্নী’তিবাজি, সমস্ত অ’ভিশপ্ত কু’কর্ম গুলো। কিন্তু প্রকৃতির অদ্ভুত নিয়ম আর বিচারের সূক্ষ্মতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে! মানুষ একটা ভালো কাজ করলেও যেমন প্রতিদান পাবে ঠিক তেমনই মানুষের করা পাপ গুলোর ও কড়ায় গন্ডায় উসুল দিয়ে যেতে হয়।
মাজহাব নিজের সমস্ত পাপ ছেড়ে দিলেও, পাপ নিজে ওকে ছাড়েনি। যেহেতু মাজহাব ব্যবসার অনেক বড় একটা অংশে জড়িত ছিলো তাই ওর অনুপস্থিতিতে সকল কাজেই বিঘ্ন ঘটতে থাকে । উপরমহল থেকে বারবার তলব অবশেষে হু’মকিও আসতে থাকে। শারীরিক, মানসিক চাপে বেজায় রকম অসুস্থ হয়ে পড়ে মাজহাব। দুবার হ্যার্ট অ্যাটাকে খুব কম বয়সেই শরীর হাল ছেড়ে দিতে শুরু করে, তবুও ছেলেকে নিয়েই একাকিত্ব গুলোকে পেরিয়ে যেতে থাকে। একদিন আজহার, আরহাম নিজেরা আসে মাজহাবের বাড়িতে। কথায় কথা বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মাজহাব সমস্ত লোভ বিসর্জন দিলেও দেয়নি আজহার আর আরহাম। ওরা তখন সাফল্যের চূড়ায় উঠতে হন্য হয়ে লেগে আছে যা মাজহাবের পিছুটানে ব্যাপক বাঁধায় পড়ছিলো। তর্কে তর্কে কথা ওঠে শেয়ারের সমস্ত টাকা ওদের দুই ভাইকে ফিরিয়ে দিতে কিন্তু তা কোনো ভাবেই সম্ভব ছিলো না কারণ মাজহাব সমস্ত টাকা আরও আগেই ট্রাস্টের ফান্ডে দান করেছিল অন্তত একটু দায়মুক্ত হতে৷ এতে যেনো আজহার আর আরহামের মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা। বির্তকের এক পর্যায়ে পরিস্থিতি হা’তাহাতিতে পৌঁছালে হুট করেই মাজহাবের আবারও হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ দেখা যায়। বুকে হাত দিয়ে চোখ মুখ খিঁচিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে লম্বা চওড়া সৌষ্ঠব শরীরের মানুষটা। মুর্তজা ভাইয়েরা পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দায় বাঁচিয়ে তক্ষুনি পালিয়ে যায়, পরে যখন খবর পায় যে মাজহাব আর বেঁচে নেই তখন লোক দেখানো সহানুভূতি, সমবেদনা দেখাতে ছুটে আসে। করুণা দেখাতে এলেও ওদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো মাজহাবের সহায় সম্পত্তি আর ব্যবসার মালিকানা হাতিয়ে নেওয়া।
ওদের চোখে পড়ে পুরো দুনিয়াতে একেলা হয়ে যাওয়া নয় বছরের ছেলেটার দিকে। যন্ত্রমানবের মতো চুপটি করে তাকিয়ে থাকে বাবার মরদেহের দিকে। মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যেতো ছেলেটার মাঝে, বাবার মৃত্যুর পর কথা বলায় বন্ধ করে দেয় একেবারে। যেহেতু ওদের ব্যবসায় শেয়ার তিনজনেরই ছিলো তাই মাজহাবের অনুপস্থিতিতে সম্পূর্ণটা এসে পড়ে ওদের ভাগে। এদিকে মাজহাবের যখন হাতভর্তি টাকা সেই সময় শখের বশে বাংলাদেশে অনেক বড় আলিসান একটা বাড়ি আর ব্যবসার শাখা তৈরী করায় আজহারদের সাহায্যে। এখন যখন মাজহাব মৃত তখন মুর্তজা ভাইয়েদের শকুনের নজর সেদিকটাতেই আগে পড়ে। কারণ এদেশে যাসব আছে তা ওইদেশে বয়ে যাওয়া আপাতত অসম্ভব। তাই মাজহাবের বাংলাদেশের সম্পদটা হয়ে ওঠে ওদের লোভের শীর্ষকেন্দ্র। কিন্তু সেই কাজটা ওরা যতটা আসান ভেবেছিল ততটাই ঝামেলাপূর্ণ হয়ে দাঁড়ালো। মাজহাব হয়তো বুঝতেই পেরেছিল ও আর বেশিদিন টিকবে না তাই মরার আগেই নিজের সমস্ত জমিজমা ও সম্পদের মালিকানা নিজের নয় বছর বয়সী ছেলের নামে করে দিয়ে যায়, এবং উল্লেখ্য যে তার সন্তানের বয়স পঁচিশ না হওয়া অব্দি সকল সম্পদের একচ্ছত্র আধিপতি শুধু তার ছেলেই থাকতে পারবে৷ ছেলে পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর স্বেচ্ছায় কাওকে দিলে তবেই তা গ্রহণযোগ্য হবে। অন্যদিকে আজহার মুর্তজার বিবাহিত জীবনের অনেক বছর পার হলেও কোনো সন্তান ছিলো না, ব্যবসায়ীক সখ্যতার খাতিরে একে অপরের বাড়িতে বহুল আসাযাওয়ার কারণে আজহারের স্ত্রী আম্বির সাথে রেজানের বেশ বন্ধুত্ব ছিলো আর তার মূল আকর্ষণ ছিলো রেজানের ছেলে। নিঃসন্তান আম্বির মনটা হার হামেশা আকুলিবিকুলি করতো একটু ছেলেটাকে ছুঁয়ে দিতে, চাঁদ মুখ খানায় চুমু দিয়ে আদর করে দিতে। শেষ মুহূর্তে এসে যখন এতবড় একটা সুযোগের ব্যবহার এলো তখন আম্বি আর তা হাতছাড়া করেনি। স্বামী আর দেবরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাচ্চাটাকে দত্তক নেওয়ার জন্য রাজি করায় এতে তারা সম্পদ ও নির্বিঘ্নে পেয়ে যাবে আর তার সন্তানের খায়েশ টাও মিটবে। ”
মিনিট দুয়েক ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতা। নিঃশ্বাসের শব্দটাও খুব ক্ষীণ শোনাচ্ছে। মুহুর্ত জুড়ে ব্যাপক নীরবতা কাটিয়ে দম নিয়ে আবারও দূর্বল গলায় শাহারা বললেন,
– নিজেদের ছয় বছরের ঘাটি উপড়ে অতঃপর দেশে ফিরে আসে আজহার আর আরহাম। আম্বি পরম মমতায় নিজ সন্তান স্নেহে বুকে করে আনে একটা বিদেশিকে। চকচকে গায়ের বরণ, ভিন্ন রঙের চোখ, ভিন্ন বেশ-ভূষা। অপলক তাকিয়ে থাকার মতো সৌন্দর্যপূর্ণ নিষ্পাপ ছেলেটাকে। যে কী না মাজহাব আব্রাহাম আর তার স্ত্রী রেজান বাহারের একমাত্র রত্ন আব্রাহাম রুদ্ধ। মায়ের নামের সাথে সাধ করে মিলিয়ে রাখা নামটাকে পালটে আম্বি তার নাম রাখে মেহরাজ, যার অর্থ সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। নিঃসন্তান আম্বির কোল উজ্জ্বল করে আসা চাঁদটাকে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ স্বরূপ আগলে নিয়ে বুকে ধরে রাখে আম্বি। সন্তানের খায়েশ মেটাতে চায় অন্যরকম চরিত্রের বাচ্চাটাকে দিয়ে। যে কী না নিজের অন্যরকম চরিত্র বহাল রেখে বেড়ে উঠেছে গাম্ভীর্যপুর্ণ একটা মানুষে। আজকে যাকে সবাই মেহরাজ আব্রাহাম বলে চিনেছে সে আসলে অস্ট্রেলিয়ান আর তুরস্ক বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, ভিনদেশী। আব্রাহাম রুদ্ধ।
দীর্ঘ . . . সুদীর্ঘ একটা গল্প, একটা কাহিনী প্রবল উৎকটতা আর রোমাঞ্চকতা নিয়ে নিঃশব্দে হজম করলো উপস্থিত পাঁচ পাঁচটা মানুষ। শাহারা বেগম যেন হাঁফিয়ে উঠলেন এতগুলো কথা একসাথে বলে। এ তো শুধু কথা নয় এ এক গল্প। একটা আস্ত জীবনের গল্প। কে বলবে এটা জীবনের গল্প, যেনো একটা ইতিহাস! যা বছরের পর বছর বুকের ভেতর সমাধি করে রেখেছে। কে জানতো সারাজীবন যেটাকে বুকে চেপে কুরে কুরে মরছিল সেই সত্যটাকেই আজ শেষ কালে এসে উন্মোচন করতে হবে! নিজের ছেলেদের মানুষ করতে গিয়ে যে চরম অ’মানুষ করে তুলেছে, মনুষ্যত্বহীন, বিবেকেহীন করে ফেলেছে এটা কী করে বলতো মানুষকে! পাপের আস্ত একটা সাম্রাজ্য হজম করে সারাজীবনটা ভারী করে রেখেছে।
সাঞ্জে আর তাথই যেনো পলকটাও ফেলতে ভুলে গেছে। এত বড় একটা সত্য ওরা জানতো না! ওদের বাবা মায়েরা এতটা নিচ! এতটা জঘন্য ব্যক্তিত্ব ওদের!
– আমার দাভাই আমার সত্যি ভাই না দিদা?
কান্নার জোয়ার সামলে টলমলে কম্পিত গলায় জিগ্যেস করলো সাঞ্জে। শাহারা চোখ মুছে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
– কে বলেছে তোর দাভাই না? ছোট থেকে আদর ভালোবাসা,স্নেহ যত্ন সবটা দিয়ে তোদের আগলে রেখেছে। ও ছাড়া আর কে হবে তোর দাভাই!
তাথই মুখ খুলে প্রশ্ন করার প্রবলতা টুকু সঞ্চার করতে পারলো না। শ্রীতমা হা করে চেয়ে আছে। অভিমন্যুর ফোন পেয়ে ও কোনো প্রশ্ন ব্যতীতই এসেছিল মিথিলার বাড়িতে। মোহরের বিধ্বস্ত অবস্থা বা তার কারণ কোনোটাই ওর জানা নেই। কিন্তু এমন সময়ে উপস্থিত হয়েছিল যে প্রশ্ন করার অবকাশ টাও পাইনি। নিজের অজান্তেই, আকস্মিকভাবেই এমন বিস্মিত করা কিছু শুনতে পাবে তা হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি ও। এখনো ভেতরে অসংখ্য প্রশ্ন,উৎকণ্ঠা, দুঃশ্চিতারা জটলা পাকিয়ে আছে, কিন্তু তা প্রকাশ করার সময় সময় বা পরিবেশ যে এটা না তা বুঝেই নিশ্চুপতার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
– রু..রুদ্ধ
সম্পূর্ণ কথাটুকুও প্রকাশ করতে পারলো না। বিস্তীর্ণ বিস্ময় কাটিয়ে ধাতস্থ হওয়ার পরিস্থিতি কোনো ভাবেই হচ্ছে না। একের পর এক ধাক্কা ক্রমেই পাগল করে দিচ্ছে মোহরকে। এতবড় একটা সত্যি! এতবড় একটা গল্প! মাথার পেছন দিকে অসম্ভব যন্ত্রণাভূত হলো মোহরের। অতিরিক্ত মানসিক চাপে, মাথার যন্ত্রণা’য় ফেটে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে অসংখ্য প্রশ্ন,কৌতূহলের স্ফূলিঙ্গ ছুটছে। অনেক,আরও অনেক কিছু বাকি আছে। আরও অনেক কিছু জানার আছে। মোহরের অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থা দেখে শাহারা বেগম স্থুল গলায় বললেন,
– আরও অনেক কিছুই বাদ আছে জানি। তবে সেসব আমার জানার বাহিরে, তোমার মনে যেই প্রশ্ন গুলো জমেছে তার উত্তর কেবল স্বয়ং মেহরাজ ই দিতে পারবে।
.
.
.
চলমান
#হীডিং : শেষোক্ত কথাটুকু অনুযায়ী, এখনো অনেকটাই অজানা রইলো। অবিলম্বেই সেগুলোও সামনে আনবো। তাই, ধৈর্য ধরে পাশে থাকার অনুরোধ, আর থাকার জন্য ধন্যবাদ। ❤️
#Humu_❤️
Golpota to 1st theke e khub interesting,,,,,,,,, kintu 1prbo kore prle,,,,, golpr perfect moja ta paina,,,,,, plz baki sob ta joto taratari paren die den,,,,,,, sob ta eksathe pore kolija ta thanda krbo NE,,,,,,,,