#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৫৬
#হুমাইরা_হাসান
– অভি!
অভিব্যক্তি টা ঠিক এমন যেন অলৌকিক কোনো ব্যাপার স্যাপার চোখের সামনে পড়েছে। দরজার দুটো পাল্লা ধরে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন বিস্ফারিত চোখে। সকাল থেকে অভিমন্যুকে বাড়িতে না দেখে চিন্তা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ওর আগমনটা এমন উত্থান ঘটাবে কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি। বড় বড় চোখের অঅদ্ভুতুরে দৃষ্টিতে অবলোকন করলেন ভদ্রমহিলা অভিমন্যুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অতি সাধারণ বেস ভূষার অনিন্দ্য সুন্দরীকে। তবে সে রমণীর অগাধ রূপের দর্শন আজ নতুন তো নয়! দুধে আলতা গায়ের রঙ ডাগর ডাগর আঁখি যেনো সাক্ষাৎ দেবীমূর্তিটির ন্যায়। তবে আজ সে রূপ কারো চোখে বিঁধার মতো না, সবকিছুকে ছাড়িয়ে আকর্ষণের মূল বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রীতমার সীঁথিয় রাঙানো রক্তের ন্যায় টকটকে রঙ’টা৷
– এ তোরা কী করে এসেছিস? ওর সীঁথিতে সিঁদুর কেনো অভি?
মাধুর্য ব্যানার্জির গলার স্বর কম্পিত, কিঞ্চিৎ আতঙ্কিত ও ঠেকলো। তবে সেসবে কান না দিয়ে অভিমন্যু হাতের করপুট টা আরও দৃঢ় করলো, তাতে চাপ পড়লো শ্রীতমার কব্জিতে ব্যাপকভাবে। অতি সহজতর ভঙ্গিমায় অভিমন্যু বলল,
– আমি পড়িয়েছি মা। ওঁকে আমি সিঁদুর পড়িয়ে বিয়ে করেছি কিছুক্ষণ আগেই।
– বিয়ে করেছিস মানে?
চোখের চশমাটা খুলে হাতে নিলেন মাঝবয়েসী লোকটা। বিস্মিত মুখাবয়বে এগিয়ে এসে মাধুর্যের পাশে দাঁড়িয়ে তাকালেন অভিমন্যুর পাশেই নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীতমার দিকে। মেয়েটার মুখটা এতো নিচু করে রেখেছে যে অভিব্যক্তি বুঝতে পারা বড় দায় হয়ে পড়েছে। তবে অভিমন্যুর ধর্যে কুলাচ্ছে না আর। খানিক বিরক্ত হয়েই বলল,
– এভাবে আর কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবে মা, ভেতরে অন্তত ঢুকতে দাও।
– ভেতরে ঢুকতে দেবো মানে? কী করে এসেছিস তুই কোনো ধারণা আছে? বলা নেই কওয়া নেই এসে বলছিস বিয়ে করেছিস? কীভাবে বিয়ে করলি তুই? মুখে বললেই বিয়ে হয়ে গেলো?
– শুধু মুখে বলছি কোথায়। তাকাও ওঁর দিকে আমার পড়ানো সিঁদুর ওঁর পরনে। আর কীসের প্রমাণ চাও?
অভিমন্যুর বাবা খানিক নিচু গলায় মাধুর্য ব্যানার্জিকে বললেন,
– ওঁদের আগে ভেতরে ঢুকতে দাও তারপর নাহয় সব জানা যাবে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ভালো দেখায় না, এক্ষুনি উপর তলা থেকে লোকজন নামবে, বড়সড় কাহিনি হবে তখন।
– কী ঢুকতে দেবো? ওঁরা বিয়ে করে এসেছে চোখে দেখছ না? সাত সকালে বিয়ে করে হাজির হয়েছে না মেনেছে নিয়ম কানুন, কোনো আচার অনুষ্ঠান। তারপরে বাড়ির বউকে বরণ করে না ঢোকালে কতো বড় অনাসৃষ্টি হতে পারে ধারণা আছে?
অভিমন্যুর বাবার মুখটা শুকিয়ে গেলো এহেন কথায়। ভুল তো বলেনি! কিন্তু এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখাটাও ভালো দেখাচ্ছে না। শ্রীতমা এতক্ষণেও মুখ তোলেনি। মাধুর্য ব্যানার্জি শক্ত গলায় বললেন,
– এখানে দাঁড়াও। অন্তত বরণ করে ঘরে ঢোকাই না তো আর কত কী হবে ভগবান জানেন
বলে ঘরের মধ্যে গিয়ে পূজোর থালা টা নিয়ে এসে অভি আর শ্রীতমাকে কোনো রকম বরণ করে কপালে চন্দন ছুঁইয়ে ঘরে ঢোকালেন, প্রবেশের সময় সাদা একটা চাদরে শ্রীতমার আলতায় ভেজানো পায়ের ছাপটা নিতে ভোলেননি। এত কিছু করার একটাই কারণ আর তা হলো নিয়মের কোনো বিশৃঙ্খলা উনি সহ্য করবেন না। ঘরে ঢুকতেই মাধুর্য বললেন,
– এবার বল। এভাবে হুট করে বিয়ে করার মানে কী? আমরা কী তোকে জোর করেছিলাম বিয়ে করার জন্য? আর তোদের মাঝে তো কোনো সম্পর্ক ও নেই তবুও বিয়ে করার মানে কী? ওর মুখটা দেখেই সাফ বোঝা যাচ্ছে ওর কোনোই মত নেই এ বিয়েতে।
অভিমন্যুর বাবা ভীষণ হতাশা মিশ্রিত গলায় বললেন,
– আমরা তো তোমাকে বিয়ের জন্য আর কোনো রকম জোর দেয়নি অভি? তবুও একটা মেয়েকে এভাবে বিয়ে করে আনার মানে কি? এটা তো কোনো ছেলেখেলা নয়! আর এমন ও না যে তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো। কিছুদিন আগেও একটা মিথ্যে বানিয়েছিলে, তারপরেও এইরকম কাজ করার মানে কি? আমার তো এখন মনে হচ্ছে তোমাকে ঠিকঠাক শিক্ষা দিতে পারিনি আমরা।
অভিমন্যু জবাব হীনা আড়চোখে তাকালো শ্রীতমার নতজানু মুখে। কাঁদতে কাঁদতে চোখটা ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। দেখে বড় মায়া লাগছে, কিন্তু ওঁর কিছু করার ছিল না। বাবা মায়ের দিকে ফের তাকিয়ে এবার বলল,
– আমি এমন কোনো কাজ করিনি বাবা যাতে তোমাদের শিক্ষার নড়চড় হবে। বিয়ে করেছি, পাপ তো না! আর রইলো কথা সম্পর্কের তা মিথ্যে নয়। আমি ভালোবাসি শ্রী’কে। আর ভালোবাসি বলেই সিঁদুর পড়িয়েছি। না কোনো পরিস্থিতির স্বীকার আর নাইবা কেও জোর করেছে।
– ভালোবাসো যখন তাহলে কিছুদিন আগের নাটকের দরকার কী ছিল? তুমি কী আমাদের ভুজুংভাজুং বোঝাচ্ছ? তখন তো মিথ্যে নাটক বলে আমাদের আশা ভরসা দিয়ে তা নষ্ট করলে। ভালোই যখন বাসতে তাহলে নাটক কেনো করেছিলে?
– ভালো বাসলেই যে প্রেমের সম্পর্ক থাকতে হবে এমন তো না মা! আমি ভালোবাসি ওঁকে। ভালো রাখবো আমি। কোনো অযত্ন বা অসম্মান হতে দেবো না। ওই হোস্টেলের দেওয়ালের মধ্যে একা একা ও থাকুক অনিরাপদ ভাবে চলাফেরা করুক এটা আমি চাইনা তাই এভাবে হুট করে বিয়ে করে এনেছি। আর তোমরা তো বরাবরই চেয়েছ যে আমি আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করি,তবে আজ কেনো এতো প্রশ্ন,আঙুল তুলছো? চাও না আমি ওঁকে নিয়ে এ বাড়িতে থাকি?
সহজ সরল, সাদামাটা ছেলেটার এমন কথাবার্তায় বিস্মিত হলেন বাবা মা দুজনেই। ঠিক খুশি হবে কী দুঃখ পাবেন সেটা নিজেরাও বুঝতে পারছে না। অভি বিয়ে করবে তাও শ্রীতমার মতো একটা মেয়েকে এ তো ওদের পরিবারে আশীর্বাদ স্বরূপ
কিন্তু চিন্তাটাও শ্রীতমাকে নিয়েই। তাদের মনে ভয় হচ্ছে যে মেয়েটা হয়তো খুশি না!
– তোমার মা তা বলেনি অভি। মেয়েটার দিকে তাকিয়েছ তুমি? ওঁকে দেখেই মনে হচ্ছে বিয়েতে একদম ওর মত নেই। একটা মেয়ের অমতে কী সংসার করা সম্ভব?
অভি শ্রীতমার দিকে তাকিয়ে এক হাত তুলে ওর গালটা মুছিয়ে দিলো হাতের উল্টো পাশে। মন্থর গলায় বলল,
– ওঁর যেভাবে ভালো লাগবে যা ইচ্ছে করবে তাই করুক সেভাবেই থাকুক। যদি আমার সাথে থাকতে না চায় তবে ওর জন্য আলাদা ঘর দাও। তবুও ও এ বাড়িতেই থাকবে আর আমার বউ এর পরিচয়েই। যতটা সম্ভব সময় নিক। অন্য কেও তো ওঁর জীবনে নেই তবে আমাকে মেনে নিতে আপত্তি কীসের? বুঝিয়ে দাও যে আজ থেকে এটাই ওঁর নিজের বাড়ি আর তোমরাই ওঁর বাবা মা।
বলে অভিমন্যু বড় বড় পা ফেলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। শ্রীতমা অঅশ্রুসিক্ত নজরে বিহ্বলিত হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। মানুষ টার এ কোন চেহারা দেখছে! অভিমন্যুকে কোনো দিন ও এতটা গম্ভীর, একরোখা মনে হয়নি। ওঁকে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে কোনো কথা ছাড়ায় সিঁদুর পড়িয়ে দিয়ে বলেছিল
“ আজ থেকে তুমি আমার স্ত্রী আর আমিই তোমার স্বামী ”
শ্রীতমার ভেতর হতবাকতা, কষ্ট, রাগ সব মিলিয়ে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। খুশি নাকি দুঃখ কোনো নামই দেওয়া যায়না সে অনুভূতির। শুধু কানে অভিমন্যুর বলা সেই কথাই বাজছে
“ আমি ভালোবাসি ওঁকে। ভালো রাখবো আমি ”
সত্যিই কী অভি ওঁকে ভালোবাসে?
•••
কাউচে বসে মাথাটা ঝুঁকিয়ে রাখা। হাত দুটোর আঙুলে আঙুল ছুঁইছুঁই ভঙ্গিমায় রাখা। ফোঁসফোঁস করে জোরে শ্বাস টেনে নিলো। চোখটা টাইলসের ফ্লোরে আঁটকে আছে। আসলেও হলো টা কী! বুকের ভেতর কেমন যেনো মুচড়ে উঠছে বারবার। এতো কষ্ট লাগার কারণ টা কী! ঘাড় তুলে পেছলে ঠেস দিলো। ক্লান্ত, স্থিত চোখটার মারবেল আকৃতির মণিটা সারা ঘরময় ঘুরিয়ে দেখলো। তবে কাঙ্ক্ষিত চেহারাটার দেখা মিললো না, উফ! শান্তি পাচ্ছে না তো! ওই মুখটা না দেখে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না।
– মোহ! একটু কাছে আসুন না
নিজের অজান্তেই মুখ ফুটে বলে ফেললো কথাটা। এক মিনিট, দুই মিনিট করে প্রায় দশ মিনিট পেরিয়ে গেলো। কোই মোহ আসলো না কেনো? ভারি অবাধ্য মেয়ে। মেহরাজ ক্ষুব্ধ হলো, ও তো বারবার বলে দিয়েছে যে যখন বাড়িতে থাকবে যেনো সবসময় চোখের সামনে থাকে তবুও মেয়েটা কেমন অবাধ্যতা করে দূরে গিয়ে বসে আছে! দূর্বল গলায় ভারি স্বরে মেহরাজ আবারও ডাকলো,
– মোহ! আসুন না একবার। আপনাকে না দেখতে পারলে আমার কষ্ট হয়,জানেন তো।
তবুও এলো না মোহর। প্রতিবারের মতো মেহরাজের ডাকটা শুনেই ছোট ছোট কদমে এগিয়ে এলো না। আর নাইবা এসে পাশে বসলো। নাক টেনে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো মেহরাজ। বদ্ধ চোখেই বুকের পাটা প্রসারিত হলো বিস্তর৷ ঘরময় মিষ্টি মেয়েলী সুবাসে আচ্ছাদিত। যেই সুবাস নাসারন্ধ্র ভেদ করে মন মস্তিষ্ক সবটায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ খুলে খোঁজার চেষ্টা করলো কিন্তু সেই সুবাসিনীকে তো পেলো না! কোথায় সে? মেহরাজের প্রিয়তমা, ওর অদ্বিতীয়া, ওর প্রাণভ্রমরী কোথায়!
মেহরাজ ধপ করে উঠে দাঁড়ালো। ঝড়ের বেগে আলমারির সামনে গিয়ে ধড়াম করে দ্বার খুলে সব জামা কাপড় লণ্ডভণ্ড করে মোহরের পরিহিত একটা শাড়ি বের করে আনলো। দুহাতে শাড়টা নাকে চেপে ধরলো। নিজেকে অবিন্যস্ত, বদ্ধ উন্মাদ মনে হচ্ছে ওঁর। দম বন্ধ হয়ে আসছে, কি করে শান্তি পাবে ও কি করে! সারাটা দিন পেরিয়ে সন্ধ্যে হয়েছে মোহ’টা তো তবুও ফিরলো না ও কি জানে না মেহরাজ ওঁকে দেখতে না পেলে পাগল হয়ে যাবে। কীসের এতো রাগ,কীসের অভিমান! সেসব কী মেহরাজের ভালোবাসার চেয়েও বড়? না তো! তবু কেনো ফিরছে না! চোখ ছাপিয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মোহরের শাড়ির উপর৷ মেহরাজ পাগলের মতো শাড়িটায় অসংখ্য চুমু দিয়ে বলল,
– মোহ আপনি কেনো চলে গেলেন? আমায় ছেড়ে গেলেন? কেনো! আমায় ছেড়ে যেতে কী একটুও কষ্ট হলো না,বুকটা কাঁপলো না! এতটা পাষাণী আমার মোহ? তবে আমি কেনো হতে পারছিনা পাষাণ। আমি পারছিনা, একটা মুহূর্ত আমার সহ্য হচ্ছে না। বুকের ভেতর কেও অনবরত খঞ্জর চালিয়ে দিচ্ছে। আমায় একটু শান্তি পেতে দিন, ফিরে আসুন মোহ। কোথায় পাবো আমি আপনাকে আমার মোহ কে আমি আবার আগের মতো করে কীভাবে পাবো বলে দিন। জান দিয়ে দেবো আমি তবুও আপনাকে চাই!
পুরুষ মানুষ নাকি পাথরের মতো শক্ত হয়! তবে মেহরাজ কেনো শিশার মতো গুড়িয়ে পড়েছে? এতো করুণ আর্তনাদ টা মোহর শুনলে আঁটকাতে পারতো নিজেকে! যেই কণ্ঠ হতে নিঃসৃত প্রতিটি হরফ, বাক্য ওঁকে ক্ষণে ক্ষণে ভালোবাসা,প্রেমের শীতলতা বুঝিয়েছে, ভরসা বিশ্বাস দিয়েছে, যেই কণ্ঠের মাদকতায় হাজারো বার নিজেকে হারিয়েছে আজ তার করুণ আর্জিটা সইতে পারতো!
– মোহর আসবেনা মেহরাজ
ঘুরে তাকালো না মেহরাজ। তবে সেসবে মন না দিয়ে দরজার নবটা পূনরায় মুচড়ে লাগিয়ে এগিয়ে এলো। হাঁটু গেড়ে মেহরাজের পাশে বসে ওঁর পিঠে হাত রেখে বলল,
– তোর মোহ চলে গেছে, তোকে ছেড়ে।
মেহরাজ ক্ষিপ্ত চেহারায় তাকালো। পৃথকের কলার চেপে বলল,
– কে বলেছে! যায়নি মোহ, ও আমার পৃথক। ওর সবটাই আমার। আমি ছাড়া ও থাকতে পারবেনা কখনোই না আর আমিও থাকতে দেবো না। মোহর শুধু মেহরাজের ও আমাকে ভালোবাসে।
– মেহরাজ তুই এতটা ভেঙে পড়ছিস? আজ হোক আর কাল এমনটা যে হবেই সেটা তুই জানতিস না? আমি তো বহুবার তোকে বুঝিয়েছিলাম, ভালো বাসিস না এতটা। সহ্য করতে পারবিনা। তাও কেনো তুই ওঁকে এতো ভালোবেসে ফেললি ভাই?
পৃথক ভীষণ আফসোস, গ্লাণি নিয়ে বলল। মেহরাজের এই চেহারাটা যে ওর সহ্য হচ্ছে না। সারাটা দিন পেরিয়েছে, তাথই যখনই ফোন করে বলেছিল মোহরের চলে যাওয়ার ঘটনা তখন থেকে আসার জন্য বহুবার প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু পারেনি, মোহরকে ছাড়া মেহরাজের অবস্থা টা কতটা বিধ্বস্ত হতে পারে তা ভেবে দুমড়ে মুচড়ে এসেছে ভেতরটা। যেই ভয়টা বছর খানেক আগে পেয়েছিল তা আজ বাস্তবে রূপান্তরিত হলোই!
– এখন পরিস্থিতি কেমন তা আমার চেয়ে ভালো তুই বুঝছিস। নোমান পালিয়েছে, আর ওকে বের করার পেছনে প্রশাসনের সাথে জড়িত হাতই কলকাঠি নেড়েছে। এখন ও ছাড়া পাওয়া সাপের মতো ঘুরছে ছোবল মা’রার জন্য। মোহরের হাত অব্দি পেনড্রাইভটা পৌঁছে গেছে আর সে খবর ওঁদের প্রত্যেকের কানেও গিয়েছে অবশ্যই। সবকিছু কতটা রিস্কের মধ্যে আছে ভাবতে পারছিস? ব্যাবসায় বিরাট লোকসানে ওরা ফুঁসে উঠেছে যেকোনো মুহুর্তে কিছু একটা করে ফেলবে। হন্য হয়ে খুঁজেছে ওঁরা এ্যাভিডেন্সের লিংক। এখন যখন সোর্স পেয়ে গেছে ওঁরা মোহরকে শেষ করে হলেও সেটা হাতিয়েই ছাড়বে। এত কিছুর মাঝে তুই ভেঙে পড়লে সবটা গুড়িয়ে যাবে মেহরাজ। ধৈর্য ধর, তোর মোহ তোরই থাকবে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক, ওঁকে তোর কাছে ফিরিয়ে দেবো কথা দিলাম। কিন্তু তুই একটু শান্ত হ প্লিজ।তোকে এইভাবে আমি দেখতে পারছিনা ভাই
মেহরাজের কানে কথাটা পৌঁছেও পৌঁছাল না হয়তো। মোহর ছাড়া ওর মস্তিষ্কে কিছু ঢুকছে না, সমস্ত টা বিক্ষিপ্ত, বিক্ষুদ্ধ। চোখের সামনে শুধু মোহ আর তার মোহনীয়তা ছাড়া কিচ্ছু নেই।
•••
মেঝেতে বসে থাকা শরীর টা বাঁকিয়ে ঠেস দিয়ে রেখেছে বিছানায়। মেদহীন পাতলা পিঠময় চুলের গোছা টা বিস্তীর্ণ ভাবে ছড়িয়ে আছে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে শরীর টা। ঘুটঘুটে অন্ধকারের নিস্তব্ধতায় একটু পরপর ফোঁপানির শব্দ হচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে আঁটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ মোহর। ঘৃণা করি বলে যেই মানুষটাকে ছেড়ে এসেছে তারই বিরহে মন প্রাণ শরীর সবটা বিধ্বস্ত। সকাল থেকে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখে খাবার দূর পানিটা অব্দি ছুঁয়ে দেখেনি। মিথিলা কতবার এসেছে কত করে ডেকেছে বিনিময়ে শুধু একটা উত্তর ই পেয়েছে ‘ আমাকে একটু একা থাকতে দে বুবু, দয়া করে আমায় ডাকিস না ’। তাছাড়া আর কিই বা বলতো! অন্তরের মাঝে যে দহনের দাবদাহ ছড়িয়েছে তা ওর সমস্ত সত্তাটাকে পুড়িয়ে ছারখার করছে নৃশংস ভাবে। দুনিয়া ওকে বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে সবাই স্বার্থপর, সবটা মিথ্যে সব ছলচাতুরী। আর কাকে ভরসা করবে ও? আব্বা, আম্মার বিয়োগ, জীবনের এতবড় ঝড় ঝাপটা সামলে যখন একটু একটু করে বাঁচতে শুরু করলো, যাকে নিয়ে বাঁচতে শুরু করলো সেই এত বড় বেইমানি টা করলো! এ নির্মম সত্য কী করে মেনে নেবে মোহর। ফুঁপিয়ে উঠে ভাঙা গলায় কাতরে বলল,
– কেনো করলেন এমনটা? ভালোবেসে ছিলাম আপনাকে, জীবনের সমস্তটুকু সপে দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলাম একবুক ভরসা,আস্থা নিয়ে। তার পরিবর্তে এতবড় ধোঁকা! হায় আল্লাহ্ আমার স্বামী কি না আমারই আব্বার খু’নী, যাকে আমি নিজের রক্ষক হিসেবে মেনে এসেছি সেই কী না শেষ অব্দি ভক্ষক। যে স্বামীর বুকে মাথা পেতে স্বর্গ পেয়েছি সেই স্বামীকে আমি কীভাবে ঘৃণা করবো! এ কোন মোড়ে এনে তুমি রাখলে আমায়! আমাকে মেরে ফেললে না কেনো তুমি আল্লাহ্ , সহ্য করার কোনো ক্ষমতা আমার আর নেই,আর নেই।
হাউমাউ করে কেঁদে ভিজিয়ে ফেললো গাল, বুক। আর কতো কাঁদবে মোহর! ওর জীবনে কী দুঃখের অন্ত কোনো দিন হবে না! প্রাণঘাতী জেহেরের মতো পচিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর। মুখে বললেই কী ছেড়ে দেওয়া যায়! ঘৃণা করা যায়!
– এ আমি কাকে ভালোবাসলাম মাবুদ কাকে ভালোবাসলাম! আমি কেনো মরছিনা, আর কতো কিছু দেখাবে। ওই মানুষটাকে আমি কী করে ছেড়ে থাকবো, কী করে দোষী ভেবে নেবো। কেনো বেঁচে আছি আমি কেনো, সব দুঃখ আমার হয় মরণ কেনো আমার হয়না!
নিজের চুল নিজেই খাম’চে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে গলার স্বর পালটে গেছে। চোখ দু’টো মেলে তাকানোর অবস্থাতে নেই, চোখের পানিও হয়তো ফুরিয়ে যবে তবু দুঃখ ফুরাবে না। নিস্তেজ লাশের মতো পরে রইলো মেঝেতে।
কতটা মুহূর্ত কতগুলো প্রহর পেরিয়েছে হিসেব নেই। ফ্লোরে পড়ে থাকা নিজেকেও অতিষ্ঠ মনে হলো। উঠে দাঁড়িয়ে টলমলে পায়ে এগিয়ে গেলো। তিনতলা বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় ফ্লোরের একদম কর্ণারের ঘরটা।সাথে ছোট্ট একটা বারান্দা, একেবারেই ছোট্ট। মোহর গিয়ে দাঁড়ালো খোলা বারান্দায় রেলিং ধরে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে। থালার মতন রূপালী চাঁদ, মিষ্টি বাতাস সবই তো আছে! তবে ও কেনো আর আগের মতো নেই। এইতো কিছুদিন আগেই, এমনই মিষ্টি বাতাস, রূপালী চাঁদের ছায়ার তলে ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে মেহরাজ বলেছিল “ আপনার এই জীবনটা শুধুই আপনার মোহ, শুধু আপনার জীবনের সমাপ্তিটা আমার। সমস্ত প্রশান্তি শুধুই আপনার, আর যন্ত্রণা গুলো আমার। সুখগুলো শুধুই আপনার, আর দুঃখগুলো আমার।সবকিছুই আপনার মোহ, আর এই আপনিটা শুধুই আমার। আমার অদ্বিতীয়া, আপনার প্রাণসঞ্চারক হয়ে আজীবন নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখতে চাই, আর রাখবো। ”
যে দুঃখগুলোকেও শুষে নিতো চাইলো সেই যখন সবচেয়ে বড় দুঃখ হয়ে দাঁড়ায় তখন আর কে সারাবে! বুকভর্তি চাপা আর্তনাদে ক্লিষ্ট হলো। কিন্তু হুট করেই মনে হলো চেনা একটা আবহ এসে ছুঁয়ে গেলো ওঁকে। দেওয়াল থেকে সরে এসে কেমন অস্থির মুখে রেলিং ধরে নিচের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা প্রবলভাবে কেঁপে উঠলো। হয়তো ভেতরটাও সজোরে চিৎকার করে উঠতে চাইছে। কিন্তু মোহর তা করলো না, এক হাত মুখে চেপে ছুটে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলো, মোহরের যাওয়ার পানে চেয়ে মলিন হাসলো মেহরাজ। চওড়া গাছটায় হেলান দিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
– আমি আপনাকে নিকষ অন্ধকারেও চিনতে পারি, নিগূঢ় স্তব্ধতায় ও শুনতে পারি। নিঃশব্দ মৌনতায় ও পড়তে পারি…আপনার প্রবল ঘৃণাতেও ভালোবাসতে পারি মোহ।
এক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ময়লা জায়গা টাতে। পারেনি থাকতে, মোহর ওকে ছেড়ে এলেও মেহরাজ তো পারেনি। যে বিছানায় কারো শরীরের ঘ্রাণ মিশে আছে তাকে ছাড়া সেখানে পিঠ ঠেকাতে পারেনি।
একহাত মুখে চেপে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়লো মোহর, ফিসফিসানির ন্যায় কান্নারত গলায় বলল,
– চলে যান আপনি,চলে যান এখান থেকে। কক্ষনও দেখতে চাইনা আপনার মুখ। ধ্বংস করেছে আমায়, বিলীন করেছে আপনাকে ভালোবাসার অভিলাষ। সবদিকে,সবভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে আমায়। আর কোনো কিছু থাকতে পারেনা আপনার আর আমার মাঝে। বিশ্বাস, ভরসাকে চুরমার করে দিয়েছেন। আমার আর কোনো আপনি থাকতে পারেন না!
তীব্র যন্ত্রণা মিশ্রিত কথাগুলো মেহরাজের কান অব্দি হয়তো পৌঁছাল না তবে মোহরের ক্ষুদ্ধতা, ক্ষিপ্ততা সবটাই অনুভব করতে পারলো। তবুও দাঁড়িয়ে রইলো, ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো চাতক পাখির মতো চেয়ে। মোহ ওর বুকে নেই তো কি হয়েছে ওর কাছাকাছি তো থাকতে পারছে!
বেহায়া প্রেমিক,স্বামী সত্তাটা অবজ্ঞা, ঘৃণা এড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ঠিক যতক্ষণ দেওয়ালের এপাশে মোহরও দাঁড়িয়ে রইলো ঠিক ততক্ষণ। জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আকাশের বুকে ডুবে যাওয়া আর সূর্যের আকাশের বুক চিরে উদয় হওয়া সবটাই দেখলো। দেখলো একটা করুণ , আকুতিভরা টলটলে চাহনি যা বেহায়ার মতো এদিকেই তাকিয়ে আছে,রইলো সারাটা রাত। যার বেহায়াপনাকে তীব্রভাবে অবজ্ঞা করে সরে আসলেও সরে যেতে পারেনি। ভালোবাসা আর মায়ার টানে দুজনই দাঁড়িয়ে রইলো একে অপরের আড়ালে আবডালে। শুধু বাহ্যিত নিষ্ঠুরতাই মাথাচাড়া দিয়ে দেওয়াল হয়ে ঢেকে রাখলো দুজনের দৃষ্টি।
.
.
.
চলমান
#Humu_❤️