প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)

1
1544

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
লেখায়: তানিয়া তানু

আজ আমার বিয়ে। তবে বিয়ের আয়োজন তেমন জাঁকজমক নেই। খুব সাদামাটা। এই বিয়েতে শুধুমাত্র ঐ বাড়ির আর এর বাড়ির লোকরাই থাকবে। তার সাথে নিলাদের পরিবারও। আপাকে বার বার ফোন করা হয়েছে। কিন্তু ফোন ধরেনি। ভেবেছিলো কোনো প্রয়োজনে ফোন করেছি।

পার্লার থেকে বিউটিশিউয়ান অয়ন আনিয়েছে। ওর মতে বাইরের জাঁকজমক না থাকলেও চলবে। কিন্তু আমার প্রেয়সীকে আমি সাজিয়েই নেবো। আমিও আর দ্বিমত পোষণ করিনি। বিয়ে নিয়ে সবারই একটা ইচ্ছা থাকে। তাই সেজেছি। বর্তমানে সাজুগুজু সব শেষ। উনার অপেক্ষায় কনে সেজে বসে আছি ।

“আপা, নিলা আপা এসেছে।”
বিথীর কথায় ভাবনা জগত থেকে ফিরে দেখলাম নিলা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় আমার বিয়ে নিয়ে তেমন আনন্দ দেখলাম না। নিলা ঘরে আসতেই দেখলাম রামিসাও তার সাথে এসেছে। তবে ওরে নিয়ে আর কোনো রাগভাব নেই। কারণ আমি চাই আকাশ ভাইয়াও সুখী হোক।

“ওহ হো দীপ্তি, সেজে তো তোকে পুরো বান্দর লাগছে।” আমার কাছে এসেই এই কথাটা বললো।

নিলার এমন কথায় অবাক হলাম। পরক্ষণে মজা করেছে বলে মলিন হাসি দিলাম।

“আচ্ছা, তোর মনে হয় না,বাদরের গলায় মানে তোর গলায় মুক্তোর মালা পড়েছে।”

নিলার অপমানজনক কথা শুনে চোখে জল চলে এলো। ছলছল চোখে না বুঝার ভান করে ওর দিকে তাকালাম।

“তুই না কোনোদিন সুখী হবি না। দেখিস, এটা আমার অভিশাপ রইলো।”
ওর এমন কথা শুনে বললা,
“কী হয়েছে নিলু? অভিশাপ দিচ্ছিস কেন?”

“চুপ কর দীপ্তি। আমকে নিলু বলে ডাকবি না। অবশ্যই তোর মুখ থেকে আমি একটা কথাও শুনতে চাই না।বিকজ আই হেইট ইউ দীপ্তি। আই হেইট ইউ। শুধু তোর জন্য আজ ভাইয়া আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আই হেইট ইউ। আর হ্যাঁ, আমাদের বন্ধুত্ব আজ থেকে এখানেই শেষ। আর এটাই তোর কাছে আসার শেষ দিন।” এতটুকু বলেই কাঁদতে কাঁদতে নিলা চলে গেল।

এদিকে ওর কথা শুনে বুক ধক করে উঠলো। আকাশ ভাইয়ার কী হয়েছে? আমাকে এমনভাবে তিরস্কার করারই বা কারণ কী? আমি কী করেছি?

নিলা চলে যাবার পর রামিসা আমার পাশে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “খুব সুন্দর লাগছে। আমিও এমন সাজে সাজবো কয়েকদিন পর। এমাসে আমারও বিয়ে। এসো কিন্তু। যাইহোক, দীপ্তি তুমি কি জানো, মেয়েদের ছয়টা ইন্দ্রিয় থাকে। তারা এটা দিয়ে অনেক কিছু বুঝতে পারে। কিন্তু তুমি বুঝলে না।”

“কী বুঝিনি?”

“একটা ছেলে সেই ছোটবেলা থেকে তোমাকে এত ভালোবাসে। অথচ বলে নাই বলেই আজ তার ভালোবাসার মানুষ অন্য কারোর হতে চলেছে। জানো,আকাশ অনেক কষ্টে আন্টিকে রাজি করিয়েছে। শেষে একমাত্র ছেলে বলে তোমাকে বাড়ির বৌ বানাতেও রাজি হয়েছিলো। এতে কী খুশিটাই না আকাশ হয়েছিলো! কিন্তু আজ কী থেকে কী হয়ে গেল! ভালোবাসা পেলো না বলেই মা, বাবা আর বোনকে ছেড়ে বিদেশ চলে গেছে।”

ওর এই কথা শুনে জলে পূর্ণ হলো আমার চোখ। তার মানে এতদিন আকাশ ভাইয়া আমাকে ভালোবাসতেন।

“আসি। সুখী হও। আর।হ্যাঁ, আমার বিয়েতে এসে কিন্তু। জানো আমার আর আমার বয়ফ্রেন্ডকে এক করতে আকাশ অনেক কিছু করেছে। আজ সেই বন্ধুই আমার বিয়েতে থাকতে পারবে না।”
এই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ থেকে বললো, “এই নাও আকাশ তোমাকে এটা দিয়েছে। এই বলেই একটা গিফট দিয়ে মলিন মুখ নিয়ে চলে গেল।

গিফট বক্স খুলে দেখলাম নীল চুরি। সেবার ক্লাস সেভেনে থাকতে এক মেলায় ভাইয়া আমার জন্য এই চুরি কিনেছিলেন। আমি কত করে বললাম এইটা এখন দাও। কিন্তু ভাইয়া বলতো, সময় হলেই দেবো। আজ বোধয় তার সময় হলো। আকাশ ভাইয়া এতই যখন ভালোবাসতে তখন বললে না কেন? তাহলে তো আজ,,,,
নাহ আকাশ ভাইয়ার কথা আমি ভাববো না। সে যেহেতু বলেই নাই। তাহলে তার কথা ভেবে কী লাভ? আমার মনে তো একখন শুধু উনিই আছেন। উনাকে রেখে অন্য কাউকে নিয়ে ভাবা ঠিক না।

কবুল বলার সময় গলা আটকে যাচ্ছে। কোনো কথাই বের হচ্ছে না। না জানি কিসের জন্য! আজ আমার ভিতর আর বাহিরের মালিকের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়ার জন্যই বহুক্ষণ পর কবুল বললাম।

এক গাড়িতে আমি আর উনি। অন্য গাড়িতে উনার আত্মীয়। আর আরেক গাড়িতে আমার পরিবার। এই বাড়ির সব স্মৃতি তালা মেরে বন্ধ করে দিয়ে এলাম। গাড়ি চলছে উনার বাড়ির দিকে। কিন্তু মনে হচ্ছে বেবলি আমাকে ডাকছে। আমার গাড়ি ধরার জন্য দৌড় দিতে দিতে বলছে, আপা যাস না। তোদের ছাড়া বাবা আর আমি থাকবো কীভাবে? এই আপা, আপা,,
ডাক দেওয়ায় পিছনে থাকালাম। সেখানে উড়ন্ত ধুলাবালি ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমি মাথা বের করে সেই বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। যতক্ষণ না আড়াল হয়।

আচমকা কারোর শীতল হাতের স্পর্শ পেলাম। ঘুরে উনাকে দেখে ঝাপিয়ে পড়লাম উনার বুকে।কেঁদে কেঁদে উনার বুক ভাসিয়ে দিচ্ছি। উনি হাত বুলিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

রাত্রে আবারও নতুন করে দিবিয়া সাজিয়ে দিলো। ওর বিয়ে এ মাসেই ঠিক হয়েছে। পরের মাসে চলে যাবে। এখন এই সাজানো রুমে বসে আছি। বেলীফুলের সুবাসে পূর্ণ হলো ঘর। মনের মধ্যে আনন্দের জোয়ার। একটা মনের মানুষ পেলাম। পেলাম একটা সংসার। পেলাম প্রয়োজন ভাগ করার মানুষ।

স্নিগ্ধময় সকালে পর্দায় ভেদ করার খানিক সূর্যের আলোয় ঘুম ভাঙলো। কিন্তু মহাশয় এখনো ঘুমে বিভোর। পর্দা আর জানালা খুলে দিলে সূর্যের পূর্ণ আলো উনার চোখে মুখে এসে পড়ছে। উনি হাত দিয়ে মুখ ডেকে বললেন,
“কী হলো? এমন করছো কেন? ঘুমোতে দাও না। কাল তো ভীষণ জ্বালিয়েছো।”
উনার এই কথা শুনে কোমরে হাত দিয়ে রাগি চোখে তাকিয়ে বললাম, কাল আমি না আপনি আমাকে জ্বালিয়েছেন।”
“তাই নাকি। তাহলে এখন দেখা যাক কে জ্বালায়? যে এখন জ্বালাবে সে রাত্রেও জ্বালিয়েছে মনে হবে।”
এই বলেই কাছে আসলে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে চলে আসলাম বাইরে। ড্রয়িংরুমে নিয়ন আর বোনেরা খেলছে। দিবিয়া ফেসবুকিং। মা আর ফুপি রান্না ঘরে ব্যস্ত। এদের এমন দেখে মনে প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। আনন্দে শিহরিত হলো মন। তবে মনের কোণায় স্মৃতি আর বাবার জায়গাটা এখনো অপূর্ণ রয়ে গেল।
এমন সুখময় দিনে আপার কথাও বেশ মনে পড়লো। কত ফোন করলাম! কিন্তু একটাও রিসিভ করেনি। তাই এবার ভাবলাম চিঠি লিখে নেই। কুরিয়ারে দিয়ে দিলে গিফট হিসেবে আনন্দে গ্রহন করবে। কোনো প্রকার বাঁধা দিবে না। চিঠির খামে শুভাকাঙ্ক্ষী লিখে দিবে। ভিতরে নিজের কথা। যেই ভাবা সেই কাজ। উনি বাথরুমে যাওয়ার সুযোগে খাতা কলম নিয়ে বসে গেলাম।

প্রিয় আপা

ফোন তো ধরলি না তাই চিঠি লিখতে বাধ্য হলাম। সে যাইহোক, আশা করি দুলাভাই আর সংসার নিয়ে খুব ভালোভাবে জীবনযাপন করছিস। সুখেই আছিস। আমিও সুখে আছি। জানিস আপা, তুই চলে যাবার পরপরই না আমার জীবন বদলে গেছে। বিষাদময় দিনের কালো আঁধারে ঢাকা মেঘ সরে এক চিলতে রোদ হিসেবে এসেছে অয়ন। তবে ও বহু পূর্বে মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছিলো। সময় বুঝে ঠিক বৃষ্টির নামার খানিক পর রোদ্দুরে বৃষ্টি হয়ে এসেছে। এমন বৃষ্টিমুখর দিনে রোদের আলো দিয়ে সব প্রয়োজন মিটিয়ে দিয়েছে। তুই তো পূর্বে থেকেই জানিস, মায়ের শখ ছেলেদের মুখে মা ডাক শুনা। তাই পাঁচ মেয়ের জামাইকে নিজের সন্তান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলো। কিন্তু তোর জামাই অর্থাৎ স্বার্থপর দুলাভাই নিজের প্রয়োজনে আমাদের প্রিয়জন হয়েছে। তাই তো এমন দুঃসহ সময়ে কেটে পড়েছে। কিন্তু অয়ন ঐ যে পুলিশ ছেলেটা ও মায়ের বোনদের এমনকি আমার প্রয়োজনও মিটিয়েছে। কিছুটা অর্থ দিয়ে তবে বেশিরভাগ অংশই ভালোবাসা দিয়ে। যেটা তুই আর দুলাভাই করতে পারিস নাই। সে সময় অর্থের বেশ প্রয়োজন ছিলো না রে। প্রিয়জনের প্রয়োজন ছিলো। ছিলো এক টুকরো সান্ত্বনার। আপা জানিস, মানুষের প্রয়োজন কখনো শেষ হয় না। প্রয়োজন আসে। বার বার আসে। তবে ভিন্ন রূপে। আমারও আসবে। সে যাইহোক,তোকে একটা কথা জানাচ্ছি, কাল আমার বিয়ে উনার সাথে হয়ে গেছে। মা,বিথী ও দ্যুতি বর্তমানে উনার বাড়িতেই আছে। ঐ বাড়ি বন্ধ। তবে চিরতরে নয়। কিছুদিনের জন্য। কারণ যখনই স্মৃতির আর বাবার কথা মনে পড়বে তখনই ঐ বাড়িতে যাবো। শুন, পারলে একবার দেখা করে যাস।

চিঠিটা এখানেই সমাপ্ত করছি। কারণ তোর সাথে বেশিক্ষণ কথা বলে লিখতে ইচ্ছে করছে না। তুই যে বড্ড স্বার্থপর আপা। ভালো লাগে না তোকে। জানি না কেন এমন করছিস। এত ফোন করলাম তাও ধরলি না। হয়তো এর আড়ালে তোর জীবনের অনেক কাহিনী লুকিয়ে আছে। যেটা বলবো বোন হিসেবে একদিন আমার কাছে ভাগ করিস। সান্ত্বনা না হয় এক আকাশ ভালোবাসা দিবো।
ভালো থাকিস। সুখে থাকিস।

ইতি তোর
অপ্রয়োজনীয় বোন

চিঠিটা লিখেই বালিশের তলায় রেখে জানালার কাছে গেলাম। এখান থেকে শহরের ব্যস্ততাময় মানুষের কাজ কর্ম খানিক দেখা যায়। যেগুলো খোলামেলা কাজ। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি আমার বাবাকে খুঁজছি। এই শহরের তিনি গাড়ি চালাতেন। এই বাড়ির অন্যদিক অনেক নিরিবিলি। সেদিকে গাড়ি চলাচল নেই। এটা সদর দরজার পাশে।

আচমকা কারোর শীতল হাতে স্পর্শ পেলাম। পিছন থেকে কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। গাঢ় নিশ্বাস পেলে কাঁধে মুখ গুজেছে। তবে এটা অয়ন সেটা বুঝতে বাকি নেই। এই ছেলেটার স্পর্শ চেনা আমার।

আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উনি বললেন, দীপ্তি,আমার কিন্তু ছোট্ট দীপ্তির প্রয়োজন!

_____সমাপ্ত_____

বিঃদ্রঃ অবশেষে ত্রিশ পর্বে সমাপ্ত হলো আমার প্রয়োজন উপন্যাস। সামাজিক উপন্যাস হিসেবেই লিখেছি। জানি না কতটুকু সামাজিক হয়েছে। তাই বলবে শেষে পুরো গল্প নিয়ে আপনার কিছু মন্তব্যে দিয়ে পরের গল্প লেখার অনুপ্রেরণা দিবেন। আর হ্যাঁ, ভুল তো আমার আছে। অনেক হয়েছেও। তাই বলবো সমালোচনা দিক দিয়ে যা মনে হয়েছে তা নির্দ্বিধায় বলে দিবেন। শুধু বানান ছাড়া। কারণ অভ্র টাইপে তাড়াতাড়ি দুই পর্ব করে লিখতে গিয়ে অনেক ভুল হয়েছে। অনেক আপু তা বলে দিয়েছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা। বানান ছাড়া অন্য কোনো ভুল হলে তা অবশ্যই বলবেন।

বিঃদ্র ০২ঃ এই গ্রুপ থেকে অনেক ভালো পাঠক পেয়েছি। মূলত পাঠক হিসেবে ধরবো না। তাদের নিজের আত্মার আত্মীয় হিসেবেই ধরবো। তাদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা,কৃতজ্ঞতা অবশেষে ভালোবাসা দিয়েই সমাপ্ত করলাম।

1 মন্তব্য

  1. আসলে কি বলবো আমি বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি ,,,, অবশেষে চোখে পানি চলে আসলো। আসলে গল্পের সাথেই জীবনে কঠিন কিছু বাস্তবতা মিলে যায়। আমরা অনেকেই অভাবী , কেউ ভালোবাসার ,কেউ টাকার ,কেউ প্রয়োজনের ,কিংবা প্রিয়জনের। আমাদের সমাজ এখন এমন হয়ে গেছে,,, শুধু প্রয়োজন হলেই প্রয়োজন। ধন্যবাদ এতো সুন্দর একটি গল্প দেয়ার জন্য। ভালোবাসা রইলো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে