প্রয়োজন পর্ব: ২৬

0
920

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২৬
লেখায়: তানিয়া তানু

“দীপ্তি, তুমি এখানে?”পাশে দাঁড়ানো পরিচিত মানুষকে দেখে অবাক হলাম।কিন্তু উনার ইউনিফর্ম দেখে অবাকের শীর্ষে থেকে ফিরে এসে ম্লান মুখে বললাম, “আপনাকে বলতে হবে নাকি?” উনি আমার কথার বলার ভঙ্গি দেখেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন আমি যে রাগ করেছি।
“দীপ্তি, রেগে যাচ্ছো কেন? আমি তো তেমন রেগে যাওয়ার মতো প্রশ্ন করিনি।”

“আপনি রাগের প্রশ্ন না করলেও আপনার জন্যই আজ আমার এমন অবস্থা হয়েছে। তাই দয়া করে আমায় বিরক্ত করবেন না। দয়া করে এখান থেকে যান।”

“আমার জন্য এমন অবস্থা হয়েছে মানে? আর তুমিই বা এইখানে কী করছো? প্লিজ দীপ্তি সব বলো আমায়। কী হয়েছে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে ক্রোধের সহিত বললাম,”কী বলবো আপনাকে? এই যে কাল আমি বাড়িতে না যাওয়ার ফলে বাবা টেনশনে স্টক করে মারা গেছেন। ছোট বোন গতকাল থেকে নিখোঁজ। এখানে এসেছি জিডি করতে। আর কিছু জানবেন? বলুন এবার কী আপনাকে বলতে হবে পাড়া-পড়শীর কাছ থেকে কত কথা শুনেছি? বলতে হবে কী বড় বোনের কাছ থেকে চড় খেয়েছি? নাকি এইটা বলতে হবে আমি কী পরিমাণ কেঁদে চোখের পানি বের করেছি? বলুন কী কী জানতে চান আপনি?”

“দীপ্তি, সেদিন আমি নিজে ডেকে অসুখ আনিনি। আর তোমাকেও থাকতে বলেনি। আমি নিজেও জানতাম না এই দিনেই তোমার এমন খারাপ পরিস্থিতে ডেকে আনবে। আমি জানি এখন তোমার খারাপ অবস্থা। মন মেজাজ কোনোটাই ভালো না। হয়তো সব দোষ আমারই। তাই তুমি দোষারোপ করতে দ্বিধা করোনি। যেহেতু আমি দোষী। তাই বলবো যা ইচ্ছে তা শাস্তি দিতে পারো।”

উনার কথা শুনে মন আরো খারাপ হয়্র গেল। তাই বললাম, প্রথমত আপনি নিজে ডেকেই অসুখ এনেছেন। কী দরকার ছিলো এই নতুন বর্ষায় ভিজা? দ্বিতীয়ত, আমাকে থাকতে না বললেও চলে গেলে স্বার্থপর বলতেন। কিন্তু আমি স্বার্থপর নই। তাই ভেবেছিলাম খানিক আপনার পাশে থাকি। ওরা আসলেই চলে যাবো। হ্যাঁ, ওরা আসার পরই আমি চলে এসেছি। তবে সেটা রাতে নয় সকালে। তৃতীয়ত, দয়া করে আপনি আমার সামনে থেকে যান। সহ্য করতে পারছি না আপনাকে।”

“চলে যাচ্ছি, যাওয়ার আগে বলছি জিডি করতে এসো। আর আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”এই বলেই মলিন মুখে থানার ভেতর ঢুকে গেলেন। এতে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। তবে কষ্ট হচ্ছে। ত্রিমুখী কষ্ট। প্রত্যেক দিক দিয়ে তীর আমার শরীরে ঢুকছে। ব্যথায় জর্জরিত করছে। কিন্তু জোরে কাঁদতে পারছি না। এই কান্নায় ব্যথা দূর হয়। কিন্তু চাপা কান্নায় কষ্ট দ্বিগুন হয়।

দুলাভাই যে গেল তার আসার তো কোনো চিহ্ন দেখি না। জানাযা কী এখনো শেষ হয়নি। বাবাকে কী ঐ অন্ধকার কুঠিরের মধ্যে রাখা হয়নি। যেখানে বসত করে হাজারও ভিন্ন রকমের পোকামাকড়। আচ্ছা বাবা বলতেন তো আমরা হচ্ছি তাঁর জান্নাত। তিনি কী জান্নাত পাবেন? আল্লাহই ভালো করে জানেন।

“এক্সকিউজ মি।”
এতক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়ে সামনের ফুকের বাগান দেখতে দেখতে ভাবনা জগতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আচমকা এমন ইংলিশ টাইপের কথা শুনে পিছনে ঘুরে জিডি লেখার অফিসারকে দেখে বিস্ময়ের রাজ্যের কিছুক্ষণের জন্য চলে গেলাম। বাকরুদ্ধ আমি! যে লোক আমাদের থেকে তাড়া দিয়ে পালিয়েছিলো সে এখন আমার সামনে। অদ্ভুত!

“ম্যাম,প্লিজ জিডি লিখাতে আসুন। জিডি লেখার পরপরই একদল পুলিশ আপনার বোনের খোঁজে বের হয়ে যাবে।”

এই লোকের সম্মানজনক কথা শুনে আবারও ইচ্ছে হলো অবাক মেঘের বাড়িতে যাই। কিন্তু না যেয়ে ভ্রুযুগল কিঞ্চিত সংকোচ করে বললাম,
“আপনি হঠাৎ এমন সম্মান দিচ্ছেন কেন? আর আমার কাছে এখনও টাকা আসেনি। তাই জিডি এখন লিখিবো না। দুলাভাই আসুক তারপর লিখবো।”

“টাকা লাগবে না ম্যাম। আর আপনি হচ্ছেন আমাদের স্যারের হবু ওয়াই,,,,”

“এই দাঁড়ান। আমি যে আপনার স্যারের হবু ওয়াইফ তা কে বললো?”

“আমাদের স্যারই তো বললেন।”

অফিসারের কথায় বুঝলাম উনি আমার কথা বলে দিয়েছেন। তাই তো আমাকে এখন স্বজনপ্রীতি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আমি এই স্বজনপ্রীতি একদমই পছন্দ করি না। তাই অফিসারকে চলে যেতে বলি। কিন্তু সে অনেকবার বলায় তাকে ধমক দিয়ে দেই। অপমানে সারামুখ লাল হলেও পরক্ষণে বেহায়ার মতো এবার আমার হাত ধরে টানাটানি করে। ওর এই অসভ্যতা দেখে সহ্য করতে না পেরে গালের মধ্যে চড় বসিয়ে দেই। এই চড়টা তেমন বড় না হলেও আশপাশের পুলিশ এইটাকে বড় করে উনার কানে নিয়ে তুললো। উনি এসে মুখ গোমরা করে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, কী দীপ্তি, তুমি ও কে চড় মারলে কেন? লোকটার কী দোষ ছিলো? তার দোষ সে তোমাকে জিডি লিখাতে বলছে। এইটাই তো?

উনার কথা শুনে যারপরনাই অবাক হলাম। উনি কিছু না দেখেই এই পুলিশের পক্ষ নিলেন। উনার এমন আচরণে অভীমান জমলো। কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। কিন্তু তাও বললাম,
“উনি আমার হাত ধরে টানাটানি করছিলেন। জিডি লিখার জন্য। কিন্তু আমার কাছে টাকা ছিলো না বলে যাইনি। কিন্তু সে টাকা না লাগলে বুঝলাম এখানে স্বজনপ্রীতি দেখানো হবে। তাই গেলাম না। জোরাজুরি করায় চড় মারলাম।”

“টাকা!”
অবাক হয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা বললাম, “হ্যাঁ,টাকা। এক হাজার টাকা। যা বর্তমানে আমার কাছে নেই।”

“থাপ্পড় না ঐ অফিসারকে না তোমাকে দিতে ইচ্ছে করছে। বেকুব মেয়ে! জিডি লিখাতে আবার টাকা লাগে নাকি। ঐ পুলিশ তোমার কাছ থেকে টাকা আদায় করার চেষ্টা করছিলো।”

উনার এমনতর কথা শুনে অফিসারের দিকে তাকালাম। সে তো মাথা নিচু করে আছে।

“এই যে আপনার কাল থেকে থানায় আসার দরকার নেই।”

“স্যার, আমি আর কোনোদিন এমন কাজ করবো না। এবারের মতো মাফ করে দিন।”

উনার চাকরি খাবে দেখে হাত জোর করে এমন কথা বললো। উনিও ইশারায় উনাকে এখান থেকে চলে যেত বললো। বাধ্য অফিসার হয়ে তিনি অন্যত্র চলে গেলেন।

“কেউ তার জিডি লিখে দাও।”
“জিডি লেখার অফিসাররা তো নেই।
“টোমরাও চাকরি হারাতে চাও নাকি। জিডি লিখাতে পুলিশের ভাগ কাগে বুঝি।”
সবাই থম মেরে রইলো উনার কথা শুনে। উনি পরক্ষণে সবার সামনে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ভিতরে। তারপর বেবলির সমন্ধে অনেক প্রশ্ন করলে তা ম্লান মুখে উত্তর দিয়ে দেই। শেষমেষ ছবি চাইলে তাও দেই।কিন্তু এবার তিনি অবাক হয়ে বললেন,
“এই মেয়েটা তোমার বোন!নিলার বিয়েতে ওর সাথে আমার খানিক কথা হয়েছে। খুব সহজ-সরল টাইপের মেয়েটা! “আমিও হ্যাঁ বলে মাথা নাড়িতে নেই। পরক্ষণে কনস্টেবল দিয়ে তাড়াতাড়ি বলেন গাড়ি বের করতে। আমি উনার এমন কান্ডে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
আচমকা উনি হ্যাচকা টানে বাইরে নিয়ে গেলেন। সেখানে এক কারে আমাকে বসালেন। তারপর হলো শুরু গাড়ি চলা। পিছনে আবার জিপ গাড়িতে পুলিশের বাহার। তারাও আমাদের পিছনে আসছে।

অভীমান করায় কোনো কথাই বলছি না। চেয়ে চেয়ে শুধু রাস্তাঘাটের অবস্থায় মন দিচ্ছি। বেবলির কথা মনে পড়তেই কান্নাটা দলা পাকিয়ে আসছে। বেবলির বাচ্চা বাচ্চা কথা মনে পড়লো কান্নার মাঝে হেসে দিচ্ছি।
“দীপ্তি”
উনার ডাকে উনার দিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে তাকালাম।

“দেখো, স্মৃতি কিন্তু অনেক অবুঝ। ওর সাথে অনেক খারাপ কিছুই হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। এটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তবে বলবো ও নিজ থেকে নিখোঁজ হয়নি। ও কোনো বাজে অবস্থায় আছে বোধয়। তাই বলবো তোমার কাউকে সন্দেহে হয়।

সন্দেহ মনে হতেই নুরু দোকানির কথা মনে পড়লো। উনাকে নুরু দোকানির প্রেমপত্রের কথা বললে উনি বলেন, ঐ ত্রিশ-বত্রিশ বছরের ছেলে কী করে এই পিচ্চিকে প্রেমপত্র দিতে পারে। বিবেক আজ এমনভাবে লোপ পাচ্ছে কেন?

উনার প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বললাম না। আবারও গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে স্মৃতির দেশে চলে গেলাম। যেখানে ছোট থেকে আছে শুধু স্মৃতির স্মৃতিময় জীবন।

গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। আমাদের নামার সাথে সাথে পড়শীরা ভীড় জমালো। একদল পুলিশ উনার ইশারায় কোথায় চলে গেল। ওরা চলে যাবার পর উনি বাড়িতে না ঢুকে দোকানির কাছে গেলেন। দোকানি আরাম আয়েশে চা-পান বানিয়ে দিচ্ছে খদ্দেরদের।

আচমকা দোনাকির কলার টেনে বাইরে এনে দাঁড় করালেন। দোকানি উনার এমিন আচরণে হচকিয়ে গেল। সে ভীত মুখে বললো, “কী ভাই, ইতা কেরে করতাছুইন। আপনে তো আমার ডেইলি কাশটমার। চা দিতামনি। খাইবাইননি।”

উনি কোনো ভণিতা করে সোজাসুজি বললেন,”স্মৃতি কোথায় বল?”
“ইশরিতি কই আমি কেমতে জানমু। জানলে তো আর আন্নেরে আওন লাগলো না নে। আমিও খালারে কইলাম নে।”

হঠাৎ জোরে এক থাপ্পড় দিলেন। থাপ্পড়ের চোটে দোকানি মাটিতে পড়ে গেল। আবারো তিনি থাপ্পড় মেরে বললেন, “তুই না জানলে কে জানবে? প্রেমপত্র তো তুই দিছিলি।”
“হ স্যার।।পেরেমপতরো মুই দিছিলাম। কিন্তু হেইডা তো ইলারে আমি ভালা পাইয়া দিছলাম।ইশরিতিরে আমি আইজো ভালা পাই স্যার। ওরে আমি পাইলে করুম।ঈর লাইগা মোর কইলজা খান জ্বলতাছে।”

আবারও আরেকটা থাপ্পড় দিয়ে বললেন, “এই পিচ্চি অবুঝ মেয়েকে তোর বিয়ে করা শখ অইছে না। দাঁড়া তর শখ মিটাচ্ছি। ঐ ওরে রিমান্ডে নিয়া পিটাইয়া সত্য কথা বের করো।” এই কথা বলার পরপরই দুজন পুলিশ অফিসার দোকানিকে নিয়া গেল। দোকানি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।

চলবে„„„„„

(স্মৃতিকে কেউ গুম করেছে বা অন্যকিছু। কিন্তু কেউ তো করেছে। কারণ না করলে তো ওর আর নিখোঁজ হয় না। তাহলে বলুন ঠিক কে স্মৃতিকে নিখোঁজ করে দিয়েছে।আন্দাজ করুন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে