প্রয়োজন পর্ব: ২২

0
887

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২২
লেখায়: তানিয়া তানু

“ভাই, ওরা বলতে তুমি কাদের বুঝিয়েছো?”
নিয়ন মাথা তোলে বললো,
“আমাদের ড্রাইভার স্বপন ভাই, তিনজন দারোয়ান ভাই, আর বয়স্ক মকবুল চাচা,আর ফুপি ও ফুপির মেয়ে আপু।”
নিয়নের কথা শুনে অবাক হলাম। তাহলে এই মুহূর্তে এই বাসায় কেউ নেই। এই দুই ভাই ছাড়া। উনি তো অসুস্থ। নিয়ন তাহলে একলা। এই কারণেই নিয়ন ভয় পেয়ে আছে। কিন্তু ওরা সবাই এক সাথে কোথায় গেল? এই প্রশ্ন নিয়কে করলে।উত্তরে সে বললো,
“শান্তা আন্টির স্বামী আজ দুপুরে মারা গেছে। বিকেলে জানাযা হবে। কিন্তু আন্টির তেমন আত্মীয় নেই। আমরা ছাড়া। কিন্তু ভাইয়া অসুস্থ তাই ওরা সবাই গেল।”
“ইন্নালিল্লাহ,,।আচ্ছা ওনার কোনো সন্তান নেই?”
“ছিলো। দুই মেয়ে ছিলো। এক মেয়ে মারা গেছে। আর অন্য মেয়ে স্বামীর বাড়িতে আছে। কেন জানি ওনাকে তারা দেখাশোনা করছে না!”
মহিলার পোড়া কপাল! নয়তো এভাবে সব আপনজনদের খোয়াতে হয়। মেয়ে বোধয় মা-বাবাকে বোঝা মনে করেছে। তাই তাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
” ওনার স্বামীকে জানাযা কোথায় করা হচ্ছে।আর ওরা আসতেই বা কতক্ষণ সময় লাগবে?”

“ওনাদের গ্রামে। আসতে কতক্ষণ সময় লাগবে তা জানি না।”
“আর তোমার ফুপি ও তার মেয়ে কখন আসবে?”
“উনাদের তো আজ আসার কথা ছিলো। কিন্তু আসবেন না মনে হয়।”
“অহ। উনাদের তো পূর্বে কখনো দেখিনি তাই না?”
“হ্যাঁ আপু, আমি নিজেও পাঁচবছর আগে দেখেছিলাম।”
” পাচঁ বছর আগে। আচ্ছা উনারা মনে হয় তোমার ভাইয়ার অসুস্থ বলেই আসছেন?”
“হ্যাঁ, আপু পাচঁ বছর আগে। কারণ উনারা বিদেশে থাকেন। পাঁচ বছর আগে একবার এসেছিলেন। উনারা ভাইয়ার অসুস্থের জন্য নয় বিয়ের জন্য আসছেন। আর ভাইয়া তো জানেই না। শুধু আমি জানি। দিবিয়া আপু তো সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আসছেন।সেই জন্য ভাইয়াকে বলতে না করেছেন।” বিয়ের জন্য শুনে মনটা কেমন খঁচ করে উঠলো। তবে সেটাকে এখন পাত্তা দিচ্ছি না।
“উনারা কোন দেশে ছিলেন?”
“ফ্রান্সে। সেখানে ফুফার ব্যবসা।”

আযান পড়ে গেল। আমি আর নিয়ন বিছানায় বসে আছি। এদিকে বৃষ্টি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। তার সাথে ঝড়ও ভীষণ গতিতে হচ্ছে। বাবাকে ফোন করেছিলাম কিন্তু নেট নেই বলেই কথা বলতে পারলাম না। বাবাকে জানানো হলো না, আজ যে আমার দেরী হবে। মা বোধয় খুব চিন্তা করছেন। জানালাদিয়ে বৃষ্টি তেড়ে আসছে। তাই জানালা লাগিয়ে দিলাম। এদিকে পরিবেশও অন্ধাকরে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে।জানালা লাগানোর ফলে এখন পুরো রুমে নিবিড় অন্ধকার বিরাজ করছে। কারণ এইমাত্র লোডশেডিং হলো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এত বড় বাড়িতে আইপিএস এর সিস্টেম নেই! তাই নিয়নকে জিজ্ঞেস করলাম,

“ভাই রুম তো মিশমিশে কালো হিয়ে গেল। আমারও খুব ভয় করছে। কোনো টর্চ বা মোমবাতি হবে?”

“টর্চ কোথায় সেটা জানি না। মোমবাতিও নেই। তবে ভাইয়ার রুমে আইপিএস পাওয়ার সিস্টেম আছে। ওখানে আলোও আছে।”
“এই রুমে তো তুমি থাকো। তাহলে এই রুমে আলো নেই কেন?”
অদ্ভুত লাগছিলো নিয়নের কথা। তাই এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে ও বললো,
“এই রুমে তো প্রয়োজন নেই। কারণ আমি ভাইয়ার রুমে থাকি। আর এটা পরিষ্কার করা হয়েছে তাই এখনো লাগানো হয়নি।।ভাইয়ার মনোযোগ এটাতে মনে হয় ছিলো না।”
“কয়েকদিন আগে পরিষ্কার করা হয়েছে কেন?”
“বারে, আপনি পড়াতে আসার কারণেই। অন্য টিচার্সরা ভাইয়ার রুমেই পড়াতো। কিন্তু আপনি পড়াবেন বলেই আলাদা রুম পরিষ্কার করা হলো।”

নিয়নের কথায় আমি যারপরনাই অবাক।কিন্তু আমাকে আলাদা রুমে দিলেন কেন?

দুজনই গুটি গুটি পায়ে উনার রুমে হাজির হলাম। নকশীকাঁথা শরীরে জড়ানো। মুখ হাত দিয়ে ঢাকা। সম্ভবত জানালা দিয়ে তেড়ে আসা প্রবল বৃষ্টির বেগ উনার চোখে মুখে পড়ছিলো। কিন্তু অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠতে পারছেন না। তাই বড় হাঁটা দিয়ে জানালা লাগিয়ে পর্দাটা মেলে দিলাম। যাতে সামান্যতম বৃষ্টিও উনাকে ছুঁতে না পারে।

“ভালো করেছিস। এতক্ষণ বৃষ্টির ফোঁটা এসে ধুয়ে দিচ্ছিলো।”কাঁপা কাঁপা গলায় আস্তে আস্তে কথাগুলো বললেন। নিয়নকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিলেন।

হাত দিয়ে মুখের পানিগুলো মুছতে শুরু করলেন। আশেপাশে সুতি কাপড় না পেয়ে কাভার্ড খুলে সেখান থেকে সুতি কাপড় এনে উনার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছি। চেহারায় মায়াভাব এখন প্রচুর ফুঁটে উঠেছে। জ্বরে চেজেরা শুকিয়ে গেছে। এক চেহারায় বুঝা যায় না উনার আসল রাগী চেহারা। উফ কত রাগ উনার!

“তুই আবার এত কেয়ারফুল হলি কী করে? শুধু তো দাঁড়িয়ে থাকতেই পারিস?কোনো কিছু বললেও করিস না। কিছু বললেই বলিস, তোমার শরীর কী গরম! আমার ভয় করে। এখন করছে না?”

উনার কথা শুনে অবাক হলাম। কারণ উনার কথা পুরোপুরি মিলে গেল।
নিয়ন এখনও দরজায়ন ঠায় হয়ে দাঁড়িয় আছে। কাছে আসছে না। কিছু বলছেও না।

“কীরে, কথা বলছিস না কেন?আচ্ছা তোর টিউটর আপা কী চলে গেছে। ও কে আমার অসুখের কথা বলেছিস?”

“বলেছি।” দরজার কাছ থেকে আমার পাশে এসে বসতে বসতে ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিলো।
“কেন বললি? দেখলি তো আমি অসুস্থ জেনেও একটু দেখতে এলো না। বড্ড স্বার্থপর মেয়েটা!”

“ওহ আমি স্বার্থপর না! তাহলে আপনি কী!আপনি তো একটা ছাগল, সারাক্ষণ ম্যা ম্যা করেন।” এতক্ষণ ধরে দিনরাত্রী ভুলে এখানে বসে আছি। আর উনি কীনা স্বার্থপর উপাধি দিচ্ছেন। তাই রাগেই কথাটা বললাম।

“তুমি!”
বেশ অবাক হয়ে গেলেন আমার কন্ঠস্বর শুনে। চোখ পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু আলোর কারণে তাকাতে পারলেন না।

“তুমি এখনো যাওনি। আর এতক্ষণ ধরে তুমি আমার মুখের পানি মুছে দিচ্ছিলে। তোমার সাহস হয় কী করে?” আবারো রাগ দেখিয়ে আমার হাত থেকে কাপড় নিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে কথাগুলো বললেন।

“আমার পাশ থেকে সরে বস। তুই আমার সামনে এসেছিস কেন? আমাকে এমনভাবে যত্ন নিচ্ছিস মনে হচ্ছে আমি তর স্বামী। এগুলো গিয়ে অন্য ছেলের সাথে কর। আমার সামনে না। যাহ্ ভাগ এখান থেকে?” এতগুলো কথা বলেই কাঁথা দিয়ে মুখ ডেকে ফেললেন।

পুরোনে কথা মনে হওয়ার কারণেই মনে হয় এই ভাষায় কথাগুলো বললেন। এদিকে এতগুলো অপমানজনক কথা শুনে আমার চোখ টলমল করলো। কান্না যেন দলা পাকিয়ে আসছে। বুকের মধ্যেও চাপা কষ্ট অনুভব হচ্ছে। এ যেন বসন্তের ফুল ফুঁটার পূর্বে ঝড়ো হাওয়ায় ঝরে গেল। অকালে তার মৃত্যু হলো।

বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। নাহ্ এই বাসায় এক মুহূর্তও থাকা যাবে না। নিয়ন একনাগাড়ে আমাকে যেতে মানা করছে। কিন্তু পিচ্চির কথায় আমি পাত্তা দিচ্ছি না। দরজার পাশে এসে যাবার পূর্বে এক পলক দেখলাম উনাকে। উনার এখনো মুখ কাঁথা দিয়ে ঢাকা। একবারো মানা করলেন না। এই রাত্রে ঝড় বৃষ্টিতে একলা একটা মেয়ে কীভাবে যাবে?

দরজা খুলে যাবার সময় আকস্মিক এক বজ্রপাত হলো। এর গর্জনে নিয়ন দূরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, প্লিজ আপু, যেও না।আমার খুব ভয় করছে। আমি ওকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললাম, ধুর বোকা, এই সামান্য বিজলির চমাকানিতে কেউ ভয় পায় নাকি? এইগুলোতে যারা ভয় পায় তারা এক্কেবারে ভীতু। আমি ওগুলোতে ভয় পাই না। তুমিও পেয়েও না। যাও, ভাইয়ার পাশে গিয়ে বসো।”

নিয়ন আমার কথা ভালো ছেলের মতো শুনে ভাইয়ার কাছে বসলো। আচমকা আবারো মেঘ এমন প্রচন্ড জোদে গর্জে উঠলো যে মনে হলো বিল্ডিং ভেঙে ফেলছে। আর এই গর্জে উঠার শব্দ এতটা ভয়ংকর ছিলো যে যার কারণে আমি দৌড়ে নিয়নের মতো অয়নের কাঁথার ভেতর ঢুকে গেলাম। শুধু মাত্র জড়িয়ে ধরাই বাকি রইলো। এক মরা লাশ থুক্কু এক অসুস্থ ব্যক্তির নিকট সাহায্যের জন্য যাচ্ছে দুই ব্যক্তি। অদ্ভুত!

“তোকে না বললাম চলে যেতে। তুই এখনো যাসনি। এত বেহেয়া কেন তুই? যাহ্ ভাগ। তোর তো দেখি লজ্জাও নেই। একটা অবিবাহিত ছেলের পাশে এভাবে গা ঘেঁষে ঘুমিয়েছিস। ছিহঃ আর তুই না বললি এগুলো তুই ভয় পাস না। তাহলে এখন কেন পেলি।” কাঁথা থেকে মুখ বের করে এতগুলো কথা বললেন।
আবারও চোখ থেকে জল আসার উপক্রম আসলো। কিন্তু শুয়া থেকে উঠে হাটু ভেঙে বিছানায় বসলাম। তবে এবার মনে মনে ভাবলাম যাবো না। যতই অপমানিত হই। এই বৃষ্টিস্নাত রাত্রিরে একা কীভাবে যাবো?তাও আবার হেঁটে! অসম্ভব! কিন্তু একটু ভাব নিয়ে বললাম,

“চলে যাচ্ছি। কিন্তু শুনে রাখুন।” বিছানা থেকে উঠে।
“কীহ?”
“আমি এখন এখান থেকে বের হবো। বৃষ্টির ঝড়ো হাওয়া এসে আমার ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ছাতাবিহীন এই আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবো। বৃষ্টির পানির কারণে আমার জামা ভিজে লেপ্টে থাকবে শরীরে। বখাটে ছেলেরা খারাপ নজর দিবে। তারপর তারা আমার সম্পদ নষ্ট করবে। কোনো ছেলে আমায় বিয়ে করবে না। আমার সম্পদ নেই দেখে। তখন আমি দৌড়ে আপনার কাছে ছুটে আসবো। বলবো, বিয়ে করেন, বিয়ে করেন। আপনি আমার সম্পদ নষ্ট হওয়ার মূল কারণ হওয়ায় বিয়ে করবেন। কিন্তু একটা ধর্ষিতা মেয়েকে। সারাক্ষণ আমার ফ্রেন্ডরা আপনাকে নিয়ে ট্রল করবে। শুধু ফ্রেন্ড নয় পুরো সমাজ। বুঝলেন?

“হুম। এবার যাহ্।”
ভাবের আশায় গুড়ের বালি ঢেলে দিলেন এই কথায়। কিন্তু আমি তো এখান থেকে এক পাও নড়বো না। তাই জেদ দেখিয়ে বলি,
“হাত সরান তো। দেখি কতটুকু জ্বর হয়েছে।” নিজেই হাত সরিয়ে কপালে হাত দিলাম। গায়ে কী উত্তাপ। মনে হয় জ্বরে পুরো শরীর পুড়ে যাচ্ছে।খুব কষ্ট হচ্ছে।

“এত খারাপ কেন তুই? আর কতবার বলবো যা এখান থেকে।” কপাল থেকে হাত সরিয়ে।

উনার এমন আচরণ বুকের মধ্যে তীড়ের মতো বিঁধছে। সত্যি চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এবার যা ভাবার তা ভেবে পেলেছি।কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতোই এবার আমিও আচরণ করবো।

“কী ভাবছিস? যাচ্ছিস না কিসের জন্য?”

“ক্যান যাইতাম। না গেলে তুই কিতা করবি, হুনি? তোর মুরুদই বা কতখান? আয় দেখি।” বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল নাচিয়ে নাচিয়ে এই কথাগুলো বললাম। এটাও বুঝলাম উনি ভারি অবাক হলেন। কারণ উনার চোখ এত বড় হগেছে যা বলার মতো না।

“তুই আমার সাথে এমন ব্যবহার করলি? তোর সাহস তো কম নয়?তোকে তো আমি,,,,” বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অসুস্থ শরীর এই ভার সহ্য করতে পারলো না। তাই বিছানায় আবার পড়ে গেলেন। রাগে গিজগিজ করছেন। কিন্তু আমি জানি তো যত গর্জে তত বর্ষে না। তাই আমার সাহসও দ্বিগুন পরিমাণ বেড়ে গেল।

“দেহি ধলাচান তোর কপালডা দেহি?” বিছানায় বসে আবারও ভাব নিয়ে কাছে গেলাম।

“এই আঞ্চলিক ভাষায় কেন কথা বলছিস। একবার তো দেখলি। আবার কেন দেখিব?”
“একশবার দেখবো। যতবার আমার ইচ্ছে হবে।” কপালে হাত দিয়ে জ্বরের পরিমাণ অনুভব করে সরে আসলে হাত ধরে মুচড়িয়ে বললেন, “এবার তোর কী হাল করি সেটা দেখ।” উনার কথা শুনে বিটলামির হাসি দিলাম। তারপর উনার হাত মুচড় দিলাম। উনি আহ করে হাত বিছানায় ফেলে দিলেন। উনার শরীরে শক্তি নেই বললেই নেই! একেবারে হাত অবশ! তাই আমার শক্তিও দেখিয়ে দিলাম।

“দীপ্তি শুনো, তুমি এখানে আজকে থাকতে পারো। কিন্তু প্লিজ আমাকে ডিস্টার্ব করো না। আমার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে।”
উনার উত্তর শুনে গগন বিদায়ী হাসি দিয়ে বললাম,,,,,,,,,,,,,

চলবে,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে