প্রয়োজন পর্বঃ ২১

0
887

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ২১
লেখায়: তানিয়া তানু

দুপুর বেলায় বৃষ্টি কমেছে। তবে আকাশে এখনো মেঘ জমেছে। আবারো বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা দ্বিগুন। নতুন বর্ষা। তাই তেজও বেশি। নয়তো এত বৃষ্টি কী আর হয় নাকি! একেবারে ঝুম বৃষ্টি। সকালবেলায় তো খুব করে ইচ্ছে হচ্ছিলো এই ঝুম বৃষ্টিতে একটুখানি ভিজি। কিন্তু মায়ের চোখের শাসন আর বাবার জ্বর বেড়ে যাওয়ায় এই সিন্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এলাম। তবে মায়ের শাসন থেকে বের হতে পারিনি। যেই না বেলা ১২ টা বাজা শুরু হলো সেই থেকেই প্রশ্ন করলেন, “হে রে দীপ্তি, তুই বিকেলের টিউশনিতে যাস না ক্যান?” মায়ের এই প্রশ্নের উত্তরে ভালো লাগছে না বললেও কিছুক্ষণ পরপর এসে একই কথা জিজ্ঞেস করলেন। সম্ভবত মায়ের সন্দেহ হয়েছে। মা আমার প্রিয় সইয়ের মতোই ছিলো। তাই নিজের সব কিছু ভাগ করি। তবে ডিপলি নয়। টিউশনিতে দুই ভাইয়ের একাকীত্ব আর নিয়নের দুষ্টুমির কথা বলেছি। এই কারণেই তিনি সন্দেহে ডুব দিলেন।

বিকেল বেলায় মায়ের মায়ের বার বার প্রশ্ন আর সন্দেহের তালিকায় না পড়ার জন্য বেরিয়ে পড়লাম নিয়নকে পড়ানোর উদ্দেশ্যে। তবে বেশ ভয় হচ্ছে না জানি নিয়নের ভাই আমাকে দেখে কী প্রতিক্রিয়া দেখায়! এই টেনশনে তো সারারাত ঘুমও হয়নি।

রাস্তাঘাটের অবস্থা ভারি শোচনীয়। পানি আর কাদায় মিশ্রিত হয়ে আছে। কয়েক জায়গায় হাটু পরিমাণ পানি। সালোয়ার তোলে জুতা হাতে নিয়ে সে জায়গা পার হতে হয়। আবার কয়েক জায়গায় পিছলে যাবার সম্ভবনা। ধীর গতিতে সাবধানে যেতে হয়। এত ঝামেলা হচ্ছে দেখে গ্রামের রাস্তা দিয়ে না হেঁটে মেইন রোডে হাঁটা শুরু করলাম। এইখানে তেমন খারাপ পরিস্থিতি নেই। বেশ কয়েক জায়গায় খানিক পানি জমে আছে। তবে সুন্দরভাবে চলাচল করা যায়। কিন্তু সমস্যা এই রোড দিয়ে অনেক জায়গা হাঁটতে হবে। আর তা করছিও।

রাস্তাঘাটের মানুষ আর প্রকৃতি দেখেই হাঁটছি। কিন্তু আকস্মিক নিলার কথা ভাবনায় এলো। আসার সময় ফোন করলো। তার বৌভাতে না ফিরাযাত্রাও না, এমন কী একদিন যে সে এক্সট্রা বাপের বাড়ি থাকলো তাও তাকে কেন দেখতে গেলাম না। উত্তরগুলো অনেক বাহানা দিয়ে বুঝেছি। বুঝলেও সে যে অভিমান করছে তা বুঝতে আমার আর বাকি রইলো না। ওদের বাসায় না যাওয়ার কারণ মূলত তিনটি। প্রথমত চারদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো। কিছুক্ষণ থামছিলো। কিন্তু আবারো হচ্ছিলো। দ্বিতীয়ত, শাহেদা আন্টির কাছে আমি আর পড়তে চাই না। উনি দু হাত মেলে আগলে রাখুক উনার সোনার ছেলেকে। তৃতীয়ত আকাশ ভাইয়ার কাছে পড়তে চাই না। কারণ টাকাটা ফেরত দেওয়ায় তার মনের কোণায় অনেক প্রশ্ন জমেছে। আমাকে পেলেই সব প্রশ্ন বন্যার মতো ঢেলে দিবে।

বহুক্ষণ হাঁটার পর গন্তব্যে আসায় বড়সড় এক শ্বাস ফেললাম। কিন্তু শ্বাস পুরোপুরি শেষ হবার পূর্বে নজর পড়লো গেইটে। দারোয়ান নেই! তবে বাইরে আছে মনে হয়। নিজেই গেইট খুলে ঢুকলাম। সদর দরজায় ঢুকে আরো অবাক হলাম! পরিবেশে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। নিয়নের রুমেও সে নেই। চাপা গলায় নিয়ন বলে কয়েকবার ডাক দিলে পাশের রুম থেকে সে জবাব দিলো “আসছি আপু”। পাশের রুম নিয়নের ভাই। খুব ইচ্ছে হলো উনাকে এক নজর দেখি। আচ্ছা উনি কী আছেন? নিশ্চয় আছেন। তা না হলে নিয়ন কেন ঐ রুমে থাকবে। তাই উঁকি দিয়ে উনাকে দেখবো বলে বাইরে পা রাখছলাম। কিন্তু উনাকে দেখার ইচ্ছে দমে গেল নিয়নের ফ্যাকাসে মুখ দেখে। তবে তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না।

পড়ার সময় শেষ হওয়ার বাকি সময় হচ্ছে ১৫ মিনিট। এই ১৫ মিনিটেই প্রতিদিন ওকে নতুন খেলা শিখাই। আজও একটা নতুন খেলা নিয়ে হাজির হয়েছি। যেগুলো ছোটবেলায় শিখেছিলাম তার একটা।

“নিয়ন, আজ এই পর্যন্তই।” নরমস্বরে এই কথাটা বলায় প্রত্যুত্তরে এলো আচ্ছা।ওর আচ্ছা বলার নমুনা দেখেই বুঝলাম পিচ্চর খেলায় আগ্রহ নেই।কিন্তু প্রতিদিন আমি বলার পূর্বে নিয়ন খেলার কথা বলতো। আজ কেন বলেনি? উনি না করে দেননি তো?

“নিয়ন, চলো, আজ তোমায় আরো নতুন একটা খেলা শিখাই।” এতক্ষণ ওর নজর বইয়ের দিকে ছিলো। আমার কথায় মাথা তুলে অসহায়ের দৃষ্টিতে বললো, সরি আপু! আজ খেলায় মুড নেই। তাই খেলতে পারবো না! ওর কথায় কিছুটা অপমানবোধ করলাম। হয়তো মুখের উপর না বলাতেই। কিন্তু কেন ও খেলবে না?

“ভাই, তোমার কী কিছু হয়েছে?”
ভাই বলায় ওর মুখ অন্য ধরণের হলো। চোখে পানি টলমল করছে। ওর এমনতর চাহনি দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে।

“আপু, আমার কিছু হয়নি। তবে ভাইয়ার হয়েছে।”
অয়নের কিছু হয়েছে শুনে বুকটা মোচড় দিলো। কেমন এক হাহাকারে আক্রান্ত হচ্ছে হৃদয়পট। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ” উনার কী হয়েছে?”উত্তরে নিয়ন বললো, জ্বর হয়েছে। প্রচুর! ডাক্তার দেখিয়েছি। ওষুধও ভাইয়া খাচ্ছে। কিন্তু এখনো জ্বর কমেনি। আমার খুব ভয় করছে আপু।”এই কথা বলেই কেঁদে দিলো। আমারও মন ব্যথিত হলো। কাছে টেনে চোখের জল মুছে বললাম, ধুর বোকা। কাঁদিস কেন! কিচ্ছু হবে না উনার।” এই কথা বললেও পরক্ষণে মনে হলো জ্বর কী করে হলো? যেই ভাবা সেই বলা। উত্তরে নিয়ন খানিক রাগ দেখিয়ে বললো, “সব দোষ ভাইয়ার। কত করে বললাম ভাইয়া বৃষ্টিতে ভিজো না। অসুখ হবে। উলটো আমাকে ধমক দিয়ে রোমান্টিক মুড নিয়ে হাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজলো। যত্তসব! আই হেট রেইন। উঠাতে শুধু অসুখ হয়। ”
নিয়নের কথায় হেসে বললাম,”নিয়ন বৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহর দান। এটাতে নিয়ামত থাকে। ঘৃণা করতে নেই ভাই।” এই কথা বলেই পুনরায় চলে গেলাম নিয়নের কথায়। এই নতুন বর্ষায় ভিজলেন কেন? তাও আবার রোমান্টিক মুড নিয়ে। অথচ আমি দেখেনি। মিস হয়ে গেল। ইশ আমি যদি বৃষ্টি হতাম।

তোমার জন্য আমি
বাদল দিনে ঝরা বৃষ্টি হতে চাই,
তুমি যখন,
বৃষ্টিস্নাত দিনে,
খোলা মাঠের প্রান্তরে
এক বুক ভালোবাসা নিয়ে
দু হাত মেলে বৃষ্টিকে আপন করে
ভিজবে মনের সুখে
তখন আমি আমার জন্মানো সার্থক মনে করে,
অঝোরে ঝরবো মেঘ জমানো সীমাহীন আকাশ থেকে।

মনে মনে নিজের ইচ্ছা নিয়ে কবিতা লিখে ফেললাম। শুধুমাত্র উনার জন্যই আমি বৃষ্টি হতে চাই।

“আপু কোথায় গেলেন?”
ওর কথায় ভাবনা জগত থেকে বের হয়ে মনে মনে প্রশ্ন উত্তর ভাবনা জগতে হলেও উত্তরে বললাম, “কোথাও না।” সময় হয়ে গেলো যাবার জন্য ব্যাগ নিলাম। নিয়ন শুধু চেয়ে আছে। বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। তাই তাড়া দিয়ে বললাম, আসি, ভাই। নিয়ন উড়না ধরে বললো,
” আপু আরেকটু থেকে যাও না।”
“বৃষ্টি হচ্ছে ভাই। পরে যেতে কষ্ট হবে। আসি কেমন!”
“আপু প্লিজ আরেকটু থেকে যাও না। ভাইটার কথা একটু রাখো।”
ভাই বলায় বুকের মধ্যে লাগলো। ভাই থাকলে নিশ্চয় এমন কাতর সুরে ডাকতো। তাই ওর কথায় ঘন্টা খানেক থাকলাম। কিন্তু বৃষ্টি কমার বদলে প্রচন্ড জোরে বাতাস দিয়ে প্রবল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে। যেতে পারবো। কারণ ব্যাগে ছাতা আছে। কিন্তু ও যেতে দেবে কী না? সেটাই এখন ভাববার বিষয়। বেজে গেল। নাহ এবার যেতেই হবে। খানিক পর তো আযান দিয়ে দিবে। সন্ধ্যার অন্ধাকার নেমে আসবে ধরণীর বুকে। তাই আর দেরী না করে বাইরে যাবার তাগাদা দিয়ে নিয়নকে বললাম, “আর নয় ভাই। আসি।”
বিছানায় বসা ছিলো এতক্ষণ। আমার কথা শুনে দৌড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“প্লিজ আপু যেও না। আমার খুব ভয় হচ্ছে। ভাইয়ার কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাবো। মৃত্যু নিয়ে আমি খুব ভয় পাই আপু। তুমি প্লিজ যেও না। ওরা এলে তুমি চলে যেও। ওরা এলে না হয় তোমাকে আমাদের গাড়ি দিয়ে পৌছে দিয়ে আসবো। এখন যেও না আপু।”।
ওর কথা শুনে ভারি অবাক হলাম। বুঝলাম অয়নের মৃত্যু হতে পারে ভেবে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। কিন্তু ওর মৃত্যু! এই কথা ভেবেই বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। নিয়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু নিয়ন ওরা বলতে কাদের বুঝিয়েছে?এই ঝুম বৃষ্টিতে কারা আসবে?
“ভাই, ওরা বলতে তুমি কাদের বুঝিয়েছো?”

চলবে„„„„„

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে