#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ১৮
পরক্ষণে মনে মনে ভাবলাম মানুষ তো সামনে অনেক। তারা আমার দিকে কেমন তরে তাকিয়ে আছে তা দেখার জন্য মাথা উঁচু করতেই প্রথমে চোখের সামনে ভেসে উঠলো মেয়েদের জটলার মধ্যে কেন্দ্রবিন্দু নিয়নের ভাইয়ের দিকে। অপলক চাহনিতে চেয়ে আছে। তবে এমনভাবে তাকানোর কী আছে সেটা ভাবে পেলাম না!সিঁড়ি দিয়ে নামার প্রতিটি পদেই একবার করে আড়চোখে দেখতে লাগলাম উনাকেও। এখনো একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। অদ্ভুত!
বরযাত্রী এলো বলে সবাই চলে গেল গেইটে। মূলত সেখানে গেইট অবরুদ্ধ করবে মেয়েরা। পূর্বে এগুলোতে বেশ ভালো লাগলো। দুষ্টুমিপূর্ণ ছেলেদের কথায় প্রচুর হাসতাম। কিন্তু নিউজ পেপারের এক কনটেন্ট পড়ে এগুলো থেকে নিজেকে দূরে সরে রেখেছি। কারণ বিয়ের মতো এমন সমাগম জায়গায় বিভিন্ন সম্পর্কের রেশ ধরে এক ধরণের ছেলেরা নতুন সম্পর্ক তৈরি করে। সেই সম্পর্কতে খাঁটি কিছু সম্পর্ক থাকলেও বেশিরভাগই নকল সম্পর্ক। পরবর্তীতে এর কারণে অনেক মেয়েরা এমনতর ছেলেদের পাল্লায় পড়ে তাদের মূল্যবান সম্পদ বলি দিয়ে ফেলছে। সমাজে এখন সেই নিকৃষ্ট ছেলেদের বদলে মেয়েরা হয়েছে শতদিক দিয়ে দোষী। যাইহোক, বর এসেছে শুনে বেবলিকে বললাম উপরে চলে যেতে। মুখ ভ্যাংচি দিয়ে গাল-মুখ ফুলিয়ে ড্যাংড্যাং করে চলে গেল। মূলত সে উপরে যেতে নারাজ। তার মর্জি ছিলো ঐ আড্ডাখানায় যেতে। বাঁধা দেওয়াতে এমনতর কাজ করলো।
“চলে যাচ্ছেন যে? যাবেন না বর দেখতে? বেবলির পিছন পিছন আমিও চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু উনার কথায় থেমে গেলাম। আচ্ছা উনি কেন আমার কাছে এলেন? বেশ তো ভালো ছিলেন এক ঝাঁক মেয়েদের মাঝে। খোশগল্পে ব্যস্ত ছিলেন।
“ওগুলো আমার অপছন্দের বিষয়। আর বরকে তো সব সময়ই দেখতে পারবো। এত ভীড়ে এই মূহুর্তে দেখার প্রয়োজনবোধ করছি না।” এক ধরনের ভাব নিয়েই কথাটা বললাম।
“আপনাকে আজ ভারি সুন্দর লাগছে। বিশেষ করে হারটায়।”
কথার মোড় ঘুরানোর জন্যই মনে হলো এই কথা বললেন। তবে প্রশংসা কিছুটা পাওয়ায় লজ্জায় কুণ্ঠিত হলাম। কিন্তু গলার হারকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় বললাম,
“সুন্দর তো লাগবেই। প্রিয়জন দিয়েছে বলে কথা। শুভাকাঙ্ক্ষী তো আর অপ্রিয় নয়। প্রিয় হিসেবেই তাকে উপস্থাপন করলাম।
“কে সেই প্রিয়জন?”
আহারে! এই প্রিয়জন কে সেটাতো আমি নিজেও জানি না। কিন্তু লোকটার বলার ভঙ্গি দেখে মনে খুব হাসলাম। কারণ অসহায় হয়ে বলছে। মনে হচ্ছে প্রিয়জনের নাম শুনেই সে ভেঙে পড়ে যাবে। এই লুচুটা যাতে আমার সাথে অসভ্যতা করতে না পারে তার জন্য বললাম,
“আমার প্রিয়জন, আমার উনি, আমার হবু স্বামী! ”
হবু স্বামী শুনেই উনার চোখ কুঠরি থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম চলছে। ভীষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। কিন্তু আমার মনে শান্তি এলো। এখন আর এই লোকটা লুচ্চামী করতে পারবে না।
“বাই দ্য ওয়ে, আমি কিন্তু হবু স্বামীকে দেখার অপেক্ষায় আছি ।”
কোনো কিছু বলছেন না দেখে উপরে চলে আসছিলাম। কিন্তু পিছনে উনার কথা শুনে একটু থমকে গিয়ে আচ্ছা বলে চলে আসলাম। তবে মনে মনে আমিও অপেক্ষায় আছি।
কাজী সাহেব নিলাকে বার বার বলছেন তুমি কী রাজি মা? রাজি হলে কবুল বলো। কিন্তু নিলা সেই যে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলো। এখনোও খুলছে না। আমি সহ্য করতে না পেরে বললাম,
“তুই যদি না বলিস তবে আমি বলে দিবো।”
জোরে পেটে চিমটি দিয়ে বলার জন্য আহ করে শব্দ করে উঠলো কাজী ভেবে নিলো নিলা হ্যাঁ বলেছে। কিন্তু আমি থামিয়ে বললাম এখনো সে বলে নাই। কাজী হতাশ হয়ে নাকের ডগায় আসা চশমা আবারো চোখে দিয়ে পান চিবুতে চিবুতে অপেক্ষায় করলো।
আবারো নিলাকে চিমটি দিতে গেলে হাত বাঁধা দিয়ে আস্তে আস্তে বললো, “এত তাড়াতাড়ি বলে দিলে বলবে মেয়ে বিয়ের জন্য পাগলা। তাই তো এমন দেরী করছি। বুঝস না ক্যান।”
ওর এই কথা শুনে আমি যারপরনাই অবাক। তাই বলে এত দেরী!
বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নিলা কবুল বললো। কাজীর মুখেও হাসি ফুঁটলো। আমিও এক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নিলা এখন অন্যের ঘরে যাবে। সংসারে ব্যস্ত থাকবে। কাজের পাহাড়ে দেখা করতে পারবে না। ফুচকার দোকানে ফুচকা খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলবে না। নান্টু দোকানিকে বউ পাগলা বলে চ্যাঁতানো যাবে না। এইভেবেই কষ্টের রাজা চলে আমার আমার রাজ্যে। কোনো এক নির্জন জায়গায় একাকী থেকে বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেলবার জন্য মনে মনে জায়গা খুঁজলাম। পরক্ষণে ভাবনায় এলো সবাই এখন বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। ছাদে কেউ যাবে না। তাই সেখানে যেতে চাইলে শাড়ির আঁচল দিয়ে আটকায় নিলা। ওর চোখের কান্নার আভাস। ইশারায় এখান থেকে যেতে না বলছে। কিন্তু আমার তো যেতেই হবে। নাহলে ওর কান্না দেখে আমিও বেশ কাঁদবো। তাই একটু পর আসছি বলেই আঁচল টেনে চলে গেলাম ছাদে। কেউ নেই সেখানে। একলা আকাশে প্রচুর কথা ভাগ করা যাবে।
অনেকক্ষণ কাঁদার পর চলে যেতে চাইলে কারোর হ্যাচকা টানে দেয়ালে লাগিয়ে শরীর চাপ অনুভব করলাম। মাথার তোলে তাকিয়ে দেখলাম আবারো নিয়নের ভাই। উফ, অসহ্য। এই লোকটা এমন কেন?বার বার শুধু উনার দিকে টানে। যত্তসব লুচ্চামী!
“নিলার জন্য কাঁদছিলে বুঝি?দুহাত গালে দিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো।
আবেগের বশে লোকটার স্পর্শে নিজ অজান্তেই চোখ বন্ধ করে দিলাম।
“সব মেয়েদেরই বিয়ে হয়। তাই কাঁদতে নেই। কেঁদো না। দোয়া করো নিলা যাতে সুখী হয়।”
লোকটার কথা শুনে অবাক। একবার আপনি তো আরেকবার তুমি। দুই বেলায় দুই রকম মুড নিয়ে যেন আমার সাথে কথা বলে।
“আপনার মতলবটা কী বলুন তো? কোন অধিকারে এভাবে স্পর্শ করে কথা বলছেন?” হাত সরিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললাম।
“মতলব কিছু নেই। আবার আছেও। অধিকার চাওয়ার জন্যই এই মূহুর্তে এখানে আসার কারণ।” এক হাত দেয়ালে ঠেকিয়ে বললেন।
উনার প্যাঁচানো কথায় কিছুই বোধগম্য হলো না। তবে রাগ দেখিয়ে বললাম,
“আচ্ছা আন্টি ও নিলার কাজিনরাও কাঁদছে। যান না ওদের গালে হাত রেখে চোখের পানি মুছে দিয়ে ঐ কথাগুলো বলুন। এখানে কেন এসেছেন? কোন সম্পর্কের রেশ ধরে এসেছেন?”
“সব মেয়েদের সাথে তোমার তুলনা করবে না, দীপ্তি। তুমি ও ওরা এক নয়। ওদের সাথে তো তেমন সম্পর্ক নেই আমার।”
“ও আমার সাথে আছে বুঝি। একজন টিউটর আর স্টুডেন্টের বড় ভাইয়ের সম্পর্কে এমন হয় বুঝি? আজব!”
“আমি এই সম্পর্কের নতুন নাম দিতে এসেছি।”
“সম্পর্কের নাম! তা কী শুনি?” একটু টিজ করেই কথাটা বললাম।
“দীপ্তি, আমি তোমাকে চাই।”
“কীহ? এটা কেমন ধারার কথা। আপনি আমাকে চান মানে?”
খানিক আমতা আমতা করতে লাগলো। মনে হলো কথাগুলো সাজাতে পারছে না। হা হুতাশ করে পাঞ্জাবির বোতাম কয়েকটা খুলে দিলো। কিন্তু ঠান্ডা পরিবেশে এই লোকের এমন অবস্থা দেখে মনে হলো লোকটা গ্রীষ্মের খরতাপে ভুগছে।
“দীপ্তি, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” অনেক্ষণ এদিক সেদিন চেয়ে বেফাঁস বলে দিলো। এই কথা শুনে অবাক হলাম না। কারণ কয়েকদিনের অসভ্যতায় বুঝিতে পেরেছিলাম। তাই ভেবেছিলাম এড়িয়ে যাবো। এখন ঠিক সেটাই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হাত দিয়ে পথ রোধ করে বললো,
“আমার উত্তর কোথায়?”
“প্রশ্ন করছিলেন বুঝি?”
“প্রশ্ন নয়। আমি তোমার কাছ থেকে মতামত শুনতে চাচ্ছি।”
“যদি মতামত শুনতে চান তবে বলবো এতে আমার ঘোর আপত্তি। তাই অনর্থক কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। পথ ছাড়ুন।”( চোখে রাঙিয়ে)
“এভাবে কী করে মতামত দেওয়া হয়। তুমি না হয় ভাবো। আমার সম্পর্কে খোঁজ নাও। কিন্তু প্লিজ ওভাবে ছেড়ে দিয়ো না। আমি যে তোমায় ভীষণ ভালোবাসি। হয়তো তোমাকে ছাড়া বাঁচত পারবো কিন্তু আমার জীবন যে তোমায় ছাড়া ছন্দহীন কবিতার মতো হয়ে যাবে।”
“কী অবলীলায় আপনি বলে দিলেন ভালোবাসি। অথচ খেয়াল করে দেখুন আমাদের পরিচয় দুদিনে। এই দুদিনে ভালোবাসা নয় ভালোলাগা হতে পারে।”
“দীপ্তি আমি দুদিন ধরে তোমায় ভালোবাসিনি।”
“দুদিন নয়! আজব তো! এটাতো কথায় কথায় বললাম। গুণে দেখতে গেলে ১৫ দিনের মতো হবে। এই এতটুকু পরিচয়ে ভালোলাবাসা নয় ভালোলাগা হয়। আর এই দুটোতে না বিস্তার তফাৎ।”
কিছুক্ষণ মাথার উপর বিশাল ছাদের দিকে তাকিয়ে বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“দীপ্তি, তোমার আর আমার বয়সের কয়েক বছরের পার্থক্য। এই পৃথিবীর অনেকাংশ আচরণ আমার জানা। তো কোনটা ভালো লাগা আর ভালোবাসা সেটা আমার খুব করেই বুঝতে পারি। তাই তোমায় ভালোলাগা,,,,,
পুরো কথা না শুনেই চলে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু আবারো হ্যাচকা টানে নিয়ে গেলেন উনার বুকে। কেমন এক অদ্ভুত ফিলিংসের মাঝে আছি। তা নিজেও বুঝতে পারছি না। একদিক দিয়ে রাগে পুরো শরীর জ্বলছে। অন্যদিকে এগুলো কথায় কর্ণপাত করতে না চাইলেও সেদিকেই মন চলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রত্যেক কথাই আমার কাছে ছলে ভুলানো মিষ্টি কথা মনে হলো। তাই রাগত কন্ঠে পূর্ণ শক্তি দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় বলতে লাগলাম,
“ছাড়ুন আমায়। এই লুচ্চামী আমার সাথে নয়। অন্য মেয়ের সাথে করুন। যে আপনার ফাঁদে সহজেই পা দিতে পারবে।”
“আমার ভালোবাসায় ফাঁদ কোথায় দেখলে?”
“এখানে ভালোবাসা ছিলো কোন সময়। এতক্ষণ তো জোরাজুরিতে ব্যস্ত ছিলেন। আমাকে মিষ্টি কথায় ভুলানো হচ্ছে তো। কিন্তু আমি বোকা নই। কখনো আপনার ফাঁদে পা দিবো না।”
চলবে„„„„„