‘প্রেম প্রার্থনা’
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার আলো
[০১]
নববধূর সাজে সদ্য বাসরঘরের চৌকাঠে পা দিয়েছে স্পর্শী।
চোখে রঙিন স্বপ্ন। হঠাৎ হেঁচকা টানে সামনে ঘুরিয়ে স্বজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো রুদ্র রাজ। পুরুষালি শক্ত হাতের থাপ্পড়ে তাল সামলাতে না পেরে সে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।
আচমকা এমন করায় গালে হাত দিয়ে অবাক নেত্রে তাকিয়ে রইল ষোড়শী নববধূ। টলমলে চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুদ্র এগিয়ে গেল একদফা দিতে। ভয়ে কিঞ্চিৎ পিছিয়ে ঠোঁট উল্টো ডুকরে কেঁদে উঠল স্পর্শী। তার পুরো মুখে স্পষ্ট হলো ভয়ের আভাস। একটু পিছিয়ে না সূচক মাথা নাড়ালো বেশ কয়েকবার। রুদ্রের দৃষ্টি তার অন্তর আত্মা কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
ভয়ে তার কাজল কালো নেত্রে ঝরছে বেপরোয়া নোনাজল। কান্নার ফলে পুরো মুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। বিয়ে করবে না বলায় কিছুক্ষণ আগেও খুব মেরেছে রুদ্র। পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিয়েছে ফর্সা আদুরে দু’গালে। মা/র খেয়ে বিয়ে করেছে তারপরেও মারছে। সামান্য ভুলই তো করেছে, আর কত বার মাফ চাইবে? তাকে কাঁদতে তখন রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-‘দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে নয়তো এমন শট দিবো
এখানেই পটল তুলবি। কী কথা কানে যাচ্ছে না? আরেকটা দিবো?’
-‘দা দী জা ন আ।’
স্পর্শীকে তোতলাতে দেখে রুদ্র আশেপাশে তাকিয়ে লাঠি খুঁজল। কিন্তু হাতের কাছে চিরুণী ছাড়া কিছু পেলো না। সে চিরুণী দিয়েই স্পর্শীর মাথায় জোরে আরেকটা বারি দিলো।
এবার ব্য/থায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তার কান্নার শব্দ শুনে দরজায় নক পড়ল। বাসার অন্য সদস্যরা ছুটে এসেছে
তাকে উদ্ধার করতে। সবাই রুদ্রের নাম ধরে ডাকছে, দরজা খুলতে বলছে। রুদ্রর বাবাও রুদ্রকে বের হতে বলছে। শুধু শুধু অকারণে মা/র/বে কেন মেয়েটাকে জানতে চান তিনি।
যা হওয়ার হয়ে গেছে এখন মারলে লাভের লাভ কিছু হবে?
হবে না! বরং মেয়েটা আরো ভয় পাবে। এরচেয়ে মেয়েটাকে বুঝাতে হবে যাতে এমন ভুল আর না করে। এছাড়া কিছুক্ষণ আগে তাদের সম্পর্কের বদল ঘটেছে। পূর্বে স্পর্শী ছিল তার চাচাতো বোন আর এখন বউ। বৈধ সম্পর্কে আবদ্ধ তারা। এ কথা স্মরণ রাখতে হবে দু’জনকেই। আর এ বাসার পুরুষরা বউদের গায়ে হাত তুলে না। এমন হীন- মানসিকতার মানুষ উনারা কেউ নন। বাবার মুখে এত কথা শুনেও রুদ্র দরজা তো খুললোই না বরং রাগে গজগজ করতে করতে স্পর্শীর গাল চেপে ধরলো। সঙ্গে ইশারায় বোঝালো আর একটা টু শব্দ করলে এক্ষুণি মে/রে ফেলবে। তারপর কে/টে টুকরো করে মাগুর মাছের পুকুরে ফেলে আসবে। রুদ্র বা স্পর্শীর আর কোনো শব্দ না পেয়ে দাদীমা সবাইকে যেতে বললেন।
আদেশ পেয়ে সবাই চলে গেলে দাদীমা খিলখিল হেসে বললেন,
-‘সুয়ামি, আমার নাতনি ডা এখুনো মেলা ছুুডু বাসর রাইতের কিচ্ছু বুজে না। তুমি একটু সামলাইয়া লইয়ো। আইজক্কার রাইতে হের উপ্রে গোস্সা কইরো না। পরথম রাইতে গোস্সা কইতে নাই দাদুভাই তয়লে আল্লাহ পাক অসুনতুষ হয়। দিন যাক দেখবা হেতিও আস্তে ধীরে সব শিইখা যাইবো। ততদিন একটু সবুর করো দাদুভাই।’
-‘দাদীমা রুমে যাও। ভুলেও যদি দরজায় আর একটা টোকা দাও, তোমার নাতনীর এমন অবস্থা করবো তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না।’
-‘দাদু ভাই আমার কথাডা শুনো।’
-‘যেতে বলেছি আমি।’
একথা শুনে দরজায় ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। তখন স্পর্শী নাক টেনে ভয়ে দাদীমা! দাদীমা! বলে চেঁচিয়ে উঠতেই তার হাতে আরেকটা বারি পড়ল। মার খেয়ে
কান্না আঁটকানোর চেষ্টা করলেও অঝরে অশ্রু ঝরে যাচ্ছে। চোখের পানির সঙ্গে নাকের সর্দি মিলেমিশে একাকার। যখন সর্দিমিশ্রিত চোখের পানি ঠোঁট ছুইয়ে যাচ্ছে তখন সে সড়াৎ করে সেটা টেনে নিচ্ছে। স্পর্শীর এহেন কাজে রুদ্র নাক, মুখ কুঁচকে হাতের ইশারায় উঠে দাঁড়াতে বলল। ইশারা বুঝে সে উঠতে গেলে পায়ে বেনারসি পেঁচিয়ে পড়ল ধপাস করে। শক্ত মেঝেতে ব্যথাও পেয়েছে। ব্যথাতুর শব্দ করে নিতম্বের দিকে হাত বাড়িয়েও হাত গুটিয়ে নিলো। আড়চোখে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, রুদ্র কিছু বুঝেছে না কী। কিন্তু কী বুঝল কে জানে পুনরায় সড়াৎ করে সর্দি টেনে পা থেকে শাড়ি ছুটিয়ে উঠে দাঁড়াল। এরপর আর কিছু বলতে হলো না রুদ্রকে। বরং নিজে নিজেই কান ধরে উঠবস করতে লাগল আপনমনে। তাকে উঠবস করতে দেখে রুদ্র বিছানায় গিয়ে আধশোয়া হয়ে বই নিয়ে বসল। বিরবির করে পড়ছে বইতে দৃষ্টি রেখে। আর তার দিকে দৃষ্টি রেখে স্পর্শী মনে মনে তাকে গালি দিয়ে ধুঁয়ে দিচ্ছে। এমন গালি যা রুদ্র কখনো শুনে নি। শুনবেই বা কী করে এগুলো তো ইন্টেক করা গালি। বাজারে
নতুন এসেছে। এসব ভাবতে ভাবতে তার কান থেকে হাতটা ছুঁটে গেল। রুদ্রকে তাকাতে দেখে জোরপূর্বক হেসে নিজের কাজে মন দিলো। ধূর বাবা, ভাল্লাগে না! বাসরঘরে বউয়ের সঙ্গে কেউ এমন করে? এই রুমে আসার পূর্বে বুড়ি (দাদীমা) কত কিছুই না শিখিয়ে দিলো। রুদ্রকে ভাই না ডাকতে, রুমে ঢুকার সঙ্গে সঙ্গে তাকে সালাম করতে, মিষ্টি খাইয়ে দুধের গ্লাসটা এগিয়ে দিতে। রুদ্র যা যা বলবে তাতে সম্মতি দিতে।
কিন্তু এসব করা তো দূর এই রুমে পা দিতে না দিতেই এমন থাপ্পড় জুটলো যে, থাপ্পড়ের প্রভাবে সব গুলিয়ে ফেললো।
কোথায় সালাম আর কোথায় দুধের গ্লাস চোখে তো পড়লো না। বরং থাপ্পড়ের চোটে দু’চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগল।
ইস! গালটা এখনো লাল হয়ে ব্যথায় টনটন করছে। ভাগ্যিস কানে মারে নি নয়তো বয়রা হয়ে যেতো। ওই কাশেম বয়রার মতো। লোকটার নাম কাশেম আলী। অথচ কানে কম শুনে এজন্য সবাই তাকে কাশেম বয়রা বলে ডাকে। অচেনা কেউ যদি এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘কাশেম আলীর বাসা কোনদিকে?’
পাড়ার কেউ চিনতে পারে না বরং জিজ্ঞাসা করে, এ পাড়াতে
কাশেম আলী বলে কেউ নাই তবে কাশেম বয়রা আছে।আর
কাশেম বয়রার কথা কী বলবো? সে পান কে শুনে কান আর কান কে শুনে যান।পরে ভুলভাল শুনে নিজেই চেঁচিয়ে লোক
জড়ো করে। সবাই যখন বুঝিয়ে বলে দোষটা তার তখন সে কাজের বাহানায় কেটে পড়ে। এইতো গতপরশু দিনের কথা,
স্কুল থেকে ফেরার পথে তার জুতো ছিঁড়ে গিয়েছিল। খুঁড়িয়ে হেঁটে আসার সময় কাশেমের সঙ্গে তার দেখা। কাশেম তাকে দেখলে মুখভর্তি হেসে আগে জিজ্ঞাসা করে, ‘আম্মা, আপনে কিরাম আছেন? শরীর স্বাস্থ্য ভালা তো?’
জবাবে সে যদি বলে ‘ জি, ভালা আছি।’
তখন কাশেম মুখটা এতিমের মতো করে উত্তর দিবে, ‘ কালা আছেন? কালা আবার কেমনে থাকে আম্মা? আমনে বহুত ফর্সা তয় কালা থাকবেন কিল্লায়?’
একথা শুনে তাকে কিছু না বলতে না দেখে কাশেমই বলল,
-‘আম্মা আপনে খুঁড়াইয়া হাটতাছেন ক্যান? পাও (পা) ব্যথা করতাছে?’
-‘আর বলবেন না, জুতোটা ম/রার আর জায়গা পেল না।’
-‘কুত্তা মরছে? কোন কুত্তাডা? আয় হায় আপনে কী 000 তে কল করছেন আম্মা?’
-‘কি আশ্চর্য! কুত্তা মরলে 000 তে কল করতে যাবো কেন?’
-‘যাতে কুরিয়ার সার্ভিসের লোক আইসা কুত্তাডা লইয়া যায়।’
-‘বলেন কী! মরা কুত্তা নিয়া কুরিয়ারের লোকরা কী করবে?’
-‘থুক্কু ওইডা কুরিয়ার সার্ভিসের লোক না কথাডা বলে কুকুর কোম্পানির লোক।’
-‘এ্যাঁ! কুত্তার আবার কোম্পানি কোথায় পেলেন আপনি?’
-‘আম্রপালি? আম্রপালি আম তো গাছে নাই আম্মা তয় পানি আইনা দিমু?’
তারপর সে আর কোনো জবাবই দেয় ন। কারণ কথায় কথা বাড়ে। শুধু বোবার মতো হেসে স্থান ত্যাগ করেছে। সেদিনের কথাগুলো মনে হতেই সে মিটিমিটি হাসতে লাগল। তারপর কী মনে করে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখে রুদ্র ঘুমিয়ে গেছে।
এটাই মোক্ষম সুযোগ ভেবে সে পা টিপে হেঁটে দরজায় খুলে ভৌ দৌড়। সেকেন্ডের মধ্যেই আবার ফিরে এসে দরজা বন্ধ পুনরায় দৌড়। স্পর্শী যাওয়ার পরপর রুদ্র উঠে বইটা রেখে ভালোভাবে শুয়ে পড়লো। রাত অনেক হয়েছে আগামীকাল খুব ভোরে উঠতে হবে। ওইদিকে, স্পর্শী নিজের রুমে গিয়ে শাড়ি একটানে খুলে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। তারপর বিরক্ত মুখে তাকিয়ে রইল পেটিকোটের নাড়ের দিকে। নাড়ে গিট্টু বেঁধে বসে আছে। ইস, জরুরি প্রয়োজনে ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন! এখন কি হবে? এজন্য বুঝি বলে বিপদের উপরে বিপদ না এলে বিপদ মানায় না। সে আর দাঁড়িয়ে না থেকে জ্যামিতি বক্স খুজতে লাগল। কিন্তু এখানে ওখানে খুঁজেও
জ্যামিতি বক্সের সন্ধান পেল না। তাই হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে
পিছনে ঘুরতেই নজর গেল ড্রেসিংটেবিলের চিপায়। দ্রুত উবু হয়ে জ্যামিতি বক্স খুলে দেখে কাঁটা কম্প্যাস নেই। পরিশেষে রাগে দুঃখে কাঁচি দিয়ে পেটিকোটের নাড় কেটে উদ্ধার হলো।
তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে চার পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়ল আপন শয্যায়। পরেরদিন সকালে মায়ের ঝাঁকুনিতে স্পর্শীর ঘুম ভাঙল। তাকে এই রুমে দেখে মায়ের প্রশ্নের শেষ নেই।
এত প্রশ্নে ভিড়ে খুব বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো সে। তখন তার মা পুনরায় জানতে চাইলেন,
-‘কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেন? এই রুমে কেন তুই?”
-‘রুদ্র ভাই বাড়াবাড়ি করছি তাই বাধ্য হয়ে পালিয়ে এসেছি।’
-‘রুদ্র এখন তোর স্বামী। বাবা মায়ের পরে স্বামী হচ্ছে একটা মেয়ের সবচেয়ে আপনজন। আর বাড়াবাড়ি করেছে মানে কী? সে যদি.. তুই তার বউ তার অধিকার আছে তোর কাছে যাওয়ার।’
-‘কি আশ্চর্য! তুমি কি পাগল টাগল হয়ে গেলে নাকি আম্মু?
স্বামী, বাড়াবাড়ি,, কাছাকাছি এসব কোথা থেকে এলো? কী বলছো এসব?’
মেয়ের কথা শুনে এবার স্পর্শীর আম্মু নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। উনি অন্যভাবে কথাটা ধরেছেন। তারপর কথা কাটাতে দ্রুত ফ্রেশ হতে বলে উনি প্রস্থান করলেন। স্পর্শী
আর একটু শুয়ে এপাশ ওপাশ করে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেল। নিচে গিয়ে দেখে সবাই খেতে বসেছে সেও তার চেয়ার টেনে খেতে বসল। একটুপরে রুদ্র এসে বসল তারা সামনের চেয়ারে। সেই জমিদার আবার সকালে বেশি কিছু খায় না। তাই তাকে শুনানোর জন্য সে বড় মা বলল,
-‘বড় মা আমাকে আরো দু’টো সিদ্ধ ডিম দাও। গতরাতে খুব ধকল গেছে আমার। অনেক ক্যালরিও লস হয়েছে। তোমার ছেলে স্বামী হিসেবে খুব খারাপ। খারাপেরও খারাপ। বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করেছে গতরাতে।’
একথা বলতে দেরি কিন্তু ওর পিঠে কিল পড়তে দেরি হয় নি।
এক কিল খেয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছে স্পর্শী। কারণ মেরেছে তার আম্মুই। কিল মেরে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মরিয়ম বেগম। যেন তৈরি হয়ে আছে আরেকটা কিল বসানোর। কিল খেয়ে স্পর্শী কাঁদতে লাগল।আজকাল দুঃখের কথা বললেও মার খেয়ে হয়। গতরাতে রুদ্র যা করেছে তাই তো বললো দোষের কিছু তো বলে নি।
কাঁদতে কাঁদতে সে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে খেয়াল করল রুদ্র হাসছে। তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা লুকোচুরি করছে।
সেই সঙ্গে তাকে তাচ্ছিল্য করে বলছে, ‘বেশ হয়েছে।’ তার হাসি দেখে স্পর্শী চোখ মুছে রুমের দিকে পা বাড়াল। আর মনে মনে বলল,
-‘মার খেতে দেখে হাসলে তো? ওকে, এবার তুমিও তোমার
পছন্দের শার্টগুলো আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না।’
চলবে।