প্রেমোত্তাপ পর্ব-১০

0
547

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

পর্বঃ ১০

মানুষের জীবনে অতি অনাকাঙ্খিত জিনিস বা ঘটনা গুলো মানুষ কখনো সহজে মানতে পারে না। আর তার ফলস্বরূপ দেখা যায় সবটা ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে। ঠিক তেমনই হলো সওদাগর বাড়ির ঘটনা। নিরু নামের মেয়েটিকে দেখে পরিস্থিতি কেমন থমকে গেলো। নিরু মেয়েটিকে সওদাগর বাড়ির প্রত্যেকেই চেনে। মেয়েটা তুহিনের ক্লাসমেট ছিল। দু একবার হয়তো এসেছিল বাড়িতে। কারো তেমন একটা সন্দেহ হয় নি তখন। কিন্তু কে জানতো এই মেয়ে এমন একটা পরিস্থিতির কারণ হবে!

সবটা যখন প্রায় থমকে রইলো, অনাকাঙ্খিত ঘটনায় অস্বাভাবিক কাজটা করে বসলো বনফুল। সে সোফা থেকে উঠে ধাম করে জড়িয়ে ধরলো তুহিনকে। বিস্ফোরণের উপর বিস্ফোরণ যেন ঘটে যাচ্ছে ঘরটায়। সবাই কেবল থ বনে দেখে গেলো। বনফুল তুহিনকে পা গ লের মতন জাপ্টে ধরে অনবরত প্রলাপ বকা শুরু করলো,
“তুমি দুষ্টুমি করছো তাই না? তুমি মজা করছো। নিরু আপুকে নিয়ে মজা করছো কেন? তুমি তো আমার। সবাই জানে তুমি আমার।”

তুহিনও বোধহয় কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো। বনফুলকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
“ছাড়ো বনফুল। আর তাছাড়া মজা করার কী আছে! আজকে ভালো একটা দিন তাই ভাবলাম সবাইকে একটু সারপ্রাইজ দেই। এভাবে ধরে আছো কেন বনফুল। ছাড়ো, আমি বিরক্ত হচ্ছি।”

তুহিন মেয়েটার বাহু ধরে বার বার সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু মেয়েটা শক্ত হয়ে কেমন লেপ্টে রইলো তুহিনের শরীরের সাথে। ভাব এমন যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে মানুষটা।

চিত্রা এলো এবার, বনফুলকে টেনে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু ফলাফল শূন্য। ততক্ষণে বনফুলের মা ও বাহারও ছুটে এসেছে খবর পেয়ে। চেরি গিয়ে ডেকে এনেছে।

আয়েশা খাতুন নিজের মেয়ের এমন নির্লজ্জতায় মাথা নত করে ফেললেন। শক্ত কণ্ঠে মেয়েকে ডাকলেন,
“বনফুল, চলে আয়। করছিস কী? ছিহ্!”

মেয়েটা তবুও এক চুল নড়লো না। বরং আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“না আম্মু, ও আমার, ও আমার। আমি দিবো না ওকে। নিয়ে যাবে তো ওরে। আমি দিবো না, আম্মু।”

চিত্রা ভাইয়ের দিকে তাকালো। অসহায় কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“এটা কী সত্যিই ভাইজান?”

তুহিন উপর-নীচ মাথা নাড়ালো। নিরুর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
“সত্যি বলেই তো আজ এনে ছিলাম ওরে। কিন্তু বনফুল এসব কী করছে! ছাড়ো বনফুল।”

বনফুলের মতন ঠান্ডা মেয়েটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলো। তুহিনকে ছেড়ে চিত্রার হাত ধরলো। মেয়েটার হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,
“কিরে চিতাবাঘ, তোর ভাই কেমন করছে দেখেছিস। তুই তো জানিস, জানিস না বল উনি আমার কাছে কী? তাহলে উনি এসব বলছে কেন আজ? তুই, তুই কিছু বলবি না? কিরে বলছিস না কেন?”

বনফুলের শ্যামলা মুখশ্রী ততক্ষণে কেঁদেকেটে বাজে অবস্থা। পরিবেশ কেমন বিশৃঙ্খল হয়ে গেলো। মুনিয়া বেগমও এলেন, বনফুলের বাহু এক হাতে জড়িয়ে ধরে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“মা, তুমি এমন করছো কেন? কী সমস্যা? বলো। এমন করো না, মানুষ খারাপ বলবে তো।”

বনফুল কেঁদেকেটে একাকার হলো। আবার তুহিনকে জাপ্টে ধরতে গেলে বেশ শব্দ করে একটা চ ড় পড়ে তার গালে। মুহূর্তেই হৈচৈ এ পরিপূর্ণ পরিবেশটা আবার চরম গম্ভীরতায় নিমজ্জিত হলো। সুখের খামে কেমন করে যেন দু মুঠো বিষাদ নিয়ে এলো গোপন করে! যে বিষাদ হঠাৎ করেই বদলে দিতে যাচ্ছে কতো গুলো সুন্দর সম্পর্কের চিত্র।

বনফুল হতভম্ব চোখে চ ড় দেওয়া মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার হৃদয় মাঝে খোদাই করা গভীর বিশ্বাসে কে যেন তাচ্ছিল্যের আচড় কেটে গেলো। কে যেন বনফুলকে শুনিয়ে গেলো ভাগ্যের নির্মমতার গল্প। বনফুল নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো তার চির পরিচিত তুহিন ভাইয়ের অপরিচিত মুখমন্ডলের দিকে! সদা কোমল মুখশ্রী আজ কেমন হিংস্র! কেমন বিরক্ত চুইয়ে পড়ছে তার শরীর ভেদ করে! এই তুহিনকে তো বনফুল চেনে না। এই তুহিন বড্ড অচেনা, বড্ড অপরিচিত। বনফুলের গায়ে হাত তুলতে পারে এমন তুহিনকে তো বনফুল কখনো চেনে নি! তবে আজ এ কেমন অপরিচিত দুঃখ এঁকে গেলো পরিচিত মুখ?

গম্ভীর এই পরিবেশে ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করলো চিত্রা। অসম্ভব সম্মান করা বড়ো ভাইয়ের বুকে আনমনেই সে ধাক্কা দিলো। বেশ জোরে চিৎকার দিয়ে বললো,
“ভাইজান! তুমি বনফুলকে মারলে!”

তখনো কারো বিশ্বাস হচ্ছিলো না তুহিন নামক ছেলেটা এত নির্মম হতে পারে! এত পাষাণ হতে পারে! বোনের চিৎকার স্তম্ভিত ফিরে পেলো ভাই। ফ্যালফ্যাল নয়নে বনফুলের দিকে তাকালো। অপরাধবোধ তখন তার শিরায় শিরায় শুরু করলো আন্দোলন। সে কেমন করে এত নিষ্ঠুর হলো? অষ্টাদশীরা ভালোবেসে নাহয় একটু অবুঝ হয় তাই বলে সেও নিজের বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে অষ্টাদশীর আবেগে গভীর ক্ষত করবে! তেমন ছেলে তো সে ছিলো না।

ঠিক এই মুহূর্তের অনাকাঙ্খিত চড়টা কেবল বনফুল না, আয়েশা খাতুনের সম্মানের গায়েও যেন খুব গোপনে আঁচড় কেটেছে যার ফল স্বরূপ ঠান্ডা আয়েশা খাতুন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। ছুটে গিয়ে এলোপাথাড়ি হাত চালান মেয়ের মুখে, পিঠে। বনফুল এখন নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। যেন চির পরিচিত চঞ্চলতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কথা বলা অঙ্গ গুলো গভীর আলস্যে লুকিয়ে গেছে কোন এক সীমানায়। বাক্য গুলো দলবল নিয়ে হয়তো হারিয়ে গেছে দিগন্তে। তারা আর বনফুলের কণ্ঠ খসে বের হবে না। তারা আর সুর তুলে জানান দিবে না আবেগ অনুভূতির।

বাহার আগলে দাঁড়ালো বোনকে। বনফুল তখনো চুপ। সকল ভাষা হারিয়ে মেয়েটা যেন নিঃস্ব। বাহার মায়ের হাতটা নিজের বিশাল হাতের মুঠোয় নিলো, সাবধানী কণ্ঠে বললো,
“মা থামো, ওর লাগছে।”

“লাগুক ওর। লাগুক। এমন মেয়ে আমি পেটে ধরে ছিলাম? এমন মেয়ে? যে মেয়ে কি-না আমার সম্মান মাটিতে পিষে দিয়েছে?”

আয়েশা খাতুনের রাগান্বিত কণ্ঠের নিচে কেমন যেন চাপা অভিমান। মেয়ের ধ্বংসাত্মক রূপ মানতে না পারার ভাষা গুলোই অভিমান হয়ে জমে গিয়েছে বোধহয়। বাহার অভিজ্ঞ ব্যাক্তির মতন মায়ের জ্বলন্ত কথার বিপরীতে উত্তর দিলো,
“সম্মান নিয়ে ভাবছো আম্মা? ব্যাথা নিয়ে ভাবছো না? তোমার বনফুল ভেঙে পড়েছে, তাকে আর ভেঙো না। তাকে যে তুলতে হবে, বাঁচাতে হবে। এই মুহূর্তে সম্মান আমাদের জরুরী না।”

“মরে যাক ও, মরে যাক। আমি চাই না এমন মেয়ে।”

“মরে গিয়েছে ও, আম্মা। মরে গিয়েছে। এবার এখান থেকে চলো।”

আয়েশা খাতুন দুই হাত জোর করে তুহিনের সামনে দাঁড়ালো। চোখ মুখ তার হুট করে ভীষণ শক্ত হয়ে উঠলো। কণ্ঠ চওড়া করে তুহিন ও বাকিদের উদ্দেশ্যে বললো,
“আমার মেয়ে ছোটো, ভুল করেছে। ক্ষমা করবেন। আশা রাখি, এই ভুল আর কখনো নতুনত্ব লাভ করবে না। ও তোমার মুখও দর্শন করবেন না, বাবা। আমি কথা দিলাম।”

মুনিয়া বেগম এগিয়ে এলেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“ছিঃ ছিঃ ভাবী, ছোটো মানুষ ভুল করেছে এসব বলছেন কেন? বরং আমরা দুঃখীত তুহিনের আচরণে।”

আয়েশা খাতুন আর কথা বললেন না। তুহিনের খুব ইচ্ছে হলো একটু ক্ষমা চাইতে, বনফুলের ভেঙে আসা মুখশ্রীতে হাত বুলিয়ে চির শান্তি দিতে কিন্তু সে পারলো না। সত্যিই সে কখনো বনফুলকে ভালোবাসেনি, তবে মেয়েটার ভালো চেয়েছে সবসময়। আজ সে নিজেই বড্ড কঠিন আচরণ করে ফেলেছে মেয়েটার প্রতি, অথচ সে তো এমন না!

আয়েশা খাতুন আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেয়ের হাত টানতে টানতে চলে গেলো ফ্লাটের বাহিরে। চলে গেলো বাহারও। পেছনে রেখে গেলো আরেক অষ্টাদশীর আবেগ।

সওদাগর বাড়ি নিশ্চুপ। অথচ কোলাহল চারপাশে। সামনের সেই পরিচিত বেশ পুরোনো ছোটো বাড়িটা থেকে ভেসে আসছে কেমন চিৎকার! ভেঙে যাওয়া মেয়েটা কাঁদছে। অসহায় সেই কান্নার স্বর। চিত্রা তার রুমের বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে আছে সেই বাড়িটার দিকে। অসহায় তার দৃষ্টি। এমন ভেঙে যাওয়া দৃশ্য সে নিজ চোখে দেখলো অথচ জোরা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। এখন হয়তো বনফুল নামের ফুলের মতন মেয়েটা আর বারান্দা দিয়ে চিতাবাঘ বলে ডাকবে না! ফুল যে আজ চরম আঘাতে মূর্ছা গেছে। তুহিন নামক মানুষটা কোমল ফুলকে পিষে ফেলেছে পায়ের আঘাতে। এই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সামলে উঠতে পারবে মেয়েটা? মেয়েটার উড়তে পারার ডানা গুলো আজ যেন কেউ ভেঙে ফেলেছে। আর উড়তে পারবে মেয়েটা!

সন্ধ্যা হয়ে আসে। চির পরিচিত অলিগলি আজ নিশ্চুপ হয়ে রইলো। পাশের বাড়ির ছাঁদ থেকে অষ্টাদশীর খিলখিল হাসি ভেসে এলো না, চিলেকোঠা থেকে ভেসে এলো না গিটারের সুর। চিত্রা তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ে। চোখ মেলে অনাকাঙ্খিত গাড়ির সুরে। বারান্দায় গ্রিলে হেলে থাকা মাথাটা নাড়িয়ে তাকায় পথ পানে। বাহার ভাইদের রঙচটা বাড়ির কোল ঘোষে চলে যায় গাড়ি তার রঙিন বাতি মেলে। অ্যাম্বুলেন্সের ভয়ঙ্কর শব্দে চিত্রার বুক কাঁপে। চিত্রার হৃদকম্পন আরেকটু বাড়িয়ে দিতে দৃষ্টিতে পড়ে বাহার ভাইদের কাঠের দরজায় বিরাট তালাখানি। ঘড়ির কাঁটা শব্দ তুলে জানান দেয় রাত প্রায় মধ্য। এত রাতে বাড়িটা খালি করে হসপিটালে কেন গেছে মানুষ গুলো? অপ্রত্যাশিত ভাবনায় বুক কাঁপে চিত্রার। মেয়েটা ভুল করে বসেনি তো?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে