#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা
[৮]
ল্যাম্পপোস্টের নিবিড় আলো ছুঁয়ে দিচ্ছে ক্লান্ত মানুষের ভেঙে আসা দেহকে। ভিজে রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের রঙিন আলো প্রতিফলিত হয়ে কেমন ঝলমল করছে! মনে হচ্ছে আকাশের অগণিত তারা হামাগুড়ি খাচ্ছে রাজপথে। লাল, নীল, কালো বিভিন্ন রকমের ছাতার মেলা মানুষের হাত জুড়ে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার উপায়ই এটা। সেই যে বিকেল থেকে হুটহাট বিজ্ঞাপন বিহীন বৃষ্টি এলো এরপর আর থামাথামির নাম-ই নেই! বাহার ব্যস্ত পায়ে বিশ্রাম হীন রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে। আজকে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল যার জন্য টিউশনি করাতে যেতে বেশ দেরি হয়ে গেছে আর পড়ে গেছে অনাকাঙ্খিত বৃষ্টির মুখে।
বাহারের কালো শার্টটা বৃষ্টির ছাঁটে প্রায় বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছে। সুন্দর, লম্বা চুলগুচ্ছ দিয়ে শিশির বিন্দুর ন্যায় পানি পড়ছে। বাহার চুল গুলো ঝাড়তে ঝাড়তে শান্ত নিরিবিলি রাস্তার বেশ কিনারে টং দোকানটার সামনে দাঁড়ালো। এই রাস্তাটা কিছুটা আলো আঁধারের মিশেলে ধোঁয়াশা চাদর জড়িয়ে আছে। বৃষ্টির দাপট ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাহার হাত ঘড়িটার দিকে তাকালো। বৃষ্টিতে ভিজে সেটা সাড়ে পাঁচটার দিকে গিয়ে যে থেমেছে, আর নড়চড় হয় নি। অথচ প্রকৃতি থেকে বুঝা যাচ্ছে এখন কমপক্ষে সাতটা কিংবা সাড়ে সাতটা বাজছে। বাহার ঠোঁট উঁচু করে বিরক্তের শ্বাস ফেললো। চিত্রা মেয়েটার দুদিন পর পরীক্ষা অথচ সে পড়াতে যাচ্ছে না, মেয়েটা যে একটু পড়তে চায় না তাকে ছাড়া সেটা তো তার বেশ ভালো জানা।
“আমার কথা ভাবছেন নাকি, বাহার ভাই?”
বাহার চমকালো মেয়েলি কণ্ঠে। তাও পরিচিত অঙ্গনার কণ্ঠ৷ চমকে সে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে চিত্রার প্রাণ খোলা হাসি বিশিষ্ট মুখ। মেয়েটা লাল টকটকে ছাতাটা মাথার উপর ধরে রেখর কী সুন্দর হাসছে! বাহার অবাক কণ্ঠে বললো,
“তুমি, এখানে কেন? ভর সন্ধ্যা বেলা?”
চিত্রা হাতের খোলা ছাতাটা বন্ধ করতে করতে বললো,
“এসেছিলাম ইট্টু গিফট্ কিনতে।”
বাহার রাশভারি কণ্ঠে ধমক দিয়ে বললো,
“ইট্টু আবার কী শব্দ? ওটা একটু হবে।”
“আমি ইট্টুই বলবো। শব্দটা কী সুন্দর না বলেন? আমার মতন মিষ্টি।”
বাহার মেয়েটার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো কিন্তু এতে চঞ্চল চিত্রার কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। সে আগের ন্যায় দুলতে দুলতে বললো,
“আমাকে বকতে ইচ্ছে করছে? বকে ফেলুন তাহলে। আমি মাইন্ড খাবো না।”
“আবার উল্টোপাল্টা বাক্য বলছো। মাইন্ড খাবো না আবার কী?”
“উফ্ বাহার ভাই, আপনি না সবসময় টিচার টিচার ভাব দেখান। কেন আপনি টিচার ভাব দেখাবেন? আপনি তো বাহার ভাই, আপনি আমার সিনিয়র, আপনি কথায় কথায় হাসবেন, প্রশংসা করবেন, তা-না আপনি কথায় কথায় দেন ধমক।”
“চিত্রা!”
বাহারের ধমকের বিপরীতে চিত্রা গাল ফুলিয়ে বললো, “আবার ধমক দিলেন।”
বাহার এবার নিজেই হেসে দিলো। মেয়েটা দিন দিন একটু বেশিই দুষ্টু হচ্ছে। বাহারকে হাসতে দেখে চিত্রা আনমনে বললো,
“জানেন বাহার ভাই, কাল আপনাদের বাড়িতে মেয়েটাকে দেখে আমি এক মুহূর্তের জন্য ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম এবার বুঝি বাহার ভাইকে চিরতরে হারালাম। বুকের ভিতর সে-কি ব্যাথা! আমার ছোট্টো জীবনের এত বড়ো ব্যাথা কখনো হবেন না তো? কথা দেন।”
বাহারের দৃষ্টি তখন ভেজা পথের দিকে। যে পথের বক্ষে বৃষ্টি খুব মোলায়েম গতিতে নৃত্য করছে। চিত্রা হাত বাড়িয়ে রাখলো তৃষ্ণার্ত নয়ন জোরা মেলে। তার মনে একটা বিশ্বাস ছিলো, বাহার হয়তো কথা দিবে। কিন্তু চিত্রার অষ্টাদশী মনকে ভীষণ বাজে ভাবে ভেঙে দিয়ে বাহার ভাই কথা দিলেন না। বরং পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। চিত্রা দেখলো, প্রতিবার ধোঁয়ায় চিত্রার দুঃখ গুলো উড়ছে। বাহার নামক মানুষটাকে ভালোবেসে সে কত দুঃখেরই না ভাগীদার হলো!
চিত্রার বাড়িয়ে রাখা হাত একই অবস্থানে থাকতে থাকতে ঝিমঝিম করে উঠলো। অবশ হয়ে এলো রক্ত সঞ্চালন করা রগ গুলো। মেয়েটার বুক ভার করে অভিমান হলো। অবশ হাতটা তার স্থায়িত্ব আর টিকিয়ে রাখতে না পেরে যেই না পড়ে যেতে নিলো ঠিক সেই মুহূর্তে চিত্রা অনুভব করলো তার হাতে নরম, ভেজা কিছুর আদুরে ছোঁয়া। চিত্রা পূর্ণদৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই দেখলো বাহার নামক গুরু-গম্ভীর মানুষটা তার হাতে এক গোছা কদম গুচ্ছ তুলে দিয়েছে। আর নিজের সুবিশাল হাতটা দিয়ে চিত্রার সেই অবশ হওয়া হাতটা ধরে রেখেছে। যেন চিত্রার ভালোবাসার হার কিছুতেই হতে দিবে না মানুষটা। চিত্রা হাসলো। বাহার সিগারেটে টান দিয়ে মেঘের মতন ধোঁয়া গুলো আকাশে উড়িয়ে দিতে দিতে বললো,
“তোমার অনুভূতি যেখানে শেষ, ঠিক সেখান থেকে এই বাহারের অনুভূতি শুরু রঙ্গনা। যে অনুভূতির দৈর্ঘ্য প্রস্থ হিসেব করতে গেলে ভালোবাসাও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। কেবল বেকারত্ব নামক ছোটো একটা থলে সেই বিরাট অনুভূতি দমিয়ে রেখেছে তবে দাফন করতে পারে নি। শোনো মেয়ে, ঠিক যতটুকু গিয়ে তুমি ক্লান্ত হবে, তারপর থেকে আমি আছি। বৃষ্টির দিনে তোমার শুদ্ধতম অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিলাম আমি একগুচ্ছ কদমের বিনিময়ে। শুনো মেয়ে রঙ্গনা,
যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…
যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায় ।
যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি ।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…”
চিত্রা অপলক তাকিয়ে রইলো এলোমেলো, বখাটে বাহারের দিকে। কী মিষ্টি তার প্রেমের বহিঃপ্রকাশ!
_
বিক্ষিপ্ত নয়ন জোড়া নিয়ে বনফুল তাকিয়ে আছে পথের দিকে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি তার অকৃপণ হাতে নিজেকে দান করছে। প্রকৃতির এক প্রলয়ঙ্কারী রূপ যেন দেখছে সে। অথচ তুহিন নামক লোকটার আসার কোনো খবর নেই! মানুষটা যে কখন আসবে কে জানে? তাকে দেখার জন্য যে ছোটো মনটা উথাল-পাতাল ঢেউ তুলে সেটা কী মানুষটা কখনো জেনেছে! বুঝেছে!
টেবিলের সামনে মোমবাতি ঝড়ের দাপটে কিছুটা নিভু নিভু হয়ে আসছে। বনফুল তাকিয়ে আছে জানালা ভেদ করে হালকা আলো মাখানো পথের দিকে। চোখে-মুখে তার তীব্র অপেক্ষা। বনফুলের সেই এক ধ্যানের অপেক্ষার মাঝে ঘরে শব্দ হলো। বনফুল কিছুটা চমকে ভেতরে তাকাতে দেখলো নোঙর নামক বাহার ভাইয়ের বান্ধবীটা ঘরের পর্দা খুলে জানালাটা লাগিয়ে দিচ্ছে। বনফুল ভ্রু কুঁচকালো। বৃষ্টি এলে সে সারা ঘরের জানালা খুলে রাখতে পছন্দ করে। কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে যায় রুমটা! তার বেশ শান্তি লাগে সেই শীতল রুমটা। মনে হয় স্বর্গ এসে দাঁড়িয়েছে তার দুয়ারে৷ অথচ নোঙর আপু কি-না তার এই সুখে এমন দেয়াল টেনে দিলো! নিজের ছোটোখাটো রুমটাতে এই অপরিচিত মেয়েটার আধিপত্যটা বেশ বিরক্তই লাগলো বনফুলের। কাল ভাইয়ার আদেশে মেয়েটাকে নিজের ঘরে থাকতে দিয়েছিল। কয়েকটা দিনের জন্য নাকি বেড়াতে এসেছে সে। তাই বনফুলের ঘরই হলো তার ঠিকানা। এ বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর রুমটাই বনফুলের রুম। কিছুটা মাঝারি আকারের রুম। দেয়ালে সুন্দর সুন্দর ডিজাইন আঁকা। পুরোনো দিনের কারুকার্য শোভিত একটা কাঠের আলনা আর খাট আছে যা সদা পরিপাটি থাকে আর সুন্দর একটা পড়ার টেবিল ও দুটো চেয়ার আছে। পুরো ঘরে জিনিসপত্র বলতে এতটুকুই আর একটা বিশাল আয়না লাগিয়েছে মেয়েটা নিজ উদ্যোগে তাও ভীষণ সুন্দর ডিজাইন করা রঙ দিয়ে। তার ঘরটাকে সে নিজ অবস্থানে সর্বোচ্চ সুন্দর রাখার চেষ্টা করেছে। আর সেই প্রিয় রুমে আরেকজন নিজের নাক গলাচ্ছে সেটা কারই বা পছন্দ হবে? তবে বনফুল মেয়েটা ভীষণ ঠান্ডা মেজাজের ও ভদ্র বলে মুখের উপর কাউকে কিছু বলে না। যেমন এখন জানালা আটকে দেওয়াতেও বললো না। কেবল নিরবে একবার সেদিকে তাকিয়ে আবার রাস্তায় ধ্যান দিলো।
নোঙর মেয়েটা বিছানা ঝাঁট দিতে দিতে বনফুলের উদ্দেশ্যে বললো,
“বনফুল, তোমার কাছে কোনো উপন্যাসের বই আছে?”
বনফুল রাস্তার দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো, “না।”
“একটাও নেই?”
“না আপু।”
মেয়েটা হতাশার শ্বাস ফেললো, চট করেই কিছু মনে পড়তে বললো,
“বাহার ভাইয়ার আছে?”
বনফুল এবার তাকালো নোঙরের মুখ পানে। সাদামাটা একটা মেয়ে নোঙর, গালে, কপালে রয়েছে অসংখ্য দাগ অথচ কণ্ঠটা ভীষণ মিষ্টি। বনফুল হুট করেই বলে উঠলো,
“তুমি গান গাইতে পারো তাই না?”
নোঙর বোধহয় কিছুটা চমকালো। বেশ প্রশংসা করে বললো,
“তুমি কীভাবে বুঝলে বলো তো?”
বনফুল বিজ্ঞদের মতন করে বললো, “আমি সব বুঝি। এবার বলো তো তুমি গান গাইতে পারো কি-না?”
নোঙর প্রশ্নের উত্তরে উপর-নীচ মাথা নাড়ালো, যার অর্থ সে পারে। বনফুল যে-ই না আবদার করবে তাকে যেন গান শুনানো হয় ঠিক সেই মুহূর্তে রিকশার সুমধুর সুর তার কানে ঠেকলো। অপেক্ষা শব্দা ভীষণ মিষ্টি যখন আমরা জানি অপেক্ষা তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিন্তু যদি এটা অনির্দিষ্টকালের জন্য হলেই গলার কাঁটা হয়ে যায়।
নোঙরকে কিছু বলতে না দিয়েই বনফুল ছুটে চলে যায় নিচে। নোঙর অবাক চোখে কেবল তাকিয়ে থাকে।
_
সওদাগর বাড়িতে বসেছে রাতের খাবারের আয়োজন। বিশাল বড়ো টেবিলের এককোণ হতো অপর কোণা অব্দি মানুষে পরিপূর্ণ। সওদাগর বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর নিয়ম তারা রাতের খাবার সকলে একসাথে খায়। এই নিয়ম কখনো এলোমেলো হয় নি আর হবেও না। তবে আজ চিত্রা বাহির থেকে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল যার দরুন সবাই তাকে ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে গেছে। অবশেষে তুহিন ভাই যখন ডাকলো তারপর মেয়েটা উঠলো। ঘুম ঘুম চোখে টেবিলে এসে বসতেই সবার খাওয়া শুরু করলো।
নুরুল সওদাগর ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে প্রায় ঠেস মেরেই বললেন,
“তোমার বোধহয় স্বভাবেই সময়ের কাজ সময়ে না করা। অদ্ভুত মেয়েছেলে।”
চিত্রা আঁড়চোখে বাবার দিকে তাকালো। মুনিয়া বেগম মাছের বাটিটা নিয়ে স্বামীর পাশে দাঁড়ালেন। কিছুটা ফিসফিস করেই বললেন,
“তোমার সবসময় এমন না করলে চলে না?”
নুরুল সওদাগর জবাব দিলেন না। চিত্রাও ঘুম ঘুম চোখে ভাত মুখে তুললো। মুনিয়া বেগম মাছের বিরাট মাথাটা স্বামীর পাতে দিতে নিলেই নুরুল সওদাগর হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আমাকে মাছের পেটি দেও। মাথা খাবো না রাত করে।”
মুনিয়া বেগম অবাক হলেন, অবাক কণ্ঠে বললেন, “কবে থেকে তুমি আবার পেটি খাওয়া শুরু করলে?”
নুরুল সওদাগর বোধহয় বিব্রতবোধ করলেন স্ত্রীর কথায়, তাই কিছুটা মিছে মিছে রাগ দেখিয়ে বললেন,
“দিলে দেও না দিলে যাও।”
চিত্রা বেশ উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
“তবে মাথাটা আমাকে দেও, মা।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ খাও, মাছের মাথা খাও তবুও আমার মাথা খেও না৷”
বাবার ধমকে চিত্রা আবারও চুপ হয়ে গেলো। তুহিন বিরক্ত চোখে একবার বাবার দিকে তাকালো। আর কোনো কথা হলো না। চিত্রা খাবার শেষ করে উঠার সময় বাবার হাতে একটা বক্স এগিয়ে দেয়। মিনমিন কণ্ঠে বলে,
“হ্যাপি বার্থডে আব্বু।”
নুরুল সওদাগর মেয়ের দিকে অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। চিত্রা ততক্ষণে চলে গিয়েছে নিজের ঘরে। নুরুল সওদাগর বক্সটা খুলে দেখলেন সিলভার কালারের বেশ সুন্দর একটা ঘড়ি। নুরুল সওদাগর তা দেখে আহ্লাদে মেতে উঠলেন। মুনিয়া বেগমকে দেখিয়ে কেমন বাচ্চামো করে বললেন,
“দেখেছো মুনি, দেখেছো, মেয়েটা কেমন অবাক করে দিলো। তোমরা তো মনেও রাখো না আমার জন্মদিনের কথা। মেয়েটা কেমন পা গ লি, দেখলে?”
#চলবে