#প্রেমে_পড়া_বারণ
#পর্ব_১৭ (শেষপর্ব)
# Taslima Munni
রানওয়েতে দেখলাম বিমানগুলো বাঁকা হয়ে আছে।
একটু পরেই বুঝতে পারলাম বিমানগুলো বাঁকা হয়ে নেই।আমাদের বিমানটাই বাঁকা হয়ে আছে!!
ল্যান্ডিং এর চেষ্টা করছে কিন্তু ল্যান্ড করতে পারছে না।
কখনো নিচে নামছে কখনো উপরে উঠছে।আবারও একটা ঝাকি দিলো।
বুঝতে পারলাম পাইলট নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। কি হতে যাচ্ছে ভেবেই কলিজ্বা শুকিয়ে গেছে। রেহানের হাত আঁকড়ে ধরলাম।
– রেহান, কি হচ্ছে!?
– বুঝতে পারছি না।
মনে কতশত ভয় ভীড় করছে। মনে পড়লো কিছুদিন আগেই ত্রিভুবনের বিমান দুর্ঘটনার কথা।
কি হবে??!!!
আমরা কি ফিরতে পারবো না?
ইতোমধ্যে সব যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছো।কেউ কেউ কান্নাকাটি শুরু করলো।
উফফ!!
কি হতে যাচ্ছে একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন।
আমাদের সব স্বপ্ন কি এখানেই মিশে যাবে?
আব্বু,আম্মু,ফুপি,দিয়া,আরিফ, মাহি আপু!…..
কাউকে আর দেখতে পারবো না?!
ভাবতেই আমার কান্না পাচ্ছে। আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম।
রেহান শক্ত করে ধরে রেখেছে।।
– হিয়া,ভয় পাস না।আমি আছি না তোর সাথে। কিছু হবে না, দেখিস।
আমাকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য রেহান এগুলো বলছে। ও নিজেই জানে না কি হচ্ছে যাচ্ছে!!
দীর্ঘ তিনঘন্টা বিমানটি আকাশে ঘুরেছে।
তিন ঘন্টা পরে পাইলট অনেক কষ্টে ল্যান্ড করাতে সক্ষম হয়।ল্যান্ড করার সময় অত্যন্ত বিপদজনক ছিলো। সবাই কমবেশি আহত হয়েছে। কিন্তু সবাই বেঁচে গেছি এটাই সবচেয়ে বড় কথা।
ল্যান্ড করার সাথে সাথে বিমানের একটা অংশে আগুন ধরে গেছে।
দ্রুত যাত্রীদের নামানো হচ্ছে। ভাগ্যিস ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রস্তুত ছিলো। বড় ধরনের ব্লাস্ট হবার আগেই আগুন নিভিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়।
আমরা বেঁচে ফিরেছি।আনন্দেও কান্না আসে।সবাই কাঁদছে, বেঁচে ফেরার আনন্দে কাঁদছে। বাসার সবাই এখানে চলে এসেছে।
আমাদের পেয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো।।
অভিজ্ঞতাটা অনেক ভয়াবহ ছিলো।।
অনেক দিন পর্যন্ত ভুলতে পারিনি।
অনেক গুলো দিন কেটে গেছে।
আমি একটা কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করলাম।
এদিকে মাহি আপু বাসায় এসেছে।
কিছু দিন ধরে খেয়াল করছি মাহি আপুর মুড অফ হয়ে আছে।
একদিন জিজ্ঞেসই করে ফেললাম।
– আপু।
– আরে হিয়া,ভিতরে আয়।।
আপুর পাশে গিয়ে বসলাম।
– তোমার কি হয়েছে?
– কই? কিছু হয়নি তো!
– আমি খেয়াল করছি তোমার মন ভালো নেই। আমাকেও বলবে না?
আপু কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো
– রিয়াদের সাথে আমার কিছু সমস্যা হয়েছে।
– কি হয়েছে?
– রিয়াদ চায় না আমি এখানে থাকি। আমার পোস্টিং এখানেই হয়েছে। কিন্তু ট্রান্সফার হয়ে যেতে কমপক্ষে একবছর লাগবে।
এসব নিয়েই।
– ওহহ…।
আপু, তুমি রিয়াদ ভাইয়ার সাথে বসে কথা বলো।সামনাসামনি কথা বলা জরুরী। ভাইকে বুঝিয়ে বলো। একটা বছরের ব্যাপার। ভাইয়া ঠিক বুঝবে।
– হুমম।
আপু মিষ্টি করে হাসলো। মাহি আপুকে গোমড়া মুখে মানায় না। আপুর হাসি মুখটা যেন সবসময় থাকে।
সময় যেন স্রোতের মতো বয়ে গেছে। সংসারের মায়াজালে জড়িয়ে পাঁচটা বছর কেটে গেছে।
মাঝে মধ্যে আফরিনের কথা মনে পড়ে।
আফরিন ভাগ্যে বিশ্বাস করে।
বলেছিলো – রেহান তোমার হবে বলেই আমার হয়নি।।
কথাটা কানে বাজে।
মাঝেমধ্যে মনে হয় রেহান বদলে গেছে। কিন্তু আসলেই কি বদলে গেছে?
না। রেহানের ভালোবাসা একটু কমেনি।
আরও বেড়েছে। আমাকে ছাড়া রেহান কতটা অসম্পূর্ণ সেটা আমি জানি।।
ব্যস্ততা বেড়েছে দুজনেরই।ভালোবাসা প্রকাশের ধরনটা হয়তো একটু বদলে গেছে। কিন্তু ভালোবাসা একবিন্দুও কমেনি।
রেহানের ভালোবাসায় আমার জীবন পূর্ণ হলেও আমাদের জীবনটা শূন্য পড়ে আছে।
নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
রেহান কোনো দিন কিচ্ছু চায়নি আমার কাছে। শুধু একটা পরী চেয়েছিলো।
একটা ছোট্ট মিষ্টি পরী।যে ছোট ছোট পায়ে সারাবাড়িতে হেঁটে বেড়াবে। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখবে।।
কিন্তু পাঁচ বছর কেটে গেছে। আমাদের কোনো পরী আসেনি। অদ্ভুত শূন্যতায় আমার ভেতরটা খাঁ খাঁ করে।
রেহান মুখে কিছু না বললেও আমি বুঝি ওর ভেতরের শূন্যতা।
সবকিছু থেকেও যেন কিছুই নেই আমাদের।
কত ডাক্তার! কত কিছু করলাম। কিন্তু….
সেদিন আমার দুই-তিন জন কলিগ তাদের বাচ্চাদের নিয়ে কথা বলছিলেন।
আমি শুধু শুনছিলাম। আমি কার গল্প শুনাবো?
আমার অস্বস্তি হচ্ছিলো। বেরিয়ে আসলাম।
ফোনটা আমার টেবিলে ফেলে এসেছি।
হঠাৎ মনে হলো রেহানকে একটা ফোন দেই।আজ আর ক্লাস নিতে ইচ্ছে করছে না।
রেহানকে বলি এসে নিয়ে যেতে।দূরে কোথাও ঘুরে আসবো।
রুমে ঢুকতে গিয়ে শুনি
– যার সন্তান নেই সে কি করে বুঝবে সন্তানের মর্ম।
– হুম। দেখলেন না কেমন উঠে চলে গেলো!!
– এইজ ডিফারেন্স বেশি হলে এমনই হয়।
– আমরা বাচ্চাদের নিয়ে কথা বললে খেয়াল করে দেখবেন যেন জ্বলে পুড়ে মরে যায়! আসলে জেলাস! নিজের নেই তো।
আমার চোখ ভিজে গেছে। ওখান থেকে সরে আসতে চাইলাম, কিন্তু তার আগেই একজনের চোখে পড়ে গেলাম। আমাকে দেখে বিব্রত হয়ে গেলেন।
আমিও আর কিছু না ভেবেই রুমে ঢুকে আমার লকার লক করে ফোন আর ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
মানুষ এমন কেন হয়?!!
আমার শূন্যতা আমার কষ্ট ওরা দেখতে পায়??
মাহি আপুর দুই ছেলে- মেয়ে যখন আসে ফুপি ভীষণ খুশি হয়।মাঝেমধ্যে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
একদিন শুধু বলেছিলেন – আল্লাহ কবে মুখ তুলে চাইবেন!!
রাতে রেহান বেডে আসলো। আমি ওর আগেই চলে এসেছি। পাশ ফিরে শুয়ে আছি।
– আজ এতো আগেই বেডে? খাবাপ লাগছে?
রেহান মাথায় হাত রেখে বুঝতে পারে আমি কাঁদছি।।
– হিয়া… কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?
কি হয়েছে বল?
এবার আমার কান্নার যেন বাঁধ ভেঙে গেছে।।
রেহানের বুকে আমি অঝোরে কেঁদে যাচ্ছি।।
– হিয়া, মুখ তুল,তাকা আমার দিকে। বলবিনা কি হয়েছে?
– আমাদের একটা বাবু নেই কেন??কেন আসে না একটা পরী!?!!
রেহান আমার চোখ মুছে বললো
– কে কি বলেছে? বল।
– কেউ কিছু বলেনি।
– তুই মিথ্যা বলবি আমার কাছে? বল কি হয়েছে?
আমি কাঁদতে কাঁদতে রেহানকে বললাম।
– এই কলেজে তোকে থাকতে হবে না। দুইটা দিন অপেক্ষা কর।তোকে অন্য কলেজে ট্রান্সফার করাবো।
আর শুন,তুই কি বোকা?
আল্লাহ যখন চাইবেন তখন আমাদের বাবু আসবে। আল্লাহ যদি না চান আসবে না।
হয়তো দশ বছর পরেও দিতে পারেন। উনি যা করেন তা ভালো বুঝেই করেন।
এসব নিয়ে আর কোনো দিন মন খারাপ করবি না।। কথা দে।এখনই কথা দে।
– আচ্ছা করবো না।
– তোর পরী চাই?
– হুম।
পরম মমতায় বুকে আগলে নিলো রেহান।
পরদিন রেহান আমাকে এক যায়গায় নিয়ে গেলো।
একটা পুরনো জীর্ন ধরনের বাসা।
সেখানে এক বৃদ্ধা আমাদের ভেতর নিয়ে গেলেন।
– রেহান, আমরা এখানে কেন এসেছি?
-একটু অপেক্ষা কর।
অই বৃদ্ধা ভেতর থেকে কোলে করে একটা ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে এলো।
– মাগো, আমার মাইয়াডা বাঁঁচবো না।ওর জামাই ওরে ফালাইয়া বিয়া কইরা চইলা গেছে। একটা খোঁজ করে নাই। মাইয়া বাঁঁচবোনা ডাক্তার কইয়া দিছে।আমি বুড়া মানুষ। এই ৫ দিনের বাচ্চা পালমু কেমনে??
তুমি নিয়া যাও।
তোমার বাচ্চা আজকে থেইকা। ওরে বড় মানুষ কইরো।
আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। রেহানের দিকে তাকালাম। রেহান ইশারা করলো।
আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে কুলে তুলে নিলাম।
আমার পরী!!এটা আমাদের পরী!!
– রেহান!!
– তুই পরী চেয়েছিলিনা?
এটাই তোর পরী।
বুকে জড়িয়ে ধরলাম পরীকে….আমার বুকের শূন্য যায়গা টা পূর্ণ হয়ে গেছে।। রেহানের চোখেও পানি।
-এই আমার পরী, হিয় দেখ কিভাবে তাকিয়ে দেখছে আমাকে!!
———–The End———?
Osmvb valo laglo golpota
Comment nakore thakte parlamna, khub sundor hoise munni apu. Thanks, ato sundor golpo tomar jonno porte parlam.