প্রেমের হাতেখড়ি পর্ব-৩+৪

0
3103

#প্রেমের_হাতেখড়ি
#পর্ব:৩
#ফাতেমা_জান্নাত (লেখনীতে)

রাতের আধারে বেলকনিতে বসে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে জান্নাত।রাত বারোটা বাজে। এখনো চোখে ঘুম ধরেনি।তাই তো বেলকনিতে এসেছে।কাজের মেয়ে আহ্লাদী সিরিয়াল দেখছিলো। ড্রয়িংরুম এ এসে আহ্লাদীর সামনে গিয়ে দাড়াতেই চোখ তুলে তাকিয়ে জান্নাত কে বলে,

—কিছু লাগবো আপামণি?

জান্নাত একবার টিভির দিকে তাকায় এখনো সিরিয়াল চলছে টিভিতে। মেয়েটা একেবারে সিরিয়াল খোর।জান্নাত তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলে,

—আমাকে কপি করে দিতে পারবি?

—আপনি ঘরে যান।আমি নিয়ে আসছি আপামণি।

—আচ্ছা।

বলেই জান্নাত আবার নিজের ঘরে এসে বেলকনিতে দাঁড়ায়। প্রান্তিকদের বাড়ির বাইরে একটা লাইট জ্ব’লছে। সেই লাইটের আলোয় তাদের সেই দিকটা পুরো আলোকিত হয়ে আছে।

কিছুক্ষণ পরেই আহ্লাদী কপি নিয়ে এসে জান্নাতের হাতে দেয়।জান্নাতের পাশেই দাঁড়ায়। জান্নাত সেই দিকে তাকিয়ে বলে,

—রাত সোয়া বারোটা বাজে।ঘুমাবি না?

—ঘুম আসতেছে না আপামণি।

—তোর বাড়ির সবাই এখন কেমন আছে?

—আছে এখন আল্লাহর রহমতে ভালোই।আম্মা এখন ভালোই আছে।তাই বিকেলেই রওনা দিছি বাড়ি থেকে।আসতে আসতে আর কি রাত আটটা বাজি গেছে।

—ওহ!

বলেই জান্নাত চুপ করে গেলো। আহ্লাদী গেলো না।জান্নাতের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলো। দুই জনের মধ্যেই নিরবতা চলছে।হঠাৎ গাড়ির শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই দুই জনে বেলকনির নিচের দিকে তাকায়।পাশের বাসার দিকে কালো একটা গাড়ি এসে থেমেছে। পাশের বাসা তো প্রান্তিক দের বাসা।প্রান্তিক দের বাসার সামনেই গাড়িটা থেমেছে।

জান্নাত ভেবে কিছু বলবে তার আগেই আহ্লাদী চি’ৎকার করে বলে উঠে,

—চো’র আপামণি, প্রান্ত ভাইগো বাড়িত চো’র আইছে।

জান্নাত তব্দা খেয়ে যায়।চো’র মানে?কি বুঝাতে চাইছে আহ্লাদী। তাই আহ্লাদী এর দিকে তাকিয়ে বলে,

—মানে?কিসের চো’র? কই চো’র?

আহ্লাদী উৎকণ্ঠ হয়ে বলে,

—আপামণি এখনকার চো’ররা হাইফাই হয়ে মাইক্রো করে আসে।যাতে কেউ না বুঝতে পারে ও চো’র। প্রান্ত ভাইগো বাড়ির সামনে যেই গাড়ি থামছে।ওইটা চো’র গো গাড়ি।

জান্নাত অ’বাক হয়ে একবার গাড়ির দিকে তাকায়।আবার আহ্লাদীর দিকে তাকায়।গাড়ি থেকে এখনো কেউ বের হয়নি।তবে কি সত্যি এটা চো’র দের গাড়ি।

—আসলেই কি তাই?

আহ্লাদী আবার বলে উঠে,

—হ আপামণি। আমি যাই চো’র রে ধরতেছি।আপনে খালুজান রে নিয়ে আসেন।আজকে চো’রের গুষ্টি শুদ্ধ পুলিশে দিবো।

বলেই আহ্লাদী দৌড়ে চলে যায়।যাওয়ার সময় চো’র চো’র বলতে যায়।জান্নাত ও কপির মগটা বেলকনিতে রেলিং এর উপরে রেখে দৌড়ে যায় জুনায়েদ আজমীর ঘরের সামনে।

জুনায়েদ আজমীর ঘরের সামনে এসে দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করতেই জুনায়েদ আজমী উঠে এসে দরজা খুলে জান্নাত কে দেখে কিছু বলবে তার আগেই জান্নাত বলে উঠে,

—আব্বু পাবেল আংকেল দের বাসায় চো’র এসেছে।তাড়াতাড়ি চলো।

বলেই জান্নাত ছুট লাগালো।তার পিছনে জুনায়েদ আজমী ও ছুটতে লাগলো।রাহেলা ও ঘর থেকে মোবাইল টা নিয়ে তাদের পিছনে পিছনে ছুটে গেলো।

প্রান্তিক দের বাসার সামনে এসে দেখে কালো একটা গাড়ির সামনে চারটা ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।চারটার মুখেই মাক্স লাগানো। এবার আরো শিউর হয়ে গেলো এরা চো’র।

জুনায়েদ আজমী দৌড়ে গিয়ে ক্যাপ মাথায় দেওয়া একটা ছেলেকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বাকি ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলে,

—একদম পালাবি না।যেমন আচত তেমন দাঁড়িয়ে থাক।চু’রি করতে এসেছিস তাইনা?আজকে সব কটা কে পুলিশে দিবো।

বলেই জান্নাতের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,

—জান্নাত, তুই প্রান্তিক আর তোর পাবেল আংকেল কে ফোন দে তো।বল চো’র ধরেছি।তাড়াতাড়ি নিচে আসতে।

বলেই জুনায়েদ আজমী ধরে রাখা ছেলে টাকে আরো ঝাপটে ধরলো। আহ্লাদী একটা মোটা লাঠি নিয়ে বাকি তিনটা ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আগন্তুক চার ছেলের মাথার উপর দিয়েই সব কিছু যাচ্ছে।কি হচ্ছে তাদের সাথে এসব কিছুই বুঝতে পারছে না।

জান্নাত জুনায়েদ আজমীর কথা মতো পাবেল কে ফোন করেছে।কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছে না।তাই প্রান্তিক কে দিয়েছে।তিনবার রিং হতেই প্রান্তিক ফোন ধরে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে,

—এতো রাতে ফোন দেওয়ার মানে কি?কে আপনি?

জান্নাত প্রান্তিক এর কথার উত্তর না দিয়ে বলে,

—মিষ্টার ভুক্তভোগী টিউটর। চো’র ধরা পড়েছে।তাড়াতাড়ি নিচে আসুন। আপনাদের বাসার সামনে চো’র ধরেছি।

চো’রের কথা শুনতেই প্রান্তিক ঘুম থেকে লাফ মে’রে উঠে ফোন কানে রেখেই চো’র চো’র করে চিল্লিয়ে উঠে।

ওই দিকে প্রান্তিক এর চিল্লানিতে জান্নাতের কানের পর্দা ফেটে গেলো যেন।জান্নাত খেঁকিয়ে উঠে ফোনেই বলে,

—এই চুপ করুন। চো’র নিচে আপনাদের বাসার সামনে ধরা পড়েছে।তাড়াতাড়ি নিচে আসুন আংকেল কে নিয়ে।

বলেই ফোন কে’টে দেয়।পাবেল কে আরো দুই বার ফোন দিতেই তিনি ফোন রিসিভ করে।জান্নাত সব কিছু বলে উনাকে।

প্রান্তিক নিচে এসে দেখে জুনায়েদ আজমী একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছে।ছেলেটা নড়চড় করছে ছাড়া পাওয়ার জন্য।এবার প্রান্তিক ও গিয়ে ছেলেটা কে জড়িয়ে ধরে বলে,

—কিরে চো’র আমাদের বাসায় চু’রি করতে এসেছিস? এখন তো ধরা পড়ে গেলি।কি করবি এবার?

—প্রান্তিক আমাকে ছাড়।

হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠ কানের কাছে আসতেই প্রান্তিক থেমে যায়।তবে ছেলেটা কে ছাড়ে না।ছেলেটা কে উদ্দেশ্য করে বলে,

—এই চো’র তোর গলার আওয়াজ আমার বড় ভাইয়ার গলার আওয়াজ এর মতো কেন?ও তুই কণ্ঠ ও চেঞ্জ করতে পারিস বুঝি?

প্রান্তিক আরো কিছু বলবে ছেলেটা কে এর আগেই পাবেল এর কথায় থেমে যায়।চেঁচিয়ে বলে উঠে,

—প্রান্তিক প্রণয় কে ছাড়।তোরা ওকে এভাবে ঝাপটে ধরে আছিস কেন?

পাবেলের কথায় এবার প্রান্তিক ছেলেটা কে ছেড়ে দেয়।সাথে জুনায়েদ আজমী ও ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণ পিছন থেকেই ঝাপটে ধরে ছিলো।

ছেলেটা মাথা থেকে ক্যাপ আর মুখ থেকে মাক্স সরাতেই প্রান্তিক আর জুনায়েদ আজমী হাজার বো’ল্টের ঝট’কা খায়।প্রান্তিক তো অ’বাক হয়ে বলে,

—ভাইয়া তুমি?

এবার তো জান্নাত, রাহেলা আর আহ্লাদী ও অ’বাক হয়ে তাকিয়ে আছে।তারমানে এতক্ষণ তারা সবাই যাকে চো’র ভেবেছিলো সে চো’র নয়।শাহরিয়ার পাবেল এর বড় ছেলে?

পাবেল এগিয়ে এসে জুনায়েদ আজমীর কাছে দাঁড়ায়। প্রণয় এর দিকে তাকিয়ে বলে,

—কিরে চিনতে পারিস নি ওকে?ও আমার বড় ছেলে প্রণয়। শাহরিয়ার প্রণয়।

পাবেলের কথায় জুনায়েদ আজমী বলে,

—ওকে তো চিনতে পেরেছি। মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছিলো। তাই পিছন থেকেই ওকে না চিনে ছেপে ধরেছি ভেবেছিলাম চো’র টোর হবে।

জুনায়েদ আজমীর কথায় প্রণয় সালাম দিয়ে হেসে বলে,

—আমি বুঝতে পেরেছি আংকেল। তাইতো জোর দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করিনি।পরে যদি আপনি ব্য’থা পেতেন ছাড়াতে গিয়ে।ভাগ্যিস আমাদের দুই বাসা ছাড়া কোনো বাসার কেউ আসেনি।তাহলে মান সম্মান সব যেতো আজ।

প্রণয়ের কথায় পাবেল,জুনায়েদ আজমী হেসে দেয়।
।প্রান্তিক ভ’য়ে চুপ করে আছে।ভুল বুঝে ভাইকে চো’র ভেবে ঝাপটে ধরেছে।তার ইচ্ছে করছে এখন গিয়ে জান্নাতের মাথাটা ফাটিয়ে দিতে।দুই ভাই বোন আস্ত বেজা’ল।

পাবেল হেসে জুনায়েদ কে বলে,

—তা এই চো’রের খবর তোকে এত রাতে দিলো কে?একেবারে ছুটে এলি।

পাবেলের কথায় জান্নাত মুখ কাছুমাছু করে রাহেলার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাহেলা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে দেয়।

জুনায়েদ আজমী কিছু বলবে তার আগেই জান্নাত রাহেলার পিছন থেকেই বলে উঠে,

—আব্বু আমাকে আহ্লাদী বলেছে।তাই তোমাকে বলেছি ।

জান্নাতের কথায় আহ্লাদী সামনে এসে বলে,

—খালুজান আমি কালা গাড়ি দেখেই ভাবছি চো’র। এখনকার চো’র রা তো হাইফাই স্টাইলে আসে।তাই আরকি।

—চুপ থাক।গ’র্দভ কোথাকার যা বাসায় যা।জুরাইন একা বাসায়।

জুনায়েদ আজমীর কথাই আহ্লাদী এক দৌড়ে বাসায়।এতক্ষণে রাহেলার আড়াল থেকে বের হয়ে আসে জান্নাত।প্রান্তিক বাসার ভিতরে চলে যায়।রোকসানা (প্রণয়,প্রান্তিক এর মা)রাহেলার সাথে কিছু কথা বলে তিনি ও বাসার ভিতরে চলে যায়।জুনায়েদ আজমী পাবেলের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।প্রণয় ও বাকি তিনটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলছিলো।

জান্নাত ইতস্তত ভাবে প্রণয়ের পাশে গিয়ে বলে উঠে,

—শুনুন!

জান্নাতের কথায় প্রণয় জান্নাতের দিকে তাকায়।এতক্ষণ মেয়েটার দিকে তেমন ভাবে তাকায়নি। এখন জান্নাতের কথায় একটু মনযোগ দিয়ে তাকায়।প্রণয় জান্নাতের দিকে এক পলক তাকিয়েই অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়।তবে মেয়েটার পুরো মুখশ্রী এর মধ্যে নাকের ডগায় ঠিক মাঝখানের লালছে কালো তিলটা নজর কাড়া।মুখের দিকে তাকালে ওই তিলেই সর্বপ্রথম চোখ যায়।

—সরি!!

জান্নাতের পুনরায় কথায় প্রণয় সম্বিৎ ফিরে আসে।ভ্রুকুটি কুঁচকে বলে,

—সরি ফর হোয়াট??

—আসলে আমি বুঝতে পারিনি।তাই আব্বু কে বলেছিলাম আর আব্বু আপনাকে ইয়া ভেবে ঝাপটে ধরেছে তাই সরি।

—ইট’স ওকে।আপনার বাবা ঝাপটে ধরেছে।আপনি তো ধরেননি। তাই সমস্যা নেই।

বলেই প্রণয় হেসে বাসার ভিতরে চলে যায়।আর পিছনে রেখে যায় তার কথায় স্ট্যাচু হয়ে যাওয়া জান্নাত কে।

🌸🌸

—আপু আজকে তুই ভার্সিটি যাবি?

জুরাইন এর কথায় মোবাইল থেকে চোখ তুলে সেই দিকে তাকায় জান্নাত।স্কুলের ইউনিফর্ম গায়ে জুরাইন প্রশ্নাত্মক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।জান্নাত জুরাইন কে স্বগতোক্তি করে,

—কেন?কোনো প্রয়োজন তোর?

—গেলে আসার সময় আমার জন্য দুইটা লাল গোলাপ নিয়ে আসিছ।

—‘লাল গোলাপ দিয়ে তুই কি করবি? এই বয়সে লাল গোলাপের কি কাজ তোর’?

জান্নাতের কথায় জুরাইন বিরক্ত হলো।এত কেন প্রশ্ন করবে তাকে?তাই বিরক্ত নিয়েই খেঁকিয়ে উঠে বলে,

—আনতে বলেছি আনবি।এত কথা কেন বলছিস তুই?

জান্নাত ভাইয়ের কথায় এবার সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে বলে,

—সত্যি করে বল কি করবি গোলাপ দিয়ে।নয়তো আনবো না।

জুরাইন তেঁতে উঠে বলে,

—গোলাপজল বানাবো। তোর জামাই এর খাবারে গোলাপজল মিশিয়ে দিবো। যাতে ওয়াশরুমে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে যায়।তখন দেখবো কি করে আমাকে আর এত প্রশ্ন করিস তুই? বিরক্তিকর!

বলেই জুরাইন বাইরে গেলো জান্নাতের রুম থেকে।জান্নাত অ’বাক হয়ে ভাইয়ের যাওয়ার পানে চেয়ে আছে।এই তো ওপেন থ্রেড দিয়ে গেলো। একি আসলেই তার ভাই?আর জামাই আসলো কোথ থেকে?

🌸🌸

আহ্লাদী গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে জান্নাতের রুমে আসে।জান্নাত ড্রেসিংটেবিল এর সামনে বসে চুল আছড়াচ্ছে। আহ্লাদী এসে জান্নাতের পাশে দাঁড়ায়। জান্নাত সেই দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচু করে বলে,

—‘কী’?

—আপামণি একটা দরকার ছিলো?

জান্নাত এবার মুখে বলে,

—বল কি দরকার।

—আপামণি জসীম বেবি পাওডার আছে আপনার কাছে?

আহ্লাদী এর কথায় জান্নাত তার দিকে তাকায়।জসীম বেবি পাওডার?এই আবার কোন রকমের পাওডার? এই প্রথম শুনলো এই নাম।জান্নাত নিজেকে অ’বাক এর চূড়া থেকে বের করে এনে বলে,

—জসীম বেবি পাওডার টা আবার কিরে আহ্লাদী? এই নামে কোনো পাওডার এর নাম আজ শুনলাম।

জান্নাতের কথার বিপরীতে আহ্লাদী কিছু বলবে।তার আগেই জান্নাতের রুমে ঢুকতে ঢুকতে জুরাইন বলে,

—আপু ওটা জনসন বেবি পাওডার। আদি আপা জসীম বেবি পাওডার বলে।

জুরাইন এর কথা শুনে জান্নাত পেট ছেপে হাসতে লাগলো। জসীম বেবি পাওডার। আহ্লাদী না থাকলে হয়তো এমন আজব পাওডার এর নাম শুনা হতো না।

চলবে ইনশাল্লাহ✨🖤

#প্রেমের_হাতেখড়ি
#পর্ব:৪
#ফাতেমা_জান্নাত (লেখনীতে)

আজ চারদিন পর ভার্সিটিতে এসেছে জান্নাত।চার দিকে চোখ ভুলিয়ে তার বেস্ট ফ্রেন্ড ইশি কে খুঁজছে।প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত দুইজনে একসাথে পড়েছে।কলেজে দুই বছর দুই জনে আলাদা কলেজে পড়েছে।কিন্তু এখন ভার্সিটি তে আবার দুই জনে একসাথ হয়েছে।

হঠাৎ একটা জায়গায় জান্নাতের চোখ আটকে যায়।ইশি মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে একটা ছেলের সাথে কথা বলছে।জান্নাত সেইদিকে হেটে গিয়ে ইশির পাশে দাঁড়িয়ে সামনে থাকা ছেলেকে দেখে অ’বাক হয়ে যায়।ছেলেটা আর কেউ না ছেলেটা প্রান্তিক। জান্নাত তাকিয়ে বলে উঠে,

—মিষ্টার ভুক্তভোগী টিউটর আপনি এখানে?

ইশি জান্নাত আর প্রান্তিক এর দিকে তাকিয়ে আছে।প্রান্তিক ভাবলেশহীন ভাবে বলে,

—তো আমার ভার্সিটি আমি আসবো না নাকি?

—আপনার ভার্সিটি মানে?

প্রান্তিক বলার আগেই ইশি জান্নাত কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

—আরে জানু তোকে তো বলাই হয়নি।প্রান্তিক আমাদের সাথেই এই ভার্সিটি তে ভর্তি হয়েছে।প্রান্তিক আর আমি একই কলেজে পড়েছি।বলতে পারিস প্রান্তিক আর আমি ফ্রেন্ড ছিলাম । আর আমরা তিনজনে-ই ব্যাচমেট।কিন্তু তোরা দুই দুইজন কে চিনিস নাকি?

প্রান্তিক বলে উঠে,

—হ্যাঁ শুধু চিনি না।খুব ভালো করে চিনি।উনি তো প্রথম দিন ভার্সিটি তে এসেই আমাকে ইভটিজিং করেছে।

প্রান্তিক এর কথায় ইশি হা হয়ে যায়।জান্নাত তেঁতে উঠে বলে,

—একদম মিথ্যে কথা বলবেন না।কতবার বলেছি আমি ইভটিজিং করিনি।গান গেয়েছিলাম জাস্ট মজা করে।

—ওই একই হলো।

ইশি দুই জনকে চুপ করতে বলে,

—কি তখন থেকে দুই জনে আপনি আপনি করে ঝ’গড়া করে যাচ্ছিস। আজ থেকে তিনজনে ফ্রেন্ড। কোনো আপনি তুমি চলবে না।অনলি তুই।তুই-ই বেটার।

ইশির কথা শুনে প্রান্তিক বলে,

—ঠিক আছে।কিন্তু ওকে বলে দে আমাকে যাতে ভুক্তভোগী টিউটর না বলে।

—ঠিক আছে তাহলে আপনি ও থুক্কু তুই ও আমাকে ইভটিজার বলতে পারবি না।

জান্নাতের কথায় ইশি প্রান্তিক হেসে দেয়।প্রান্তিক হেসে বলে,

—ঠিক আছে।

—কিন্তু জান্নাত প্রান্তিক কে টিউটর কেন বলছিস?

ইশির কথায় জান্নাত বলে,

—প্রান্তিক জুরাইন এর নিউ টিউটর।তাছাড়া প্রান্তিক আর আমাদের পাশাপাশি বাসা।আবার প্রান্তিক এর আব্বু আর আমার আব্বু বন্ধু।আবার…

জান্নাত আর কিছু বলবে তার আগেই ইশি থামিয়ে দিয়ে বলে,

—থাম বইন।আর কোনো সম্পর্কের কথা জানতে চাই না।আর কোনো সম্পর্ক ভবিষ্যৎ এ তৈরি হলে আমরা দেখে নিবো নাহয় তখন।এখন থাম।

ইশির কথায় প্রান্তিক, জান্নাত হেসে দেয়।পরে একসাথে তিনজনে ক্লাসে চলে যায়। শ’ত্রু শ’ত্রু ও বন্ধু হয়ে যায়।যেমন প্রান্তিক আর জান্নাত। এতদিন দুইজন দুই জনকে ইচ্ছে মতো জ্বা’লাতো।আর আজ বন্ধু হয়ে গেলো।

🌸🌸

—প্রণয় ভাই রাফসান মির্জা জেনে গেছে আপনি বাড়িতে আসছেন। বাবা মায়ের সাথে থাকেন। আপনি সাবধানে থাকিয়েন বলা তো যায় না কখন আবার লোক পাঠায় তারা আপনাকে মা’রার জন্য।

—তুই চিন্তা করিস না।আমি সাবধানে থাকবো ইনশাল্লাহ। তোরা ও সাবধানে থাকিস। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাস।

—জি ভাই।

প্রণয় সজীবের সাথে কথা বলে ফোন রেখে দেয়।সজীব প্রণয়ের খুবই বিশ্বস্ত কাছের একজন। পার্টির যেকোনো কাজে বা যেখানেই যাওয়া আসা হয় সজীব প্রণয়ের সাথে যায়।সজীব প্রণয়ের পার্সোনাল গাড়ির ড্রাইভার। তবে প্রণয় কখনো তাকে গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে বিচার করে না।ভাই হিসেবেই দেখে।

সুজন আর রিফাত ও প্রণয়ের সাথে সাথে থাকে সবসময়। প্রণয়ের কোনদিন কোন কাজে কোথায় মিটিং বা পার্টির কোনো কাজে সব সময় প্রণয়ের সাথে থাকে।

রাফসান মির্জা বিরোধী দল।রাফসান মির্জা চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রণয় যাতে এমপি পদে দাঁড়াতে না পারে।তাই সুযোগ খুঁজছে প্রণয়ের ক্ষ’তি করার জন্য।রাফসান মির্জা এখন যখন জানতে পেরেছি প্রণয় বাসায় থাকে সবার সাথে।যেকোনো সময় লোক পাঠাতে পারে মা’রার জন্য।সজীব কোনো ভাবে সেটা জানতে পেরে প্রণয় কে জানিয়েছে।

🌸🌸

জুরাইন স্কুল থেকে বাসায় যাচ্ছিলো।হঠাৎ সামনের দিকে চেয়ে দেখে পাখি ও বাসায় যাচ্ছে।তাই দ্রুত হেটে পাখির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

—কেমন আছো পাখি?

হঠাৎ কারো মুখে নিজের নাম শুনতেই পাখি চমকে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখে জুরাইন। জুরাইন কে বরাবরই পাখির কাছে ভালো লাগে।গুলুমুলু ছেলেটা।বয়সের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা সে।দেখলে সবাই বলবে হয়তো ক্লাস সিক্সে পড়ে।চতুর্থ শ্রেণির কেউ বলবে না।

পাখি মুচকি হেসে বলে,

—আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো জুরু?

পাখির মুখোচ্চরিত জুরু ডাক শুনেই জুরাইন খুশিতে আটখানা হয়ে গেছে।বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে বলে,

—এভাবে বলো না পাখি এখানে লাগে।

জুরাইন এর কথায় পাখি অবাক হয়ে বলে,

—এসব কোথা থেকে শিখলে জুরাইন?

—আমার একটা ফ্রেন্ড আছে।ও ওর আম্মুর মোবাইলে মুভিতে এরকম দেখেছে।পরে স্কুলে এসে আমাদের বলেছে।তাই জানি।

—এসব বলা ভালো না ভাই।তুমি আর ওই ফ্রেন্ডের সাথে থাকবে না।ওগুলো খারাপ ফ্রেন্ড ভাইয়া।

পাখির মুখে ভাইয়া ডাক শুনে জুরাইন ভ্রুকুটি কুঁচকে চলে যেতে যেতে বলে,

—ভাইয়া ঢেকে মনটাই ভে’ঙে দিলে।

পাখি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।এই পিচ্ছি বাচ্চা ছেলে এসব কি বলে?

🌸🌸

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বাজে।প্রান্তিক জুরাইন কে পড়াচ্ছে জুরাইন এর রুমে।জান্নাত নিজের রুমে বসে ফোন ঘাটছে।হঠাৎ আহ্লাদী এসে বলে,

—আপামণি একটা কথা বলার ছিলো?

জান্নাত তাকিয়ে আছে আহ্লাদী এর দিকে। আর ভাবছে আজকে আবার কোন আজগুবি পাউডার এর নাম শুনাই আল্লাহ ভালো জানে।জান্নাত তপ্ত নিশ্বাস ফেলে মোবাইল একপাশে রেখে বলে,

—বল কি বলবি?

—কালকে আমাকে একটু সুন্দর করে সাজাই দিতে পারবেন আপামণি?

—কেন?কই যাবি তুই?

—কালকে আমার বেবিট্যাক্সি এর সাথে দেখা করতে যামু আপামণি।

—বেবিট্যাক্সি? এটা আবার কি নাম?

—আসলে আপামণি ওর নাম বেবিট্যাক্সি না।ওর নাম হলো শাকিল।ও তো মূর্খ।পড়াশুনা কিছুই করিনাই আমরা দুই জনে।গ্রামে একদিন এক শহরের শিক্ষিত আপা আইছে কি দরকারে। লগে জামাই ও আইছে ওই আপার।ওই আপা তার জামাইরে নাকি বেবি কইয়া ডাকছিলো। শাকিলে এটা শুনে একদিন আমারে ও বেবি বলে ডাকছে।এটা শুনে ফেলছে আমাদের পাশের ঘরের লিটন।লিটনে পুরো গ্রাম করছে এই কথা যে শাকিল আমারে বেবি বলে ডাকছে।সেই থেকে শাকিলরে সবাই বেবিট্যাক্সি বলে ডাকে।সেই জন্য মাঝে মাঝে আমার ও মুখ ফসকে বেবি ট্যাক্সি নামটা চলে আসে।

আহ্লাদী এর কথা শুনে জান্নাত হাসি চেপে রাখতে না পেরে হেসে দেয়।এই মেয়েটা এইসব আজগুবি কথার ঝুলি কই থেকে বের করে।ও পুরো মানুষটা আস্তো কমিডি।

জান্নাত কোনো মতে হাসতে হাসতে আহ্লাদী কে বলে,

—ঠিক আছে যা সাজিয়ে দিবো।

বলেই আবার হাসতে থাকে।আহ্লাদী জান্নাতের ঘর থেকে চলে যায়।জান্নাত হাসতে হাসতে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।

🌸🌸

রিফাতের সাথে আগামীকাল কের পার্টির মিটিং এর কথা ফোনে বলতে বলতে বেলকনিতে আসে প্রণয়। হঠাৎ কারো খিলখিল হাসির ধ্বনি কানে এসে বাজাতেই পাশের বাসার বেলকনির দিকে তাকিয়ে দেখে গত পরশু রাতের মেয়েটা একা একা হাসছে।

প্রণয় কথা শেষ করে ফোনটা কে’টে দিয়ে জান্নাত কে উদ্দেশ্য করে বলে,

—এই যে,মিস.! একা একা হাসছেন কেন?

হঠাৎ কারো কথা শুনতে পেয়ে জান্নাত কথার উৎস এর দিকে ফিরে দেখে পাশের বেলকনি তে প্রণয় দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি ফেলে।

জান্নাত হাসি থামিয়ে বলে,

—কিছু না।এমনি একটা কথা মনে পড়েছিলো বার বার তাই হাসছিলাম।

জান্নাতের কথায় প্রণয় মুচকি হাসে।কি অমায়িক সে হাসে।ঠোঁটের কোণে হাসিটা লেগে আছে।

জান্নাত প্রণয় কে বলে,

—তা আপনি এখানে?মানে এই সময় বেলকনিতে?

—দরকারি একটা কল এসেছিলো। তাই কথা বলতে এখানে আসা।না আসলে তো দেখতে পেতাম না কেউ এখানে হাসছে সুন্দর করে।

শেষের কথাটা প্রণয় বিড়বিড় করে বলে।জান্নাত সেটা দেখে বলে,

—কিছু বলেছিলেন??

প্রণয় থতমত খেয়ে যায়।তবে সেটা প্রকাশ না করে বলে,

—নাহ কিছু না।বাই দ্যা ওয়ে!আপনার নামটা জেনো কি?

—জান্নাত! জান্নাত আজমী।

—জান্নাত। মাশাল্লা। নামটা সুন্দর আপনার।

—আপনার নাম শাহরিয়ার প্রণয়! এম আই রাইট?

—ইয়্যাহ।

—প্রণয় নামের অর্থ কি জানেন? ভালোবাসা।

—হ্যাঁ।

—আপনাকে বরং আমি মিষ্টার ভালোবাসা বলেই সম্বোধন করি?

—মিষ্টার ভালোবাসা?

—হ্যাঁ। তবে শুধু নাম হিসেবে। কোনো কেমিস্ট্রি নেই কিন্তু এর মাঝে।

জান্নাতের কথায় প্রণয় সেই অমায়িক হাসিটা ঠোঁটের কোণে ফুটে তুলে বলে,

—আচ্ছা।

প্রণয়ের কথার বিপরীতে জান্নাত এক চিলতে হাসি উপহার দেয়।আর প্রণয় তাকিয়ে থাকে জান্নাতের নাকের সেই লালছে কালো তিল টার দেখে।ওই তিল টায় যেন মুখশ্রীর অর্ধেক সৌন্দর্য ধরে রেখেছে।

চলবে ইনশাল্লাহ✨🖤

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে