#প্রেমের_মেলা
পর্ব:[ ২ ]
#বর্ষা
ইনায়া বাড়ি ফিরতেই শুনতে পায় কালই তাদের ফ্লাইট। সিঙ্গাপুর ফিরে যেতে হবে তাদের। ইনায়ার গলা শুকিয়ে আসে।যেই অতীতকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছে,সেই অতীতের নিকট ফিরে যেতে যে সে চায় না।ইসরাক খান দ্যা গ্রেট কার্ডিওলজিস্ট ইনায়ার পাপাই।ইসরাক খান মেয়ের অনুরোধ রাখতেই সিঙ্গাপুর থেকে দেশে এসেছিলেন বছর দুয়েক আগে। পাশাপাশি প্রাইভেট মেডিকেলে কয়েকটা সিরিয়াস হার্ট অপারেশনেও এটেন্ড করতেই আসা কেননা মানুষের জীবন বাঁচাতে পারাই একজন চিকিৎসকের ধর্ম বলে ইসরাক খান মনে করেন।
”পাপাই আমি সিঙ্গাপুর ফিরে যেতে চাই না।আমার দ্বিতীয় বর্ষের এক্সামও কাছাকাছি।এসময় সিঙ্গাপুর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়!”
ইসরাক খান কফি খাচ্ছিলেন।মেয়ের কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেলেন।এই মেয়ে কবে থেকে পড়াশোনার প্রতি এতটা দায়িত্ববান হলো তা তার স্মরণে এলো না। অবশ্য তিনি মেয়ে পড়াশোনার প্রতি এমন অগোছালোপনা কখনো পিড়া দেইনি কেননা অগোছালো এই মেয়েটা রেজাল্ট মোটামুটি করার পাশাপাশি অন্যদেরকেও গোছালো করতে ব্যস্ত।
”ইয়ু বেটা,কিছু কি হয়েছে?কেউ কিছু বলেছে তোমায় তোমার পড়াশোনার স্ট্রেটিজি নিয়ে?”
”নো পাপাই।তবে তুমি কেন জিজ্ঞেস করছো এগুলো?”
”আমার অগোছালো মেয়েটা হঠাৎ পড়াশোনার তাগিদে নিজ জন্মভূমিতে ফিরতে চাইছে না কেন তাই তো স্বাভাবিক লাগছে না!”
”পাপাই সত্যিই কি সিঙ্গাপুর আমার জন্মভূমি!”
ইসরাক খানের মুখ চুপসে গেলেও পরক্ষণে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
”হ্যা,অবশ্যই। তুমি তোমার বার্থ সার্টিফিকেট দেখোনি!”
ইনায়া আর কিছুই বলে না।ক্লান্ততার অযুহাতে রুমে চলে আসে।ব্যাগটা স্টাডি টেবিলে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।ইনায়ার অনেক কষ্ট হয় মা’কে ছাড়া থাকতে। দাদুভাই তো ওকে মিথ্যা বলেনি কখনো তবে বলেছে ওর মা পালিয়ে গিয়েছিলো।তাও তো সত্যিই ছিলো।তবে ওর মা ওকে রেখে কেনই বা পালিয়ে গেল তা আজও জানতে পারলো না। ইসরাক খানের সাথে প্রেমের বিবাহ ছিল ইনায়ার মায়ের।তবে ওর জন্মের পরেই কি এক অজানা কারণে পালিয়ে গেলেন তিনি।সাইন করে রেখে গেলেন ডিভোর্স পেপার। সঙ্গে নিলেন ছেলেকে।মেয়ে হয়তো তার নিকট এতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না!তবে ইনায়া কেন মন খারাপ করবে পাপাই কি তাকে কম ভালোবাসে!
ফ্রেশ হয়ে যোহরের নামাজ আদায় করে নিচে নামতে ইনায়া দেখে ওর পাপা কোথাও বের হচ্ছে। জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারে, হসপিটালে একটা ইমার্জেন্সি এসেছে। সেখানেই যাচ্ছেন তিনি। ইনায়ার মাথায় চুম্বন করে খেয়ে নিতে বলে বেরিয়ে যান তিনি।ইনায়া মুচকি হেসে খেতে বসে বুঝতে পারে তার পাপাই আজও না খেয়েই বেরিয়ে গেছেন।ইনায়ারও আর খাওয়া হয় না।
রাত্রিবেলা বাড়ি ফিরে ইসরাক খান একদমই অবাক হন না টেবিলে খাবার ঢেকে রাখা দেখে।তিনি কি করে ভুলে গেলেন মেয়েটা তিনি না খেলে খায় না। অবশ্য ইনায়া চাইলেই খাবার নিয়ে হসপিটালে যেতে পারতো তবে সে তার পিতার দায়িত্বস্থলে গিয়ে পিতাকে ডিস্ট্রাব করতে চাইনি। অবশ্য ইসরাক খানই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
”পাপাই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো।খিদেই পেট চুইচুই করছে। ইঁদুরগুলো বারবার বলছে জলদি খেয়েনে!”
”পাপাই এই যাবো,আর এই আসবো।তুমি খাবার বাড়তে থাকো”
ইসরাক খান ফ্রেশ হয়ে এসে নিজ হাতে মেয়েকে খাইয়ে দেন।অবসর সময়ে মেয়েকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে আলাদা এক শান্তি পান তিনি।তার মাও তো তার মেয়েটার মতোই অবিকল চেহারার ছিলেন।তিনি যে তার মা’কে ফিরে পেয়েছেন। তবে দাদির মতো মুখায়ব পেলেও চুলগুলো ঘন কালো তার।দাদির মতো গোল্ডেন কালার না। সম্পূর্ণ বিদেশি রমনী নয় ইনায়া! পাঁচ ফুট দুই তিন উচ্চতার অধিকারী ইনায়ার দুষ্টুমিতে বন্ধুমহল মেতে থাকে সর্বদাই। বিদেশী দাদির অসম্পন্ন বিদেশী নাতিন সে!
★
ইনায়া ভাবতেও পারেনি ইসরাক খানকে এগিয়ে দিতে এসে এই ক্যাচালে পড়তে হবে তাকে।বহু কষ্টে পাপাইকে মানিয়ে একাই পাঠিয়ে দেয় সিঙ্গাপুরে সে। ইনায়া চায়না তার পাপাই নিজ বাবা,মা,ভাই-বোনদের থেকে দূরে বাংলাদেশে থাকুক শুধু মাত্র তার জন্যে। অবশ্য এছাড়াও সেদেশে ইসরাক খানের নিজস্ব হসপিটাল আছে, দায়িত্ব আছে। সেগুলো চাইলেও তিনি এড়িয়ে যেতে পারেন না। এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে যেতে নিলেই পথ রোধ করে দাঁড়ায় কেউ।ইনায়া ক্ষেপে যেই না কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সেই ব্যক্তিটি ইনায়াকে জড়িয়ে ধরে।ইনায়া বিষ্মিত হয়।
”ও মাই জান তুমি কিভাবে জানলে আমি তোমার কাছে আসছি?ইউ আর সো সুইট জান। তুমি আমার থেকে পালাতে চেয়েও আমাকে ড্রপ করতে এয়ারপোর্টে এসেছে!আই লাভ ইউ টু মাচ জান”
ইনায়া অবাক হয়ে বাক্যহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এয়ারপোর্টের মানুষেরাও ওদের দেখে মজা লুটছে।ইনায়া ধাক্কা মারে সামনের ব্যক্তিটিকে।আশিয়ান পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। বাঁকা হেঁসে রুমানের কাঁধে একহাত দিয়ে ভর দিয়ে বেঁকে দাঁড়িয়ে বলে,
”রুমান তুমি কি আমাকে এই সারপ্রাইজের কথাই বলেছিলে নাকি!আমি তো তোমার সারপ্রাইজে অনেক প্রশন্ন হয়েছি বলতেই হবে”
রুমান ভয়ে কাঁপছে।সে তো তাহলে উল্টা পাল্টা কথা বলে ফেলেছে আশিয়ানকে।ইনায়া ভয়ে কাঁপছে।যেই অতীত থেকে বাঁচতে এখান থেকে না যাওয়া সেই অতীতই এখানে!ইনায়ার ভাবনার মাঝেই একটা বিদেশী মেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আশিয়ানকে।
”সারপ্রাইজ আশিয়ান বেভ”
আশিয়ান মুখশোক্ত করে রুমানের দিকে তাকায়। রুমান হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে তার গালতি ছে মিস্টেক হোগেয়া হে!আশিয়ান এলিকে ছাড়িয়ে কঠিন কন্ঠে বলে,
”এলি এটা বাংলাদেশ। সিঙ্গাপুর নয় যে তুমি যেখানে সেখানে এরকম আচরণ করবে যার তার সাথে!সো আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখো”
ইনায়া কেটে পড়ার ধান্ধায় ছিল।কেটেই পড়তো আরেকটু হলে তবে বলে না বেশি পরিচিতি ভালো না ঠিক তেমনি ইনায়ার পরিচিতিই ওকে বিপদে ফেলেছে। সিনিয়র ভাই রিজভী আহমেদ কানাডা যাচ্ছেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণে।আর তিনি ইনায়াকে দেখেই দিলেন ডাক।আর যা হওয়ার তা হয়ে গেলো।আশিয়ানের নজরেও পড়লো ইনায়ার পালিয়ে যাওয়ার দিকটি।ইনায়া এবার আর আস্তে আস্তে বরং জোরে দিলো এক দৌড়।বাবার রেখে যাওয়া গাড়ি নিয়েই পালালো।আশিয়ানও ছুটেছিলো ওর পেছনে তবে ধরার আগেই পালিয়ে গেল।
রিজভী আহমেদ অবাক দৃষ্টিতে ইনায়ার পালিয়ে যাওয়ার হিসেব মেলাতে ব্যস্ত ছিলো।তবে স্ত্রী ফাতেমা চলে আসায় আর হিসেব মেলানোর সময় পাননি।ফাতেমার তাড়ায় এয়ারপোর্টের ভেতরে চলে যেতে হয়েছে তাকে।আর ইচ্ছে থাকলেও আশিয়ান তার প্রিয়শীর ঠিকানা বের করে নিতে পারলো না।
এলি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো আশিয়ানের ছুটে যাওয়ার দিকে।তাইতো অবাকতা এবং কৌতুহল মেটাতে প্রশ্ন করেই ফেললো রুমানকে।
”এই পি.এ. ওই মেয়েটা কে যার পেছনে আমার আশিয়ান ছুটে গেলো?”
রুমান নাক মুখ কুঁচকে মনে মনে বললো,”এহহ,বলতে আসছে তার আশিয়ান।আরে সাতচুন্নি তুই এখনো বুঝছোস নাই যে ওই ম্যামটা স্যারের ইয়ে মানে প্রিয় কেউ।আর তুই পুরাই বিরক্তিকর ”
মনে মনে এগুলো বললেও রুমান মুচকি হেসে বললো,
”ম্যাম আপনি যেখানে আমিও সেখানে। আমি কিভাবে বলবো?”
”তাহলে তুমি এখানে কি করছো যাও গিয়ে দেখো”
রুমান দ্রুত নিজের আর আশিয়ান মির্জার লাগেজ নিয়ে কেটে পড়ে। একপাশে আশিয়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
”স্যার দ্রুত চলেন।ওই সাতচুন্নি ম্যাডাম আসার আগে কেটে পড়ি!”
”হোয়াট, সাতচুন্নি?হা হা হা”
রুমান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আশিয়ানের দিকে।অনেক আপেক্ষিক তত্ত্ব বলা যায় আশিয়ানের হাসিকে।সহজে হাসতে দেখা যায় না এই বান্দাকে।হয়তো আজ প্রিয় মানুষটিকে দেখেই খুশ মেজাজ তাই অল্পতেই হেসে ফেলা।হতেই পারে!
আশিয়ান হাসি থামিয়ে প্রশস্ত সেই রাস্তার দিকে তাকিয়েই বাঁকা হেসে মনেমনে বলে,
”পালিয়ে আর কোথায় যাবে জান?যেহেতু এদেশে এসে প্রথমেই তোমার দেখা পেয়েছি, সেহেতু ভাগ্যও যে ইঙ্গিত দিয়ে দিলো আমার গন্তব্য তুমি আর তোমার হাজারো গন্তব্যের শেষ আমি!”
চলবে?