#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি
৮.
‘একটু ব্যস্ত আছি। হলে ফিরে যান। রাতে দেখা হবে।’
ছোট্ট ম্যাসেজটায় মুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে এলো। ফোন রেখে উদাস চোখে আকাশ পানে তাকালাম। মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়েছে। স্বচ্ছ আকাশটাকে হঠাৎ করে কালো রঙের মেঘেরা ঘিরে ধরেছে। আবারো হয়তো বৃষ্টি নামবে। আমি যখন মন খারাপের ফর্দ আটতে ব্যস্ত তখনি হঠাৎ আমার পাশের চেয়ার টেনে বসলেন তুষার। সাথে তার চ্যালাপ্যালাও এসেছে। আমি মনে মনে বিরক্ত হলেও বাহিরে তা প্রকাশ করলাম না। তুষার তার স্বভাবসুলভ বোকা হেসে বললেন,
‘কেমন আছ তনয়া? অনেক দিন পর দেখা।’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া। জ্বি একটু বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছিলাম।’
আমার কথায় তুষার ভিষণ চিন্তিত হওয়ার মতো করে বললেন,
‘হঠাৎ বাড়িতে? কোনো সমস্যা হয়েছে?’
আমি মুচকি হেসে বললাম,
‘না না জাস্ট মন চাইলো।’
তুষার শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েসয়ে বললেন,
‘কোনো সমস্যা হলে আমাকে নির্দ্বিধায় বলবে তনয়া। আমি তোমার জন্য সবসময় বেস্ট অপশন হয়ে থাকব।’
চট করে মেজাজ চটে গেল। এত উপন্যাসিক ভাবে কথা বলতে কে বলেছে? যার মুখে এসব শোনার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছি সে ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে বসে আছে আর এই মগা আসছে ইমপ্রেস করতে! সিরিয়াসলি? এত খারাপ দিন কবে এলো আমার? আমি তুষারের দিকে ঘুরে বসলাম। কোনো ভনিতা ছাড়া সরাসরি বললাম,
‘তুষার ভাই! আমার আপনার প্রতি কোনো রকম অনুভুতি নেই। আমি জানি আপনি এসব কেন করছেন! কিন্তু যেখানে সম্ভাবনা নেই সেখানে শত চেষ্টা করেও কি লাভ আছে বলুন? আমি চাই আপনি আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলুন। ব্যাস এটুকুই।’
অন্তি আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ও জাস্ট ভাবতে পারেনি আমি সত্যিই এই ভয়ংকর কাজটা করে বসবো। আমি চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে ক্যাস কাউন্টার এর দিকে যেতে যেতে বললাম,
‘বিলটা আমি দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে পছন্দ করার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এই ট্রিটটা দিয়ে দিলাম।’
তুষারের মুখটা এটুকু হয়ে গেছে। হয়তো লজ্জায়। এতটুকু লজ্জা পাওয়া তার দরকার ছিল। এতে করে মেয়েদের পা চাটা স্বভাবটা যদি একটু বদলায়! ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তায় চলে এলাম। অন্তি পুরোটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি ওর এমন নাটক দেখে যাস্ট বিরক্ত। ধমকে উঠে বললাম,
‘তাকাই থাকিস ক্যান? তোর ও কি তুষারের মতো সমস্যা আছে? থাকলে বল ওষুধ আছে আমার কাছে!’
এতক্ষণে অন্তি ওর আটকে রাখা হাসিটা ব্লাস্ট করলো। পেট চেপে ধরে হাঁটু ভেঙ্গে রাস্তার উপর বসে পড়েছে মেয়েটা। আমি বিরক্ত চোখে আশপাশে তাকালাম। লোকজন অবাক চোখে অন্তির দিকে তাকিয়ে। এমন ধিঙ্গি মেয়ে রাস্তায় বসেপড়ে হিহিহাহা করছে সেটা নিশ্চই লোক ভালো চোখে দেখবে না! আমি ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে রিকশা ডাকলাম। অন্তি ততক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে।
‘ইউ ডিড এ গুড জব দোস্ত। তবে আমার বেচারা তুষার ভাইয়ের জন্যেও খারাপ লাগছে। বেচারা কেমন প্রেম প্রেম চোখে তাকাতো তোর দিকে!’
আমি ওর কথাকে সম্পূর্ণ ভাবে এড়িয়ে গেলাম। এই মেয়ে প্রেমের কি বুঝে? কিছুই বুঝে না। প্রেম দেখতে হলে সাহিল সাহেবের চোখে তাকাতে হবে। স্বচ্ছ বইয়ের মতো তার চোখ। দেখলেই হাজারখানি গোপন কথা ভেসে ওঠে তাতে।
______________
সাহিলের সাথে আমার সম্পর্কটা কতদূর এগিয়েছে জানি না। তবে তার সাথে আমার আগের থেকে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়েছে। আগের মতো নার্ভাসনেসটা আর কাজ করে না। তবে বুকের ভেতর তোলপাড়টা ঠিকই হয়! এই তো গত দিনের ঘটনা। লোকটা হুট করে বিকেলে কল করলেন। সূর্য তখন ডুবি ডুবি। আমি বারান্দায় চেয়ার পেতে বই এ মুখ গুঁজে বসে আছি। একমাস বাদেই ফাইনাল এক্সাম এ বসতে হবে। ওদিকে বাবা কল করলেই গম্ভীর গলায় শুধান,
‘পড়াশোনার অবস্থা কি? এবার ফেইল করলে পড়াশোনার ইতি টেনে বাড়িতে চলে আসবে। ওখানে বসে বসে ঘুরঘুর করার ফর্দ বানাতে হবে না।’
বাবার এমন কথায় আমার মন চায় খুশি খুশি বলেদিতে যে,
‘এক্সাম দেওয়ার কি দরকার বাবা? আমি এখনই চলে আসি। তোমার ঠিক করা পাত্র সাহিল সাহেবের গলায় ঝুলিয়ে দাও আমাকে। তোমার সাথে সাথে আমিও কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।’
কিন্তু তা আর বলা হয়ে ওঠে না। ইশশ! এই পড়াশোনাটা না করলে কি এমন হয়? অসহ্য! আমার অসহ্যকে আরো একধাপ বাড়িয়ে দিতেই মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। বই রেখে মোবাইল তুলতেই মুখভাব পরিবর্তন হয়। খুশি খুশি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সাহিল বলে,
‘নেমে আসেন শুভ্র! আপনাকে নিয়ে ঢাকা শহরের অলিগলিতে ঘুরব। আপত্তি আছে?’
আমি চট করে জবাব দিলাম,
‘একদম আপত্তি নেই!’
সাহিল নিঃশব্দে হাসলেন। আমি নিজের মাথায় চাটি দিলাম। সবসময় এত উত্তেজিত কেন হতে হবে? এর থেকে সুন্দর করে এটা বললেই হতো,”অপেক্ষা করুণ। আসছি।” নিজের উপর চরম বিরক্ত হয়েই ফোন কাটলাম। লোকটা কি সুন্দর কথা বলে! আর আমি? হাদা গাধা!
.
.
আধঘন্টা সময় নিয়ে তৈরি হয়ে হল থেকে বের হতেই দেখলাম সাহিল কালো রঙের গাড়িটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে তার রোদ চশমা। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। লাল রঙের আবরণে ছেয়ে গেছে পুরো আকাশ। আমি মুখ বাঁকালাম। ঢং! সাহিলের দিকে এগিয়ে যেতেই সে মুচকি হেসে বললো,
‘গাড়িতেই যাবেন নাকি রিকশা?’
‘রিকশা।’
এই প্রথম আমাদের একসাথে রিকশায় করে ঘুরতে বের হওয়া। সাহিলের বাহুর সাথে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার বাহু। আমি শক্ত হয়ে বসে রইলাম। সাহিল তার বা হাত আমার পেছন থেকে নিয়ে আমার পাশে রিকশার হুড চেপে ধরলো। আমি ঢোক গিলে নড়েচড়ে বসলাম। সাহিল ছোট করে বললেন,
‘অসুবিধা হচ্ছে?’
আমি মাথা নাড়িয়ে না জানালাম। এর থেকে গাড়িতে করে আসাই ভালো ছিলো। নিজের কথার জন্য এখন আফসোস হচ্ছে।
‘বি ইজি তনয়া। আমি আপনাকে খেয়ে ফেলবো না!’
সাহিলের কথায় আমি খুক খুক করে কেশে উঠলাম। লজ্জায় গাল গরম হয়ে এলো। লোকটা ভয়ংকর অসভ্য!
‘আপনিকি আমায় গালি দিচ্ছেন?’
আমি চমকে তাকালাম। ধরা পড়ার মতো অবস্থা। সাহিল অন্যহাতে তার চুল ব্যাকব্রাশ করতে করতে বললেন,
‘এটা আপনার ফল্ট শুভ্র। আপনি তখন বিয়েতে রাজি হয়ে গেলে এতো দিনে আমি বাচ্চার বাপ বনে যেতাম। আপনার ভুল সিদ্ধান্তর জন্য আমাকে এখনো ব্যাচেলর হয়ে ঘুরতে হচ্ছে। আমার বয়সটা তো এখন কিশোর প্রেমিকদের মতো নেই! জলদি বিয়েতে মত দিন। নয়তো আমার কথার অনলে আপনি লজ্জা পাওয়ার কথাও ভুলে যাবেন।’
সাহিলের দিকে আমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলাম। লোকটা কি আমায় হুমকি দিল?
আমরা প্রায় সাতটা অবদি রিকশা করেই ঘুরলাম। ফেরার পথে ফুচকার দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন সাহিল। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সে মুচকি হেসে বললেন,
‘ফুচকা খাবেন?’
না করতে যেয়েও পারলাম না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই সে ফুচকা আনতে চলে গেল। আমি রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সাহিলকে দেখতে লাগলাম। লোকটা ফরমালে থাকতে পছন্দ করে। তাই বলে ডেটেও বুঝি ফরমাল পরতে হবে? তবে আকাশি রঙের শার্টটা তার দেহে মানিয়েছে ভিষণ। হাতাটা গুটিয়ে কনুই পর্যন্ত তোলা। দৃষ্যমান পেশিবহুল হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। ইশশশ! কি সুন্দর!
‘এজন্যই বলেছি ঝটপট বিয়েতে মত দিন। তাহলে আর এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতে হবে না।’
সাহিলের কথায় ঘোর ভাঙলো। কিছুটা লজ্জা পেলেও তা এড়িয়ে বললাম,
‘আপনার বয়স চল্লিশ পেরোলেই বিয়েতে বসবো। হুমায়ূন এর লেখা মধ্যবয়স্ক প্রেমিক ক্যারেক্টর গুলো আমার একটু বেশিই পছন্দ। আপনাকে দিয়েই না হয় সেই সখ পূরণ করবো।’
আমার কথায় সাহিল বেদনার দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি তৃপ্তিময় চোখে তার এই বেদনা উপলব্ধি করলাম। দিনটা বুঝি একটু বেশিই সুন্দর কাটল!
চলবে…….