প্রেমাচ্ছন্ন প্রহর পর্ব-০৭

0
575

#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি

৭.
ভারী বর্ষণ শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে হুট হাট দূরে কোথাও বাজ পড়ার মতো শব্দ হচ্ছে। সাথে মেঘের ভয়ংকর গর্জন। বিদ্যুৎ চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। বর্ষার সাথে বিদ্যুৎ এর এই দুশমন শুলভ সম্পর্কটা আমার একদম অপছন্দের। বর্ষা এলেই বিদ্যুৎ ধেই ধেই করে পালায়। যেন একে অপরের মুখদর্শন করতে অনিচ্ছুক। চার্জার লাইটে চার্জ ফুরিয়েছে। মোবাইলেও চার্জ প্রায় শেষের দিকে। অন্ধকারেই চুপটি করে বসে রইলাম। মাথায় অসহ্য রকম যন্ত্রণা হচ্ছে। বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। এই মুহূর্তে যদি আমি মরে যাই বাবাকি আমার জন্মদিনটাও মায়ের মতো করে মনে রাখবে? হুট করে মাথায় আসা প্রশ্নটার উত্তর জানার জন্য ছটফটিয়ে উঠলো মন। চট করে কল করে বসলাম বাবাকে। একবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে বাবার গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসলো,

‘বলো।’

‘কি করছো?’

‘খবর দেখছি। দেখলাম বৃষ্টিপাত হচ্ছে প্রচুর! ভিজেছো?জ্বর এসেছে?’

আমি মলিন হাসলাম। আমার স্বভাবের সাথে বাবা খুব বেশি পরিচিত। কত সহজেই সবটা বুঝে ফেললেন! আমি চট করে আমার মনের প্রশ্নটা করে ফেললাম,

‘আমি মরে গেলে আমায় মনে থাকবে তোমার?’

বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

‘তুমি কি চাচ্ছ তোমায় আমরা মনে রাখি?’

আমার মনটা হঠাৎ করেই ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ছোট করে বললাম,

‘না চাচ্ছি না।’

‘তনয়া!’

বাবা এই প্রথম আমায় এমন নরম গলায় ডাকলেন। আমি আপ্লুত হলাম। চোখে পানি চিকচিক করে উঠলো।

‘আমি চাই তুমি সবসময় শক্ত থাকো। অল্পতে ভেঙে না পরো। তোমার মা কিন্তু অনেক নরম মনের ছিলেন। একদম তোমার বোনের মত। এটা কখনো ভেবো না তোমার বাবা তোমাকে ভালোবাসে না। আমি কেবল চাই তোমাকে আমার মতোই স্ট্রং বানাতে। আমি চলে গেলে তোমাদের আর কে থাকবে? ভবিষ্যতে তোমাকে অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। তাই এখন থেকে নিজেকে গড়।’

আমার চোখ থেকে টুপ টুপ করে জল গড়িয়ে পড়লো। বাবা তার শক্ত আবরণের পেছনে কত কষ্টই না লুকিয়ে রেখেছে!

‘ফার্মেসি থেকে ওষুধ আনাও দারোয়ান কে দিয়ে। এসব মরার প্লান মাথা থেকে ঝেড়ে সুস্থ হয়ে পড়াশোনায় মন দাও। আর তা না হলে তোমার হলের রাঁধুনির থেকে রান্না শেখ। কাজে আসবে।’

আমি নাক কুঁচকালাম। বললাম,

‘দরকার হলে আমি রান্নার জন্য কোর্স করবো তাও রুমলী খালার রান্না শেখার মতো ভুল করবো না। নয়তো শ্বশুর বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই বিদায়ের ঘন্টা বেজে যাবে।’

বাবা বিরক্ত হয়ে টুট করে কল কেটে দিলেন। প্রতিবার এমনটাই হয়!

_______________

নাজেরা খালা এসে ডেকে‌ গেলেন। তিনি আমাদের হলের দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন। সাহিল নিচে গেস্ট রুমে অপেক্ষা করছেন। আমি সটান করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সে আসবে তা তো আমি জানি তবুও তিনি এসেছেন শুনতেই বুকটা লাফিয়ে উঠলো যেন! পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে শরীরে চাদর জড়িয়ে রেখেই ধীর পায়ে রুম ছেড়ে বের হলাম। কিছু একটা মনে পড়তেই আবারো রুমে এলাম। খুঁজে নতুন টাওয়েলটা সাথে নিলাম। একটা এক্সট্রা টাওয়েল সবসময়ই থাকে আমার কাছে। কখন কোথায় লেগে যায়! আমার রুমটা দ্বিতীয় তলায় রাস্তা ঘেঁষে। আমাদের হলটা তৃতীয় তলা বিশিষ্ট। গেষ্ট রুমটা নিচে সদর দরজার পাশেই। এটুকু সিঁড়ি ভেঙে নামতেই ভীষণ কষ্ট অনুভব করলাম। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে।
সাহিল অনেকটাই ভিজে গেছে। গায়ের হালকা নীল রঙের শার্টটা বৃষ্টিতে ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে। আমাকে দেখতেই সে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন। ব্যস্ত হাতে কপাল ছুঁয়ে বললেন,

‘তাপমাত্রা বড্ড বেশি! আপনি অবুঝ নন তনয়া! এভাবে বৃষ্টিতে ভেজাটা মোটেও ঠিক হয়নি আপনার।’

আমি চুপটি করে রইলাম। এতদিনে আমি সাহিলের স্বভাব সম্পর্কে কিছুটা নিশ্চিত হয়েছি। তিনি কেবল আপসেট কিংবা রেগে থাকলেই আমায় তনয়া বলে সম্মোধন করেন। আমি আমার হাতের টাওয়েল তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সাহিলের চুল গুলো ভিজে লেপ্টে আছে। আমি একপলক সেদিকে তাকিয়ে বললাম,

‘আমি নাহয় অবুঝ। কিন্তু বুঝমান শিক্ষক মহাশয় কেন এমন কাক ভেজা হয়েছে?’

আমার হাত থেকে ছো মেরে টাওয়েল নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে সে বললেন,

‘অবাধ্য বেপরোয়া মেয়ে মানুষকে সভ্য বউ বানাতে চাওয়া পুরুষদের পক্ষে সবসময় বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করলে চলে না। কখনো নিয়মের বাহিরে যেয়ে বউয়ের মতো অবাধ্য অবুঝ হতে হয়!’

লোকটা বরাবরের মতো তার ভয়ংকর কথার জালে আটকে দিলো আমায়। আমি হাঁসফাঁস করে উঠলাম। কত সহজেই সে আমায় বউ বলে যাচ্ছে। কিন্তু তার এই অতি সহজে বলা অতি সহজ কথাটা আমার হৃদয় সহজভাবে নিতে পারছে না। বাবা বলতেন বুলেটের বেগকে হার মানায় আমার কথার বেগ। সেখানে আজ আমি কথা শূন্য হয়ে পড়েছি। সাহিল টাওয়াল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে টেবিলের উপর রাখা পানির বোতল নিয়ে এলেন। পলিথিনের ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে দুটো ট্যাবলেট ভেঙে এগিয়ে দিলেন।

‘ঝটপট খেয়ে নিন।’

আমি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই খেয়ে নিলাম। বৃষ্টির পানি মাথায় লাঘার ফলে ইতিমধ্যে সাহিল হেঁচি দিতে শুরু করেছেন। আমি মুখ টিপে হাসলাম। ওষুধের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে তার মতো করেই বললাম,

‘ঝটপট খেয়ে নিন।’

সাহিল ছোট ছোট চোখ করে তাকালেন। তবে কিছু বললেন না। আমার খারাপ লাগলো। ইশশ! আমার সেবা করতে এসে লোকটা নিজেই রোগী হয়ে পড়েছেন! এখন আমার উচিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য আদা দিয়ে গরম গরম এক মগ চা খাওয়ানো।

______________

গতকাল বৃষ্টি শেষে আজ আকাশে সূর্য উঠেছে। ঝকঝকে আকাশের দিকে তাকাতেই মন ভালো হয়ে এলো। আজ একটার দিকে ক্লাস। সবে বাজে এগারোটা। বালিশের তলা থেকে ফোন বের করে ভাবনা চিন্তা ছাড়াই কল দিয়ে বসলাম সাহিলের নম্বরে। কয়েকবার রিং হতেই সে কল ধরলো। গাঢ় পুরুষালী গলায় বললো,

‘ক্লাসে আছি শুভ্র। বের হয়ে ব্যাক করছি।’

কল কেটে দিলেন তিনি। তার বলা এই অতি সাধারণ কথাটাও আমার কাছে অসাধারণ মনে হলো। গোটা তিনিটাইতো অসাধারণ!

সাহিল কল করলো ঠিক একঘন্টা পর। আমি তখন বের হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে সাহিলের মিষ্টি নরম কন্ঠ ভেসে এলো।

‘অত্যন্ত দুঃখিত শুভ্র। একটু ব্যস্ততার মাঝে ছিলাম।’

আমি হাসলাম। বললাম,

‘ইট’স ওকে। শরীর কেমন আপনার?’

‘আ’ম গুড। আপনার জ্বর কমেছে কি? ডক্টরের কাছে যাবেন?’

আমি রুমের দরজায় তালা ঝুলিয়ে একহাতে ফোন অন্যহাতে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাহিলের কথায় স্বল্প হেসে বললাম,

‘আমার হচ্ছে শেয়ালের জ্বর। এক বেলার বেশি থাকে না। ও নিয়ে চিন্তা করবেন না।’

‘আচ্ছা। করলাম না চিন্তা। ক্লাস আছে আজ? আসবেন?’

‘অন দা ওয়ে!’

______________

ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনে এসে বসেছি আমি আর অন্তি। বৃষ্টির ফলে মাঠে পানি জমেছে। সকল আড্ডা আজ ক্যান্টিনের আশপাশ ঘিরে বসেছে। অন্তি মোবাইলে ব্যস্ত হাত চালিয়ে টাইপ করে চলছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে ছোট করে শ্বাস ফেললাম।

‘আবার নতুন কারো প্রেমে পড়েছিস?’

আমার কথার জবাবে অন্তি আকাশ থেকে টুপ করে পড়ার মত‌ ভান করে বললো,

‘হোয়াট ডু ইউ মিন বাই নতুন কেউ? আগের গুলো মাত্র মোহ ছিল। এটাই প্রথম প্রেম। ইউ নো দোস্ত আমি এরকম একটা ছেলেকেই খুঁজছিলাম। প্যাশোনেট ইন্টেলিজেন্ট সাথে হ্যান্ডসাম। হি ইজ জাস্ট পারফেক্ট। একদম আমার টাইপের!’

আমি কফির মগে চুমুক বসিয়ে বললাম,

‘এই যে প্যাশোনেট ইন্টেলিজেন্ট এগুলো কিভাবে বুঝলি দোস্ত?’

আমার কথায় অন্তি গদগদ হয়ে বললো,

‘এগুলো হচ্ছে অভিজ্ঞতা! আমি ছেলেদের চোখ দেখলেই তাদের মন থেকে দেহ সব পড়ে ফেলতে পারি।’

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বাহবা দিলাম। দুদিন পর এটাও যে প্রথম প্রেম থেকে সরে মোহর লিস্টে দাঁড়াবে তা ঢের বুঝেছি আমি! তবে এমন একজোড়া চোখ থাকলে খারাপ হয়না! শিক্ষক মহাশয় এর মন থেকে দেহ সব পড়ে ফেলতে পারতাম! পরক্ষণে জিভ কাটলাম। ছিঃ কি নোংরা চিন্তা ভাবনা আমার! এত অধঃপতন কবে হলো?

চলবে…………..

(রি চেক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে