#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি
৫.
নিসাকে সাথে করে শপিং এ বেড়িয়েছি। এই আষাঢ় মাসেও গরমের কমতি নেই। যখন তখন ঝুপ করে বৃষ্টি নামছে কিন্তু প্রকৃতির উত্তাপ কমার নাম নেই। এই অসহ্য গরমে পড়ার জন্য পাতলা জামাকাপড় দরকার। দুই তিন দোকান ঘুরেও পছন্দ মতো কোনো জামা পেলাম না। ইতিমধ্যে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। শপিং মল মানুষে গিজগিজ করছে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এক নিঃশ্বাসে সবটা শেষ করে ফেললাম। নিসা অদূরে রেস্তোরাঁর দিকে ইশারা করে বললো,
‘আপু চল ঠান্ডা হয়ে আসি। ওখানের কোল্ড কফিটা দারুন!’
আমিও দিরুক্তি করলাম না। মার্কেট সাইডে হওয়ায় বেশ জমজমাট রেস্তোরাঁটা। নানা রঙের লাইটে সজ্জিত রেস্তোরাঁর কাঁচের গ্লাস দিয়ে আবিষ্ট সাইডের একটা ফাঁকা টেবিল দেখে বসলাম। সেলফ সার্ভিস হওয়ায় নিসাই গেল অর্ডার কনফর্ম করতে। আমি তখন আশপাশে তাকিয়ে পরিবেশ দেখছিলাম। পরিবেশটা মুগ্ধকর। অলস মস্তিস্কে সাহিলকে নিয়ে চিন্তায় ডুব দিলাম। ধ্যান সরলো নিসার কথায়। গরম মেজাজে এসে চেয়ার টেনে বসলো। চোখ মুখে তীব্র রাগের ঝলকানি। চোখের কোণে স্বল্প পানিও জমেছে। আমি হাসলাম। মেয়েটা ছোট থেকেই এমন। বেশি রেগে গেলেই কেঁদে ফেলে। বাবা বলেছেন মায়ের ও এমন স্বভাব ছিলো। এই অদ্ভুত সুন্দর স্বভাবটা আমার মাঝে নেই। আমি রেগে গেলে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেলি। কাঁদার সময় কোথায়? আমি ওকে ওর মত থাকতে দিলাম। বাসায় গিয়ে নাহয় শুনব কি ঘটেছে। আপাতত স্ট্রতে ঠোঁট চেপে কফির স্বাদ নিতে শুরু করলাম। এটা সত্যিই অসাধারণ।
এই অতি অসাধারণ একটি দিনে খুব জঘন্যতম একটা ঘটনা ঘটে গেল আমার সাথে। নিসার সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার চোখ আটকালো কিছুটা দূরত্বে বসে থাকা সাহিলের উপর। এই বাহারি আলোতেও তাকে চিনতে আমার একদম ভুল হয়নি। কিভাবে হবে? তার চোখ নাক ঠোঁট সবই যে আমার অতি পরিচিত!
সাহিলের অপজিটে সুন্দরী একটি মেয়ে বসে। দুজন খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। সাহিলের মুখে স্বাভাবিক হাসি। আমার হৃৎপিণ্ড খানিকের জন্য বন্ধ হয়ে এলো যেন। শ্বাস নিতে ভুলে গেলাম। সাহিল অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে কেন হাসবে? তার এই হাসি কি তবে সবার জন্য উন্মুক্ত? এটা আমি মানতে চাইলাম না। আমার মন মস্তিষ্ক কেউই এটা মেনে নিতে পারল না। আমার অস্থিরতা নিসার চোখের আড়াল হলো না। ও কিছুটা ভয় পেয়ে গেছিলো। চিন্তিত গলায় ব্যস্ত হয়ে বললো,
‘আপু শরীর খারাপ করছে? এত ঘামছিস কেন?’
আমি মাথা নাড়িয়ে মলিন হাসলাম। নিজেকে ধাতস্থ করতে দুমিনিট সময় নিলাম। নিসাকে আস্বস্ত করতে বললাম,
‘ঠিক আছি আমি। বের হই এখন?’
ও স্বায় জানালো। বাড়িতে ফিরে রাতে আর খাওয়া হয়নি। সদ্য ষোলতে পা দেওয়া কিশোরীর মতো না খেয়ে নিজের শোক প্রকাশ করার চেষ্টা করলাম। রাতে ঠিক করে ঘুম হলো না। সিনেমা নাটক বিভিন্ন কিছু দেখে রাত পার করলাম। ততক্ষণে আমার মন শান্ত না হলেও মস্তিষ্ক সচল হয়েছে। নিজের এই অধপতন সহ্য হচ্ছিলো না। এই মুহূর্তে আমার সাহিলকে আমার জীবনের ভিলেন মনে হলো। আমার গোছালো জীবনটার কি হাল করেছে লোকটা! সকাল হতেই ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম। এখানে যে উদ্দেশ্যে এসেছিলাম তার বিপরীত সব কিছু ঘটেছে। নিজের উপর খানিকটা বিরক্ত হলাম। এভাবে অন্য পুরুষের জন্য দেবদাসী হওয়ার কোনো মানে হয়?
_______________
ময়মনসিংহ থেকে ফিরে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আসলে যথাসম্ভব নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলাম। অলস মস্তিষ্ক সাহিল নামক যন্ত্রণাকে নিয়ে ভাবতে বসে যাবে বলেই পড়াশোনায় ফোকাস করার চেষ্টা করলাম। সামনেই সেমিস্টার ফাইনাল। মিডে দুই বিষয়ে ফেল করে বসে আছি। সুগোলো রিকভার করতে হবে। রাহার কাছ থেকে বইয়ের লিস্ট নিয়ে নিলক্ষেত থেকে একগাদা বই কিনে এনেছি। এখন বিরহে মরে যাওয়ার সময় নেই। পরীক্ষা শেষে এ ব্যাপারে ভাবা যাবে। এদিকে পড়ার টেবিলে বইয়ের স্থুপ জমেছে। কিছু বই কেনা এখনো বাকি। অন্যদিকে মাসের প্রায় শেষ! হাতের টাকা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। সময় করে বাবাকে কল করে টাকা চাইতে হবে। যদিও টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা অনলি টুয়েন্টি পার্সেন্ট! ছয় মাসের হাত খরচের টাকা এক ট্যুরে শেষ করে বসেছি। বাবা জানতে পারলে টাকা হাতে পাওয়ার সকল রাস্তা বন্ধ করে দিবেন! শেষ ভরসা হিসেবে আছে কেবল ছোট ফুপি! সব মিলিয়ে সুন্দর জীবনটা প্যারাময় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
.
.
লাইব্রেরিতে ছাত্র-ছাত্রীদের আনাগোনা বেড়েছে। এই সময় ভার্সিটির লাইব্রেরিতে জায়গা মেলা ভার! এত মানুষের সমগমে লাইব্রেরির পরিবেশ হয়ে উঠেছে উত্তপ্ত। মাথার উপর পুরতন ফ্যানগুলোর ক্যাচক্যাচ শব্দ যেন পরিবেশকে করে তুলেছে থমথমে। আমি আশপাশে তাকিয়ে বসার জায়গা খুঁজতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম। কিন্তু কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আমার ঠিক অপজিটে সিঙ্গেল টেবিলে বসে বইয়ে মুখ গুঁজে আছে সাহিল। আমাকে হয়তো সে লক্ষ্য করেনি। আমি একবার উঠে যাওয়ার চিন্তা করলেও পরক্ষণে তা ঝেড়ে ফেললাম। বিপদ দেখে পালিয়ে যাওয়ার মেয়ে নই আমি বরং দাঁড়িয়ে থেকে তা মোকাবেলা করাই আমার কাজ। খাতা কলম নিয়ে নোট করতে বসে গেলাম। আড় চোখে বার কয়েক সাহিলকে পর্যবেক্ষণ ও করলাম। ভদ্রলোক একইভাবে বইয়ের ভাঁজে মাথা গুজে বসে আছেন। এই শিক্ষক জাতিটাইকি এমন বোরিং!
লেখা শেষ করে উঠতে ঘন্টা খানেক সময় লাগলো। আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সাহিলের কথা মনে পড়লো। চোরা চোখে চাইতে তাকে কোথাও দেখলাম না। ভদ্রলোক হয়তো অনেক আগেই বেরিয়ে পড়েছেন! আমি স্বস্তির শ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলাম। ফোন বের করে অন্তিকে কল লাগালাম। এ সময় রাহাকে কখনোই কলে পাওয়া যাবে না। তার পানসে জীবনকে আরো পানসে করতে শখানেক বইয়ের মাঝে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে হয়তো!
‘কোথায় তুই?’
‘ক্যান্টিনে চলে আয়।’
কল কেটে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালাম। মাজা কোমর অবস হয়ে গেছে বসে থেকে। ঘামে ভিজে প্রায় জুবথুব হয়ে ক্যান্টিনে পৌঁছালাম। অন্তির সাথে কতেক সিনিয়র আপু ভাইয়ারা বসে আছে। আমায় দেখতেই তাদের মধ্যে একজন হেসে বললো,
‘এই তো তনয়া চলে এসেছে।’
আমি মুচকি হেসে অন্তির দিকে তাকালাম। ইশারায় বললাম,
‘এরা এখানে কেন?’
উত্তরে অন্তি মাথা নাড়ল। অর্থাৎ সে জানেনা। তুষর ভাই তার পাশের চেয়ার টেনে আমাকে বসার জায়গা করে দিলো। এই লোকটা সবসময় কেমন গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে। এমন আদিখ্যেতা আমার পছন্দ নয়। পুরুষ মানুষেকে হতে হবে কঠোর ব্যক্তিত্যসম্পন্ন। এমন আলাভোলা গলেপড়া পুরুষ আবার কেমন পুরুষ?
‘শুনলাম পড়াশোনা নিয়ে খুব প্রেশারে আছ?’
তুষরের কথায় আমি স্বাভাবিক ভাবে বললাম,
‘সামনে ফাইনাল। প্রেশারে থাকাটা কি স্বাভাবিক নয়?’
তুষর হো হো করে হাসলেন। আমি বিরক্ত দৃষ্টিতে চাইলাম। অকারণে এমন হাসির কোনো যৌক্তিকতা আছে? বিরবির করলাম,
‘পাগল লোক।’
তুষর শুনল কিনা জানি না তবে সে খুব ভাব নিয়ে বলল,
‘পড়াশোনা বিষয়ক যাবতীয় সমস্যাগুলো তুমি আমাকে বলতে পার। আমি যথাসম্ভব তোমাকে সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করবো।’
আমি মুচকি হেসে সায় জানালাম। ভদ্রতা বজায় রাখতে চেয়েও নিজের অভদ্র স্বভাবের জন্য তা সম্ভব হলো না। মুখ ফোঁসকে বলে ফেললাম,
‘কিন্তু ভাইয়া আমি যে সুনেছিলাম আপনাকে এবার হলে বসতে দেওয়া হবেনা! মিডে সকল বিষয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ফেইল করার জন্য বোধহয়?’
অপ্রত্যাশিত এহেন কথায় তুষর মুখ লুকানোর জায়গা পেল না। স্বলজ্জ ভঙ্গিতে উঠে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় অবশ্য সকল বিল পরিশোধ করে দিয়েছেন। তার পিছু ধরে অন্তি বাদে প্রায় সকলেই বের হয়ে গেলেন। জায়গা খালি হাতেই অন্তি পেট চেপে ধরে হাসতে শুরু করলো।
‘সিরিয়াসলি তনা! এগুলো তোকে দিয়েই সম্ভব। মুখটা দেখেছিস কেমন চুপসে গেছিলো!’
আমি বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকালাম।
‘ওদের সাথে নিয়ে বসেছিলি কেন?’
আমার কথায় অন্তি হাসি থামিয়ে সোজা হয়ে বসলো। সরু চোখ করে বললো,
‘আমি কেন ওদের সাথে নিয়ে বসবো। তুষর ভাইয়াই তো তনয়া তনয়া করতে করতে এসে হাজির হলো।’
আমি নাক কুঁচকে বিরবির করলাম,
‘অসহ্য লোক!’
______________
সেদিন রাতেই ঘটলো এক দুর্দান্ত ঘটণা। হলের বারান্দায় ধোঁয়া ওঠা কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা গুনছিলাম। এই কাজটা আমি প্রায় সময়ই করে থাকি। আকাশটাও বেশ উজ্জ্বল। কিছু সময় আগেই একদফা বর্ষণে সকল মেঘ কেটে গেছে। বাহিরে এখন শীতল বাতাস। বর্ষণের পরের আকাশটা ভিষণ সুন্দর। সাথে পরিবেশটাও। কেমন সতেজ একটা ভাব আর সাথে ভেজা মাটির গন্ধ। একদম মন মাতিয়ে তোলা একটা পরিবেশ। চোখ বন্ধ করে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে চাইলাম। কিন্তু প্রকৃতির প্রতি এই অগাধ প্রেম হয়তো কারো একজেনর সহ্য হলো না। রেলিংয়ের উপর রাখা ফোনটা ভাইব্রেট হলো। মেসেজ এসেছে। সময় তখন দশটা কি তার বেশি। একবার এড়িয়ে যেতে চেয়েও গেলাম না। ম্যাসেজ ওপেন করতেই চক্ষু চড়কগাছ। সাহিল ম্যাসেজ করেছে। ফর্মালিটি সাইডে রেখে তার প্রথম ম্যাসেজটা এমন ছিল,
‘আপনার হলের সামনে অপেক্ষা করছি। ঝটপট নিচে নেমে আসুন।’
আমার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পরলো। ভদ্রলোক আমায় রিকোয়েস্ট করলো নাকি অর্ডার করলো? ভাবনা চিন্তা সাইডে রেখে গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হলের সামনে রাস্তায় কালো রঙের প্রাইভেট দাড় করানো। তাতেই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আমি বড়বড় পা ফেলে ঠিক তার সামনে যেয়ে দাড়ালাম। চোখ সরু করে ভ্রু নাচিয়ে বললাম,
‘তো শিক্ষক মহাশয়! এত রাতে মহিলা হলের সামনে ঠিক কি কারণে?’
চলবে…….