#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি
৪.
লজ্জা জিনিসটা অদ্ভুত। কোনো বার্তা ছাড়াই হুট করে জেঁকে বসে। যেমন তেমন লজ্জা না একদম গা ঢাকা লজ্জা। এই মুহূর্তে সাহিলের পাশে বসে থাকতে আমার ঠিক তেমন ধরণের লজ্জা লাগছে। অকারণে এমন লজ্জা পাওয়ার পেছনের কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না।
‘আপনি ঠিক আছেন? অস্বস্তি বোধ হলে বলতে পারেন!’
ভদ্রলোকের এহেন কথায় অস্বস্তি অরেক দাপ বেশি বাড়লো বোধহয়। আমি নড়েচড়ে বসলাম। নিজেকে যথেষ্ট জেনটাল প্রমান করতে মুচকি হেসে বললাম,
‘আমি ঠিক আছি। কিছু বলবেন?’
পরিস্থিতিটা আরো গুমোট হয়ে এলো। এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি! আমি হাশফাশ করে উঠলাম। আমার সাজিয়ে রাখা কথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পুরো আমিটাই এই মানুষটার সংস্পর্শে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি যেন। সাহিল প্রগাঢ় চোখে তাকালো। কপালের মাঝে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে বললেন,
‘আপনি কি অসুস্থ তনয়া? আপনাকে স্বভাবিক লাগছে না!’
আমি চোখ তুলে তাকালাম। এই প্রথম তার মুখে আমার নাম শুনলাম। তার চোখে আমায় নিয়ে দুশ্চিন্তা নজরে এলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে সে তার ডান হাতের উল্ট পিঠ দিয়ে আমার কপাল ছুঁয়ে দিল। আমার ক্লান্ত মন এত কিছু হয়তো সহ্য করতে পারলো না। কি হয়েছিল এরপর আমার জানা নেই। কিন্তু যখন চোখ খুললাম তখন নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলাম। পাশেই চিন্তিত মুখে সাহিল বসে আছে। আমার অস্বস্তির সীমা এবার রেখা পার করে ফেলেছে। সিরিয়াসলি!! প্রেমে পড়লে মানুষ জ্ঞান হারায় এটা নিজেকে না দেখলে হয়তো কখনোই জানতাম না! বাই এনি চান্স মিডিয়া এ কথা জানতে পারলে হয়তো আজকের নিউজের হট টপিক হতো,”প্রেমিক পুরুষের সন্নিকটে আসার দরুণ এক রমণীর প্রাণনাশ!’
মিডিয়ার কাজ স্বভাবত এক স্টেপ বাড়িয়ে বলা। এ নিয়ে পুরো দেশে হয়তো হৈ চৈ পড়ে যেত। হয়ত পরবর্তী ইতিহাসে বিরল প্রেমিকার চরিত্রে আমার নাম লাইলি মজনুর মতোই অক্ষয় অবস্থায় থেকে যেত।
‘এখন কেমন বোধ করছেন মিস?’
সাহিল বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো। আমি শুকনো হেসে বললাম,
‘একদম সুস্থ আমি। বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করুণ প্লিজ।’
সাহিল মাথা নাড়িয়ে বেড়িয়ে গেল। আমি বড় করে শ্বাস ফেললাম। অনুভূতির সাথে আর কত লুকচুরি খেলব? এর একটা সমাধান দরকার। একটা প্রোপার সলিউশন!
_____________
সাহিল বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। ভদ্রতার খাতিরে তাকে মিষ্টি হেসে চায়ের আমন্ত্রণ করেছিলাম। কিন্তু ভদ্রলোক অতিব সুন্দর ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে বিদায় নিলেন। সময় গড়িয়ে তখন প্রায় রাত নয়টা। বাসায় ঢুকতেই নিসার হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো। কোনোভাবে তা কাটিয়ে উঠতে পারলেও বাবার গম্ভীর কন্ঠে থেমে গেলাম।
‘এত দেরী কেন?’
এমন প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। তাই বিনি সংকোচে ঝটপট জবাব দিলাম,
‘তোমার পছন্দের পাত্রের সাথে দেখা করতে যেয়েই তো দেরী হলো! কিছু জানার থাকলে সেই ভদ্রলোকের থেকেই নাহয় জেনে নাও!’
আমি আর দাঁড়ালাম না। ঝটপট রুমে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে দিলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। একে একে আজকের সকল ঘটনা রিকল করলাম। আমার অন্ত:আত্মা আমায় জানান দিলো, আমি বদলে গেছি! এই আমির সাথে আমি পরিচিত নই! সিলিং এ ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনিক পাখার দিকে তাকিয়ে আনমনে বললাম,
‘আপনি নামক রোগটা আমায় গ্রাস করে নিচ্ছে সাহিল। খুব দ্রুত এর প্রতিষেধক দরকার। আর সেটা হচ্ছেন আপনি!’
.
.
তীব্র বজ্রপাতের শব্দে ধরফরিয়ে উঠলাম। মাথাটা প্রচন্ড ধরে আছে। এই মাথা ব্যাথাটা অনেকটা সাহিলের মতোই! হুটহাট করে আগমন ঘটে এদের। আদো আদো চোখে তাকাতেই জানালার সাদা পর্দা ভেদ করে সূর্যের আলো এসে মুখে পড়লো। এমন রোদ্র উজ্জল দিনে বজ্রপাত কোথায় ঘটলো? প্রকৃতির এতটা অধপতন কবে হলো? এরই মাঝে আবারো তীব্র শব্দে কান ধেই হারালো। বিরক্ত চোখে দরজার দিকে তাকালাম। এলোমেলো পায়ে উঠে দরজা খুলে দিতেই এক ঝাঁক পোলাপাইন আমার ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো। আগেই বলেছিলাম আমার গুষ্টির প্রায় সকল লোকই পাগল! এরা সেই পাগলের-ই অংশ মাত্র।
‘এত রুম থাকতে এখানেই কেন বাপ তোরা?’
পিচ্চিগুলোর মধ্যে সবথেকে ছোট সদস্য হলো তুয়া। আমার চাচাতো কাজিনের মেয়ে। ভিষণ মিষ্টি একটা মেয়ে। বয়স সবে পাঁচ। সে এগিয়ে এসে জানালো,
‘মিষ্টি আম্মি তুমাল রুমে খেলা করতে বলেছে।’
বাকিদের দিকে তাকাতে তারাও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আমি আর বলার কিছু পেলাম না। বাচ্চাদের সাথে তো আর ঝগড়া করতে পারি না রুম নিয়ে!
নিচে নামতেই দেখা গেলো গোটা গুষ্টি সমেত ব্রেকফাস্ট করতে বসেছেন বাবা। কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকাতেই স্মরণ হলো আজ মায়ের জন্মদিন! বাবা মায়ের জন্মদিনটা খুব সুন্দর করে মনে রেখেছেন। বিগত বিশ বছর যাবত তিনি এভাবেই মায়ের জন্মদিন পালন করে আসছেন। আমাকে দেখতেই তিনি গম্ভীর গলায় বললেন,
‘তুমি অলরেডি টেন মিনিট লেইট করে ফেলেছ! তোমার জন্য নাস্তা রেডি করা রয়েছে। বসে পরো।’
নিসা আমার দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে বসার জায়গা দেখিয়ে দিলো। বড়ো ফুপি এক গাল হেসে বললেন,
‘তোর রূপ দিন দিন চোখ ধাঁধানো হচ্ছেরে তনয়া! একদম তোর মায়ের মতো। প্রথম যেদিন তোর মাকে আমরা দেখতে গেলাম ওমা তোর বাবা এক দেখাতেই তোর মাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবেনা বলে জানিয়ে দিলো!’
বাবা একটু কেশে উঠলেন। তবে তার মুখে আমি তৃপ্তির হাসি দেখতে পেলাম। নিসা আগ্রহ নিয়ে ফুপির গল্পের পরের টুকু শোনার জন্য তাগাদা দিল।
‘তারপর আর কি, তোর নানার হাত পা ধরে রাজি করাতে হয়েছিল। তোর মায়ের তখন বয়স কম ছিলো। অত ছোট মেয়ে বিয়ে দিতে চাননি ভদ্রলোক।’
বাবা ফুপিকে থামিয়ে দিলেন। তার গম্ভীর্যতা ধরে রেখে বললেন,
‘পুরোনো কথা থাক। সবাই যখন একসাথে আছ আমি তনয়ার বিয়ের ব্যাপারটা আগাতে চাই।’
সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকালো যেন এখানে আমার বিয়ে না আমাকে কুরবানী করার গোল মিটিং বসেছে। আমি ওদিকে নজর দিলাম না। নিচমিচ তাকিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলাম। বড় ফুপি আলতো হেসে বাবাকে এক ভয়ংকর আবদার করে বসলো।
‘ভাই বলছি তনয়া আমাদের সবার খুব আদরের। সেই ছোট থেকে সবাই কোলে পিঠে করে বড় করেছি ওকে। বাড়ির মেয়েকে বাহিরে না দিয়ে নিজেদের মধ্যে রাখলেই হয়না! আমার তুহিনের জন্য তনয়াকে দিলে হয়না? তুহিন এখন সরকারি চাকরি করে ওদের দুজনকে বেশ মানাবে!’
আমি চমকে তাকালাম। ফুপিকে সমর্থন করলেন ফুপাও। ছোট চাচ্চু মত না দিলেও তাকে অখুশি মনে হলো না। আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবার মতামতের উপর নির্ভর করছে আমার পদক্ষেপ। বাবা সময় নিয়ে ভাবলেন। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
‘সেটা ঠিক। তেমন হলে ভালোই হয়। কিন্তু বাচ্চাদের মতামতের ও একটা বিষয় আছে!’
ফুপি প্রায় সাথে সাথেই বললেন,
‘তুহিনের সাথে আমি এ ব্যাপারে আগেই কথা বলে রাখছিলাম। ওর আপত্তি নেই। তনয়ার মত হলেই হয়ে যায় তাহলে।’
ফুপি কথা শেষ করে আমার দিকে তাকালেন। প্রায় সবগুলো চোখ আমাতে নিবদ্ধ হলো। এই প্রথম হয়তো আমি নিজের মত জানাতে কেঁপে উঠলাম! হাঁসফাঁস করে ছোট করে বললাম,
‘আমার যদি মত না থাকে তোমরা কি খুব বেশি কষ্ট পাবে?’
আমার কথায় সকলে নড়চড়ে বসলো। ফুপি মুচকি হেসে জানালেন,
‘এমা কষ্ট কেন পাব? তুই তো আমাদেরই মেয়ে! তোর মনের বিরোধীতা কেন করবো আমরা?’
আমার বড় ফুপি এমনই। তার মুখের কথা এমন মিষ্টি হলেও তিনি এমন মিষ্টি স্বভাবের মানুষ না। এ ব্যপারটা নিয়ে জল কতদূর গড়াবে জানা নেই তবে এ বিয়েতে আমার কোনো মত নেই! আমি মলিন হেসে বললাম,
‘সত্যি বলতে আমি এই বিয়েটা করতে চাইনা।’
আমার এমন স্বীকারোক্তিতে চমকে উঠলেন ফুপি। সরু চোখে তাকিয়ে জানতে চাইলেন,
‘বিয়ে করতে চাইছিস না? নাকি তুহিনকে বিয়ে করতে আপত্তি?’
এমন কিছুর আশাই আমি করেছিলাম। খিচুড়ি গালে তুলে নিতে নিতে ঝটপট জবাব দিলাম,
‘বিয়ে কেন করবো না? কেবল তোমার ছেলেকে চাইছি না ব্যাস!’
এরপরের ব্যাপারটা হয়তো আপনারা অনুমান করতে পারছেন! ফুপি রেগে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার সোনার টুকরো ছেলেকে পায়ে ঠেলে দেওয়ার মতো জঘন্য অপরাধ করার জন্য কেঁদে কেটে বাবার কাছে বিচার চাইতে লাগলেন। আমি প্লেট হাতে উঠে দাঁড়ালাম। এখানে বসে খাওয়ার পরিবেশ নেই। খিচুড়িটা চমৎকার হয়েছে। বহুদিন পর এমন খিচুড়ি খাচ্ছি। হলের সাদা রঙের খিচুড়ি খেতে খেতে এতদিনে খিচুড়ির স্বাদ ভুলেই বসেছিলাম!
চলবে………
(ভুল ত্রুটি মার্জনা করিবেন ধন্যবাদ 💓)