#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি
২.
এরপর কেটে গেছে তিনটি মাস। ক্ষণিকের মুগ্ধতা কাটিয়ে সাহিল নামের সুদর্শন পুরুষকে ততদিনে আমি ভুলে বসেছি।
পড়াশোনায় শেষের দিকে হলেও ডিপার্টমেন্টের বেশ পরিচিত মুখ আমি। সাংস্কৃতিতে পারদর্শী হওয়ার দরুন এই পরিচিতি। বন্ধুমহলেও কদর রয়েছে বেশ। সুন্দরী হওয়ার দরুন সিনিয়র ভাইয়াদের সাথেও সক্ষতা রয়েছে বেশ। শিক্ষকদের প্রিয় শিক্ষার্থী কিনা জানিনা তবে তাদের কাছেও বেশ পরিচিত মুখ। এক কথায় তনয়া নামের সাথে ভার্সিটির জুনিয়র সিনিয়র সকলেই বেশ পরিচিত। কাহিনীর শুরু ভার্সিটির রিইউনিয়ন থেকে। বেশ জমজমাট আয়োজন করা হয়েছিল। ভলেন্টিয়ার হিসেবে নাম উঠেছিল আমার। আগ্রহ না থাকলেও জয়েন হতে হয়েছিল। এত বড় প্রোগ্রাম হোল্ড করার জন্য ভলেন্টিয়রদের দায়িত্ব ছিল আকাশ সমান। আমার দায়িত্ব ছিল মঞ্চের ওখানে। সবাইকে সুন্দর করে জায়গা মতো বসানো হাসি মুখে দু একটা কথা বলা এগুলো ছিল অনেকটা একঘেয়ামি কার্যকলাপের মতো। আমার পরনে ছিল লাল রঙের জামদানী সাথে সাদা রঙের ব্লাউজ। উদ্ভট মনে হলেও আমার কাছে এটাই বেস্ট লেগেছিল। খোপায় গুজেছিলাম তাজা বেলী ফুলের মালা। হাত ভর্তি করে লাল সাদা কম্বিনেশনে চুড়ি। ঠোঁটেও লাগিয়েছিলাম গাঢ় লাল রঙ। চোখে অল্প কাজল। সাজ বলতে এইতো যথেষ্ট!
সকলের প্রশংশায় পিঠে আলতো হসি উপহার দিতে দিতেই লক্ষ করলাম আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে সাদা শার্ট পরিহিত এক ব্যক্তিকে। স্বল্প সময়ের অতি পরিচিত ব্যক্তিটি চোখে মুখে হেসে কোনো এক শিক্ষকের সাথে কথা বলছেন। হৃদস্পন্দন যেন খনিকের জন্য থেমে গেলো। অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালাম,
‘সাহিল!’
সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া ক্ষণিকের অনুভূতিরা নতুন করে নাড়া দিয়ে উঠলো। আমার ইন্দ্রিয় বারবার করে জানান দিতে লাগলো আমি এই পুরুষের সাথে প্রেম নামক বস্তুতে আটকে পড়তে চলেছি। ইংলিশে যেটাকে বলা হয় love at first sight. চোখ সরিয়ে নিতে চেয়েও পাড়লাম না। অবাধ্য চোখদুটো ঘুরেফিরে তার দিকেই আটকাচ্ছে। মস্তিষ্ক চরম বিদ্রুপ করে জানালো,বিয়ে ভাঙতে যেয়ে প্রেমের ঘাটে ডুব দিয়ে ফেলেছি আমি। কি সাংঘাতিক ব্যাপার!
ইতিমধ্যে অন্তি আর রাহা ও চলে এসেছে। আমার বন্ধুমহলের সবথেকে কাছের দুজন মানুষ এরা। রাহা শাড়ি পড়ায় ভিষণ কাঁচা। পথিমধ্যে পায়ে বাদিয়ে শাড়ির কুচি নষ্ট করে ফেলেছে। এই মুহূর্তে আমার প্রধান কাজ ফাঁকা কোনো রুম খুঁজে তার শাড়ি ঠিক করে দেওয়া। একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেল আমায় রাহা। যাওয়ার সময় সাহিলের সাথে চোখের মিলন ঘটলো। লোকটার ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল না সে অবাক হয়েছে কিনা। আমার ভিষণ ইচ্ছা হয় তাকে বোঝার। তার মনের চিন্তাগুলো বইয়ের মতো করে পড়ার। আমাকে নিয়ে কি তার মনের কোনে কোনো কথা জমেছে কি না জানার ভিষণ ইচ্ছা হলো আমার।
____________
‘এত এত সুদর্শন পুরুষদের ভীরে আমার নিজেকে মৌমাছি মনে হচ্ছে।’
অন্তির কথায় আমি হাসলাম। অন্তির বিশেষ এক গুন আছে। সে টুপটাপ করে প্রেমে পড়ে যায়। একসাতে পাঁচ-ছ জনের প্রেমে পড়ার রেকর্ড ও তার আছে। রাহার ব্যাপারটা ভিন্ন। সে আমার মতো করে হুটহাট হারিয়ে যেতে চায়। আমার অবশ্য সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণের কোনো ইচ্ছা নেই। তবে সে সন্নাসিনী হতে চায়। এই সংসার-ধর্ম পড়াশোনা সকল কিছু তার কাছে পানসে লাগে। এই পানসে লাগার ফল হিসেবে প্রিতিবার ক্লাস টপ করে সে! এমন পানসে জীবন তো সকলের কাম্য!
‘তারপর? আঙ্কেল তোর বিয়ের ব্যাপারটার কি করল?’
রাহার কথায় আমি তপ্ত শ্বাস ফেললাম। কুচি ঠিক করতে করতে বললাম,
‘এবার সেমিস্টার ফেইল করলে ভুরিওয়ালা কনফর্ম। তুই শেষ ভরসা। পাশ করার একটা ব্যাবস্থা কর মা!’
আমার কথার পিঠে অন্তি প্রশ্ন করে বসলো,
‘তুই না একজনের সাথে দেখা করলি? তার কি খবর?’
আমার চোখে সাহিলের মুখ ভেসে উঠলো। কথা এড়াতে সোজা জবাব দিলাম,
‘জানি না।’
.
.
ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে মাঠে বা মঞ্চে কোথাও সাহিলের দেখা পেলাম না। যেমন হঠাৎ করে এসেছিল ঠিক সেভাবেই হঠাৎ করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল যেন। আমি হতাশ হলাম। মন ভাঙার মতো বেদনা অনুভব হলো। মুখে না বললেও আমি মনে মনে তাকে আরো একটিবার দেখতে চাইলাম। আনমনে বললাম,
‘আপনি ভিষণ অসামাজিক শিক্ষক মহাশয়! সমাজের নিয়ম অনুযায়ী আপনার উচিত ছিল মুগ্ধ হাসি হেসে বলা, আপনাকে চমৎকার লাগছে শুভ্রলতা! আপনার উচিত ছিলো আমার রূপে মুগ্ধ হওয়া। আপনি কোনোটাই করেননি। এ সমাজ কিছুতেই আপনাকে মানবে না।’
‘আপনাকে চমৎকার লাগছে শুভ্রলতা!’
স্পষ্ট চিরচেনা কন্ঠে চমকে উঠলাম। সাহিলের পারফিউমের কড়া গন্ধ নাকে এসে বাড়ি খেলো। উপলব্ধি করলাম সে আমার খুব নিকটে দাঁড়িয়ে। কেমন গা হিম করা সিচুয়েশন। আমি একটুতে চমকে যাওয়া মেয়ে নয়। কিন্তু এই ব্যক্তি শুরু থেকে একেরপর এক চমক দিয়ে আসছে। ব্যাপারটা খুবই অমানবিক। আমি সময় নিয়ে ঘুরলাম। লোকটা কি মনটন পড়তে পারে নাকি? মুচকি হেসে বললাম,
‘আবারো দেখা হলো শিক্ষক মহাশয়!’
সাহিল মাথা দুলিয়ে হাসলো। আমি এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। এই লোকের দিক তাকানো পাপ। তাকালেই সর্বনাশ। মায়াজালে জড়িয়ে যাব যেখান থেকে ফেরার পথ থাকবে না। ভদ্রলোক আলাপের চিরপরিচিত বৈশিষ্ট্য ভঙ্গ করে শুধালেন,
‘শুভ্রলতাকে শুভ্র রঙেই স্নিগ্ধ লাগে জানেন তো?’
আমার চোখ সরু হলো। বহুদিন বাদে দেখা হলে কেমন আছেন? বা কি অবস্থা? এ ধরণের প্রশ্ন করাটা সামাজিক রীতি। এই লোক তো তার ধারেকাছেও নেই! বাট আই লাইক ইট!!
উত্তরে পালটা প্রশ্ন করলাম।
‘আর লাল?’
সাহিল ঠোঁট কামড়ে হাসলো। কিছু একটা ভেবে আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
‘লালে তাকে আগুনের শিখার মতো লাগে। উজ্জ্বল, তেজস্বী, ভয়ংকর মোহনীয় রমনী!’
এক মুহুর্তের জন্য হৃৎস্পন্দন থামলো হয়তো। পরক্ষণে দ্রুত বেগে ছুটতে লাগলো। গলা শুকিয়ে এলো। লোকটা তবে ফ্লার্টিং করতেও জানে! আমার অস্থিরতা তাকে বুঝতে না দিয়ে শুধালাম,
‘সুদর্শন পুরুষেরা বুঝি এভাবেই নারীদের হৃদয় হরণ করে?’
জবাবে সাহিল পকেটে হাত গুঁজে আরো কিছুটা ঝুঁকে এসে বললো,
‘তবে কি আমি সফল হয়েছি হৃদয় হরণ করতে?’
আমি কেঁপে উঠে এক পা পিছিয়ে গেলাম। পরিস্থিতি আজ আমার বিপক্ষে। এই লোকের সামনে আর এক মুহূর্তও নয়। কিন্তু হুট করে চলে যাওয়া খুবই বেমানান। নিজের ইমেইজ কিছুতেই ডাউন হতে দেওয়া যাবে না। প্রসঙ্গ বদলাতে বললাম,
‘আপনি কত তম ব্যাচের? আপনাকে এর আগে কখনো ভার্সিটিতে দেখিনি।’
আমার অস্বস্তি হয়তো বুঝলেন তিনি। কিছুই হয়নি এমন ভাবেই বললো,
‘আমি পড়াশোনা করেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে।’
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।
‘তবে এখানে?’
উত্তরে মুচকি হেসে বললেন,
‘এখানের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক আমি।’
আমি চমকে তাকালাম। এটা আশা করিনি অন্তত! তৃতীয় বারের মতো আমার হৃদয় ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেলো। আহত চোখে তাকাতেই সাহিল যেন সবটা বুঝে নিল। প্রায় সাথে সাথেই সে বললো,
‘আমার সাথে ফর্মাল হতে হবে না ম্যাডাম। আপনার এই সত্তার সাথেই অভ্যস্থ আমি।’
প্রতিউত্তরে আমি কিছু বলার আগেই আমার ডাক এলো। আমাদের আলাপ এ পর্যন্তই থমকে দাঁড়াল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় জানাতে হলো তাকে। সেদিন তার সাথে আমার আর দেখা হয়ে ওঠেনি।
এরপর আবারো সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। ভার্সিটিতে গেলেও কখনো তার সাথে দেখা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য আমি চেষ্টা ও করিনি। বরং নিজেকে তার থেকে আড়াল করার চেষ্টা করেছি প্রতিনিয়ত। এর মাঝে একদিন বাবা কল করলো। বাবা সচরাচর আমাকে কল করে না। আমি সবে ভার্সিটি থেকে হলে ফিরেছি। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় শুধালেন,
‘বাসায় চলে এসো। দুদিন এসে থেকে যাও।’
‘ক্লাস আছে…’
‘ওটা দুদিন না করলেও চলবে। ক্লাস করে জিরো পাওয়ার থেকে না করে জিরো পাওয়া তুলনামূলক বেশি সম্মানের।’
আমি চট করে জবাব দিলাম,
‘আসলেই! এটা তো ভেবে দেখিনি।’
ওপাশ থেকে বাবা রেগে গেলেন বোধহয়। চরম বিরক্ত নিয়ে বললেন,
‘তুমি ঠিক কবে শুধরাবে? ছোট বোনের থেকেও তো কিছু শিখতে পারো!’
নিসা হয়তো বাবার পাশেই ছিল। চিৎকার করে বললো,
‘আপু চলে আয়। তোকে ১০% ছাড়ে লেকচার দিব।’
আমি কল কেটে দিলাম। ড্রয়ার থেকে লাল মলাটের ডায়েরিটা বের করে লিখতে বসলাম। অনেক কথা জমেছে। কিন্তু লিখতে যেয়ে সব কেমল অগোছালো হয়ে গেলো। কিভাবে শুরু করবো ভেবে পেলাম না। অগোছালো ভাবনা নিয়ে এলোমেলো ভাবে গোটা গোটা অক্ষরে লিখলাম,”আমার স্নিগ্ধ পুরুষ!”
হাত থেমে গেলো। নিজের লেখার দিকে নিজেই বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। মন অবাধ্য হয়েছে বহু আগেই। শরীর ও অবাধ্যতা শুরু করেছে। এ মেনে নেওয়া যায় না! ডায়েরি আগের স্থানে রেখে উঠে পড়লাম। বড় করে নিঃশ্বাস নিলাম। একটু আবহাওয়া পরিবর্তন দরকার।
বাসায় যাওয়া হয়না অনেকদিন। একবার ঘুরে আসা উচিত। বাবা মুখে না বললেও আমি জানি সে আমাকে মিস করছে। নয়তো কল করে যাওয়ার জন্য বলতো না। ভাবতে ভাবতেই ব্যাগ গোছাতে লেগে পড়লাম। একটা লম্বা ছুটি কাটিয়ে সাহিল নামক যে কীটপতঙ্গ মাথায় গন্ডগোল পাকিয়ে আছে তা চিরতরে দূর করে তবেই ফিরব।
চলবে……….
(ভুল ত্রুটি মার্জনা করিবেন। ধন্যবাদ)