#প্রেমাচ্ছন্ন_প্রহর
#লাবিবা_আল_তাসফি
১০.
প্রেমে পড়লে মানুষ বদলায়। সাথে বদলায় তার চিরচেনা অচেনা স্বভাব ও। আমার ও বদলেছে। বিয়ে বিদ্বেষী এই আমি হুট করেই বিয়ে নিয়ে ভাবতে বসে পড়েছি। এই ভাবনার মূল কারণ আমার রেজাল্ট। এভাবে অন্য সকল শিক্ষকদের সামনে হবু বউকে নিয়ে সম্মানহানির পর লোকটা যদি বিয়েতে মত না দেয়? যুক্তিটা লেইম মনে হলেও আমি এই মুহূর্তে এটা নিয়েই প্রচন্ড ভাবনায় তলিয়ে আছি। আমার এমন হাল দেখে অন্তি চট করে বলে ফেলল,
‘দোস্ত বিয়ে নিয়েই তো চিন্তা? চল ভাইয়াকে তুলে নিয়ে আসি! হাতুড়ি হাতে হুমকি ধামকি দিয়ে কবুল বলিয়ে নিলেই কাজ খতম।’
ওর কথায় সহমত হতে পারলো না রাহা। বিরক্ত ধরা গলায় বললো,
‘সিনেমার কাহিনী বাদ দে। আর তুলতে যে যাবি তুই কি ওর সেই প্রেমিকরে চিনোস?’
এতক্ষণে অন্তি নড়েচড়ে বসলো। আমিযে তাদের না জানিয়ে প্রেম করে ফেলেছি কথাটা এতক্ষণে তার মনে পড়লো। সরু চোখ করে চেয়ে বললো,
‘তুই তো বেটি শত্রুর থেকেও খারাপ। বিয়ের প্লান করতে বসে গেলি আর আমরা জানতেই পারলাম না প্রেমের মতো কাজ তুমি কবে শুরু করছোস!’
অন্তির সাথে সায় জানালো রাহাও। তাদের মতে এ ব্যাপার গোপন করার মাধ্যমে আমি তাদের সাথে মিরজাফরের মতো কাজ করেছি। তারপর আর কি? না বলে কি আর উপায় আছে! আমার কথা শেষ হতেই অন্তি চিৎকার করে উঠলো,
‘দোস্ত তুই তো দেখি একবারে ছক্কা মেরে দিছোস! একবারে স্যারকে পটাই বইসে আছস! ইউ আর এ জিনিয়াস দোস্ত!’
অন্তিকে থামিয়ে দিলো রাহা। সে এ ব্যাপারটায় প্রচন্ড রকম হতাশ অনুভব করছে। চোখ নাক কুঁচকে থমথমে গলায় বললো,
‘দেশে ছেলেদের অভাব পড়ছে? এত ছেলে থাকতে তোর কেন শিক্ষক রূপে বুড়ো ব্যাটার প্রেমে পড়তে হবে?’
রাহার কথায় আমি তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলাম। বললাম,
‘তার বয়স সবে একত্রিশ! বুড়ো কিভাবে হয়?’
আমার কথায় রাহা বিরক্ত হলো। কিছু একটা হিসাব করে বললো,
‘তোদের বয়সের পার্থক্য দেখছিস?ঐ ব্যাটা তোর থেকে নয় বছরের বড়ো। বুড়ো ছাড়া আর কি বলবো?’
আমি কিছু বলতে নিব তার আগেই অন্তি রাহার উপর হামলে পড়লো।
‘তুই বন্ধু না দুশমন? কোথায় মেয়েটাকে একটু শান্তনা দিবি তা না করে তুই বয়সের অংক কষতে বসে পড়ছিস।’
এদের ঝগড়ায় আমি হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ঘড়িতে এখন রাত আটটা। অন্তিদের বাড়িতে এসেছিলাম দুপুর বারোটা নাগাদ। হাতে ছোট একটা পার্স আর মোবাইল নিয়েই বেরিয়েছিলাম।
‘একি তুই কোথায় যাস?’
‘মাথা ধরেছে খুব। হলে ফিরে একটা লম্বা ঘুম দিব।’
অন্তি নাকোচ করলো।
‘আজ এখানেই থেকে যা। মা রান্না করছে।’
আমি কোনোভাবে অন্তিকে বুঝিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় বের হতেই মন আবার বিষন্নতা ছেয়ে গেল। হলে ফিরতে ইচ্ছে হলো না। চারপাশে তখন ঘুটঘুটে আঁধার নেমেছে। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। সোডিয়ামে্য আলোতে রাস্তাঘাট উজ্জ্বল হয়ে আছে। রাতের ঢাকা শহর সুন্দর। এই সৌন্দর্যতা আমাকে বরাবরের মতোই মুগ্ধ করলো। মন খারাপের হ্রেস কেটে গেলো অনেকটা। কিছুদূর এগিয়ে সাহিলকে কল করলাম। ভদ্রলোক এখন ফ্রি। ব্যস্ত থাকলেও বা আমার কি? একবার রিং হতেই সে কল রিসিভ করলো।
‘মন ভালো হয়েছে?’
কল রিসিভ করেই এমন প্রশ্নে আমি ভ্রু বাঁকালাম। অবাক গলায় বললাম,
‘আমার মন খারাপ আপনি কিভাবে জানলেন?’
লোকটা নিঃশব্দে হাসলেন। আমি সেটা মোবাইলের এপাড়ে থেকেও উপলব্ধি করতে পারলাম। আমার ঠোঁটের কোণে ও হাসি ধরা দিলো।
‘প্রেয়সীর মন খারাপের খবর প্রেমিক পুরুষ ছাড়া কে জানবে?’
আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম। দুষ্ট হেসে তাকে বললাম,
‘আপনি বুঝি প্রেমিক পুরুষ? কোই আমিতো কারো প্রেম আহ্বান এ সাড়া দেই নি! কেউ অবশ্য আহ্বান জানাননি ও!’
উত্তরে সাহিল গম্ভীর স্বরে বললো
‘ওসব প্রেম আহ্বান আমার দ্বারা হবেনা শুভ্র। আমার প্রেমের বয়স ফুরিয়েছে। এখন বিয়ে করে সংসার করার বয়স। আমার বন্ধুদের বাচ্চারা এখন স্কুলে যেতে শুরু করেছে অন্যদিকে আমি আমার বাচ্চার মাকে ঘর অবদি তুলতে পারিনি।’
লোকটার কথায় খানিক লজ্জা পেলাম। সারাদিনের চিন্তা চেতনা মন খারাপ ভুলে লজ্জায় আড়ষ্ট হলাম। আমার প্রতি প্রেমিক পুরুষের মনে বিরক্তি জন্মেনি উপলব্ধি করে খুশি অনুভব করলাম। এতক্ষণে যেন আমার মনের আকাশ থেকে মেঘ সরেছে। আমি খুশি খুশি তাকে বললাম,
‘শিক্ষক মহাশয় কি তার এই না হওয়া বউকে তার জীবনের মূল্যবান কিছু সময় দিতে পারবে? তাহলে ভিষণ-ই কৃতজ্ঞ হতাম।’
‘সে একবার মুখ ফুটে বললেই হবে। হাজার ব্যস্ততার মাঝেও তার জন্য সময় বের করে নিব।’
আমি মুচকি হাসলাম। বললাম,
‘লোকেশন ম্যাসেজ করে দিচ্ছি চলে আসুন। আজ রাত করে ঘুরবো।’
______________
মাঘকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পৌষ বিদায় নিয়েছে। তবে শীতের প্রকোপ বেশি নেই। খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই শিরশির করে শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিলো আমায়। খানিটটা কেঁপে উঠলাম। শীতের সকাল গুলো তুলনামূলক শান্ত হয়। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কম থাকে। দু একটা কুকুরকে রাস্তায় ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। আমি বর্তমানে ময়মনসিংহে পারি জমিয়েছে। স্বইচ্ছায় নয় বাবার আদেশেই আসা। বড়ো ফুপি চিরুনি তল্লাশি করে তুহিন ভাইয়ের জন্য সুন্দরী দেখে মেয়ে ঠিক করেছে। মেয়ে সবে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। ফুপির ভাষ্যমতে সেই কন্যা রূপে গুণে সর্বদিক থেকে সেরা। আজ তুহিন ভাইয়ের বিয়ে। ফুপি পইপই করে বলে দিয়েছেন আমি না গেলে বিয়ে বন্ধ। এজন্যই বাবা অতি জরুরী খবর পাঠিয়ে আনিয়েছেন আমায়। আমার সহজ সরল গম্ভীর বাবা না বুঝলেও আমি বেশ বুঝেছি ফুপি কি চান। তার পুত্র বধুকে দেখে হিংসা করার মতো মেয়ে আমি নই। আমি বিয়েতে অবশ্যই যাবো। সুন্দর করে শাড়ি পড়ে সেজেগুজে হেলেদুলে বিয়ে খেয়ে আসবো।
নিসা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। আমি বাড়িতে আসলে মেয়েটা সবসময় আমার আশপাশে ঘুরঘুর করবে। কখনো তার নতুন টিকটক হিট করার গল্প শোনাবে তো কখনো কলেজে কখন কোথায় কি হয়েছে সেটা বলবে। আমিও চুপচাপ ভিষণ আগ্রহ নিয়ে ওর কথা শুনি। মেয়েটা কথা জমিয়ে রাখে। আমি আসলেই অনর্গল সেসব জমানো কথা রেডিওর মতো বাজাতে থাকে। ওর চেহারখর গঠন অনেকটা মেয়ের মতো। এজন্য ও বাবার অনেক আদরের। আজ ও সকাল সকাল উঠে আমার রুমে হানা দিয়েছে। আমি বারান্দায় দাড়িয়ে শীতল বাতাস উপভোগ করছিলাম। তখনি দু মগ কফি হাতে তার আগমন।
‘কফি চলবে?’
আমি হেসে ওর হাত থেকে কফির মগ নিলাম। তৃপ্তির চুমুক বসালাম। মেয়েটা দুর্দান্ত কফি বানায়। বাহিরে তখন শিরশির করে হাওয়া বইছে। আমার পড়নে ঢোলাঢালা পাতলা কুর্তি। বাতাসে শরীরে শিহরণ খেলে যাচ্ছে। নিসার কাঁপাকাপি অবস্থা। আমি ওকে ভেতরে যেতে বললে সে নাকোচ করলো। আমার মতো করে নিসাও প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে চায়। আমি বাঁধা দিলাম না।
‘ইশশ! আপু এই ঠান্ডায় কিভাবে দাঁড়িয়ে আছিস?’
‘কেন? পা দিয়ে!’
আমার এই অতি সামান্য কথায় ও নিসা খিলখিল করে হেসে ফেললো। আমার সব কথাই ওর কাছে মজার মনে হয়। ওর মতে আমি ভিষণ মজার মানুষ।
‘আপু জানিস কাল তুই আসার আগে ভয়ংকর এক ঘটনা ঘটেছে।’
আমি কৌতুহল চোখে চেয়ে বললাম,
‘কি সেটা?’
‘ঘটক এসেছিল।’
বাড়িতে ঘটক আসাটা আমি ভয়ংকর ঘটনা মনে করি না। যে বাড়িতে বড় বড় দুটো মেয়ে আছে ঘটকদের আনাগোনা সেখানে থাকবে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এই মুহূর্তে এই স্বাভাবিক ঘটনাটা আমার ভালো লাগছে না। আমি চোখ ছোট করে তাকালাম। বিষন্ন গলায় বললাম,
‘বাবা আবার ছেলে দেখছে?’
‘হুমম!’
আমি ছোট করে শ্বাস ফেলে বাহিরে তাকালাম। বাবাকে শিঘ্রই সাহিলের ব্যাপারে জানানো দরকার। এবার বিয়ের ব্যাপারে কোনো ভনিতা চলবে না। একদম না।
চলবে……..