#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৯)
১.
অর্কের আজ ভীষণ আনন্দ। ভোর হতেই ও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। আম্মু তখনও ঘুমুচ্ছিল। ও ডেকে ডেকে আম্মুকে উঠিয়ে রেডি হয়ে বের হয়েছে। পায়ে কাল বাবার কিনে আনা নতুন জুতো। আম্মুও আজ নতুন জুতো পরেছে।
কুঞ্জলের ভীষণ আলসেমি লাগছিল ঘুম থেকে উঠতে। কাল অনেক রাতে ঘুম এসেছে, আরেকটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু অর্কের উত্তেজনা দেখে ওকে আর নিরাশ করেনি। রেডি হয়ে যখন বেরোয়, অভীক তখনও ঘুমুচ্ছিল। আজ অফিস ছুটি। দশটার আগে উঠবে না ও।
ওদের বাসা থেকে একটু এগিয়ে যেতেই ছোট্ট একটা মাঠ। অনেকেই সকালে এখানে দৌড়োয়। ইতোমধ্যে অনেকেই এসেছে, কেউ দৌড়ুচ্ছে, কেউ জোর কদমে হাঁটছে। মাঠে ঢুকেই অর্ক এক দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে থামে, তারপর পেছন ফিরে চিৎকার করে বলে, ‘আম্মু, তুমি স্টপ ওয়াচ চালু করো।’
কুঞ্জল হেসে মোবাইলের স্টপ ওয়াচ চালু করে। তারপর ইশারা করতেই অর্ক ছোটা শুরু করে। ওর ছোট ছোট পা দুটো একটা নির্দিষ্ট ছন্দে এগিয়ে চলে। অনেকটা দৌড়ে ও যখন কুঞ্জলের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন রীতিমতো ও হাঁপাচ্ছিল।
কুঞ্জল স্টপওয়াচ বন্ধ করে, ওর দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বলে, ‘১৮ সেকেন্ড। তোমাদের তো একশ মিটার দৌড় হবে। তুমি এক কাজ করো বাবা। এখান থেকে দৌড়ে ওই গাছটা পর্যন্ত যাবে। ওটাই তোমার টার্গেট। আমি ঘড়িতে হিসেব রাখছি।’
অর্ক এবার চোখমুখ সিরিয়াস করে দৌড়ের পজিশন নেয়। কুঞ্জল এবার সুর করে বলে, ‘রেডি, ওয়ান, টু, থ্রিইইই।’
অর্ক তীরের বেগে ছুটে চলে। কুঞ্জল এক বুক মায়া নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর ছেলেবেলা দেখতে পায়। স্কুলে ও যখন দৌড়ুত তখন এমন করে সকালে উঠে প্রাকটিস করত।
গাছের সামনে পৌঁছুতেই ও ঘড়ি বন্ধ করে। তারপর বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে থাম্পস আপ করে।
অর্ক কাছে এসে আগ্রহের সাথে বলে, ‘কত সেকেন্ড লেগেছে আম্মু।’
কুঞ্জল হাসিমুখে বলে, ‘১৭ সেকেন্ড। অনেক ফাস্ট দৌড়েছ বাবা।’
অর্কের চোখে হাসি দেখা যায়। এবার ও ফার্স্ট হবেই। ও আবার দৌড়ের প্রস্তুতি নিতেই কী মনে করে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘আম্মু, তুমি দৌড়ুবে? দেখি তুমি আমার সাথে পারো কি-না?’
কুঞ্জল হাসে, ‘আমি দৌড়ুব? তোর সাথে পারব না বাবা। সেই কবে দৌড়াতাম, এখন এত দমও নেই।’
অর্ক এবার মাকে পেয়ে বসে, ‘না, না। তোমাকে দৌড়াতে হবে। মোবাইলটা আমার কাছে দাও, আমি স্টপওয়াচ চালু করে দেখব তোমার কত সময় লাগে।’
কুঞ্জল একটু ভাবে। সত্যি বলতে ওর খুব ইচ্ছে করছে দৌড়ুতে। কিন্তু কেমন একটা জড়তা কাজ করছে। অবশ্য ওর মতো কয়েকটা মেয়ে দৌড়ুচ্ছে।
অর্ক আবার আবদারের গলায় বলে, ‘আসো না আম্মু। একবার শুধু।’
কুঞ্জল এবার উড়নাটা কোমরে পেচিয়ে বাঁধে। তারপর মোবাইলটা অর্কের হাতে দিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, তুই হিসেব রাখ।’
কুঞ্জলের কেমন একটা উত্তেজনা হচ্ছে। কতদিন পর আজ দৌড়ুবে ও। পেছন থেকে অর্কের কচি গলায় চিৎকার শোনা যায়, ‘আম্মুউউ, রেডি, ওয়ান, টু, থ্রিইইই।’
কুঞ্জল ছোটে। প্রথমে একটু জড়তা নিয়ে, তারপর বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে গাছটার কাছে এসে ও দৌড় শেষ করে। জোরে জোরে হাঁপাতে থাকে। হাঁপড়ের মতো বুক উঠানামা করছে। কতদিন অভ্যাস নেই, তাই অল্পতেই দম ফুরিয়ে গেছে। পেছন থেকে অর্কের ছুটে আসা টের পায়। কাছে এসে ও চিৎকার করে বলে, ‘আম্মু তুমি তো প্রো। মাত্র ১৫ সেকেন্ড লেগেছে তোমার। ও আম্মু, তুমি এত ভালো দৌড়াও!!’
কুঞ্জল হাসে। সত্যিই অনেক ভালো লাগছে। দৌড়ানোর সময় মনে হয় ও যেন আকাশে উড়ছে। ছোটবেলায় দৌড়োনোর সময় মনে হতো ও বুঝি পাখির মতো আকাশে উড়ে যাবে।
সেদিনের মতো দৌড় শেষ করে ওরা যখন বের হয়ে আসছিল ঠিক তখন ,পেছন থেকে কেউ ডাকে, ‘আপুউ ! তুমি এত সুন্দর করে দৌড়াতে পারো!’
কুঞ্জল পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখে তুহিন, পৃথুলের ছোট ভাই। লজ্জা পেয়ে বলে, ‘আমি কী আর পারি। ওই অর্কের স্কুলে একটা দৌড়ের কমপিটিশন আছে তাই নিয়ে এসেছিলাম। জানিস তো স্কুলে আমি খুব ভালো দৌড়ুতাম। তা তুই দৌড়াস নাকি?’
তুহিনের গায়ে নেভি ব্লু রঙের ট্র্যাকস্যুট, পায়ে কেডস। ও কাছে এসে বলে, ‘আপু, আমি তো নিয়মিত দৌড়াই। অনেকগুলো ম্যারাথন দৌড়িয়েছি। আগামী মাসের ছাব্বিশ তারিখেও একটা দশ কিলোমিটারের ম্যারাথন আছে।’
কুঞ্জলের হঠাৎ করেই সাইফুল্লাহ স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। উনি বলেছিলেন এমন অনেকে ম্যারাথন দৌড়ুয়। ও আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করে, ‘মেয়েরাও যায়?’
তুহিন চনমনে গলায় বলে, ‘হ্যাঁ তো আপু। আমাদের এখানেই একটা বড়ো আপু আছে, ডাক্তার আফরোজা আপু। উনি তো আমাদের সব দৌড়ে অংশগ্রহণ করেন। তুমি দৌড়ুবে আপু?’
কুঞ্জল অর্কের দিকে তাকায়, অর্ক চিৎকার করে বলে, ‘হ্যাঁ, আম্মু দৌড়ুবে।’
কুঞ্জল হাসে, তারপর তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি পারব? দমই তো নেই। কতদিন দৌড়াই না।’
তুহিন এবার উৎসাহের সাথে বলে, ‘আপু, তুমি ঠিক পারবে। হাতে তো এখনও মাসখানেক সময় আছে। প্রতিদিন সকালে এসে আধা ঘন্টা করে দৌড়ুলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আর আমি কিছু টিপস শিখিয়ে দেব নে।’
কুঞ্জল একটা উত্তেজনা বোধ করে। সত্যিই ও দৌড়ুবে?
সেদিন বাসায় ফিরতেই অর্ক দৌড়ে বাবার রুমে যায়, হড়বড় করে বলে, ‘জানো বাবা, আম্মু অনেক জোরে দৌড়ুতে পারে। আমাকে আজ হারিয়ে দিয়েছে।’
অভীক সবে ঘুম থেকে উঠেছে। কাল অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসেনি। কুঞ্জলের সাথে ঝগড়াটা হবার পর থেকেই আর ঘুম আসেনি। ইদানিং কী যে হয়, কুঞ্জল ওর কোনো কিছুতেই স্বাভাবিক আচরণ করে না। আদর করে চুমু খেতে গেল আর তাতে কেমন উলটো কথা বলল। কাল ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেও কেমন একটা শূন্যতা ঘিরে ধরেছিল। কিন্তু এখন অর্ককে দেখে ভালো লাগছে।
ও বিছানা থেকে উঠে বসে বলে, ‘তোমার জুতো ঠিকঠাক ছিল?’
অর্ক মাথা দোলায়।
অভীক একবার ওর দিকে তাকায়, ‘এই টি-শার্ট পরে দৌড়ুতে গিয়েছিলে? ট্র্যাকস্যুট নেই?’
অর্ক মুখ কালো করে মাথা নাড়ে, ‘না তো বাবা।’
অভীক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘আচ্ছা নাস্তা করে নেই। তারপর চলো মার্কেটে যাব। তোমাকে একটা সুন্দর ট্র্যাকস্যুট কিনে দেব।’
রান্নাঘর থেকে কুঞ্জল ওদের কথা শুনছিল। অর্কের জন্য আসলেই একটা ট্র্যাকস্যুট কেনা দরকার। সকালে খুব ঠান্ডা পড়ে। জ্যাকেট পরে তো আর দৌড়ুনো যায় না। যাক, ছেলের ব্যাপারে অন্তত খেয়াল আছে। এটুকু থাকলেই হবে।
কুঞ্জল দ্রুত তিনটা রুটি ভেজে ফেলে সাথে ডিম-আলু ভাজি, আর চা। ওদের নাস্তা করতে দিয়ে ও নিজেও আলাদা করে বসে।
ওরা বেরোবার সময় অভীক গম্ভীরমুখে বলে, ‘কিছু আনতে হবে? আমি অর্ককে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি। তুমি যাবে?’
কুঞ্জল শুকনো গলায় বলে, ‘না, আমি যাব না। চা, আর গুড়ো দুধ শেষ।’
অভীক ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে। তারপর ছেলেকে নিয়ে বেরোয়।
ওরা চলে যেতেই কুঞ্জল দুপুরের রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ বিরিয়ানি রান্না করবে ও। সেইসাথে নতুন একটা ভিডিও করে ফেলা যাবে, ভাবে কুঞ্জল।
দুপুর নাগাদ ওরা যখন ফিরে আসে ততক্ষণে কুঞ্জল রান্না শেষে গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
অর্ক বাসায়ায় ঢুকেই আনন্দের গলায় বলে, ‘আম্মু, দেখো কত কী এনেছি। এটা আমার ট্র্যাকস্যুট। আর এটা তোমার।’
কুঞ্জলের কপালে ভাঁজ পড়ে, অবাক গলায় বলে, ‘আমার ট্র্যাকস্যুট মানে?’
অর্ক দুষ্ট হাসি হেসে বলে, ‘বাবাকে বলেছি তুমি ম্যারাথন দৌড়ুবে। বলতেই বাবা এটা কিনে দিয়েছে।’
কুঞ্জল নিচের ঠোঁট কামড়ে একবার আড়চোখে অভীকের মুখের দিকে তাকায়। একটা সময় মানুষটা ওর ছিল, ভালোবাসত এমন করে। অনেক দিন পর একটু হলেও মায়া টের পায়। অভীক কি সত্যি সত্যি ভালো হয়ে গেছে, নাকি সাময়িক?
২.
কুঞ্জল চিন্তিত মুখে গরুর মাংসের ভুনার দিকে তাকিয়ে আছে। রেসিপি দেখে ঠিকঠাকই বানিয়েছে। খেতে ভালোও হয়েছে। কিন্তু একবার খেলে স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো ভালো হয়নি। ওর মনে পড়ে, মাঝে মাঝে এক দুটো দাওয়াতে মুখে লেগে থাকার মতো গরুর মাংসের ভুনা খেয়েছিল। কিন্তু ও কিছুতেই কাঙ্ক্ষিত স্বাদটা আনতে পারছে না। সমস্যাটা কোথায়? মানুষ ওর রান্নার রেসিপি দেখে রান্না করে যদি কাঙ্ক্ষিত স্বাদটা না পায় তাহলে তো ওর পেজটা একটা সময় চলবেই না। এই ক’দিনেই ওর পেজের ফলোয়ার পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সবাই ওর নতুন নতুন রেসিপি খুব পছন্দ করছে। কিন্তু এই সোজা রান্নাটা কিছুতেই মন মতো হচ্ছে না।
একটু ভাবতেই শেফ অংশুলের কথা মনে পড়ে৷ একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে? শেষবার তো ওর রান্নার প্রশংসা করেই কমেন্ট করেছিল। একটু দ্বিধা করে শেষ পর্যন্ত মেসেজ দেয়, “রান্না না জেনেও রান্না করি। তাই একটু সাহায্যের দরকার ছিল। সব ঠিকঠাক দেবার পরও গরুর মাংস ভুনাটা মন মতো হচ্ছে না। একটু কি ঠিকঠাক করে দেবেন ‘রান্না জানা মানুষ’?”
অংশুল একজন ‘কমি শেফ’কে (শিক্ষানবিশ) সবজি কাটার টেকনিক শেখাচ্ছিল। ছেলেটা বরাবরই স্লাইসগুলো মোটা করে করছিল। অংশুল নিখুঁত মাপে কেটে দেখিয়ে দিয়ে বলে, ‘এভাবে কাটবে। আমার প্রতিটা স্লাইস এক মাপের, প্রয়োজনে স্কেল দিয়ে মেপে দেখতে পারো।’
ছেলেটা শ্রদ্ধাবনত চোখে একবার তাকায়। এমন একজন গুণী শেফের কাছে হাতেকলমে রান্না শিখতে পারবে ও ভাবেনি। ছেলেটা এবার আবার চেষ্টা করে।
অংশুল এবার নিজের স্টেশনে ফিরে এসে মোবাইলটা হাতে নেয়। সাইলেন্ট করে রাখা ছিল৷ হাতে নিতেই দেখে কুঞ্জলের মেসেজে। কৌতুহল নিয়ে খুলতেই হেসে ফেলে। নাহ, মেয়েটা এখনও রেগে আছে। শুরুতেই খোঁচা দিয়ে লিখেছে। আবার শেষটাতেও রান্না জানা মানুষ বলে সম্বোধন করেছে।
একটু ভাবে, তারপর লিখে, “হ্যালো, ‘রান্না না জানা মানুষ’, মাংস ভুনা কেন মনমতো হচ্ছে না সেটা তো না খেয়ে বলতে পারব না। একদিন সকালে চলে আসুন না আমার রেস্তোরাঁয়। খেয়ে বলব কী সমস্যা। আর এটা আমার ফোন নম্বর।”
কুঞ্জল রান্নাঘরে হাঁড়িকুঁড়ি গোছাচ্ছিল। আর একটু পর পর মোবাইলের দিকে উৎসুক চোখে তাকাচ্ছিল। ঠিক তখুনি অংশুলের মেসেজ আসে। ও দ্রুত টাওয়ালে হাত মুছে মোবাইল হাতে নেয়, তারপর ফিক করে হেসে ফেলে। লোকটা দুষ্ট আছে তো। ওকে ‘রান্না না জানা মানুষ’ বলে সম্বোধন করেছে। পুরো মেসেজ পড়ে একটু ভাবে, তারপর লিখে, ‘তাহলে কালই আসছি। আজকের রান্না করা মাংসটা ফ্রিজে উঠিয়ে রাখছি। অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে আপনি সময় দেবেন বলে।’
কুঞ্জল এবার একটা ছোট টিফিন বক্সে মাংসটা বেড়ে ফ্রিজে রাখে। তারপর সব গুছিয়ে যখন গোসল করতে যায় তখন হঠাৎ করেই একটা কথা মনে হয়, আচ্ছা, এই লোকটা ওকে এতটা সময় দিচ্ছে কেন? ওনার মতো ব্যস্ত শেফের এত কী দায় পড়েছে যে ওর রান্না খেয়ে সেটা ঠিক করে দেবে?
পরদিন সকালে অর্কের সাথে দৌড় শেষ করে ও গোসল করে রেডি হয়। অর্ককে স্কুলে দিয়ে তারপর বাসায় এসে মাংসটা নিয়ে বের হয়। আধা ঘন্টা পর ও যখন ইনকা রেস্তোরাঁর সামনে এসে পৌঁছে ততক্ষণে সকাল দশটা বেজে গেছে। আধুনিক, ঝকঝকে একটা রেস্তোরাঁ। খুব সুন্দর আর রুচিশীল সব জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো। ভেতরটা এখন খালি। দুপুর থেকে ভীড় বাড়ে আর সেটা রাত বারোটা অব্দি চলবে। কুঞ্জল মোবাইল বের করে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে ভরাট একটা গলা ভেসে আসে, ‘আপনি নিশ্চয়ই কুঞ্জল?’
কুঞ্জল একটু অবাক হয়, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ। আমি আপনাদের রেস্টুরেন্টের ভেতরে।’
ফোনটা কেটে যায়। কুঞ্জল আবার ফোন করতে যেতেই পেছন থেকে কেউ একজন বলে ওঠে, ‘রান্না না জানা মানুষ।’
কুঞ্জল একটু কেঁপে ওঠে পেছন ফেরে। লম্বা, একহারা গড়নের একজন মানুষ। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, লম্বাটে মুখ, তীক্ষ্ণ চোখ, চুলগুলো ছোট ছোট করে ছাঁটা। গলার স্বর ভরাট, শুনতে ভালো লাগে। বয়স ওর কাছাকাছিই হবে অথবা কয়েক বছর বড়ো।
ওকে রান্না না জানা মানুষ বলে সম্বোধন করাতে হেসে ফেলে, ‘আপনি নিশ্চয়ই অংশুল?’
অংশুল মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘চলুন, ওপাশটায় যেয়ে বসা যাক। তার আগে আপনার মাংসের বাক্সটা দিন। আমি কাউকে গরম করে দিতে বলি। আজ না হয় আপনার মনমতো না হওয়া মাংস দিয়েই নাস্তা করি।’
কুঞ্জল হাসে, তারপর টিফিনবক্সটা ওর হাতে দেয়। অংশুল একজনকে ডেকে বুঝিয়ে দেয়। তারপর ওর দিকে ফিরে তাকায়। মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে। মুখটা মায়া মায়া।
এক কোণে বড়ো কাচঘেরা দেয়ালের পাশে একটা টেবিলে ওরা বসে। কাচের ভেতর দিয়ে ওপাশে ছোট একটা সবুজ লন দেখা যাচ্ছে। অংশুল এবার ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি ভালো আছেন তো?’
কুঞ্জল হাসে, মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো আছি।’
অংশুল চেয়ে থাকে, মেয়েটার মুখ হেসেছে, কিন্তু চোখ হাসেনি। কেমন নিষ্প্রাণ। কুঞ্জল এবার নিজেই রান্নার অনেক গল্প জুড়ে দেয়। অনেক কিছুই জানতে চায়৷ অংশুল মৃদু হেসে ওর সব প্রশ্নের একটা একটা করে উত্তর দেয়।
কিছুক্ষণ পর ওর রান্না করে নিয়ে আসা মাংসটা আসে সাথে লাচ্ছা পরোটা। একটা প্লেটে সুন্দর করে কিছু সালাদ। অংশুল ওর প্লেটে বেড়ে দিয়ে নিজে নেয়। তারপর খাওয়া শুরু করতেই কুঞ্জল চিন্তিত মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
অংশুল খেতে খেতে বলে, ‘কী ব্যাপার, আপনি খাচ্ছেন না কেন? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। নিন, খান। আমার সময় লাগবে রান্নার সমস্যাটা ধরতে।’
কুঞ্জল মন খারাপ করে খেতে থাকে। এই লোক কী না কী বলবে। ধুর, ঝোঁকের মাথায় এমন করে আসা উচিত হয়নি। ও তো আর শেফ হবে না। একটু না হয় কম মজা হলোই।
খাওয়া শেষে অংশুল চা নিয়ে বলে, ‘আমার মনে হচ্ছে আপনার রান্নায় লবন আর ঝালের পরিমাণটা ঠিক নেই। মাংসগুলো চিবোনোর সময় মনে হচ্ছিল ভেতরে লবন ঢোকেনি। আর মাংস ভুনা একটু ঝাল বেশি হলেই ভালো লাগে। এই দুটো যদি ঠিকঠাক করতে পারেন তাহলেই দেখবেন একদম মনমতো হচ্ছে। আসলে যেকোনো রান্নায় লবন আর ঝালটা খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটু এদিকওদিক হলেই গোলমাল। সংসারে যেমন বিশ্বাস আর মায়া এদিকওদিক হলেই সব গোলমাল, তেমন আর কী।’
কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই লোকটা কি ইচ্ছে করেই শেষ কথাটা বলল? কিন্তু উনি তো ওর মনের কথা জানার কথা না।
কুঞ্জলের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। ও শুকনো গলায় বলে, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমার মতো সাধারণ একটা মানুষের জন্য এতটা সময় দিলেন।’
অংশুল মেয়েটার বদলে যাওয়া মুখটা খেয়াল করে। মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। আপনাকে এতটা সময় দেবার কথা না। কিন্তু দিলাম। কেন দিলাম, জানেন?’
কুঞ্জল সরু চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কেন দিলেন?’
অংশুল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আপনি আমার মেসেজের উত্তরে লিখেছিলেন যে আপনি রান্না করেন জাগতিক কষ্ট ভুলে থাকার জন্য। এই মেসজটা পড়ে মনে হয়েছে আপনি আমার খুব আপন কেউ। কারণ, আমিও আপনার মতোই দু:খ, কষ্ট ভুলে থাকার জন্য রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আমার জীবনে এই প্রথম কাউকে পেলাম যে আমার মতোই কষ্ট থেকে পালিয়ে বেড়াতে রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই সেদিনের পর থেকে আপনি আমার কাছে খুব মূল্যবান একজন মানুষ। আপনার গুরুত্ব আমার কাছে অনেকই বেশি।’
কুঞ্জল স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। ওর মতো কষ্ট ভুলতে ইনিও এমন রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে! তারমানে উনিও ওর মতোই জীবনে আঘাত পাওয়া একজন মানুষ? ওনার আঘাত কি ওর চেয়েও গভীর?
কুঞ্জল ফিসফিস করে বলে, ‘আপনার কষ্টগুলো কি আমাকে বলবেন?’
অংশুলের বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা কিছু হয়ে যায়। আহ, এতদিন পর কেউ এমন করে জানতে চাইল ওর কষ্টের কথা, একাকীত্বের কথা। হ্যাঁ, ও বলবে, সব খুলে বলবে। এই মেয়েটা যে ওর মতোই কষ্ট পাওয়া মানুষ।
ওরা দু’জন সেদিন মনের আগল খুলে সব কষ্টের কথা বলে। বিশ্বাস হারানোর গল্প বলে। ওরা ঠিক বুঝে পায় না কার মনের ক্ষত কতটা বেশি গভীর।
(চলবে)