#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৮)
১.
অংশুল মনোযোগ দিয়ে এবারের মিশেলিন স্টার গাইডটা দেখছিল। মিশেলিন স্টার হলো শেফদের জন্য অনেকটা অস্কার জেতার মতো। শুধু রান্না ভালো হলেই হবে না, এর পরিবেশন, নতুন নতুন রেসিপি উদ্ভাবন – সব মিলিয়ে যারা অসাধারণ কিছু করে তারাই এই সম্মান পায়। একজন শেফের সারাজীবনের স্বপ্ন, কম করে একটা মিশেলিন স্টার পাওয়া অথবা একটা মিশেলিন স্টার রেস্তোরাঁয় কাজ করা। এই মুহুর্তে উনিশটি মিশেলিন স্টার নিয়ে ‘এলেইন ডুকাস’ তালিকার একদম প্রথমেই আছেন। আর ওর প্রিয় গর্ডন রামসে সাতটা মিশেলিন স্টার নিয়ে আছেন তালিকার মাঝামাঝিতে। ইশ, ওঁদের মতো এমন বিখ্যাত শেফ যদি হতে পারত! তা রান্নাটা ও বেশ মনোযোগ দিয়েই করে। আর তার ফলও হাতে হাতে – শহরের নামী রেস্তোরাঁ বলতে ‘ইনকা’ কে সবাই একনামেই চেনে। এই রেস্তোরাঁয় এক্সিকিউটিভ শেফ অর্থাৎ শেফ দ্য কুইজিন হিসেবে বছর পাঁচেক ধরে কাজ করছে। মালিকপক্ষ অনেকটা তোয়াজ করেই ওকে রাখে। একটাই সমস্যা, ওর রাগটা একটু বেশি।
অংশুল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে চায়ে চুমুক দেয়। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, শীতের সকাল। একটু একটু করে রোদ বাড়ছে। এসময়টা ওর বরাবরই ভালো লাগে।
এমন সময় মেসেজের ‘টুন’ শব্দে ও ফিরে তাকায়। বিরক্ত হয়ে দেখে মেসেঞ্জারে মেসেজ এসেছে। ও মেসেঞ্জার খুলতেই দেখে একগাদা মেসেজ স্প্যাম ফোল্ডারে জমা হয়েছে। নাহ, এগুলো সব ডিলিট করতে হবে। অংশুল মেসেজগুলো সিলেক্ট করে ডিলিট করতে যেয়ে হঠাৎ একটা মেসেজে চোখ পড়ে, কুঞ্জল নামে একটা মেয়ের মেসেজ। নামটা চেনা লাগছে। পরিচিত কেউ?
কৌতুহল নিয়ে ও মেসেজ বক্স খোলে। মেসেজটা কয়েকদিন আগে এসেছে। কচুবাটা কী করলে গলায় ধরবে না সেটা জানতে চেয়েছে মেয়েটা। এবার মনে পড়ে। আরে, এই মেয়েটা তো সেই মেয়েটা যে নারকোল দিয়ে কচুবাটার একটা ভিডিও ছেড়েছিল। আর লোকজন সমানে প্রশংসা করে যাচ্ছিল। আজকাল সবাই শেফ হতে চায়। রান্নার বেসিক না জেনেই একটা যা তা ভিডিও ছেড়ে দেয় আর লক্ষ লক্ষ লাইক, কমেন্ট পড়ে। এসব অংশুলের ভীষণ বিরক্ত লাগে। সেদিন এই মেয়েটার ভিডিও দেখে আনাড়ি মনে হলেও এর কাজটা পরিপাটি ছিল। কিন্তু রান্নার রেসিপিতে একটু ভুল ছিল। কী মনে হতে অংশুল মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর দেয়,
‘আপনি কচুর টুকরোগুলো ব্লেন্ড করার পর সরাসরি না মাখিয়ে আগে কচুর পেস্টটা একটা পাতলা কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে চেপে চেপে সব পানিগুলো বের করে ফেলবেন। অনেকে এটাকে কচুর দুধ বলে। এটাই মূলত গলায় ধরে। সব পানি ঝরিয়ে একদম ঝরঝরে হয়ে গেলে তখন আর গলায় ধরবে না। আর, রান্না না শিখে সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার লোভে রান্নার ভিডিও ছাড়বেন না। আপনার জন্য অনেক শুভকামনা রইল।’
ইচ্ছে করেই একটু রুঢ় করে লিখে অংশুল, যাতে
এরা একটু ঠিক হয়।
কুঞ্জল আজ মেথি দিয়ে হাঁসের রান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মোবাইলটা রান্নাঘরের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সেট করে। তারপর একবার ভিডিও অপশনটা চালিয়ে দেখে। নাহ, সব ঠিকঠাক আছে। সন্তুষ্ট মনে আজকের রান্নার নতুন ভিডিওটা শুরু করতে যেতেই মেসেজ আসার একটা শব্দ পায়। নাহ, নেটটা বন্ধ করে নেওয়া উচিত ছিল। ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে খেয়াল করে সেই বিখ্যাত শেফ লোকটা ওর মেসেজের উত্তর দিয়েছে। বুকটা একটু চলকে ওঠে।
ও ঝট করে মোবাইলটা হাতে নেয়, তারপর দ্রুত মেসজটা খুলতেই হোঁচট খায়। খুব ভালো একটা টিপস দিয়েছেন ভদ্রলোক, কিন্তু এমন রুঢ় করে লিখল? ও সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার লোভে ভিডিও বানায়? না হয় উনি মস্ত শেফ, রান্না নিয়ে পড়াশোনা আছে। তাই বলে এমন করে লিখল?
মনটাই খারাপ হয়ে যায়। কেন যেন নতুন রেসিপিটা আজ করতে ইচ্ছে করছে না। এত এত ভালো কমেন্টের ভীড়ে একটা নেগেটিভ কথা কেমন করে সব উৎসাহ নিভিয়ে দেয়।
একটু ভেবে ও লিখে, ‘আপনার মতো মানুষ আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, অনেক ধন্যবাদ। রান্নার ব্যাপারে আমার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই, কিন্তু আমি রান্না করতে ভালোবাসি। আপনার এমন হয় কি-না জানি না কিন্তু আমি রান্না করতে গেলে ওই সময়টুকু জাগতিক কষ্ট ভুলে থাকতে পারি। সবাই তো আপনার মতো প্রফেশনাল না, যারা শুধু রান্নার জন্যই রান্না করে।’
মেসেজটা পাঠিয়ে চুপ করে বসে থাকে। সকাল সকাল মনটা খারাপ করে দিল। পৃথুলকে কাল বলেছিল আজ নতুন রান্নার ভিডিও আপলোড করবে। কিন্তু এই লোকটা সব ভেস্তে দিল। কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে, নাহ, মানুষের কথা শুনে কাজ নেই। এটা ওর বেঁচে থাকার একটা জানালা। দু’একজন এমন নেগেটিভ কথা বলবেই, তাই নিয়ে মন খারাপ করে ও বসে থাকবে না। ও নিজেই নিজেকে বোঝায়। তারপর আবার মোবাইলটা আগের জায়গায় সেট করে। তার আগে মোবাইলটা ফ্লাইট মোডে দিয়ে নেটওয়ার্ক বন্ধ করে নেয়। তারপর সুন্দর করে শুরু করে, ‘প্রিয় দর্শক, শীত মানেই হাঁসের মাংসের ভুনা। আজ আপনাদের আমি মেথি দিয়ে হাঁস রান্না করে দেখাব।’
কুঞ্জল যত্ন করে পুরো রান্নাটা করে। তারপর শেষ হতেই ও পুরো ভিডিওটা একবার দেখে নেয়। কয়েকটা জায়গায় একটু অস্পষ্ট হয়েছে ভিডিওটা, এছাড়া সব ঠিকঠাক। ভালো হতো কেউ যদি মোবাইলটা ধরে রেখে ওর রান্নাটা ভিডিও করে দিত। অর্ক বলেছিল ও ধরে রাখবে। কিন্তু কুঞ্জল দেয়নি। ছেলেটা কষ্ট করে এতক্ষণ রান্নাঘরে থাকবে এটাই মেনে নিতে পারেনি। আজ অর্কের স্কুল নেই। ও বসার ঘরে বসে পড়ছিল।
রান্না শেষ হতে দেখে এগিয়ে আসে, ‘আম্মু, তোমার শেষ? আমি কিন্তু একবারও শব্দ করিনি।’
কুঞ্জল হাসে, ‘লক্ষ্মী ছেলে তুমি। আচ্ছা, তুমি পড়াটা শেষ করো, আমি একটু গুছিয়ে গোসল করে খেতে দেব।’
এদিকে অংশুল ওর সব শেফদের ডেকে আজকের কাজগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছিল। সবাই বেশ মনোযোগ দিয়েই ওর কথা শুনছিল। এই লাইনে শেফ দ্য কুইজিনকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করে। আর অংশুল স্যারের রান্নার সেন্স অসাধারণ।
সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে অংশুল এবার ওর স্টেশনে গিয়ে দাঁড়ায় যেখান থেকে সব শেফদের দেখা যায়। রান্নার সময় ও ঘুরে ঘুরে তীক্ষ্ণ নজর রাখে সবার উপর। আজকের রান্না শুরু হয়।
অংশুল একবার মোবাইলে চোখ বোলায়। আর কৌতুহল নিয়ে খেয়াল করে সেই মেয়েটা আবার মেসেজ দিয়েছে। দেখবে না ভেবেও মেসেজটা দেখে। নিস্পলক চোখে চেয়েই থাকে। মোবাইলটা বন্ধ করে ও ‘সু শেফ’ ( রান্নাঘরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ) কে ডেকে বলে, ‘আমি একটু বারান্দায় বসছি। কিছু লাগলে আমাকে ডাকবে।’
এই রেস্তোরাঁর পূব কোণে একটা বড়ো বারান্দা আছে। বারান্দা পেরিয়ে ওপাশে একটা লেক। সকালের রোদ্দুর পড়ে বারান্দাটা এখন আলোকিত। অংশুল বারান্দার এককোণে রাখা বেতের একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। মাথার লম্বা শেফ হ্যাটটা নামিয়ে রাখে, তারপর আনমনে বাইরে তাকিয়ে থাকে। অনেক দিন পর কেউ একজন ওর পুরনো কষ্টগুলো মনে করিয়ে দিল। ও কুঞ্জলের মেসেজটা আবার পড়ে, বার বার করে পড়ে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, মেয়েটা একদম ঠিক বলেছে। রান্না ওকে ওর পুরনো দুঃখ, কষ্টগুলো ভুলে থাকতে সাহায্য করে। এটাতে ডুবে থাকতে পারে বলেই তো ও বেঁচে আছে। না হলে কবেই পাগল হয়ে যেত। প্রিয়াঙ্কাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। বিয়ের পাঁচ ছয় বছর পর প্রথম টের পেল ও অন্য কারও সাথে জড়িয়ে গেছে। প্রথমে ব্যাপারগুলো সাধারণ মেসেজ ফোনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এরপর সেটা সীমা ছাড়িয়ে শারীরিক সম্পর্কে গড়াল। অংশুল যেদিন এটা জানতে পেরেছিল ভেবেছিল মরে যাবে। কিন্তু পারেনি, সন্তানের মুখ চেয়ে। প্রিয়াঙ্কা পায়ে পড়ে ক্ষমাও চেয়েছিল। পুরনো ভালোবাসার জেরে ওকে ক্ষমা করে বুকেও টেনে নিয়েছিল। ভেবেছিল সব আগেরমতো ঠিকঠাক হয়ে যাবে, কিন্তু হয়নি। প্রায়ই ঘুম ভেঙে চুপ করে বসে থাকত অংশুল। অসহ্য স্মৃতিগুলো তাড়িয়ে বেড়ায় এখনও। সেদিনের পর থেকে একটা দিন ও ভালো থাকেনি। একটা সময় রান্নায় মনোযোগ দেয়। অবাক হয়ে দেখে কষ্টটা ও ভুলে থাকতে পারছে। আচ্ছা, এই কুঞ্জল মেয়েটাও কি ওর মতোই দুঃখী যে রান্নার ভেতর ডুবে থেকে কষ্ট ভুলতে চায়? কোথায় যেন এই মেয়েটার সাথে ওর একটা মিল খুঁজে পায়। একটা মায়া টের পায় মেয়েটার জন্য।
বিকেলের দিকে কুঞ্জল যখন হাঁস রান্নার ভিডিওটা ছাড়ে সাথে সাথে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আজকেও ঝড়ের বেগে লাইক কমেন্ট পড়তে থাকে – ‘আহ, শীতের পারফেক্ট রান্না’, ‘দেখেই মনে হচ্ছে হাঁস ভুনাটা মজা হয়েছে’। কমেন্টগুলো পড়ে ওর দিনের শুরুতে যে মন খারাপ হয়েছিল সেটা কেটে যায়। অবশ্য ফাঁকে ফাঁকে দুরুদুরু বুকে ওই লোকটা আজ কিছু লিখল কি-না সেটাও খুঁজে দেখে। নাহ, আজ এখনও কমেন্ট করেনি। কেন যেন লোকটাকে ও ভয় পাচ্ছে। শেফ মানুষ, কী না কী ভুল ধরবে কে জানে।
বিকেলে অর্ককে নাস্তা করে দিয়ে ও যেই মোবাইলটা নিয়ে বসেছে ঠিক তখুনি একটা নতুন কমেন্ট আসে। ও খুলতেই অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে, সেই লোকটা লিখেছে তো! কমেন্টটা দুইবার পড়ে, তারপর একটা অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে। লোকটা এত সুন্দর একটা কমেন্ট করেছে?
“আজকের রান্নাটা একদম পারফেক্ট। একটা মিশেলিন স্টার পেতেই পারেন এই রান্নার জন্য।’
কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে তাকায়, এই মিশেলিন স্টার আবার কী? ভালো কিছু সেটা বুঝতে পারছে। দ্রুত গুগলে সার্চ দিতেই ওর চোখ ছানাবড়া। এ তো দেখছি সত্যিই শেফদের একটা অনারারি র্যাংক। লোকটা এমন ভালো মন্তব্য করতে পারে? বিশ্বাস হতে চায় না। সকালে যখন লিখল, সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার জন্য ও এমন করে, তখন খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সত্যিকারের মন ভালো হয়ে গেছে। এমন নামকরা একজন শেফের মন্তব্য পেয়ে ওর আত্মবিশ্বাসের পারদ উঁচুতে উঠে। নাহ, ওনাকে সুন্দর করে লিখতেই হয়। কুঞ্জল কমেন্টের উত্তর লিখে –
‘আপনার এমন একটা মন্তব্য বাঁধিয়ে রাখার মতো। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি সত্যিই অনুপ্রাণিত।’
অংশুল কমেন্টের উত্তর পড়ে মৃদু হাসে। যাক, মেয়েটার মন ভালো হয়েছে। সকালে অমন কড়া করে মেসেজ করা ঠিক হয়নি। অবশ্য তাতে একটা জিনিস তো জানতে পারল, ওর মতো কেউ একজন দুঃখ ভুলে থাকতে রান্না করে।
২.
অভীক অফিস শেষে একটা স্পোর্টস এর দোকানে ঢোকে, অর্কের রানিং স্যু কিনতে হবে। ছেলেটা নাকি স্কুলে দৌড়ের হিটে ফার্স্ট হয়েছে। বুকের ভেতর একটা নরম মায়া টের পায়।
দোকানিকে জিজ্ঞেস করতেই বলে, ‘স্যার, একদম অরিজিনাল নাইকি স্যু আছে। নিয়ে যান, মাখনের মতো নরম আর পাতলা জুতা। পঙখীরাজের মতো দৌড়াইব।’
অভীক হাসে। এগুলো কপি নাইকি, আসল না। তবে আসলের মতোই। অভীক হাতে নিয়ে একবার উল্টেপাল্টে দেখে। ভালোই মনে হচ্ছে। অর্ক বলছিল ব্ল্যাক স্যু নিয়ে যেতে। আর এটা তাই। ও দামাদামি করে স্যুটা কিনে ফেলে। তারপর বেরিয়ে আসতে যেতেই পাশের মেয়েদের শোরুমে সুন্দর একটা কার্ডিগানের দিকে চোখ পড়ে। কুঞ্জলের জন্য নেবে? নাহ থাক। দেখা যাবে এই নিয়ে উল্টো অশান্তি হবে। সেদিন শাড়ি নিয়ে যা কান্ড হলো ভাবতেই ও সংকুচিত হয়ে পড়ে। এখন সত্যিটাও কুঞ্জলের কাছে মিছে মনে হয়। আর সেজন্য ও নিজেই দায়ী। কিন্তু এমন করে সংসার হয়? এতটুকু মায়া অবশিষ্ট নেই ওর জন্য। এই যে অফিস থেকে আজ ফিরতে দেরি হচ্ছে সেটা নিয়ে একবারও ফোন আসেনি। আচ্ছা কেন ও বাড়ি ফিরে যায় যেখানে এতটুকু মায়া নিয়ে কেউ অপেক্ষা করে নেই?
মন খারাপ নিয়ে অভীক বাসায় ফেরে। অর্ক নতুন জুতো পেয়ে বাড়ি মাথায় তোলে। সাথে সাথে পায়ে দিয়ে একটু দৌড়ে দেখে। তারপর খুশিতে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘বাবা, এটা একদম পারফেক্ট। দেখো, এবার কেউ আমার সাথে পারবে না। আর আম্মু বলেছে আমাকে কাল সকাল থেকে প্রাকটিস করাবে।’
অভীক একবার আড়চোখে দেখে কুঞ্জল মোবাইলে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। হয়তো রান্নার ভিডিও। ইদানীং ও রান্নার ভিডিও দিচ্ছে ফেসবুকে, তাই নিয়ে হয়তো ব্যস্ত। এই যে ও অফিস থেকে ফিরে এল একবার চেয়েও দেখল না। একটা রাগ টের পায় অভীক।
গোসল সেরে এসে দেখে টেবিলে খাবার বেড়ে দেওয়া। একজনের খাবার। তার মানে ওরা খেয়ে নিয়েছে। শেষ কবে একসাথে খেয়েছে ওরা? একটা সময় কুঞ্জল বসে থাকত, ও বাইরে থেকে খেয়ে আসত। কুঞ্জল খুব কষ্ট পেত সে সময়টা। কিন্তু আজ যেন পাশার দান উলটে গেছে। মন খারাপ নিয়ে খেতে বসে। খিচুড়ি, হাঁসের মাংস। খেতে গিয়ে টের পায় রান্নাটা অসাধারণ হয়েছে। তা কুঞ্জলের রান্না হাত খুব ভালো। খেয়ে তৃপ্তি হয়।
কুঞ্জল আড়চোখে খেয়াল করে অভীক দুইবার খিচুড়ি নিল। তার মানে রান্না ভালো হয়েছে। না হলে নাক কুঁচকে কিছু একটা বলতই। বিয়ের প্রথম থেকেই এই রান্না নিয়ে অনেক কথা শুনেছে। মূলত ওর কথার ভয়েই ও রান্নাটা খুব যত্ন নিয়েই করত। এখন সেটা অভ্যেস হয়ে গেছে।
অভীকের খাওয়া শেষ হলে ও সব গুছিয়ে শোয়ার আয়োজন করে। কাল ভোরে উঠতে হবে। অর্ক ধরেছে ও সকালে নাকি নতুন স্যু পরে দৌড়ুবে। কেন যেন কুঞ্জলেরও খুব ইচ্ছে হচ্ছে ছেলের সাথে দৌড়ুয়। বিশেষ করে সেদিন সাইফুল্লাহ স্যার ওকে রানিং স্যুটা গিফট করার পর থেকেই এমন ইচ্ছে হচ্ছে। ও ফেসবুকে দেখেছে সত্যিই ওর মতো অনেক মেয়েই ম্যারাথন দৌড়ুয়। অনেকগুলো সংগঠন আছে যারা এমন দৌড়ের আয়োজন করে।
কুঞ্জল বিছানা ঠিক করতে করতে ভাবে, কাল একবার নতুন স্যু পরে অর্কের সাথে দৌড়ে দেখবে আগের দমটা আছে কি-না।
বিছানা পাতা হতেই অর্ক শুয়ে পড়ে। অন্যদিন ওকে জোর করেও এত দ্রুত বিছানায় পাঠানো যায় না। আজ নিজেই শুয়ে পড়েছে কাল সকালে উঠবে বলে। ওর দিকে তাকিয়ে কুঞ্জল হাসে।
মশারি করে ও এবার ডাইনিংয়ে যায়। এক গ্লাস পানি খেয়ে ফিরে আসতে যেতেই অভীক পেছন থেকে হুট করে ওর হাত টেনে ধরে। কুঞ্জল ভয়ে চাপা চিৎকার করতে যেতেই থেমে যায়। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর হাত ছাড়িয়ে নিতে যেতেই অভীক মরিয়া গলায় বলে, ‘আর কতদিন রাগ করে থাকবে বলো তো? আমি বলেছি তো আমি আর এমন করব না। প্লিজ, আর রাগ করে থেকো না।’
কুঞ্জল ঠান্ডা গলায় বলে, ‘অভীক, তোমার উপর আমার রাগ নেই। কাছের মানুষের সাথেই রাগ করা যায়, অভিমান করা যায়। তুমি তো আমার কাছের মানুষ নেই। আমি তো বলেছি, তুমি তোমার মতো থাকো, আমার কোনো অভিযোগ নেই।’
অভীক এবার ওকে ঝট করে কাছে টেনে নেয়। তারপর দুই হাতে শক্ত করে ধরে আকুল গলায় বলে, ‘প্লিজ, এমন করো না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আসো, আজ আমার সাথে শোবে।’
কথাটা শেষ করেই ও কুঞ্জলের মুখটা টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে।
কুঞ্জলের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ওর শুধু একটা কথা মনে হয়, এই ঠোঁট দিয়ে অভীক মেঘাকে চুমু খেয়েছে অথবা পূর্ণকে। কথাটা মনে হতেই কুঞ্জল তীব্র একটা ঘৃণা নিয়ে ছিটকে মুখটা সরিয়ে নেয়। তারপর তীব্র গলায় বলে, ‘তোমার শরীরের এই খিদেটা অন্য কারও সাথে মেটাও, আমার সাথে না।’
অভীক স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জল এই কথা বলতে পারল! মাথায় ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে। ও হিংস্রভাবে ওর বাহু খামচে ধরে সামনে টেনে নেয়৷ তারপর মুখের কাছে মুখ নিয়ে তীব্র গলায় বলে, ‘তুমি বুঝি অন্য কারও সাথে শরীরের খিদে মেটাচ্ছ, তাই আমার আদর ভালো লাগছে না। অসভ্য, নষ্ট মেয়ে।’
কুঞ্জলের স্তম্ভিত হয়ে তাকায়। একটা অপমানের জ্বালা টের পায়। চোখ ফেটে কান্না আসে। একবার পেছন ঘুরে ভয়ে ভয়ে ছেলের রুমের দিকে তাকায়। নাহ, অর্ক গভীর ঘুমে।
কুঞ্জল চোখ মুছে, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘আমাকে একটা বাজে কথা বললে আমি সুইসাইড করব। আর মরার আগে আমি সবাইকে তোমার কথা বলে যাব।’
কথাটায় কাজ হয়। অভীক কুঁকড়ে যায়, ওকে ছেড়ে দিয়ে অসহায় চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর মন খারাপ করে নিজের রুমে ফিরে যায়।
কুঞ্জল বিছানায় বসে থাকে। দু’চোখ বেয়ে অবিরল জল ঝরে। এত বাজে একটা কথা অভীক বলতে পারল? কষ্টে বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে যায়। সংসার এত কষ্টের কেন?
রাত বাড়ে, কিন্তু কুঞ্জলের ঘুম আসে না। একটা চাদর জড়িয়ে বারন্দায় এসে বসে। বাইরে ল্যাম্পপোস্টের আলো ঘিরে ঘন কুয়াশা। সেখান থেকে ক্ষীণ একটা আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। চারদিক সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে বাইরে শীতের কুয়াশা ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দ হচ্ছে। এই শহরের সবাই এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হয়তো সাবাই না, ওর মতো মনের কষ্ট নিয়ে কেউ কেউ জেগে আছে।
নাহ, আজ আর ঘুম আসবে না। কুঞ্জল ভেতর থেকে হেডফোন নিয়ে আসে। গান শুনে আজ রাত পার করে দেবে। একে একে পছন্দের গান বাজতে বাজতে একটা সময় শুভমিতার গলায় প্রেমহীন সংসার গানটা বাজে –
আমি কার কে আমার, কি যে তার আমি হই, কানামাছি কাছাকাছি, দূরে-দূরে আমি রই, প্রেমহীন সংসার, আহা সোনামুখী সুঁই।’
গানটা শুনতেই কুঞ্জল হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। এই পৃথিবীর কোথাও কী কেউ নেই যে ওকে একটু ভালোবাসবে, মায়া করবে?
(চলবে)