#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৭)
১.
‘প্রিয় দর্শক, কুঞ্জল রসুইঘরে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আমি কুঞ্জল আজ আপনাদের খুব মজার একটা রেসিপি দেখাব যেটা একবার খেলে বার বার খেতে ইচ্ছে করবে। আর রেসিপিটা হলো নারকোল দিয়ে কচুবাটা।’
এ পর্যন্ত বলে কুঞ্জল থামে। তারপর দৌড়ে এসে মোবাইল স্ট্যান্ডে রাখা মোবাইলের ভিডিও অপশনটা অফ করে। তারপর একবার চালিয়ে ভিডিওটা দেখে। সন্তুষ্ট মনে মাথা নাড়ে, নাহ, একদম ঠিকঠাক। কিছুদিন আগেই পৃথুল ‘কুঞ্জল রসুইঘর’ নামে একটা রান্নার পেজ খুলে দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত রান্নার ভিডিও আপলোড করেনি। এটাই প্রথম ভিডিও। তাই ইচ্ছে করেই একটু ভিন্ন রকমের রান্নার রেসিপি ও বেছে নিয়েছে।
কুঞ্জল শাড়িটা ভালো করে কোমরে পেচিয়ে নেয়। এবার আবার শুরু করে, ‘আমি আজ দু’ভাবে মানকচুর এই অমৃত ভর্তাটা করে দেখাব। আগে থেকে কুড়ানো নারকোল, সরিষা দানা, কাঁচা মরিচ… ‘, কুঞ্জল একে একে উপাদানগুলো বলে যায়। তারপর যত্ন নিয়ে নারকোল দিয়ে মানকচু ভর্তাটা করে দেখায়।
ভিডিওটা অফ করে এবার ও একটু ভর্তা মুখে দিয়ে দেখে, বাহ, দারুণ হয়েছে তো। এবার ভিডিওটা আপলোড করতে হবে। তার আগে একটু কেটে ছেঁটে কমানো দরকার। কাজটা করতে গিয়ে কোথা দিয়ে ঘন্টাখানেক সময় পেরিয়ে যায় ও বুঝতেই পারে না। নাহ, হাতে সময় নেই। অর্কের নতুন বছরের ক্লাশ শুরু হয়েছে। ওকে আনতে যেতে হবে।
ভিডিওটা পেজে আপলোড করেই ও বেরিয়ে পড়ে। আল্লাহ ভরসা, এবার আর কয়েক ঘন্টা ও ফেসবুকেই ঢুকবে না। ভিডিওটা আপলোড করে এখন কেমন যেন লজ্জা লাগছে। ওই পাগল মনের ডাক্তারের কথা শোনা উচিত হয়নি। সেদিন অদ্ভুত সব কথা বলছিল। না, কষ্ট কমেনি কিন্তু সেদিনের পর মনের এই কষ্টগুলো সইবার শক্তি বেড়েছে। হ্যাঁ, এখন থেকে নিজের আনন্দগুলো খুঁজে দেখবে তারা ওর মনের কোথায় ঘাপটি মেরে আছে।
কুঞ্জল বেরোয়। স্কুলে আসতেই পৃথুল হইহই করে ওঠে, ‘প্রথম ভিডিওতেই তো ফাটিয়ে দিয়েছিস। কংগ্রাচুলেশনস।’
কুঞ্জল অবাক গলায় বলে, ‘কী ফাটিয়ে দিলাম আবার?’
পৃথুল মুখ ভেঙচে বলে, ‘ন্যাকা। মানকচুর ভর্তাটা তো হিট। ইতোমধ্যেই তিনশ লাইক পড়ে গেছে, আর গোটা পঞ্চাশ কমেন্ট। সবাই কী দারুণ দারুণ কমেন্ট করছে। তুই সবগুলো কমেন্টের আলাদা করে উত্তর দিবি। তুই দেখেছিস তো?
সর্বনাশ! সত্তিই এতগুলো লাইক, কমেন্ট পড়েছে? কুঞ্জল নিরীহ গলায় বলে, ‘না, আমি আপলোড করেই ফেসবুক বন্ধ করে বসে আছি। ভীষণ লজ্জা লাগছিল।’
পৃথুল ওর গালে একটা ঠুনকো দিয়ে বলে, ‘এহ, লজ্জা করে। একবার খুলে দেখ, মন ভালো করা সব কমেন্টস।’
কুঞ্জল এবার ফেসবুক খোলে, আর সাথে সাথে নোটিফিকেশনের মিষ্টি ‘টুন’ ‘টুন’ শব্দে চারপাশ ভরে ওঠে। ও স্ক্রল করে করে নিচে যায়। সবাই দারুণ সব কমেন্ট লিখেছে। কেউ লিখেছে – আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, পুরনো এই রান্নাগুলো ফিরিয়ে আনার জন্য; কেউ লিখেছে – অসাধারণ একটা ভর্তা, মা করতেন; কেউ লিখেছে – নিয়মিত এমন সুন্দর সব রেসিপি দেবেন। আরও কত কত কমেন্ট। পরিচিতদের মাঝে অনেকেই লিখেছে। কিন্তু অপরিচিত মানুষ বেশি। কুঞ্জল ভাবতেই পারে না, ওকে চেনে না জানে না এমন মানুষজন ওর প্রশংসা করছে। হঠাৎ করেই মনটা ভালো হয়ে যায়। পৃথুলের হাত ধরে বলে, ‘সত্যিই তো অনেক লাইক কমেন্ট পড়ছে। আমি তো ভাবলাম এমন সাধারণ ভর্তার রেসিপি কেউ পছন্দই করবে না।’
পৃথুল দুষ্ট হাসি হাসে, ‘আপনার চেহারা মাশাল্লা যা, তাতে করে কচুর লতি রান্না করলেও মানুষজন হামলে পড়বে। তবে শাড়ি পরাটা ছাড়িস না, এটা পরেই রান্না করবি। তাতে কেমন একটা আপন আপন লাগে, আমাদের মায়েদের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।’
কুঞ্জল হিহি করে হাসে, ‘আমরাই তো এখন মা। তবে ব্যাপারটা এত জমে যাবে এটা ভাবিনি। আচ্ছা চল, অর্কদের ছুটি হলো বলে।’
স্কুল ছুটি হতেই অর্ক বন্ধুদের হাত ধরে বেরিয়ে আসে। মাকে দেখে দৌড়ে কাছে এসে বলে, ‘আম্মু, আমার রানিং স্যু কিনতে হবে। আমি স্কুলের খেলায় দৌড়ে নাম দিয়েছি। আজ হিট হয়েছিল, আমি ফার্স্ট হয়েছি।’
কুঞ্জলের হঠাৎ করেই মনে পড়ে, স্কুলে ও খুব ভালো দৌড়াত। ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘তাই! আমার অর্ক বাবা ফার্স্ট হয়েছে? তাহলে তো দৌড়ুনোর জন্য ভালো জুতো কিনতেই হয়। জানো তো, আম্মুও কিন্তু ভালো দৌড়াতে পারে।’
অর্ক অবিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘তুমি দৌড়াতে পারো?’
কুঞ্জল মন খারাপ করে ভাবে, আসলেই তো, ও যে দৌড়াতে পারে, ছুটতে পারে সেটা ভুলেই গিয়েছিল। সংসার ওকে জুবুথুবু মানুষ বানিয়েছে। সব দুঃখ, কষ্টকে হারিয়ে দিয়ে ও যে দৌড়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে সেটা ভুলে গিয়েছিল। এখন থেকে ও খুব দৌড়ুবে, সামনের দিকে।
বিকেল নাগাদ কুঞ্জলের রান্নার ভিডিওতে হাজারখানেক লাইক পড়ে, তিনশ’র উপর কমেন্ট। ওর কেমন দিশেহারা লাগছে। এতদিন জাদুর বাক্স নামের শাড়ির পেজে ও এটা হতে দেখেছে। যদিও সেই ঘটনার পর ওই কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল। আজ নিজের পেজে হচ্ছে। ভাবতেই ও একটা অবাক,আর অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে বসে থাকে। কী মনে হতে ও মনের ডাক্তার সাইফুল্লাহকে ফোন দেয়, ‘হ্যালো, আপনি ফ্রি আছেন একটু?’
সাইফুল্লাহ মাত্রই একটা সেশন শেষ করে চা নিয়ে বসেছিল, তখনই কুঞ্জলের ফোন আসে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘মাত্রই ফ্রি হলাম। আপনি ভালো তো?’
কুঞ্জল কিশোরী মেয়েদের মতো উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো। জানেন, আজ দারুণ একটা ব্যাপার হয়েছে। আপনার কুবুদ্ধিমতো আমি একটা রান্নার ভিডিও করেছিলাম। বলুন তো কী হতে পারে?’
সাইফুল্লাহ গায়ের চাদরটা আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘নিশ্চয়ই সবাই খুব পচা বলছে।’
কুঞ্জল কৃত্রিম রাগের গলায় বলে, ‘এহ, তা বলবে কেন। আমার রান্না বুঝি পচা?’
সাইফুল্লাহ হেসে বলে, ‘আমি তো খাইনি কখনো। না খেয়ে বলি কী করে?’
কুঞ্জল গাঢ় গলায় বলে, ‘আপনাকে খাওয়াব তো। আপনি সত্যিই আমার দিনগুলো ভালো করে দিচ্ছেন। জানেন, আজ আমার প্রথম ভিডিওটাই হাজারখানেকের উপর লাইক পড়ে গেছে। আর সবাই এত ভালো ভালো কমেন্ট করছে যে কী বলব। সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গাটা কি জানেন? এরা বেশিরভাগই আমার অপরিচিত। আমি আমার জীবনে কোন কাজ করে এত প্রশংসা পাইনি।’
সাইফুল্লাহ নরম গলায় বলে, ‘আপনি জানতেনই না আপনার এই শক্তিশালী দিকটার কথা। আমার কাজই হলো আপনাকে আপনার মনের সেই শক্তিশালী দিকগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। আপনার পাওনা প্রশংসাগুলো ঠিকঠাক পাওয়া। আর এগুলো হলো মনের খাবার। আচ্ছা শুনুন, আপনার জন্য একটা গিফট আছে। একবার এসে নিয়ে যাবেন খন।’
এবার কুঞ্জল অবাক হয়, ‘সে কী! আমার জন্য গিফট! কেন?’
সাইফুল্লাহ রহস্যের গলায় বলে, ‘সেটা এলেই জানবেন। আমি সকালের দিকে ফ্রি থাকি। আসার আগে জানিয়ে আসবেন কিন্তু।’
ফোন রেখে কুঞ্জল কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। আজ দিনটা এত সুন্দর কেন? সব ভালো লাগার জিনিসগুলো ওর সাথে ঘটছে। একটা মন ভালো করা নিশ্বাস নেয়। নিশ্বাস নিতে গিয়ে টের পায় বুকের কোথাও ব্যথা লাগল না। এমন করেই তো ও বাঁচতে চেয়েছিল। অভীক ওর নিশ্বাসগুলো ব্যথায় ভরিয়ে দিয়েছিল। আর সেটা প্রতিবার নিশ্বাস নেবার সময় ও টের পেত। নাহ, এরপর আর কোনো বেচাল করেনি অভীক। অথবা করলেও ও আর সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবেনি। অভীক কয়েকবার ক্ষমা চেয়েছে, কুঞ্জল কিছুই বলেনি। আসলে বিশ্বাসটাই টলে গেছে।
রাতে অভীক যখন বাসায় ফেরে ততক্ষণে কুঞ্জলের ভিডিওটা দু’হাজার লাইক পেরিয়ে গেছে। আর সেইসাথে পাল্লা দিয়ে কমেন্টের সংখ্যাও বাড়ছে। ও অর্ককে নিয়ে টিভি দেখছিল আর ফাঁকে ফাঁকে কমেন্টগুলো পড়ছিল। অভীক এসে একবার গম্ভীরমুখে তাকায়, তারপর অর্ককে ডেকে বলে, ‘বাবা, এটা তোমার আম্মুকে দাও।’
কুঞ্জল আড়চোখে একবার দেখে, একটা কাগজের ব্যাগ। অর্ক ওর হাতে দিতেই ভেতর থেকে একটা মভ কালারের শাড়ি বের হয়ে আসে।
কুঞ্জল খুশি হতে যেয়েও মন খারাপ করে ফেলে। সেবারও অভীক ওর জন্য শাড়ি নিয়ে এসেছিল, কিন্তু যে শাড়ির জন্য ও অপেক্ষা করে বসেছিল সেটা না। সেদিন সেই শাড়িটা মেঘাকে দিয়েছিল। আর সেটা ব্যালেন্স করতেই ও বাসায় ওর জন্য জামদানি শাড়ি নিয়ে এসেছিল। সেই স্মৃতিটা মনে পড়তেই হঠাৎ করেই ওর মাথায় আগুন ধরে যায়।
ও ঝট করে মুখ তোলে, তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘শাড়ি এনেছ কেন? আজ বুঝি অন্য কাউকে শাড়ি কিনে দিয়েছ, আর সেটা ব্যালেন্স করতে আমার জন্যও একটা নিয়ে এসেছে? এর আগেও তো এমন করেছিলে। এবার মেয়েটা কে?’
হঠাৎ এমন আক্রমণে অভীক প্রথমে হকচকিয়ে যায়। কুঞ্জলের সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতেই শাড়ি আনা। কিন্তু এ তো দেখি হিতে বিপরীত হলো। অভীক চোখমুখ অন্ধকার করে বলে, ‘তোমাকে আর কতবার বললে তুমি বিশ্বাস করবে আমার আর এসব কিছু নেই। কেন এমন উল্টাপাল্টা কথা বলো?’
কুঞ্জল তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘কারণ তুমি মিথ্যুক, বেইমান। তোমাকে আমি একফোঁটাও বিশ্বাস করি না। তোমার এই শাড়ি যার জন্য কিনেছ তাকে দিয়ে আসো।’
কথাটা বলেই কুঞ্জল শাড়িটা ছুড়ে ফেলে দেয়। অভীকের মাথায় যেন আগুন ধরে যায়। ও শাড়িটা কুড়িয়ে নিয়ে হিংস্র গলায় বলে, ‘ঠিক আছে। তোমার যখন এতই অবিশ্বাস সেটা আমি এখনই মিটিয়ে দেব।’
কথাটা বলে ও শাড়িটা নিয়ে রান্নাঘরে যায়। তারপর খুঁজে খুঁজে একটা দেয়াশলাই বের করে আনে। তারপর হিসহিসিয়ে বলে, ‘সব জ্বালিয়ে দেব। এত অশান্তি আর ভালো লাগে না।’
অর্ক বিছানায় বসে কাঁপছিল, ও ভয়ার্ত গলায় বলে ওঠে, ‘আম্মুউউ।’
কুঞ্জলের এবার হুশ ফেরে। ও লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামে। ঝট করে অভীকের হাত থেকে শাড়িটা ছিনিয়ে নেয়। তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, ‘বাচ্চাটাকে ভয় না দেখালেই না, তাই না? ওর সামনে এমন হিংস্র আচরণ করবে না আর। এমন করলে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে চলে যাব।’
শাড়িটা নিয়ে ও অর্ককে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। ফিসফিস করে বলে, ‘বাবা ভয় পেও না।’
অর্ক মায়ের বুকের ভেতর ঢুকে পড়ে। ও ঠিক বুঝে পায় না আম্মু আর বাবা কেন এত ঝগড়া করে?
অভীক অবসন্ন শরীরে লিভিংয়ের সোফায় বসে পড়ে। মাথাটা কেমন ঘোরাচ্ছে। কুঞ্জল ওকে দোষ দিল। অথচ আজকের ঝগড়াটা ওই শুরু করেছে। কী হতো শাড়িটা নিয়ে নিলে? শাড়িটা নিয়ে অমন একটা খোঁচা দেওয়া কথা বলার কোনো মানে ছিল? যেখানে ও বার বার ক্ষমা চাচ্ছে, ফিরে আসতে চাইছে সেখানে কুঞ্জল বারবারই ওকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মাঝখান দিয়ে ছেলেটা একটা অসুস্থ পরিবেশে বড়ো হচ্ছে। নাহ, এমন আর করা যাবে না।
অভীক এবার গলা বাড়িয়ে ডাক দেয়, ‘অর্ক, এদিকে শুনে যাও তো বাবা।’
একটু পর অর্ক ছোট ছোট পা ফেলে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে অভীকের বুক ভেঙে যায়। ইচ্ছে করছে নিজের গালে চড় মারতে। এত খারাপ বাবা কেন ও?
একটা হাত ধরে ছেলেকে পাশে বসায়, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘বাবা, আজ স্কুলে গিয়েছিলে?’
অর্ক মাথা নাড়ে। তারপর ভয়ে ভয়ে বলে, ‘বাবা, আমার একটা রানিং স্যু লাগবে। আমি স্কুলে দৌড়ে নাম দিয়েছি।’
অভীক ছেলেকে কাছে টেনে বলে, ‘তাই! বাহ, খুব ভালো। কাল আমি আসার সময় নিয়ে আসব। কী রঙের জুতো কিনবে? সাদা, না নীল?’
অর্ক মাথা নেড়ে বলে, ‘কালো স্যু বাবা। ভালো করে দেখে এনো কিন্তু। আমি ফার্স্ট হব দৌড়ে।’
অভীক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘হবে তো। জানো তো, তোমার আম্মুও স্কুলে ফার্স্ট হতো দৌড়ে।’
অর্ক এবার উৎসাহের সাথে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা। আম্মু আজ বলেছে আমাকে। আমার ফাইনাল খেলার দিন ছুটি নেবে কিন্তু।’
কুঞ্জল ভেতর থেকে ওদের কথা শুনছিল। এখন নিজের কাছে খারাপ লাগে। ইশ, কেন যে ছেলের সামনে অমন করতে গেল? বার বার ভাবে, ছেলের সামনে এই কুৎসিত ব্যাপার নিয়ে কথা বলবে না। কিন্তু কেন জানি তখন মাথাটা উল্টাপাল্টা হয়ে গেল। নাহ, এটা নিয়ে সাইফুল্লাহ স্যারের সাথে কথা বলতে হবে।
সেদিন রাতে কুঞ্জল মন খারাপ নিয়ে ঘুমিয়ে যাবার আগে অবাক হয়ে দেখে ওর রান্নার ভিডিওটা তিন হাজার লাইক পেরিয়ে গেছে। আরও অনেক নতুন কমেন্ট পড়েছে। স্ক্রল করে ও নতুন কমেন্টগুলো পড়তে থাকে। তাতে করে মন খারাপ ভালো হতে শুরু করে।
ঘুমিয়ে যাবার আগে হঠাৎ করে একটা কমেন্ট দেখে ও থমকে যায়, ‘এভাবে কচু ভর্তা করলে গলায় ধরবে। আপনার ভর্তার রেসিপিতে একটু ভুল আছে।’
কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে কমেন্টটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই প্রথম একটা নেগেটিভ কমেন্ট পড়ল। কিন্তু সত্যি বলেছে। কারণ আজ দুপুরে খাবার পর একটু একটু গলায় ধরেছিল কচুটা। কুঞ্জল আইডিটা খেয়াল করে, ‘অংশুল’ নামে একজন কমেন্ট করেছে। কী মনে হতে ও প্রোফাইলে ঢুকতেই দেখে লেখা, ‘শেফ, ইনকা রেস্তোরাঁ।’
কুঞ্জলের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। ইনকা শহরের নামকরা একটা রেস্টুরেন্ট। আর সেখানকার শেফ ওর রান্নার ভিডিও দেখেছে? মনটা ভালো হয়ে যায়। ও এবার কী মনে হতে অংশুলের ইনবক্সে একটা মেসেজ লিখে, ‘আপনার কথা ঠিক, কচু ভর্তাটা আসলেই গলায় ধরছে। একটু যদি বলতেন ভুলটা কোথায় হলো, তাহলে খুব উপকার হতো। আর আপনার মতো একজন মানুষ আমার ভিডিও দেখে মন্তব্য করেছেন সেজন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। নাহ, কোনো রিপ্লাই আসে না। বিখ্যাত শেফ, হয়তো মেসেজ দেখবেই না। কুঞ্জল আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর মোবাইল বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার আয়োজন করে। অর্ক আগেই ঘুমিয়েছে। অভীক এখনও একাই শোয়। এই জীবনে আর কখনও হয়তো ওরা একসাথে ঘুমাবে না।
২.
আজ কুঞ্জল নিজে একা একাই সাইফুল্লাহ স্যারের বাসা চিনে এসে পড়েছে। গেটের দরজার হাতল ঘোরাতেই খুলে যায়। সকাল দশটা, শীতের সকাল। ভেতরে পা দিতেই একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পায়। তাকাতেই দেখে শিউলি ফুল পড়ে আছে মাটিতে।
এমন সময় স্যারের গলা পাওয়া যায়, ‘কুড়োতে পারেন, এখনও টাটকা আছে।’
কুঞ্জল গলার আওয়াজ লক্ষ করে উপরে তাকায়। ছাদে বসে মিটিমিটি হাসছেন। ইশারা করেন, ‘ উপরে উঠে আসেন।’
কুঞ্জল হাতের টিফিন বক্স দেখিয়ে বলে, ‘আপনার জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছি। আপনার সেই সহকারী কই?’
সাইফুল্লাহ আশ্বস্ত করে বলে, ‘ও আছে। আপনি ওটা নিচে রেখে উপরে চলে আসেন। শীতের রোদ পোহাই আর আপনার সাথে গল্প করি।’
কুঞ্জল হাসে। তারপর টিফিন বক্সটা বাড়ির ভেতর নামিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে আসে। সিঁড়িটা পুরনো আমলের মোজাইক করা, সেগুন কাঠের হাতল। এমন বাড়িগুলো কেমন নস্টালজিক যেন।
ছাদে আসতেই মন ভালো হয়ে যায়। ফুলে ফুলে চারপাশ ছেয়ে গেছে। গাঁদা ফুল, কসমস ফুল, নানান জাতের গোলাপ। আরও যে কত কত ফুল। ও অবাক গলায় বলে, ‘আপনি আবার ফুলও ফোটান?’
সাইফুল্লাহ হাসে, ‘আপনার মতো আমারও এই একটা গুণ আছে, ফুল ফোটানোর। বসুন আরাম করে। বাচ্চুকে বলা আছে, চা দিয়ে যাবে এখুনি। তারপর আপনার খবর বলেন।’
কুঞ্জল কালকের রাতের কথাটা একবার মনে করে, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘একদম ফার্স্টক্লাস। আমার রান্নার ভিডিও তো মানুষজন খুব পছন্দ করেছে। সত্যিই নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
সাইফুল্লাহ হাসে, তারপর বলে, ‘আমি কিছুই করিনি। আপনার মাঝে ছিল, দেখতে পাননি। আচ্ছা, এবার বলেন অভীকের কী খবর।’
কুঞ্জল একটু থমকায়, এমন সরাসরি ওর কথা জিজ্ঞেস করবেন ও আশা করেনি। নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আছে ঠিকঠাক। আমি আমার মতো, ও ওর মতো। আচ্ছা, আমাকে একটা বুদ্ধি বাতলে দিতে পারবেন?’
সাইফুল্লাহ কৌতুহলী গলায় বলে, ‘কী বুদ্ধি?’
কুঞ্জল দ্বিধান্বিত গলায় বলে, ‘আমি অভীকের ব্যাপারে ভাবতে চাই না। মানে ও কার সাথে প্রেম করল সেটা নিয়ে ভাবতে চাই না। কিন্তু পারি না। সুযোগ পেলেই আমার ভেতরের সন্দেহপ্রবণ মনটা জেগে ওঠে। আর যার ফলাফল কুৎসিত ঝগড়া। কেন এমন হয় বলুন তো? আমি তো ওর কাছে আর কিছুই আশা করি না।’
সাইফুল্লাহ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘ভুল। আপনি আসলে মনে মনে আশা করেন। অভীকের উপর আপনার একটা অধিকারবোধ আছে যেটা চাইলেও আপনি ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না। মানুষ একটা অদ্ভুত প্রাণী, একবার কোনো কিছু নিজের করে পেলে সেটা আর কিছুতেই হারাতে চায় না, সেটা কাজে না লাগুক, তাও। ব্যাপারটা সহজ করে বলি। বাসায় এমন অনেক জিনিস পাবেন যেটা বছরের পর বছর ব্যবহার হয়নি, কিন্তু সেটা ফেলে দিতে ইচ্ছে করে না আবার কাউকে দিতেও ইচ্ছে করে না। এটা একটা অবস্থা। এরপর যখন সত্যিই অধিকারবোধটা ক্ষীণ হয়ে আসে তখন আর অসুবিধে হয় না জিনিসটা ঝেড়ে ফেলতে। আপনি এখনও ওই অবস্থায় যাননি। এখনও কিছু মায়া হয়তো রয়ে গেছে, তাই অমন হয়।’
কুঞ্জল হতাশ গলায় বলে, ‘আপনি বলছেন এত কিছুর পরেও ওর জন্য আমার মনে মায়া রয়ে গেছে?’
সাইফুল্লাহ হেসে বলে, ‘হ্যাঁ রয়ে গেছে, ভাগশেষের মতো। চিন্তা করবেন না, এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় ভাগশেষও থাকবে না। আর তখন কষ্টও থাকবে না, আপনি যেটা চান আর কি।’
কথাটা বলে সাইফুল্লাহ তীব্র চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জলের মুখে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে। আর সেটা পেয়েও যায়। মেয়েটার মুখে এখন একটা নীল বেদনার রেখা ফুটে উঠেছে। আহারে, মানুষের কত কত কষ্ট! নিজের অচেনা মনের সামনে কত অসহায় মানুষ!
পরিবেশটা হালকা করতে ও বলে, ‘তা আজ কী কী রান্না করে নিয়ে এলেন?’
কুঞ্জল এবার স্বাভাবিক হয়, ‘উম, পাবদা মাছ জলপাইয়ের ঝোল দিয়ে। কুচো চিংড়ি পালং শাক দিয়ে। আর একটু মুরগির মাংস, সাতকড়া দিয়ে। খান তো এগুলো?’
সাইফুল্লাহ চোখ কপালে তোলে, ‘এত কিছু! আর সব পছন্দের পদ নিয়ে এসেছেন। খাবেন তো আমার সাথে?’
কুঞ্জল বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই খাব। কিন্তু তার আগে বলুন, আমার গিফট কই?’
সাইফুল্লাহ প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে হাসে, তারপর পাশে থাকা একটা ব্যাগ ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘খুলে দেখেন।’
কুঞ্জল আগ্রহ নিয়ে ব্যাগটা খোলে, অবাক হয়ে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, ‘কেডস? আমার জন্য?’
সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘কেডস না, রানিং স্যু। জানেন তো ম্যারাথন দৌড় হয় প্রায়ই। বিভিন্ন সংগঠন আয়োজন করে। ঢাকাতেও অনেকগুলো গ্রুপ আছে। ফেসবুকে দেখবেন UCR নামে একটা গ্রুপ আছে, ওরা হলিডেগুলোতে ম্যারাথন দৌড়ের আয়োজন করে। অনেক মেয়েরাও তাতে অংশগ্রহণ করে। আপনি যেহেতু একসময় দৌড়ুতেন সেজন্যই এটা কেনা। সাইজটা না হলে ওদের শপ থেকে পালটে নিবেন। ওরা বলেছে পালটে দেবে।’
কুঞ্জল আঁতকে ওঠে, ‘এই বয়সে দৌড়ুব?’
সাইফুল্লাহ আশ্বস্ত করে বলে, ‘ইয়াং লেডি, আপনার চেয়ে বিশ বছর বড়ো বয়সের মেয়েরাও দৌড়ুচ্ছে। আপনি ফেসবুকে ঢুকে একবার দেখতে পারেন।’
কুঞ্জলের ভীষণ ইচ্ছে করছে দৌড়াতে। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব?
দুপুরে ওরা দু’জন যখন খেতে বসে তখন সাইফুল্লাহ প্রশংসার গলায় বলে, ‘বাহ, আপনার হাতের রান্না আসলেই তো খুউব ভালো। মাঝে মাঝে নিয়ে আসবেন তো?’
কুঞ্জল একটা মায়া নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ আসব। কেন যেন আপনার কাছে আসতে আমার ভালো লাগে।’
সাইফুল্লাহ মৃদু হাসে তারপর বলে, ‘তার কারণ আছে। আপনি আমাকে আপনার কথাগুলো অকপটে বলতে পারেন। নিজের কথাগুলো কাউকে বলার মতো মানুষের খুব অভাব। তাই তো এত এত কষ্ট।’
কুঞ্জল খাওয়া থামিয়ে চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। কী ভীষণ সত্যি একটা কথা উনি এইমাত্র বললেন। অভীককে যদি ও ওর সব কথা বলতে পারত!
(চলবে)