প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০৬

0
461

প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৬)

১.
অভীক সবে ভৈরব পেরিয়েছে ঠিক তখন মেঘার ফোন আসে। ঘণ্টাখানেক আগে মেঘাকে ফোন করেছিল, তখন ধরেনি। সকালে বাসা থেকে বের হয়েই মেসেজ করেছিল আজ সিলেট যাচ্ছে, ফ্রি থাকবে। কিন্তু ও তখন ফোন ধরল না কেন? যাক, এখন ফোন দিয়েছে তো।

ও দ্রুত ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে মেঘার কাঁপা গলা পায়, ‘অভীক, সর্বনাশ হয়ে গেছে। তোমার বউ একটু আগেই আমার অফিসে এসেছিল। আমি বলেছিলাম তোমার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু ঠিক তখুনি তোমার ফোন আসে। ও দেখে ফেলেছে। তুমি তোমার বউকে সামলাও প্লিজ। ওকে মানসিকভাবে ভীষণ এলোমেলো লেগেছে। আমাকে প্লিজ আর ফোন করো না।’

অভীকের তলপেট খালি হয়ে যেতে থাকে। ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত ওর পিঠ বেয়ে নেমে যায়। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাসে বসেও ও ঘামতে থাকে। সর্বনাশ! কুঞ্জল মেঘার অফিসে গিয়েছিল। আর তখুনি ও ফোন দিয়েছিল? হায় হায়। এবার যে কুঞ্জল ওকে আর বিশ্বাসই করবে না। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ের ব্যাপার হলো কুঞ্জল যদি রাগের মাথায় সুইসাইড করে ফেলে! কথাটা ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। কী করবে ও?

সিলেট অভিমুখী বাসটা ভৈরব ব্রিজ পার হয়ে একটা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে থামে। অভীক একবার ভাবে, কুঞ্জলকে ফোন করবে? কথাটা ভাবতেই ও ফোন করে। নম্বরটা বন্ধ। অভীক আবার করে, এবারও বন্ধ পায়। এবার টেনশন হতে থাকে ওর। মেয়েটা যদি কিছু একটা করে ফেলে? কাকে ফোন করবে এখন? একটু ভাবতেই কুঞ্জলের বন্ধু পৃথুলের কথা মনে হতেই ও ফোন দেয়। ওপাশ থেকে পৃথুল অবাক গলায় বলে, ‘ভাইয়া, কোনো সমস্যা?’

অভীক একটু থতমত খেয়ে বলে, ‘কুঞ্জলের ফোন বন্ধ পাচ্ছি। তুমি যেয়ে একটু দেখবে ও বাসায় আছে কি-না? একটু জরুরি দরকার ছিল।’

পৃথুল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কুঞ্জল তো একটু মার্কেটে গেছে। যাবার আগে অর্ককে আমার বাসায় রেখে গেছে। আপনি ভাববেন না, ওর মোবাইলে হয়তো চার্জ ফুরিয়ে গেছে। ও এলে আমি বলব আপনাকে ফোন দিতে।’

অভীক ফোন রেখে বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। তার মানে কুঞ্জল এখনও বাসায় ফেরেনি। হয়তো পথে। একটু ভাবে, তারপর দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। অফিসে ফোন করে জানিয়ে দেয় ও সিলেট যেতে পারছে না, ছেলে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই মিথ্যেটা বলতে বুক কাঁপে, কিন্তু তাও বলে। এরপর ও ঢাকার বাস ধরে। কুঞ্জলকে বিশ্বাস নেই, ও রাগের মাথায় যা তা করে ফেলতে পারে।

এদিকে কুঞ্জল একটু আগেই বাসায় এসেছে। ভেবেছিল মাকে সব জানাবে, কিন্তু ইচ্ছে করেনি। মা বাব দু’জনের অবস্থা ওর মতোই, বড়ো ভাইয়ার সংসারে আশ্রিতের মতো। উল্টো বলবে মানিয়ে নিতে।

কুঞ্জল খাটে পা মেলে বসেছিল। অর্ক অবাক চোখে মায়ের পায়ে সাদা প্লাস্টারের দিকে তাকিয়ে আছে। বার বার জিজ্ঞেস করেও ওর কৌতুহল শেষ হয় না। মাকে কখনও এমন অসুখ হতে দেখেনি ও।

অর্ক মন খারাপ গলায় বলে, ‘আম্মু, অনেক ব্যথা করছে তোমার? আমি একটু আদর করে দেই তোমার পায়ে?’

কুঞ্জল বুকের ভেতর একটা নরম মায়া টের পায়। ছেলেটার জন্য বেঁচে থাকা। না হলে এই জীবনের কোনো মানেই নেই। আজকের পর থেকে অভীক ওর জীবন থেকে মৃত। ওকে নিয়ে আর ভাববে না। অভীকের উপর ওর অধিকারটুকু ও ছেড়ে দেবে। পৃথুল আজ হয়তো কিছু সন্দেহ করেছে। একে তো ওর ফোন বন্ধ ছিল, তার মাঝে অভীক ওকে ফোন দিয়ে না পেয়ে পৃথুলকে ফোন দিয়েছিল। পৃথুল তো ওকে দেখে যার পর নাই অবাক। বেচারি আজ দুপুরের রান্না, রাতের রান্না করে দিয়ে গেছে।

আচ্ছা অভীক হঠাৎ করে পৃথুলকে ফোন দিল কেন? ওই মেঘা মেয়েটা কি ওর যাবার কথা জানিয়ে দিয়েছে? আর সেজন্যই বুঝি অভীক ওকে ফোন দিয়েছিল? যা ইচ্ছে করুক, ও আর ভাবতে চায় না।

কষ্ট করে দুপুরের খাবার খেয়ে ও যখন একটু বসেছে ঠিক তখন বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। অর্ক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ‘আম্মুউ, বাবা এসেছে। বাবা, আম্মু পায়ে ব্যথা পেয়েছে। দেখে যাও, পায়ে সাদা ব্যান্ডেজ।’

কুঞ্জল বাসায় আছে, একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অভীক। কিন্তু পায়ে ব্যান্ডেজ মানে?

ও অপরাধীর মতো রুমে ঢুকতেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে, তারপর উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘তোমার পায়ে কী হয়েছে? এক্সিডেন্ট করেছ?’

অর্ক চোখে মুখে একটা ভয় ফুটিয়ে বলে, ‘জানো বাবা, একটা পচা রিক্সা আম্মুর পায়ের উপর দিয়ে চলে গেছে। আম্মু অনেক ব্যথা পেয়েছে। এই দ্যাখো হাতও কেটে গেছে।’

অভীক ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। তারপর অনুযোগের গলায় বলে, ‘এত বড়ো একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেল আমাকে একটা খবর দিলে না?’

কুঞ্জল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে একটা মানুষ এতটা নির্লজ্জ হয় কী করে! বার বার মিথ্যে বলে ধরা খাচ্ছে তারপরও কেমন করে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়?

কুঞ্জল নিচু কিন্তু তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘আমার জন্য আর চিন্তা করবে না কখনও। তুমি তোমার মতো থাকবে, আমি আমার মতো। তুমি কার সাথে প্রেম করো না ঘুরে বেড়াও তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।’

অভীক হাতজোড় করে বলে, ‘কুঞ্জল, প্লিজ আমাকে শেষবারের মতো ক্ষমা করে দাও। দেখো, আমি তোমাকে আজও অনেক ভালোবাসি। আমি তোমার ফোন বন্ধ পেয়ে আমার সিলেট যাওয়া ক্যানসেল করে চলে এসেছি। এরপরও বলবে তোমার জন্য আমার ভালোবাসা নেই?’

কুঞ্জল এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বিষণ্ণ একটা হাসি হাসে, বলে, ‘না নেই। তুমি কেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছ সেটা আমি জানি। তুমি ভেবেছ তোমার এই নির্লজ্জ বেহায়াপনা দেখে আমি সুইসাইড করে ফেলব, পুলিশ তখন তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। আর তোমার মোবাইল একটু ঘাটলেই তো সব কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাবে। আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেবার দায়ে তোমার শাস্তি না হয়ে যায় এই ভয়ে ছুটে এসেছ।’

অভীক আর্তনাদ করে ওঠে, ‘এসব কী বলছ কুঞ্জল! তোমার বেঁচে থাকা আমার কাছে যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’

কুঞ্জল কেটে কেটে বলে, ‘না, একবিন্দুও গুরুত্ব নেই তোমার কাছে। থাকলে আমাকে মেরে ফেলার সব আয়োজন তুমি করতে না। অভীক, তুমি ভয় পেও না। আমি সুইসাইড করব না। শুধু একটা অনুরোধ, আমাকে নিয়ে ভেব না। আমিও তোমাকে নিয়ে ভাবব না। তুমি আজ থেকে মুক্ত। অর্ক বড়ো হওয়া পর্যন্ত আমি আছি। ও আরেকটু বড়ো হলে আমি তোমার সাথে আর থাকব না। তখন পূর্ণ অথবা মেঘা অথবা অন্য কাউকে বিয়ে করো।’

অভীক মাথা নিচু করে বসে থাকে। নাহ, এখন আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না। আসলেই ওর উত্তর দেবার মতো কিছু নেইও। অর্ক বড়ো হবে, একদিন সব জানবে। তখন নিশ্চয়ই ও বাবাকে ঘৃণা করবে। কথাটা ভাবতেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়।

বিকেলে পৃথুল ওকে দেখতে আসে। কুঞ্জলের খুব ভালো লাগে ও আসাতে। এবার পৃথুল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করে। কুঞ্জল মেঘার অংশটুকু বাদ দিয়ে ওই সাইফুল্লাহ লোকটার কথা বলে।

পৃথুল শুনতে শুনতে উত্তেজিত গলায় বলে, ‘এ তো দেখি পুরো সিনেমার কাহিনী। নায়িকার পা ভেঙ্গে গেল, নায়ক কোলে তুলে হাসপাতালে দৌড়।’

ওর বলার ভঙ্গিতে কুঞ্জল হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে, ‘আরে কম করে পঞ্চাশ-ষাট বছরের বুড়ো। তবে দারুণ পরিপাটি মানুষ।’

পৃথুল সিনেমাটিক গলায় বলে, ‘প্রেম না মানে বয়সের বাধা।’

বলেই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে থাকে।

অভীক একবার উঁকি দিয়ে যায়। ওদের দুই বান্ধবীকে হাসতে দেখে একটু যেন নিশ্চিন্ত বোধ করে। ইশ, এমন যদি হাসিখুশি থাকত কুঞ্জল। নাহ, এখন থেকে ও ভালোবাসতে চেষ্টা করবে কুঞ্জলকে। অনেক অপরাধ জমা হয়ে গেছে। অনেক অবিশ্বাস। একটু একটু করে ওকেই সেই পুরনো বিশ্বাস ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।

পৃথুল বিদায় নেবার সময় কুঞ্জল ওকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে দিয়ে বলে, ‘তুই একটু যাবার সময় আমার ফোনে এই টাকাটা বিকাশ করিস তো। ভদ্রলোককে টাকাটা ফেরত দিতে হবে।’

পৃথুল বিরক্ত গলায় বলে, ‘তুই কী রে! এভাবে কেউ উপকারের প্রতিদান দেয়? নিজে যেয়ে ওর টাকাটা ফেরত দিয়ে আয়। সাথে একটা সুন্দর শার্ট বা পাঞ্জাবি কিনে নিয়ে গেলি। তোর কথা শুনে যা বুঝলাম মানুষটা ভীষণ ভালো।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে, ‘আসলেই খুব ভালো মানুষ উনি। না, টাকাটা আজ দিয়ে দেই। পা ভালো হলে একদিন তোকে নিয়ে দেখা করে আসব।’

পৃথুল বলে, ‘না বাবা, আমি কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না।’

বলেই চোখ মারে, তারপর হি হি করে হেসে বিদায় নেয়।

কুঞ্জলের মনটা হালকা হয়। ও একবার অর্ককে ডেকে নাস্তার কথা জিজ্ঞেস করে। অভীক লিভিং থেকে গলা বাড়িয়ে বলে, ‘তুমি উঠো না, আমি বাইরে থেকে নিয়ে আসছি।’

অভীক বাইরে চলে যায়। কুঞ্জল মোবাইলটা হাতে নিতেই বিকাশের টাকাটা আসে। তারপর ও দ্রুত সেন্ড মানি অপশনে যেয়ে সাইফুল্লাহ নামের লোকটার মোবাইল নম্বর লিখে। তারপর একবার মিলিয়ে নিয়ে টাকাটা পাঠিয়ে দেয়।

টাকা পাঠিয়ে এখন খুব শান্তি লাগছে। আচ্ছা লোকটা বলছিল উনি নাকি মনের ডাক্তার। তাই বুঝি চট করে ওর মনের এলোমেলো দিকটা ধরতে পেরেছিলেন?

ঠিক এই সময় মেসেজ আসে, ‘ধন্যবাদ, টাকা পেয়েছি। আপনার পায়ের ব্যথা কমেছে?’

কুঞ্জল কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে দেখে সাইফুল্লাহ সাহেব মেসেজ লিখেছে। লিখবে না ভেবেও ও লিখে, ‘হ্যাঁ, এখন অনেক কম। খোঁজ নেবার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।’

মেসেজটা পাঠিয়ে কেন জানি ভালো লাগতে থাকতে ওর। এরপর মাঝে মাঝেই মনের অজান্তে ওর চোখ মোবাইলের দিকে চলে যায়। তারপর নিজেই লজ্জা পায়। আচ্ছা ওর মন কি সাইফুল্লাহ সাহেবের মেসেজের আশা করছে? কিন্তু কেন? লোকটা ওর মন খারাপের খবরটা পড়তে পেরেছে, সেজন্য ওকে এত আপন মনে হচ্ছে?

২.
সাইফুল্লাহ মনোযোগ দিয়ে পাবমেডে বাংলাদেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ছিল। মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৮.৭% ছিল যেটা মহামারী পরবর্তী সময়ে বেড়ে গিয়ে ৪৬% পর্যন্ত উঠেছে। আর সরকারের স্বাস্থ্য খাতের মোট বাজেটের মোটে ০.৪৪% টাকা মানসিক স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয়। কী ভয়াবহ একটা চিত্র! কত মানুষ যে এই মানসিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। মন খারাপ করে আবার পড়া শুরু করতে যেতেই ফোন বাজে, চেয়ে দেখেন সেই মেয়েটির ফোন। আজ মেয়েটার আসার কথা। ক’দিন আগেই এক বিকেলে ওকে ফোন করেছিল, দেখা করতে চায়। সাইফুল্লাহ সানন্দেই রাজি হয়েছিল। ও যতটুকু বুঝেছে মেয়েটার সাহায্য দরকার।

সাইফুল্লাহ ফোনটা রিসিভ করে, ‘আপনি এসেছেন?’

ওপাশ থেকে কুঞ্জলের গলা পাওয়া যায়, ‘এই তো কাছাকাছি। আপনি কি ওই দোকানটায় আছেন, মানে যেখানে আমার এক্সিডেন্টটা হয়েছিল?’

সাইফুল্লাহ ওকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘আপনি আসতে আসতে আমি চলে আসব। আসুন আপনি।’

ফোন রেখে সাইফুল্লাহ দ্রুত রেডি হয়ে বের হয়। একটু হাঁটতেই সেই দোকানের কাছে পৌঁছে যায়। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। কুঞ্জল একটা সিএনজি থেকে নামতেই সাইফুল্লাহ হাত নাড়ে ওকে উদ্দেশ করে। কুঞ্জল একবার তাকিয়ে হাসে।

সাইফুল্লাহর মন ভালো হয়ে যায়। আজ মেয়েটাকে দেখে ভালো লাগছে। লালচে খয়েরী রঙের সুন্দর একটা জামা পরেছে, চুল পরিপাটি করে বাঁধা। মুখে হালকা প্রসাধনী। মন ভালো করা একটা মুখ, ভাবে সাইফুল্লাহ। মেয়েটা হয়তো নিজেকে সামলে নিয়েছে।

কুঞ্জল কাছে আসতেই সাইফুল্লাহ ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘বাহ, আপনার পা তো একদম ভালো হয়ে গেছে। দৌড়ুতে পারবেন?’

কুঞ্জল হাসে, ‘কেন আপনি বুঝি দৌড়ুবেন আমার সাথে। আমি কিন্তু দৌড়ে বরাবর ফার্স্ট হতাম স্কুলে।’

সাইফুল্লাহ কৃত্রিম অবাক হবার ভান করে, ‘তাই বুঝি? একদিন তাহলে আপনার সাথে দৌড়ে দেখতে হবে। আচ্ছা, কোথায় বসবেন তাই বলুন। এখানে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে বসতে পারি। আর আমার বাসা কাছেই, ওখানেই রোগী দেখার আলাদা চেম্বার আছে। ইচ্ছে করলে বসতে পারেন।’

কুঞ্জল একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘আপনার চেম্বারেই বসি, চলুন।’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে। তারপর ওকে পথ দেখিয়ে ওর বাসার কাছে নিয়ে যায়।

কাছাকাছি আসতেই কুঞ্জল অবাক হয়ে খেয়াল করে ঢাকা শহরের এমন ব্যস্ততম জায়গায় একটা ছোট এক তলা বাড়ি। চারপাশে সব উঁচু দালানকোঠা। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, ‘এটা আমার পৈতৃক ভিটা। কেন জানি উঁচু দালানকোঠা আমার সহ্য হয় না। আমার স্ত্রীও এই একতলা বাসাটা ভালোবাসত। তাই এটা রয়ে গেছে। একমাত্র মেয়ে ইরা গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েশন করছে। এখানে আমি একাই থাকি।’

কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আপনার স্ত্রী?’

সাইফুল্লাহ গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনি খেয়াল করেননি আমি কিন্তু বলেছি আমার স্ত্রী এই একতলা বাসাটা ভালোবাসত। মানে, ও এখন আর বেঁচে নেই। ইরার জন্মের দু’বছর বয়সেই মারা যায়। তারপর থেকে এই পৃথিবীতে আমরা দু’জন, আমি আর ইরা। বছরের কয়েকটা মাস ওর কাছে গিয়েই থাকি।’

কুঞ্জলের মন খারাপ হয়ে যায়। এই মানুষটার এত মন খারাপ করা একটা গল্প আছে ও ভাবতেও পারেনি। ও অস্ফুটে বলে, ‘সরি।’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘আপনি তো জানতেন না। মানুষকে বাইরে থেকে পরিপাটি মনে হলেও ভেতরে ভেতরে প্রতিটি মানুষ এমন দুঃখ বয়ে বেড়ায়। একেকজনের দুঃখ একেকরকম, এই যা পার্থক্য। এসব মন খারাপের কথা থাকুক, আপনি চা খাবেন তো?’

কুঞ্জল হ্যাঁ-সূচল মাথা নাড়ে, তারপর ও ব্যাগ থেকে একটা কাগজের ব্যাগ বের করে বলে, ‘দেখুন তো এই ফতুয়াটা আপনার লাগে কি-না?’

সাইফুল্লাহ খুশি খুশি গলায় বলে, ‘বাহ, আমার প্রিয় আকাশি রঙের ফতুয়া এনেছেন। উম, লাগবে এটা। আপনি দেখি এক দেখাতেই আমার ফতুয়ার সাইজ বুঝে ফেলেছেন।’

কুঞ্জল হাসে, তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনিও তো একবার দেখেই আমার মনের গোপন খবর জেনে ফেলেছেন।’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘আসলে যার যা কাজ। আমি তো মনের খবর নিয়েই কাজ করি। আচ্ছা, বসুন আমি চা নাস্তার কথা বলে আসি।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে। সাইফুল্লাহ বেরিয়ে যেতেই ও পুরো রুমটা ঘুরে দেখে। একটা পাশ জুড়ে বই রাখার তাক। বেশিরভাগই ইংরেজি বই। একটা পাশে দুটো গদি ওয়ালা চেয়ার, দেখেই বোঝা যায় চেয়ার দুটো আরামদায়ক, আর দামীও। এককোণে একটা টেবিলে তাজা ফুল রাখা। ঘরের মাঝমাঝি দেয়াল জুড়ে বড়ো জানালা, তার ফাঁক গলে সকালের রোদ্দুর আসছে। কুঞ্জলের মন ভালো হয়ে যায়। ও আরাম করে একটা চেয়ারে বসে।

সাইফুল্লাহ এসে একবার তাকায়, মেয়েটা আজ খুব বেশি স্বাভাবিক আচরণ করছে, জড়তা নেই। কিন্তু কেন?

সাইফুল্লাহ বসতে বসতে বলে, ‘আমার এই রুমটা পছন্দ হয়েছে? আমি সাজিয়ে রাখি প্রতিদিন।’

কুঞ্জল বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ, খুব সুন্দর, সাজানো গোছানো। আচ্ছা, আপনি তো মনের ডাক্তার। আমার এলোমেলো হয়ে থাকা মনটা কি এমন পরিপাটি করে সাজিয়ে দিতে পারবেন?’

সাইফুল্লাহ চেয়ে থাকে, তারপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘মানুষের মন আসলে কেউই ঠিক করে দিতে পারে না। আমি আপনাকে বরং আপনার মনকে চিনতে সাহায্য করতে পারি। আপনার মনের নাজুক দিকগুলোর পাশাপাশি শক্তিশালী দিকগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। যাতে করে আপনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করতে পারেন।’

কুঞ্জল গালে হাত দিয়ে সামনে ঝুঁকে বসে বলে, ‘সেটা কেমন?’

সাইফুল্লাহ একটু ভেবে বলে, ‘এই যে আপনি জোরে দৌড়াতে পারেন এটা কিন্তু ভুলেই গিয়েছিলেন। আজ আমার সাথে কথা বলতে গিয়েই আপনার এই কথাটা মনে হলো।’

কুঞ্জল আগ্রহের গলায় বলে, ‘একদম ঠিক বলেছেন। আমি যে আগে এত ভালো দৌড়ুতাম সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা আর কি কি?’

সাইফুল্লাহ হাসে, মেয়েটা মজা পেয়েছে ওর কথায়। ও চোখ কুঁচকে বলে, ‘কুঞ্জল, আমি কোনো জাদু জানি না যে আপনার মনের খবরগুলো বলতে পারব। আপনি আপনার কথাগুলো আমাকে বলতে পারেন। অবশ্য যতটুকু আপনি বলতে চান। জোর করে কিছু বলতে হবে না।’

কুঞ্জল মাথা নিচু করে বসে থাকে তারপর ধীরে ধীরে প্রথম থেকে সব খুলে বলে। তাতে মাঝে মাঝেই কুঞ্জলের গলার স্বরে উঠানামাটা টের পায় সাইফুল্লাহ।

একটা সময় কথা ফুরোয়। কুঞ্জল মাথা নিচু করে বসে থাকে।

সাইফুল্লাহ উঠে গিয়ে একটা গ্লাসে পানি ভরে ওর দিকে এগিয়ে দেয়, ‘নিন, আপনার পিপাসা পেয়েছে।’

কুঞ্জল হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নেয়। তারপর ঢকঢক করে পানি খায়, সত্যিই গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।

গ্লাসটা রাখতেই সাইফুল্লাহ বলে, ‘খুব সাধারণ সমস্যা আপনার।’

কুঞ্জল চমকে মুখ তুলে তাকায়, মন খারাপ গলায় বলে, ‘সাধারণ সমস্যা! আমার সংসার ভেঙে যাচ্ছে আর আপনি বলছেন সাধারণ সমস্যা?’

সাইফুল্লাহ আশ্বাস্ত করে বলে, ‘বুঝিয়ে বলছি আপনাকে। সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকেই এমন হয়ে আসছে৷ মানুষ আসলে পলিগ্যামাস। তাই সুযোগ পেলেই এমন করে। হ্যাঁ, এটা যে করে সে অপরাধী। যে করে সে নিজেও জানে এটা অপরাধ। কিন্তু এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এজন্য যুগ যুগ ধরে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানান কিছুর আশ্রয় নিয়েছে। তার মধ্যে ধর্ম একটা। এছাড়া শিক্ষা, বিবেক, সামাজিকতার মতো উপাদানও আছে।’

কুঞ্জল রাগী গলায় বলে, ‘তার মানে আপনি বলছেন অভীককে কিছু বলার নেই?’

সাইফুল্লাহ মাথা নেড়ে বলে, ‘আমি তো বলার কিছু দেখি না। অভীক এই পথ থেকে নিজেকে কিছুতেই ফেরাতে পারছে না। তার শিক্ষা, ধর্ম, পরিবারের প্রতি মায়া – এগুলোর কোনো উপাদানই ঠিকঠাক কাজ করছে না। নিজের মোহের কাছে এগুলো সব পরাস্ত। তবে একটা আশার কথা হলো মানুষ একটা সময় ঠিক ফিরে আসে। মানুষ জন্মগতভাবে ভালো হয়ে থাকতে চায়। সে আশেপাশের মানুষের কাছে ‘ভালো মানুষ’ কথাটা শুনতে চায়। তখন তার শিক্ষা অথবা ধর্ম অথবা বিবেক – যেকোনো একটা উপাদান শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় অভীক এবার ফিরবে।’

কুঞ্জল অনেকক্ষণ ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘ও ফিরুক বা নাই ফিরুক আমি আর ওর কথা ভাবতে চাই না। আপনি কি আমাকে একটা পথ বাতলে দিতে পারেন যাতে আমি এই ক্ষতগুলো ভুলে থাকতে পারি।’

সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘এটা খুব সহজ। নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলতে পারেন। এমন কোনো একটা কাজ যেটা আপনি করতে ভালোবাসেন। আমি যেমন মন খারাপ হলে ছবি আঁকতে বসি। তাতে মন কেন্দ্রীভূত হয়।’

কুঞ্জল চিন্তিত মুখে বলে, ‘কিন্তু আমি তো এমন কিছু পারি না। শুধু নানা ধরনের রান্না করতে পারি।’

সাইফুল্লাহ সামনে ঝুঁকে এসে বলে, ‘তাই করুন তাহলে। আজকাল তো দেখি অনেকে রান্নার ব্লগ করে, পেজ বানায়। তাতে অনেক অনেক মানুষ ভালো ভালো মন্তব্যও করে। এতে মন ভালো থাকবে।’

কুঞ্জলের হঠাৎ করেই পৃথুলের কথা মনে পড়ে যায়। ও একদিন এমনটা বলেছিল বটে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলে, ‘আর কিছু?’

সাইফুল্লাহ দুই হাত ছড়িয়ে বলে, ‘পুরনো স্কুল বন্ধুদের খুঁজে বার করুন। নিজের জন্য সময় বার করে ঘুরতে চলে যান বন্ধুদের সাথে। অথবা মানুষের উপকার হয় এমন কিছু করতে পারেন। দেখবেন জীবনে বেঁচে থাকার কত কত উপাদান পড়ে আছে। শুধু কুড়িয়ে নিতে জানতে হয়। আর নিজের কষ্টের কথাগুলো শেয়ার করবেন, অবশ্যই ভালো মানুষের সাথে। যে আপনার কথাগুলো মন দিয়ে শুনবে।’

কুঞ্জলের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তারপর আকুল গলায় বলে, ‘আমার এই কথাগুলো আর কাউকেই বলিনি। আপনাকেই আজ বললাম। আপনার সাথে আমার কথাগুলো শেয়ার করলে আপনি শুনবেন তো?’

সাইফুল্লাহর মুখে মৃদু হাসি ফোটে, ‘হ্যাঁ, আমি আপনার সব কথা শুনব। আপনার যখনই মন খারাপ লাগবে আমাকে বলবেন, নিশ্চিন্ত মনে। আমি আপনাকে আপনার মনের ঠিক পথটা বাতলে দিতে সাহায্য করব।’

কুঞ্জলের কেন যেন আজ নিজেকে ভারমুক্ত মনে হয়। একজন মানুষকে অন্তত ওর কষ্টের কথা বলতে পেরেছে। আর মানুষটা ওর কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে শুনেছে। হয়তো বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টাটা ও এবার করে দেখতে পারবে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে