#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৫)
১.
মেঘা সকালের চা শেষ করে আজকের কাজগুলো পয়েন্ট করে লিখে ফেলে। কোনো কোনো পয়েন্টে লাল কালি দিয়ে দাগ দেয় যেগুলো করতেই হবে। তার মধ্যে অভীককে ফোন করা একটা। সকালেই ওর মেসেজ এসেছিল আজ সিলেট যাচ্ছে। আজ যেকোনো সময় ওকে নিশ্চিন্তে মেসেজ বা কল দেওয়া যাবে। একটু যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে ও। এই ক’টা মাসের প্রিয় অভ্যাস হুট করে চাইলেও ছেড়ে দেওয়া যায় না। হৃদয়ের দাবিতে এত সহজে যে ছাড় দেওয়া যায় না।
ভাবনার এ পর্যায়ে পিয়ন ছেলেটা জানায় ফাহমিদা নামে একজন ক্লায়েন্ট ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। নামটা অপরিচিত, এর সাথে ইন্স্যুরেন্সের ব্যাপারে কখনও কথা হয়েছিল কি?ঠিক মনে করতে পারে না মেঘা।
ও মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা পাঠিয়ে দাও।’
কুঞ্জল কাচের দরজা খুলে ঢুকতেই মেঘা মুখ তুলে তাকায়, মুখটা অচেনা। কেমন এলোমেলো লাগছে মেয়েটাকে।
ও গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনি ফাহমিদা?’
কুঞ্জল অপলক চেয়ে থাকে, এই মেয়েটাই মেঘা? অভীক একেই ভালোবাসে? গায়ের রঙ দুধে আলতা, ধারালো মুখচোখ। পরিপাটি করে শাড়ি পরেছে, হাতে চারকোণ ডায়ালের কালো ফিতের ঘড়ি। বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটা লুকায় ও। তারপর চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি ফাহমিদা।’
ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলে। পিয়নটা যখন নাম জিজ্ঞেস করেছিল তখনই এই নামটা বলেছে। কুঞ্জল নামটা হয়তো ওর জানা থাকতে পারে। আর অভীক এর মধ্যে নিশ্চয়ই ওর ব্যাপারে সব বলেছে।
মেঘা তাড়া দিয়ে বলে, ‘বলুন, আপনাকে কেমন করে সাহায্য করতে পারি? ইন্স্যুরেন্স করবেন?’
কুঞ্জলা একটা বিষণ্ণ হাসি হাসে, তারপর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, সংসার-ইন্স্যুরেন্স করব।’
মেঘা ভ্রু কুঁচকে তাকায়, অবাক গলায় বলে, ‘কী বললেন? সংসার-ইন্স্যুরেন্স? এমন অদ্ভুত ইন্স্যুরেন্সের নাম তো শুনিনি কখনও।’
কুঞ্জল একটু বাঁকা হাসি হাসে, তাতে ওর কষ্ট হয়। তারপর আনমনে বলে, ‘এই যেমন থাকে না, আপনাদের গাড়ির ইন্স্যুরেন্স। কোনো দূর্ঘটনায় ক্ষতি হলে আপনারা মেরামতি করে দেন নয়তো বা নতুন গাড়ি কিনে দেন। তেমন আর কি। কারও সংসার-ইন্স্যুরেন্স থাকলে তার ভেঙে যাওয়া সংসার জুড়ে দেওয়া হবে অথবা নতুন ঝকমকে সংসার গড়ে দেওয়া হবে যেখানে শুধুই মায়া থাকবে। যেমন থাকা উচিত আর কি। আছে আপনাদের এমন সংসার-ইন্স্যুরেন্স?’
মেঘা মনে মনে সতর্ক হয়। কোথাও একটা কিছু ঠিকঠাক নেই। কে এই মেয়ে? ও মুখচোখ শক্ত করে বলে, ‘না, আমাদের এমন কিছু নেই। আপনি আসুন।’
কুঞ্জল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ করেই বলে, ‘আচ্ছা আপনি কি বিবাহিত?’
মেঘা এবার ধৈর্য হারায়, ‘আপনি কি চান আসলে বলুন তো? আমি বিবাহিত কি-না তা দিয়ে আপনার কী দরকার?’
কুঞ্জল একটু সামনে ঝুঁকে আসে, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘না মানে আমি বুঝতে চেয়েছিলাম আপনি যদি বিবাহিত হন তাহলে কী করে অন্য একটা মানুষের সংসার ভেঙে দেবার আয়োজন করতে পারেন। অবশ্য আপনিই প্রথম না, এর আগেও আরেকজন আমার সংসার ভাঙার পাঁয়তারা করছিল। তাই ভাবছিলাম আপনাদের যদি একটা সংসার-ইন্স্যুরেন্স থাকত তাহলে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে করতাম। প্লিজ আপা, দেখেন না, এমন একটা ইন্স্যুরেন্স আমাকে খুলে দেওয়া যায় কি-না?’
মেঘার তলপেট কেমন খালি হয়ে যেতে থাকে। আড়াচোখে একবার তাকায় কাচের দরজাটা বন্ধ আছে কি-না। অফিসে লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। যে কেউ যেকোনো মুহুর্তে রুমে ঢুকে পড়তে পারে। সামনে বসা এই মেয়েটা অভীকের স্ত্রী কুঞ্জল, এ ব্যাপারে ওর কোনো সন্দেহ নেই। এই ভয়টাই এতদিন ও পেয়ে আসছিল। ইশ, অফিসে জানাজানি হয়ে গেলে ওর যে মান-সম্মান আর কিছুই থাকবে না। অভীক সামলাতে পারল না ব্যাপারটা?
মেঘা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘আপনি কুঞ্জল?’
কুঞ্জলা মাথা নাড়ে। কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাতে করে মেঘার অস্বস্তি বাড়ে। না, একে রাগানো যাবে না। তার চেয়ে অপরাধ স্বীকার করে ফেলা ভালো।
মেঘা মাথা নিচু করে বলে, ‘আমার ভুল হয়েছে। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেবেন প্লিজ।’
কুঞ্জল হাসে, ‘জানেন তো সবাই আমার কাছেই ক্ষমা চায়। কিন্তু একই ভুল বার বার করলে ক্ষমা করি কী করে?’
মেঘা নিজের পক্ষে সাফাই দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘কিন্তু এটা আমার প্রথম ভুল। এর আগে কখনও এমন হয়নি।’
মেঘা বুঝদার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে কেমন অদ্ভুত গলায় বলে, ‘সেক্ষেত্রে আপনাকে ক্ষমা করে দেয়াই যেতে পারে। কিন্তু অভীককে নিয়ে কী করি, বলুন তো? আপনার আগে পূর্ণ নামে আরেকটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। সেটা নিশ্চয়ই জানতেন?’
মেঘার চোখে মুখে কষ্ট পাবার ছাপ স্পষ্ট ফুটে ওঠে। অভীক সবসময় বলত ও ওর প্রথম প্রেম। এর আগে কাউকে ভালোবাসেনি। এত বড়ো মিথ্যেটা ও বলল?
কুঞ্জল কৃত্রিম দুঃখ পাবার গলায় বলে, ‘দেখেছেন, আপনিও সহ্য করতে পারছেন না অভীকের অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কটা। তাহলে আমি কী করে করি বলুন তো? আমার তো সংসার। না হলে কবে ছেড়েছুড়ে আপনার মতো দিব্যে প্রেম করে সময় পার করতাম।’
শেষ দিকে এসে কুঞ্জলের গলার স্বর উঁচু হয়। মেঘা ভয়ে ভয়ে একবার বাইরে তাকায়। নাহ, এখনও সব স্বাভাবিক আছে।
ও নরম গলায় বলে, ‘এমন ভুল আর হবে না। প্লিজ আপনি শান্ত হন। অভীকের সব নম্বর আমি ব্লক করে দিয়েছি।’
কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই মেঘার ফোন বেজে ওঠে। ওরা দু’জনেই স্ক্রিনের দিকে তাকায়। অভীকের নামটা জ্বলজ্বল করে স্ক্রিনে ভেসে উঠছে। এটা যেন নাম না, মেঘার মৃত্যু পরোয়ানা।
কুঞ্জল এবার হিসহিসিয়ে বলে উঠে, ‘অসভ্য, মিথ্যেবাদী মহিলা। অন্যের সংসার ভাঙতে এতটুকু লজ্জা নাই। আমি এখুনি আপনার অফিসের সবাইকে ডেকে ডেকে বলব আপনি কত বাজে একটা মহিলা।’
মেঘার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মাথাটা কেমন ঘুরছে। ও ঝট করে কুঞ্জলের হাত ধরে ফেলে, কান্না কান্না গলায় বলে, ‘প্লিজ, এখানে কিছু বলবেন না। এই চাকরিতে আমার সংসার চলে। আমার এ জীবনের মতো শিক্ষা হয়ে গেছে। আপনি কোনোদিন আমার দিক থেকে কোনো ঝামেলা পাবেন না। এই যে আমি অভীকের নম্বর মুছে দিচ্ছি। আর ও যদি এরপরেও যোগাযোগ করে আমি আপনাকে জানাব। আমাকে ক্ষমা করে দিন, প্লিজ, প্লিজ।’
কুঞ্জল করুণার চোখে চেয়ে থাকে। মানুষের যখন আসল জায়গায় টান পড়ে তখন মানুষ ঠিক হয়। এর আগে বুঝি হয় না। ভীষণ কষ্ট লাগছে, অভীক এখনও ঠিক হলো না। এখনও এই মেয়েটার সাথে যোগাযোগ রাখছে। নাহ, বাইরের মানুষকে দোষ দিয়ে ও কী করবে, ওর ঘরের মানুষই যে ঠিক নেই। ভীষণ একটা ধিক্কার আসে নিজের উপর। ওর কোনো মূল্যই নেই অভীকের কাছে। ইচ্ছে করছে আজই মরে যেতে। শুধু অর্ক বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে ও উঠে দাঁড়ায়, তারপর ক্লান্ত গলায় বলে, ‘সংসার-ইন্স্যুরেন্সের কথাটা মাথায় রেখেন। দেখবেন অনেক কাটতি থাকবে এই ইন্স্যুরেন্সের।’
কুঞ্জল চলে যায়। মেঘা স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে। বুকের ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একটা মানুষের জীবন, তার সংসার কী ভীষণ করে এলোমেলো করে দিয়েছে ও। স্বার্থপরের মতো নিজের একটু সুখের জন্য ওই মেয়েটার সব সুখ ও কেড়ে নিল কী করে? একটা অনুতাপ ঘিরে ধরে মেঘাকে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
২.
সাইফুল্লাহ একটা চায়ের দোকানে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। আকাশী রঙের একটা ফতুয়া আর সাদা পাজামা পরা, কোথাও একটু ভাঁজ নেই, একদম পরিপাটি। মাথার কাঁচাপাকা চুলগুলো ঝাউ গাছের মতো ঘন কোঁকড়ানো। চোখে গোল ফ্রেমের একটা চশমা। মুখটা ছোটখাটো, নাকটা বেশ তীক্ষ্ণ। চেহারাটা হিন্দি সিনেমার নাসিরুদ্দিন শাহ এর সাথে মিলে যায়। অনেকে ফিরে তাকায়। সেদিকে অবশ্য ওর ভ্রুক্ষেপ নেই। সাইফুল্লাহ মনোযোগ দিয়ে পথ চলতি মানুষ দেখছিল। এটা ওর একটা খেলা। কাকরাইলের এই দিকটা অফিস পাড়া। সারাদিন নানান পদের মানুষ আসে। কেউ দালাল, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবি, কেউ ভবঘুরে। সাইফুল্লাহ সবাইকে খেয়াল করে দেখে। তাদের কথা বলার ভঙ্গি, হাঁটার স্টাইল, সব।
এই যে সামনের ফুটপাত ছেড়ে রাস্তা দিয়ে এখন যে মেয়েটা বিপদজনকভাবে হনহন করে হেঁটে চলছে তাকে দেখলে মনে হয় এখুনি বুঝি পৃথিবীর সাথে সব লেনদেন চুকিয়ে দিতে চায়। নাহ, মেয়েটাকে সাবধান করা দরকার। যেকোনো সময় গাড়ি চাপা পড়বে। সেটা না হলেও নিদেনপক্ষে রিক্সার নিচে।
কথাটা ভাবতে ভাবতেই দূর্ঘটনাটা ঘটে। উল্টোপথে একটা রিক্স আচমকা সামনে চলে আসে। শেষ মুহুর্তে ব্রেকও কষে কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। হুড়মুড় করে রিক্সাটা মেয়েটার উপর পড়তেই চিৎকার চেচামেচি শোনা যায়। সাইফুল্লাহ চায়ের কাপ রেখে তড়িৎ গতিতে সামনে এগিয়ে যায়। মেয়েটা ফুটপাত ঘেঁষে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। ব্যথায় নীল হয়ে গেছে মুখটা, চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। একটা হাত দিয়ে ডান পায়ের নিচের দিকে চেপে ধরে বসে আছে।
সাইফুল্লাহ সংকোচ ঝেড়ে মেয়েটাকে টেনে তোলে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে কুঞ্জল। পায়ে জোর ব্যথা পেয়েছে। ভেঙেছে কি-না কে জানে। মেঘার অফিস থেকে বেরিয়ে ওর কেন যেন মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটছিল। কোথা থেকে এই রিক্সাটা চলে এল?
সাইফুল্লাহ জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘আপনি হাঁটতে পারবেন? মনে হচ্ছে পায়ে জোর ব্যথা পেয়েছেন। দেখুন তো পা ফেলতে পারেন কি-না?’
কুঞ্জল নিচের ঠোঁট চেপে ব্যথাটা সামলায়। তারপর লোকটার দিকে তাকায়। বয়স্ক একজন মানুষ, কাঁচাপাকা চুল। দেখে তো ভদ্রলোক মনে হচ্ছে। ও এবার সাবধানে পা ফেলতেই পুরো শরীরে ব্যথাটা বিদ্যুতের মতো একটা শক দেয় যেন। কুঞ্জল লোকটার ধরে থাকা হাত শক্ত করে চেপে ধরে ‘উউউহ’ করে ওঠে।
সাইফুল্লাহ চিন্তিত গলায় বলে, ‘এহ হে, মনে তো হচ্ছে পা মচকে গেছে অথবা হাড় ভেঙে গেছে।’
কুঞ্জল দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আমাকে একটা সিএনজি ঠিক করে দিন প্লিজ। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।’
সাইফুল্লাহ হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘আপনাকে এখন হাসপাতাল যেতে হবে। আপনি মনে হয় খেয়াল করেননি যে আপনার নিচের দিকে জামা রক্তে ভিজে গেছে। হাতের এদিকটাও কেটে গেছে। কাছেই একটা ক্লিনিক আছে, চলুন আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
এরপর লোকটা ওকে আর কথা বলার সুযোগ দেয় না। ভীড় জমে যাওয়া লোকদের মাঝে একজন একটা সিএনজি ঠিক করে দেয়। লোকটার কাঁধ ধরে ও কোনোমতে সিএনজিতে উঠে বসে।
ঘন্টা দুই পর হাসপাতাল থেকে যখন ও ছাড়া পায় ততক্ষণে ডান পায়ে ভারী প্লাস্টার। আর হাতে, পায়ে যেখানে ছড়ে গেছে সেখানেও ব্যান্ড এইড দেওয়া। পায়ের উপরের দিকে একটা ব্যান্ডেজ পড়েছে। সব দেখেশুনে ডাক্তার সাহেব বলেছেন, হাড় ভাঙেনি, মচকে গেছে শুধু।
সাইফুল্লাহ হেসে বলে, ‘বেঁচে গেলেন। না হলে মাস তিনেক পা তুলে বসে থাকতে হতো। আর রাস্তায় অমন আনমনে হয়ে হাঁটবেন না।’
কুঞ্জল এবার খুব লজ্জা পায়। সেই তখন থেকে বয়স্ক মানুষটা ছুটোছুটি করে সব ব্যবস্থা করছে। ওকে চেনে না জানে না তাও কত কী করল। হঠাৎ করে একটা কথা মনে হতেই ও জিভ কাটে। আচ্ছা, এইসব টেস্ট, প্লাস্টার করতে তো অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবার কথা। ও দ্বিধান্বিত গলায় বলে, ‘কিছু মনে না করলে যদি বলতেন আপনার কত টাকা খরচ হলো?’
সাইফুল্লাহ ভ্রু কুঁচকে হিসেব করে, ‘তা ধরুন গিয়ে হাজার পাঁচেকের মতো। আমি কার্ড দিয়ে দিয়েছি।’
কুঞ্জল এবার অতলান্তে পড়ে। এত টাকা যে এই মুহুর্তে ওর কাছে নেই। অভীক কয়েকবার ক্রেডিট কার্ড নেবার কথা বলেছিল, কিন্তু নেওয়া হয়নি। নাহ, এখন কী করে?
ও এবার সংকোচের গলায় বলে, ‘যদি কিছু মনে না করেন আপনার মোবাইল নম্বর যেটাতে বিকাশ আছে সেটা দিলে আমি দিয়ে দিতাম।’
সাইফুল্লাহ পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বলে, ‘এখানে আমার নাম ধাম ঠিকানা লেখা আছে। আর নিচে যে মোবাইল নম্বরটা ওটাতেই টাকা পাঠাতে পারেন। আপনি একা ফিরতে পারবেন তো?’
কুঞ্জল হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিয়ে ব্যাগে রাখে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, ‘একটা সিএনজি ঠিক করে দিলে পারব।’
সাইফুল্লাহ ওর বাসার ঠিকানাটা জেনে একটা সিএনজি ঠিক করে দেয়। কুঞ্জল ওর হাত ধরে সিএনজিতে কষ্ট করে উঠে, তারপর কৃতজ্ঞ গলায় বলে, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার জন্য অনেক কষ্ট করলেন।’
সাইফুল্লাহ মৃদু হাসে, তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনার পা সেরে গেলে একবার জানাবেন। আর মনের যত্ন নেবেন, আপনি কিন্তু মনের দিক থেকে ভালো নেই।। ভালো নেই মানে খুব খারাপ আছেন। অবহেলা করবেন না।’
কুঞ্জল চমকে ওঠে। এই লোক জানল কী করে ওর মন ভালো নেই? নাকি এই বুড়োটাও অন্য সব পুরুষ মানুষের মতো ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছে?
ওর চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়, ‘আমার মন ভালো আছে, সেটা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আজ বিকেলেই আপনার পাওনা টাকা পেয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।’
সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘না, আপনার মন ভালো নেই। আপনি মিথ্যে বলছেন। আপনি যখন ফুটপাত দিয়ে না হেঁটে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন আমি খেয়াল করে দেখছিলাম আপনার দু’ পায়ে দু’রঙের জুতো। মন ভালো থাকলে এমন ভুল করতেন না। তারপর আপনার ব্যাগের চেইনটাও খোলা ছিল। পড়ে যাবার সময় আপনার ব্যক্তিগত কিছু জিনিস পড়ে গিয়েছিল। একটা মেয়ে এত অগোছালো হয়ে বাড়ি থেকে বের হয় না। আপনি হয়তো ভাবছেন আমি এতকিছু খেয়াল করলাম কেন? আমি আসলে একজন কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট। আমার ভিজিটিং কার্ডে লেখা আছে, আপনি খেয়াল করেননি। মানুষ দেখা আমার একটা নেশার মতো। আপনার দু’পায়ে দু’রকম জুতো দেখেই আমি কৌতুহলী হয়ে আপনাকে অনুসরণ করছিলাম।’
কুঞ্জল অবিশ্বাস নিয়ে জুতোর দিকে তাকায়। একটা পাটি খুলে রেখেছে, অন্যটা বা পায়ে পরা। ও অবাক হয়ে খেয়াল করে আসলেই তো, দু’পায়ের জুতো দুই রঙের। তাড়াহুড়ায় সকালে খেয়ালই করেনি। লজ্জা লাগছে এখন।
সাইফুল্লাহ নরম গলায় বলে, ‘বাসায় যান। ডাক্তার যেভাবে লিখেছেন সেভাবে ক’টা দিন বিশ্রাম নিন। ওষুধগুলো ঠিকঠাক খাবেন। আর মনের ভেতর যে জট পাকিয়ে আছে সেটা সারাতে চাইলে আমাকে ফোন করতে পারেন।’
কুঞ্জল নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। হঠাৎ করেই আবার কান্না পাচ্ছে। আজ মেঘাকে অফিসে দেখে মনটা একটু হলেও স্বস্তি পেয়েছিল যে ওই মেয়েটা অভীকের সাথে সিলেট যায়নি। কিন্তু মেঘার মোবাইলে যখন অভীকের ফোন এল তখন ওর পুরো পৃথিবীটা যেন ভেঙেচুরে গিয়েছিল। নিজেকে ভীষণভাবে প্রতারিত মনে হচ্ছিল। এতক্ষণ কষ্টটার কথা মনে ছিল না। কিন্তু এই লোকটা আবার মনে করিয়ে দিল। ও গম্ভীরমুখে বলে, ‘আমার কারও সাহায্য লাগবে না। ধন্যবাদ আপনাকে।’
সিএনজি ছেড়ে দেয়। সাইফুল্লাহ চিন্তিত মুখে মেয়েটার চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটার মধ্যে জীবন নিয়ে একটা চরম উদাসীনতা চলে এসেছে। যতটুকু মনে হচ্ছে হাসব্যান্ডের সাথে ঝামেলা। না হলে এতক্ষণে একবার হলেও হাসব্যান্ড বা বাসার কাউকে দূর্ঘটনার কথা ফোন করে জানাত। এই মেয়েটা দারুণ অভিমানী। বুকে বড়ো কোনো কষ্ট চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে। না হলে এত বড়ো একটা দূর্ঘটনা ঘটে যাবার পরও কাউকেই ফোন দেয়নি। যেকোনো সময় মেয়েটা আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে। সাইফুল্লাহ চিন্তিত মুখে বাসার দিকে এগোয়। মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু যে নিজেই বেঁচে থাকতে চায় না তাকে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন কাজ। কিন্তু সেই কঠিন কাজটাই এখন করতে ইচ্ছে করছে।
(চলবে)