প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০৪

0
471

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৪)

১.
মেঘা কিছুতেই বুঝে পারছে না অভীকের কী হয়েছে। আজ দু’দিন ওর কোন পাত্তাই নেই। শুধু ছোট্ট একটা মেসেজ এসেছিল, আপাতত ওকে কোনো মেসেজ না করতে। তা মেঘা আর মেসেজ দেয়ওনি। কিন্তু খুব চিন্তা হচ্ছে, ওর বাসায় কি কোনো ঝামেলা হয়েছে? ওদের সম্পর্কটা কি জেনে ফেলল? এটা ও ভাবতেও চায় না। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। মাহমুদ জানলে কী যে হবে! ভাবতেই বুক শিউরে ওঠে ওর। কিন্তু অভীক ছেলেটার জন্য যে মন কেমন করে। পরিচয়ের প্রথম থেকেই ভালো লেগে গেছিল ওকে। এমন মায়া জড়ানো একটা মানুষকে যদি পেত ও। মাহমুদের সংসারে কোনো দায়িত্ব নেই, উলটো ওর পয়সায় নেশা করে। মাঝে মাঝে মেয়ের সামনেই গায়ে হাত তুলত। সংসারটা বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতো। তাই অভীকের সাথে পরিচয়টা ওকে একটা মুক্তি দিয়েছিল। একটু হলেও জীবনের না পাওয়া মায়া, ভালোবাসা পাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কী হলো?

এই যখন ভাবছে ঠিক তখনই অভীকের ফোন আসে। মেঘার বুক চলকে ওঠে। তাড়াহুড়ো করে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ওর গলা পাওয়া যায়, ‘মেঘা, জরুরি কথা আছে। আজ বিকেলে একটু সেই কফিশপে আসতে পারবে?’

মেঘা আকুল গলায় বলে, ‘আসব। কিন্তু তোমার কী হয়েছে, যোগাযোগই করছ না একদম। অভীক, কোনো সমস্যা?’

অভীক বিমর্ষ গলায় বলে, ‘বিকেলে আসো, সব খুলে বলছি।’

ফোন রেখে দিয়ে অভীক চিন্তিত মুখে সামনে তাকিয়ে থাকে। দু’দিন পর আজ অফিসে এল। সেদিন রাতে কুঞ্জল যখন অমন করে দরজা বন্ধ করে দিল তখন ভয়ে ওর হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। বার বার মনে হচ্ছিল দরজা খুললেই কুঞ্জলের দেহটা ফ্যান থেকে ঝুলতে দেখবে। তীব্র আতংক ওকে গ্রাস করেছিল। আর ছোট্ট অর্ক কেমন ভয় পেয়ে কান্না করছিল! এটুকু ভাবতেই অভীকের বুক দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। না, কুঞ্জল তার একটু পরে নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিল। হয়তো ছেলের কান্নাতেই কাজ হয়েছিল। তা যেটাতেই কাজ হোক তাতে অভীকের মাথাব্যথা নেই। কুঞ্জল যে ঠিকঠাক ছিল সেটাই তখন বড়ো মনে হয়েছে। সেদিন ওর হাত ধরে ক্ষমা চেয়েছে, এমন আর করবে না। কী যে হয় ওর। পূর্ণের পর ভেবেছিল অন্য কোনো মেয়ের সাথে আর জড়াবে না। কিন্তু কেমন করে যেন ঠিক জড়িয়ে যায়। নাহ, মেঘাকে আজ সব খুলে বলতে হবে। এই সম্পর্কটা আর রাখা যাবে না। কুঞ্জল একদম পাগল হয়ে গেছে। কেমন পাগলাটে চোখে তাকিয়ে থাকে। কখন যে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। কথাটা ভাবতেই ওর বুক কেঁপে ওঠে। দ্রুত ছেলের মোবাইলে ফোন দেয়।

ফোন বাজছে। ধরছে না কেন অর্ক? অভীক বুকের ভেতর একটা ধুকপুক টের পায়। একদম শেষ মুহুর্তে ওর গলা পাওয়া যায়, ‘বাবা।’

অভীক আদরের গলায় বলে, ‘নাস্তা করেছ অর্ক?’

অর্ক মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা। তুমি?’

অভীক মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা করেছি। তোমার আম্মু খেয়েছে? তোমার আম্মু কী করে?’

অর্ক একটু চুপ থাকে, তারপর উত্তর দেয়, ‘আম্মু খেয়েছে। আর এখন আমার নতুন বইয়ের মলাট লাগিয়ে দিচ্ছে।’

অভীক একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তারপর বলে, ‘আচ্ছা বাবা, আম্মুকে হেল্প করো তুমি। আর আম্মুর দিকে খেয়াল রেখো। আম্মুর শরীর খারাপ লাগলে আমাকে ফোন দিও।’

ফোন রেখে এবার ও চায়ে চুমুক দেয়। পিয়ন ছেলেটা একটু আগেই চা দিয়ে গেছে। কুঞ্জল বইয়ের মলাট লাগাচ্ছে, তার মানে ও এখন স্বাভাবিক। ছেলের মুখ চেয়ে নিশ্চয়ই ও খারাপ কিছু করবে না? এই ভাবনাটুকু স্বস্তি দেয় ওকে। কিন্তু পরক্ষণেই একটা দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে, কুঞ্জল এখন স্বাভাবিক আছে। কিন্তু আবার যদি মন বিগড়ে যায়? অর্ক স্কুলে চলে যাবার পর বড়ো একটা সময় কুঞ্জল বাসায় একাই থাকে। তখন কোনো অঘটন ঘটে গেলে? ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে ওর। এখন থেকে এই ভয়টা ওকে তাড়া করে বেড়াবে।

বিকেল চারটা। গুলশানের রেট্রো কফিশপে ভীড়টা এখন কম। মেঘা আজ আগেই এসে পৌঁছেছে। মনের ভেতর একটা অস্বস্তি হচ্ছে যেটা অভীকের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত কিছুতেই দূর হবে না। কোণের একটা টেবিলে বসতেই ও দরজা ঠেলে অভীককে ঢুকতে দেখে। অভীক পুরো ক্যাফেতে একবার চোখ বুলিয়ে ওর উপর এসে চোখ স্থির হয়। একটু হাসে, হাত নাড়ে। মেঘাও হেসে হাত নাড়ে।

কাছে এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে ও বলে, ‘অনেক আগেই এসে পৌঁছেছ?’

মেঘা না-সূচক মাথা নাড়ে, ‘এই এসে বসলাম মাত্র। তুমি ঠিক আছ তো?’

অভীক নিচের ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ে। ওর চোখের দিকে তাকায়। মেঘা আজ অরেঞ্জ কালারের একটা জামা পরেছে। এমনিতেই ওর গায়ের রঙটা দুধে আলতা৷ তার উপর এই জামাতে আরও ঝলমলে লাগছে। এত ভালো লাগে মুখটা। মন খারাপ করা সুন্দর, এই মেয়েটা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভীক। মেঘার সান্নিধ্য ওর ভালো লাগত। অথচ আজ সেই ভালো লাগাটুকুর মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।

কয়েকটা মোমো আর কফির অর্ডার দিয়ে অভীক মেঘার হাতটা চেপে ধরে, তারপর আবেগের গলায় বলে, ‘মেঘা, বিরাট ঝামেলা হয়ে গেছে। তোমার ব্যাপারে কুঞ্জল সব জেনে ফেলেছে।’

মেঘা আতংকিত চোখে ওর দিকে তাকায়। মনে মনে এটাই আশংকা করছিল ও। চিন্তিত মুখে বলে, ‘কিন্তু কী করে হলো? তুমি বাসায় যাবার পর তো আমি মেসেজ করিনি কোনোদিন।’

অভীক ওর হাত ছেড়ে হতাশ গলায় বলে, ‘সেসব কিছু না। এটাকে বলে দূর্ভাগ্য।’

তারপর ওকে সব খুলে বলতেই ওর মুখ রক্তশূণ্য হয়ে যায়। কাঁপা গলায় বলে, ‘তার মানে তোমার বউয়ের কাছে আমার অফিসের ঠিকানা, আমার ফোন নম্বর সব আছে। সর্বনাশ হয়ে গেল। এখন যদি আমার অফিসে এসে কোনো সিনক্রিয়েট করে?’

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে ও সত্যিকার অর্থেই কেঁপে ওঠে। অভীক ওর হাত ধরে, একটু চাপ দিয়ে বলে, ‘এটা করবে না ও। কিন্তু আমাদের আর যোগাযোগ করা যাবে না। অন্তত ক’টা মাস চুপচাপ থাকতে হবে। সব স্বাভাবিক হয়ে গেলে এরপর আমি অনেক সাবধান থাকব।’

মেঘা চেয়ে থাকে, তারপর আকুল গলায় বলে, ‘তার মানে তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ না? সত্যিই আবার আগেরমতো ভালোবাসবে?’

অভীক বুকের ভেতর একটা মায়া টের পায়। ইচ্ছে করছে ওকে বুকের ভেতর টেনে নিতে। আর্দ্র গলায় বলে, ‘মেঘা, আমি তোমাকে সারাজীবন ভালোবেসে যাব। হয়তো আগের মতো হুটহাট করে দেখা হবে না, মেসেজও দিতে পারব না। কিন্তু জেনে রেখো, আমি তোমার পাশে আছি।’

মেঘা মাথা নাড়ে, ‘আমি অপেক্ষা করব অভীক। তুমি ভেব না, আমি আর নিজে থেকে মেসেজ দেব না।’

ওর ফর্সা মুখটা কেমন লালচে এখন। চোখ জলে ভেজা। ইচ্ছে করছে ওর মুখটা বুকে চেপে ধরতে। অভীক ঠিক বুঝতে পারে না এই মায়ার উৎস কোথায়? কুঞ্জল যখন মরে যেতে নিল তখন মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময়ে হলেও ওকে চায়। আবার এখন মেঘাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। নাহ, এরপর আর কখনও কারও মায়ায় জড়াবে না। একবার জড়িয়ে গেলে বের হয়ে আসা কষ্টের।

অভীক বিদায় নেয়। মেঘা ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলায়। তারপর ও নিজেও বেরিয়ে আসে। বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে। মেঘা ক্লান্ত পায়ে বাড়ির পথ ধরে যেখানে একটা বিষাক্ত পরিবেশ ওর জন্য অপেক্ষা করছে। মেয়ের মুখ চেয়েই মাহমুদের সব অত্যাচার সহ্য করে যায় ও। মাহমুদ যদি ওকে অভীকের মতো করে একটু ভালোবাসত, মায়া করত, তাহলে ও বেঁচে যেত। অভীককে আঁকড়ে ধরে একটু বাঁচতে চেয়েছিল। অভীক বলেছে সব স্বাভাবিক হলে আবার ও যোগাযোগ করবে, ভালোবাসবে। কথাটা ওর ছেলেভুলানো কথা মনে হয়েছে, বিশ্বাস হয়নি। কুঞ্জলের জন্য আজ অভীক ওকে ছেড়ে যেতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করল না। ভীষণ হিংসা হয় কুঞ্জলের উপর। কী ভাগ্যবতী মেয়েটা, অভীক ওকে ভালোবাসে। ওর জন্য সব ছেড়ে দিতেও কুন্ঠাবোধ করল না অভীক। অথচ প্রায়ই বলত ওকে কখনও ছেড়ে যাবে না, ভালোবাসবে। কিন্তু ঠিক ছেড়ে গেল। আজ এই পৃথিবীতে শুধু ওকে আলাদা করে ভালোবাসার কেউ রইল না। তীব্র একটা মন খারাপ ঘিরে ধরে মেঘাকে।

২.
আজ অর্কের রেজাল্ট দেবে। সকালেই সবাই চলে এসেছে। বাইরে অভিভাবকেরা চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করছে। পৃথুল কুঞ্জলের মুখের দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কী রে, মুখটা অমন হাড়ির মতো অন্ধকার করে রেখেছিস কেন? অর্কের রেজাল্ট নিয়ে খুব ভাবছিস বুঝি?’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে, ‘উহু। এমনিতেই ভালো লাগছে না। আচ্ছা, ওদের আর কতক্ষণ লাগবে, বল তো? এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।’

পৃথুল ওর হাত ধরে টান দেয়, ‘রেজাল্ট দিতে দেরি হবে। চল ওদিকে যেয়ে বসি। তোকে একটা জিনিস দেখাব।’

ওরা হেঁটে মাঠের কোণে শান বাঁধানো বড়ো একটা ছাতিম গাছের নিচে গিয়ে বসে। এই জায়গাটা ওদের খুব প্রিয়। এখানে পা ঝুলিয়ে বসলে সেই কলেজে পড়ার সময়টুকু যেন ফিরে আসে। নিশ্চিন্ত, উচ্ছ্বল একটা সময়। কিন্তু সেই সময়টা আসলে ফিরে আসে না।

কুঞ্জল পা ঝুলিয়ে বসে। একটা সুন্দ ঘ্রাণ পায়। নাক টেনে নিশ্বাস নেয়। ছাতিম ফুল ফুটল বুঝি। আচ্ছা, জীবন এত জটিল কেন? ও তো কাউকে কষ্ট দেয়নি কখনও। কেন ও কষ্ট পায়?

পৃথুল মোবাইল বের করে কিছু একটা খোলে। তারপর ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে একটা দুষ্ট হাসি হেসে বলে, ‘দেখ তো এটা কেমন হয়েছে?’

কুঞ্জল চেয়ে দেখতেই চোখ বড়ো হয়ে যায়। গোলাপি রঙের একটা ইনার স্লিপ যেটা থাই পর্যন্ত নেমেছে সেটা পরে মোহময় একটা পোজ দিয়েছে পৃথুল। ও চাপা চিৎকার করে ওঠে, ‘এ কী! এটা তুই কী পরেছিস!’

পৃথুল হেসে গড়িয়ে পড়ে, ‘এহ হে, তুই দেখি লজ্জা পেয়ে চোখমুখ লাল করে ফেলেছিস। ইমন খুঁজে খুঁজে এইসব কিনে নিয়ে আসে। আমার ওয়ারড্রোবের একটা ড্রয়ার পুরোটা জুড়ে এইসব।রাত হলেই পাগলামি বাড়ে। এগুলো পরতে বলে। আর কী কী পাগলামি যে করে।’

কুঞ্জলের কান গরম হয়ে যায়। সেইসাথে তীব্র একটা মন খারাপ ওকে ঘিরে ধরে। একটা হাহাকার টের পায় মনের ভেতর। ওর সাথে অভীকের সম্পর্কটা কবে যে উষ্ণতা হারিয়েছে ঠিকঠাক মনে পড়ে না। ওকে ঘিরে অভীকের পাগলামো নেই, কোনো উচ্ছ্বাস নেই, আবদার নেই।

হঠাৎ করেই মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। শুকনো মুখে বলে, ‘চল, ওদের রেজাল্ট মনে হয়ে গেছে।’

কথাটা বলে ও শান বাঁধানো জায়গাটা থেকে নেমে পড়ে। পৃথুল অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জলের নিশ্চিত অন্য কোনো সমস্যা হয়েছে। কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে ও। ভেবেছিল ওর এই দুষ্ট ছবিটা দেখে হেসে ফেলবে, মজা করবে। কিন্তু কেমন চুপ হয়ে গেল। তাহলে কি অভীক ভাইয়ের সাথে ওর সম্পর্কটা ঠিকঠাক যাচ্ছে না?

অর্ক রেজাল্ট কার্ড হাতে দৌড়ে আসে, ‘আম্মু, আমি সেকেন্ড হয়েছি এবার। এই দ্যাখো।’

অর্কের মুখ ঝলমল করছে আনন্দে। ওর রোল বারো ছিল ক্লাশ ফোরে। কখনও প্রথম দিকে থাকতে পারেনি। এবার এত ভালো রেজাল্ট করল!

কুঞ্জলের সব মন খারাপের মেঘ বিদায় নেয়, আলোকিত হয়ে উঠে চারপাশ। ও রেজাল্ট কার্ড নিয়ে একবার চোখ বোলায়, ‘২য়’।

ছেলেকে এবার জড়িয়ে ধরে, ‘আমার সোনা বাবা। সত্যিই দেখি তুমি সেকেন্ড হয়েছ। উম্মমা।’

সশব্দে কপালে চুমু খায় ও। পেছন থেকে পৃথুল হেসে বলে, ‘এই তো মুখে হাসি ফুটেছে। এবার বুঝলাম, ছেলের জন্যই এতক্ষণ মন খারাপ করে ছিলি।’

কুঞ্জল হাসে, তারপর পৃথুলের পাশে ওর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘পৃথা মামণি তো এবার ক্লাশ থ্রিতে উঠল।’

পৃথুল হাসে, ‘হ্যাঁ, অর্কের মতো অত ভালো করেনি। শোন, অর্কের নোটগুলি দিস।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে, ‘সে দেব খন। তুই বাসায় আসিস, আড্ডা দেব।’

ওরা বিদায় নেয়।

কুঞ্জলের খুব ইচ্ছে করছে ছেলেকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসে। সারাটা বছর ওরা দু’জন এত পরিশ্রম করেছে যার ফল আজ হাতেনাতে পেল। ছেলেটা একটু ঘুরে এলে মন ভালো লাগত। কিন্তু অভীকের সাথে এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।

রাতে অভীক ফিরতেই অর্ক ওর রেজাল্ট কার্ড নিয়ে দেখাতেই ও অবাক গলায় বলে, ‘তুমি সেকেন্ড হয়েছ? ওরে আমার লক্ষ্মী বাবাটা আমার। চল, মিষ্টি কিনে নিয়ে আসি।’

অর্ক মায়ের দিকে তাকায়। কুঞ্জল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। অভীক অফিসের জামা কাপড় না ছেড়েই ছেলেকে নিয়ে বাইরে চলে যায়। কুঞ্জল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, সংসারে এই ছোট ছোট সুখ, মায়ার বাঁধন ছেড়ে মানুষ কেন অন্য কারও কাছে আলাদা করে মায়া খোঁজে?

রাতে খাওয়া শেষে কুঞ্জল ছেলেকে নিয়ে আলাদা রুমে ঘুমোতে যায়। সেদিনের পর থেকে আলাদাই ঘুমুচ্ছে ও। অর্ক অবশ্য খুব খুশি। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কত কত গল্প চলে ওর।

এমন সময় দরজায় অভীকের ছায়া দেখা যায়। কুঞ্জল অবশ্য তাকায় না। অভীক গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, ‘কাল আমি সিলেট যাচ্ছি, অফিসের কাজে। দু’দিন পর ফিরব।’

অর্ক মাথা তুলে বলে, ‘বাবা, আমাদের বেড়াতে নিয়ে যাবে না এবার?’

প্রতি বছর ওরা একবার হলেও কোথাও না কোথাও যায়। কিন্তু এবার যা পরিস্থিতি তাতে অভীকের ঠিক সাহস হয় না বেড়াবার কথা বলবার। ও নিচু গলায় বলে, ‘তোমার আম্মুকে বলো বাবা।’

অভীক আর দাঁড়ায় না। কুঞ্জল ছেলের সামনে কখন কী বলে ফেলে তার কোনো ঠিক নেই।

রাত বাড়ে। অর্ক একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে। কুঞ্জলের ঘুম আসে না। হঠাৎ করেই পৃথুলের কথা মনে পড়ে যায়। মনের অজান্তেই ফিক করে হেসে ফেলে। আচ্ছা, ও কি এখন অমন অদ্ভুত সব জামা পরে ওর বরের সাথে ঢং ঢাং করছে? ভাবতেই মন খারাপ ঘিরে ধরে। নিজেকে ভীষণ বঞ্চিত মনে হয়।

পরদিন সকালে অভীক যখন ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে যায় কুঞ্জল আড়চোখে খেয়াল করে জিন্সের প্যান্ট সাথে সাদা হাফ শার্টে ওকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছে। আচ্ছা এই শার্টটা তো আগে দেখেনি ও। এটা কি তবে ওই শয়তান মেঘা মেয়েটা দিল? ভাবতেই মাথা গরম হয়ে যায়। এই মেয়েটা ওর সাথে সিলেট যাচ্ছে না তো?

কুঞ্জলের কেমন পাগল পাগল লাগছে। ফোন করবে ওই মেয়েটাকে? কিন্তু যদি না ধরে? অভীক নিশ্চিত এর মাঝেই ওকে সব জানিয়ে দিয়েছে। ওর নম্বরটাও হয়তো ব্লক করে রেখেছে। আর যদি নাও রাখে, ফোন ধরে যদি মিথ্যা বলে?

কুঞ্জল অস্থির পায়ে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। তারপর কী মনে হতে পৃথুলকে ফোন দেয়।

ওপাশ থেকে পৃথুল অবাক গলায় বলে, ‘কী রে, এত সকালে ফোন দিয়েছিস। কোনো সমস্যা?’

কুঞ্জল গম্ভীরমুখে বলে, ‘পৃথুল, অর্ককে তোর বাসায় কিছুক্ষণ রাখতে পারবি? আমি একটু বাজারে যাব, ফিরতে দেরি হবে।’

পৃথুল মনে মনে অবাক হয়। এর আগে কখনও এমন হয়নি। কুঞ্জল তো ছেলেকে নিয়েই বাজার সদাই করে। ওর অস্বস্তিটা বুঝতে না দিয়ে বলে, ‘কোনো সমস্যা নেই। পৃথা খুশি হবে। তুই দিয়ে যা।’

কুঞ্জল দ্রুত অর্ককে নাস্তা করে রেডি করায়। তারপর ঘর তালা দিয়ে বেরোয়। অর্ককে বুঝিয়ে বলে, ‘বাবা, তোমার পৃথুল খালামণির বাসায় সুন্দর করে থেকো। আমি দুপুরের মধ্যেই চলে আসব। দুষ্টুমি কোরো না কিন্তু।’

অর্ক মাথা নাড়ে, মাকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘আমি একটুও দুষ্টুমি করব না আম্মু।’

কুঞ্জল অর্ককে দিয়ে পথে নামে। তার আগে ওই মেয়েটার অফিসের ঠিকানাটা একবার দেখে নেয়, কাকরাইল। একটা সিএনজি ঠিক করে উঠে পড়ে।

কুঞ্জলকে নিয়ে এগিয়ে চলে সিএনজিটা। কেন যেন আজকাল নিজের উপর ওর নিয়ন্ত্রণ নেই। যে কাজগুলো করলে ও আরও ছোট হয়ে যাবে সেই কাজগুলোই করতে ইচ্ছে করে। ওই মেঘা মেয়েটার কাছে যেয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, কেন ওর সংসারে হাত বাড়িয়েছে মেয়েটা? আচ্ছা, যদি যেয়ে দেখে মেয়েটা আজ অফিস আসেনি, সত্যিই সিলেট গেছে, তাহলে? কুঞ্জলের চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে, প্রয়োজনে আজ ও সিলেট যাবে, সত্যটা ওর জানতেই হবে। অভীককে ও আর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না।

কুঞ্জল যখন মেঘার অফিসের সামনে এসে পৌঁছে ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা দশটা পেরিয়ে গেছে। এদিকে অফিস পাড়ায় কর্মচঞ্চল মানুষের ভীড় বেড়েছে। কুঞ্জল একবার ঠিকানা মিলিয়ে দেখে। তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে মেঘার অফিসের দিকে এগোয়।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে