#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ৩)
১.
কুঞ্জল পিঠের নিচে দুটো বালিশ দিয়ে আধাশোয়া হয়ে বসে আছে। আজ সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। সকালের নাস্তা বানানো হয়নি আজ। অভীক না খেয়েই অফিসে চলে গেছে। না রাগ করে নয়, বরঞ্চ ওর শরীর খারাপ ভেবে ওই জোর করে সকালে উঠতে দেয়নি। তাতে একটা মায়া ছিল, কিন্তু এই মায়াটা কি সত্যি? যে মানুষ অন্যের জন্য চুপিচুপি শাড়ি কেনে সে ওর এমন অল্প শরীর খারাপ গুরুত্ব দেয় কী করে? ও বিভ্রান্ত হয়ে যায়।
কাল মাথা ঘুরে পড়ে যাবার পর অভীক ঘাবড়ে গিয়েছিল। বার বার জিজ্ঞেস করছিল কী হয়েছে? কুঞ্জল ইচ্ছে করেই কিছু বলেনি কাল রাতে। কেমন করে কিছু না জিজ্ঞেস করে ও থাকতে পারল, তাই ভেবে অবাক হচ্ছে কুঞ্জল।
অর্ক ঘুম থেকে উঠে আজ লক্ষ্মী ছেলের মতো একটা খাতা নিয়ে বসেছে। কুঞ্জল চেয়ে দেখে ও মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকছে। ছোট্ট মানুষেরাও বড়োদের মন খারাপ টের পেয়ে যায়। মা বিরক্ত হতে পারে এমন কিছুই করছে না।
খাট থেকে নেমে ও ছেলের পাশে গিয়ে বসে। মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলে, ‘কী আঁকছ বাবা?’
অর্ক মাথা তুলে, তারপর ফিক করে হেসে দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবির দিকে ইশারা করে বলে, ‘তোমার আর বাবার ছবি।’
কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে ছবিটার দিকে তাকাতেই ও অবাক হয়ে খেয়াল করে অর্ক ওর আর অভীকের বিয়ের দিনের একটা ছবি আঁকছে যেটা দেয়ালে টাঙানো। এবং ছবিটা হুবহু এঁকেছে। মুহুর্তেই ওর মন ভালো হয়ে যায়। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ইশ! কী সুন্দর এঁকেছে আমার অর্ক বাবা। এত সুন্দর আঁকা কই শিখলে তুমি?’
অর্ক মাথা নেড়ে বলে, ‘আমাদের আর্ট টিচার মানুষ আঁকা শিখিয়েছে।’
কুঞ্জল ছবিটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। একটা সময় মন খারাপ হয়ে যায়। অভীক ওকে আর আগেরমতো ভালোবাসে না। অন্য কাউকে ভালোবাসে, অন্য কারও জন্য শাড়ি কেনে। কথাটা মনে হতেই ওর হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। ঠোঁট চেপে কান্না সামলায়। হালকা করে চোখ মুছে বলে, ‘ক্ষুধা পায়নি বাবা?’
অর্ক মাথা দোলায়। কুঞ্জল ওকে একটু আদর করে বলে, ‘আমি এখুনি নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি।’
অর্ক চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘কিন্তু তুমি যদি আবার মাথা ঘুরে পড়ে যাও?’
কুঞ্জল এবার শক্ত গলায় বলে, ‘না বাবা, আর মাথা ঘুরে পড়ব না।’
মনের ভেতর দূর্বল হয়ে আসা অংশটুকু এবার শক্ত করতে হবে। অভীক যদি এবার উল্টোপাল্টা কিছু করে ও ছাড়বে না।
কুঞ্জল এবার দ্রুত নাস্তা বানিয়ে অর্ককে খাইয়ে নিজেও খায়। এখন একটু ভালো লাগছে। না খেয়ে শরীর দূর্বল হয়ে ছিল। এবার ও এক কাপ চা নিয়ে বসে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবে, আচ্ছা, অভীক কার জন্য শাড়ি কিনল এটা কী করে জানা যায়? এমন তো হতে পারে ওর অফিসের কোনো ফিমেল কলিগ কেউ ওর ফেসবুক থেকে অর্ডার করে দিতে বলেছে। ও হয়তো মিথ্যে সন্দেহ করছে। নাহ, ব্যাপারটা জানা দরকার। কিন্তু, কী করে?
হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। দ্রুত মোবাইল খুলে ‘জাদুর বাক্স’ শাড়ির পেজে লগ-ইন করে। তারপর খুঁজে খুঁজে অভীকের মেসেজটায় যায়। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে মেসেজটার দিকে। তারপর দ্রুত টাইপ করে, ‘স্যার, শাড়িটা নিশ্চয়ই হাতে পেয়েছেন। শাড়িটা কেমন ছিল, ম্যাডামের পছন্দ হলো কি-না জানাবেন।’
মাঝে মাঝে এমন ফিডব্যাক জানার জন্য ওরা কাস্টমারকে মেসেজ করে। অনেকে শাড়ি পরে ছবিও দেয়। সেগুলো মার্কেটিংয়ের অংশ হিসেবে পেজে আপলোড করা হয়।
কুঞ্জল অধীর আগ্রহে বসে থাকে। অভীক এখনও মেসেজটা সিন করেনি। আচ্ছা কী লিখতে পারে অভীক? যদি লিখে ম্যাডাম খুব পছন্দ করেছে, তখন ও কী করবে?
এলোমেলো ভাবনার এই পর্যায়ে ‘টুন’ করে শব্দ হতেই ও ঝট করে তাকায়। অভীক লিখেছে!
‘শাড়িটা ডিফেক্ট ছিল। আপনারা এটা চেঞ্জ করে দিন।’
কুঞ্জল নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। তার মানে শাড়িটা যাকে দিয়েছে সে কমপ্লেইন করেছে। নিজেকে সামলায়। একবার যদি জানা যেত কাকে শাড়ি দিল।
কুঞ্জল দ্রুত টাইপ করে, ‘স্যার, শাড়িটা আমরা সংগ্রহ করে আপনাকে নতুন ভালো দেখে একটা কপি পাঠিয়ে দেব। শাড়িটা কি আপনার অফিসের যে ঠিকানা সেখান থেকেই সংগ্রহ করব? আপনি চাইলে বাসা থেকেও সংগ্রহ করতে পারি।’
শেষ লাইনটা ইচ্ছে করেই বলে।
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর উত্তর আসে। সেটা ঠিক উত্তর না, যেন একটা ধারালো ছুরি দিয়ে বুক ফালা ফালা করে দেবার মতো কতগুলো শব্দ।
‘ডিফেক্ট শাড়িটা ম্যাডামের অফিসের ঠিকানা থেকে সংগ্রহ করে ওখানেই আবার নতুন শাড়িটা ডেলিভারি করবেন। আর এই হলো ঠিকানা:
মেঘা, ম্যানেজার, আলফা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড, কাকরাইল, মোবাইল নং: ০১৭১…’
পড়তে পড়তে কুঞ্জলের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। হাতে ধরে থাকা মোবাইল থরথর করে কাঁপতে থাকে। কোনোমতে লিখে, ‘ওকে স্যার।’
তারপর মোবাইল রেখে বিছানায় বসে। চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে। প্রাণপণ চেষ্টা করে কান্নাটা থামাতে। এবার আর সফল হয় না। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। একটা বালিশ বুকে চেপে ধরে। বুকটা যে ভীষণ করে পুড়ে যাচ্ছে, জ্বলে যাচ্ছে। অভীক আবার নতুন কোনো মেয়ের সাথে জড়িয়েছে!
অর্ক বসার ঘর থেকে ছুটে আসে, ভয় পাওয়া গলায় বলে, ‘আম্মুউউ, কী হয়েছে? তুমি কাঁদছ কেন? ব্যথা পেয়েছ?’
কুঞ্জলের বুক ছিড়ে যায়। বলতে ইচ্ছে করে, হ্যাঁ বাবা, ভীষণ ব্যথা পেয়েছি। এ জীবনে এমন করে আর কখনও ব্যথা পাইনি। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রে বাবা।
ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে কুঞ্জল। অর্কের কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। আম্মু এমন করে কখনও কাঁদেনি। তবে কি আম্মু অনেক ব্যথা পেয়েছে? বাবাকে কি ফোন দেবে ও?
অনেকক্ষণ পর ও শান্ত হয়। তারপর অর্ককে বুঝিয়ে বলে, ‘তোমার বাবাকে কিছু বলো না। আমি একটু ব্যথা পেয়েছিলাম, তাই কান্না করেছি বাবা।’
অর্ক মাথা নেড়ে অদ্ভুত চোখে আম্মুর দিকে তাকিয়ে থাকে। আম্মুর বুঝি অনেক ব্যথা?
এদিকে অভীক অফিসে দুপুরের খাবার শেষ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে মেঘাকে ফোন দেয়, ‘লাঞ্চ করেছ?’
ওপাশ থেকে হ্যাঁ-সূচক উত্তর আসতেই অভীক বলে, ‘শোন, শাড়িটা তোমার অফিস থেকে কালেক্ট করবে ওরা। তারপর আবার নতুন ভালো দেখে একটা দিয়ে যাবে।’
মেঘা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘ভালো করেছ। ইশ, এত দামী আর সুন্দর শাড়িটায় অমন ডিফেক্ট ছিল, ভাবাই যায় না। ভেবেছিলাম এই শাড়িটা পরে তোমার সাথে দেখা করতে আসব।’
অভীক আদরের গলায় বলে, ‘ও রে আমার পাখিটা। লক্ষ্মী একটা মেয়ে তুমি। তুমি শাড়ি পরলে খুব ভালো লাগে।’
মেঘা হাসে, তারপর বলে, ‘ছাড়ছি। মিটিং আছে। পরে কথা হবে।’
অভীক ফোনটা রাখে। তারপর চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে ভাবে বাসায় একটা ফোন করা দরকার। কাল রাতে কুঞ্জল অমন মাথা ঘুরে পড়ে গেল কেন?
প্রথমবার ফোন দিতেই কেউ ধরে না। দ্বিতীয়বারে অর্ক ফোন ধরতেই অভীক জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘তোমার আম্মু কই?’
অর্ক কেমন মনমরা গলায় বলে, ‘আম্মু ঘুমিয়ে আছে।’
অভীক ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এখন ঘুমুচ্ছে! তোমরা দুপুরের খাবার খাওনি?’
অর্ক মাথা নেড়ে বলে, ‘আমার ক্ষুধা পায়নি বাবা। পরে খাব।’
অভীক এবার আরও অবাক হয়। এখনও ওরা দুপুরের খাবার খায়নি? নাহ, কুঞ্জলের শরীর কি বেশি খারাপ?
অভীক চিন্তিত গলায় বলে, ‘তোমার আম্মু ঘুম থেকে উঠলে আমাকে একটা ফোন দিতে বলো বাবা। এখন রাখছি।’
ফোন রেখে ও কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে থাকে। কাল শাড়ি নিয়ে যাবার পর থেকেই উলটো ঘটনা ঘটছে। কই শাড়ি দেখে খুশি হবে, তা না, মাথা ঘুরে পড়ে গেল? আর আজ তো একবার ফোনও দিল না কুঞ্জল। কাল হঠাৎ মেঘার শাড়িটা যখন এলো তখন হুট করেই একটা অনুশোচনা ঘিরে ধরেছিল। কুঞ্জল মাঝে মাঝে সাদা জামদানি শাড়ির কথা বলত। কেনা হয়নি। কাল মেঘার সাথে দেখা করে যখন শাড়িটা দিল তখনই মনে হয়েছিল। মেঘা খুব খুশি হয়েছিল শাড়িটা পেয়ে। মেয়েটা এত রুচিশীল, আর পরিপাটি যে প্রথম দেখাতেই ও প্রেমে পড়ে যায়। ওদের অফিসের সব ইন্স্যুরেন্সের কাজ মেঘাদের অফিসের সাথে। মাস তিনেক আগে পরিচয়। তারপর একটু একটু করে কখন যে জড়িয়ে গেল ও বুঝতেই পারেনি। পূর্ণের সাথে যোগাযোগটা বন্ধ হয়ে যাবার পর ভীষণ একা লাগত। কোনো কিছুতেই উৎসাহ পেত না, শুন্য শুন্য লাগত সব। সেই সময়টায় কুঞ্জল কেমন দূরে দূরে থাকত।
মেঘা যেন ওর জীবনে সেই শূন্যতাটুকু পূরণ করতেই এসেছে। এখন আর মন খারাপ থাকে না। একটা ভীষণ ভালো লাগা জড়িয়ে থাকে সবসময়। মেঘাকে ভাবলেই বুকের ভেতর একটা আঁকুপাঁকু টের পায়। ইশ, মেঘাকে যদি একদিন নিজের করে পেত!
২.
অভীক আজ সন্ধ্যা নামতেই বাড়ি ফিরে আসে। কুঞ্জল আর ফোন দেয়নি। যতবারই ফোন দিয়েছে, অর্ক ধরেছে। আর সেই একই কথা, আম্মু ঘুমোচ্ছে। নাহ, কোথাও একটা বড়োসড়ো ঝামেলা হয়েছে। মেজাজ খারাপ নিয়ে ও বাসায় ঢোকে। বেডরুম অন্ধকার। অর্ক লিভিংয়ে বসে বসে টিভি দেখছিল। বাবাকে দেখে কাছে আসে, কিন্তু আজ কোনো উচ্ছ্বাস নেই। ও ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তোমার আম্মু কই, বাবা?’
অর্ক হাত তুলে ইশারা করে বেডরুম দেখায়। অভীক চিন্তিত মুখে বেডরুমে যেয়ে লাইট জ্বালাতেই দেখে কুঞ্জল কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। তাহলে কি ওর শরীর খারাপ?
কাছে যেয়ে ওর গায়ে হাত দিয়ে নরম গলায় বলে, ‘এই কুঞ্জল, কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?’
কুঞ্জল ভেজা চোখ মোছে। বুকের ভেতর একটা ঝড় টের পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসে। তারপর ওর দিকে তাকাতেই অভীক চমকে ওঠে। এ কী হাল হয়েছে ওর! চোখ ফুলে আছে, মনে হয় অনেকক্ষণ কেঁদেছে।
অভীক ভয়ে ভয়ে বলে, ‘কী হয়েছে তোমার, কাঁদছ কেন?’
কুঞ্জল স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘আচ্ছা, তুমি তিনদিন আগে ‘জাদুর বাক্স’ নামে অনলাইন শাড়ির পেজ থেকে একটা শাড়ি কিনেছিলে?’
অভীক চমকায়। বুকের ভেতর কেমন ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে। তোতলানো গলায় বলে, ‘না তো। কেন?’
কুঞ্জল পাগলাটে দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, তারপর নিচু কিন্তু তীক্ষ্ম গলায় বলে, ‘তোমার নামে, তোমার অফিসের এড্রেসে সাড়ে আট হাজার টাকা দামের একটা আজ্রাখ সিল্ক শাড়ি অর্ডার হয়েছে। শাড়িটা তুমি কার জন্য কিনেছ অভীক?’
অভীক ঢোঁক গিলে। কুঞ্জল জানল কী করে শাড়ির কথা! নাহ, কেউ কি বলে দিল? মাথা গরম করা যাবে না। ঠান্ডা মাথায় সামলাতে হবে।
এবার ও যথাসাধ্য মুখচোখ স্বাভাবিক করে বলে, ‘ওহ, মনে পড়েছে। আমার অফিসের রায়হানা আপা অর্ডার করেছিল আমার ফেসবুক আইডি থেকে। টাকাটা উনিই দিয়েছেন। এখন মনে পড়ল। ওনার ইন্টারনেট কাজ করছিল না, তখন উনি আমার ফেসবুক থেকে শাড়িটা অর্ডার করেছে। কিন্তু তোমাকে এগুলো কে বলল?’
কুঞ্জল চেয়ে থাকে। অবাক হয়ে ভাবে, মানুষ কত অবলীলায় মিথ্যে বলতে পারে।
কুঞ্জল এবার কেটে কেটে বলে, ‘অভীক, তোমার ভুল হচ্ছে কোথাও। শাড়িটা তুমি মেঘা নামের একটা মেয়ের জন্য কিনেছ যে একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করে। তোমার শাড়ির অর্ডারটা আমিই রেখেছিলাম। তুমি তো আমার কোনো খোঁজ খবর রাখো না। জাদুর বাক্স শাড়ির পেজটাতে আমি কয়েকমাস ধরেই কাজ করি। এখন সত্যটা বলো আমাকে। মেঘা তোমার নতুন প্রেমিকা?’
অভীকের মুখ রক্তশূণ্য হয়ে যায়। মেঘা জাদুর বাক্স পেজে কাজ করে??? হায় হায়, সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন কী করে এটা ধামাচাপা দেবে ও?
অভীক ঝট করে কুঞ্জলের হাত চেপে ধরে, তারপর আকুল গলায় বলে, ‘বিশ্বাস করো, মেঘা আমার কেউ না। ওই কাজ করতে যেয়ে পরিচয় হয়েছে। আমাদের অফিস থেকেই ওকে একটা শাড়ি কিনে দিতে বলেছিল তাই দিয়েছি। আমাদের একটা বড়ো ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম ছিল সেটা ওই মেঘা পাইয়ে দিয়েছিল। ওর সাথে সত্যিই আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তোমাকেই ভালোবাসি।’
কুঞ্জলের সারা গায়ে কেউ যেন বিছুটি পাতা ছেড়ে দেয়। ও পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠে, ‘মিথ্যুক, শয়তান একটা। তুই আমাকে ভালোবাসিস না। তুই ওই মেঘার সাথে নষ্টামি করিস, ওকে শাড়ি কিনি দিস। আর কত এইসব করবি??? একবার পূর্ণের সাথে, আরেকবার মেঘার সাথে? তুই আমাকে কেন বিয়ে করেছিস তাহলে? আজকেই আমাকে তুই ডিভোর্স দিবি।’
অর্ক টিভি বন্ধ করে ভয়ে ভয়ে আম্মুর রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর ক্ষীণ গলায় বলে, ‘আম্মু!’
অভীক দুই হাতে কুঞ্জলকে জড়িয়ে ধরে নিচু গলায় বলে, ‘প্লিজ, আমাকে যা ইচ্ছা বলো, কিন্তু অর্কের সামনে বোলো না। ছেলেটা ভয় পাচ্ছে।’
কুঞ্জল এক ঝটকায় ওকে সরিয়ে দেয়, তারপর হিসহিসিয়ে বলে, ‘ওর জানা উচিত, ওর বাবা একটা মিথ্যুক, লুচ্চা।’
কুঞ্জল যেন উন্মাদিনী এখন। চুলগুলো এলোমেলো, হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীদের মতো সারা শরীর কাঁপছে। অর্ক এবার ভয়ে কেঁদেই ফেলে।
অভীক দৌড়ে গিয়ে অর্ককে জড়িয়ে ধরে, ‘বাবা, কিছু হয়নি। তোমার আম্মু ভালো হয়ে যাবে।’
ঠিক এমন সময় সশব্দে বেডরুমের দরজা লাগানোর শব্দ হতেই অভীক ঝট করে ঘুরে তাকায়। ছিটকিনি লাগানোর শব্দ হচ্ছে। অভীকের বুক চলকে ওঠে। কুঞ্জল দরজা বন্ধ করছে কেন?
এক লাফে ও দরজার কাছে চলে এসে জোর একটা ধাক্কা দেয়। ভেতর থেকে বন্ধ! হায় হায়। অভীকের বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি পেটার শব্দ হতে থাকে। ও পাগলের মতো ধড়াম ধড়াম শব্দে দরজা ধাক্কাতে থাকে। আর আকুল গলায় ডাকতে থাকে, ‘কুঞ্জল, প্লিজ দরজা খোল। আমাকে মাফ করে দাও। আমি আর এমন করব না। কুঞ্জল, প্লিইইজ।’
আর এদিকে ছোট্ট অর্ক বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করতে থাকে, ‘আম্মুউউউ। দরজা খোল, আম্মু। আমার ভীষণ ভয় করছে।’
(চলবে)