প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-০২

0
497

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ২)

১.
গুলশান পুলিশ প্লাজার দোতলায় একটা ভালো স্পোর্টসের দোকান আছে। অফিস শেষে ফেরার পথে অভীক নামে। সাধারণত বাসায় ফেরার সময় ও কোথাও নামে না। আজ অবশ্য অন্য একটা কারণ আছে। অর্কের পরীক্ষা শেষ, একটা কিছু নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ছেলেটার জন্য। ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করে অর্ক। বাসার পাশেই খেলার একটা মাঠ আছে। ছুটির দিনগুলোতে ছেলেটাকে এবার সময় দেওয়া যাবে।

অভীক দোকানের তাকে সাজানো ফুটবলগুলো দেখতে থাকে। এখন কত ধরনের কোম্পানির ফুটবল এসেছে। অথচ ওদের সময় একটাই বল ছিল, সাদা কালো, ডিয়ার। অভীক দোকানির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘ডিয়ার সাদা কালো বলটা আছে?’

দোকানি হেসে তাকায়, ‘সাদা কালো নাই, তবে নীল সাদা বলটা আছে।’

দোকানি তাক থেকে একটা নীল সাদা ছক কাটা চুপসানো বল বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘অরিজিনাল ৫ নম্বর সাইজের বল। ইচ্ছা করলে মাপ দিয়া নিতে পারেন, পুরা সত্তুর সেন্টিমিটার।’

বলটা নতুন, চকচকে। দেখেই খেলতে ইচ্ছে করছে। স্কুলে পড়ার সময় ওরা চাঁদা তুলে তুলে একটা বল কিনত। কী উত্তেজনা ছিল! দেখা যেত পুরো টাকাটা যোগাড় হয়নি, সবার মন খারাপ। সেসময় একটা বল মানে অনেকগুলো ছোট ছোট বাচ্চার স্বপ্ন। আর এখন!

অভীক দোকানিকে অনুরোধের গলায় বলে, ‘এটা পাম্প করে নেওয়া যাবে?’

লোকটা মাথা নেড়ে বলটা দোকানের ছোট একটা ছেলের হাতে দিয়ে বলে, ‘এইটা পাম্প কর তো। দেখিস বেশি হার্ড করিস না।’

দোকানি ওকে বসতে বলে। অভীক ছোট্ট একটা টুলে বসে তাকিয়ে দেখে। ছেলেটা একটু একটু করে হাওয়া দিচ্ছে আর চুপসে থাকা বলটা কেমন সুন্দর গোল একটা আকৃতি পাচ্ছে। একটু আগেও বলটাকে কেমন মন মরা জুবুথুবু মনে হচ্ছিল। অথচ এখন কেমন তরতাজা। হঠাৎ করেই ওর মনে হয় ওর আর কুঞ্জলের জীবনটাও ওই চুপসে থাকা ফুটবলের মতো জুবুথুবু। কোনো প্রাণ নেই সম্পর্কটায়। হ্যাঁ, ভুলটা ওর ছিল। কিন্তু সেটা নিয়ে কুঞ্জল এত বাড়াবাড়ি করল যে মনটাই বিষিয়ে গেল।

পূর্ণের সাথে বহুদিন পর একটা শপিংমলে দেখা হয়েছিল। ওর প্রথম প্রেম ছিল পূর্ণ, যেমন থাকে আর সবার, আবেগে ভরা একটা সময়। তাই বহুদিন বাদে পূর্ণকে দেখে পুরানো সেই উজ্জ্বল দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। পূর্ণও ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। পুরানো মান অভিমান, অভিযোগ পাশে সরিয়ে ওরা একসাথে বসেছিল এক কাপ কফি নিয়ে। পূর্ণের দুই ছেলে, বর ইঞ্জিনিয়ার। বেশ সুখে যে আছে সে কথাই বার বার বলছিল। ওর বউ কি করে সেটা জানতে চাইতেই যখন কুঞ্জলের কথা বলেছিল তখন ও আগ্রহ নিয়ে বউয়ের ছবি দেখতে চাইল। দেখে প্রশংসার গলায় বলল, ‘বাহ, তোর বউ তো দেখতে ভারী মিষ্টি।’

সেদিনই ওর ফেসবুকে রিকুয়েষ্ট পাঠিয়ে আবার নতুন করে বন্ধু হয়। মোবাইল নম্বর দেয় পূর্ণ। পুরনো বন্ধুর মতো যোগাযোগ থাকবে সে কথা জানায়। কিন্তু যোগাযোগটা একটা সময় বন্ধুর পর্যায়ে থাকেনি। অভীক ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিল পূর্ণ অসুখী। প্রাচুর্য আছে কিন্তু সুখ নেই ওর সংসারে। একদিন ভীষণ অসুস্থ শরীর নিয়ে ফোন দিয়েছিল একজন ডাক্তার দেখাবে বলে। পুরনো প্রেম কিংবা পুরনো বন্ধুর টানেই ও গিয়েছিল। আর সেদিন মনে মনে অবাক হয়েছিল ওর হাসব্যান্ড আসেনি বলে। পরে জেনেছিল ওর ইঞ্জিনিয়ার জামাই ভীষণই ব্যস্ত থাকেন অফিস নিয়ে। তাই আসতে পারেননি। সেদিন অভীক পূর্ণকে নিয়ে অনেক ছুটোছুটি করেছিল। এরপর ও সুস্থ হলে একটা বেলা ওরা বসেছিল, অনেক অনেক কথা বলার পর ওরা দু’জন আবিস্কার করেছিল এখনও ওরা দু’জন দু’জনকে ভুলতে পারেনি। আর বিয়ের এতটা বছর পর ওরা যে মনের দিক থেকে অনেকটাই একা সেটাও বেরিয়ে এসেছে। না, নতুন করে ভালোবাসাবাসির কথা হয়নি, কিন্তু একটু পাশে থাকা, মনের কথাগুলো শেয়ার করার জন্যই ওরা কাছে এসেছিল। প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো। তাতে করে ঘনিষ্ঠ কথাও থাকত, শরীরের আকুলতার কথাও থাকত। সম্পর্কের এই পর্যায়ে কুঞ্জল একদিন ওর একটা মেসেজ দেখে ফেলে। অভীক বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছিল এটা নেহায়েত ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথাবার্তা, বাস্তবে কিছু নেই। কিন্তু কুঞ্জল কেমন পাগলের মতো হয়ে গেল। ও সাথে সাথে ওর মোবাইলের মেসেঞ্জার থেকে ফোন করে যা তা বলল পূর্ণকে। তারপর রাগের চোটে মোবাইলটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ভেঙে ফেলেছিল। সেবার এক মাস কোনো কথাই বলেনি কুঞ্জল।

এর মাঝে পূর্ণ নিজেই একবার ওর সাথে দেখা করে বলেছিল, ‘অভীক, আমরা এখন এমন একটা বয়সে আছি যখন সুখের চেয়ে স্বস্তি দরকার, ভালোবাসার চেয়ে ঝামেলাবিহীন ভালো থাকা জরুরি। তুই আর আমাকে ফোন দিস না, আমিও দেব না। তবে কোনোদিন খুব বিপদে পড়ে গেলে হয়তো ডাকব, তখন আসবি তো?’

অভীকের বুকের ভেতর ভেঙেচুরে যাচ্ছিল সেদিন। ও কথা দিয়েছিল আর ফোন দেবে না, দেয়ও নি। তারপর ধীরে ধীরে আবেগটাও কমে এসেছে। ওদিকে কুঞ্জলের রাগ, অভিমানের পারদ নেমে স্বাভাবিক হয়েছিল সম্পর্কটা। স্বাভাবিক মানে পূর্ণের কথা মতো ঝামেলাবিহীন স্বস্তির জীবন ফিরেছিল সংসারে। কিন্তু মায়াটা ছিল না, ভালোবাসা ছিল না।

অভীক ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেলে। সেই সাথে বল থেকে পিন বের করার সময় বাতাসের একটা হিসহিস শব্দ বেরিয়ে আসে। ও তাকিয়ে দেখে বলটা এখন বেশ গোলগাল সুখী, সুন্দর। ছেলেটা ওর হাতে দিতেই বলটা ও মাটিতে ক’বার ঠুকে ঠুকে দেখে। মাটিতে পড়া মাত্রই বলটা একদম বুক বরাবর উঠে আসছে। জীবনটাও বুঝি এমন? ঠিকঠাক মায়ার হাওয়া ভরা না থাকলে সেটা আর বুকের কাছে উঠে আসে না, পায়ের কাছেই পড়ে থাকে।

দোকানি বলটা একটা সুতোর জালে জড়িয়ে দিতে দিতে বলে, ‘মাঝে মাঝে হাওয়া ভরে নেবেন। নেতানো অবস্থায় রেখে দেবেন না। বোঝেন তো, হাওয়া ছাড়া ফুটবল অচল। যার যা খাবার, তাই দিতে হয়।’

অভীক মাথা নাড়ে। সেটা ওর চেয়ে আর কে ভালো বোঝে। যার যেটা লাগে তাকে সেটা না দিলে যে সে বেঁচে থাকে না। যেমন ওর সংসারে মায়া নেই, তাই ওটা নেতিয়ে আছে। ঠিকঠাক মায়া পেলে আবার বেঁচে উঠত।

অভীক বলের দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ে। নাহ, আজ দেরি হয়ে গেল।

গলির কাছাকাছি আসতেই হাজী বিরিয়ানির দোকানটা চোখে পড়ে। এটা আসল হাজীর বিরিয়ানি না, কিন্তু এটাও খুব স্বাদের। অর্ক বিরিয়ানি খেতে খুব পছন্দ করে, কুঞ্জলও। কথাটা মনে হতেই ও তিন প্যাকেট বিরিয়ানি কেনে। তার আগে কুঞ্জলকে একটা মেসেজে জানিয়ে দেয় আজ রাতে যেন না রান্না করে, হাজীর বিরিয়ানি নিয়ে আসবে।

২.
কুঞ্জল ফ্রিজ থেকে তিন পিস রুই মাছ বের করে। আজ রাতে আর ঝামেলা করবে না। বেশি করে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ভেজে দিলে গরম গরম খেতে খুব ভালো লাগবে। অভীক খুব পছন্দ করে এটা। সাথে একটু নতুন ছোট ছোট আলুর ভর্তা করবে শুকনো মরিচ আর পেয়াঁজ পাতা একটু টেলে নিয়ে।

কুঞ্জল মাছের পিসগুলোতে একটু লবন আর হলুদ মাখিয়ে রাখতেই পৃথুলের ফোন আসে, ‘আপু, লেবু ডালটা যেন কেমন করে করে? লেবুর পিসগুলো আগেই দেব?’

পৃথুল মাঝে মাঝেই এমন ফোন দেবে। বেচারা এখনো রান্নাটা আয়ত্বে নিয়ে আসতে পারল না। ও বুঝিয়ে বলে, ‘একদম শেষে দিবি, না হলে তো তিতে হয়ে যাবে। আর নামানোর আগে বাসায় লেবু পাতা থাকলে দুই তিনটা দিস।’

ওপাশ থেকে পৃথুল কৃত্রিম ক্ষোভের গলায় বলে, ‘এই, তুই একটা রান্নার চ্যানেল দিস না কেন বল তো? আমাদের মতো আনাড়ির কত হেল্প হয়। তোর এইসব টোটকা রান্নায় খুব কাজে লাগে। আচ্ছা ছাড়ছি এখন, কাল দেখা হবে।’

ফোনটা রাখতেই কুঞ্জলের হঠাৎ করেই মনে হয় আসলেই তো, একটা রান্নার চ্যানেল ও দিতেই পারে। অনলাইনে প্রতিটি রান্নার চ্যানেল এত জনপ্রিয়। ও মাঝে মাঝেই দেখে। নিজেও একটু আধটু এক্সপেরিমেন্ট করে দেখে। রান্নার একটা চ্যানেল দিলে মন্দ হয় না। ওর তো রান্না করতেই হয়। শুধু মোবাইলের ভিডিও অপশনটা চালু করে রাখলেই হয়। ভাবতেই একটা উত্তেজনা টের পায় কুঞ্জল। এর আগে একবার অনলাইনে শাড়ির পেজ খুলতে চেয়েছিল। কিন্তু ও কাছ থেকে দেখেছে। অনেক ঝক্কির কাজ। শাড়ি কিনে আনা, লাইভ শো করা, তারপর এগুলোর ডেলিভারির ব্যবস্থা করা। কাস্টমাররা অনেক সময় শাড়ি ফেরত দেয়। এসবের পাশেও সবচেয়ে বড়ো সমস্যা এখন এত এত শাড়ির পেজ যে বিক্রি করাই মুশকিল। আর এতে অনেক টাকাও ইনভেস্ট করতে হয়। ওর অত টাকা কোথায়?

মোবাইলটা রেখে রান্নাঘরের দিকে এগোতেই অভীকের মেসেজ আসে। ভ্রু কুঁচকে মেসেজটা পড়তেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আর কিছুক্ষণ আগে জানালে কী হতো যে আজ বিরিয়ানি নিয়ে আসবে? ও তো মাছ মসলা দিয়ে মাখিয়ে ফেলেছে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে, অভীক ইদানীং ফোনটাও ঠিকঠাক করে না। মাছ ভাজতে ভাজতে ও ভাবে শাড়িটা কি ওর জন্যই অর্ডার করেছে?

অভীক বাসায় আসতেই অর্ক এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তারপর উৎসাহের সাথে বলে, ‘বাবা, আমার আজ পরীক্ষা শেষ। এখন শুধু খেলব।’

কথাটা বলতে বলতে ও থমকে বাবার হাতের দিকে তাকাতেই চিৎকার করে ওঠে, ‘ফুটবল!!’

অভীক হাসে, তারপর হাতে থাকা ফুটবলটা সুতোর জাল থেকে বের করে মেঝেতে ঠুক দেয়, বলটা শুন্যে লাফিয়ে উঠতেই অর্ক একটু সামনে ঝুঁকে দু’হাত দিয়ে লুফে নেয়। তারপর বুকের সাথে চেপে ধরে ঘ্রাণ নেয়।

অভীক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘কি, পছন্দ হয়েছে বাবা?’

অর্ক জোরে মাথা নাড়ে। তারপর এক দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায়। কুঞ্জল রান্নাঘর থেকেই বাপ ছেলের কথা শুনছিল। অর্ক দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই ও হেসে তাকায়।

অর্ক চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘আম্মু, দেখো বাবা আমার জন্য ফুটবল নিয়ে এসেছে।’

এমন সময় অভীক হাতের বিরিয়ানি প্যাকেটগুলো ডাইনিং টেবিলের উপরে রাখতে রাখতে বলে, ‘এগুলো তাড়াতাড়ি বেড়ে ফেলো, খেয়ে ফেলি। না হলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

কথা শেষ করে তাকাতেই দেখে কুঞ্জল গম্ভীরমুখে মাছ ভাজছে, ওর দিকে তাকাচ্ছে না। কী হলো আবার? আজ দুপুরে দু’বার ফোন বিজি পেয়েছিল। তাই বুঝি রাগ করে আছে? পূর্ণের সেই ঘটনার পর থেকে ওর ফোন বিজি পেলেই সন্দেহ করত। কিন্তু সেসব পাট তো অনেক আগেই চুকেছে। তাহলে আজ নতুন করে কী হলো? নাহ, ঘরে ফিরে শান্তি নেই। সবসময় মুখ কালো।

ও আর কথা বাড়ায় না। শার্ট-প্যান্ট ছেড়ে গোসলে ঢোকে।

গোসল সেরে যখন বেরোয় ততক্ষণে কুঞ্জল খাবার বেড়ে ফেলেছে। খেতে বসতে গিয়ে ও থমকে তাকায়, তারপর বলে, ‘কী ব্যাপার, তুমি বিরিয়ানি খাবে না?’

কুঞ্জল শুকনো গলায় বলে, ‘মাছ ভেজেছিলাম। ভাতও রান্না হয়ে গিয়েছে। তুমি বিরিয়ানি নিয়ে আসবে সেটা আগে জানালেই হতো। তোমরা খাও, আমি খাব না। আমি একটু মাছ দিয়ে ভাত খাই।’

অভীক মাথার ভেতর সূক্ষ্ম একটা যন্ত্রণা অনুভব করে। কই ভেবেছিল সবাই আরাম করে বিরিয়ানি খাবে, তা না উলটো ঝামেলা হলো। কুঞ্জল রাগ দেখিয়েই খেল না। কেন যে এত অল্পতেই রেগে যায়, কে জানে।

চুপচাপ খাওয়া শেষ করে ও উঠে পড়ে।

কুঞ্জল সব গুছিয়ে যখন ঘুমোতে আসে ততক্ষণে রাত বারোটা প্রায়। অভীক বিছানায় শুয়ে শুয়েই টিভি দেখছে। কুঞ্জল আড়চোখে একবার তাকায়। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ওর মনে কী চলছে। এই যে আজ অনলাইনে শাড়ির অর্ডার দিল সেটা কার জন্য? ওর জন্য নিশ্চয়ই না? নাকি ওকে চমকে দিতেই এটা করেছে? খুব ইচ্ছে করছে শাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতে। করবে? নাহ, থাক। আগে শাড়ি ডেলিভারি হোক, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যদি এরপরও ওকে কিছু না বলে তাহলে বুঝতে হবে অভীক আবার ওই বজ্জাত মেয়েটার সাথে প্রেম করছে। আর এবার যদি এমন কিছু হয় তাহলে ওকে ছেড়ে চলেই যাবে। কথাটা ভাবতেই ও থমকে যায়। কোথায় যাবে ও? কার কাছে? বাবা মায়ের কাছেই ফিরে যেতে হবে। কিন্তু ওরাও যে ওর মতোই ভাই ভাবির সংসারে আশ্রিতের মতোই থাকে। কুঞ্জল আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও চলে যাবার মতো একটা জায়গা খুঁজে পায় না। ভীষণ হতাশ লাগে।

লাইট অফ করে ও শুয়ে পড়ে। অভীকও চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ে, একা, কোলবালিশ জড়িয়ে। একটাবার ওকে ধরে ঘুমায় না। এমনই চলছে অনেকদিন। কুঞ্জলের ভীষণ কষ্ট হতে থাকে। একটু ভালোবাসা পাবার জন্য মন ছটফট করে।

এরপর দুটো দিন দারুণ উৎকন্ঠায় কাটে ওর। বার বার শাড়িটার ডেলিভারি স্ট্যাটাস চেক করে দেখে। তৃতীয় দিন দুপুর বারোটার দিকে শাড়িটা ডেলিভারি হবার খবর পায়। কুঞ্জল সেদিন পুরোটা বেলা উদাস হয়ে বারান্দায় বসে থাকে। খুব বেশি উৎকন্ঠা হতে হতে একটা সময় মানুষ যখন সব আশা ছেড়ে দেয় ঠিক তেমন করে ও বসে থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। মনের ভেতর চাপ বাড়ছে। আচ্ছা, আজ যদি অভীক শাড়িটা না নিয়ে আসে, ও তাহলে কী করবে? জিজ্ঞেস করলে সত্যিই যদি বলে ওই মেয়ের জন্য কিনেছে? তখন ও কী করবে?

রাত আটটার দিকে বাসার কলিং বেল বেজে উঠে। কুঞ্জলের বুক চলকে ওঠে। অর্ক এক দৌড়ে দরজা খোলে, চিৎকার করে বলে, ‘বাবা, এসেছে।’

অভীকের মনটা আজ খুব ভালো। কুঞ্জল আজ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। ওর পছন্দের একটা শাড়ি নিয়ে এসেছে আজ। ইচ্ছে করেই ওকে বলেনি শাড়ির কথাটা।

কুঞ্জল উন্মুখ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। অভীক ঢুকছে, এক হাতে অফিসের ব্যাগ। আরেক হাতে ওটা কী? বুকের ভেতর ড্রাম পেটানোর শব্দ পাচ্ছে। একটা মোড়ানো প্যাকেট। তবে কি ওর অনুমান মিথ্যা করে অভীক শেষ পর্যন্ত শাড়িটা নিয়ে এল?

অভীক বাসায় ঢুকেই বেশ চনমনে গলায় বলে, ‘দেখো তো শাড়িটা পছন্দ হয় কি না?’

কুঞ্জলের পা কেমন অবশ হয়ে আসছে। ও পায়ে পায়ে কাছে আসতেই দেখে বিছানার উপর একটা শাড়ির ব্যাগ। চেয়ে থাকে কাগজের ব্যাগটার দিকে। চেয়েই থাকে। এটা ওদের শাড়ির পেজের ব্যাগ না।

অভীক উৎসাহের সাথে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা সাদার উপর সাদা কাজ করা জামদানী শাড়ি বের করে ওর চোখের সামনে মেলে ধরে। তারপর উৎসাহের সাথে বলে, ‘সাদা জামদানি না কিনতে চেয়েছিলে? নিয়ে এলাম। পছন্দ হয়েছে?’

কুঞ্জল মেলে ধরা সাদা জামদানীর দিকে বিহবল চোখে চেয়ে থাকে। ধীরে ধীরে সাদা জামদানীটা ঝাপসা হয়ে কেমন ধূসর একটা সাদা কুয়াশার চাদর হয়ে ওকে ঘিরে ধরে। মাথার ভেতরটা শুন্য হয়ে যায়। চোখে কেমন অন্ধকার দেখছে এখন। মাথা ঘুরে খাটে পড়ে যাবার আগে ওর একটা কথাই মনে হয় অভীক ওর জন্য ওদের পেজ থেকে অর্ডার করা মোডাল সিল্ক আজ্রাখ শাড়িটা নিয়ে আসেনি। তাহলে ওটা কার জন্য কিনেছে?

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে