#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১৬) -শেষ পর্ব
১.
অক্টোবর মাসের শেষে বাতাসে একটা হালকা শীতের ছোঁয়া টের পাওয়া যায়। প্রকৃতি এ সময়টায় সবচেয়ে সহনীয় থাকে। ভোর পাঁচটা বাজে। কুঞ্জল, পৃথুলের ছোট ভাই তুহিন, আফরোজা আপু সহ ম্যারাথন দৌড়ের স্টার্টিং মার্কে দাঁড়িয়ে আছে। আজ দশ মাইলের লম্বা দৌড়ে নাম লিখিয়েছে কুঞ্জল। এর জন্য শেষ একটা মাস ও নিয়মিত সকালে অনুশীলনও করেছে। না লিখিয়ে উপায়ও ছিল না। আর ক’টা দিন পরেই রান্নার কোর্সের তৃতীয় কিস্তির টাকা জমা দিতে হবে। কিন্তু হাতে জমানো টাকা খুব সামান্যই আছে। সেদিন হঠাৎই তুহিন বলছিল, আপু এবার দশ মাইলের দৌড়ে নাম লিখাও। প্রথম হলে পঁচিশ হাজার টাকার পুরস্কার আছে। সেদিনই সিদ্ধান্ত নেয়, ও দৌড়ুবে। মেয়েদের ক্যাটাগরিতে একটু চেষ্টা করলেই ও ফার্স্ট হতে পারে। তা ও জোর প্রস্তুতিও নিয়েছিল। কিন্তু গত ক’দিন ধরে শরীরটা খারাপ যাচ্ছে, ঠান্ডা-জ্বরের মতো। কুঞ্জল নাক টানে। অভীক আসতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত আসেনি। আসার পর থেকে তিন চার বার ফোন দিয়েছে অভীক। ও বলেওছিল এখন আর ফোন না দিতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওর সন্দেহ যায় না।
কুঞ্জল কান খাড়া করে অপেক্ষা করে রেস শুরু হবার, হুইশেল বাজার। তীক্ষ্ণ শব্দে হুইশেল বাজতেই একটা হুড়োহুড়ি লাগে। কুঞ্জল ধীরে সুস্থে দৌড় শুরু করে। আজ মনে করে ও পানির বোতল নিয়ে এসেছে। প্রথমবারের মতো ভুল করেনি। হঠাৎ করেই অংশুলের কথা মনে পড়ে যায়। সেবার অংশুল পানির বোতল এনে দিয়েছিল, সাথে ওর জন্য একটা লেমোনেডও বানিয়ে এনেছিল। মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায় কুঞ্জলের। জীবন চলার পথে এমন ছোট ছোট মায়ার দেখা ও আর পাবে না যেটা বেঁচে থাকার জন্য খুব দরকার ছিল। না, অংশুল আর কোনো মেসেজ দেয়নি। হয়তো নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবেই। আর সেটা ভাবাই উচিত। কুঞ্জল নিজেও ব্যাপারটা বোঝে।
অর্ধেক পথ পেরোতেই কুঞ্জল টের পায় ওর খারাপ লাগছে। কেমন যেন শক্তি ফুরিয়ে আসছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সাহস দেয়। ওর যে আজ ফার্স্ট হতেই হবে। কিন্তু আজ এখনও ওর সামনে অনেক প্রতিযোগী। কুঞ্জল মরিয়া হয়ে দৌড়ুতে থাকে। শেষের দিকে এসে ও চোখে যেন অন্ধকার দেখে। কিছুতেই শক্তি পাচ্ছে না। ইচ্ছে করছে সব ফেলে এখানেই শুয়ে পড়তে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। ও যখন ফিনিশিং লাইন ছোঁয় তখন মাথা ঘুরে পড়ে যায়। জ্ঞান হারানোর আগে ও কিছু মানুষের আফসোসের গলা শুনতে পায়।
মুখে ঠান্ডা পানির স্পর্শে কুঞ্জলের জ্ঞান ফেরে৷ চেয়ে দেখে তুহিন, আফরোজা আপু ওর মুখের উপর ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। ওকে চোখ মেলতে দেখে ওরা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
আফরোজা আপু ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘তোর শরীর এতটা খারাপ বলবি না? অমন জোর করে দৌড়ানো যায়? নিজের ক্ষতি করে ফেলবি তো পাগলি।’
কুঞ্জল একটু হাসার চেষ্টা করে, তারপর দূর্বল গলায় বলে, ‘আপু, আমি দৌড়ে কততম হয়েছি?’
আফরোজা নরম গলায় বলে, ‘তুই এই শরীর নিয়ে দৌড়েও সপ্তম হয়েছিস। ইশ, তুই ভালো থাকলে ঠিক ফার্স্ট হতিস।’
কুঞ্জলের বুক ফেটে কান্না আসে। ও পারল না? এখন কী হবে। ও হেরে গেল এমন করে? তাহলে কি ওর রান্নার কোর্সটার এখানেই সমাপ্তি টানতে হবে? চেয়েছিল নিজের টাকায় কোর্সটা শেষ করবে। কিন্তু টাকা উপার্জন আসলেই ভীষণ কঠিন, অন্তত এই বয়সে এসে। বিষণ্ণ মনে ও ভাবতে থাকে জীবনের সব দৌড়েই আজ ও পরাজিত।
বাসায় যখন ফেরে শরীর অবসন্ন, ক্লান্ত। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। তুহিন এসেছে ওকে এগিয়ে দিতে।
অভীক দরজা খুলেই কর্কশ গলায় বলে, ‘তোমার ফোন বন্ধ কেন? সেই কখন থেকে ফোন দিচ্ছি।’
কুঞ্জল একবার তুহিনের দিকে তাকায়, তারপর বলে, ‘দৌড়ানোর সময় ফোন বন্ধ করে রেখেছিলাম, আর খুলতে মনে নেই।’
পাশ থেকে তুহিন এবার উদ্বিগ্ন গলায় বলে, ‘ভাইয়া, আপু ভীষণ অসুস্থ। মনে হচ্ছে দৌড়ে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আপুর বিশ্রাম দরকার।’
অভীক রাগের গলায় বলে, ‘কেন দৌড়াতে যাও? আর তুহিন, তোমরা আর তোমার আপুকে নিয়ে যেও না। সবার সব কাজ না।’
কুঞ্জল কোনোমতে ভেতরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ে৷ অর্ক কাছে এসে মায়ের কপালে হাত রাখে, ‘আম্মু, তুমি অসুখ? আজ দৌড়ে ফার্স্ট হয়েছ?’
কুঞ্জল চোখ বন্ধ করেই ক্লান্ত গলায় বলে, ‘আব্বু, একটু পানি দাও। আর দেখো তো বাবার কাছে প্যারাসিটামল আছে কি-না।’
সেদিন অভীক একটু পর পরই কুঞ্জলের কাছে এসে বসে খোঁজ নেয়, জ্বর মেপে দেখে। রাতে কুঞ্জলের জ্বর বাড়ে। জ্বরের ঘোরে ও দেখতে পায় দশ মাইলের দৌড়ে ও প্রথম হয়েছে। কেউ একজন ওকে মেডেল পরিয়ে দিচ্ছে। কোথা থেকে অভীক এসে ওর গলা থেকে মেডেলটা ছুড়ে ফেলে দেয়। স্বপ্নের ভেতরই কুঞ্জল ভয়ে কেঁপে ওঠে।
তিনদিন লেগে যায় কুঞ্জলের সুস্থ হতে। অভীক আজ অফিসে গেছে। এই ক’টা দিন অভীকের যত্নটুকু ভালো লেগেছে। সাইফুল্লাহ স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। উনি কি এই মায়ার কথাই বলেছিলেন?
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ও রেডি হয়। অর্ককে আনতে যেতে হবে। আয়নার সামনে চুলে চিরুনি বোলাতে বোলাতে ওর হঠাৎ মনে পড়ে রান্নার স্কুলে কোর্স ফি দিতে হবে। চিন্তিত মুখে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। গলার দিকে নজর পড়তেই ও ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবে। তারপর গলার স্বর্নের চেইনটা হাত দিয়ে ধরে। গত বছর বিবাহবার্ষিকীতে অভীক কিনে দিয়েছিল। বারো আনার মধ্যে সুন্দর একটা চেইন। আচ্ছা এটা বিক্রি করলেই তো ওর টাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ভাবতেই একটা উত্তেজনা বোধ করে কুঞ্জল। কিন্তু কাজটা করা কি ঠিক হবে? একটু ভাবে ও৷ তারপর সব দ্বিধা ঝেড়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, চেইনটা বিক্রি করে ও পুরো কোর্স ফি টা দিয়ে দেবে।
কুঞ্জল আলমারি থেকে খুঁজে খুঁজে চেইন কেনার রশিদ বের করে। তারপর চেইনটা খুলে একটা ছোট বক্সে ভরে হাতব্যাগে নিয়ে নেয়। অর্ককে স্কুল থেকে নিয়েই আজ চলে যাবে।
স্কুল থেকে অর্ককে নিয়ে ও যখন সেই জুয়েলারির দোকানে আসে ততক্ষনে দুপুর দুটো বেজে গেছে। অর্ক শুকনো মুখে বলে, ‘আম্মু, আমার ক্ষুধা পেয়েছে।’
কুঞ্জল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘একটু দাঁড়াও বাবা। আমি ওই দোকনটা থেকে এখনই আসছি।’
অর্ক স্কুল ব্যাগ নিয়ে বাইরে দাঁড়ায়। চেয়ে দেখে আম্মু সামনের দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল। কাচের দরজা দিয়ে আম্মুকে দেখা যাচ্ছে।
দোকানি তাকাতেই কুঞ্জল সংকুচিত গলায় বলে, ‘আমার একটা গলার চেইন বিক্রি করব। আপনাদের এখান থেকেই নিয়েছিলাম। এই যে এটা।’
লোকটা কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। কুঞ্জলের ভীষণ লজ্জা লাগছে। একটা সংকোচ ওকে ঘিরে ধরে। লোকটা বলে, ‘রিসিট আনছেন?’
কুঞ্জল এবার ব্যাগ হাতড়ে রশিদটা দিতেই লোকটা কী যেন দেখে। তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘কিন্তু এখানে তো অভীক নামে একজনের নাম লেখা। উনি আপনার কে হয়?’
কুঞ্জল মনে মনে প্রমাদ গোনে। স্বর্ন বিক্রি করতে এসে এখন না ও বেইজ্জতি হয়। ও গম্ভীরমুখে বলে, ‘আমার হাসব্যান্ড উনি। কেন বলুন তো?’
লোকটা এবার নরম গলায় বলে, ‘আসলে অনেকে এমন বিক্রি করতে আসে। পরে আবার হাসব্যান্ড এসে ঝামেলা করে। তাই আর কি। আপনি বসুন ম্যাডাম, আমি ওজন দিয়ে দেখছি।’
কুঞ্জল বসে না। ও কাচের দরজা দিয়ে বাইরে তাকায়, অর্ক ওর দিকেই উম্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে।
স্বর্নের দোকানি যখন ওর হাতে পয়ষট্টি হাজার টাকা তুলে দেয় তখন কুঞ্জল যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ভেবেছিল এরা ঠকাবে। নাহ, ভালো দামই দিয়েছে। কুঞ্জল টাকাটা ব্যাগে ভরে।
বাইরে বেরোতেই অর্কের মুখে হাসি ফোটে। অর্ককে নিয়ে প্রথমে একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে ঢোকে। তারপর অর্কের প্রিয় চিজ বার্গার অর্ডার করে৷ নিজেও একটা নেয়। অর্ক বেশ মজা করে খেতে থাকে। দু’জনে দুটো কোক নেয়। অর্ক কোকে চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘আম্মু, বার্গারটা খুব মজা ছিল। মাঝে মাঝে আমরা এখানে এসে খাব।’
কুঞ্জল ছেলের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে। খাওয়া শেষে অর্কের জন্য টুকিটাকি কিছু কেনে – একটা প্যান্ট, পোলো শার্ট। নিজের জন্যও একজোড়া জুতো কেনে। কেন যেন খুব ভালো লাগছে। হঠাৎ করেই ওর মনে হয় অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একটা বড়ো স্বাধীনতা।
সেদিন কুঞ্জল ওর পুরো কোর্স ফি জমা দিয়ে বাসায় ফিরে। আর কোনো বাধা রইল না। এবার একটু মাথা ঠান্ডা করে ক্লাশগুলো করতে পারবে। ও গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রাতের রান্নার যোগাড়যন্ত্র শুরু করে।
রাতে অভীক যখন বাসায় ফেরে কুঞ্জল খেয়াল করে ওর মুখ গম্ভীর। কপালে একটা চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কী হলো আবার?
রাতে খাওয়া শেষে অভীক কুঞ্জলকে ডাকে, ‘একটু রুমে আসো, কথা আছে।’
কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়। আবার অংশুলকে নিয়ে কথা শোনাবে? আজ যদি একটা বাজে কথা বলে ও ছেড়ে দেবে না।
কুঞ্জল গম্ভীরমুখে রুমে ঢোকে, চোখমুখ শক্ত করে বলে, ‘বলো, কী বলবে?’
অভীক পকেট থেকে ছোট্ট একটা বক্স বের করে ওর হাতে দেয়। কুঞ্জল চোখ কুঁচকে বলে, ‘কী এটা?’
অভীক উদাস গলায় বলে, ‘খুলে দেখো।’
কুঞ্জল কপাল কুঁচকে বক্সটা খোলে। ভেতরে তাকাতেই একটা সোনালি আলো ঝিকমিক করে ওঠে। স্তম্ভিত হয়ে ও তাকিয়ে দেখে এটা সেই স্বর্নের চেইন যেটা ও আজ দুপুরেই বিক্রি করে এসেছে। পুরো শরীর কেঁপে ওঠে ওর। তোতলানো গলায় বলে, ‘এটা কোথায় পেলে?’
অভীক ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে, তারপর বলে, ‘তুমি যখন ওই দোকানে এটা বিক্রি করতে যাও, ওরা আমাকে ফোন দিয়েছিল। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি রশিদে আমার নাম, মোবাইল নম্বর লেখা ছিল। ওরা শুধু নিশ্চিত হতে চেয়েছিল চেইনটা বিক্রি হচ্ছে আমি জানি কি-না। পুরোটা শুনে বললাম টাকাটা তোমাকে দিয়ে দিতে। তারপর আমি যেয়ে আবার ওটা কিনে এনেছি – তোমাকে যে দামে দিয়েছে তার চেয়ে একটু বেশি দামে। কুঞ্জল, কী সমস্যা বলো তো? তোমার টাকার দরকার আমাকে বলোনি কেন? না বলে চেইন বিক্রি করতে গেলে!’
কুঞ্জল মাথা নিচু করে থাকে। কেন যেন খুব লজ্জা লাগছে এখন। নিজেকে চোর চোর মনে হচ্ছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আমার রান্নার কোর্সে টাকা বাকি ছিল। সেজন্য বাধ্য হয়েই এটা বিক্রি করতে গিয়েছিলাম।’
অভীক সামনে ঝুঁকে অবাক গলায় বলে, ‘কিহ!? সেই কোর্সের টাকার জন্য তুমি আমার দেওয়া বিয়ে বার্ষিকীর উপহারটা বেচে দিলে? আমার কাছে টাকা চাইলে কি আমি না করতাম? এতটা দূরে সরে গেছ তুমি কুঞ্জল!’
শেষ লাইনটায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে অভীকের।
কুঞ্জলের চোখে জল চলে আসে৷ ও দুটো ঠোঁট চেপে কান্না সামলায়, তারপর বলে, ‘তুমিই তো দূরে ঠেলে দিয়েছ। একের পর সম্পর্কে জড়িয়েছ। কখনও আমার ছোট ছোট ভালো লাগাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোননি। রান্না শিখতে আমার ভালো লাগে, নিজে একজন নামকরা শেফ হবার স্বপ্নও দেখি। প্রতিটি মানুষ তার নিজের কাছে অন্তত বড়ো হতে চায়। কিছু ব্যক্তিগত অর্জন থাকতে হয় মানুষের। না হলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাটা আসে না। যেটা আসে সেটা করুণা। আমার তো তেমন কিছুই ছিল না। তাই এটা আঁকড়ে নিজের আত্মবিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি ভুল বুঝলে। আরও দূরে ঠেলে দিলে, নিজেও দূরে সরে গেলে। তুমি কি সত্যিই আমার আছ এখনও?’
অভীক সামনে এসে ওর দুই বাহু চেপে ধরে, আবেগ নিয়ে বলে, ‘কুঞ্জল, শেষ পর্যন্ত আমি তোমার কাছেই ফিরে এসেছি। আমি বার বার ভুল করেছি, উচিত হয়নি। মোহে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার নিজের মানসিক দূর্বলতা আছে, কখনও লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করিনি। কিন্তু একটা সময় আমি ফিরে আসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি আমাকে ক্ষমা করোনি, বিশ্বাস করোনি। চেয়ে দেখো আমি তোমারই আছি।’
কুঞ্জল আর পারে না, অভীকের বুকের ভেতর ঢুকে যায়। মনের সব কষ্ট জল হয়ে চোখ ভিজিয়ে দিয়ে যায়। অভীক শক্ত করে ওকে বুকের ভেতর ধরে রাখে।
সেদিন বহুদিন পর ওদের গুমোট সংসারে সুখের সুবাতাস বইতে থাকে। অর্ক অবাক হয়ে দেখে আম্মু বাবার সাথে হাসছে। ওর ছোট্ট মনের ভেতর এতদিনের চেপে থাকা একটা ভয় যেন নিমিষেই মিলিয়ে যায়। আম্মু ওদের ছেড়ে কোথাও চলে যাবে না। বাবা আর আম্মুকে বকবে না, আম্মু কাঁদবে না।
২.
কুঞ্জল ব্যস্ততার সাথে রান্না করছিল। অভীক কাল বাজার থেকে বড়ো শোল মাছ এনেছে, সাথে কচি একটা লাউ। লাউটা চুলোয় দিয়ে মসলা দিয়ে মেখে ঢেকে দেয়। সিদ্ধ হোক। এই ফাঁকে অন্য কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে। ঘড়ির দিকে তাকায়, অর্কের স্কুল ছুটি হতে এখনও অনেকটা সময় বাকি আছে।
কুঞ্জল ফ্রিজের দরজা খুলতে যেতেই বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। কে এল আবার এই সময়। হাত মুছে ও দরজা খুলেই দেখে সেই পুরনো ভাঙাচোরা জিনিসপত্র কেনে যে লোকটা সে। ভাঙাচোরা মুখ, পিঠে সাদা একটা বড়ো বস্তা। ওকে দেখেই এক গাল হেসে বলে, ‘আপা, অনেকদিন পরে আইলাম। এই কয়দিনে নতুন কইরা ভাঙাচোরা কিছু জমে নাই?’
কুঞ্জল আজ প্রাণখোলা হাসি হাসে, ‘না ভাই, এই ক’দিনে ভাঙাচোরা যা ছিল তা জোড়া লেগেছে। তোমাকে দেবার মতো কিছু নেই।’
লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে কেমন আধ্যাত্মিক গলায় বলে, ‘ভাঙাচোরা জিনিস কি আর জোড়া লাগে আপা? একটু জোরে চাপ পড়লেই আবার ভাইংগা যায়।’
কুঞ্জল থমকে তাকায়। এমন করে এই লোকটার কাছ থেকে সত্যটা শুনবে ও ভাবেনি। সেই সোনার চেইন ফিরিয়ে দেবার দিন থেকে প্রথম একটা মাস দারুণ সময় কেটেছে। অভীক যেন সেই পুরনো অভীক হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পর পর যেমন হয়। তারপর একদিন হুট করেই ওর মনের ভেতর চেপে থাকা নোংরা ভাবনাটা বেরিয়ে আসে। সেদিন কুঞ্জলের রান্নার স্কুলের সবাই মিলে বিখ্যাত এক শেফের রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল হাতে কলমে শিখতে। তা সেদিন ওর ফিরতে রাত দশটার মতো বেজে যায়। ওর ক্লাশের সুশীল নামে একটা ছেলে সেদিন ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। সেদিনও কেমন করে যেন সেটা অভীকের চোখে পড়ে যায়। আর সাথে সাথে ওর ভেতরে লুকিয়ে থাকা নোংরা মানুষটা বেরিয়ে আসে। কুৎসিত ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘কী, এখন আবার নতুন প্রেমিক ধরেছ?’
কুঞ্জল সেদিনই বুঝে গিয়েছিল অভীক শোধরাবার না। মন খারাপ করে ক’দিন কথা বন্ধ ছিল ওদের। শেষমেষ আবার ক্ষমা চেয়ে মিল করে। কিন্তু কুঞ্জলের মনটা আর ঠিক হয়নি। ইদানিং ও আগের মতোই দেরি করে বাড়ি ফেরে। প্রায়ই ফোন বিজি পাওয়া যায়। তাতে ওর মনেও সন্দেহ জাগে, অভীক আবার পুরনো পথে পা বাড়ায়নি তো? পুরনো সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলো প্রায়ই হানা দিয়ে যায় – ‘বউ বাসায় আছে সোনা, পরে ফোন দেই’, অথবা শাড়ির অর্ডার নেবার দিনের কথা। মাঝে মাঝেই এই দুঃসহ স্মৃতিগুলো চোরাগোপ্তা হামলা করে, মনের স্বস্তির ঘরটুকু টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিয়ে যায়। ও আবার জোড়া লাগায়, আবার ভেঙে যায়৷
ভাঙাচোরা জিনিসপত্র কিনতে আসা এই সামান্য লোকটা ওকে কত দামি একটা কথা বলে গেল আজ!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটাকে বিদায় দেয়। তারপর দ্রুত রান্না শেষ করে ও অর্কের স্কুলে যায়। ওর ক্লাশ সিক্সের পরীক্ষা চলছে। আর ক’দিন পরেই ক্লাশ সেভেনে উঠবে ও। ছেলেটা বড়ো হয়ে যাচ্ছে। ও বড়ো হলেই ওর মুক্তি, ভাবে কুঞ্জল।
স্কুল থেকে ফেরার পথে কুঞ্জল ছেলের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘বাবা, তুমি তো বড়ো হয়ে যাচ্ছ। এখন থেকে একা একা স্কুল যেতে পারবে না?’
অর্ক মাথা দুলিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ তো আম্মু। আমাদের অনেকেই একা একা আসে। আমি ক্লাশ সেভেনে একা একাই আসতে পারব। এখন থেকে তুমি রান্নার স্কুলে গেলে আর পৃথুল আন্টির বাসায় আমাকে রেখে আসতে হবে না।’
কুঞ্জল থমকে ছেলের মুখের দিকে তাকায়। অর্ক ঠিক ওর মনের কথা বুঝতে পেরেছে। ওর জন্যই এতটা দিন কিছু করতে পারেনি। আর ক’টা মাস পর ওর কোর্স শেষ হলে তখন ও ভালো কোথাও শেফের চাকরির চেষ্টা করবে। আর চাকরি যদি হয়েই যায় তাহলে অর্ককে তখন একাই স্কুলে যেতে হবে। অনেকটা সময় অর্ককে বাসায় একা থাকতে হবে। তাতে করে ওর যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়? হতাশ লাগে ওর। অর্ক ক্লাশ নাইন বা টেনে না ওঠা পর্যন্ত যে ওর মুক্তি নেই। কিন্তু তখনও কি ও মুক্তির পথ খুঁজে পেতে সাহস করে বেরিয়ে পড়তে পারবে?
রাতে অভীক বাসায় ফেরে। সাদামাটা কথা হয়। বাজার সদাই আছে কি-না, ঘরের চাদর পুরনো হয়েছে, দেয়ালটা পেইন্ট করাতে হবে, ইলেক্ট্রিসিটির বিল বাকি সেটা দিতে হবে।
এক ফাঁকে অর্ক বাবার কাছে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাবার আবদার করে। অভীক কথাও দেয়, ওদের নিয়ে এবার ঘুরতে যাবে। তারপর খাওয়া শেষে অভীক টিভির সামনে বসে মনোযোগ দিয়ে খবর দেখতে থাকে। কুঞ্জল রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে ছেলেকে পরীক্ষার পড়া পড়াতে বসে। পড়া শেষে বিছানা করে ওকে ঘুম পাড়িয়ে অভীকের রুমে আসে। ওরা এখন আগের মতো একসাথেই ঘুমোয়।
বাসার সব আলো নিভিয়ে দেওয়াতে কেমন একটা অন্ধকার চারপাশ। অভীক একটা সময় কুঞ্জলকে নিয়মমাফিক কাছে টানে। বেডরুমে কাঠের খাটটা পুরনো হয়েছে। অল্পতেই বড্ড বেশি শব্দ হয়। গভীর রাতে সেখান থেকে একটা নিয়মিত ছন্দে শব্দ আসতে থাকে। একটা সময় শব্দটা দ্রুত হতে থাকে। তারপর পুরুষের ঘন শ্বাসের শব্দের সাথে একটা তৃপ্তির শব্দ ভেসে আসে।
কিছুক্ষণ পর বারান্দা থেকে সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যায়। আদর শেষে সিগারেট খাওয়া অভীকের বহুদিনের অভ্যেস। অভীক সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে ভাবে, কুঞ্জলকে ও আবার নিজের করে পেয়েছে। মাঝখানে কুঞ্জল ওর ছিল না, কেমন দূরে সরে গিয়েছিল। যে কুঞ্জলকে ও হারিয়ে ফেলেছিল আজ সেই কুঞ্জলকে বুঝি নিজের করে ফিরে পেল।
কুঞ্জল গায়ে একটা চাদর জড়ায়। কেন যেন শীত শীত লাগছে। অভীক ঘুমিয়ে পড়েছে, মৃদু নাকও ডাকছে। মুখটা কেমন সুখী সুখী। ওর শরীরের অধিকার ফিরে পাবার আনন্দ ওর চোখেমুখে লেপটে আছে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ও পাশ ফিরে ঘুমোনোর চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম আসে না। না, অভীককে ও মন থেকে ক্ষমা করতে পারেনি। মনের ভেতর যে অবিশ্বাসের ক্ষতটা রয়ে গেছে সেটা যে আর কিছুতেই সারবার নয়। আজ সেই ভাঙাচোরা পুরনো জিনিস কিনতে আসা নিতান্ত সাধারণ লোকটা ওকে আরেকবার সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিয়ে গেছে। বাকি জীবনটা হয়তো এমন প্রেমহীন সংসার করেই কাটিয়ে যেতে হবে।
(সমাপ্ত)