#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১৫)
১.
গ্রীষ্মের শুরুতেই এবার অনেক গরম পড়েছে। রাত আটটা বাজে তবুও গরম কমেনি। একটু হাঁটলেই ঘাম হচ্ছে৷ কুঞ্জল হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখটা মোছে, তারপর অর্কের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাবা, পৃথুল আন্টির বাসায় দুষ্টুমি করোনি তো?’
অর্ক দু’পাশে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘না আম্মু। আমি আর পৃথা অনেক খেলেছি। আন্টি আমাদের এগ টোস্ট ভেজে দিয়েছিল। কিন্তু তোমার এত্ত দেরি হলো কেন আম্মু?’
কুঞ্জল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘মন খারাপ হয়েছে?’
অর্ক আহ্লাদী গলায় বলে, ‘হ্যাঁ আম্মু, তুমি না থাকলে একদমই ভালো লাগে না।’
কুঞ্জলের বুকের ভেতর নরম হয়ে আসে। এটুকু মায়ার জন্যই তো মুখ বুজে সব সহ্য করা। আজ বাসায় ফেরার পর অভীক যে কী করবে ভাবতেই মাথাটা দপদপ করছে। এতদিন তো ওকে বলার মতো কিছু পায়নি, কিন্তু আজ অংশুলকে জড়িয়ে বলার মতো কিছু পেয়েছে। অভীক নিশ্চয়ই এই সুযোগটা ছাড়বে না। কিন্তু একটা জায়গায় স্বস্তি যে অভীক আজ ওর রান্নার স্কুলে যায়নি। এতটা নিচে ও নামেনি। মনে মনে একটু কৃতজ্ঞ বোধ করে।
বাসায় পৌঁছে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে যায়। অভীক যেন ওর অপেক্ষাতেই ছিল। কুঞ্জল ওর দিকে তাকিয়ে একটু চমকে ওঠে। মুখে কয়েকটা ব্যান্ড এইড, ডান হাতের কব্জিতে প্লাস্টার, হাতটা একটা আর্ম স্লিংয়ে ঝোলানো। ইশ, কী করেছে ওরা। এমন করে মেরেছে! এবার সত্যিই রাগ হয় অংশুলের স্টাফদের উপর।
অর্ক ভয় পাওয়া গলায় বলে, ‘বাবা! কী হয়েছে তোমার? ব্যথা পেয়েছ?’
অভীক ছেলের দিকে একবার তাকায়, তারপর চোখ কুঁচকে কুঞ্জলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জল উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘ইশ! এমন করে ব্যথা পেয়েছ? ডাক্তার দেখিয়েছ তো?’
অভীক কর্কশ গলায় বলে, ‘তোমার প্রেমিক তো গুন্ডা পোষে।’
কুঞ্জল ঝট করে তাকায়, কড়া গলায় বলে, ‘খবরদার! ছেলের সামনে একটা বাজে কথা যদি বলেছ আমি এক মুহুর্ত থাকব না বাসায়। যা বলার আমাকে আলাদা বলো।’
অভীক বাঁকা হাসে, তারপর বলে, ‘আমার সময় একথা মনে ছিল না? আমাকে তো ঠিকই ছেলের সামনে লুচ্চা বলেছিলে, আমাকে ছোট করেছ। ওর জানা উচিত ওর মা ভালো না। আরেক লোকের সাথে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ায়। না জানি আর কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়।’
কুঞ্জল তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে ওঠে, ‘অভীক! এত নোংরা আর বাজে কথা বলতে বাঁধছে না তোমার? অর্ক, তুমি ওই ঘরে যাও তো।’
তারপর ও অভীকের দিকে ফিরে বলে, ‘এই রুমে আসো। যা বলার আমাকে বলো। ছেলের সামনে মিথ্যে বলে আমাকে ছোট করো না।’
অভীক মুখ ভেঙচে বলে, ‘মিথ্যে বলেছি আমি? তুমি সেদিন ওই বদমাশটার সাথে মোটরসাইকেলে আসোনি?’
কুঞ্জল এবার সামনে এসে ওর বাম হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে রুমের দিকে নিয়ে যায়। তারপর দরজা বন্ধ করে ওর বাহু খামচে ধরে তীব্র গলায় বলে, ‘এবার বলো, যা খুশি। আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব।’
অভীক মুখ থমথমে করে বলে, ‘ওই লোকের সাথে তুমি কতদূর এগিয়েছ? তোমরা কি বেডেও গেছ?’
কুঞ্জলের মনে হয় এত কুৎসিত কথা ও এই জীবনে শোনেনি। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। নাহ, আর এক মুহুর্ত এই সংসারে থাকবে না। কুঞ্জল ওর দিকে তাকিয়ে ঘৃণার স্বরে বলে, ‘তোমার মুখ নর্দমা হয়ে গেছে। আমি তোমার সাথে সংসার করব না। আজই আমি চলে যাচ্ছি। তুমি তোমার মেঘা, পূর্ণকে নিয়ে সুখে থাকো।’
কুঞ্জল পেছন ঘুরে দরজার লক খুলতে যেতেই পেছন থেকে অভীক ওর হাত টেনে ধরে৷ তারপর হিংস্র গলায় বলে, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেখানে খুশি চলে যাও।’
কুঞ্জল ঘুরে ওর দিকে তাকায়। তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে শক্ত গলায় বলে, ‘সবাইকে নিজের মতো ভাবো কেন? এই নাও আমার মোবাইল। অংশুলের সাথে আমার কী কী কথা হয় সেটা দেখো। কোনো লুকোছাপা নেই। আমার রান্নার পেজ থেকে পরিচয়। সেদিন আমার ম্যারাথন দৌড়ের দিন উনি গিয়েছিল এটা সত্য। কিন্তু সেটা আমি জানতাম না। আর আমার বাসায় ফেরার কথা ছিল আফরোজা আপার সাথে। কিন্তু উনি আসতে দেরি করবেন তাই আমি তাড়াহুড়ো করে অর্কের স্কুলে পৌঁছাতে চাচ্ছিলাম। কোনো কিছু না পেয়ে ওনার মোটরসাইকেলে এসেছিলাম, শুধুমাত্র তাড়াতাড়ি আসার জন্য।’.
অভীক এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর গম্ভীরমুখে বলে, ‘তাহলে সেদিন মিথ্যে বলেছিলে কেন যে তুমি ‘পাঠাও’য়ে এসেছ?’
কুঞ্জল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘ওটাই ভুল হয়েছে। তোমাকে সত্যটা বলা উচিত ছিল। আমি সেজন্য ক্ষমা চাইছি। কিন্তু এর বাইরে একটা বাজে কথা বললে আমি মেনে নেব না।’
অভীক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, বিশ্বাস করার মতো কিছু একটা খোঁজে। কুঞ্জল কখনও ওর সংগে মিথ্যে বলেনি। ওর মতো নিতান্ত গৃহিণী একটা মানুষ এমন করেছে ও ভাবতেই পারেনি। এতদিন বাসা আর স্কুল, এই পর্যন্ত ছিল ওর গন্ডী। এখন ম্যারাথন দৌড়ুচ্ছে, রান্না শিখতে যাচ্ছে। সেখানেও তো কত মানুষের সাথে পরিচয় হবে। ও কি কুঞ্জলকে আটকে রাখতে পারবে?
অভীক গম্ভীরমুখে বলে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সব বিশ্বাস করলাম। কিন্তু কাল থেকে তুমি আর রান্নার স্কুলে যাবে না। লাগলে অনলাইনে শিখে নাও। আর তোমার হাতের রান্না তো এমনিতেই অনেক ভালো। কী দরকার ওসব শিখে?’
কুঞ্জল বিষণ্ণ একটা হাসি হেসে বলে, ‘তুমি ভুল বুঝছ। আমি বাসায় রান্নার জন্য শিখছি না। আমি এই লাইনে ক্যারিয়ার করব।’
অভীকের হঠাৎ করেই শেফ অংশুলের কথা মনে পড়ে যায়। ও বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বলে, ‘তার মানে তুমি ওই অংশুল হারামজাদার মতো বাবুর্চি হবে?’
কুঞ্জল উত্তপ্ত গলায় বলে, ‘উল্টোপাল্টা কথা বলবে না। আমি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য শেফ হচ্ছি।’
অভীক তেড়ছা গলায় বলে, ‘তা এতদিন পর বুঝি মনে হলো নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা?’
কুঞ্জল ম্লান হাসে, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ বড্ড দেরি হয়ে গেল। তোমাকে একদিক থেকে ধন্যবাদ দেবার আছে। সত্যি কথা বলতে তুমিই আমার চোখ খুলে দিয়েছ যে আমার নিজের পায়ে দাঁড়ানো দরকার।’
অভীক ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আমি!? সেটা কী করে?’
কুঞ্জল ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘যেদিন জানলাম তুমি অন্য কারও সাথে জড়িয়ে পড়ছ সেদিন ধাক্কা খেলাম। এরপর আবার। দেখলাম, তুমি শুধরাবে না। আমার তখন মনে হয়েছিল এই সংসার ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু পারিনি। তার জন্য নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দরকার।’
অভীক জীবনে এত অবাক হয়নি। ও কখনও ভাবেনি কুঞ্জল ওকে ছেড়ে চলে যেতে পারে।
অভীক অবাক গলায় বলে, ‘তারমানে তুমি নিজের পায়ে দাঁড়ালে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?’
কুঞ্জল ওর অবাক হওয়া মুখটা দেখে। কোনোদিন এমন ধাক্কা আসতে পারে অভীক হয়তো ভাবেনি। সবকিছু নিঃশর্ত সমর্পণ বলে ধরে নিয়েছিল। জানত, ওর যাবার জায়গা নেই। তাই বুঝি আজ এমন অবাক হয়েছে। কুঞ্জলের খুব মজা লাগে, ও কপাল কুঁচকে বলে, ‘তোমার কি মনে হয় না তোমাকে ছেড়ে যাওয়া উচিত? আচ্ছা, আমি রান্না চড়াই, অর্ক না খেয়ে আছে।’
অভীক ফ্যালফ্যাল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই কুঞ্জলকে ও চেনে না। ওর চোখেমুখে একটা দৃঢ়তা যা ভয় পাইয়ে দেবার মতো।
দরজা খুলতেই অর্ককে দেখতে পায়। মুখটা ভয়ে শুকিয়ে গেছে। মাকে দেখে এক দৌড়ে কাছে আসে, তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, ‘আম্মু!’
বুকের ভেতর কষ্টের ঠোকাঠুকি টের পায়। আহারে আমার সোনা বাচ্চা। আমরা বড়োরা কেন এত জটিল? আমাদের জটিলতায় বাচ্চারা কেন কষ্ট পাবে? অর্ক কি কোনোদিন ওর বাবা মাকে মন থেকে সম্মান করবে? ভবিষ্যতে কোনো সম্পর্কে কি ও সুখী হতে পারবে?
কুঞ্জল ওর কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘কিচ্ছু হয়নি বাবা। তোমার বাবা হাতে ব্যথা পেয়েছে তো তাই ঠিক করে দিলাম। যাও, বাবার কাছে গিয়ে বসো। আমি রান্না করব।’
কুঞ্জল দ্রুত ফ্রিজ থেকে মাছের একটা বক্স বের করে পানিতে ডুবিয়ে রাখে। মাছ ছাড়তে সময় লাগবে। এই ফাঁকে ও পেয়াঁজ কেটে নেয়। পেয়াঁজের ঝাঁঝে চোখ জ্বালা করে ওঠে, জলে ভরে ওঠে চোখ। তারপর জল গড়াতেই থাকে সেটা শুধু পেঁয়াজের ঝাঁঝের জন্য নাকি সংসারের ঝাঁঝের জন্য সেটা ঠিক বোঝা যায় না।
কুঞ্জল পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে মাছগুলো ভেজে গরম গরম ভাত বেড়ে ওদের ডাক দেয়। অর্ক বাবাকে হাত ধরে নিয়ে এসে বসে। কুঞ্জল ওদের ভাত বেড়ে দেয়।
অর্ক চিন্তিত গলায় বলে, ‘আম্মু, বাবা খাবে কী করে? বাবার হাতে তো ব্যথা।’
কুঞ্জল আড়চোখে একবার তাকায়, তারপর একটা টেবলচামচ আর কাঁটাচামচ দেয়। অর্ক আগ্রহের সাথে দেখতে থাকে বাবা কেমন করে খায়।
অভীক বাম হাতে চামচ নিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বসে থাকে। চামচ দিয়ে এক হাতে মাছ খাবে কী করে? ও রাগের সাথে বলে, ‘আমি মাছ খাব না। একটু ডাল দাও।’
কুঞ্জল একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘আচ্ছা, চামচটা দাও। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
অর্ক চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘আম্মু, তুমি বাবাকে খাইয়ে দেবে! আমাকেও খাইয়ে দিতে হবে।’
অভীক অবিশ্বাস নিয়ে কুঞ্জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন যেন মনে হচ্ছে কুঞ্জল ওকে ছেড়ে কখনোই চলে যাবে না।
সেদিন রাতে কুঞ্জল ঘুমিয়ে পড়ার আগে ভাবে, কী করবে ও এখন? ভেবেছিল চুপচাপ ক’টা বছর পার করে দেবে। কোর্সটা শেষ করে কোথাও চাকরি পেয়ে থিতু হলে তখন না হয় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। অংশুল ভরসা দিয়েছিল পাশে থাকবে। কিন্তু এখন আর সে পরিস্থিতি রইল না। অংশুল নিশ্চয় এখন নিজের ক্যারিয়ার বাঁচাতে ওকে ভুলে যাবে। তাহলে ও কি রান্নার কোর্সটা শেষ করতে পারবে না? আরও দুটো কিস্তি বাকি আছে। এই টাকাটা ও অভীকের কাছ থেকে কিছুতেই নেবে না। কিন্তু এত টাকা ও কোথায় পাবে? ইশ, এত বাধা কেন আসে? আসলে জীবনে একবার পিছিয়ে পড়লে কিছুতেই আর এগিয়ে যাওয়া যায় না।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মনটা অস্থির হয়ে যায়। বহুদিন সাইফুল্লাহ স্যারের সাথে দেখা হয় না। কাল ওনার সাথে দেখা করতে যাবে। কেন যেন ওনার সাথে কথা বললে মন ভালো হয়ে যায়। জীবনের ঠিকঠাক পথটা ও খুঁজে পায়।
২.
আজ কুঞ্জল ফোন করেই এসেছে। সাধারণত সকালে ওনাকে পাওয়া যায়ই। তারপরও আজ কোনো ঝুঁকি নেয়নি কুঞ্জল। আজ যে পেতেই হবে ওনাকে। সদর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ও থমকে যায়। সাইফুল্লাহ স্যারকে দেখা যাচ্ছে। ঠিক দেখা যাওয়া যাকে বলে তা না। ওনার কাঁধের একপাশ, হাত। বাকিটা দেখা যাচ্ছে না। কারণ একটা মেয়ে পেছন থেকে স্যারের মাথায় চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। কুঞ্জল ইতস্তত করে, ও কি ভুল সময়ে চলে এল? চলে যাবে?
চলে যেতে পা বাড়াতেই মেয়েটা ঘুরে তাকায়, তারপর শুদ্ধ উচ্চারণে ওর নাম ধরে ডাকে, ‘কুঞ্জল আপু।’
কুঞ্জলের পা থেমে যায়, বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কম বয়েসী একটা মেয়ে, সাদা একটা টপস, আর জিন্স পরা। কে এই মেয়েটা যে ওর নাম জানে? আর মেয়েটা স্যারের মাথায় বিলি কাটছে, কাছের কেউ?
এবার সাইফুল্লাহ ঘুরে তাকিয়ে বলে, ‘কুঞ্জল এসেছ। আসো আসো। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। বলো তো ও কে?’
কুঞ্জল কাছে এসে মেয়েটার দিকে তাকাতেই বুঝে ফেলে এটা স্যারের মেয়ে। চেহারায় মিল আছে। ও বিস্মিত গলায় বলে, ‘আপনার মেয়ে এসেছে বিদেশ থেকে, বলেননি তো।’
এবার মেয়েটা ওর সামনে এসে হাত ধরে, ‘আপু আমি সারাহ, ইউএসএ তেই গ্রাজুয়েশন করছি কম্পিউটার সাইন্সে। বাবা বলছিল আপনি আসবেন। আপনার হাতের রান্না নাকি মায়ের মতো। একদিন আমাকে খাওয়াবেন?’
কুঞ্জল বুকের ভেতর মায়া টের পায়। এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বলে, ‘তুমি যা যা খেতে চাও আমাকে আজই বলে দেবে। আমি আরেকদিন রান্না করে নিয়ে আসব। আজও এনেছিলাম। তুমি এসেছ জানলে অনেক বেশি কিছু করে নিয়ে আসতাম।’
সারাহর দু’চোখ ভিজে আসে, ‘আপনি আমাকে কখনও দেখেননি, অথচ এক মুহুর্তেই কত আপন করে নিলেন। আপনার নামটাও মায়ের সাথে মিলে যায়। কুঞ্জল নামের মানুষ বুঝি মায়াময় হয়?’
কুঞ্জল টের পায় ওর মন ভালো হতে শুরু করছে। সেইসাথে আফসোস হয়, ওর জীবন এমন মায়াময় হলো না কেন?
ওরা তিনজন বসতেই রান্নার লোকটা চা দেয়। কুঞ্জল ওকে খাবারগুলো বুঝিয়ে দিয়ে সাইফুল্লাহর দিকে ঘুরে বলে, ‘আজ ছুরি শুটকির ভর্তা, চিংড়ির পাতুরী নিয়ে এসেছি। আপনি কাল বললেন না কেন সারাহ এসেছে। তাহলে আরও কিছু করে নিয়ে আসতাম।’
সাইফুল্লাহ মিটিমিটি হাসে, হালকা গলায় বলে, ‘ভাবলাম আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দেই।’
এরপর ও সারাহর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে। তারপর একটা পর্যায়ে সারাহ বলে, ‘আপনি বাবার সাথে কথা শেষ করে নিন। তারপর দুপুরে একসাথে খাব।’
কুঞ্জল হাসে, ‘হ্যাঁ, তোমার বাবার সংগে কথা শেষ করে নেই।’
সারাহ ভেতরে চলে যেতেই সাইফুল্লাহ ওর দিকে নরম চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কী খবর তোমার?’
কুঞ্জল দু’হাতে মুখ রেখে বলে, ‘একটা ভালো খবর আছে একটা খারাপ খবর আছে আপনার জন্য।’
সাইফুল্লাহ আগ্রহ নিয়ে বলে, ‘আগে ভালো খবরটা শুনি। তাতে করে খারাপ খবর হজম করতে সহজ হবে।’
কুঞ্জল হাসে, তারপর উৎসাহের সাথে বলে, ‘আমি ইন্টারন্যাশনাল কালিনারি ইন্সটিটিউটে এক বছরের একটা কোর্সে ভর্তি হয়েছি। যেহেতু রান্না ভালোবাসি তাই ভাবলাম শেফ হব। ক্লাশ শুরু করেছি কয়েকদিন হলো।’
সাইফুল্লাহ টেবিল চাপড়ে বলে, ‘বাহ, এটা তো দারুণ খবর। আমি জানতাম তোমার ভেতর আগুন আছে। একটু জ্বালিয়ে দিলে সেটা আলো দেবে।’
কুঞ্জল বিষণ্ণ হাসে, তারপর বলে, ‘আবার পুড়িয়েও দিতে পারে৷ অভীক গত সপ্তাহে ভীষণ বাড়াবাড়ি করেছে।’
সাইফুল্লাহ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কী করেছে আবার?’
কুঞ্জল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘অংশুলের কথা তো আপনাকে বলেছিলাম। ওর সাথে আমার ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়েছিল। সত্যি বলতে ও আমাকে রান্নার কোর্সে ভর্তি হতে বলল। যাতে ভালো কিছু একটা করতে পারি। আর এতে বিপদ যা হবার হলো। অভীক ভাবল আমি অংশুলের সাথে প্রেম করছি। তাই নিয়ে ও তুলকালাম কান্ড করেছে। অংশুলের রেস্তোরাঁয় মারামারি করে হাত ভেঙে এসেছে। আমাকে যা তা বলেছে এই নিয়ে। আচ্ছা বলেন তো, ও কেন এমন করল?’
সাইফুল্লাহর চোখে কৌতুক খেলা করে। ও মৃদু হেসে বলে, ‘যতদূর মনে পড়ে আপনিও একই কাজ করেছিলেন। অভীকের বান্ধবীর অফিসে যেয়ে কথা শুনিয়ে এসেছিলেন। কেন করেছিলেন?’
কুঞ্জল মাথা নিচু করে বলে, ‘আমি আসলে দেখতে চেয়েছিলাম ও কেন আমাকে ছেড়ে ওই মেয়ের প্রেমে পড়ল।’
সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘উহু, শুধু সেজন্য যাননি। আপনার একটা অধিকারবোধ ছিল। আপনি অভীককে কারও সাথে ভাগ করে নিতে চান না। কেউই চায় না। অভীকও আপনাকে অন্য কারও সাথে ভাগ করে নিতে চায়নি। তাই ও এমন করেছে। তার মানে হলো, আপনারা দু’জন এখনও দু’জনকে কারও সাথে ভাগ করে নিতে পারছেন না। সেজন্যই অন্য কেউ কাছাকাছি এলেই ঈর্ষা হচ্ছে। যেদিন এটা হবে না সেদিন বুঝবেন সম্পর্কটা মরে গেছে। আপনাদের সম্পর্কটা দারুণভাবে বেঁচে আছে। অভীক যে এই বয়সেও আপনার জন্য মারামারি করে এসেছে এটা শুনে আমার খুব ভালো লাগছে।’
কুঞ্জলের চোয়াল ঝুলে যায়, অবাক গলায় বলে, ‘আপনার ভালো লাগছে? সামান্য ব্যাপার নিয়ে এমন তুলকালাম কান্ড কেউ করে?’
সাইফুল্লাহ কৃত্রিম গম্ভীরমুখে বলে, ‘আমি হলে এর চেয়ে বেশি করতাম। আপনার মতো এমন মিষ্টি একটা মুখের জন্য যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেওয়া যায়।’
কুঞ্জল ফিক করে হেসে ফেলে। এই লোকটা জাদু জানে। কেমন মন খারাপের গল্পের মাঝেও
ওর মনটা ভালো করে দিল। অভীকের সত্যিই ওর জন্য এখনও এত টান আছে? বিশ্বাস হয় না। টান থাকলে অমন কুৎসিত কথা কেউ বলতে পারে?
কুঞ্জল আনমনে বলে, ‘আচ্ছা, মানুষের কাছে শরীর বড়ো না মন বড়ো?’
সাইফুল্লাহ নির্দ্বিধায় বলে, ‘মানুষের কাছে শরীর বড়ো। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন আপনি কাউকে মনের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসেন তাতে এই পৃথিবীর কেউ আপনাকে দোষ দেবে না কিংবা কোনো কাঠগড়ায় তুলবে না। কিন্তু শরীর দিয়ে ফেললেই সবাই আপনাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।’
কুঞ্জল মাথা নিচু করে। ওর উত্তর পেয়েছে। অভীক গত এক সপ্তাহে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার যেকথাটা জানতে চেয়েছে সেটা হলো ও শারীরিকভাবে জড়িয়েছে কি-না। মানুষ কী আজব একটা প্রাণি। মন দিয়ে ফেললে কোনো পাপ নেই। শরীর দিলেই যত পাপ।
ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আগে আমি ওকে বিশ্বাস করতাম না। এখন ও আমাকে বিশ্বাস করে না। বলতে পারেন আমরা দু’জন কী করে একসাথে থাকি?’
সাইফুল্লাহ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এটা খুব শক্ত। বিশ্বাসটা না থাকলে অযথা ভুল বোঝাবুঝি হবে। আর সেটা থেকে তীব্র সন্দেহ, ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকবে। এটা একটা সময় পর্যন্ত হতে থাকবে। বিশ্রী কিছু ঘটনা ঘটবে। তারপর সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে।’
কুঞ্জল বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘কী করে ঠিক হবে? যেখানে বিশ্বাসটাই নড়বড়ে। আমার প্রতি ওর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই।’
সাইফুল্লাহ ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘যদি আপনারা সত্যিই আর এমন কিছুতে না জড়ান, তাহলে একটা সময় পর আবার নতুন করে বিশ্বাস ফিরে আসবে। সেজন্য সময় দিতে হবে।’
কুঞ্জল মুখ শক্ত করে বলে, ‘আমি অবিশ্বাসের কিছু করিনি।’
সাইফুল্লাহ মাথা নাড়ে, ‘তা হয়তো করেননি। কিন্তু অংশুল আপনার জন্য বিপদজনক পথ ছিল। আপনি তো জানতেন এখানে ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। অংশুল মনের দিক থেকে এগোচ্ছিল, আপনি বাধা দেননি। জীবন চলার পথে এমন অনেক খানাখন্দ থাকে। সচেতনভাবে সেই পথ এড়িয়ে যেতে হয়। না হলে যেকোনো সময় তাতে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।’
কুঞ্জল এবার মাথা নিচু করে। হ্যাঁ, অংশুল ওর দিকে ঝুঁকছিল। আর তাতে ওরও ভালো লাগছিল। একটা অনুচ্চারিত সম্পর্ক হয়তো ছিল। কিন্তু ও তো কোনো সীমারেখা অতিক্রম করেনি। একটা মানুষের ব্যক্তিত্ব, মায়া ভালো লাগতেই পারে। তাতে কি অপরাধ হয়?
কুঞ্জল মুখ তুলে বলে, ‘আপনার কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু যে বিশ্বাস একবার ভেঙে গেছে তা আর জুড়বার নয়। এই প্রেমহীন সংসারে আমার দম আটকে আসছে।’
সাইফুল্লাহ হাসে, তারপর বলে, ‘সংসার কিন্তু এমনই। এর শুরু হয় দারুণ প্রেম দিয়ে। একটা সময় সেই প্রেম থিতু হয়ে বাস্তবতা সামনে আসে।জীবন নানান চাহিদা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় – তাতে টানাপোড়েন এর সৃষ্টি হয়। সম্পর্ক তেতো হতে থাকে। আবার মাঝে মাঝে এমন দু’একটা মায়ার দেখা পাবেন যেটা আপনি সংসার ছাড়া অন্য কোথাও পাবেন না। এই একটা দুটো স্বর্গীয় মায়ার জন্য মানুষ সংসারে আটকে থাকে, অনেকটা চুক্তিবদ্ধ মানুষের মতো।’
কুঞ্জল চেয়ে থাকে। ও যখন আট মাসের প্রেগন্যান্ট তখন এত গরম লাগত যে ঘুমোতে পারত না। ভাদ্র মাস ছিল, প্রায়ই বিদ্যুৎ থাকত না। আর্থিক অবস্থা এমন ছিল যে বাসায় একটা আইপিএস পর্যন্ত ছিল না। তখন অভীক সার রাত হাত পাখা ঘুরিয়ে বাতাস করত। বেচারা এক ফোঁটা ঘুমোতে পারত না। পরদিন ঘুম ঘুম চোখে অফিস যেত। সেই মানুষটা কি করে পালটে গেল? তাহলে ওরও কিছু অবহেলা ছিল? নিজের খামতিগুলো নিয়ে ও কখনই খতিয়ে দেখেনি।
সাইফুল্লাহ নরম গলায় বলে, ‘আপনি যেমন আমার কাউন্সেলিং নিচ্ছেন ঠিক তেমনি অভীকেরও কাউন্সেলিং প্রয়োজন। ওর বিক্ষিপ্ত মনটার মেরামতি দরকার।’
কুঞ্জল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘মেরামতি করা মন দিয়ে কি সংসার হয়?’
সাইফুল্লাহ ব্যথিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর আশ্বস্ত করে বলে, ‘শরীরের অসুখ করলে যেমন চিকিৎসা নিতে হয়, মানুষ সুস্থ হয়ে ওঠে, তেমনি মনেরও চিকিৎসা নিলে অনেকটাই ঠিক হয়ে যায়।’
কুঞ্জল কথাটা বিশ্বাস করতে চায়, অভীক ভালো হয়ে যাবে। ওদের অর্কসোনা আর কোনোদিন ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে না। ও প্রাণভরে জীবনের সুবাতাস নিতে পারবে।
(চলবে)