#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১৩)
১.
দুপুরের খাবার শেষে কেমন একটা ঝিমুনি আসে অভীকের। চাকরিতে ঢোকার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুরে ভাত খেয়ে একটা ভাতঘুমের অভ্যেস ছিল। ওর মনে পড়ে যায়, সেই ছোটবেলায় মা দুপুরের খাওয়া শেষে ওদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে বিকেল অব্দি ঘুমোত। বাবা আসত সন্ধ্যে বেলা। ছোট একটা চাকরি করত। এসেই খেয়েদেয়ে ওদের নিয়ে পড়তে বসত। রাত দশটার মধ্যে সবাই বিছানায়। ওর কোনোদিন মনে পড়ে না মা বাবার মাঝে এমন তৃতীয় পক্ষের সংগে অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে কখনও ঝামেলা হতে দেখেছে। ওর আশেপাশের বন্ধুদের বাবা মায়ের ক্ষেত্রেও এমন শুনেনি। কিন্তু ওর বেলায় এমন হলো কেন? যুগ পালটে গেছে, তাই? ইন্টারনেটের যুগে মানুষের যোগাযোগ বুঝি খুব বেশি সহজ হয়ে গেছে। তাই সুযোগ পেলেই অমন জড়িয়ে পড়ছে। আচ্ছা, ওর বাবা মায়েরা কি সুযোগের অভাবে সৎ ছিলেন? নাহ, কীসব পাপ ভাবনা ভাবছে। মনটাই পচে গলে গেছে। মন শোধরাবার যন্ত্র কোথায় পায়?
এমন সময় অফিস কলিগ পাশা ওর কাঁধে হালকা করে ধাক্কা দেয়। ঘুমের ঝিমোনি কেটে যায়, ও চোখ খুলে তাকাতেই পাশা দুষ্ট গলায় বলে, ‘কী বন্ধু, রাতে মনে হয় কাজকাম বেশি হইছে? ঘুমাচ্ছিস যে।’
অভীক ম্লান হাসে। কাজকাম মানে বউকে আদর করার কথা বলছে পাশা। ও মাঝে মাঝেই এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চায়। অভীক এড়িয়ে যায়। কতদিন ওর কুঞ্জলের সাথে কিছুই হয় না? সম্পর্কের ভিতে শরীরের একটা ব্যাপার হয়তো থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘নাহ, রাতে আসলে ঘুম হয়নি। তোর কী খবর তাই বল?’
পাশা ওর পাশে বসতে বসতে বলে, ‘আমার খবর ভালো। তোর কাছে একটা কাজে এলাম। সামনের সপ্তাহেই তো পহেলা বৈশাখ। আমাকে একটা সুন্দর দেখে পহেলা বৈশাখের শাড়ি কিনে দে। তুই তো মাঝে মাঝে অনলাইনে শাড়ি কিনতি। সেখান থেকে একটা অর্ডার কর।’
অভীক চমকে ওঠে। মেঘার কথা মনে পড়ে যায়। এই শাড়ি কেনা নিয়েই অশান্তির শুরু। এত আগ্রহ করে কেনা শাড়ি যে একসময় গলার ফাঁস হবে তা ভাবেনি কখনও। পাশাকে সতর্ক করতে হবে। ও কার জন্য শাড়ি কিনছে?
অভীক গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘দোস্ত, কার জন্য শাড়ি কিনছিস?’
পাশা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কার জন্য মানে? তোর ভাবির জন্য। এখন তোর সেই শাড়ির পেজটা খোল, আর তাড়াতাড়ি অর্ডার কর।’
অভীক থতমত খেয়ে যায়, আসলেই ওর মনটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সবাইকে ওর মতোই ভাবে। ও এবার দ্রুত ফেসবুক ব্রাউজ করে কয়েকটা শাড়ির পেজ থেকে ওকে লাল সাদা শাড়ি দেখায়। প্রতিটি পেজে এখন নববর্ষের শাড়ির অফার।
পাশা একটা লালের উপর গোল্ডেন কাজের পাড় শাড়ি পছন্দ করে। দামটাও বেশ কম। অভীক অর্ডার কনফার্ম করতেই পাশা অবাক গলায় বলে, ‘হয়ে গেল? এত সহজ? এই অভীক, তোর ভাবি তো একটু স্বাস্থ্যবান, শাড়িটা হবে তো? মানে এক্সএল শাড়ি অর্ডার করেছিস তো?’
অভীক হো হো করে হেসে ফেলে, ‘এই গাঁড়ল, শাড়ির আবার সাইজ হয় নাকি। তুই বুঝি জীবনেও শাড়ি কিনিসনি?’
পাশা একটা বোকা হাসি হাসে, ‘আমার এই কেনাকাটা করতে গেলেই গোলমাল লাগে। এটা ওর ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু এবার মনে হলো ওকে চমকে দেই। আমি ভাবছি শাড়ি পেলে ওর মুখের অবস্থা কেমন হবে। এই প্রথম আমি নিজে শাড়ি কিনছি ওর জন্য।’
অভীক ওর সারা মুখে একটা দাম্পত্য সুখের ছায়া দেখতে পায়। পাশা চলে যায়, আর অভীক ওর জীবনের গভীর দাম্পত্য অসুখ নিয়ে ভাবতে থাকে। তারপর কী মনে হতে বিকেলের দিকে একটা সবুজ জমিনের সাথে লালচে গোলাপি পাড়ের শাড়ি অর্ডার করে। যদিও এর আগেরবার শাড়ি নিয়ে যাওয়াতে উলটো ফল হয়েছিল। কিন্তু এতদিনে নিশ্চয়ই সেই রাগটা আর নেই। শাড়িটা অর্ডার করে অভীকের মনটা ভালো হয়ে যায়। এবারের নববর্ষে ও নতুন করে জীবন শুরু করবে। কুঞ্জলকে আর অমন দূরে দূরে থাকতে দেবে না।
অভীক শাড়িটা হাতে পায় পহেলা বৈশাখের ঠিক আগেরদিন। এই ক’টা দিন একটা উদ্বেগ ছিল শাড়িটা আদৌও পহেলা বৈশাখের আগে পাবে কি-না। শেষ পর্যন্ত হাতে পেয়ে মন শান্ত হয়।
অভীক সেদিন অফিস থেকে আগেই বের হয়। বসন্তের শেষ দিন আজ। যদিও গরম পড়ে গেছে অনেক আগেই, তবুও আজ রাস্তায় পা দিয়েই মন ভালো হয়ে যায়। একটা মাতাল হাওয়া শরীরে লাগে। ঘর ফেরতা মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা সুখ আজ তাদের চোখেমুখে। অভীক নিজেকে সুখী ভাববার চেষ্টা করে।
মাগরিবের আজান যখন পড়ে তখন অভীক বাসায় এসে পৌঁছে। কলিং বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ। কেউ ওপাশ থেকে দরজা খোলে না। ও অধৈর্য হয়ে বার বার কলিংবেল বাজায়, কিন্তু তারপরও দরজাটা বন্ধই থাকে। মেজাজ চড়ে যাচ্ছে, টের পায় অভীক। বিরক্তি নিয়ে ব্যাগ থেকে চাবি বের করে লক খোলে। দরজার হাতল ঘোরাতেই ও অবাক হয়ে দেখে পুরো বাসা অন্ধকার। বুকটা কেঁপে ওঠে অভীকের। ওরা কই? হাতড়ে হাতড়ে ও লিভিং এর বাতি জ্বালে। তারপর মরিয়া গলায় ডাকে, ‘অর্ক, কোথায় তোমরা।’
কারও সাড়া আসে না। ও দ্রুত রুমগুলো, বাথরুম, রান্নাঘর – সব খুঁজে দেখে। নেই, কোথাও ওরা নেই। তারমানে ওরা বাইরে কোথাও গেছে? ওকে তো কিছু বলেনি, অন্তত একটা মেসেজ দেয়নি। কুঞ্জল ফোন না দিলেও অন্তত মেসেজ তো দেয়।
শাড়ির প্যাকেট রেখে ও ফোন বের করে। বার বার নিজেকে বোঝায়, মাথা ঠান্ডা রাখবে। ফোনটা কয়েকবার বেজে থেমে যায়। আবার ফোন দেয়, এবারও কুঞ্জল ধরে না। রাগটা টের পায় অভীক। মুখ গম্ভীর করে ও সোফায় বসে। নাহ, আজকে এই ঝামেলার একটা বিহিত করে ফেলতে হবে। অনেক সহ্য করেছে।
কুঞ্জলের মনটা আজ খুব ভালো লাগছে। শেষ পর্যন্ত ও সাহস করে ইন্টারন্যাশনাল কালিনারি ইন্সটিটিউট এ ভর্তি হয়েছিল। আজ ছিল তার প্রথম দিন। সবার সাথে পরিচিতি, এখানে পড়ার উদ্দেশ – এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো আজ। বিশেষ করে ওর কোর্সের চীফ ইন্সট্রাকটর মাস্টার শেফ ড্যানিয়েল স্যারের দুটো কথা ওর ভীষণ ভালো লেগেছে। রান্নার প্রতি তীব্র আগ্রহ সেই সাথে কঠোর পরিশ্রম একজন শেফের সাফল্যের চাবিকাঠি। তা পরিশ্রম করতে ওর দ্বিধা নেই। এখন আফসোস হয় কেন আগেই নিজের জীবন নিয়ে ভাবেনি ও।
অর্ক মায়ের হাত ধরে টান দেয়, ‘আম্মু, আমরা চলে এসেছি তো।’
কুঞ্জলের ভাবনায় ছেদ পড়ে। ও তাকিয়ে দেখে বাসার কাছের গলিতে চলে এসেছে। আজ প্রথম দিন, তাই অর্ককে সাথেই নিয়ে গিয়েছিল। অভীককে এখনও বলা হয়নি। আজ বলতে হবে, মানে জানিয়ে রাখা আর কি। সপ্তাহে মোটে দুটো দিন, তার একটা আবার ছুটির দিনে। সেদিন অভীক একটু অর্ককে দেখে রাখবে। আর বাকি দিনটা পৃথুলের কাছে রেখে আসবে।
লিফট বেয়ে উঠতেই ও অবাক হয়ে খেয়াল করে দরজা হালকা করে খোলা। বুকটা ধক করে ওঠে, চোর ঢুকল না তো!
ওদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে অভীক গম্ভীরমুখে দরজা খুলে দাঁড়ায়, চোখে রাগী দৃষ্টি। কুঞ্জল একটু থতমত খেয়ে যায়, অস্ফুটে বলে, ‘তুমি কখন এসেছ?’
কথাটা বলেই হঠাৎ ওর মনে পড়ে যে ও তো অভীকের সাথে কথা বলে না।
অর্ক বাবার মুখ দেখে সংকুচিত হয়ে যায়, ক্ষীণ গলায় বলে, ‘বাবা, আমরা আম্মুর স্কুলে গিয়েছিলাম।’
ওরা ভেতরে ঢুকতেই অভীক ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আম্মুর স্কুল মানে? তোমরা যে বাইরে যাচ্ছ, আমাকে একবার বলবে না?’
কুঞ্জল হাতের ব্যাগ নামিয়ে রাখতে যেতেই শাড়ির প্যাকেটের দিকে নজর যায়। অভীক শাড়ি এনেছে ওর জন্য?
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে ও বলে, ‘অর্ক, তুমি হাতমুখ ধুয়ে ফেল। আমি নাস্তা বানাচ্ছি, বাবার সাথে খাবে।’
অভীকের মাথায় রাগটা বাড়ছিল। ও চাপা গলায় বলে, ‘আমি জিজ্ঞেস করেছি তোমরা কোথায় গিয়েছিলে, উত্তর দিচ্ছ না যে?’
অভীকের কর্তৃত্বের গলায় এমন জিজ্ঞাসা করাটা কুঞ্জলের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়। ও কঠিন মুখে বলে, ‘তোমাকে সব বলে যেতে হবে?’
অভীক মুখচোখ শক্ত করে বলে, ‘অবশ্যই আমাকে বলে যেতে হবে।’
কুঞ্জল স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘তুমি ভুল ভাবনায় আছ। তোমাকে জানিয়ে যাবার দিন ফুরিয়েছে। তারপরও যেহেতু জানতে চেয়েছে বলছি। আমি একটা কালিনারি ইন্সটিটিউটে শেফ কোর্সে ভর্তি হয়েছি। এক বছরের কোর্স। সপ্তাহে দু’দিন। বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। শুক্রবার আর মঙ্গলবার। শুক্রবার দিন বাবু তোমার কাছে থাকবে আর মঙ্গলবার আমি পৃথুলের কাছে রেখে যাব।’
কোথাও একটা ভূমিকম্প হলেও অভীক বুঝি এত অবাক হতো না। ও অবিশ্বাস নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর চোখমুখ কুঁচকে বলে, ‘কিসে ভর্তি হয়েছ? বাবুর্চি হবার জন্য? মানে ওই ছেলেমানুষদের সাথে হোটেলে রান্না করবে? নষ্টামি করতে সুবিধা হয়, তাই না?’
কুঞ্জলের গায়ে যেন কেউ বিছুটি পোকা ছেড়ে দেয়। নিজেকে আর সামলাতে পারে না, চিৎকার করে বলে, ‘একটা বাজে কথা বলবা না। নিজে নষ্ট মানুষ তাই সবাইকে নষ্ট মনে করো। আমি রান্না ভালোবাসি, তাই সেটা ভালো করে শিখতেই গিয়েছি। এতে অন্যায়টা কী?’
অভীক সত্যিই কোনো কারণ খুঁজে পায় না। তবুও ও গোঁয়ারের মতো বলে, ‘এইসব শেখার কী দরকার? তুমি কি হোটেলের শেফের চাকরি করবে?’
কুঞ্জল লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি এই কোর্স শেষ করে সুযোগ পেলে তাই করব। শেফ পেশায় আমার ক্যারিয়ার করব।’
অভীক মুখ ভেংচে বলে, ‘ভদ্র বাড়ির মেয়েরা এমন হোটেলের বাবুর্চি হয় না।’
কুঞ্জল তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘আর ভদ্র বাড়ির ছেলেরাও বউ রেখে পরনারীদের সংগে প্রেম করে না।’
অভীক রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ‘কথা অন্য দিকে নিয়ে যাবে না। ঐটা আমার অতীত৷ আমি এখন ভালো হয়ে গেছি। তাই তুমি এসব কাজ করতে পারবে না।’
কুঞ্জল এক পা সামনে এগোয়, ‘আমি করবই, পারলে তুমি ঠেকিও।’
অভীক আগুন চোখে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জল ঘুরে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। শব্দ করে হাড়িপাতিল বের করে। তারপর নুডলস বের করে। গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে হাড়িতে পানি গরম দেয়। এক দৃষ্টিতে ও দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছে করছে সব পুড়িয়ে দিতে।
অর্ক চুপ করে ওর রুমে বই খুলে বসে আছে৷ যদিও ওর এখন তেমন পড়ার চাপ নেই। কিন্তু ও বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা কেন আম্মুকে এত বকাঝকা করে? আম্মু স্কুলে পড়লে কী হয়? ওর ছোট্ট মনে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। তবে একটা জিনিস বোঝে বাবা আর আম্মুর মাঝে অনেক ঝগড়া। যদি ও হ্যারি পটারের মতো জাদু জানত, তাহলে এক লহমায় সব ঝগড়া ঠিক করে দিত।
সে রাতে আরেকটা রাত আসে প্রেমহীন সংসারে। একই ছাদের নিচে দুটো আলাদা ঘরে দুটো মানুষ একসাথে না হতে পারার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। আর লিভিংরুমে সবুজের উপর লালচে গোলাপি পাড়ের নববর্ষের শাড়িটা অনাদরে, অবহেলায় পড়ে থাকে। ওদের জীবনে নতুন ঝলমলে নববর্ষ কি আর আসবে?
২.
অভীক আজ ক’দিন ধরেই একটা কথা ভাবছে। কুঞ্জল ইদানিং এমন এমন সব কাজ করছে যা আগে কখনও করত না। এই যে ম্যারাথন দৌড়োনোর ব্যাপারটা। এটা ও আগে কখনও করেনি। ওর মতো একজন হাউসওয়াইফ যে এটা করতে পারে সেটা মাথায়ই আসেনি। সেটা না হয় ওই তুহিন ছেলেটার পাল্লায় পড়ে দৌড়ুল। কিন্তু এই যে এখন বাবুর্চি হতে চাচ্ছে সেটা কার বুদ্ধিতে? তাও একেবারে একবছরের কোর্সে ভর্তি হয়েছে? আর এসব কোর্সে তো অনেক টাকা লাগে। এত টাকা ও কই পেল? ওর কাছেও তো চায়নি। ওর মা বাবা দিয়েছে? কিন্তু ওনাদের অবস্থা তো ভালো না, ছেলের সংগে থাকেন। বিয়ের পর ওদের বাড়ি থেকে ইদ ছাড়া তেমন কিছু কখনোই দেয়নি। ওরা টাকা দেবার কথা না। তাহলে?
হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই অভীক থমকে যায়। আচ্ছা, কুঞ্জল কারও সাথে প্রেম করছে না তো? সেই হয়তো ওকে উস্কাচ্ছে ঘর ছাড়তে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে। কথাটা মনে হতেই একটা রাগ টের পায় অভীক। সেইসাথে একটা হীনমন্যতা। ওর কুঞ্জল অন্য কাউকে পছন্দ করে এই ভাবনাটা ও নিতেই পারছে না।
সন্দেহটা ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে। যদি কেউ থেকেই থাকে তবে তার সাথে বেশিদিন পরিচয় না। কী মনে হতে ও কুঞ্জলের ফেসবুক পেজে ঢোকে। আচ্ছা দেখা যাক ওর নতুন বন্ধু কারা। ফ্রেন্ড লিস্ট ক্লিক করতেই দেখে সেটা লক করা। ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবে। তারপর ওর ফেসবুকের নতুন পোস্টগুলো একটা একটা করে দেখে। কারা লাইক দিয়েছে, কারা কমেন্ট করেছে তাদের সবার প্রোফাইল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। বেশিরভাগই অর্কের বন্ধুদের মায়েরা অথবা ওর স্কুল ফ্রেন্ড যাদের ও চেনে। অপরিচিত অনেকে আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে সন্দেহ করার মতো তেমন কিছু খুঁজে পায় না।
দেখতে দেখতে ও কুঞ্জলের ম্যারাথন দৌড়ে ট্রফি হাতে ছবিটায় আসে। এটাতে আরও কয়েকটা ছবি আছে, ও আর অর্কের মেডেল পরা ছবি। কুঞ্জল দৌড়াচ্ছে তার ছবি। এটাতে সবচেয়ে বেশি লাইক, কমেন্ট পড়েছে। অভীক এবার সময় নিয়ে প্রতিটা কমেন্ট পড়ে। যাদের চেনে না তাদের প্রোফাইল খুলে খুলে দেখে। এমনই একটা অপরিচিত প্রোফাইলে ক্লিক করতেই ও থমকে যায়। বিড়বিড় করে পড়ে, অংশুল, হেড শেফ, ইনকা রেস্তোরাঁ। ভ্রু কুঁচকে ও কিছুক্ষণ প্রোফাইলটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত কুঞ্জলের বন্ধু লিস্টে শেফ কেউ ছিল না। এটাই প্রথম। আচ্ছা এই লোকটা ওকে রান্নার ইন্সটিটিউটে ভর্তি হতে উৎসাহ জোগায়নি তো?
কথাটা মনে হতেই ও লোকটার প্রোফাইল স্ক্রল করতে থাকে। একটা ছবিতে লোকটার মাথায় শেফের সেই বিখ্যাত টুপিটা নেই। এই ছবিটার দিকে ও অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এই মুখটা ও কোথাও দেখেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। তবে দেখেছে এটা নিশ্চিত।
অভীক চিন্তিত মুখে স্ক্রল করতে থাকে। বেশিরভাগ পোস্টই রান্না সংক্রান্ত। লোকটার অনেক ফ্যান ফলোয়ার, বোঝায় যাচ্ছে নাম করা শেফ। আর ইনকা রেস্তোরাঁতে ও নিজেও অনেকবার খেয়েছে। মেঘাকে নিয়েও এক দু’বার যাওয়া হয়েছে।
ও স্ক্রল করে আরেকটু নিচে নামতেই হঠাৎ একটা পোস্টে ওর চোখ আটকে যায়। একটা ম্যারাথন দৌড়ের পোস্ট। একসাথে অনেকজন প্রতিযোগীদের ছবি। ও চোখ কুঁচকে পোস্টটা জুম করে, সবার গায়ে একই গেঞ্জি। গেঞ্জির উপর বড়ো করে লেখা ‘গ্রিণ ঢাকা ম্যারাথন’।
অভীক একটু ভাবতেই বিদ্যুৎ চমকের মতো ওর একটা কথা মনে হয়। তারপর দ্রুত ও কুঞ্জলের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢোকে। দ্রুত স্ক্রল করে ওর সেই দৌড়ের পোস্টে যায়। হ্যাঁ, একদম যা ভেবেছিল তাই। কুঞ্জলও সেদিন এই গেঞ্জিটাই পরে দৌড়েছিল। ওর গেঞ্জিতেও ‘গ্রিণ ঢাকা ম্যারাথন’ লেখা। পোস্ট দুটো একই তারিখে করা। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে এই শেফ অংশুল ওইদিন ম্যারাথনে উপস্থিত ছিল! তারমানে এই লোকের সাথে কুঞ্জলের আগে থেকেই ঠিক করা ছিল ম্যারাথনে দেখা করার?
কথাটা ভাবতেই ওর মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। ও দ্রুত লোকটার আরও কিছু ছবি বের করে দেখে। একটা ছবি দেখে ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়। লোকটা একটা মোটরসাইকেলে বসে আছে, তার ছবি। এবার লোকটাকে ও চিনতে পারে। সেদিন কুঞ্জল একজনের মোটরসাইকেলে করে ফিরেছিল। ও জানালা দিয়ে লোকটার মুখ স্পষ্ট দেখেছিল। ওরা কেমন হাসিমুখে কথা বলছিল সেদিন। অথচ কুঞ্জল বলেছিল পাঠাও কোম্পানির মোটরসাইকেলে করে ও বাড়ি ফিরেছিল। কুঞ্জল মিথ্যে বলেছে ওর সাথে!? ওর সাথে প্রতারণা করেছে? ওই অংশুল লোকটার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে? আর লোকটার বুদ্ধিতেই বুঝি শেফ কোর্সে ভর্তি হয়েছে। এবার ও একে একে সব মেলাতে পারছে। কেন কুঞ্জল হঠাৎ করেই শেফ কোর্সে ভর্তি হলো। নিজের ছেলেকে অন্যের বাসায় রেখে ক্লাশ করতে যাচ্ছে। ও কঠিনভাবে নিষেধ করা সত্বেও সেটা করেই যাচ্ছে। সব ওই লোকটার জন্য। তাহলে শেষ পর্যন্ত ওর সন্দেহটাই ঠিক। কুঞ্জল অন্য কাউকে ভালোবাসে। এজন্যই তো এতবার ক্ষমা চাইবার পরেও ওর মন গলেনি। ওর সাথে ঘুমায় না, আদর করে না। আচ্ছা কুঞ্জল কি ওই লোকের সাথে……..। নাহ, এত নিচে ও নামবে না নিশ্চয়ই।
অভীক বুকের ভেতর কেমন একটা হাহাকার টের পায়। পা দূর্বল হয়ে আসে। ও নিজে ভুল করেছে, সেজন্য নিজের কাছেই লজ্জিত। কিন্তু কুঞ্জল যে কখনও এমন কিছু করতে পারে এটা ওর ধারণাতেই ছিল না। বিশ্বাস ভাঙার একটা তীব্র কষ্ট ও টের পায়। এতদিন এই কষ্টের সাথে ওর পরিচয় ছিল না। আজ মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে ও শুন্য। ওর কেউ নেই।
অভীক মন শক্ত করে। ও কিছুতেই ছেড়ে দেবে না। কুঞ্জল ওর বেলায় যা করেছে ও তাই করবে। এই বদমাশ লোকের রেস্তোরাঁয় যেয়ে ওর গলা চেপে ধরবে কেন ওর কুঞ্জলের সাথে ও প্রেম প্রেম খেলা খেলছে। বেটাকে কঠিন একটা শিক্ষা দিতে হবে যাতে আর কোনোদিন কুঞ্জলের পেছন না ঘোরে। প্রয়োজনে এই লোকটার বাসায়ও জানাবে ও। আগুন যখন লেগেছে তখন ভালো করেই লাগুক। সব পুড়ে ছাই হয়ে যাক।
(চলবে)