প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-১২

0
434

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (১২)

১.
কুঞ্জল অর্কের একটা বাংলা রুল টানা খাতায় হিসেব লিখছিল –

দু’রুমের একটা বাসা – পনের হাজার টাকা
খাওয়া খরচ (২জন) – সাত হাজার টাকা
স্কুল টিউশন – পনেরশ টাকা
জামা কাপড় – দু’হাজার টাকা
যাতায়াত – তিন হাজার টাকা
অন্যান্য – দুই হাজার টাকা

মোট – ত্রিশ হাজার পাঁচশ টাকা।

লেখাটার দিকে ও তাকিয়ে থাকে। ও যদি অর্ককে নিয়ে আলাদা বাসা নেয় তাহলে খরচের অংকটা যে এত বেশি হবে ও ভাবতেই পারেনি। একটা অবিশ্বাস নিয়ে যোগ করার পর মোট টাকার ঘরটায় স্থির চোখে তাকায়। তারপর হঠাৎ করেই মনে হয় এটা আরও বাড়বে। যদি ও বা অর্ক কেউ অসুস্থ হয়? অর্কের যদি প্রাইভেট পড়তে হয়? যত উঁচু ক্লাশে উঠবে ততই তো খরচ। তখন? কথাটা ভাবতেই ও দিশেহারা বোধ করে। এই ক’টা দিন ও আশেপাশের কয়েকটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে কথা বলেছে। দশ থেকে পনের হাজারের বেশি বেতন দেয় না এরা। আর এই বয়সে হুট করেই কোথাও চাকরি হবার না। ও তো সাধারণ বিষয়ে মাস্টার্স করা। এতে কোথাও চাকরি হবার না। আর অনলাইনে রান্নার অর্ডার নিয়ে, তারপর বাজার করে সেগুলো রেডি করা ওর একার পক্ষে সম্ভব না। আর যদি কষ্ট করে করেও কিন্তু অর্ডার যে পাবে তার খুব একটা নিশ্চয়তা নেই। কত কত রান্নার পেজ যে আছে, তার ভীড়ে ও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে কী করে?

আরেকটা ব্যাপার মনে হতেই ও আরও পিছিয়ে যায়। ও যদি চাকরি করে তাহলে অর্ককে কে দেখবে?

পুরো ব্যপারটার একটা সমাধান অবশ্য আছে। ও যদি বাবা মায়ের ওখানে যেয়ে থাকে তাহলে ওর বাসা ভাড়া বাবদ মোটা অংকের টাকা লাগবে না, আবার অর্ককে দেখে রাখার বিষয়টাও সমাধান হবে। বাসায় এখনও অভীকের সাথে ওর টানাপোড়েনের কথা জানায়নি। এবার যে জানাতেই হয়। দেয়ালে ওর পিঠ ঠেকে গেছে। অভীক সেদিন গায়ে হাত তোলার পর যদিও অনেকবার ক্ষমা চেয়েছে কিন্তু অভীকের ভয়টা ভেঙে গেছে। এখন ছুতো পেলেই গায়ে হাত তুলবে, আর পরে ক্ষমা চেয়ে নেবে। এভাবে যে চলতে দিতে পারে না ও। আজই মায়ের বাসায় যাবে। এবার সব খুলে বলার সময় হয়েছে।

সেদিন অর্ক স্কুল থেকে ফিরতেই ও ব্যাগ গুছিয়ে ফেলে। অর্ক যখন শোনে ও নানুর বাড়ি যাবে তখন ও আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ‘ইশ, কতদিন নানুর কাছে যাই না। আম্মু, আজই যাব?’

কুঞ্জল একটু হেসে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা। আজ রাতটা ওখানে থাকব।’

অর্কের মন খারাপ হয়ে যায়, ‘মোটে এক রাত?’

কুঞ্জল থমকে তাকায়, তারপর বলে, ‘যদি সবসময় থাকি আমরা, তখন থাকবি?’

অর্ক চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘সত্যিই আম্মু? তাহলে তো খুব মজা হবে।’

কুঞ্জল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, বাচ্চাদের পৃথিবীটা কত সুন্দর, নির্ঝঞ্ঝাট। ওর ছোট্ট মনে একবারও নানুর বাড়ি সবসময় থাকার ব্যাপারটা নিয়ে খটকা লাগেনি।

কুঞ্জল এবার দ্রুত হাতে রাতের রান্না করে। রান্না শেষে অর্ককে নিয়ে খেতে বসে। তারপর রাতের খাবারগুলো ফ্রিজে ঢোকায়। আর অভীককে একটা মেসেজ লিখে, ‘আমরা অর্কের নানু বাড়ি গেলাম। কাল আসব।’

মেসেজ পাঠানোর এক মিনিটের মাথায় অভীকের ফোন আসে। ধরবে না ভেবেও ফোনটা ধরে। ওপাশ থেকে অভীকের অধৈর্য গলা শোনা যায়, ‘তুমি হঠাৎ করে মায়ের বাড়ি যাচ্ছ, কেন?’

কুঞ্জল গম্ভীরমুখে বলে, ‘কেন, যেতে মানা আছে নাকি? আমি কাল সকালে আসব।’

বলেই ফোনটা রেখে দেয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আরও ক’বার ফোন আসে, ও ধরে না। অযথা কথা বলা।

অর্কের নানু বাড়িটা কাছেই। সিএনজি করে যেতে খুব একটা সময় লাগে না। এত কাছে বাসা তাও মাসে একবার আসা হয় না। তার পেছনে অবশ্য কারণও আছে। মা বাবা বড়ো ভাই সেলিমের সাথে থাকে। আর মায়ের সাথে ভাবির প্রায়ই ঝগড়া হয়। কুঞ্জল মাঝে ভাবিকে এক দু’বার বলতে গিয়ে উল্টো কথা শুনেছে। তাই যতটা কম পারা যায় এখানে আসে।

সুলতানা আসরের নামাজ পড়ে সবে সালাম ফিরিয়েছেন। এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। তুতুলকে ডাকতে যেয়ে হঠাৎ করেই মনে হয় তুতুল তো বাবা মায়ের সাথে কোথায় যেন দাওয়াত খেতে গেছে। বউটা এমন নচ্ছার হয়েছে যে কিছু বলে যাবার প্রয়োজনবোধ করে না। আর সেলিমও হয়েছে একেবারে বউ ন্যাওটা। বউ উঠতে বসলে উঠবে, বসতে বললে বসবে। একমাত্র নাতনি তুতুলটা ভালো হয়েছে। যাবার সময় ওর গলা ধরে আদর করে গেল, আর ফিসফিস করে বলে গেছে ওরা আসলে দাওয়াত না শপিংয়ে যাচ্ছে। ক’দিন পর কক্সবাজার নাকি ঘুরতে যাবে তার জন্য কেনাকাটা করতে। তা যাক, কিন্তু ওকে সেটা না বলার কী আছে?

ভাবতে ভাবতে এবার গলা বাড়িয়ে বলেন, ‘এই তুমি কই, দরজাটা খোল। দেখো তো কে আসল?’

বাথরুম থেকে হাজী মোহাম্মদ মোস্তাফিজের একটা গলাখাঁকারির আওয়াজ পাওয়া যায়।

তারপর ক্ষীণ গলায় বলে, ‘আমি বাথরুমে।’

সুলতানা গজগজ করে ওঠেন, ‘একটু পর পর বাথরুমে যেতে হয়। ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে বলি, তা করবে না।’

সুলতানা গায়ের চাদরটা জড়িয়ে নিয়ে দরজার কাছে যায়। খুলতে যেয়ে থমকে যান। বউমা পইপই করে সাবধান করেছে কি-হোল দিয়ে না দেখে দরজা যেন না খোলে। সুলতানা কি-হোলে চোখ রাখেন। খালি চোখে অতটা পরিস্কার বোঝা যায় না। কিন্তু একটা সময় চেহারার অবয়ব একটু পরিস্কার হতেই বুক ধক করে উঠে, কুঞ্জল!

দ্রুত হাতে দরজার ছিটকিনি খুলে অবাক গলায় বলেন, ‘তুই! আরে আমার অর্ক সোনাও এসেছে।’

অর্ক চিৎকার করে বলে, ‘নানুউ!’

সুলতানা এগিয়ে গিয়ে অর্কের হাত ধরেন। তারপর টেনে ভেতরে নিয়ে যান।

কুঞ্জল ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, ‘তোমরা তো একটা খবর নাও না, বেঁচে আছি না মরে গেছি।’

সুলতানা মনে মনে শংকিত হয়, মেয়ের মেজাজ ঠিক নেই। জামাইয়ের সাথে কিছু হলো?

ব্যাপারটা বুঝতে হালকা গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘তুইও তো ফোন দিস না। খুব ভালো করেছিস এসে। তা অভীক বুঝি রাতে আসবে তোদের নিতে?’

কুঞ্জল সোফায় বসতে বসতে বলে, ‘কেন? তোমার এখানে বুঝি একটা রাত থাকা যাবে না? আমি বুঝি না, এটা তো বাবার নিজের পয়সায় কেনা বাসা। কিন্তু তোমাদের দেখলে মনে হয় তুমি তোমার ছেলের বাসায় ভাড়া থাকো।’

ঠিক এসময় মোস্তাফিজ ড্রয়িংরুমে ঢোকেন। আনন্দিত গলায় বলেন, ‘কুঞ্জল মা এসেছিস। আমার নানাভাই এসেছে। ও নাকি এবার দৌড়ে ফার্স্ট হয়েছে?’

অর্ক উৎসাহের গলায় বলে, ‘নানা, আম্মুও দৌড়ে সেকেন্ড হয়েছে।’

মোস্তাফিজ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই কুঞ্জল চোখ পাকিয়ে অর্ককে থামায়। তারপর হাসিমুখে বলে, ‘বাবা, তোমার শরীর ভালো তো? ডায়াবেটিসটা চেক করাও তো নিয়মিত?’

সুলতানা ফোড়ন কাটে, ‘সেটা করাবে না, উলটো চুপিচুপি মিষ্টি খাবে। আচ্ছা তোরা বোস, আমি নানুভাইকে নাস্তা দেই। ওরা সবাই বাইরে গেছে, ফিরতে রাত হবে।’

কুঞ্জল মায়ের পেছন পেছন যায়। তারপর নিজেই ফ্রিজ খুলে দেখে কি কি আছে। একটা মিষ্টির প্যাকেট থেকে মিষ্টি মুখে পুরে অস্পষ্ট গলায় বলে, ‘মা, তোমার সাথে আমার কথা আছে। ভালো হয়েছে যে ভাইয়া ভাবি বাসায় নেই।’

সুলতানা মনে মনে প্রমাদ গোনেন। লক্ষণ সুবিধার মনে হচ্ছে না। দ্রুত কয়েকটা মিষ্টি আর কেক বের করে অর্ককে খেতে দেন। তার আগে অবশ্য কটমট করে মোস্তাফিজের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমি কিন্তু একটা মিষ্টিও খাবে না।’

তারপর বেডরুমে আসতেই দেখেন কুঞ্জল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পায়ে পায়ে মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। আলতো করে কাঁধে হাত রাখতেই ও চমকে ওঠে, ফিরে তাকিয়ে বলে, ‘মা, এই বাসা তো এখনও বাবার নামে। তোমাদের চারটা রুমের মধ্যে একটা রুমে আমাকে থাকতে দেবে?’

সুলতানা ভ্রু কুঁচকে বলেন, ‘এটা কেমন কথা। তুই বেড়াতে এসেছিস, তোর মতো আরাম করে থাকবি। কে কি বলবে তোকে।’

কুঞ্জল অস্ফুটে বলে, ‘বেড়াতে না, আমি সারাজীবনের জন্য থাকতে চাই মা। অভীকের সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিকঠাক যাচ্ছে না। ওর কিছু ব্যাপার আমি তোমাদের বলিনি। কিন্তু আমি আর পারছি না মা। দেবে আমাকে থাকতে?’

সুলতানার বুক কেঁপে ওঠে। নিজের সন্তান, একদিন এই বাসাতেই কত আদরে মানুষ হয়েছে আজ সেই বাসার একটা রুমে থাকার জন্য কী আকুল করে হাত পেতেছে! কষ্টে বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে যায়। সন্তানের এমন অসহায় বাড়ানো হাত যে ভীষণ কষ্টের।

এক লহমায় মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন, আকুল গলায় বলেন, ‘কী হয়েছে মা? অমন করে কেন বলছিস?’

কুঞ্জল কাঁদে। আজ বহুদিন পর একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়ে ও অনেক কাঁদে। জমাট বেঁধে থাকা সব কষ্টরা আজ বরফ গলা নদীর মতো মুক্তির পথ খুঁজে পায়।

সুলতানা মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘আমাকে সব খুলে বল।’

কুঞ্জল সব খুলে বলে। সুলতানা শোনেন, নির্বাক তাকিয়ে থাকেন। তারপর একটা সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘তুই ফিরে যা। ছেলেমানুষের এমন একটু আধটু দোষ থাকে। ও তো আরেকটা বিয়ে করে ফেলেনি বা করতেও চায়নি। ছেলেদের এটুকু দোষ থাকে সেটা শক্ত হাতে তোকে ঠিক করে নিতে হবে। তুই চোখে চোখে রাখবি ওকে। আর নিজেও একটু সেজেগুজে থাকবি। মা রে, মেয়েদের এমন কত কিছু করে সংসার টিকিয়ে রাখতে হয়।’

মায়ের কথা শুনে কুঞ্জলের মাথায় আগুন ধরে যায়, অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘তা তুমি কি কি করেছ এমন? নিজেকে তো কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি তাই অমন বলছ। আমার মতো এমন পরিস্থিতিতে পড়লে বুঝতে কত অপমান এই বেঁচে থাকাতে।’

সুলতানা বিষণ্ণ হাসি হাসেন, তারপর বলেন, ‘সন্তানকে তার পিতার সম্পর্কে খারাপ কিছু বলতে নেই, লুকিয়ে রাখতে হয়। এটুকুই শুধু বললাম।’

কুঞ্জল হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে। তার মানে বাবাও মাকে কষ্ট দিয়েছে! কথাটা বিশ্বাস হতে চায় না।

সুলতানা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘আমি জানি এই অপমানের কষ্টটা। কিন্তু কী করবি বল? আমরা বুড়ো হয়েছি, তোর ভাইয়ের সংসারে থাকি। তোর বাবার জমানো সব টাকা গেছে এই বাড়ি করতে। এখন ছেলে না দেখলে যে না খেয়ে মরতে হবে। তাই এই বাসায় তোকে রাখার অধিকার কিংবা সামর্থ্য কোনোটাই নেই আমাদের।’

সত্যটা নিদারুণ। চোখ জ্বালা করে উঠে কুঞ্জলের। কোথাও এতটুকু ভরসার জায়গা নেই। নিজের বেড়ে উঠা বাড়িটাতে আজ ও অনাহুত। এই পৃথিবী বুঝি ওকে হারিয়ে দেবার সব ষড়যন্ত্র করে বসে আছে।

২.
অংশুল নিপুণ নামের নতুন কমি শেফের দিকে তাকিয়ে আছে। নিপুণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে জল নিয়ে বলছে চাকরি ছেড়ে দেবে। মেয়েটা খুব বেশিদিন হয়নি চাকরিতে যোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে খুব ভালোও করেছে। ও খেয়াল করে দেখেছে মেয়েরা রান্নার সেন্সটা বেশ ভালো বুঝতে পারে। কিন্তু একটাই সমস্যা, এরা এই পেশায় খুব বেশিদিন ক্যারিয়ার ধরে রাখতে পারে না। হয় স্বামী না হয় সন্তানের জন্য একটা সময় ছেড়ে দিতেই হয়। আর সামাজিক মর্যাদাও একটা বড়ো ব্যাপার। অথচ পাশ্চাত্যে একজন ভালো শেফ একজন সেলিব্রেটির মতোই।

অংশুল আফসোসের গলায় বলে, ‘তুমি তো খুব ভালো করছিলে। একটা বছর কষ্ট করে কাজটা করলে অনেক কিছু শিখতে। এই লাইনে অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতে।’

নিপুণ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, ‘স্যার, আমার বাসা থেকে এই কাজটা করতে দিতে চাচ্ছে না। কিন্তু আমি সত্যিই একজন মাস্টার শেফ হতে চেয়েছিলাম।’

অংশুলের মন খারাপ হয়ে যায়। আশ্বস্ত করে বলে, ‘তুমি মন খারাপ কোরো না। আপাতত বাসায় যাও। কিছুদিন সময় নাও। তোমার ইচ্ছের কথাটা বুঝিয়ে বলো। হয়তো ওনারা রাজি হতেও পারে। আর না হলেও কিছু যায় আসে না। তুমি অনলাইনেও শিখতে পারো। এখন অনলাইনেও অনেক কোর্স করা যায়।’

নিপুণ ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলায়, তারপর আশা নিয়ে বলে, ‘আমি যদি বাসায় রাজি করাতে পারি তবে আপনি আমাকে আবার সুযোগ দেবেন?’

অংশুল মাথা নেড়ে বলে, ‘অবশ্যই। তুমি একটুও ভেব না।’

এবার নিপুণের মুখে হাসি ফোটে। ও ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেয়।

অংশুল ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াতেই ফোন আসে। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নামটা দেখেই মন ভালো হয়ে যায়, ‘কুঞ্জল, আপনি? এতদিন কোন খোঁজ নেই?’

কুঞ্জল একটু লজ্জাই পায়। সেদিনের পর ইচ্ছে করেই যোগাযোগ কমিয়েছিল। আজ দরকারেই ফোন দিয়েছে।

কুঞ্জল কৈফিয়ত দেবার গলায় বলে, ‘একটু ব্যস্ত ছিলাম। আপনি আজ আছেন? একটু আসতাম অথবা কোথাও একটু বসতাম।’

অংশুলের বুকের ভেতর একটা কিছু হয়। মনে চঞ্চলতা টের পায়। ও দ্রুত বলে, ‘এখানেই চলে আসুন, সমস্যা নেই। আজ আমার হাতে কাজ কম আছে।’

কুঞ্জল খুশি হয়। অংশুল যে আলাদা কোথাও বসতে চায়নি তাতে ওর প্রতি বিশ্বাসটা বাড়ে। যাক, অংশুল ওকে নিয়ে উল্টোপাল্টা ভাবছে না।

আধা ঘন্টা লাগে কুঞ্জলের। শীত শেষে গরম পড়তে শুরু করেছে। এটুকু পথ আসতে গিয়েই ও ঘেমে গেছে। ইনকা রেস্তোরাঁর ভেতর ঢুকতেই অবশ্য এসির ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। মানুষের মনের জ্বালা জুড়োনোর এমন কোনো যন্ত্র থাকত, তবে খুব ভালো হতো, ভাবে কুঞ্জল।

ওকে দেখে হাসিমুখে অংশুল এগিয়ে আসে। হাতে সুদৃশ্য দুটো বাহারি কাচের গ্লাসে হালকা সবুজ রঙের ড্রিংক্স, তাতে লেবুর পাতলা স্লাইস ভাসছে। দেখেই পিপাসা বাড়ে।

‘আগে এটা খেয়ে নিন, তারপর কথা শুনব’, অংশুল একটা গ্লাস বাড়িয়ে দেয়।

কুঞ্জল চুমুক দিতে দিতে বলে, ‘আপনি ভালো আছেন তো?’

অংশুল মাথা নাড়ে, ‘আছি, আমার মতো করে। আপনার কী খবর? অনেকদিন রান্নার ভিডিও দেননি যে।’

কুঞ্জল বিষণ্ণ হাসে, তারপর বলে, ‘আসলে একটু ঝামেলায় ছিলাম।’

অংশুল কিছু বোঝার চেষ্টা করে। কুঞ্জল ভালো নেই, নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েই ওর কাছে এসেছে। নাহ, মেয়েটাকে সময় দিতে হবে। নিশ্চয়ই নিজে থেকেই বলবে।

খাওয়া শেষে গ্লাস নামিয়ে রেখে টিস্যুতে মুখ মোছে, তারপর আচমকা জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, আপনাদের এখানে শেফদের বেতন কেমন? পার্টটাইম কাজ করলে? মানে বিকেল তিনটে থেকে রাত দশটা?’

অংশুল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কেন বলুন তো? কার জন্য? আপনার পরিচিত কেউ?’

কুঞ্জল মাথা নিচু করে বলে, ‘আমার জন্য।’

অংশুল একটু চমকে ওঠে। কী অসহায় দেখাচ্ছে মুখটা। ও উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘আপনার হাসব্যান্ডের কিছু হয়েছে? মানে ওনার চাকরির সমস্যা?’

কুঞ্জল ম্লান হাসে, ‘না, সেসব কিছু না। আমি নিজে কিছু একটা করব, তাই ভাবছিলাম। তেমন কিছু তো পারি না, রান্নাটা একটু বুঝি। তাই ভাবলাম আপনি যদি একটা সুযোগ করে দেন, তাহলে হয়তো নিজের পায়ে একটু দাঁড়াতে পারতাম।’

অংশুল চেয়ে থাকে, কোথাও একটা বেদনার সুর টের পায়। সুরটা ভীষণ চেনা। কুঞ্জলের ব্যক্তিগত সমস্যাটা হয়তো আরও বেড়েছে। তাই বুঝি মুক্তির পথ খুঁজে পেতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাচ্ছে।

ও সামনের দিকে ঝুঁকে বলে, ‘হ্যাঁ, তেমন একটা চাকরি আপনি পেতেই পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে খুব বেশিদূর আপনি এগোতে পারবেন না। বেতনও খুব একটা বেশি হবে না। কম করে হলেও একটা একাডেমিক ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাগে। আমি বলি কি আপনি ডিপ্লোমা ইন গ্লোবাল কালিনারি আর্টসের উপর একটা বছর পড়াশোনা করুন। তাতে করে ভালো স্যালারিতে জয়েন করতে পারবেন। আপনার কি খুব বেশি তাড়া আছে?’

কুঞ্জল একটু ভাবে, অংশুল ঠিক বলেছে। একটা ডিগ্রি না থাকলে ও খুব বেশি এগোতে পারবে না। ও জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘এক বছরে হবে? কখন ক্লাশ হয়?’

অংশুল আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘আপনার সমস্যা হবে না। তিনটা শিফট আছে, সকাল ৭-১০ টা, অথবা ১১-৩টা, অথবা ৩-৭টা। অর্কের স্কুলের পরে এসে যদি করতে চান তাহলে আমি মনে করি ৩-৭ টা পর্যন্ত করতে পারেন। আর এটা সপ্তাহে মাত্র দু’দিন করতে হবে।’

কুঞ্জল আশান্বিত গলায় বলে, ‘তাই? তাহলে তো খুব সহজে আমি করতে পারব। কত টাকা লাগতে পারে?’

অংশুল একটু মনে করে বলে, ‘খুব বেশি না, দেড় লাখ টাকার মতো। কিন্তু এটার সার্টিফিকেটের ভ্যালু আছে। এই কোর্সের ক্রেডিট আপনি অস্ট্রেলিয়াতেও ট্রান্সফার করতে পারেন।’

কুঞ্জল ঢোঁক গিলে, ‘এত টাকা!’

অংশুল থমকায়। ও যতটুকু দেখেছে ওরা স্বচ্ছল। এই টাকাটুকু খুব বেশি হবার না। কিন্তু কুঞ্জলের গলা বলে দেয় টাকাটা অনেক। ও আশ্বস্ত করে বল, ‘একবারে দিতে হবে না। চার কিস্তিতে দেওয়া যাবে।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে, চার কিস্তি তো ব্যাপার না। কিন্তু টাকাটা পাবে কোথায় ও? ওর কাছে সব মিলিয়ে হাজার পঞ্চাশেক টাকা আছে। অভীকের কাছে চাইলে পাওয়া যাবে। কিন্তু ও কিছুতেই ওর কাছ থেকে টাকা নেবে না। তাহলে?

ভাবনাটা ভাবতেই ও হতাশ গলায় বলে, ‘আচ্ছা, আমি একটু ভেবে দেখি।’

অংশুল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জল টাকার কথা শুনে পিছিয়ে গেল? তার মানে ও হাসব্যান্ডের টাকা নিতে চায় না। ওদের স্বামী স্ত্রীর টানাপোড়েন বুঝি আরও বেড়েছে? নাহ, মেয়েটাকে সাহায্য করা উচিত। ও গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘কুঞ্জল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি আপনি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাচ্ছেন। আমি কি আপনার পাশে দাঁড়াতে পারি?’

কুঞ্জল স্থির চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কেন আমি আপনার সাহায্য নেব?’

অংশুল একটু ভেবে বলে, ‘জীবনে এগিয়ে যেতে কারও না কারও সাহায্য নিতে হয়। আমি যে আজ এই পর্যায়ে এসেছি তার পেছনে অনেক শুভাকাঙ্খীর অবদান আছে। ধরে নিন আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্খী।’

কুঞ্জল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে সত্যিকারের একটা মায়ার ছায়া দেখতে পায়। এই মায়া ফিরিয়ে দেবার শক্তি নেই ওর। কিন্তু একটাই ভয়, মানুষকে সবকিছুর শোধ দিতে হয়। আর মায়ার ঋণ মায়া দিয়েই যে শোধ দিতে হয়।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে