প্রেমহীন সংসার আহা সোনামুখী সুঁই পর্ব-১১

0
433

#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (১১)

১.
‘শুচিশুদ্ধ’ স্কুলের ফাইনাল খেলা চলছে। এখনই ক্লাশ ফোর আর ফাইভের বাচ্চাদের একশ মিটার দৌড় শুরু হবে। সবাইকে স্টার্টিং মার্কে সার বেঁধে দাঁড়াতে বলে। অর্ক একবার দর্শক সারির দিকে তাকায়। নাহ, আম্মু এখনও আসেনি। ওর ছোট্ট মুখটা মলিন হয়ে যায়। তারপর হাঁটু গেড়ে পজিশন নেয়। একজন শিক্ষক গলা ফুলিয়ে চিৎকার করেন, ‘রেডিইই, ওয়ান..’

অর্ক লম্বা করে একটা নিশ্বাস নেয়। আম্মু এটা শিখিয়েছিল। একবার ও আড়চোখে তাকায়। আর তখনই আম্মুকে দেখতে পায়। মুহুর্তেই ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর ঠিক তখনই দৌড় শুরু করবার বাঁশি বেজে ওঠে।

অর্কের একটু দেরি হয় শুরু করতে, কিন্তু তারপর ও ছোটে, প্রাণপণে ছোটে। আম্মু এসেছে, আম্মু ওকে দেখছে দৌড়ুতে। একটা দুর্নিবার আনন্দে ও হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে দৌড়ুতে থাকে।
কুঞ্জল উত্তেজনায় ওর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আছে। বুকের ভেতর নিশ্বাস চেপে ও ফিনিশিং লাইনের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে পায় সাদা গেঞ্জি পরা, এক মাথা কালো চুল ছেলেটা সবার আগে ফিনিশিং লাইন পেরোল। কুঞ্জল স্থান-কাল ভুলে চিৎকার করে ওঠে, ‘অর্ক!’

পাশ থেকে অভীক ওর বাহু ধরে আনন্দের গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, আমাদের অর্ক ফার্স্ট হয়েছে।’

কুঞ্জল হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। তারপর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পৃথুল অবাক হয়ে বলে, ‘তুই কখন এলি? অর্ক ফার্স্ট হয়েছে দেখেছিস!’

কুঞ্জল চোখের জল মোছে, তারপর ধরা গলায় বলে, ‘হ্যাঁ দেখেছি। তুই অনেক কষ্ট করলি।’

পৃথুল মুখ ভেংচে বলে, ‘আহা, কী কষ্টই না করলাম! আচ্ছা তোর দৌড় কেমন হলো? এমন সেজেগুজে দৌড়ুতে গেছিলি? মুখে এত মেকআপ দিয়েছিস কেন?’

কুঞ্জল বিষণ্ণ হাসি হাসে। আসার সময় ইচ্ছে করেই বেশি করে মুখে ফাউন্ডেশন দিয়েছে যাতে করে ওর মুখে চড়ের দাগটা দেখা না যায়। আর সেটা যে ও ভালোভাবেই লুকোতে পেরেছে তা পৃথুলকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ওর গালে চড়ের দাগটা টের পায়নি। ও দরজা বন্ধ করে রেডি হচ্ছিল দেখে অভীক ভয় পেয়ে দরজায় সে কী ধাক্কাধাক্কি। ভেঙেই ফেলে আর কী। ভয় পেয়েছিল, সুইসাইড করে ফেলে কি-না। না, কুঞ্জল মরবে না। ও আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, এই প্রেমহীন সংসার থেকে ও বেরিয়ে যাবে। অর্ককে নিয়েই ও বেঁচে থাকবে।

ভাবনার এই সময় অর্ক ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে, ‘আম্মুউউউ। আমি ফার্স্ট হয়েছি।’

কুঞ্জল শক্ত করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে৷ পরম মমতায় ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়, চুলের ঘ্রাণ নেয়। জীবনে বেঁচে থাকার একমাত্র আনন্দ।

অভীক অপরাধীর মতো মুখ করে পাশে এসে দাঁড়াতেই অর্ক অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর চিৎকার করে বলে, ‘বাবা, তুমিও এসেছ? আমার দৌড় দেখেছ বাবা?’

অর্ক গভীর আগ্রহ নিয়ে অভীকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অভীক এবার কাছে এসে ছেলের হাত ধরে, ‘হ্যাঁ বাবা, দেখেছি তো। একদম উসাইন বোল্টের মতো দৌড়েছ। আজকে থেকে তোমার নাম অর্ক বোল্ট।’

অর্ক শুদ্ধ হাসি হাসে। ওর খুব ভয় করছিল। কাল বাবা আম্মুকে অনেক বকা দিয়েছিল। ভেবেছিল বাবা বুঝি আসবেই না। কিন্তু এখন সেই ভয়টা আর নেই। বাবা এসেছে, আম্মুও এসেছে। ওর নিজেকে এখন রাজা মনে হয়। অর্ক এবার এক হাতে মাকে ধরে। তারপর ওর ছোট দুইটা হাত দিয়ে বড়ো বড়ো দুইজন মানুষকে শক্ত করে ধরে থাকে।

অভীকের মন অনুতাপের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। এই যে সুখের সংসার, আজ শুধু ওর জন্যই ভাঙতে বসেছে। নিজের কুৎসিত চিন্তা কুঞ্জলের মতো মানুষকে সন্দেহ করতে বাধ্য করেছে। অথচ বেচারি অর্কের স্কুলে একটু আগে পৌঁছানোর জন্যই ‘পাঠাও’ এর মোটরসাইকেলে করে এসেছিল। কেন ও এমন করল? নিজের হাত কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

সেদিন অর্ক গলায় মেডেল পরে বাসায় ফেরে। কত কত কথা যে বলে আজ ছেলেটা। ওর খুশি দেখে কুঞ্জল সব কষ্ট ভুলে যায়। আহা, এত মায়া কেন সংসারে? আজ সকালেই যে সংসারকে বিষাক্ত মনে হয়েছিল এখন সেটাই এত মমতা নিয়ে হাজির হলো!

বাসায় ফিরে মনে পড়তেই অর্ক দৌড়ে মায়ের কাছে এসে বলে, ‘আম্মু, তুমি দৌড়ে কী হয়েছ, বললে না তো?’

কুঞ্জল কৃত্রিম মন খারাপ গলায় বলে, ‘আমি তোমার মতো ফার্স্ট হতে পারিনি বাবা। সেকেন্ড হয়েছি।’

অর্ক কাছে এসে ওর হাত ধরে সান্ত্বনার গলায় বলে, ‘মন খারাপ করো না আম্মু। তুমি এরপর আমার মতো প্রতিদিন দুটো করে ডিম খাবে। তাহলে তোমার অনেক শক্তি হবে। আর ফার্স্ট হবে। তুমি তো ডিমই খাও না।’

কুঞ্জলের বুকটা মুচড়ে ওঠে। আমার ছোট্ট অর্ক সোনা ঠিক খেয়াল করেছে ও যে ডিম খায় না। ওকে কাছে টেনে বলে, ‘আচ্ছা, আজ থেকে ঠিক খাব।’

অভীক চুপ করে বসে বসে সব শুনছিল। কুঞ্জল নিজের খাওয়া নিয়ে খুব অবহেলা করে। সংসারের সবার খাওয়া ঠিকঠাক রেখে ও নিজেরটাই ভুলে যায়। নাহ, এখন থেকে ও নিজে একটু খেয়াল রাখবে।

সেদিন বিকেলে আফরোজ আপু, তুহিন হইহই করতে করতে বাসায় ঢোকে। হাতে ফুল, মিষ্টি। তুহিন চিৎকার করে বলে, ‘আপু, প্রথমবারই তুমি সেকেন্ড হয়ে গেলে! কনগ্রাচুলেশনস। এই তোমার ট্রফি, সার্টিফিকেট আর তিন হাজার টাকার একটা প্রাইজমানি।’

অর্ক অবাক চোখে দেখে আম্মুর হাতে একটা ট্রফি। অভীক পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতেই তুহিন প্রাঞ্জল গলায় বলে, ‘ভাইয়া, আপু তো ফাটিয়ে দিয়েছে। আপু যে এত ভালো দৌড়ুয়, জানতামই না। আপনি এরপর আপুর সাথে আসবেন। আপুকে আজ একা একা যেতে হলো।’

আফরোজা আপু এবার গম্ভীরমুখে বলেন, ‘হ্যাঁ ভাই, আপনি না গেলে বেচারি উৎসাহ পাবে কোথা থেকে। আমার হাসব্যান্ড তো প্রায়ই যায়।’

অভীক একটা বিব্রত হাসি হাসে, তারপর জড়তা কাটিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ যাব তো। এরপর প্রতিটি দৌড়েই যাব। আর ও তো আসলেই খুব ভালো দৌড়োয়। আমাদের ছেলে অর্কও আজ স্কুলে ফার্স্ট হয়েছে দৌড়ে।’

তুহিন অবাক গলায় বলে, ‘কী রে, তুইও ফার্স্ট হয়েছিস! তোরা মা ছেলে মিলে তো সব পুরস্কার নিয়ে যাবি।’

ওর কথা বলার ভঙ্গিতে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। কুঞ্জল ওদের সবাইকে মিষ্টি, নাস্তা খেতে দেয়। অনেক গল্প হয়। তারপর যাবার সময় ট্রফি হাতে ওদের সাথে ছবি তোলে।

ওরা বিদায় নিতেই অভীক কাছে এসে আন্তরিক গলায় বলে, ‘কনগ্রাচ্যুলেশনস।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে। কিছু বলে না। অর্ক ট্রফিটা হাতে নিয়ে বলে, ‘আম্মু, আমার একটা ছবি তুলে দাও।’

অভীক এবার মোবাইল বের করে বলে, ‘তোমার আম্মুর পাশে দাঁড়াও, আমি তুলে দিচ্ছি।’

অর্ক উৎসাহের সাথে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।কুঞ্জল অর্কের হাত ধরে গম্ভীরমুখে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। অভীক চার-পাঁচটা ছবি তোলে।

ছবি তোলা শেষ হতেই অর্ক আবদারের গলায় বলে, ‘বাবা, তুমি আর আম্মু একসাথে দাঁড়াও। আমি তুলে দেই।’

অভীক আগ্রহের সাথে সামনে আসতেই কুঞ্জল বিরক্ত গলায় বলে, ‘অর্ক, ছবি তুলতে হবে না। আমার রান্না আছে।’

অর্ক জোরে মাথা নাড়ে, ‘আম্মু একটা ছবি তুলব।’

কুঞ্জল লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে দাঁড়ায়। অভীক ওর পাশে এসে দাঁড়াতেই ও সংকুচিত হয়ে যায়। অর্ক হাসি হাসি মুখে বলে, ‘স্মাইল আম্মু।’

কুঞ্জল হাসার চেষ্টা করে, কিন্তু সেটা ঠিকঠাক হাসি না হয়ে কেমন একটা কান্নার মতো হয়।

রাতে ঘুমাতে যাবার আগে অংশুলের মেসেজ আসে, ‘ছেলের দৌড় কেমন হলো? ঠিক সময়ে যেতে পেরেছিলেন তো? সারাদিন আর কিছু জানালেন না তো?’

কুঞ্জল চেয়ে থাকে মেসেজটার দিকে। উত্তর দেবে? অংশুলের সাথে কথা বলা কি ঠিক হবে? ভাবতেই ওর মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, অভীকের ভয়ে ও অংশুলের সাথে কথা বলা বন্ধ করবে না। বরং ওর সামনেই দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলবে। ও তো আর অংশুলের সাথে প্রেম করছে না।

কথাটা ভাবতেই ও স্বস্তি পায়, তারপর লিখে, ‘সরি, ব্যস্ত ছিলাম। হ্যাঁ, আমি সময়মতোই পৌঁছাতে পেরেছিলাম। আর অর্ক দৌড়ে ফার্স্ট হয়েছে।’

ওপাশ থেকে উচ্ছাসের সাথে অংশুল লিখে, ‘আনন্দের খবর। একদিন ছেলেকে নিয়ে আসুন, কেক কেটে সেলিব্রেট করি। আমি নিজে কেক বানাব আপনাদের জন্য।’

কুঞ্জল একটা হাসির ইমোজি দিয়ে বলে, ‘অবশ্যই আসব।’

অংশুল একটা লাইক সাইন দিয়ে লিখে, ‘আচ্ছা, আপনার কি মন খারাপ?’

কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে তাকায়, এই লোকটা বুঝল কী করে ওর যে মন খারাপ। নাহ, ব্যাপারটা বাড়তে দেওয়া যাবে না। ও লিখে, ‘না, মন ঠিক আছে। ঘুম পাচ্ছে খুব। সারাদিন অনেক খাটুনি গেল।’

ওপাশ থেকে অংশুল তাড়াহুড়ো করে লিখে, ‘আচ্ছা, ঘুমান। তার আগে আপনার কয়েকটা ছবি দেখে ঘুমান। আপনার অনুমতি না নিয়েই তুলেছিলাম। অপরাধ মার্জনীয়।’

কুঞ্জলের চোখ বড়ো হয়ে যায়, ওর ছবি তুলেছে? কখন?

ছবিগুলো আসতেই ও অবাক হয়ে খেয়াল করে ভোরে ও যে দৌড়ুচ্ছিল তার কিছু ছবি। আর ছবিগুলো এত সুন্দর এসেছে যে ও বিশ্বাসই করতে পারছিল না এগুলো ওর ছবি। ইশ, এগুলো এখনই ফেসবুকে পোস্ট করতে ইচ্ছে করছে। ও এবার অনেক ধন্যবাদ জানায় ছবিগুলো তোলার জন্য।

ওপাশ থেকে অংশুল হাসির একটা ইমোজি দিয়ে বলে, ‘আমি খুব চিন্তায় ছিলাম, আপনি না আবার রাগ করেন।’

কুঞ্জল লিখে, ‘না তো। কেউ তো আমার এমন দৌড়োনোর সময়কার ছবি তুলেনি। আপনি আজ এসেছিলেন বলেই না এমন হলো। আবারও অনেক ধন্যবাদ আসার জন্য।’

কথাটা লিখেই অভীকের চড় দেবার কথা মনে হয়। একটু কুঁকড়ে যায়। তারপর হুট করেই ‘শুভরাত্রি’ বলে বিদায় নেয় ও। কেন জানি এখন কষ্ট লাগছে। সেইসাথে একটা অপরাধবোধও। অভীক সকালে নিজে থেকেই যখন বলল, তুমি ‘পাঠাও’ এর মোটরসাইকেলে এসেছ? তখন ও মাথা নেড়ে শুধু ‘হু’ বলেছিল। কেন সত্যিটা বলল না? বলতে তো পারত আমার বন্ধু অংশুল পৌঁছে দিয়ে গেছে। কেন এটা বলতে পারল না ও? তাহলে কি ও অংশুলের কথাটা লুকোতে চায়?

২.
সাইফুল্লাহ আগ্রহ নিয়ে বাসার সামনের বড়ো রাস্তাটার পাশে একটা গাছের নিচে বসে বসে ওর প্রিয় কাজটা করছিল, মানুষ দেখা। ঠিক মানুষ দেখছিল না, মানুষের রাস্তা পার হওয়া দেখছিল। পাশেই ইয়াসিনের বাহারি টি স্টল। সুন্দর করে সাজানো কাচের চায়ের কাপ। একটা কাচের গ্লাসে তুলসী পাতা, আরেকটাতে মালটা কেটে রাখা, আরেকটা পাত্রে আদা কুচি করে রাখা, আরেকটায় লেবুর টুকরো। যে যেমন চায় ও বানিয়ে দেয়। ওর চায়ের হাত ভালো। সাইফুল্লাহ একটা তুলসি চা নিয়ে আরাম করে চুমুক দিচ্ছে, আর মানুষের রাস্তা পার হওয়া দেখছে। একটা মজার জিনিস ও আবিষ্কার করেছে। যখনই একটা ছেলে আর একটা মেয়ে রাস্তা পার হচ্ছে তখনই ছেলেটা অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করছে। যেপাশ দিয়ে গাড়ি আসে নিজে সেই পাশে আর মেয়েটাকে অন্যপাশে দিয়ে একটা হাত ট্রাফিকের মতো উঁচু করে রাস্তা পার হচ্ছে। সংগে থাকা মেয়েটা কোনো দিক না তাকিয়ে নিশ্চিন্ত মনে রাস্তা পেরোয়। এভাবে তিনটে জুটি রাস্তা পেরোল। প্রত্যেকে একইভাবে। আচ্ছা, মেয়েরা যখন একা রাস্তা পার হয় তখন কিন্তু সে নিজেই ভালো করে দেখে পার হয়। অথচ এই মেয়েটাই যখন আরেকটা ছেলের সাথে রাস্তা পার হয় তখন সে ধরেই নেয় ছেলেটা খেয়াল রাখবে। এটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা। সাইফুল্লাহ আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে, এর উল্টোটা কেউ করে কি-না।

ঠিক এমন সময় রস্তার উল্টোপাশ থেকে শাড়ি পরা একটা মেয়েকে রাস্তা পেরোতে দেখে। এই মেয়েটা এক দু’বার দেখেই রাস্তায় নামে। তারপর দ্রুত পায়ে রাস্তা পেরোতেই সাইফুল্লাহ অবাক হয়ে দেখে মেয়েটাকে উনি চেনেন, কুঞ্জল! ওর কাছে এসেছে?

সাইফুল্লাহ হাত নাড়ে, কিন্তু মেয়েটা বুঝি খেয়াল করেনি ও এখানে বসে আছে। এবার ও গলা বাড়িয়ে ডাক দেয়, ‘কুঞ্জল।’

কুঞ্জল থমকে যায়, এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজে, কে ডাকল। একটু তাকাতেই দেখে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছে সাইফুল্লাহ স্যার। এবার ওর মুখে হাসি ফোটে।

কাছে এসে বলে, ‘আপনি এখানে? আমি আপনার বাসায় যাচ্ছিলাম।’

সাইফুল্লাহ মুচকি হাসে, ‘আমাকে তো নাও পেতে পারতেন? বসুন এখানে। চা খাবেন তো?’

কুঞ্জল বেঞ্চে একটা ফু দিয়ে বসে পড়ে, তারপর মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, খাব। মালটা চা।’

সাইফুল্লাহ এবার গলা তুলে ইয়াসিনকে এক কাপ মালটা চা দিতে বলে। তারপর মিটিমিটি হেসে বলে, ‘আপনার অনেকদিন কোনো খবর নেই। সব ভালো তো?’

কুঞ্জল হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। তারপর ব্যাগ থেকে একটা কাগজে মোড়ানো জিনিস বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে , ‘এটা আপনার।’

সাইফুল্লাহ আগ্রহ নিয়ে মোড়কটা খোলে, তারপর অবাক বিস্ময়ে বলে, ‘ট্রফি? আপনি কি সত্যি সত্যি দৌড়েছেন?’

কুঞ্জল বাচ্চাদের মতো মাথা দোলায়, তারপর আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি খুশি হয়েছেন?’

সাইফুল্লাহ মায়া নিয়ে ওর দিকে তাকায়, ‘খুব খুশি হয়েছি। এই তো, এভাবেই জীবনের সব কষ্টকে দৌড়ে পেছন ফেলে দিতে হবে। চলুন, বাসায় যেয়ে বসি। আপনার গল্প শুনব।’

চা শেষে ওরা হাঁটতে হাঁটতে বাসার দিকে এগোয়। সাইফুল্লাহ আড়চোখে ওকে খেয়াল করে, মেয়েটার মন খারাপ? কেমন মাথা নিচু করে হাঁটছে।

আজ আর ছাদে বসে না। রুমের ভেতর সেই গদিওয়ালা চেয়ারে আরাম করে বসে। তারপর অনুযোগের গলায় বলে, ‘আপনি নিজ থেকে আমার খবর নেন না কেন?’

সাইফুল্লাহ মিটিমিটি হেসে বলে, ‘আমি জানি আপনি ভালো আছেন। আর এও জানি, খারাপ থাকলে ঠিক আমার কাছে চলে আসবেন, এই যেমন আজ এসেছেন।’

কুঞ্জল আনমনে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে, ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। আমি আর পারছি না, সম্পর্কটা দিন দিন বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে।’

সাইফুল্লাহ ওর দিকে ঝুঁকে এসে বলে, ‘বেরিয়ে যান তাহলে। কি, সাহস হচ্ছে না বেরোতে?’

কুঞ্জল একটু চমকে ওঠে, উনি এত সহজে ওকে বেরিয়ে যেতে বলছে? ও ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, সাহস হচ্ছে না। ছেলের কথা ভাবি, নিজের কোনো উপার্জন নেই সেটাও একটা বড়ো বাধা। তাই মার খেয়ে অপমান হজম করে সংসার করি।’

সাইফুল্লাহ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘গায়ে হাত তুলেছে! কী বলছেন? কেন?’

কুঞ্জল লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে সংক্ষেপে সব খুলে বলে। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ও কেন এমন করল বলতে পারেন?’

সাইফুল্লাহ মন খারাপ গলায় বলে, ‘দুইজন পার্টনারের মাঝে একজন যদি অপরাধ করে আর সেটা ধরা পড়ে তখন সে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। সে তখন সুযোগ খুঁজতে থাকে পার্টানারের এমন কোনো অপরাধ বা ভুল ধরতে পারে কি-না। অভীক আপনাকে ওর মতো অপরাধী প্রমাণ করতেই এমন করেছে। যাতে ওর অপরাধ জায়েজ হয়। আপনিও যদি ওর মতো অন্য আরেকজনের সাথে প্রেম করে ধরা পড়েন তাতে ওর খুব সুবিধা হয়। ওর হীনমন্যতাটা কমে। মানুষ কখনও নিজের কাছে কিংবা অন্যের চোখে নিজেকে মন্দ মানুষ হিসেবে দেখতে চায় না। কিন্তু যেহেতু অভীক আপনার চোখে মন্দ হিসেবে ধরা পড়েছে, এখন আপনি যদি সামান্য ভুলও করেন সেটা ও অনেক বড়ো করে উপস্থাপন করবে।’

কুঞ্জল মাথা নাড়ে। কথাটা ঠিক বলেছেন উনি। তারপর ও একটু ভেবে বলে, ‘আচ্ছা, আমি যে ওই শেফ অংশুল ছেলেটার সাথে আমার কষ্টগুলো শেয়ার করার জন্য কথা বলছি, এটা কি ঠিক হচ্ছে?’

সাইফুল্লাহর চোখে হাসি খেলা করে। ও চোখ কুঁচকে বলে, ‘আচ্ছা, আপনি যে আমার সাথে কষ্টের কথা শেয়ার করতে আমার বাসা পর্যন্ত আসছেন তাতে কি আপনার মনে কোনো প্রশ্ন জাগে? মানে এটা ঠিক না বেঠিক এমন প্রশ্ন?’

কুঞ্জল এর উত্তর দিতে দেরি করে না, নির্দ্বিধায় বলে, ‘না তো। এমন প্রশ্ন মাথায়ই আসে না।’

সাইফুল্লাহ হেসে বলে, ‘কিন্তু অংশুল ছেলেটার ক্ষেত্রে আসছে। তার মানে আপনি নিজেই দ্বিধান্বিত। কাজটা তখনই অন্যায় হবে যখন আপনি নিজে ভাববেন কাজটা অন্যায়। আপনি যেহেতু এটা নিয়ে দ্বিধান্বিত সেক্ষেত্রে আপনার মনে কোথাও এটা নিয়ে অপরাধবোধ আছে। সম্পর্কটা আমার সংগে যেমন সহজ, তেমন হলে প্রশ্নটা আসত না।’

কুঞ্জল চেয়ে থাকে। এই লোকটা এত সুন্দর করে ব্যাপারটা পরিস্কার করে দিল! আসলেই তো, অংশুলকে নিয়ে ওর একটু হলেও অস্বস্তি আছে। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘অভীক এটাকে ইস্যু করে আরও খারাপ ব্যবহার করবে। আমি অবশ্য সেটা ভাবছি না। ও যেহেতু আমার গায়ে হাত তুলেছে, আমি আর ওর সাথে থাকব না। কিন্তু এত সাহস ও কোথা থেকে পায়?’

সাইফুল্লাহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘কারণ ও জানে আপনার যাবার জায়গা নেই। আপনি স্বাবলম্বী হলে এটা করত না হয়তো।’

একটা অক্ষম রাগ টের পায় কুঞ্জল। কেন যে বিয়ের পর সব ছেড়ে দিল। হতাশ চোখে তাকিয়ে বলে, ‘আমি তো এখন এই বয়সে চাকরিও খুঁজে পাব না।’

সাইফুল্লাহ আশ্বস্ত করে বলে, ‘এখন মানুষ অনেক কিছুই করছে। আপনি এত সুন্দর রাঁধেন, অনলাইন রেস্টুরেন্ট বিজনেস করতে পারেন। মানে, খাবারের অর্ডার নিলেন, বানিয়ে দিলেন। সেক্ষেত্রে আমি এক নম্বর কাস্টমার হব আপনার।’

কুঞ্জল একটু হাসে, ‘সে আপনাকে আমি এমনি রেঁধে খাওয়াব। আপনি ফ্রি ফ্রি আমাকে সময় দিচ্ছেন।’

সাইফুল্লাহ হাত নাড়ে। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘জীবনের একটা সহজ সাধারণ নিয়ম থাকে। আপনি এত ভাববেন না। আপনি শুধু যেখানে পৌঁছাতে চাচ্ছেন সেখানে যাবার জন্য যা করার তাই করুন। জীবন আপনাকে হতাশ করবে না। আমি আপনাকে শুধু এক জোড়া জুতো দিয়েছিলাম। আর আপনি দৌড়ে ঠিক একটা ট্রফি জিতে নিয়ে এলেন। অথচ এর আগে কোনোদিন দৌড়ানোর কথা ভাবেননি। আজ আমি আপনাকে আরেকটা জিনিস দেব, দেখেন কতদূর যেতে পারেন।’

কুঞ্জল কৌতুহলী চোখে ওর দিকে তাকায়। সাইফুল্লাহ উঠে ভেতরে যায়। একটু পরেই হাতে পুরনো একটা ডায়েরি নিয়ে আসে। ওর হাতে দিয়ে বলে, ‘আমার স্ত্রী আপনার মতো রাঁধতে পছন্দ করত। সেদিন আপনি যে জলপাই দিয়ে পাবদার ঝোল করে খাওয়ালেন আমার তখন ওর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। ও আপনার মতো এমন পুরোনো দিনের সব মজার রান্না করত। এটাতে ওর নিজস্ব কিছু রেসিপি আছে, যদি কাজে লেগে যায় আপনার। দেখা গেল এটা দিয়েই আপনি দেশ সেরা রাঁধুনি হয়ে গেলেন।’

কুঞ্জল পরম মায়ায় ডায়েরিটা হাতে নেয়। তারপর যত্নের সাথে খুলে – কুমড়োর ছক্কা, বাদাম ভর্তা, আমের টকে পঞ্চপদী ডাল। গোটা গোটা অক্ষরে সুন্দর হাতের লেখা। চোখ জুড়িয়ে যায়। বোঝা যায় মানুষটা পরিপাটি ছিলেন।

কুঞ্জল নরম গলায় বলে, ‘এত মূল্যবান একটা জিনিস আমাকে দিয়ে দিলেন?’

সাইফুল্লাহর মুখে একটা আলো খেলা করে, ও সস্নেহে বলে, ‘আমি চাই আপনি এগিয়ে যান। আপনার ভেতরের শক্তিগুলো কাজে লাগান। আর নিজের উপর বিশ্বাস রাখবেন। আপনি ঠিক লক্ষে পৌঁছে যাবেন।’

কুঞ্জল উজ্জ্বল চোখে ওর দিকে তাকায়, তারপর এক বুক আশা নিয়ে বলে, ‘সত্যিই আমি পারব?’

সাইফুল্লাহ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে, তারপর গম্ভীর গলায় বলে, ‘অবশ্যই।’

কুঞ্জলের মনের ভেতর অস্থিরতাটা কমে। মনটা শান্ত হয়ে আসে। ও পারবে, নিশ্চয়ই মুক্তির পথ খুঁজে পাবে। একটা কৃতজ্ঞতা ওকে ঘিরে ধরে। এই মানুষটা বার বার ওর অস্থির মন শান্ত করে দিয়েছে।

ও কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, আপনি আমার জন্য এত করছেন কেন? আমি তো আপনাকে আপনার প্রাপ্য কিছুই দেই না। মানুষ এমনি এমনি কারও জন্য কখনও কিছু করে না।’

সাইফুল্লাহ কিছুক্ষণ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তারপর উঠে যেয়ে ভেতরের ঘর থেকে একটা ছবি নিয়ে আসে। ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ওই যে আপনাকে ডায়েরিটা দিলাম এটা ইনি মানে আমার স্ত্রীর ছবি। ওনার জন্যই করি। কাকতালীয়ভাবে ওর নামও ছিল কুঞ্জল। আমি কোকিল বলে ডাকতাম। যেদিন আপনি পা মচকে হাসপাতালে আপনার নাম কুঞ্জল লিখলেন সেদিন চমকে উঠেছিলাম। সচারাচর এমন নাম কম শুনি। তাই একটা মায়া পড়ে গেছে আপনার উপর।’

কুঞ্জল মায়া নিয়ে সাইফুল্লাহর দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষ কত বিচিত্র হয়। একজন এখনও তার মৃত স্ত্রীর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। তার সাথে সামান্য নামের মিলের জন্যও কত কিছু করছেন। আর অভীক? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুঞ্জল বিদায় নেয়। কথা দেয়, ও হেরে যাবে না, ওর ভেতরের শক্তিগুলো খুঁজে দেখবে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে