#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১০)
১.
কুঞ্জল ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি সামান্য এই রান্নার ভিডিও ওকে এমন একজন মানুষের সংগে পরিচয় করিয়ে দেবে। অংশুল যে ওর মতোই দুঃখ পাওয়া মানুষ সেটা ও সেদিন দেখা হবার আগ পর্যন্ত জানত না। আর এত সহজে মনের আগল খুলে দেবে এটা ও ভাবতেই পারছে না। একজন নিতান্ত অপরিচিত মানুষ কেমন করে মুহুর্তে এত আপন হয়ে যায় এটা ভেবে ও বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে। এমন অভিজ্ঞতা ওর প্রথম। লোকটার সাথে ওর বার বার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ইদানিং সারাদিন টুকটাক করে কথা হয়। নিজেদের দুঃখ নিয়ে, রান্না নিয়ে। তাতে করে ওর মনের চাপটা যেন অনেকটাই কমে। সাইফুল্লাহ স্যারকেও ও অনেক কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু অংশুলের সাথে ওর কষ্টের মিল থাকাতে বলতে ইচ্ছে করে। ওর কষ্টটা আরও বড়ো। যে মেয়েটাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সেই মেয়েটাই বিয়ের পাঁচ ছয় বছরের মাথায় অন্য একটা ছেলের সাথে জড়িয়ে যায়। এবং ভীষণ বাজেভাবেই জড়ায়। অন্তরঙ্গ কিছু মুহুর্তের ছবিও ও দেখেছিল। ভীষণ আঘাত পেয়েছিল অংশুল। বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণা, ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। ওর কষ্টের কথা শুনে কুঞ্জল একটু হলেও নিজের দুঃখ ভুলতে পেরেছে। অভীক হয়তো অতটা জড়ায়নি কারও সাথে।
কথাটা ভাবতেই ও নিজের মনকে প্রশ্ন করে, ও আসলে কতটুকু জানে অভীক সম্পর্কে? দু’দুটো মেয়ের সংগে প্রেম ছিল, সেটা কি অন্তরঙ্গতার সীমা অতিক্রম করেনি? কথাটা ভাবতেই আবার মাথা গরম হয়ে যায়। নাহ, এসব আর ও ভাববে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখবে। রান্নার পেজটা দ্রুত পরিচিতি পাচ্ছে। এটাতেই সময় দেবে। আর ইদানিং অর্কের সাথে সকালে দৌড়াতে ভালোই লাগে। আচ্ছা, সেদিন তুহিন যে বলল ম্যারাথনে দৌড়ে নাম লেখাতে, লেখাবে?
একটু ভেবে ও ফোন দেয় তুহিনকে। ওকে ম্যারাথনের কথা বলতেই ও উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘আপু, সত্যিই তুমি নাম লেখাবে? দারুণ হবে। আমি তো পৃথুল আপুকে কতবার বলেছি, ও একটা অলস।’
কুঞ্জল হেসে ফেলে, তারপর বলে, ‘কিন্তু ম্যারাথন দৌড় কি আমি দৌড়ুতে পারব?’
তুহিন একটু ভেবে বলে, ‘আপু, প্রথমে অল্প দূরত্বের দৌড়গুলো দৌড়াতে পারো। সামনের ২৬ তারিখে একটা পাঁচ কিলোমিটার রান আছে। আফরোজা আপু, আমি যাব ওটাতে। তুমি আপাতত এগুলোতে দৌড়াও। পরে ধীরে ধীরে দশ, পনের এভাবে বাড়াতে পারো। পরে হাফ ম্যারাথন মানে ২১ কিলোমিটারের ইভেন্টে দৌড়ুতে পারবে।’
কুঞ্জল চোখ কপালে তুলে, ‘হাফ ম্যারাথনই এত! আমি পারব না।’
তুহিন হাসে, ‘আগে শুরু করো, দেখবে তুমি কত কী পারো। আমিও একসময় ভাবতাম এত লম্বা পথ দৌড়ুতে পারব না। কিন্তু এখন দৌড়ুতেই ভালো লাগে।’
কুঞ্জল হাসে, তারপর দৌড়ের আরও খুঁটিনাটি জেনে ফোনটা রাখে। তার আগে ৫ কি.মি. রানের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করে ফেলতে বলে। দেখাই যাক, কী হয়।
পরদিন স্কুলে যেতেই পৃথুল হইহই করে ওঠে, ‘এই, তুই নাকি দৌড়াবি? তুহিন কাল রাতে বলল। ইশ, আমি যদি তোর মতো দৌড়ুতে পারতাম!’
কুঞ্জল ওর হাত চেপে ধরে বলে, ‘আমার সাথে তুই চল না, প্লিজ। একা একা খুব অস্বস্তি হচ্ছে।’
পৃথুল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘একা কই? তুহিন যাবে, আফরোজা আপু আছে। যা, ভালো লাগবে। আমার তো উলটো হিংসে হচ্ছে তোকে।’
সেদিন বহুদিন পর ওরা মন খুলে গল্প করে। অংশুলের কথা বলতেই পৃথুল চোখ টিপে বলে, ‘দেখিস, আবার প্রেমে পড়ে যাস না। লোকটা কিন্তু দারুণ স্মার্ট।’
কুঞ্জল হাসে ওর কথা শুনে। মনের ভেতর একটা অজানা ভয় ওকে একটু হলেও ছুঁয়ে যায়। ও আবার জড়িয়ে পড়ছে না তো? নাহ, নিজেকে একটু সামলাতে হবে। সেদিন ইচ্ছে করেই সারাদিন আর অংশুলকে ও মেসেজ দেয় না।
সন্ধ্যার পর অংশুলের ছোট্ট একটা মেসেজ আসে, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’
মেসেজটা পেয়ে কুঞ্জলের কেন যেন ভালো লাগে। অংশুল ওর মেসেজ না পেয়ে চিন্তা করছে এটা ওকে আনন্দ দেয়। কিন্তু সেইসাথে মনের ভেতর একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, তবে কি ও মনের অজান্তেই অংশুলের মেসেজের জন্য অপেক্ষা করে ছিল?
ও দ্রুত টাইপ করে, ‘হ্যাঁ, ঠিক আছি। একটা লম্বা দৌড়ে নাম দিলাম, তাই নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।’
ওপাশ থেকে বিস্ময়ের ইমোজি আসতেই কুঞ্জল সব খুলে বলে। পুরোটা শুনে অংশুল অবাক হয়ে লিখে, ‘ইশ, আগে জানলে আমিও আপনার সাথে দৌড়ুতাম। কতদিন দৌড়াই না। নাহ, এখন থেকে আপনার মতো সকালে দৌড়াব। তারপর এমন ইভেন্টগুলোতে যাব। আমাকে নিয়ে যাবেন তো?’
কুঞ্জল হাসির একটা ইমোজি দিয়ে বলে, ‘আগে দৌড়ে দম ঠিক করুন।’
কুঞ্জল টের পায় ওর মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। অংশুলের সাথে সব শেয়ার করতে খুব ভালো লাগছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি ঠিক হচ্ছে? নাহ, অনেক দিন সাইফুল্লাহ স্যারের সাথে দেখা হয় না। যেতে হবে। মনের ভেতর এই দ্বন্দ্বটা নিয়ে একটু কথা বলতে হবে। দৌড়টা শেষ করেই ও দেখা করতে যাবে। ওনাকে জানিয়েও আসবে ও দৌড়াচ্ছে। নিশ্চয়ই খুশি হবেন।
এর ক’দিন পর স্কুলে যেতেই কুঞ্জলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। অর্কের স্কুলের ফাইনাল খেলা নাকি ২৬ তারিখেই। কথাটা শোনামাত্র ওর মন খারাপ হয়ে যায়। তাহলে তো ওর দৌড়ানোটা হবে না।
ওর মন খারাপ দেখে পৃথুল আশ্বস্ত করে বলে, ‘আরে, তুই অত ভাবছিস কেন? অর্কের সাথে আমি থাকব। তোর দৌড় তো সকালেই শেষ হয়ে যাবে। আর ওদের খেলা শুরু হতে হতে সকাল দশটা। এর মধ্যে তুই চলে আসতে পারবি। তুই ভাবিস না, আমি বাসায় এসে অর্ককে নিয়ে যাব। আমার ইরাও তো দৌড়ে নাম লিখিয়েছে। ওদের দু’জনকে নিয়ে আমি স্কুলে চলে যাব। তুই সরাসরি স্কুলে চলে আসিস।’
কুঞ্জল হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, ‘সত্যিই তুই কত করছিস আমার জন্য। তোর কাছে যে আমার অনেক ঋণ।’
পৃথুল তেড়ে মারতে আসে, ‘তোর জন্য এইটুকু করতে না পারলে কিসের বন্ধু? আচ্ছা, অভীক ভাইয়া আসবে না ওইদিন?’
কুঞ্জল অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ে যার অর্থ হ্যাঁ বা না হতে পারে। পৃথুল আর কথা বাড়ায় না। ওর কেন যেন মনে হয় কুঞ্জল আর অভীকের সম্পর্কটা ঠিকঠাক যাচ্ছে না।
দেখতে দেখতে পঁচিশ তারিখ এসে যায়। কুঞ্জলের হঠাৎ করেই মনে হয় অভীককে ওর দৌড়ানোর ব্যাপারে এখনও কিছু বলা হয়নি। যদিও বলার কিছু নেই, কিন্তু সকালে পৃথুল যখন অর্ককে নিতে আসবে তখন একটা ঝামেলা হতে পারে।
কুঞ্জল একবার লিভিং রুমের দিকে তাকায়। অভীক টিভি দেখছে। অর্ক পাশেই বসে বাবার সাথে গল্প করছে।
কুঞ্জল পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়, তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘অর্ক তোমার বাবাকে বলো কাল আমার সকালে ম্যারাথন দৌড় আছে। তোমার পৃথুল খালামণি এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। আমি সকাল দশটার মধ্যে স্কুলে চলে আসব।’
কুঞ্জল এখনও ওর সাথে সরাসরি কথা বলে না।
অভীক ওর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায়, তারপর অবাক গলায় বলে, ‘তোমার ম্যারাথন দৌড় আছে মানে?’
অর্ক পাশ থেকে উৎসাহের সাথে বলে, ‘বাবা, তুমি তো জানোই না কাল আম্মু দৌড়াবে। আমারও কাল স্কুলে ফাইনাল খেলা, আমিও দৌড়াব।’
অভীক কিছুই বুঝতে পারছিল না। ও জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘তুমি কাল সকালে কোথায় যাচ্ছ?’
কুঞ্জল বিরক্ত গলায় বলে, ‘বললাম তো ম্যারাথন দৌড় দৌড়াতে। আমাদের এখান থেকে আফরোজা আপু যাবেন। উনি গাড়ি নিয়ে আসবেন। আর পৃথুলের ছোট ভাই তুহিনও যাবে। ওদের সাথেই ভোরে বেরিয়ে যাব। আমাদের বাসার কাছেই। পৃথুল সকালে এসে অর্ককে নিয়ে যাবে। আমি পরে সরাসরি ওর স্কুলে যাব।’
ব্যাপারটা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগে অভীকের। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তুমি ছেলে মানুষের সাথে দৌড়াবে?’
কুঞ্জল সরু চোখে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘তো? ছেলেমানুষের সাথে দৌড়ালে কী হয়? সবাইকে নিজের মতো ভেব না। আর তোমার জানার জন্য বলছি, আমাদের সাথে অনেক মেয়েও দৌড়াবে।’
অভীকের হুট করেই রাগ উঠে যায়, ও কর্কশ গলায় বলে, ‘খুব শখ না, ছেলেদের সাথে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে দৌড়াবে। অসভ্য মেয়েছেলে কোথাকার।’
অর্ক ভয় নিয়ে আম্মুর মুখের দিকে তাকায়। কুঞ্জল আর নিজেকে সামলাতে পারে না, ‘অসভ্য তো তুমি। ঘরে বউ রেখে বাইরের মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে বেড়াও। আমাকে নিয়ে একটা বাজে কথা বললে তোমার খবর আছে। অর্ক, চলো, ঘুমোবে। সকালে উঠতে হবে।’
অর্ক মায়ের সংগে বেডরুমে চলে যায়। অভীক বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কুঞ্জল কবে কবে এতটা বদলে গেল! একবার ওকে জানাবার প্রয়োজন মনে করেনি যে ও ম্যারাথনে দৌড়াবে। অভীক যত বেশি করে কাছে আসার চেষ্টা করছে ও ততোই দূরেই সরে যাচ্ছে।
আর এদিকে কুঞ্জলের তখনও অপমানে গা জ্বালা করছিল। ছেলের সামনে এমন কুৎসিত কথা ও বলতে পারল? চোখ ফেটে কান্না আসে। অর্ক মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আম্মু, তুমি কান্না কোরো না। আমি কাল একা একাই যেতে পারব, আর দৌড়ে ফার্স্ট হব।’
কুঞ্জল ছেলেকে বুকে চেপে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেলে। আর কত অপমান ও সইবে?
২.
ভোর ৫.১৫। আফতাবনগরে এই ভোর বেলাতেই লোকে লোকারণ্য। অনেক মেয়েরা এসেছে। এত মেয়ে দেখতে পাবে ভাবেইনি। ওর চেয়ে বয়সে বড়োরা যেমন আছে আবার ছোটরাও আছে। আজ সবাই একই রকমের জার্সি পরা। কুঞ্জলও তাই পরেছে। চারদিকে একটা উৎসব উৎসব ভাব।
ও অবাক গলায় বলে, ‘তুহিন, এত লোক দৌড়ুবে?’
তুহিন হেসে বলে, ‘হ্যাঁ আপু, এরা সবাই দৌড়ুবে। চলো স্টার্টিং মার্কে যাই। তুমি আর আফরোজা আপু তো পাঁচ কিলোমিটার দৌড়ুবে, তাতে এক ঘণ্টার মধ্যেই তোমাদের শেষ হয়ে যাবে। আমারটা ২৫ কিলোমিটার, সময় লাগবে। তুমি আফরোজা আপুর সাথে চলে যেও। তোমাদের সার্টিফিকেট আমি নিয়ে আসব।’
আফরোজা আপু খুব হাসিখুশি একজন মানুষ। কুঞ্জলকে দেখে উনি ভীষণ খুশি হয়েছেন। কুঞ্জলকে একটা পানির বোতল দিয়ে বলেন, ‘অল্প অল্প করে পানি খাবে। খেয়াল রেখো শরীর যেন ঠিকঠাক পানি পায়। না হলে কিন্তু খুব অসুবিধে। আর সবসময় তোমার শরীরের কথা শুনবে। যদি মনে হয় দৌড়ুতে কষ্ট হচ্ছে তাহলে সাথে সাথে থেমে যেও। তুমি তো আজ প্রথম দৌড়ুবে, তাই সমস্যা হতেই পারে। জোর করে দৌড়োনোর দরকার নেই। আর আমি যদি আগে শেষ করে ফেলি তাহলে ওই গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকব। একসাথেই ফিরব।’
কুঞ্জল মাথা নাড়ে। আপুর এই টিপসগুলো ও আগেও পেয়েছে। এখন আরেকবার মনে পড়ল।
ভোর পাঁচটা চল্লিশে দৌড় শুরু হয়। এত মানুষ, একটু হুড়োহুড়ি হয় প্রথমটায়। কুঞ্জল দৌড়ের শুরুতেই আফরোজা আপুকে হারিয়ে ফেলে। ওর কেমন ভয় লাগতে থাকে। ছোট ছোট স্টেপে ও দৌড় শুরু করে। কিছুদূর এগোতেই ভীড়টা কমে। ওকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় অনেকেই উৎসাহ দিয়ে যায়। একজন বয়স্ক মানুষ ওকে পার হয়ে যাবার সময় বলে, ‘মাথা সোজা রাখবেন, নিচের দিকে বার বার তাকাবেন না।’
কুঞ্জল মাথা উঁচু করে সামনের দিকে তাকিয়ে দৌড়াতে থাকে। ও মনে মনে হিসেব করে, প্রতি দশ মিনিটে এক কিলোমিটার পেরোতে হবে। সেদিক দিয়ে হিসেব করলে ও অনেকটাই পিছিয়ে।
তিন কিলোমিটার শেষ করতে ওর পয়ত্রিশ মিনিট লেগে যায়। একটু পিছিয়েই পড়েছে ও। নাহ, এবার স্পীড বাড়াতে হবে। ও এবার একটু জোরে দৌড় শুরু করে। একটা জিনিস টের পায়, এখনও ওর ক্লান্ত লাগছে না। কিন্তু খুব পানি পিপাসা পেয়েছে। ও দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রাউজারের পকেটে হাত দেয়। কয়েকবার খোঁজে, পানির বোতলটা নেই! হায় হায়! পানির বোতলটা কি তখন হুড়োহুড়িতে পড়ে গেল? কিন্তু ভীষণ পানি পিপাসা পেয়েছে যে।
কারও কাছে চাইবে তাতে সংকোচ হয়। ও শুকনো মুখে দৌড়ুতে থাকে। কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে এখন। ঠিক এই সময় একটা মোটরসাইকেল ওর পাশে এসে চলতে থাকে। কেউ একজন ওর নাম ধরে ডাকে, ‘কুঞ্জল, দারুণ দৌড়ুচ্ছেন।’
কুঞ্জল অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে অংশুল। হঠাৎ ওর মনে পড়ে আজকের দৌড়ের ইভেন্ট নিয়ে অংশুল ক’দিন আগেই জানতে চেয়েছিল।
ও চোখ বড়ো বড়ো করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘আপনি এখানে!’
অংশুল হাসে, তারপর বলে, ‘আপনার কথা বলতে হবে না। তাহলে দৌড়াতে কষ্ট হবে। আমি ভোরেই এসেছি। কিন্তু এত মানুষের ভেতর খুঁজে পাইনি। কয়েকবার করে চক্কর কেটে এই পেলাম। আপনার জন্য স্পেশাল একটা লেমোনেড বানিয়ে নিয়ে এসেছি। এটা দৌড়ুনোর সময় খেলে খুব কাজে লাগে। এই নিন।’
কুঞ্জলের মনে হয় ও যেন হাতে স্বর্গ পেল। বোতলটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ঢক ঢক করে খেতে থাকে। অংশুল মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘামে ভেজা মুখটা চিকচিক করছে। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। এত সুন্দর লাগছে দেখতে!
কুঞ্জল বোতলটা ফেরত দিয়ে বলে, ‘একটু পানি খাব। পারলে একটু এনে দেবেন?’
অংশুল হাসে, ‘সেটাও এনেছি। এই নিন। আপনি আসতে থাকুন, আমি আপনার আশেপাশেই আছি।’
অংশুল একটু সামনে এগিয়ে যায়। কুঞ্জলের কেন জানি এখন খুব ভালো লাগছে। এতক্ষণ খুব একা একা লাগছিল, ভয় লাগছিল। রাস্তাটার এই অংশে প্রতিযোগী কম।
অংশুল একটু এগিয়ে গিয়ে থামে। কুঞ্জল যখন দৌড়ে কাছাকাছি আসে তখনই আবার ও সামনে এগিয়ে যায়। অংশুলকে আজ খুব সুন্দর লাগছে জিন্স আর সাদা টি-শার্ট তার উপর কালো জ্যাকেটে দারুণ হ্যান্ডসাম লাগছে।
অংশুল উৎসাহ দেবার গলায় বলে, ‘ফাইনাল ল্যাপ। এবার কিন্তু জোরে দৌড়াতে হবে।’
কুঞ্জল হাতঘড়ির দিকে তাকায়। মিনিট পাঁচেকের মতো ও পিছিয়ে আছে। হ্যাঁ, এবার ও সবটুকু দিয়ে দৌড়ুবে। ইচ্ছে করেই প্রথমে আস্তে আস্তে দৌড়িয়েছে।
কুঞ্জল গতি বাড়ায়। একে একে অনেকেই এবার পিছে পড়তে থাকে। শেষ দুইশ মিটার ও দৌড়ুয় একদম পেশাদার দৌড়বিদদের মতো। লম্বা লম্বা স্টেপে হরিণের মতো ছুটতে থাকে। আর অবাক হয়ে খেয়াল করে ওর সামনে দুইজন মাত্র প্রতিযোগী আছে। চারপাশ থেকে সবাই চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে। তার মাঝে অংশুলের গলাটাও শুনতে পায়। কুঞ্জল একবার অর্কের মুখ মনে করে, তারপর শরীরের সবটুকু শক্তি এক করে ছোটে।
কুঞ্জলে বুক হাঁপড়ের মতো উঠানামা করছে। UCR এর একজন অফিশিয়াল এসে ওকে অভিনন্দন জানায়, ‘আপনি সেকেন্ড হয়েছেন। আপনি কিন্তু থাকবেন, সবার শেষ হলে আমরা সার্টিফিকেট আর প্রাইজমানি দেব। আপনি একটা ক্রেস্টও পাবেন।’
কুঞ্জল অবিশ্বাস নিয়ে তাকায়। ও সেকেন্ড হয়েছে! এমন সময় অংশুল হইহই করতে করতে এগিয়ে আসে, ‘অসাধারণ পারফরম্যান্স। আপনি তো দেখি মাত করে ফেললেন। কংগ্রাচুলেশনস কুঞ্জল।’
কুঞ্জল কপালের ঘাম মুছে বলে, ‘অনেক ধন্যবাদ।’
কিছুক্ষণ পর আফরোজা আপু হাঁপাতে হাঁপাতে আসেন। চোখ কপালে তুলে বলেন, ‘তুই তো দেখি এসেই বাজিমাত করে দিলি। কংগ্রাচুলেশনস কুঞ্জল। অনেক ভালো লাগা। শোন, আমার যেতে দেরি হবে। তুহিন বলছিল তোর নাকি তাড়া আছে। কিন্তু তুই যাবি কী করে? আর তোর প্রাইজ, সার্টিফিকেট, ট্রফি এগুলো নিবি না?’
কুঞ্জল অসহায় গলায় বলে, ‘আপু, আজ আমার ছেলের স্কুলে ফাইনাল খেলা। আমাকে এখনই যেতে হবে। আপনি যদি কষ্ট করে আমার ট্রফি প্রাইজ মানি নিয়ে আসতেন খুব খুশি হতাম।’
আফরোজা আপু মন খারাপ গলায় বলে, ‘আহারে, এতো ভালো করলি, নিজ হাতে পুরস্কার নিবি না? আচ্ছা, তুই যা আমি নিয়ে আসব তোরটা।’
কুঞ্জল থ্যাংকস জানিয়ে এবার ছোটে। পেছন থেকে অংশুল ওর মোটরসাইকেল চালিয়ে এসে ওর পাশে থামে, ‘আপনি চলে যাচ্ছেন! একবার বিদায় নিলেন না?’
কুঞ্জল লজ্জিত গলায় বলে, ‘সরি। আমার মাথার ঠিক নেই। আমার এখনই বাসায় যেতে হবে। আজ অর্কের স্কুলে ফাইনাল খেলা। আফরোজা আপুর গাড়িতে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু উনি এখন যাবেন না। ভীষণ মুশকিল হয়ে গেল।’
অংশুল ওর দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনি আমার কথা একবারও ভাবলেন না? দেখলেন তো আমি মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছি। তাও আমার কাছে লিফট চাইলেন না? আমি কি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসলে খুব অন্যায় হবে?’
কুঞ্জল থমকে ওর মুখের দিকে তাকায়। ওর গলায় একটা অভিমান টের পায়। কেমন বাচ্চাদের মতো মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও অভিমানটা পাত্তা দেওয়া উচিত না, কিন্তু আগে পৌঁছুতে পারবে এই ভেবে ও রাজি হয়। হাসিমুখে বলে, ‘আপনি পৌঁছে দিয়ে এলে খুব উপকার হয়। আগে যেতে পারব।’
অংশুলের মুখে এবার হাসি দেখা যায়। কুঞ্জল উঠে বসে আলতো করে ওর কাঁধটা ধরে। অংশুল এক্সিলারেটরে চাপ দেয়, মোটরসাইকেল এগিয়ে চলে।
আধা ঘন্টার মধ্যেই ওরা পৌঁছে যায়। কুঞ্জল দ্রুত নেমেই দৌড় দিতে নিয়েও থেমে যায়। তারপর ফিরে এসে হেসে বলে, ‘থ্যাংকিউ সো মাচ। আমার ভীষণ উপকার হলো। এটাই আমার বাসা। আজ উপরে আসতে বলতে পারলাম না। আমি এখুনি ড্রেস চেঞ্জ করে স্কুলে যাব। আরেকদিন অবশ্যই আসবেন।’
অংশুল মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘সে না হয় আসব। আপনি তো ছেলের স্কুলে যাবার তাড়া আছে, চাইলে আমি অপেক্ষা করি। আপনি নামুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।’
কুঞ্জল হাসে, তারপর বলে, ‘স্কুলটা কাছেই, অসুবিধা হবে না। আমি যাই।’
কথাটা বলে কুঞ্জল আর দাঁড়ায় না।
অংশুল ওর চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর হালকা করে মাথা নেড়ে মোটরসাইকেল ঘুরিয়ে চলে যায়।
কুঞ্জল দ্রুত লিফট থেকে নেমে দরজার চাবি ঘুরিয়ে খুলতেই দেখে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ? ও ভ্রু কুঁচকে তাকায়, অভীক বাসায়?
কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে যায়। ও অবাক হয়ে খেয়াল করে অভীক দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ থমথমে।
একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে বলে, ‘প্রেমিক পৌঁছে দিল বুঝি? আজ আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আগে না এলে তো দেখতেই পেতাম না। আমাকে খারাপ বলো, আর নিজে তলে তলে এসব করছ। অসভ্য, নষ্টা মেয়ে একটা।’
কথাটা শেষ হতেই সজোরে একটা চড় এসে পড়ে কুঞ্জলের গালে। মাথাটা যেন ঘুরে উঠে। ও গালে হাত চেপে ধরে। বিস্ময়ে বোবা হয়ে ও তাকিয়ে থাকে। অভীক অশ্রাব্য সব গালি দিয়ে যাচ্ছে।
কুঞ্জল চোখের জল মুছে কঠিন গলায় বলে, ‘তুমি আমার গায়ে হাত তুললে? এতটা নীচ। ছিঃ!’
অভীক হিংস্র গলায় বলে, ‘তোর গায়ে হাত তোলাই উচিত।’
কুঞ্জল কেটে কেটে বলে, ‘আরেকবার হাত তুলে দেখো। আমি সোজা যেয়ে থানায় মামলা করব। তখন পুলিশ ঘাড় ধরে থানায় নিয়ে যাবে।’
অভীক থমকায়। ক’দিন আগেই ওর এক কলিগের সাথে এমন হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা খুব কঠিন মামলা, জামিন অযোগ্য। ও গজগজ করতে করতে ভেতরে চলে যায়।
কুঞ্জল নিজের রুমে যেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর আয়নার সামনে একবার দাঁড়ায়, গালে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, গালটা নোনতা জলের স্পর্শে জ্বলে ওঠে।
কী করবে? ইচ্ছে করছে যেদিক দু’চোখ যায় চলে যায়। অর্কের মুখটা মনে পড়ে। ছেলেটা নিশ্চয়ই বার বার ওর আসবার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। আহারে, আমার ছোট্ট অর্ক সোনা। এই প্রেমহীন সংসারের নীল বিষে সব বিষাক্ত। কুঞ্জল সিলিংয়ে ঝোলানো ফ্যানের দিকে তাকায়। বেঁচে থাকতে আর ইচ্ছে করছে না। একটু ভেবে উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কুঞ্জল।
(চলবে)