#প্রেমহীন_সংসার_আহা_সোনামুখী_সুঁই (পর্ব ১)
১.
কুঞ্জল কড়াইয়ের গরম তেলে সবে জিরের ফোড়ন ছেড়েছে আর ঠিক তখুনি বাইরের রাস্তা থেকে একটা হাঁক ভেসে আসে, ‘অ্যাই, পুরানা ভাঙাচোরা কিছু আছে এ এ..’
কুঞ্জল থমকে যায়। কড়াইয়ে এখন পেয়াঁজ কুচি ছাড়তে হবে, কিন্তু ও সেটা বেমালুম ভুলে কেমন একটা বিহবল দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকে। রান্নাঘরের জানালা পেরিয়ে একটা খালি জমি, তাতে লাল শাকের ছোট ছোট চারা মাথা জাগিয়েছে সবে। জমিটা পেরিয়ে গলি রাস্তা। সেখান থেকেই হাঁকটা আসছে। কুঞ্জল উঁকি মেরে তাকাতেই লোকটাকে দেখতে পায়। পুরনো রঙ চটে যাওয়া নীল একটা শার্ট আর বাদামী লুঙ্গী পরা একটা লোক, ভাঙাচোরা মুখ, কাঁধে একটা বড়োসড়ো সাদা বস্তা। লোকটা কুঞ্জলকে উঁকি দিতে দেখে এবার আবার সুর করে হাঁক দেয়, ‘পুরানা ভাঙাচোরা বিক্রি করবে..এ..এ..ন’
কুঞ্জল এবার গলা বাড়িয়ে উঁচু স্বরে ডাকে, ‘অ্যাই, বাড়ির গেটে এসো।’
লোকটা মুখ তুলে একবার ওর দিকে তাকায়, তারপর মাথা নেড়ে রাস্তা ঘুরে বাড়ির গেটের দিকে আসতে থাকে। কুঞ্জল এবার দ্রুত হাতে পেয়াঁজ কুচি ভেজে নেয়। তারপর তাড়াহুড়ো করে অল্প অল্প মসলা ছেড়ে নাড়তে থাকে। এর মাঝেই গেটের কলিংবেলটা বাজতেই ও দ্রুত হাতে পরনের জামাটা ঠিক করে নেয়। বাসায় এখন কেউ নেই, অর্ক স্কুলে, পরীক্ষা চলছে। ওদের ক্লাশ ফোরের পরীক্ষা শেষ হতে হতে দুপুর দেড়টা। তার আগেই রান্না শেষ করে ওকে আনতে যেতে হবে। কাল বাজার থেকে একটা কচি লাউ কিনে এনেছিল। ফ্রিজে শোল মাছ ছিল, তাই দিয়ে আজ দুপুরের রান্না।
কুঞ্জল এক দৌড়ে গিয়ে গেটটা খুলে, দেখে লোকটা বস্তা নামিয়ে সিঁড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও অনুনয়ের গলায় বলে, ‘ভাই, একটু বোসো। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি।’
লোকটা মাথা নেড়ে এবার সিঁড়িতে বসে পড়ে।
কুঞ্জল এবার আগে থেকে বের করে রাখা মাছের টুকরোগুলো দ্রুত মসলায় কষিয়ে নেয়। তারপর মাছ উঠিয়ে কিউব করে কাটা লাউয়ের টুকরোগুলো কড়াইয়ের মসলার ভেতর ছাড়ে। হালকা একটু নেড়ে চুলার জ্বাল কমিয়ে একটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়। তারপর দ্রুত হাতে কিচেনের ক্যাবিনেট থেকে জমে থাকা পুরনো যত প্লাস্টিকের কৌটা বের করে। এরপর নিচের ক্যাবিনেট থেকে একটা ভাঙা ব্লেন্ডার মেশিন বের করে। ব্লেন্ডার মেশিনটা নামী কোম্পানির ছিল। অনেকদিন ঝামেলা ছাড়াই ও ব্যবহার করেছে। এই মেশিনটা ওর প্রতিদিনের রান্নার সংগী ছিল। আজ বেচে দিতে একটু খারাপই লাগছে।
জিনিসগুলো নিয়ে এবার ও লোকটাকে ডাক দেয়, ‘অ্যাই, দেখো তো এগুলোর কত দাম হবে।’
লোকটা নিরুৎসাহিত চোখে প্লাস্টিকের কৌটাগুলো দেখে। তারপর ব্লেন্ডারে চোখ পড়তেই চোখ চকচক করে ওঠে। দ্রুত খুশির ভাবটা লুকায়। বেজার মুখে বলে, ‘প্লাস্টিকের এইগুলান ত্রিশ টাকা কেজি আর এই মেশিনটা পঞ্চাশ টাকা কেজিতে বেচবার পারবেন।’
কুঞ্জল স্পষ্ট বোঝে লোকটা ওকে ঠকাচ্ছে। অন্যদিন হলে এই নিয়ে দামাদামি করত। কিন্তু কেন জানি আজ ইচ্ছে করছে না। ও মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা মাপ দাও। ‘
লোকটা এবার আর দেরি করে না, দ্রুত বস্তার ভেতর থেকে একটা দাড়িপাল্লা বের করে মাপ দিতে থাকে। কুঞ্জল আনমনে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে, ‘এগুলো দিয়ে তোমরা কী করো?’
লোকটা একবার মুখ তুলে, বোঝার চেষ্টা করে প্রশ্নটা। তারপর বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে, ‘মনে করেন এই পুরান প্লাস্টিক বেচমু প্লাস্টিকের কারবার করে যারা তাগো কাছে। ওরা এইগুলান ধুইয়া মুইছা আগুনে গলাইয়া আবার নতুন প্লাস্টিক বানায়। তারপর এই লোহাও দেখা যায় কোনো না কোনা কামে লাগায়। আফা, এই মেশিনটার মতো দামী পুরানা ভাঙাচোরা আর কিছু আছে?’
শেষের কথাটা লোকটা বেশ আগ্রহ নিয়েই বলে।
কুঞ্জলের হঠাৎ করেই বলতে ইচ্ছে করে, আছে তো! ওর আর অভীকের সম্পর্কটা। বিয়ের এই বারো বছরে তা আজ জরাজীর্ণ, পুরাতন, অথচ একসময় কী ভীষণ দামী ছিল! অথচ সেই সম্পর্কটার আজ কোনো মূল্য নেই, অন্তত ওর কাছে। কুঞ্জলের খুব জানতে ইচ্ছে করে, এমন কেউ কি আছে যে এই পুরাতন, ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্কটা নিয়ে ঠিকঠাক করে একদম ঝাঁ চকচকে নতুন একটা টাটকা সম্পর্ক বানিয়ে দেবে?
ও মাথা নাড়ে, ‘নাহ, আর কিছু নেই। আবার এসো একদিন, পেলে বলব।’
লোকটা বিগলিত হেসে বলে, ‘আফা, আপনি খুব ভালা মানুষ। সবাই এই ভাঙাচোরা জিনিস বেচার সময় এমন করে যেন যক্ষের ধন। দামাদামি করে হুদাই। অথচ দেখেন, কয় টেকার আর জিনিস। আমরা তাও টেকা দিয়া কিনা নেই। নাইলে তো এই পুরান, ভাঙাচোরা জিনিস দিয়া কী হইত? এইগুলা তো অচল, বাড়িতে কেবলি জঞ্জাল। ফালায় দেওয়া সবচেয়ে ভালো।’
কুঞ্জল ঠোঁট কামড়ে ভাবে, লোকটা না বুঝে কী দামী একটা কথাই না বলল! ভাঙাচোরা জিনিস আসলেই অচল, ফেলে দিতে হয়। অথচ ও গত একটা বছর সেই ভাঙাচোরা সম্পর্কটাই বয়ে চলছে। ইশ, যদি অন্যান্য ভাঙাচোরা জিনিসের মতো সম্পর্কও বেচে দিয়ে জঞ্জালমুক্ত হতে পারত!
লোকটা মুখে মুখে হিসেব আউড়ে ওকে টাকাটা বুঝিয়ে দেয়। তারপর বস্তাটা কাঁধে নিয়ে অমায়িক একটা হাসি দিয়ে বলে, ‘আফা, আবার দুই সপ্তাহ পর আইমু। পুরান কিছু জমলে দিয়েন।’
কুঞ্জল মাথা নেড়ে ওকে বিদায় দেয়। তারপর টাকাটা ডাইনিং টেবিলের এক কোণে গ্লাস চাপা দিয়ে রেখে দ্রুত রান্নাঘরে যায়। ঢাকনা উঠিয়ে একবার দেখে, লাউ প্রায় সিদ্ধ হয়ে এসেছে। এবার মাছটা ছাড়তে হয়। আচ্ছা, অভীক তো আবার লাউয়ের তরকারি খাবে না। ওর মাংস ছাড়া কিছুই পছন্দ না।
কথাটা ভাবতেই ও শোবার ঘরে এসে মোবাইলটা হাতে নেয়। ফোন করতেই নম্বরটা বিজি পায়। মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। ঘড়ির দিকে তাকায়, সাড়ে এগারোটা বাজে। নাহ, হাতে খুব একটা সময় নেই। ফোনটা হাতে নিয়েই ও রান্নাঘরে আসে। তারপর এক হাতে লাউয়ের তরকারিটা একবার নেড়ে দিয়েই আবার ফোন করে। এখনও ব্যস্ত। ভ্রু কুঁচকে ও ফোন রাখতে যেতেই ওপাশ থেকে অভীক ফোন ধরে কর্কশ গলায় বলে, ‘কী সমস্যা, বার বার ফোন দিচ্ছ কেন?’
ইদানীং এমন। অভীক ভালো করে কথাও যেন বলতে চায় না। অথচ রাগ করার কথা কুঞ্জলের। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘দুপুরে লাউ দিয়ে শোল মাছ রান্না করেছি। রাতে আর কিছু লাগবে?’
ওপাশ থেকে অভীক বিরক্তির গলায় বলে, ‘তোমার যা ইচ্ছে রান্না করো। বাসায় বসে কাজ নেই, বার বার ফোন দিয়ে বিরক্ত করা। ফোন রাখো, অফিসে এমনিতেই কাজের চাপে থাকি।’
বলেই খট করে ফোনটা কেটে দেয়। যেন হঠাৎ করেই জমজমাট একটা নাটকের পর্দা পড়ে তেমন। কুঞ্জলের মনটা খারাপ হয়ে যায়। ওর বলতে ইচ্ছে করছিল এতই যদি কাজের প্রেশার তাহলে এতক্ষণ ধরে ফোন বিজি কেন? সেই মেয়েটা না তো?
কথাটা মনে করতে চায় না ও। কিন্তু মনে পড়ে যায়। আর যখন মনে হয় তখন ইচ্ছে করে সব ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দেয়। এই যেমন এখন ইচ্ছে করছে গরম এই লাউয়ের তরকারির কড়াইটা এক টানে উলটে ফেলে দিতে। মাথাটা কেমন দপদপ করে ওঠে। ও ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে কড়াইয়ের দিকে। ‘লাভ ইউ পাখি। বউ বাসায়, পরে ফোন দিচ্ছি’, এই লাইনটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বছরখানেক আগে হুট করেই একদিন ও অভীকের মেসেঞ্জারে মেসেজটা দেখে ফেলেছিল। তারপর থেকে একটা দিনের জন্যও ও ভুলতে পারেনি। একটা রাত শান্তিতে ঘুমোতে পারেনি। আজকেও আবার মনে পড়ে গেল। সেদিন ও পাগলের মতো ওকে খামচে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল মেয়েটা কে। অভীক বলেছিল, পুরাতন প্রেমিকা। কুঞ্জল স্তম্ভিত হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়েছিল, কী অবলীলায় কথাগুলো বলছে!
অভীক ব্যাখ্যা দেবার ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘বোঝই তো, পূর্ণ ছিল আমার প্রথম প্রেম। এতদিন পর খুঁজে পেলাম। তাই একটু আবেগতাড়িত হয়ে গিয়েছিলাম।’
কুঞ্জলের শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিল, যেখানে অভীকের লজ্জিত, সংকুচিত হওয়া উচিত ছিল সেখানে ও যুক্তি দেখাচ্ছিল। তাতে করে কুঞ্জলকে যে আরও বেশি করে অপমান করা হয় সেটা ও বুঝতেই পারছিল না। নিজেকে সেদিন ভীষণ প্রতারিত মনে হয়েছিল। হঠাৎ করেই পরাজিত মনে হয়েছে নিজেকে।
টানা একটা মাস ও কথা বলেনি। একটা সময় অভীক ওর কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছে, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে। ছেলে অর্কের দিক চেয়ে ও স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করেছে। লুকিয়ে পূর্ণ নামের মেয়েটার প্রোফাইলে চুপিচুপি দেখে এসেছে। ওর চেয়ে তো আহামরি সুন্দর কিছু না। গায়ের রঙটা একটু সাদা এই যা। চোখ দুটো কেমন ছোট ছোট। অথচ কুঞ্জলের চোখ যেই দেখেছে বলত নাটোরের বনলতা সেন। গায়ের রঙটা উজ্জ্বল শ্যামলা, কালো নয় মোটেই। নাকটা আদুরে বোচা। অনেকে বলে নাটকের ‘তিষা’র সাথে খুব মিল। ওর মুখে নাকি একটা মায়া আছে। কিন্তু এতকিছু থেকেও অভীককে ও আটকে রাখতে পারেনি। ওর সব কিছু বুঝি পাওয়া হয়ে গিয়েছে অভীকের?
সেসময় একটা কথাই ওর মনে হয়েছিল, ওর আসলে যাবার কোনো জায়গা নেই। না আছে নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই, না আছে একটা চাকরি। খুব আফসোস হয়েছিল। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির চেষ্টা করার আগেই অর্ক পেটে চলে এল। বিয়েটাও তাড়াতাড়িই হয়েছিল। কত হবে তখন ওর বয়স? ২৩-২৪। ভেবেছিল অভীক থাকতে ওর বুঝি নিজের কিছু করার দরকার নেই। কিন্তু গতবছর সেই ঘটনাটা ওর সব ধারণা আমূল পালটে দিয়েছে। চাকরির চেষ্টা করেছে কিন্তু এতটাই দেরি হয়ে গেছে যে এখন আর ব্যাপারটা সহজ নেই। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে ‘জাদুর বাক্স’ নামে একটা নামকরা শাড়ির পেজে মডারেটর হিসেবে কাজ করে। শাড়ির অর্ডার রাখে, শাড়ি নিয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে তার উত্তর দেয়। এই কাজটা ওর জন্য খুব সহজ হয়েছে। যদিও খুব বেশি টাকা পাওয়া যায় না, তবুও হাতখরচটা ওঠে। কেন জানি সেদিনের পর থেকে অভীকের কাছ থেকে নিজের জন্য কিছু চাইতে ইচ্ছে করে না। অভীক ওর মন থেকে সেদিনই মুছে গেছে। ওদের যে সম্পর্কটা নতুন থাকবার কথা আজ তা পুরোনো, ভাঙাচোরা যেটা ফেলে দিতে হয়, না হয় সের দরে বেচে দিতে হয়।
কুঞ্জল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কড়াইটা নামাতে গিয়েই ‘উফ’ করে ওঠে। দ্রুত পাশের সিংকের কল ছেড়ে পানিতে হাতের আঙুল ভেজাতে থাকে। অসাবধানে খেয়ালই করেনি খালি হাতে এলুমিনিয়ামের কড়াই নামাতে গিয়েছিল, আর গরম ছ্যাঁকাটা খেল। ইশ, জ্বলছে হাতটা। ঠান্ডা পানিতে জ্বলুনি কমে। আর তখনই আবার সেই মেসেজের লাইনগুলো মনে পড়ে। তাতে করে মনের জ্বলুনিটা বাড়ে। আর সেটা ঠান্ডা করবার কোনো উপায় কুঞ্জলের আজ এখন পর্যন্ত জানা নেই।
২.
অর্কের স্কুলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পোনে একটা বেজে যায়। হাতে এখনও পয়তাল্লিশ মিনিট সময় আছে। নাহ, আরেকটু পরে এলেও হতো। অর্ককে আনতে যাবার সময় প্রতিবার এমন হয়। কখনও একটু দেরি হয়ে গেলে বুক কাঁপতে থাকে। অর্ক যদি স্কুল থেকে বেরিয়ে ওকে না দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে যায়? এই ভয়টাই ওকে কোথাও চলে যেতে দেয় না। সেবার মনের এমন বিক্ষুব্ধ অবস্থায় একবার মনে হয়েছিল সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই অর্কের কথা মনে হতেই আর পারেনি।
কুঞ্জল ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সামনে এগোতেই দেখে পৃথুল পুরো আসর জমিয়ে বসেছে। স্কুলের মাঠের এককোণে ওকে ঘিরে অন্যান্য বাচ্চাদের অভিভাকেরা ঘিরে আছে। পৃথুল খুব দুষ্ট। প্রায়ই দুষ্ট আর হাসির সব ভিডিও খুঁজে খুঁজে বার করে ওদের দেখায়। আর সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে। আজকেও নিশ্চয়ই এমন কিছুই দেখাচ্ছে। মেয়েটা খুব হাসিখুশি, ওর চেয়ে বয়স কম, কিন্তু বন্ধুর মতো তুই তুই করে বলে।
ও হাসিমুখে কাছে এগিয়ে যেতেই ভীড়ের ভেতর থেকে পারভিন আপা চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘ওই যে কুঞ্জল এসেছে। দেখে যান ভাবি, আজ হাতেনাতে আসামি ধরেছি।’
বলেই পারভিন আপা মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। কুঞ্জল ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কে আসামি? কাকে ধরেছেন আপা?’
পারভিন আপা এবার পৃথুলের থুতনিটা হাত দিয়ে ধরে উঁচু করে ধরেন, তারপর কৃত্রিম রাগের গলায় বলেন, ‘দেখেছিস, কী অবস্থা?’
কুঞ্জল কৌতুহলী চোখে তাকাতেই দেখে পৃথুলের ফর্সা গলায় কালচে লাল দাগ। আদরের দাগ। বিয়ের প্রথম দিকে ওরও হতো। যদিও ওর গলা অত ফর্সা না, কিন্তু ভালোবাসার জোরটা বুঝি তখন বেশিই ছিল। তাই গায়ের রঙ ছাপিয়েও দাগ হয়ে যেত। এখন অবশ্য এমন করে আদর পায় না বহুদিন, ওর ইচ্ছেও নেই। মনটা খারাপ হয়ে যায়।
পারভিন আপা বলে, ‘দেখেছিস, আদরের ঠেলায় গলার কী হাল? আর আমাদের বলে ওসব নাকি আর ভালো লাগে না।’
আপার কথা বলার ধরণ দেখে পৃথুল হেসে গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। আশেপাশের অন্য আপারাও হাসতে থাকে। কুঞ্জল জোর করে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে, তাতে করে হাসিটা আরও বেশি করে করুণ দেখায়।
পরীক্ষা শেষ হবার ঘন্টাটা বাজে। কুঞ্জল হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচে। আড্ডাটা ভেঙে যায়। সবাই তাড়াহুড়ো করে এবার স্কুল গেটের দিকে এগোয়। কুঞ্জল একটু এগোতেই পেছন থেকে পৃথুল জোর পায়ে হেঁটে এসে ওকে ধরে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘কী রে, মন খারাপ?’
কুঞ্জল মাথা নাড়ে, ‘না তো। তোর দেখি খুব ভাব হয়েছে জামাইয়ের সাথে। একদম দাগ করে স্কুলে এসেছিস।’
পৃথুল হাসে, ‘আর বলিস না। কী যে লজ্জা পেয়েছি আজ। বাদ দে। তোদের শাড়ির পেজ থেকে একটা ইক্কাত শাড়ি অর্ডার করেছিলাম। এখনও দেয়নি কেন রে?’
পৃথুলের মনে পড়ে, ও মাথা নেড়ে বলে, ‘ ধূসর সাদার সাথে কালো-হলুদের পাড় দেওয়া শাড়িটা তো? পাবি। একটু রাশ চলছে, তাই দেরি হচ্ছে।’
পৃথুল হেসে বলে, ‘অসুবিধে নেই। আসিফ শাড়ি কেনার টাকা দিয়েছে তো তাই। ও দেখতে চাইছিল।’
কুঞ্জল দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে। অভীক অনেকদিন নিজে থেকে ওকে শাড়ি কিনে দেয়নি কিংবা হাতে টাকাও দেয়নি। ইদানিং এমন হয়। মানুষের ছোট ছোট সুখগুলো ওকে জোর করে মনে করিয়ে দিয়ে যায় যে ও সুখে নেই।
গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দূর থেকে অর্ককে আসতে দেখে। সাথে সাথে মন খারাপের মেঘ দূর হয়ে যায়। এই একটা মুখের দিকে চেয়ে ও পৃথিবীর সব না পাবার দুঃখ ভুলে থাকতে পারে।
অর্ক কাছে আসতেই কুঞ্জল চিন্তিত গলায় বলে, ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে বাবা?’
অর্ক কল কল করে বলে, ‘ভালো হয়েছে আম্মু। আমি সব প্রশ্ন লিখতে পেরেছি। আর জানো, রনি না একটা প্রশ্ন পারে নাই। পরে আমাকে খালি পেছন থেকে ডাকে।’
কুঞ্জল পৃথুলের দিকে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। তারপর অর্কের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে, ‘তাই? তুমি সব পেরেছ?’
হাঁটতে হাঁটতে অর্ক বলে, ‘হ্যাঁ আম্মু, আমি সব পেরেছি। আর স্যাররা বলেছে আমরা নাকি এখন ক্লাশ ফাইভে। জানুয়ারি মাসের এক তারিখে নতুন বই নিতে যেতে বলেছে।’
অর্কের চোখেমুখে একটা আনন্দ, নতুন বই পাবার আনন্দ। কুঞ্জল ওকে নিয়ে রিক্সায় ওঠে। তারপর এক হাতে জড়িয়ে ধরে গল্প করতে করতে বাড়ির পথে এগোয়।
বাসায় এসে হাতমুখ ধুয়ে আগে ছেলেকে খাইয়ে নেয় ও। তারপর নিজেও খায়। খুব ক্ষুধা পেয়েছিল। এখন একটু ভালো লাগছে। খাওয়া শেষে ও অর্কের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার বাবাটা এখন কী করবে?’
অর্কের মুখটা হাসি হাসি হয়ে যায়। ও আবদারের গলায় বলে, ‘আমি গেমস খেলব আম্মু।’
কুঞ্জল হাসে, পরীক্ষার এই ক’টা দিন বেচারা খেলতে পারেনি। ও ছেলের কপালে একটা চুমো খেয়ে বলে, ‘আচ্ছা বাবা, খেল। আমি একটু কাজ করব এখন।’
রিয়া আপু সকালেই মেসেজ দিয়ে রেখেছিলেন আজ শাড়ির লাইভ করবেন। জাদুর বাক্স পেজটা আপুর। আপুর লাইভ মানে হাজার লোক দেখবে। সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর মুহুর্তেই সব শাড়ি বিক্রি হয়ে যায়। মানুষজন কাড়াকাড়ি করে শাড়ি নেয়। সেক্ষেত্রে ওদের উপর চাপটা বেশি থাকে। অর্ডারগুলো ঠিকঠাক নেওয়া, ডেলিভারির ব্যবস্থা করা।
কুঞ্জল দ্রুত সব গুছিয়ে ওর বেডরুমে আরাম করে বসে। রিয়া আপু অলরেডি সবাইকে নক করেছেন, লাইভ শুরু হচ্ছে। আর আজ শাড়ির কোড ১ থেকেই শুরু হবে। লোকজন কোড উল্লেখ করে শাড়ির অর্ডার দেয় এই পেজে।
একটু পরেই লাইভ শুরু হয়ে যায়। আজ রিয়া আপু খুব সুন্দর সুন্দর মোডাল সিল্ক আজ্রাখ শাড়ি দেখাচ্ছেন। একেকটা একেকটার চেয়ে সুন্দর। দামটাও নেহায়েত কম না, সাড়ে আট হাজার করে প্রত্যেকটা। ইনবক্সে দ্রুত অর্ডার পড়ছে। লোকজন কোড নম্বর আর মেইলিং এড্রেস লিখে লিখে পাঠাচ্ছে। কুঞ্জল অর্ডার কনফার্ম করার আগে আইডিগুলো একবার দেখে নেয়। যাতে বুঝতে পারে এরা আসলেই নেবে কি-না। অনেকে রেগুলার কাস্টমার, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না। এই যেমন এখন দিলারা চৌধুরী ম্যাডাম অর্ডার দিল, কোড ১। উনি মোটামুটি দু’দিন পর পরই শাড়ির অর্ডার দেন। মানুষ এত টাকা যে কোথায় পায়, কে জানে।
কুঞ্জল দ্রুত ওনার অর্ডার কনফার্ম করে। যত বেশি অর্ডার ও কনফার্ম করতে পারে তত বেশি কমিশন। কুঞ্জল আরও দুটো অর্ডার কনফার্ম করে। তারপর অপেক্ষা করে নতুন মেসেজের।
ঠিক এই সময় একটা অর্ডার আসে। এটা নতুন আইডি, মানে এর আগে কখনও নেয়নি। ভালো করে নামটা পড়তেই ও থমকে তাকায়। আরে, এটা তো অভীকের ফেসবুক আইডি। অবিশ্বাস নিয়ে ও মেসেজের দিকে তাকিয়ে থাকে। শাড়ির কোড ৩, নিচে ডেলিভারি এড্রেস লেখা। আর সেটা অভীকের অফিসেরই ঠিকানা। নিশ্চিত হতে ও ফেসবুক আইডিটা খুলে। অভীকের হাসিমাখা একটা মুখ, পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বছর দুয়েক আগে ওরা সবাই দার্জিলিংয়ে গিয়েছিল তার ছবি। কাভার পেজে ওদের তিনজনের ছবি। দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। আইডিটা অভীকের। কুঞ্জলের সারা শরীর কেমন অসাড় হয়ে আসে। অভীক শেষ পর্যন্ত ওর জন্য বুঝি শাড়ির অর্ডার করল? মনটা খুশি হতে যেয়েও থমকে যায়। ও যে অনলাইন শাড়ির পেজের মডারেটর সেটা অভীক জানে না। মানে কখনও জিজ্ঞেস করেনি, আর ও নিজেও বলেনি। তাহলে কি শাড়িটা ওর জন্য না? সেই পূর্ণ মেয়েটার জন্য?
(চলবে)