#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(০৮)
লাবিবা ওয়াহিদ
রায়াফ এবং ফাহান এতিমখানা থেকে ফিরে কাজের লোকের দেখানো রুমে যেতেই দুজনের অবস্থা কাহিল। রায়াফ তো একের পর এক হাঁচি দিয়েই চলেছে। মাত্রই সে মাস্কটি খুলেছে। ধুলোমাখা রুমটাকে পুরোই কুয়াশার ন্যায় লাগছে। যার ফলে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না শুধুমাত্র ধুলো ছাড়া। পুরো রুমে যেন ধুলোরা বিচরণ করছে। তবে ঝাড়ার শব্দ তাদের কানে আসছে সাথে জিনির খক খক করে কাশির আওয়াজ! রায়াফ আরেকটা হাঁচি দিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
-“স্টপ! আই সে স্টপ ইট! যে ঝাড়ছো সে থামো!”
শেষোক্ত বাক্যটি কিছুটা উচ্চস্বরেই বলে উঠে রায়াফ। সাথে সাথে ঝাড় দেয়ার শব্দ বন্ধ হয়ে গেলো। অতঃপর সেই ধুলোর মধ্যে থেকে এক কন্যার আবির্ভাব ঘটলো যার নাক অবধি ওড়না দিয়ে বেঁধে রাখা। আফনা তার কাঁধে ঝাটাটা রাখার পোজ মেরে চোখ ছোট ছোট করে ওদের দিকে দৃষ্টিপাত স্থির করে।
-“কী সমস্যা?”
-“সেটা তো আমাদের বলা উচিত! হোয়াট’স ইওর প্রব্লেম? এভাবে ধুলো উড়াচ্ছো কেন?”
আফনা তার মুখের থেকে কাপড়টা সরিয়ে বললো,
-“রুমে ধুলো জমলে তা ঝাড়বো না? অদ্ভুত কথাবার্তা বলছেন তো আপনি!”
রায়াফ আফনার দিকে অবাক চোখে তাকালেও ফাহান হা করে আফনার দিকে তাকিয়ে রয়। কী অপরূপ সুন্দরী আফনা। তার তো দম যায় যায় অবস্থা। রায়াফ নিজেকে সামলে বলে,
-“রুম ঝাড়ছিলেন আগে থেকে বলে দেয়া কী উচিত হয়নি? শুধু শুধু ঝামেলায় পরার মানে হয় না!”
-“আপনাদের কেন বলবো? এতো দামড়া হয়েও যদি নিজ দায়িত্বে বুঝতে না পারেন তাহলে আমার কিছু করার নেই৷ তাও বলছি আপনারা পাশের রুমে গিয়ে রেস্ট করুন, আমার এই ঘর ঝাড় দিতে আরও কিছুক্ষণ সময় লাগবে!”
রায়াফ ফাহানের দিকে তাকাতেই দেখলো ফাহান আফনাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। তাই রায়াফ ফাহানকে টেনে নিয়ে যাওয়া ধরলেই আফনা ওদের পিছু ডাকলো।
-“শুনুন! কুকুরটা যদি আপনাদের হয়ে থাকে তাহলে একেও নিয়ে যান, বারংবার কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে!”
আফনার এমন আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারে রায়াফ বেশী অবাক হলো। এই ঝাঁঝলঙ্কা ভালো ব্যবহারও করতে জানে? বাহ! রায়াফ জিনিকে এক ডাক দিতেই জিনি চোখের পলকে রায়াফের সামনে হাজির। আফনা কোণা চোখে বিরক্তিমার্কা মুখ করে জিনির দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন চাইছে কুকুরটাকে এই ঝাটা দিয়ে জম্মের মতো পিটাইতে, তাও যদি তার শান্তি হয়। রায়াফ তার জিনিকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আফনা আবার তার কাজে ফিরে গেলো।
পাশের রুমে আসার পর থেকেই ফাহান কেমন ঘোরের মাঝে রয়েছে। রায়াফ কিছু বললে হু, হা বলে উত্তর দিচ্ছে৷ একসময় ফাহানের প্রতি রায়াফের বিরক্তি ধরে গেলো৷ তা অজান্তে মুখে হাত যেতেই দেখলো তার মুখে মাস্ক নেই। রায়াফ চরম অবাক হলো এবং তার মনে পরলো সে তো পাশের ঘরে মাস্ক ছাড়া গেছিলো৷ আফনা? ইয়েস! ও কেন কোনোরকম রিয়েক্ট করলো না? রায়াফের এই ক্যারিয়ার জীবনে ফ্যামিলি বাদে বাহিরে মাস্ক না পরে বের হলে সবাই তাকে চেপে ধরতো, অটোগ্রাফ, সেল্ফি তোলার জন্য। মেয়েদের কথা তো বাদই দিলো, এরা তো হুমড়ি খেয়ে পরে। তাহলে আফনার বিষয়ে এমন কাহীনি ঘটলো কেন? হাউ? মেয়েটা কী তাকে দেখেনি? তখনই মনে পরলো আফনার আগের বলা কথাগুলো, আফনা ক্রিকেট বা রায়াফ কাউকেই পছন্দ করে না। তাই বলে এতো সামনে থেকে দেখেও কোনোরকম রিয়েক্ট করলো না? না চাইতেও কিছুটা মুগ্ধতা কাজ করলো আফনার প্রতি, মেয়েটা অদ্ভুত হলেও ছেলেদের থেকে ডিস্টেন্স রেখে চলে, সে যেই হোক না কেন! পরক্ষণে তার এই ভাবনাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ভাবলো,
-“না, নাহ! রায়াফ! মেয়েদের বিলিভ করো না, নারীর প্রতারণা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর জিনিস যা থেকে বাঁচা ইমপসিবল। কান্ট্রোল ইওরসেল্ফ। সব মেয়েই একরকম, তাদের বিশ্বাস করো না!”
এদিকে আফনা বিরক্তি নিয়ে কাজ শেষ করতেই ছেলেগুলোর কথা মনে পরলো। ছেলেগুলোর চেহারা মস্তিষ্কে ভেসে উঠতেই আফনা অটোমেটিক চোখ বড় বড় করে ফেললো। আফনা পিছে ফিরে দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবলো,
-“ওটা কী সত্যি সত্যিই রায়াফ সানভি ছিলো? হায় আল্লাহ! আমি কী স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব? আচ্ছা ভুল দেখিনি তো? দেখতে পারি। অথবা হয়তো রায়াফ সানভির মতো দেখতে কেউ? আমিও কী বলদ, রায়াফ সানভির মতো মানুষ আমাদের এই খানে কেন আসবে? তার তো রাজার হালে থাকার কথা।”
ভাবতে ভাবতেই সে পাশের ঘরে চলে গেলো এই রুমের কথা জানাতে। পাশে রুমে গিয়ে আফনা রায়াফকে দেখে ঠিক হজম করতে পারলো না। আসলেই রায়াফ সানভি তার বরাবর বসে। এ তো আসলেই সাদা। যাক আফনার দেয়া সাদা ইলিশ নামটা তাহলে ঠিক আছে। রায়াফ যখনই আফনার দিকে তাকাবে তার আগেই আফনা চোখ সরিয়ে এক ঢোক গিলে গলা ভিঁজিয়ে ফাহানের উদ্দেশ্যে বললো,
-“আপনাদের পাশের ঘর রেডি আছে, যে যেতে ইচ্ছুক আসতে পারেন। আর কোনোরকম সমস্যা হলে কাউকে ডেকে নিবেন। আর হ্যাঁ কিছুক্ষণের মাঝেই আপনাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে, আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন!”
কথাগুলো বলার সময় আফনার হাত দুটো অধিকমাত্রায় কাঁপছিলো। কেন কাঁপছিলো সে নিজেও জানে না। তাই হাতদুটো পিছে নিয়ে রেখেছে যাতে করে ওদের দৃষ্টি আফনার হাতে না পরে। ফাহান কখন থেকেই আফনার দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। রায়াফ আফনার দিকে একনজর তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রায়াফ দাঁড়াতেই আফনা তার উচ্চতা মাপার চেষ্টা করলো। চোখে দেখে না বুঝলেও এটা ভালো করে বুঝলো যদি রায়াফ তার সামনে দাঁড়ায় তাহলে আফনা রায়াফের কাঁধের কিছুটা নিচে নামবে। এতো লম্বা আল্লাহ রে! আফনা আমার চোখ ফিরিয়ে রুম থেকে হনহন করে চলে গেলো। রায়াফ এবারও অবাক হলো। এবারও আফনা কোনোরকম রিয়েক্ট করলো না কেন? অদ্ভুত! রায়াফ আফনার কথা ভাবতে ভাবতে জিনিকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলো। যেহেতু এটা গ্রাম সেহেতু চারপাশে গাছপালার অভাব নেই। তাই হয়তো গরমটা কমই লাগে। খোলা জানালা, দরজা দিয়ে শীতল হাওয়া প্রবেশ করে রুমে ঘুরপাক খায়।
আফনা আরেকবার গোসল সেরে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার চোখের সামনে এখনো সেই মুহূর্তগুলো ভাসছে। এখনো সে অস্বস্তির চাদরে আবৃত। আফনা এ-জম্মেও এতোটা অস্বস্তি ফিল করেনি যতোটা না রায়াফের সামনে দাঁড়িয়ে ফিল করেছে। আফনা চোখ বুজে কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলো। অতঃপর আঁখিপল্লব মেলে ভাবে,
-“যাকে অপছন্দ করি তার সামনে অস্বস্তিতে পরার কোনো মানেই হয় না। আমি কোনো চোরও নই, ডাকাতও নই তাও কেন এতো অস্বস্তি? ধুর, ভালো লাগছে না কিছু!”
তখনই কলি আফনাকে হাঁক ছেড়ে খেতে ডাকলো। আফনা উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে গিয়ে তার ভেঁজা চুলগুলো ঝেড়ে, মাথায় সুন্দরভাবে ওড়না দিয়ে নিচে চলে গেলো। বাসায় থাকলে মাথায় ওড়না দিতো না তবে এখানে দিচ্ছে কারণ, দাদু ওড়না মাথায় না দিয়ে চলাফেরা করা পছন্দ করেন না। খাওয়া-দাওয়া সেরে উঠতেই ফুপি বলে উঠলো,
-“আফনা মা! গিয়ে দেখ তো রহিম ভাই মেহমানদের ভালোভাবে আপ্যায়ন করছে কিনা!”
আফনা আবারও পরলো অস্বস্তিতে। সে কিছু বলার পূর্বেই যে যার ঘরে চলে গেলো। আফনা উপায় না পেয়ে একাই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। দুই বাড়ি পরেই আফনার দাদুর বাড়ি। এখন তারা যে বাসায় থাকছে সেটা আফনার বাবা এবং চাচারা মিলে তৈরি করেছে।
খেতে খেতেই রায়াফের চোখজোড়া সদর দরজার দিকে চলে গেলো। আফনা প্রবেশ করছে। ভেঁজা চুল আফনার গালের দুপাশে চলে এসেছে। মাথায় ঘোমটা, ন্যাচারাল চেহারা। শুভ্র গায়ে কালো ড্রেসটা যেন আরও সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। আফনাকে দেখে রায়াফ যেন খাবার চিবুতে ভুলে গেলো। কোন এক মোহ তাকে আফনার দিকে চৌম্বুকের মতো টানছে। আফনা তার মাথায় ভালোভাবে ঘোমটা দিতেই রায়াফ চোখ সরিয়ে ফেললো। ফাহান এখনো খেয়াল করেনি আফনাকে, সে আপাতত খেতে ব্যস্ত। খাওয়ার সময় ফাহানের আশেপাশে খেয়াল থাকে না। আবার যদি খুদা লাগে বেশি তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আফনা রায়াফের দিকে একপলক তাকিয়ে রায়াফের পাশ কেটেই কিচেনের দিকে চলে গেলো। আফনা যেতেই এক মোহনীয় সুঘ্রাণ রায়াফের নাকে এসে ঠেকলো। রায়াফ সাথে সাথে চোখ বুজে সেই সুঘ্রাণ অনুভব করলো।
আফনা রহিম চাচার থেকে সব জেনে এবং কিছু বুঝিয়ে পেছন দরজা দিয়েই বেরিয়ে গেলো। তার সাহস হচ্ছে না আবারও ওদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার।
রাত্রিবেলায় ছাদে একাকী আফনা জোৎস্নাবিলাস করছিলো, সাথে ভাবনা তো আছেই। ভাবনার পুরোটাই তার অস্বস্তিকে কেন্দ্র করে। এখনো সে উত্তর পায়নি তার এই অজানা অস্বস্তির। অস্বস্তিটা তার কেমন বিদঘুটে স্বপ্নের ন্যায় লাগছে। তখনই কলি চেঁচাতে চেঁচাতে ছাদে আসলো এবং পেছন থেকে আফনার গলা জড়িয়ে বললো,
-“ইয়ার!! আমি জাস্ট সারপ্রাইজড হয়ে গেছি রায়াফকে সামনে থেকে দেখে। আমি তো কখনো স্বপ্নেও ভাবি নাই রায়াফকে কখনো সামনে থেকে দেখবো। কী হ্যান্ডসাম ভাই! ভাগ্যিস সেখানে সেন্সলেস হয়ে যাই নাই। ইরা দেখলে কী হতো বলতো?”
এবার আফনার বিরক্তি ধরে গেলো। এমন ভাব ধরছে যেন এলিয়েন দেখেছে। আরে ভাই সেলিব্রিটি হলেও তো সে একজন মানুষ, তাকে নিয়ে লাফানোর কী আছে আফনা তা বুঝে না। আফনা নিজেকে ছাড়িয়ে বললো,
-“শুধু চোখের দেখা দেখেই এমন লাফাচ্ছিস? কথা বলিসনি কেন?”
-“ইসহাক ভাই না করেছে। তার নাকি এসব পছন্দ না!”
মিনিটেই আফনার রাগ সপ্তম আসমানে উঠে গেলো। সে ঠিক ধরেছিলো, সেলিব্রিটি নামটাই অহংকারে আপ্লুত! এরে যখন হাতের কাছে পাইসে ভালো তেল মশলা দিয়ে মজা বুঝাতে হবে। ভেবেই আফনা তার অধর জোড়া প্রসারিত করলো। তার ভেতরের শয়তানি ধরাটা কলির পক্ষে সম্ভব হলো না!
~চলবে।