প্রেমকুঞ্জ পর্ব-১৫+১৬

0
867

#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
| পঞ্চদশ পর্ব |

“তিতির…

কেমন আছো? চিঠিতে নামের পাশে নাকি সম্বোধন বসাতে হয়। মা বাবা বা বড় কেউ হলে শ্রদ্ধেয়, অতি আদরের ছোট কেউ হলে প্রিয় আর প্রিয় মানুষটি হলে প্রিয়তম! কিন্তু আমি কি লিখবো এটা নিয়েই বিভ্রান্ত পড়ে গেলাম। হঠাৎ করে বোধহয় প্রিয়তম লিখলে তুমি খুব একটা ঘাবড়ে যেতে না কারণ আমার মনের কথা তুমি জানো‌। কি জানো না? আমি জানি আমার মনের কথা অনেক আগেই আন্দাজ করতে পেরেছ তুমি। তাহলে কেন এতো কষ্টে রাখছো আমায়! তুমি হয়তো জানো না কতোটা কষ্ট পেয়ে এই চিঠি আমি লিখছি। চিঠি লেখার ব্যাপারে বরাবর আমি সাবধানতা মেনে লিখি। এটা আমার প্রথম লেখা চিঠি নয় কিংবা বলতে পারো প্রেমের চিঠি না। আর আগেও অনেক প্রেমের চিঠি লিখেছি তবে নিজের জন্য না। আমার সুন্দর হাতের লেখার কারণে বান্ধবীর প্রেমিকের কাছে অনেক চিঠি লিখেছি আমি। তখন এতোটা ভাবতে হয় নি কিন্তু এই প্রথমবার তোমায় চিঠি লিখতে গিয়ে কেন যেন বার বার হোঁচট খাচ্ছি আমি। হয়তো লেখা দেখে ভাবছো কোথায় সুন্দর লেখা! এতো কুৎসিত! কিন্তু সত্যি বলতে তা না, চিঠিটা খুব তাড়াহুড়োয় লেখা। দ্বিতীয় বারের মতো পড়ার সুযোগ অবদি পায় নি আমি। বিশ্বাস করো আমার খুব ইচ্ছে ছিল তোমাকে দেওয়া প্রথম চিঠি খানা অনেক সুন্দর করে লিখে দেবো, যাতে তুমি পড়েই চমকে উঠতে পারো। কিন্তু সেই আশা পূরণ হলো না! শুধু এই আশা না আরো অনেক স্বপ্ন বেঁধেছিল তোমায় নিয়ে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কোন স্বপ্ন’ই পূরণ হবে না। এই ধরো চিঠি’র লেখা প্রত্যেকটা কথা তোমায় নিজের মুখে বলার ইচ্ছে ছিল কিন্তু হলো না। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন বাসা থেকে বের হবার আগে ভেবে যেতাম হয়তো কথাটা আজ বলবো তোমায়! বলবো বলবো করে ভেবে আর বলা হলো না। এখন সেই কথা চিঠিতে লিখে জানাবো তোমায় কিন্তু আমি জানি কথাটা অনেক আগে থেকেই জানতে তুমি।

তিতির! আমার আজও মনে পড়ে তোমার সাথে আমার প্রথম দেখার কথা। কোন কারণ ছাড়াই তোমার আমার দেখা হয়। তবে একটি সত্যি কথা জানো, পৃথিবীতে কোন কিছুই কারণ ছাড়া ঘটে না। ঠিক তেমনি আমি যেমন বলছি কোন কারণ ছাড়া তোমার আমার দেখা হয়েছে আসলে কিন্তু তা না। কারণ ছিল! তোমার সাথে আমার দেখা হবার কারণ ছিল আমি মারা পড়ব! হ্যাঁ তিতির তোমার প্রেমে আমি মারা পড়েছি! আটকে পড়েছি তোমায় মায়ায়। এখন হয়তো বলবে, পাগল আমি! কিন্তু তাতে আক্ষেপ নেই! তোমার প্রেমে আমি পাগল হতে রাজি, হাজারটা পাগলামি করবো তোমার প্রেমে। শেষে তোমায় না পেলে পাগল হয়ে রাস্তায় ঘুরবো। ঢাকা শহরে কিন্তু পাগলের কমতি নেই। সেই পাগলের মাঝে আমি চিনতে পারবে কি তুমি! আমি জানি তুমি পারবে‌। তখন তোমার মনে কি কষ্ট হবে না,খারাপ লাগবে না আমার জন্য! একটু হলেও লাগবে। থাক! তোমার সেই কষ্ট আমি দিতে চাই না। এর চেয়ে বরং বিষ খেয়ে মারা পারবো! মৃত্যু শোকে না হয় বরং ৩ দিন’ই কাঁদবে তুমি। এরপর ভুলে যাবে আমায়! সমাপ্তি এইভাবেই হবে কিন্তু বিশ্বাস করো এই সমাপ্তি আমি চাই নি!

তিতির! প্রিয়তম বলে একবার ডাকি তোমায়। খুব ইচ্ছে ছিল তোমার কানের কাছে নিজের উষ্ঠ জোড়া বাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলা, প্রিয়তম আমি ভালোবাসি তোমায়! আমি সত্যি ভালবাসি তোমায়। তোমাকে ভালোবেসে হাজার বার মরতে রাজি আমি। কোন কিছুর মূল্যে এই ভালোবাসা চাই আমার!

জানি আমার প্রত্যেকটা কথা হয়তো তোমার কাছে বোকা বোকা লাগছে। তবে এইটা চরম সত্য! এতো তাড়াহুড়ো করে ভালোবাসার কথা কেন বলছি জানো? আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তিতির! আমি পারবো না তোমায় ছেড়ে অন্য কারো হতে। আমার স্বপ্ন গুলো যে শুধু তোমায় নিয়ে বুনা! এখানে অন্য কারো ঠাঁই হতে পারে না। তুমি দয়া করে আমাকে বাঁচাও! কিছু একটা করো। কিন্তু কথা হচ্ছে তুমি কিছু একটা করবে কেন? কারণ আমি জানি তুমি ভালোবাসো আমায়! কি সত্যি বললাম তো। আমি জানা সত্ত্বেও কেন কিছু করেনি জানো, আশায় ছিলাম কখন তুমি এসে আমায় কথাটা বলো। কিন্তু তুমি বললে না। জানি না কেন বলো নি? হয়তো সময়ের অপেক্ষা না হয় ভাগ্যের অপেক্ষা করছো। কিন্তু আমার ভাগ্য আমার সাধ দিচ্ছে না তিতির। আমি শুধু চাই তোমায়! শুধু তোমায়। না হয় আমি হারিয়ে যাবো আঁধারের মাঝে। তখন আর তুমি পাবে না আমায়। হারিয়ে ফেলবে চিরদিনের মতো…

ইতি,
ইরা!

তিতির দীর্ঘশ্বাস ফেলল! চিঠি খানা ভাজ করে রেখে দিল বইয়ের মাঝে। নিজের শরীরের শক্তি মনে হয় হঠাৎ করেই হারিয়ে ফেলল সে। দুলতে দুলতে এসে বিছানায় বসল। এতোক্ষণ নিজেকে একটা ঘোরের মধ্যে লাগছিল তার। বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল সে!

খানিকক্ষণ পর’ই ঘুম ভাঙল তিতিরের। মুখ হাত ধুয়ে এসে বসল বসার ঘরে। টেলিফোন বেজে উঠল তৎক্ষণাৎ। আশপাশ অবশ্য কেউ ছিল না। কিন্তু টেলিফোনের আওয়াজে রান্না ঘর থেকে ঊষা বেড়িয়ে এলো। তিতির তাকে চা বানানোর কথা বলে আবার রান্না ঘরে পাঠিয়ে দিল। মন বলছে এখন ইরা ফোন করেছে। টেলিফোন ধরতেই তা সত্য প্রমাণ হলো। তিতিরের আওয়াজ পেয়ে ওপাশ থেকে যেন সব নিশ্চুপ হয়ে গেল!

তিতির বলে উঠল,
“ইরা! কাল দেখা কর!

বলেই টেলিফোন কেটে দিল। ইরা তখনো টেলিফোন ধরে রাখল। কানের কাছে টুং টুং শব্দটা যেন হৃদয় ভেদ করছে তার। সেখানে দাঁড়িয়েই নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো সে। তবে কি সব এখানেই শেষ হয়ে যাবে!

ঊষা চা নিয়ে এসে দেখল তিতির আর ঘরে নেই। অবাক চোখে তাকিয়ে চারদিক দেখতে লাগল। শ্রেয়া এসে তখন ঊষা’র হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে বলে,

“কি খুঁজছিস ওমন ভাবে!

“তিতির ভাইজান কে! এখানে’ই তো আছিলো!

“ছিল এখন নেই, যা তোর কাজে যা।

“কিন্তু এই চা তো ভাইজানের লইগা আনছি।

শ্রেয়া আর কিছু বললো না। আড়চোখে তাকিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেল!

—-

গতকাল সারারাত্র ঘুমাতে পারে নি ইরা! তবুও বেশ ভোরে’ই ঘুম থেকে উঠলো সে। কেন জানি আজ বেশ সাজতে ইচ্ছে করছে। গোসল করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল সে। চুলের পানি টপ টপ করে পড়ছে। তোয়ালে দিয়ে সেই পানি মুছল সে। তুঁতে রঙের কেনা সেই শাড়িটা পড়ল আজ। মনে আশা বাঁধছে তিতির কে কালো রঙের পাঞ্জাবি তে দেখার।

সুন্দর করে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পড়ল আজ। খোলা চুল গুলো শুকানোর জন্য ছাদে উঠে গেল। ঠান্ডা বাতাস গা ছুঁয়ে গেল তার। মন ভালো হচ্ছে,‌হোক! কখন এই মন ভাঙবে তার ঠিক নেই এর আগে তো ভালো থাকা উচিত!

অনেক বেলা ছাদে থাকার পর মনে পড়ল ভাইয়ের জন্য চা বানাতে হবে। দ্রুত ছাদ থেকে নেমে রান্না ঘরে ঢুকল ইরা। চা বানানো শেষে এসে দেখে বেলকনিতে বেতের চেয়ারে বসে ভাই সকালের খবরের কাগজ পড়ছে। ভাবীর পাশ দিয়েই গেল চা দিতে। ভাবী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তার ধারণা ভাই কে নিজের হাতে রাখার জন্য এতো ভালো সাজি আমি। কিন্তু সত্যি বলতে এমন কিছু না। ছোট বেলায় মা বাবা মারা যাবার পর এই ভাইয়ের কাছেই মানুষ সে। তার ভালোটা কেন চাইবে সে! তবে এসব নতুন কিছু না। সব সংসারেই ভাবী আর ননদের এমন টুকটাক লেগেই থাকে!

ভাইয়ের হাতে চায়ের কাপ দিল ইরা। ভাই ভ্রু কুঁচকে ইরার দিকে একবার তাকিয়ে খবরের কাগজে দৃষ্টি রেখে বলল,

“কোথায় বের হচ্ছিস!

“হুম ভাইয়া!

“সামনে’ই তো বিয়ের কথাবার্তা চলছে। বাইরে বেশি ঘোরাফেরা করা ঠিক না।

“আচ্ছা!

বলেই নিচু মাথা করে চলে এলো ইরা। সে যেতেই ভাবী জোর গলায় বলতে শুরু করে,

“তুমিই না হয় বলো একটু! তোমার বোন তো আর আমার কথা শুনে না। কখন যে বাড়ি আসে আর কখন যে বের হয় টের’ই পাই না। এখনকার যেই যুগ, একটু সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে হয় এটা বোঝাবে কে। এখন আমি বললে তো আবার খারাপ হয়ে যাবো। তা তুমি বলো, ও বাড়ি থেকে কোন খবর এসেছে কি। ভালো খবর তো আসার কথা। আমাদের ইরা কি দেখতে কম সুন্দরী নাকি। এরকম মেয়ে হাজারে একটা পাওয়া যায়। তবুও ভাগ্য বলে একটা কথা আছে কি!

ভাইয়া গম্ভীর স্বরে বলেন,
“ইরার ভাগ্য ভালোই! আগামী পরশু আসবে মেয়েকে সামনাসামনি দেখতে।

“এই মা, এই তো এসে গেল।

“তখন তো মা আর নানু এসে দেখে গেছে। এখন বাবা আসবে ছেলে আসবে

“এ কি শোনালে তুমি। কতো তোড়জোড় করতে হবে জানো এখন!

“বাড়িতে দুটো কাজের লোক তো আছে। তোমাকে এতো চিন্তা করতে বলেছে কে?

“থাকলে কি? মেহমান বলে কথা। সব যোগাড় যন্ত্র তো আমায় দেখতে হবে তাই না।

বলেই উঠে গেল ভাবী। দরজার আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে সবটা শুনল ইরা। বুক কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছে মনের ভেতর ছু*রি চালিয়ে দিয়েছে কেউ! পুরো শরীর কাঁপতে লাগলো তার!

——

ব্যাগ নিয়ে প্রস্তুত ইরা। ভাইয়া বের হলেই বের হবে সে। অতঃপর ঘর থেকে বের হতে যাবে ওমনি সামনে পড়ল ভাবীর। ভাবী একবার তার দিকে তাকিয়ে বলল,

“কোথায় যাচ্ছ? এই না বলে গেল বাইরে ঘোরাঘুরি না করতে

“ভাবী খুব দরকারি একটা কাজ আছে।‌ আমি জলদি এসে পড়বো।

“জানি না বাপু। তোমার ভাই বোনের ব্যাপার তোমরা দেখে নাও।

“আমি এসে পড়বো ভাবী!

বলেই দ্রুত বের হয়ে গেল ইরা। ভাবী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। মুখ ভেংচি কেটে নিজের ঘরের দিকে আগাল!

বড় রাস্তার মোড়ে বট গাছের নিচে বসে আছে ইরা। এই ছায়ার নিচে বসেও অনেকটা ঘামছে সে। শাড়ির আঁচল দিয়ে বার বার ঘাম মুচছে। কি হবে জানা নেই তার। হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে তার। বার বার রাস্তার ওপারে তাকাচ্ছে সে।

হঠাৎ চোখ আটকে গেল তার। তিতির কে আসতে দেখল সে। সেই কালো রঙের পাঞ্জাবি পরণে তার। এটা কি ইরার দেওয়া সেই পাঞ্জাবি। জানা নেই। তিতির এগিয়ে এখানেই আসছে।

মুখোমুখি ইরা আর তিতির। তিতির মুচকি হেসে বলল,
“এতো ঘামছিস কেন? পানি খাবি!

ইরা মাথা নেড়ে না বলল। তিতির বলে উঠল,
কখন এলি, অনেকক্ষণ!

ইরা জবাব দিল না ঠোক গিলল। মনে হচ্ছে তিতির তার চিঠি পায় নি। সত্যি কি তাই! তবে যে আপার কাছে চিঠি দিয়ে এলো সেটা কি পড়ে নি তিতির। হুট করেই ইরার হাত ধরল তিতির। ইরা থমকে গেল। ইরার হাত শক্ত করে ধরে বলল, চল নদীর ঘাটে যাই!

বলেই হাঁটা ধরল। প্রায় অনেকখানি পথ হাটলো দুজন। চারদিকের পরিবেশ এখন শান্ত। তিতির হালকা কাশল। ইরা খানিকটা চমকে উঠল।

“বুঝলি ইরা তুই আমাকে সেদিন মিথ্যে বলেছিলি?

ইরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“কোন মিথ্যে?

“এই যে,‌ কোন মেয়ের হাত ধরলেই ছেলেরা তার প্রেমে পড়ে যায়। এইটা! কারণ কি বল তো?

হাঁটা থামিয়ে ইরার দিকে তাকাল তিতির। হেসে বলল, আমি তো তোর হাত না ধরেই তোর প্রেমে পড়েছিলাম! তাহলে হলো না এটা মিথ্যে কথা!

ইরার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তিতিরের কথায় এখন শ্বাস নিচ্ছে সে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। দু চোখে অশ্রু জড়ো হচ্ছে। মাথা নিচু করে ফেলল সে। তিতির ভ্রু কুঁচকে বলল, কি হয়েছে?

ইরা মাথা নাড়িয়ে বলল,‌কিছু না! অতঃপর তিতিরের হাত শক্ত করে ধরে বলল, চল নদীর ধারে চল!

—-

নদীর ধারে বসে আছে দুজন। ইরা তিতিরের ঘাড়ে মাথা রেখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আজ মনে হচ্ছে মরে গেলেও আর আফসোস থাকবে না। যা শোনার জন্য এতোদিন ধরে পাগল ছিল সে আজ সেই কথা শুনতে পেরেছে সে। তিতির আকাশের থেকে চোখ সরিয়ে ইরার দিকে তাকিয়ে বলল,

“ইরা! আমি যদি তোর ভাইয়ের কাছে গিয়ে খানিকটা সময় চাই তাহলে সে কি আমাকে সময় দেবে না। বলবো আমি চাকরি পাওয়া অবদি এই মেয়েকে আপনার হেফাজতে রাখবেন, তিনি কি রাখবেন না!

ইরা তিতিরের দিকে তাকিয়ে রইল। মুচকি হাসল সে। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার। এই অশ্রু হচ্ছে সুখের অশ্রু!

#চলবে….

[ রি চেক করা হয়নি ভুল গুলো ক্ষমার চোখে দেখার অনুরোধ রইল! ]

#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
| ষোড়শ পর্ব |

ফরহাদ রোজ করে দাঁড়িয়ে থাকে সেই রাস্তায়! নিলুফার বের হবার আগে বের হয়ে যায় সে। বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেই রাস্তায়। নিলুফার একটিবার তাকায় তখন এদিক। চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা থাকলে হয়তো নিলুফারের চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতে সে! না সেটা তো আর সম্ভব না!

ফরহাদ চা খাওয়ার জন্য বেরিয়েছিল। বাইকের কাছে এসে তাকিয়ে দেখে নিলুফার ওখানে দাঁড়ানো। তাহলে কি নিলুফার তার অপেক্ষা করছিল। ফরহাদ কাছে আগাতেই নিলুফাল হেসে তার দিকে তাকাল। বলে উঠল,

“ফরহাদ সাহেব যে, কোথায় ছিলেন? আপনার অপেক্ষায় করছিলাম!

ফরহাদ খানিকটা অপ্রস্তুত গলায় বলে উঠে,
“কেন?

“বাসায় যাবো বলে, আপনার বাইকে করে নিয়ে যাবেন!

“চলুন!

“আচ্ছা গিয়েছিলেন কোথায়?

“চা খেতে!

“তাহলে দুঃখিত!

“কেন?

“আমার জন্য আপনার আরেকবার চা খেতে হবে, চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে আমার!

“আচ্ছা!

বলেই ফরহাদ বাইকে বসল। তার কথা টুকু সমাপ্ত ছিল না। বলার ইচ্ছে ছিল, তোমার সাথে বসে চা খাবার সাধ আমার অনেক দিনের! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই কথাটার সমাপ্তি করল সে!

চায়ের টং বসে আজ আর চা খাওয়া হলো না। খুব ভিড় জমেছে দোকানের চারদিকে। নিলুফার কে বাইকে বসিয়ে রেখে ফরহাদ চা আনতে গেল। দুই কাপ চা হাতে নিয়ে এলো বাইকের কাছে। নিলুফার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, মেঘ জমেছে! খানিকক্ষণ পর বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টিতে ভিজবেন ফরহাদ সাহেব!

“আপনি ভিজবেন আমি বরং দাঁড়িয়ে থাকবো

নিলুফার হাসল। ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো তখন। বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস এটা। নিলুফার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

“আপনি কখনো একজন ভালো প্রেমিক হতে পারবেন না, বুঝলেন তো!

“কেন?

“কারণ আমি বৃষ্টিতে ভিজবো এই কথা বলার পর আপনার বলা উচিত ছিল, না ভিজবেন না আপনার সর্দি লেগে যাবে। তা না বলে কি কথা বললেন আপনি। আপনার পক্ষে কোন মেয়েকে পটানোর কাজ হবে না। ধুর ছাই করে যেকোন মেয়ে তাড়িয়ে দেবে আপনাকে!

ফরহাদ হেসে বলল, এটাতেও কিন্তু একটা মজা আছে।

“এখন প্লিজ বলবেন না একবার না পারিলে দেখ শত বার! বার বার গিয়ে মেয়ে পটাতে যাবেন আপনি!

ফরহাদ হেসে উঠলো। নিলুফার ও হেসে উঠলো তার সাথে। অপলক দৃষ্টিতে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইল ফরহাদ। বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা হয়তো পড়ল নিলুফারের গালে।‌ ঝড় ঝড় করে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। নিলুফার চোখ বন্ধ করে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। বিন্দুমাত্র বিরক্ত লাগছে না তার।‌ ফরহাদের ইচ্ছে করছে এই দৃশ্য ছবি বন্ধ করে রাখতে। কোন মেয়েকে বৃষ্টিতে ভিজলে এতোটা সুন্দর লাগে নিলুফার কে না দেখলে বোধহয় এই কথাটা জানতো না সে।

ফরহাদ বাইক চালাচ্ছে। মাঝে মাঝেই আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখছে নিলুফারকে। মেয়েটা এখনও চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ ফিরে আছে। ফরহাদ বলেছিল নিলুফার কে একাই ভিজতে কিন্তু এখন তারা ভিজছে দুজন একসাথে। নিলুফার এক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে ফরহাদের কাঁধ!

——-

এই অসময়ে বৃষ্টি আসবে সেটা জানা ছিল না শ্রেয়ার। কলেজের ভর্তির ব্যাপারে বের হয়েছিল সে। ইর্ডেন কলেজে ভর্তি হবার ইচ্ছে তার।‌ ব্যাগ কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে একটা মুদি দোকানের কাছে। নিজেকে তো বাঁচিয়ে নিচ্ছে ভিজে যাবার হাত থেকে কিন্তু পরণের শাড়িটার নিচের অংশটা বৃষ্টির পানির ছিটায় ভিজে যাচ্ছে। পা দুটোও কাঁদায় মাখামাখি! কেন জানি অসহ্য লাগছে তার। এই বৃষ্টি বোধহয় থামবার নয়! হঠাৎ করেই দৌড়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল মামুন! শ্রেয়া কে লক্ষ্য করেনি সে। বৃষ্টিতে অনেকটাই ভিজে গেছে।‌ কোন মতে গা ঝাড়া দিয়ে একটা সিগারেট কিনল দোকান থেকে। শ্রেয়া অদ্ভুত চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মামুন যেই না সিগারেট ধরাতে যাবে ওমনি তার মনে হলো কেউ তাকিয়ে আছে তার দিকে। শ্রেয়া কে দেখেই থমকে গেল সে। তাকে কোনভাবেই এখানে আশা করে নি সে।

থতমত খেয়ে মুখের সিগারেট টা নামিয়ে রাখল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল সে। শ্রেয়ার দৃষ্টি এখনো তার দিকেই। মামুন আল দাঁড়াল না। এই বৃষ্টির মাঝেই দৌড়ে বের হয়ে গেল সে। শ্রেয়া ভড়কে গেল!

বৃষ্টির গতি বেড়েছে! খানিকক্ষণ পর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এসে হাজির হলো মামুন। দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছে সে। শ্রেয়ার দিকে হাতের ছাতা খানা বাড়িয়ে দিল মামুন। শ্রেয়া অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে, “এই লোকটা শুধু ভিতু না তার সাথেও বোকা! নাহলে সাথে ছাতা থাকা সত্ত্বেও ভিজে ভিজে আসে কেউ!

হাত বাড়িয়ে ছাতা টা নিল শ্রেয়া। মামুন হাঁটতে হাঁটতে সরে গেল। এক সময় দৌড়ে চলে গেল আবার। তার মুখে যেন হাসির রেখা ছিল। শ্রেয়া এবারো কিছু বলতে পারল না। ছাতাটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। নতুন ছাতা! এখন কি তবে কিনে আনল ছাতা টা!

শ্রেয়া ছাতা মেলে হাঁটতে শুরু করল। এখন আর অসহ্য লাগছে না, মনে হচ্ছে বৃষ্টির চেয়ে মধুর আর কিছু হতে পারে না। মুচকি হেসে ছাতার দিকে তাকাল সে।

মন বলছে পেছন পেছন মামুন আসছে। নিশ্চিত হবার জন্য হঠাৎ করেই পেছন ফিরল সে। মামুন সত্যি ছিল পেছনে। তাকে দেখে ছুটে চলে গেল সে। শব্দ করে হাসল শ্রেয়া। না থাক বেচারা কে আর ভয় দেখাবে না। আসুক পিছনে! এই ভেবেই হাঁটতে লাগল। খানিকক্ষণ পর আবারো মনে হলো মামুন তার পিছনেই আছে। না থাক এবার আর পিছন ফিরবে না। এই মুহুর্তটা ভালো লাগছে তার!

—–

তিতির দাঁড়িয়ে আছে ইরার বড় ভাইয়ের সামনে। তার বড় ভাই পুলিশের আই জি! তাকে দেখে বোঝা দায় বয়স কতো হবে, কারণ তার বয়সের ছাপ মুখে পড়ে নি। নিজেকে সবসময় ফিট রাখে হয়তো। বড় ভাইয়ের নাম মোঃ মোজাম্মেল হোসেন! তার টেবিলের পাশেই ছোট একটা কার্ডে এই নামটা লেখা আছে। তিতির এর মাঝেই সেটা পড়ে ফেলেছে। এছাড়া আরো অনেক কিছুই আছে এই রুমে দেখার মতো। অনেক সম্মাননা আছে! তিতির সেখান থেকে চোখ সরিয়ে ফেলল। মোজাম্মেল হোসেন এতোক্ষণ পেছন ফিরে ছিল। এখন সামনে ফিরে তিতির কে দেখে বলল,

“তুমি তিতির!

“জ্বি!

“বসো!

বলেই তিনি বসলেন। তিতিরের অনেকটা বিচলিত লাগছে। রুমে এসেই সালাম দিয়েছিল সে। মনে হচ্ছে না তিনি সেটা কানে নিয়েছেন। তিতির তার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। তার মাথা নিচু কিন্তু উপলব্ধি করছে কেউ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে।‌ পুলিশের চোখের নিশানা হয় অন্যরকম। এখানে তার দিকে দৃষ্টি তো একটু তীক্ষ্ণ হবেই! মোজাম্মেল হোসেন পিয়ন কে ডেকে বলল চা দেবার কথা। অতঃপর তিতিরের উদ্দেশ্য বলেন,

“তোমার ব্যাপারে ইরা আমাকে সব’ই বলেছে।

তিতির ঢোক গিলে মাথা নাড়ল। মোজাম্মেল হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ইরা আমার একমাত্র বোন। মা বাবা মারা যাবার পর ওর পুরো দায়িত্ব আমার! কখনো কোন কমতি রাখি নি, যা চেয়েছে যখন চেয়েছে তাই দিয়েছি। তুমি জানো ইরার বিয়ে ঠিক হয়েছিল!

“জ্বি!

“ছেলেটা খুব ভালো ছিল, ভদ্র ছিল। পরিবারও ভালো! ভালো একটা চাকরিও করতো, কয়েকদিন পরই চাকরির সুবাদে বাইরেও যেত! ইরা কে তারাও বেশ পছন্দ করেছিল!

তিতির বুক কেঁপে উঠলো।‌ মনে হচ্ছে না জল ঠিক দিকে আগাচ্ছে! তিতির কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। মোজাম্মেল হোসেন টিস্যুর বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল,

“নাও ঘাম মুছে নাও! নার্ভাস হবার কিছু নেই।

এর মাঝেই চা এসে উপস্থিত হলো! চায়ের সাথে বিস্কিট ও! মোজাম্মেল হোসেন চা এগিয়ে দিয়ে বললেন চা খাও। তিতিরের হাত কাঁপছে। এই কাঁপা হাতেই চায়ের কাপ হাতে নিল। মোজাম্মেল হোসেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোন মতে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিয়ে রাখল সে। মোজাম্মেল হোসেন চায়ের কাপের চুমুক দিয়ে বললেন,

“গত পরশু ইরা আমার কাছে এসে তোমার কথা বলল। আজ সেই ছেলেদের আসার কথা ছিল। আমি তাদের বারণ করে দিয়েছি। তা এখন তুমি বলো!

“জ্বি!

“কতোদিন সময় চাও তুমি?

“জ্বি, আমি এখন অনার্স প্রথম বর্ষের পড়ছি!

“পড়ালেখা শেষে চাকরি পাওয়া অবদি!

“আমি চেষ্টা করবো পড়াশোনার পাশাপাশি’ই কিছু একটা করতে! শুধু একটু সময় চাই! ততোদিন ইরাও তার পড়াশোনা শেষ করুক। ওর ইচ্ছে ছিল অর্নাস কমপ্লিট করার!

“হুমম! তা কোন হেল্প চাইছো আমার কাছে।

“না না, শুধু সময়। আমি নিজেই এর মাঝে কিছু একটা করে নেবো।

“তা আর কিছু বলবে।

“জ্বি না।

“কোথায় যাবে এখন?

“টিউশনি আছে, পড়াতে যাবো।

“আচ্ছা যাও তাহলে, আমি ইরার সাথে কথা বলে নেবো।

“আচ্ছা!

বলেই উঠে দাঁড়াল তিতির। আবারো একবার সালাম দিল সে। মোজাম্মেল হোসেন মাথা নাড়ল!

ঘরের আলমারি খুলে কাপড়ের কোনা থেকে বিষে*র কৌটা বের করল ইরা! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কৌটার দিকে। অতঃপর এসে দাঁড়াল বেলকনির দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করল সে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে চোখ থেকে। হাতে মুঠ করে বিষে*র কৌটাটা। তিতিরের সাথে বিয়ে না হলে এটা খাবে বলে এনে রেখেছিল। কিন্তু এখন আর এটার দরকার নেই। ভাইয়া মেনে নিয়েছে। বুক ভরে শ্বাস নিল সে। নিজেকে আজ দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে। এখন আর এটার দরকার নেই। মুচকি হেসে কৌটাটা ফেলে দিল ইরা! আজ সে সুখী, অনেক সুখী!

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে