প্রেত সাধক ৩য় এবং শেষ পর্ব

0
1621

#প্রেত_সাধক
.
৩য় এবং শেষ পর্ব
.
রাত ১১টা বাজতেই নাইলা তার বিছানা-পত্র এনে আফরোজা বেগমের ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়ল। আফরোজা বেগমও ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। শুয়ে মনে পড়ল ঘরের আলো নেভাতে ভূলে গেছেন। বিছানা থেকে আর উঠতে মন চাইল না। ফাহাদ আর রাজ্জাক সাহেবকে নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন তিনি। প্রকৃতির ডাকে রাত ৩টা নাগাত ঘুম ভাঙল তার। তিনি বিছানায় উঠে বসে মেঝেতে তাকাতেই পুরো স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মেঝেতে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে নাইলা। মাথার কাছে তার সমস্ত কাপড় গুলটি করে রাখা। যেমনটা রান্নাঘরে থাকতো। বিদ্যুৎ গতিতে তিনি দরজার দিকে তাকালেন। না, দরজা ভেতর থেকেই আটকানো। তাহলে ঘরে কী তারা ছাড়া আর কেউ রয়েছে? নাকি এটা অলৌকিক কিছুর কাজ! কিন্তু ঘটনাটা যদি অলৌকিক হত তাহলে অলৌকিকের তো পানিতে ঘুমের ঔষুধ মেশানোর কোনো প্রয়োজন নেই। নাইলা নিজে থেকে উঠে দরজা না খুললে কেউতো ঘরে প্রবেশও করতে পারবে না। আফরোজা বেগমের মাথা ঘুরাচ্ছে। তিনি হতভম্ব, স্তম্ভিত হয়ে মুর্তির মতো বিছানায় বসে রইলেন।
.
এত সহজে আফরোজা বেগমের পক্ষে হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠা সম্ভব না। তবুও তিনি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। ধীরে ধীরে খাট থেকে নিচে নেমে নাইলাকে জাগানোর একটা বৃথা চেষ্টা করলেন। নাইলার মাথার পাশে আজও পানির জগ। আফরোজা বেগম বুঝলেন তার বড় ভুল হয়ে গেছে। অপরাধী হয়তো ভেবেছিল আজও নাইলা রান্নাঘরে ঘুমাবে। তাই জগে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিল। জগের পানিটা আগেই পরিবর্তন করা উচিত ছিল। নাইলা না হয় ঘুমের ঔষধ মেশানো পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্ত তার শরীরের এই অবস্থা করল কে? কারও পক্ষেতো আর দরজা না খুলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব না! তিনি সন্তপর্ণে পুরো ঘর পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করলেন যে এই ঘরে কেউ লুকিয়ে আছে কিনা! প্রথমে ভয়ে ভয়ে খাটের নিচে উঁকি দিলেন। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলেন না। এইভাবে পুরো ঘর খুঁজেও কাউকে না পেয়ে হতাশ হয়ে যান তিনি। এরপর নাইলার উপর কাঁথা জড়িয়ে দরজা খুলে উপস্থিত হন ফাহাদের ঘরে।ফাহাদ,রাহাত,রাজ্জাক সাহেব বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আফরোজা বেগমের মাথায় এখনও কিছুই ঢুকছে না। তিনি একবার ভাবলেন রাহাতকে ডাকবেন। পরে আর ডাকলেন না। চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিলেন।
ফেসবুক পেজ: নিঃস্বার্থ ভালোবাসা

.
এক ধ্যানে অনেক্ষণ নাইলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। বোঝার চেষ্টা করলেন, আচ্ছা এই মেয়েটা তার সাথে কোনো খেলা খেলছে নাতো! কিন্তু এইটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের এর পেছনে উদ্দেশ্যটা কী থাকতে পারে? আর সেদিন ধমক দেওয়ার পর থেকে সকালে নিজেকে নগ্ন পাওয়ার ব্যাপারে আর কোনো কথাই বলেনি নাইলা। সারাদিন স্বাভাবিক ভাবেই থাকে সে। যেন ঘটনাটাতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে!
এই রহস্যের শেষ কোথায়, জানা নেই তার। তাকে শান্ত রাখার জন্য মস্তিস্কও মনে হয় ঘুমানোর জন্য বারবার এলার্ম করছে। হাই তুলতে তুলতে বালিশে মাথা লাগালেন আফরোজা বেগম। অন্যদিন এত চিন্তার মধ্যে সহজে তার ঘুম আসত না। আজ ঘুমিয়ে পড়লেন দ্রুতই।
.
.
আফরোজা বেগম যখন ঘুম থেকে উঠলেন তখন ঘড়িতে সকাল ১০টা বেজে গিয়েছে। তিনি দ্রুত বিছানা থেকে নিচে নামলেন। এত বেলা হয়ে গেছে অথচ তাকে কেউই ডাকল না কেন? ঘরের দরজা খোলা। নাইলা তো অনেক্ষণ আগেই উঠে চলে গেছে মনে হয়। রাজ্জাক সাহেবও হয়তো এতক্ষণে অফিসে চলে গেছেন, আর ফাহাদ কলেজে। আফরোজা বেগম এখন আর রাজ্জাক সাহেব বা ফাহাদকে সন্দেহ করছেন না। তিনি আন্দাজ করতে পারছেন ঘটনাটা অন্য কিছুর প্রভাবে ঘটছে। যদিও অন্য কিছুটা কী সেটা তিনি বুঝতে পারছেন না।
.
.
ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন রাহাত খাবার টেবিলে। তার পাশের চেয়ারে
রাজ্জাক সাহেবকে দেখে আফরোজা বেগম একটু অবাক হলেন। উনারতো এখন অফিসে থাকার কথা! আফরোজা বেগমকে দেখে রাজ্জাক সাহেব বেশ ফুরফুরে কণ্ঠেই বললেন, শুভ সকাল, ঘুম কেমন হলো? আফরোজা বেগম ঘটনার আকস্মীকতায় কোনো উত্তরই দিতে পারলেন না। রাহাতের ডাকে খাবার টেবিলে এসে বসলেন।
.
.
আফরোজা বেগম আর কোনো কথাই বললেন না। চুপচাপ ৩ জনেই খাবার শেষ করলেন।
খাবার শেষ করে আফরোজা বেগম যেই উঠেছে নাইলা কোত্থেকে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে আরম্ভ করল। নাইলাকে তিনি ছুটানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আফরোজা বেগম কিছুই বুঝতে পারছেন না। মেয়েটার কান্না তাকেও স্পর্শ করল। নিজের অজান্তেই তার চোখ বেয়েও পানি পড়তে লাগল। পরমুহূর্তেই রাজ্জাক সাহেব একটা ব্যাগ হাতে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। এই ব্যাগটা আফরোজা বেগমের চেনা। এই ব্যাগটা সঙ্গে করেই নাইলা এই বাড়িতে পা রেখেছিল। রাজ্জাক সাহেব আফরোজা বেগমের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে বললেন, ওকে গ্রামের বাড়ি দিয়ে আসছি। এই বলেই তিনি ব্যাগ হাতে ধীরো পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। নাইলাও চোখ মুছতে মুছতে তার পিছু পিছু হাঁটতে আরম্ভ করল। আফরোজা বেগমের হতভম্ব ভাব কিছুতেই কাটছে না। তার মনে হচ্ছে বাড়ির লোকগুলো ইচ্ছে করেই তাকে বড় কোনো মানসিক চাপ দিচ্ছে।
ফেসবুক পেজ: নিঃস্বার্থ ভালোবাসা

.
রাজ্জাক সাহেব এবং নাইলা চলে যাওয়ার পর রাহাত বাড়ির বড় দরজাটা ভেতর থেকেই আটকে দিল। এখন বাড়িতে শুধু আফরোজা বেগম এবং রাহাত। রাহাত আফরোজা বেগমকে একটা চেয়ারে শান্ত হয়ে বসতে বলে। তিনি চেয়ারে ঠিকই বসলেন। কিন্তু তার উদ্বিগ্ন আর বিস্মীত চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনি শান্ত নেই। তার মন উথাল-পাথাল করছে। রাহাত একটা চেয়ার এনে আফরোজা বেগমের মুখোমুখি বসল। মাথা একটু ঝুকিয়ে বলতে আরম্ভ করল:
.
দেখ আপা, তুমি আমাকে ভূল বুঝো না। মাথাটা একটু শান্ত রাখার চেষ্টা কর। আমার সমস্ত কথা মনোযোগ দিয়ে শুনো। তাহলেই সব রহস্যের সমাধান পাবে তুমি। তোমার মনে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না। তুমি আমাকে যখন নাইলা সম্পর্কে ঐরাতে অদ্ভুত কথাগুলো বলেছিলে। তোমার মতো আমিও প্রথমে দুলাভাইকেই সন্দেহ করলাম। পরের দিন যখন তোমরা ঘরটাতে ছিলে না আমি ভাবলাম ঘরটার একটা তল্লাসী নেওয়া উচিত। ঘুমের ঔষধ কোথায় আছে এটা জানলে দুলাভাইকে ধরা সহজ হতো। ঘর তল্লাসী করতে করতে তোমাদের খাটের নিচে একটা কাপড়ের ট্রাংক দেখতে পাই। এত পুরনো একটা ট্রাংক এখানে দেখে বেশ অবাক হলাম। ট্রাংকটাতে তালা ছিল না। খুলে যা দেখলাম তাতে আরও অবাক হলাম। কয়েকটা মরা পাখি, বাদুড়, ইদুর, মাথার খুলি, হাড় সহ একটা প্রেত সাধনার পুরনো আমলের বই। তখনি বুঝতে পারলাম এই বাড়িতে কেউ প্রেত সাধনা করে প্রেত সাধক হয়েছে। আর প্রেত সাধকদের নানান পাপ কাজ করতে হয়। তাই এটা বুঝতে বাকি রইল না যে প্রেত সাধনা করে সে প্রেতকে খুশি করতেই নাইলার পানিতে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে রোজ রাতে তার সাথে খারাপ কাজটা করে। এরপরে গতকালকে যখন তোমার কথামতো পানির শিশি নিয়ে ফারহানা আপুর কাছে গিয়েছিলাম তখন আসল ঘটনা কী এটা জানার জন্য তিনি আমাকে চেপে ধরলেন। আমি কিছুতেই বললাম না আসল ঘটনা। তোমার মতো বানিয়ে একটা গল্প বলে দিলাম। কিন্তু তিনি মনে হয় বিশ্বাস করলেন না। এরপর তিনি যে কথা বললেন তা শুনে আমি পুরোই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ” তোমরা ভাই-বোন আমার থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছ বুঝতে পারছি। না বলতে চাইলে সমস্যা নেই। কিন্তু গতবার আফরোজা যখন আমার এখানে আসল তাকে বেশ অস্বাভাবিক লাগল। সে এর আগে একবার আমার কাছ থেকে এসে অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল রাতে নাকি তার ঘুম আসে না। ঘুমের ঔষুধগুলো বেশ কড়া। এগুলো কাউকে দেওয়া বেআইনী। একটা খেলে ৩-৪ ঘন্টা মরার মতো পড়ে থাকবে। আমি তাকে একপাতা ঔষধ দিলাম। সে অনেকটা জোর করেই পুরো প্যাকেটটাই নিয়ে গেল। বান্ধবী বলে কোনো দোহাই ই শুনল না। তাও আমি তাকে সাবধান করে দিয়েছি। আবার কিছুদিন আগে এক বোতল পানি এনে জানতে চাইল ঘুমের ঔষধ মেশানো আছে কিনা। আমি দেখলাম আমার কাছ থেকে যে ঔষধ নিয়েছিল ঐ ঔষধগুলোই মেশানো। এবার আবার তুমি পানির বোতল নিয়ে এসেছ। আফরোজা কী ঘুমের ঔষধ নিয়ে
কোনো গবেষণা করছে নাকি? তার আচরণও অস্বাভাবিক। তার দিকে একটু নজর রেখ। একসাথে এই ঔষধ অনেকগুলো খেলে মৃত্যুও পর্যন্ত হতে পারে।” আমার কাছে ঘটনাটা অনেকটাই পরিষ্কার হলো তখন। আবার আমার মনে পড়ল তুমি বেশ কিছুদিন আগে প্রেত-ফেত নিয়ে আমাকে নানান কিছু জিজ্ঞেস করছিলে। আমি এইগুলো বিশ্বাস করিনা বলে গুরুত্বের সঙ্গে নেইনি কথাগুলো। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি সেই প্রেত সাধক আর কেউ না তুমি। তুমিই নাইলা সহ বাড়ির সবার পানির জগে ঘুমের ঔষধ মেশাতে। আর রাতে রান্নাঘরে নাইলার ওই অবস্থা তুমি ই করতে। অবশ্য উপরের এতটুকু কথার উপরে প্রমাণ হয় না যে তুমিই আসলে রোজ রাতে কাজটা করতে। কিন্তু এতটুকু তথ্য তোমাকে সন্দেহ করার জন্য যথেষ্ট। তাই গতদিনে যখন তুমি বলেছিলে রাতে নাইলা তোমার সাথে ঘুমাবে তখনি আমি ছকটা কষে ফেলেছিলাম। চার্জ দেওয়ার নাম করে তোমার ঘরে আমার ভিডিও ক্যামেরাটা অন করে রেখে এসেছিলাম। যেটা দিয়ে মোটামুটি পুরো ঘরটা স্পষ্ট বোঝা যায়। যদিও ক্যামেরার উপর তেমন ভরসা ছিল না। তাই নাইলাকে বলেছিলাম পানির জগটা সাথে করে নিয়ে গেলেও পানি খাবি না। ঘুমের অভিনয় করে সারারাত জেগে থাকবি। ওর পানিতে যে ঘুমের ঔষধ থাকে এটা জেনে সে বেশ অবাক হয় আর আমি যে তার এই ঘটনাটা জানি এটা শুনে বেশ লজ্জাও পেয়ে যায় সে। যাই হোক, প্লান মতাবেক সবকিছুই হয়েছে। নাইলা সকালে কাঁদতে কাঁদতে রাতের ঘটনাটা আমাকে খুলে বলে। তুমি যে একটা ঘোরের মধ্যে থেকে কাজটা করো এটাও সে বুঝতে পেরেছে। দুঃখজনক ভাবে অনাকাঙ্গিত এই ঘটনাটা ক্যামেরা বন্ধীও হয়েছে। যাতে তোমার বিশ্বাস হয় ঘটনাটা। নাইলাকে টাকা দিয়েই বিদায় করা হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে যে তুমি মানসিক ভাবে অসুস্থ। সে এই ঘটনা কাউকেই বলবে না।
.
.
রাহাতের কথাগুলো যেন আফরোজা বেগমের মাথার উপর দিয়ে গেল। তিনি বড়বড় চোখ আর হাঁ করে রাহাতের মুখের দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। রাহাত এক নাগাড়ে কথা বলেই চলল:
.
কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে এতে। তুমিই যদি এই কাজগুলো করে থাক তাহলে তুমি এই কাজগুলোর কথা স্বীকার না করে উল্টো প্রথম থেকে এই কাজগুলোর জন্য অন্য কাউকে সন্দেহ করছ কেন? তার মানে কী তুমিই সবার সাথে ছলনা করে আসছিলে এতদিন? ইচ্ছে করেই আমাকে বিভ্রান্ত করছিলে? আমি তোমায় বিশ্বাস করি আপা। এবং আমার মনে হচ্ছে না তুমি আমাকে ইচ্ছা করেই বিভ্রান্ত করছ। তোমার এতে কোনো দোষ নেই। তোমার এই কাজগুলো নিজে করে নিজেই ভুলে যাওয়ার পেছনে দুটো ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। প্রথম ব্যাখাটাকে অপব্যাখ্যাই বলা যায়। ব্যক্তিগত ভাবে আমি এটা বিশ্বাস করি না। ব্যাখ্যাটা হলো, তোমার প্রেত সাধনাটা সফল হয়েছিল। সত্যি সত্যিই তোমার আহ্বানে একটা প্রেত এই বাড়িতে চলে এসেছিল। যে তোমার শরীরে ভর করে। কিন্তু তুমি কিছুই জানতে পারোনি। সেই প্রেতটাই তোমাকে অনেকটা সময় নিয়ন্ত্রন করতো। তার প্রভাবেই তুমি নাইলার সাথে এই জঘন্য কাজ করতে। আর সে যখন তোমাকে নিয়ন্ত্রন করা বন্ধ করে দিত তখন তুমি স্বাভাবিক হয়ে যেতে। আর নিজেরই করা কর্মকাণ্ড ভুলে যেতে। কিন্তু তোমার চারপাশ তা মনে রাখত। আর তোমার কাছে সেগুলোই রহস্যজনক মনে হতো। যেহেতু আমি অলৌকিকতা বিশ্বাস করিনা তাই এই ব্যাখ্যাটা আমি গ্রহন করতে পারছি না।
.
ফাহাদ এ বিষয়ে কিছুই জানে না। সে জানবেও না। গতরাতে তোমার ঐ ব্যবহারের পর দুলাভাই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে যায়। তাকে আমি আলাদা ঘরে নিয়ে পুরো ঘটনাটা খুলে বলি। তিনিও অবাক হন এবং তারও ধারণা হয় তুমি মানসিক ভাবে অসুস্থ। তুমি হয়তো ডাক্তার রহমত কে চেনো। দুলাভাইয়ের বন্ধু। তিনিতো সাইকিয়াট্রিস্ট। তাকে ফোনেই দুলাভাই সকাল বেলা পুরো ঘটনা খুলে বলেন। তিনি একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন এর। এই ব্যাখ্যাটাই গ্রহনযোগ্য আমার কাছে। আসলে তুমি সবার মাঝে থেকেও এক ধরণের নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলে। ঠিক তখনি তুমি কোথাও হতে প্রেত সাধনা সম্পর্কে জানতে পাও। এই সম্পর্কে লেখা একটা পুরনো বইও জোগাড় করে ফেল। বইটার লেখা তোমার উপর এতটাই প্রভাব ফেলে যে তুমি একা একাই প্রেত সাধনার উপরকরণ জোগাড় করে প্রেত সাধনা করে প্রেত সাধক হয়ে যাও। তোমার অবচেতন মন বিশ্বাস করতে শুরু করে প্রেত বলতে আসলেই কিছু আছে, তোমার প্রেত সাধনা সফল হয়েছে, তুমি যে প্রেতের সাধনা করেছ সে তোমার নিঃসঙ্গতা দুর করতে আসবে। তুমি যেহেতু বইটা পড়ে প্রেতটা সম্পর্কে ধারণা করেছিলে। সেই প্রেতটা সম্পর্কে সেখানে হয়তো লেখাছিল সেই প্রেতটা শরীরে প্রবেশ করলে সেই প্রেতটা অন্য নারীর সঙ্গে সঙ্গম করতে চায়। তাই তোমার মধ্যে একটা ২য় সত্তা তৈরি হয়েছে। তোমার চেতন মন নিয়ন্ত্রন করে একটা সত্তা, অপরটা অবচেতন মন। তাই একটা সত্তার কথা আরেকটা সত্তা মনে রাখতে পারছে না। তুমি কিছু সময় নিজেকে প্রেত মনে করছ এবং নাইলাকে কাছে পাওয়ার জন্য যা যা করার সব করছ। অথচ এর কিছুই তোমার পরবর্তিতে মনে থাকছে না যখন তুমি স্বাভাবিক হয়ে যাও। আপা, তোমার ভয় নেই। এটা একটা মানসিক রোগ মাত্র। এতটা ভয়াভহও নয়। ডাক্তার রহমত কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে চলে আসবেন। তোমাকে শুধু এইটুকু বিশ্বাস করতে হবে যে প্রেত বলে কিছু নেই।সবই তোমার অবচেতন মনের কল্পনা। ২য় সত্তাকে সৃষ্টি করেছ তুমি আর এটাকে ধ্বংসও করতে পারবে তুমি। একমাত্র এটাকে অবিশ্বাসের মাধ্যমেই ধ্বংস করতে পারবে আপা।
.
.
আফরোজা বেগমের মাথা ঘুরাচ্ছে। এই ধরণের কোনো কথা শোনার জন্য তিনি মানসিক ভাবে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি কৌতুহলতার বসে প্রেত সাধনা করেছিলেন ঠিকই কিন্তু এটা যে তার মনে এতটা প্রভাব ফেলতে পারে এটা তিনি কখনও কল্পনাও করতে পারেননি। এটা অবিশ্বাস করার কোনো উপায়ও নেই তার কাছে। রাহাতের ভিডিও ক্যামেরায় গতরাতে নাইলার সাথে করা ঘটনা দেখে তিনি লজ্জায়, সংকোচে, ভয়ে, আতংকে, বিস্ময়ে পাথরের মুর্তির মতো চেয়ারে বসে রইলেন। লজ্জায় তার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।
.
.
.
রাহাতও নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তার গভীর সাগরে সাতার কাঁটছে। রাজ্জাক সাহেব এখানে থাকলে সে একটু সাহস পেত। কিন্তু ডাক্তার রহমত বলেছেন যেহেতু নাইলা এই ঘটনার উদ্দীপক। তাই যত দ্রুত সম্ভব নাইলাকে এই বাড়ি থেকে সড়াতে হবে। তাই দুলাভাই তাকে নিয়ে চলে গেছে।
.
হঠাৎই বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠল। রাহাত ভাবল ডাক্তার রহমত এসেছেন বোধহয়। রাহাত সন্তর্পণে গিয়ে দরজাটা খুলে দেখল একটা বৃদ্ধ লোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। খালি পা, জীর্ণশীর্ণ লম্বা চুল, লম্বা দাড়ি। পরনে একটা ময়লা পায়জামা-পাঞ্জাবী। প্রথম দেখায় রাহাত ভাবল কোনো ভিখারী।
.
পরমুহুর্তেই একটা লোককে দেখা গেল রিক্সার বিল মিটিয়ে এইদিকে আসতে। পরণে একটা সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট ইন করা। শ্যাম বর্ণের মধ্যম উচ্চতার লোকটা রাহাতের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, হ্যালো আমি ডাক্তার রহমত। ইনি আমার সাথেই এসেছেন। বৃদ্ধ লোকটা তার সব গুলো দাঁত বের করে রাহাতকে সালাম দিল। রাহাত কিছুটা ইতস্ততা করে তাদের দুজনকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। সেই ময়লা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরা লোকটা কুকুরের মতো নাক ছিটকাতে ছিটকাতে আফরোজা বেগমের সামনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বড়বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর আবার সবগুলো ময়লা দাঁত বের করে ডাক্তার রহমতের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘটনা শুইনা আগেই আঁছ করছিলাম ছার। মাইয়ার শইলে প্রেত আছে। এবার আফরোজা বেগমের দিকে মুখ করে বললেন, ভয় পাইও না মাইয়া। তুমি বুদ্ধীমতী। তোমার শইলে যেই প্রেত আছে ঐটা ছোট জাতের। এদের বলে মিকি। এরারা মাইনষের কোনো ক্ষতি করেনা। এদের আনা যতটা সোজা খেদাইয়া দেওন তার চাইতে বেশি সোজা। এইগুলো যার শইলে ঢুকে তারারে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রনই করতে পারে না। এরার যাদুর ক্ষমতাও নাই। এরা নিজেরা মাইয়া। ভরও করে মাইয়ার শইলে। এরাদের মাইনষের শইলে ভর করার আসল কারণ হইল গিয়া অইনো মাইয়ার শরীর ভোগ করা। আর কিছুই করেনা। আমি এখনই ঐটারে তারাইতাছি। তুমি আমারে আগে ঐ জিনিসগুলার কাছে নিয়া যাও যেই জিনিস গুলো দিয়ে প্রেত সাধন করছিলা।
.
.
কারও কোনো কথা বলার অপেক্ষা না করেই লোকটা আফরোজা বেগমের ঘরের দিকে এগিয়ে চলেন। আফরোজা বেগম রোবটের মতো তাকে অনুসরণ করে চলেন।
.
রাহাত বিস্মীত কণ্ঠে ডাক্তার রহমতকে বলে, এই পাগলটা বলে কী? আপনি একে কেন নিয়ে এসেছেন? আপনি ডাক্তার হয়ে এটা বিশ্বাস করেন যে আপার শরীরে প্রেত ভর করেছে?
.
ডাক্তার রহমত তার এক হাত রাহাতের কাঁধে রেখে মুঁচকি হেসে বলেন, দেখ, আমি এবং তুমি দুজনেই জানি প্রেত বলে কিছু নেই। কিন্তু তোমার আপা এটাকে বিশ্বাস করেন। এতটাই বিশ্বাস করেন যে তার মতে এইরুপ প্রভাব ফেলেছে প্রেত বলে এক অজানা, অচেনা বস্তু। প্রেতের প্রতি তার মনে বিশ্বাসটা এসেছে প্রেত সাধনার মাধ্যমে। তাই তার মন থেকে প্রেতটা দূর করতে হবে প্রেত সাধনার মাধ্যমেই।
আমি আর তুমি জানি প্রেত বলে কিছু নেই। কিন্তু সে ভাববে প্রেত সাধনার মাধ্যমে সে প্রেত এনেছিল আর প্রেত সাধনার মাধ্যমে সে দুর হয়েছে।
.
রাহাত আবারো অবাক কণ্ঠে বলল, তার মানে এই লোকটা জাল প্রেত সাধক? ডাক্তার রহমত এবার কণ্ঠটাকে একটু নিচু করে উত্তর দিলেন, না। এই লোকটা ৫০বছরেরও বেশি সময় নিয়ে নাকি প্রেত সাধনার সাথে জড়িত। লোকটার সাথে পরিচয়ের ঘটনা অনেক বড়। এখন বলা সম্ভব না। তিনি নাকি এখন প্রেতসাধক থেকে প্রেত খাদক হয়ে গেছেন। প্রেত ধরে আর গপাগপ গিলে। হাহাহা।
ধাপ্পাবাজ ।
.
এই পরিস্থিতিতে ঠাট্রা মোটেও পছন্দ হয়নি রাহাতের। রাহাত এবং ডাক্তার রহমতও তাদের পিছুপিছু আফরোজা বেগমের ঘরে ঢুকলেন।
.
খাটের নিচ থেকে ঐ ট্রাংকটা বের করলেন লোকটা। একটা একটা উপকরণ মেঝেতে সাজিয়ে রাখলেন ট্রাংক খুলে। লোকটাকে দেখে তেমন পড়ালেখা জানে বলে মনে হয় না। তবুও সেই প্রেতসাধনার বইটার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন তিনি। এরপর বইটা নিজের ঝুলির মধ্যে ভরে দাঁত বের করে রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, এইডা সাবধানে নষ্ট করতে হইবে। এইডা আমি পরে নষ্ট করব। এরপর আফরোজা বেগমকে মেঝেতে বসতে বললেন। আফরোজা বেগম বসলেন। আফরোজা বেগমের সামনে তিনি প্রেত সাধনার সময় যে যে উপকরণ ব্যবহার করেছিলেন তা সাজিয়ে রাখা। তিনি একদৃষ্টিতে সেগুলো দেখতে লাগলেন। তার মাথা সত্যিই এলমেল হয়ে গেছে। তাকে যা বলা হচ্ছে তিনি তাই করছেন। সাধক লোকটা তার ঝুলি থেকে একটা খালি কাঁচের বয়াম আর পানি ভর্তি একটা বোতল বের করলেন। সেই পানির কয়েক ফোটা আফরোজা বেগমের শরীরে ছিটিয়ে দিতেই আফরোজা বেগম ব্যাথার আর্তনাদে চেঁচিয়ে উঠলেন। যেন এটা কোনো পানি না, ভয়ংকর এসিড। ডাক্তার রহমত রাহাতকে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, মনের প্রভাব এবার শরীরে কাজ করছে। এরপর সাধক লোকটা তার ঝুলি থেকে কয়েকটা কাঠের টুকরো বের করে ঘরের ভেতরেই আগুন জ্বালালো। প্রেত সাধনার একটা করে উপকরণ সেই আগুনে ফেলে পোড়াতে লাগলেন। সবকিছু রাহাতের কেমন অসহ্য লাগছে। আকস্মীক লোকটা তার বোতলের অর্ধেক পানি আফরোজা বেগমের মাথায় ঢেলে তার ঝুলি থেকে এক মুঠ কী মাটি বের করে মুঠো করে আফরোজা বেগমের কপালে ধরে রাখলেন। এবার আফরোজা বেগম বিকট আওয়াজ করে চেঁচিয়ে সাথে সাথেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। রাহাত আর ডাক্তার রহমতের সকল যুক্তিকে পেছনে ফেলে একটা অবয়বহীন কালো ছায়া ধুয়ার মতো আফরোজা বেগমের শরীর থেকে বেরিয়ে এসে খালি কৌটায় প্রবেশ করল। সাধক লোকটা সাথে সাথে বয়ামের মুখা বন্ধ করে ফেললেন।সন্তপর্ণে দাড়িয়ে রাহাত এবং ডাক্তার রহমতকে বললেন, এইডারে পরে এই পানি দিয়াই খায়া ফালামু। সূর্য ডুবার আগে খাইয়া কোনো ফল নাই। এই বলেই বয়ামটা তার ঝুলিতে ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির বাইরের দিকে এগিয়ে চললেন।
.
রাহাত বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে ডাক্তার রহমতের মুখের দিকে তাকাল। ডাক্তার রহমত কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বিড়বিড় করতে লাগলেন, এরা ভয়ংকর দুরন্দর প্রকৃতির মানুষ। লোকটা আমাদের হেলুসিনেট করেছে। আমরা যা দেখলাম পুরোটাই হেলুসিনেশন।
.
.
* * * * * সমাপ্ত * * * * *
.
.
লেখা: #Masud_Rana
.
.
[গল্পটা এখানেই শেষ। পাঠকরা চাইলে আফরোজা বেগমের পুরো কাণ্ডটা প্রেতের কাজ হিসেবে নিতে পারেন আবার ডাক্তার রহমতের ব্যাখ্যাটাও গ্রহন করতে পারেন। এটা পাঠকদের ইচ্ছা।সবার জন্য ভালোবাসা। ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে