#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩২
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
“নবাব… এই নবাব?” মিষ্টি ডাকলো নবাবকে কিন্তু নবাব একটিবারের জন্য ফিরেও দেখলো না। ভারাক্রান্ত মনে মিষ্টি হঠাৎ-ই অনুভব করলো তার গাল ভিজিয়ে কিছু একটা গড়িয়ে পড়েছে। ডান হাতে সেটা ছুঁয়ে চোখের সামনে ধরে বলে উঠলো, “সবাই আমাকে চোখের জল উপহার দিয়ে কেন সরে যায়?” এরপর আকাশের দিকে মুখ করে সেই স্বাতী নক্ষত্রের উদ্দেশ্যে বললো, “তোমার মতো আমিও একা, না?”
.
“কী হয়েছে তোমার বলো তো? একটু বাদে মেয়ের বিয়ে আর তুমি একা ঘরে অস্থির হয়ে উঠছো। আরে মেয়ে তো সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে না। পাশের শহরেই বিয়ে হচ্ছে। তাছাড়া ইফাদ খুব ভালো ছেলে।” নিঝুম অনর্গল বললেন কিন্তু সোবহানের পায়চারি থামবার নাম নেই। ঘরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে হেঁটে চলেছেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিঝুমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইফাদকে নিয়ে কে ভাবছে? আমি তো ভাবছি ঐ কবিরকে নিয়ে।”
“কবির?” হা হয়ে গেলেন নিঝুম।
“হ্যাঁ, কবির। মেয়েকে যখন পাত্রপক্ষ দেখতে এলো, তখন থেকেই আমাকে হুমকির মুখে রেখেছে। তবে আমি মামুলি বিষয় ভেবে গায়ে তুলিনি। কিন্তু আজকে সকালে ফোন করে বললো মেয়ের বেনারসি সাথে কাফনের কাপড় তৈরি করে রাখতে।”
“কী বলছো গো তুমি?” আঁতকে উঠলেন নিঝুম।
“ঠিকই বলছি।”
“এখন কী হবে? মেয়েটা বিয়ের আসরে এমন কলঙ্কিত হলে লোকে কী বলবে গো?” এই বলেই আঁচলে মুখ ডাকলেন নিঝুম।
“তুমি বিয়ে নিয়ে পড়লে? মেয়েটার যদি উনিশ-বিশ কিছু হয়ে যায় তখন? আমাদের কি আট-দশ জন ছেলে-মেয়ে? একটা মাত্র মেয়ে আর তার যদি কিছু হয় তাহলে সেই কষ্ট বইতে পারবে সারাজীবন?” বেশ উঁচু গলায় কথাগুলো বললেন সোবহান। দোতলার ঘরে এখন কেউ নেই। সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত। তাই গলার স্বরের দিকে নজর রাখেননি সোবহান অবশ্য উত্তেজনার ফলে তার মনে আসেনি অন্য কেউ এসব শুনতে পারে।
“কী হয়েছে ভাবী?” হঠাৎ মিনারার কন্ঠ শুনে স্বামীস্ত্রী দু’জনেই চমকে উঠলেন। সোবহান এই বিষয়ে বোনকে কিছু বলতে নারাজ। তাই পুনরায় পায়চারি করার সিদ্ধান্ত নিলেন কিন্তু নিঝুম সবটা বলে দিতেই আঁতকে উঠলো মিনারা, “এখন উপায়? দুই ঘন্টা বাদেই তো বরযাত্রী আসবে।” এরপর ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, “ভাইজান, এসব বিষয় নিয়ে আপনার আরও আগে আলোচনা করা উচিত ছিল।”
খেঁকিয়ে উঠলেন সোবহান, “আমি কি জানতাম না-কি মেম্বারের ঐ পাতি মাস্তান ছেলে এসব করতে পারে?”
“ভুল বললেন ভাইজান। জল কি একদিনে গড়ায়? ছোটবেলায় মিষ্টিকে কিন্তু শাসিয়ে ছিল, ওকে বড় হলে দেখে নিবে৷ আল্লাহর অশেষ রহমতে আজ অবধি মেয়েটার কিছু হয়নি। আপনি যদি আগে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন তবে আজকেও এসব শুনতে হতো না।”
“আমি জানি না। মাথায় কিছু ঢুকছে না আমার।” হাত নেড়ে সোবহান আবার পায়চারি শুরু করলেন। এদিকে নিঝুম মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছেন। কিছু সময় ভাই-ভাবীকে দেখে নিঃশব্দে ঘর ত্যাগ করলেন মিনারা।
নিজের স্বামীকে খুঁজতে খুঁজতে বিরক্ত প্রায় মিনারা একলা মনে বিড়বিড় করলেন, “কাজের সময় মানুষটা যে কোথায় থাকে? আর ছেলে তো বিদেশে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করেছে। দিনের পর দিন এমনিই চলে যায়। না কোনও ফোন না কোনও খবর নেওয়া। কত করে বললাম বিয়েতে আসার জন্য। আজকে বিয়েতে এলে কি এতসব দেখতে হতো আমায়?”
“কার সাথে কথা বলছো নবাবের মা?” আরমানের কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো মিনারা। পিছনে ফিরে ভ্রু জোড়া কুঁচকে স্বামীকে জবাব দিলেন, “আমার ভাগ্যের সাথে।”
“তার আবার কী হলো?”
“কী আবার হবে? বিয়ের পর তুমি সৌভাগ্য এনে দিলে আর এখন তোমার ছেলে দিচ্ছে।”
“আহা! চটছো কেন? কী হয়েছে বলবে তো?”
আশেপাশের মানুষদের শুনিয়ে কিছু বলতে চান না মিনারা। তাই স্বামীকে বললেন, “বলছি আগে এসো আমার সাথে।” বলেই হাত ধরে টানতে টানতে হাঁটতে শুরু করলেন। আরমান কিছু বলতে গিয়েও চুপচাপ হাঁটতে লাগলেন।
ফাঁকা ঘরে বউয়ের মুখে সবটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন আরমান, “কী বলছো তুমি? হ্যাঁ?”
“দেখো, এছাড়া কোনও উপায় নেই। তোমাকেই ব্যবস্থা করতে হবে।”
“আমি কী ব্যবস্থা করবো? জহির আমার বন্ধু বলে কি নিজের কাজ ফেলে বিয়ে বাড়ি পাহারা দিবে?”
“আশ্চর্য! পাহারা দিতে আমি কখন বললাম?” বিরক্ত হলেন মিনারা।
হাত নাড়িয়ে আরমান বললেন, “না, না, আমি এসব করতে পারবো না। জহির আমার বন্ধু বলে আমি যা খুশি তাই আবদার করতে পারি না।”
“তুমি কী? হ্যাঁ? মিষ্টি যদি তোমার নিজের মেয়ে হতো আর এমন বিপদে থাকতো তাও কি তুমি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে? আরে আমি কি অন্যায় কিছু করতে বলছি? পুলিশের একটু নজরদারিতে বিয়েটা চুকে যেত। এতে কি আর দিন-রাত পাহারা দিতে হবে?”
একটু ভেবে আরমান জিজ্ঞেস করলেন, “বিয়ের পর কিছু হবে না তার কোনও নিশ্চয়তা আছে?”
মিনারা বললেন, “আমাদের নিশ্বাসেরও তো নিশ্চয়তা নেই। তাই বলে কি আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি? তা তো নয়। তাহলে বিয়েটা হলে সমস্যা কোথায়?”
ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে আরমান বললেন, “জানি না কিন্তু ওর হয়ত বিয়েটা না হলেই ভালো হতো। ওর বিয়ে নিয়ে অনেকেই বোধহয় অখুশি।”
“এসব কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি বরং জহির ভাইয়ের সাথে কথা বলে একটা কিছু ব্যবস্থা করো।”
আরমান গম্ভীর গলায় বললেন, “ব্যবস্থা করছি কিন্তু পরে দেখো আবার না পস্তাতে হয়।” মিনারা অবাক হলেন, কিছু বলতেও চাইলেন কিন্তু কথা খুঁজে পেলেন না বিধায় চুপ করে রইলেন।
আরমান জহিরের সাথে আলাপ করতেই জহির রাজি হয়ে বলে উঠেন, “সমস্যা নেই। আসলে আজকে একটু ফাঁকা আছি। তুই ভাবিস না। আমি দেখছি কী করতে পারি?”
জহিরের সহায়তায় বিয়ে বাড়িতে কোনও গোলযোগ দেখা দেয়নি। বরপক্ষ যথা সময়ে এসেছে। সবার খাওয়াদাওয়া চুকে যেতে এখন কাজি সাহেবকে নিয়ে বিয়ে পড়ানোর ধুমধাম চলছে। বরপক্ষের কথানুযায়ী দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়েছে একুশ লক্ষ টাকা। এমন বেমিল টাকার পরিমাণ নিয়ে নিঝুম আপত্তি করলেও সোবহান বলেছিলেন, “তারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী দিচ্ছে। আমাদের সেখানে কথা বলা উচিত নয়।” স্বামীর কথার বিপরীতে নিঝুম কথা বাড়ায়নি কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট নন সেটা সোবহান ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন।
হালকা কেশে কাজি সাহেব মিষ্টিকে বললেন, “তোমার মত আছে মা বিয়েতে? থাকলে কবুলটা বলে ফেলো।”
নববধূর সাজে মিষ্টি নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। তার চিবুক ভেজানো চোখের জলকে হয়ত সবাই স্বাভাবিক বিষয় মনে করছে। কারণ বিয়েতে প্রায় সকল মেয়েই পরিবার হারানোর ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে। কিন্তু মিষ্টির চোখের অশ্রুর নামটা যে সবার অজানা। কেউ হয়ত জানবেও না তার চোখের জলের নাম নবাব।
…চলবে
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩৩
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
স্বাতী নক্ষত্রের সমতুল্য করে যে রাতে নবাব মিষ্টিকে একা করে চলে গিয়েছিল, সে রাতের পর আর কখনও নবাব মিষ্টির সাথে যোগাযোগ করেনি। মিষ্টির অসংখ্য কল এবং ম্যাসেজ নবাব এতদিন ধরে উপেক্ষা করে এসেছে৷ মিষ্টি ভেবেছিল তার বিয়েতে হয়ত নবাব আসবে। কিন্তু মিনারা তাকে জানিয়ে ছিল, “ও ছেলের কথা ভেবে দুঃখ করিস না মা। ও যে আমাকেও ত্যাগ করেছে। কত করে অনুরোধ করলাম তোর বিয়েতে আসার জন্য কিন্তু মুখের উপর মানা করে দিলো।”
নিজের ফোন দিয়ে ব্যর্থ হয়ে মিষ্টি অন্য নাম্বার দিয়েও চেষ্টা করেছিল নবাবের সাথে কথা বলতে। কিন্তু নবাব টের পেয়ে যেত এবং কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে কল কেটে দিতো এরপর কল রিসিভ করাও বন্ধ করে দিলো। সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে যখন মিষ্টির চোখের জলে হৃদয় ভাসতো, তখন অভিমানী কন্ঠে বলতো, “তুমি এমন পাষাণ হবে আমি কখনও ভাবিনি নবাব। এতই যখন পাষাণ হতে পেরেছো, তখন আমিও মনে করবো তুমি আমার জন্য মরে গেছো।” কিন্তু এই অভিমান ছিল ক্ষনিকের। যখন ফুরিয়ে যেত তখনই মিষ্টি নবাবের কন্ঠ শুনতে ব্যাকুল হয়ে উঠতো।
“কবুল বলো মা।” কাজি সাহেব আরও একবার বলতেই মিষ্টির চোখের কোলে পানির পরিমাণ তরান্বিত হলো। চোখ বুজে দিতে নবাবের চেহারা ভেসে উঠলো আর সেই ভাসমান চেয়ারকে অবলীলায় জানালো, “তোমার পানে চেয়ে কবুল বলার সাধ ছিল নবাব কিন্তু কপালে নেই হয়ত।” ভাবতে গিয়ে ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেল মিষ্টির। নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হতেই মিনারা মিষ্টির পাশে বসে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কাঁদিস না মা৷ কবুল বল।”
মিষ্টির কান্না সামলাতে গিয়ে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। ভেজা দৃষ্টিতে সে কাল্পনিক নবাবকে দাঁড় করিয়ে উচ্চারণ করলো, “কবুল।”
বিছানায় কত-শত ফুলের সমারোহের মাঝে মিষ্টি চুপটি করে বসে আছে। অপরিচিত এই বাড়ির অপরিচিত একটা ঘরে একা সে। আজকে তিনটে শব্দের এতো শক্তি যে অচেনা একজন পুরুষের গৃহে সে দিব্যি বসে আছে। তবে এমনটা আগে সম্ভব হতো না কিন্তু কবুল বলার মাধ্যমে সেটা সম্ভব হয়েছে কারণ সে যে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ।
ঘরভর্তি মানুষ একে একে চলে যেতেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে মিষ্টি। যার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে তাকে মিষ্টি একবারই দেখেছিল। যেদিন প্রথম ইফাদ মিষ্টিকে দেখতে ওর বাড়ি গিয়েছিল, তখন ওদের আলাদা করে কথা বলার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেদিন ইফাদ মিষ্টিকে জিজ্ঞেস করেছিল, “দেশকে ভালোবাসেন?”
মিষ্টি তার নত মাথা সোজা করে চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “মানে?”
হালকা হেসে ইফাদ বললো, “দেশপ্রেম, দেশের প্রতি টান অনুভব করেন কি?”
মিষ্টি এমন প্রশ্ন আশা করেনি তার ওপর অপরিচিত একটা মানুষের সম্মুখে কথা বলতেও তার যেন সংকোচ হচ্ছে। কিন্তু তাকে যে উত্তর দিতে হবে। তবে মিষ্টি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে স্থির করলো।
“হ্যাঁ, করি আর কি।” মিষ্টির কথা জিহ্বায় আটকালেও সেটা স্পষ্ট হলো না।
“বোধহয় তেমন করে নয়। আসলে দেশ আমাদের কাছে মায়ের সমতুল্য। গর্ভধারিণী মায়ের মতো দেশমাতাকেও আমাদের ভালোবাসা উচিত, দেশের জন্য আত্মনিয়োগ করা উচিত আর সুন্দর দেশ গঠনে ভূমিকা রাখা উচিত।” ইফাদের কথা শুনতে মিষ্টির ভালো লাগছে। মুগ্ধ হয়ে শুনতে গিয়ে মিষ্টি অনুভব করলো ইফাদের দেশের প্রতি অন্য রকম টান আছে। একা ঘরে বসে মিষ্টির আজ ইফাদের সাথে দেখা হওয়ার দিনটার কথাই মনে পড়ছে।
মিষ্টির পরনে এখন সাধারণ থ্রি-পিস। ইফাদের বোন এসে বলেছিল, “ভাবী, ভাইয়া একটু বাইরে গেছে। তুমি পোশাক পাল্টে বিশ্রাম নাও। আমি একটু পরে খাবার নিয়ে আসবো। মা একটু ব্যস্ত তো তাই উনিও আসতে পারছেন না।” মিষ্টির কী বলা উচিত সে বুঝতে পারছিল না তাই শুধু মাথা দুলিয়ে ছিল। জবাব পেয়ে ইফাদের বোন চলে গিয়েছিল। মিষ্টি সংকোচে মেয়েটার সাথে কথা বলেনি আর মেয়েটাও প্রয়োজনের বেশি বাক্য ব্যয় করেনি এমনকি মিষ্টি মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করারও সুযোগ পায়নি। বার কয়েক নামটা যদিও বা শুনেছিল সে কিন্তু মনে করতে পারছে না।
ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে অথচ ইফাদের দেখা নেই। এদিকে কান্নাকাটি আর যাতায়াতে মিষ্টির শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিছানায় হেলান দিয়ে মিষ্টি বাধ্য হলো চোখ বুজে দিতে। কারণ তার চোখের পাতা আর চাইছে না আলো গ্রহণ করতে।
“এই মিষ্টি? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?” বালুচরে হাঁটছে মিষ্টি অথচ তার মন পড়ে আছে ইফাদের বাড়িতে।
“এমনি।” বেশ মলিন মুখে জবাব দিলো মিষ্টি। নবাবের মনের অবস্থাও ভালো নয়। তাই চটপটে হতে দেখলো মিষ্টি নবাবকে, “দাঁড়িয়ে থেকো না। জলদি এসো।”
মিষ্টি কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো আর তখনই আবার ইফাদের কথা মনে পড়লো। মনে পড়লো পরদিন সকালে জেগে উঠে ইফাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার কথা। বিয়ের রাতে মিষ্টি টের পায়নি সে কখন ঘুমিয়ে ছিল? কিন্তু তার সকালের সূচনা হয়েছিল কারো গলা ফাটানো চিৎকারে। ধুরমুর করে জেগে উঠে মিষ্টি শুনতে পেয়েছিল কেউ একজন কেঁদে কেঁদে চিৎকার করছে, “ইফাদ রে। বাপ তুই আমাকে ফেলে চলে গেলি? কে আমার মানিককে আমার কোল থেকে কেড়ে নিলো?”
মিষ্টি সবটা বুঝতে পেরে যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য তার বিয়ে হয়েছে আর মানুষটাকে দেখার আগেই সে মিষ্টিকে নতুন একটা পরিচয় দিয়ে চলে গেছে। বিধবা, মিষ্টির নামের সাথে তার ভাগ্য একটা নতুন শব্দ জুড়ে দিয়েছিল সেদিন আর জীবনে এনে দিয়েছিল অন্য এক বাঁক।
.
নবাবের সাথে মিষ্টির সম্পর্ক কিঞ্চিৎ শিথিল হয়ে এসেছিল। কিন্তু আজকে সোহেলের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে মিষ্টি নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নিয়েছে। মুখে সর্বদা উদাসীন আর কৌতূহলী ভাব। দরকার ছাড়া কথা বলা একদম কমিয়ে দিয়েছে সে। এসব নবাবকে খুব বেশি আহত করছে কিন্তু এই আহত হৃদয় নবাব যতটা পারছে মিষ্টির থেকে আড়াল করে রাখছে।
বালিশে মাথা রেখে ঝিম মেরে শুয়ে আছে নবাব। কপালে বলিষ্ঠ হাত আর চোখের রাজ্যে চিন্তার ছাপ। পাশের রুমেই মিষ্টি রয়েছে একদম নিশ্চুপ হয়ে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে দু’জন নিঃশব্দে আলাদা রুম দখল করে যে যার মতো পড়ে আছে৷
হানিমুন হোটেলের নিচতলায় খাওয়ার ব্যবস্থা আছে, সেখানেই খাওয়াদাওয়া চলছে মিষ্টি আর নবাবের। আজ দুপুরে খেতে গিয়েও তেমন কথা বলেনি মিষ্টি। নবাব একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হয়েছে মিষ্টি?”
অহেতুক ভাত নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত মিষ্টি জবাব দিলো, “কিছু না।”
“তাহলে খাচ্ছো না কেন?” নবাবের প্রশ্নের উত্তর দেয়নি মিষ্টি। মাংস আর ভাতের দলা মুখে পুড়ে বুঝিয়ে ছিল সে খাচ্ছে।
প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে নবাব ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ঘুম আসছে না। অসহ্য যন্ত্রণায় সে এবার উঠে বসলো। পা ঝুলিয়ে দু’হাতের উপর শরীরে ভর ছেড়ে মাথা নুইয়ে ভাবতে লাগলো, “আমি তো কখনও বলিনি তোমায় কিছু। তবে অন্যের কথায় কেন আমার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলে মিষ্টি? তুমি সবসময় আমার থেকে নিজেকে আড়াল করতে। তবে সেখানে আমার প্রতি তোমার চিন্তা কাজ করতে বিধায় এমনটা করতে তুমি। কিন্তু আজকে তো অন্যের কথায় আমাকে পর করে দিচ্ছো মিষ্টি।” এসব ভাবতে গিয়ে নবাবের চোয়াল শক্ত হলো। আচমকা রাগের বাতি জ্বলে উঠতেই নবাব মিষ্টির ঘরে চলে এলো।
বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে মিষ্টি। মুখে মলিনতা আর শরীরে জীর্ণতা স্পষ্ট দেখতে পেল নবাব। কিন্তু এতে তার ক্রোধ ক্রমশ বৃদ্ধি পেল। মিষ্টির পাশে এসে দাঁড়িয়ে নবাব জিজ্ঞেস করলো, “তোমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে, না?”
কিঞ্চিৎ আঁতকে উঠে চোখ খুললো মিষ্টি। নবাবের দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসলো। নবাব রেগে আছে এটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তাই মিষ্টি কোনো জবাব দিলো না। ওকে নিশ্চুপ দেখেও নবাবের বুঝতে বাকি রইলো না মিষ্টি সবটা জানতে ব্যাকুল হয়ে আছে।
শরীরের ভার ছেড়ে বিছানায় বসে নবাব বললো, “সোহেলের সাথে তোমার বাগদানের পর আমার পক্ষে নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল মিষ্টি। মেনে নিতে হয়ত পারতাম কিন্তু তুমি যখন কেঁদে কেঁদে বললে তোমার মতের বিরুদ্ধে এসব হচ্ছে, তখন আর পারিনি নিজেকে সামলাতে।” মিষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেও এখন নবাব আর পারছে না মিষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে। একটা অপরাধ নিজের মাঝে জেগে উঠতে সে চোখ সরিয়ে নিলো কিন্তু মিষ্টি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
একটু সময় নিয়ে নবাব আবার বলতে শুরু করলো কিন্তু এবার তার কন্ঠে উত্তেজনা নেই বরং কষ্ট এসে ধরা দিলো, “তোমাকে আমি সুখী দেখতে চাইতাম সবসময়। কিন্তু দূর থেকে আমি তোমাকে এসব বিষয় থেকে সরিয়ে রাখতে পারতাম না। কারণ তোমার পরিবার তোমাকে বিয়ে দিবেই সেটা হয়ত হাজারবার দিতেও তাদের আপত্তি নেই। মামা-মামীর সাথে কথা বলার সাহস আমার হয়নি তখন আর এখনও নেই।”
একটু থামলো নবাব, “কত-শত সমস্যায় যখন অস্থির আমি, তখন নিলয় বললো তোমাকে বিয়ে করতে। আমি প্রথমে রাজি হইনি৷ কারণ তুমি হয়ত আমাকে ভুল বুঝতে পারো, এখনও যে ভুল বুঝছো না তা কিন্তু নয়।… নিলয় আমাকে বুঝিয়ে ছিল তোমাকে বিয়ে করলে অন্যায় হবে না। আমার কাছে থাকলে হয়ত তুমি স্বস্তি পাবে।”
মিষ্টির দিকে তাকিয়ে নবাব বললো, “বিশ্বাস করো তখন আমার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। ওরা যা বলেছিল আমি তাই করেছিলাম কারণ তখন আমার মনে হয়েছিল এতে তোমাকে আমি এসব ঝামেলা থেকে দূরে রাখতে পারবো। তোমাকে পাওয়ার আশায় এসব করিনি মিষ্টি বরং তোমাকে বাঁচাতে আমি ওসব করেছি।”
পুনরায় মাথা নুইয়ে নিলো নবাব আর বললো, “পরিকল্পনা মাফিক বাবার থেকে সোহেলের ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করি। ব্যাটা প্রথমে কিছু বলতে চায়নি। শেষমেশ ভয়ে মুখ খুললো আর এতে আমার মাথা আরও খারাপ হয়ে গেল। ঐ ব্যাটা না-কি বিয়ে করে তোমাকে তালাক দিয়ে নিজের প্রেমিকাকে বিয়ে করতো৷ ভাবতে পারো তুমি? এসব শুনলে কারোর মাথা কি ঠিক থাকবে?” মিষ্টির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতেই মিষ্টি এবার মুখ খুললো, “কী বলছো তুমি এসব?”
“ঠিকই বলছি৷ এরপর যা হয়েছে তা তো তুমি জানোই।” স্তব্ধ যেন হয়ে গেল মিষ্টি। কিছু সময়ের ব্যবধানেও ওর মাঝের স্তব্ধতার অবসান ঘটেনি।
“আর কত আমাকে অবাক হতে হবে বলতে পারো? আর কত নবাব? আর কত?” নবাবকে প্রশ্নবিদ্ধ করেই কেঁদে উঠলো মিষ্টি। ওকে কাঁদতে দেখে নবাবের হৃদয় ছুরিকাহত যেন হলো।
“এই মিষ্টি? কাঁদছো কেন?… আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি, না?”
…চলবে।