#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৪
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
রুমের দরজা বন্ধ করলো নবাব। হাতের ব্যাগগুলো একপাশে রেখে একে একে মাস্ক আর ক্যাপ খুলে মিষ্টিকে বললো, “তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। এখন নাস্তা করতে হবে।”
“সম্ভব না আমাকে দিয়ে।” এই বলে মিষ্টি বোরকা এবং হিজাবসহ বালিশে মাথা রাখলো। ওর এহেন কান্ডে নবাব চমকে গিয়ে বললো, “এই মিষ্টি, কী করছো এসব? বোরকা হিজাব না খুলেই কেন শুয়ে পড়লে? এমন পাগলামি না করে উঠো শীগগির।”
ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মিষ্টি আর কাঠ গলায় বলে গেল, “সিলেটে গিয়ে যে মরার মতো ঘুমিয়ে ছিলে, আমি কিছু বলেছিলাম তখন? তো এবার চট্টগ্রামে আমার ঘুমানোর পালা। ঘুমাতে দাও আমায় কারণ বড্ড চোখ জ্বলছে।” এই বলে সোজা হয়ে চোখ বুজে দিলো মিষ্টি। ডান পাশের চিবুকে ডান হাত আর বাম হাতে অহেতুক বোরকা খামচে ধরে একটু একটু করে ঘুমের রাজ্যে হারাতে শুরু করলো। এতক্ষণ ধরে সবটা দেখে হালকা হেসে উঠলো নবাব, “কী অবস্থা!”
কমলা রঙের টি-শার্ট, কালো টাউজার আর তোয়ালে নিয়ে নবাব ফ্রেশ হতে চলে এলো। যতটা সম্ভব কম দামে রুম ভাড়া করেছে সে কারণ কালকেই চট্টগ্রাম ছেড়ে দিবে তারা। ভাড়া অনুযায়ী রুমটা বেশ ভালো কিন্তু ওয়াশরুমের অবস্থা সুবিধাজনক নয়।
মাথা ভিজিয়ে যখন পানির ফোটা তরতর করে গা গড়িয়ে ফ্লোরে পড়লো, তখন বুকের ভেতর উষ্ণ হাওয়ায় কষ্ট ভাসলো। দেয়ালে হাতের ভরে মাথা নুইয়ে রেখেছে নবাব। মাথার উপর অবিরত পানি পড়ছে। এই মূহুর্তে তার মনে হচ্ছে সে গোসল নয়, কষ্ট ধুয়েমুছে দিচ্ছে পানিতে।
পরিবারের একমাত্র সন্তান হয়েও পিতামাতার প্রতি তেমন কোনও কর্তব্য পালন করেনি নবাব। নিজের মনে যখন যা এসেছে সর্বদা তাই করে গেছে। শুধুমাত্র মিষ্টিকে হারানোর যন্ত্রণায় সে এতগুলো বছর বিদেশে কাটিয়েছে এমনকি এখনও বিদেশেই পড়ে আছে। নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য সে এতটাই লোভী হয়ে উঠেছে যে, মা-বাবাকে যেন একপ্রকার ভুলতে বসেছে।
বাসায় ফোন না করলেও নবাব জেনেছিল নিলয়ের কাছ থেকে৷ মিষ্টিকে তুলে আনার ফলে নবাবের মা এতটা আঘাত পেয়েছেন যে, সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। নিজের মায়ের এমন করুণ পরিনতি মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল নবাবের। সে মিষ্টির সাথে হাসিখুশি থাকলেও দুই পরিবার নিয়ে খুবই চিন্তিত। বাইরে থেকে নিজেকে যতটা শক্ত রাখছে, ভেতর থেকে ঠিক ততটাই ভেঙে পড়ছে নবাব।
ঝরনা কলের মুখ বরাবর নিজের মুখ রাখলো এবার। চোখ বুজে দিতে দু’টো জল ধারা চোখের কোল থেকে বেরিয়ে এলো ঝরনা কলের পানির সাথে মিশে। ভেজা মুখ এবার নড়ে উঠলো, “মা, খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমায়, না?”
প্রায় আধঘন্টার মতো ওয়াশরুমে কাটিয়ে বেরিয়ে এলো নবাব। যেই কান্না হৃদয়ে উত্তাপের সৃষ্টি করেছে, সেটা এখন চোখের জলে শান্ত হয়েছে। ভেজা চুলে তোয়ালে চালিয়ে রুমের চারপাশে নজর বোলালো নবাব। হঠাৎ ঘুমন্ত মিষ্টির উপর চোখ পড়তে দেখলো গুটি-শুটি মেরে নবাবের দিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে। ভেজা তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে নবাব হাঁটু ঘেরে বসলো মিষ্টির পাশে। খুব সাবধানে মুখের হিজাব তুলে দিতে দেখতে পেল মিষ্টি ঘুমে কাদা হয়ে আছে।
একরত্তি ঐ মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের বিচরণ। হালকা ফেঁপে উঠা মুখ দেখে নবাবের মন এক মূহুর্তের জন্য যেন হলো উচাটন। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থেকে ঠোঁটে হাসি ফুটলো নবাবের আর সোনালি হাসিতে সে বিড়বিড় করলো, “মিষ্টি, তোমার ঘর্মাক্ত ললাটের ঐ বিশাল উঠোনে আমি ভালোবাসার পুষ্প নিয়ে এখন হাঁটতে চাই। খুব ইচ্ছে করছে যে ঐ উঠোনে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে যাই। কিন্তু বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলেও মনের সম্পর্কে যে আজও নিবদ্ধ হতে পারলাম না। তাই সকল ইচ্ছেকে কবর দিয়ে বিষাদের পথে পথিক আমি আজও তাই।”
.
চোখের সামনে সিলিং আর এতে ঝোলানো পাখা ঘুরছে ক্লান্ত পথিক রূপে। নিজের অস্তিত্ব আঁচ করতে শোয়া থেকে উঠে বসলো মিষ্টি। শরীর হালকা আড়মোড়া করতেই বিছানার ডান দিকে চোখ পড়লো তার। মেঝেতে বসে বিছানায় মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে নবাব। সদ্য ঘুম ভাঙলেও মিষ্টির একটা হাত অজান্তেই চলে গেল নবাবের মাথার ওপর। হালকা ভেজা চুলে হাত চালাতেই নবাব ধুরমুর করে সোজা হয়ে বসলো। এতে চমকে গিয়ে মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “এ কি! ঘুমাওনি তুমি?”
“এটা কি ঘুমানোর জায়গা?” পাল্টা প্রশ্নে মিষ্টিকে এড়াতে চাইলো নবাব।
“তাহলে মেঝেতে বসে কী করছিলে?”
উঠে দাঁড়িয়ে নবাব জবাব দিলো, “হা-ডু-ডু খেলছিলাম।” এই বলে ভেজা তোয়ালে এতক্ষণ পর ছড়িয়ে দিলো। এটা এতোটা সময় গলায় ঝোলানো ছিল বলে টি-শার্ট কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে নবাবের কাছে।
“কী? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?” মিষ্টির তীক্ষ্ণ চাহনি দেখে নবাব জানতে চাইলো। মিষ্টি সেই চাহনি বহাল রেখে বললো, “ভাবসাব খুব একটা ভালো ঠেকছে না তোমার।” মিষ্টির এমন কথায় নবাব হঠাৎ করে ওর উপর ঝুঁকে এলো। আচমকা এমন কিছু হবে ভাবতে পারেনি মিষ্টি। ভয়ে তাই সে বালিশে পড়ে গেল। নবাব দাঁড়িয়ে থেকে আরও খানিকটা ঝুঁকে এসে বললো, “এত বেশি কথা বলো কেন? তুমি কিন্তু আমাকে সন্দেহও করো অবশ্য সেটার প্রমাণ সিলেটেই দিয়েছো।”
মিষ্টি শোয়া থেকে উঠে বসলো কিন্তু নবাব তেমনই ঝুঁকে রইলো বিধায় সে জিজ্ঞেস করলো, “এমন ঝুঁকে থাকো কেন সর্বদা? হুটহাট চিলের মতো ঝুঁকে পড়ো আর আমি কি ভুল কিছু বলেছি?”
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো নবাব। এরপর শীতল কন্ঠে বললো, “অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু বলবো না।”
কৌতূহলের সৃষ্টি হলো মিষ্টির মাঝে, “কেন? কেন?”
“কারণ এই মূহুর্তে রোমান্টিক কথাবার্তা বলতে আমার ইচ্ছে করছে না।”
বিস্ময়ে মিষ্টির মুখ থেকে নিসৃত হলো, “হোয়াট?”
“জি।” হালকা হেসে জবাব দিয়ে মিষ্টি কপালে আলতো করে টোকা দিলো নবাব। এতে আরও বিস্মিত হয়ে স্তম্ভিত হলো মিষ্টি। নবাব এবার সরে দাঁড়ালো আর মিষ্টিকে না দেখেই বললো, “এখন ফ্রেশ হয়ে নাও। না-কি দুপুরেও খাওয়ার ইচ্ছে নেই?” প্রশ্ন শেষে মিষ্টির দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল লজ্জায় রক্তিম হওয়া মুখ নামিয়ে নিয়েছে মিষ্টি। জড়ানো একটা কন্ঠে কোনোমতে বাক্য খরচ করলো, “আমার বেশিক্ষণ লাগবে না ফ্রেশ হতে।”
“ঠিক আছে।” উত্তর পেয়ে ভারী পায়ে হাঁটলো মিষ্টি ওয়াশরুমের দিকে। ওর দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে নবাব আনমনে জপলো, “এই রক্তিম হওয়া মুখ আমার হৃদয় রক্তিম করে। তবে ঐ ঘুমন্ত মুখ যেন আমায় খুব করে টানে তোমার তরে।” নিজের মনের কথায় হেসে উঠলো নবাব। হাসির মাঝে হঠাৎ তার নিলয়ের কথা মনে পড়লো, “ঐদিকের কাজ কতদূর হলো? নিলয়কে একবার ফোন করতে পারলে কাজ হতো। কিন্তু সেটা যে সিলেট পড়ে আছে। এখন নতুন করে এসবের ব্যবস্থা করাও বড্ড ঝামেলা।” চিন্তায় চোখের পাতা এক হতেই ভেসে উঠলো অর্ষার ছবি আর তাকে জড়িয়ে কিছু পুরাতন স্মৃতি।
ক্লাস শেষ কিন্তু বাইরে বৃষ্টি; ঝুম বৃষ্টি। মেঘ গুড় মুড় করছে না তবে এই নিস্তব্ধ আকাশের বুক চিরে নামা বৃষ্টি বাতাস ভারী করছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে অনেক শিক্ষার্থী বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু নবাব দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অর্ষা। একটু গম্ভীর আর ভয়কাতুর দেখাচ্ছে বলে নবাব জিজ্ঞেস করলো, “অর্ষা, তুমি কি ভয় পাচ্ছো?”
বয়সে বড় না হলেও অর্ষার স্বপ্ন সে চলচ্চিত্রে কাজ করে নায়িকা হবে। তাই তার কথাবার্তায়ও সেটা প্রকাশ করবার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকে, “হুম, খু-উ-ব।” ঠোঁট উল্টে আবার বললো, “সবাই কেমন চলে যাচ্ছে। আসিফও চলে গেছে।”
ইদানীং কারণে অকারণে অর্ষা শুধু আসিফের নাম জপতে থাকে। বিষয়টা নবাবের পছন্দ নয় বলে সে জানিয়ে ছিল কিন্তু তখন অর্ষা বলেছিল, “বারে! আসিফ তো আমার বন্ধু।”
“আর আমি?”
“তুমিও আমার বন্ধু কিন্তু বন্ধুর চেয়ে একটু বেশি।”
নবাব রেগেমেগে বলে উঠেছিল, “বন্ধু! কেন? শুধু বন্ধু কেন? ভালোবাসো না না-কি আমায়?”
“তুমি রাগ করছো কেন নবাব?” বেশ কাঁদো কাঁদো মুখে অর্ষা জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু নবাব উত্তর না দিয়েই প্রস্থান করেছিল। আজকেও আসিফের নাম শুনে তার খুব রাগ হচ্ছে কিন্তু নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় চুপ করে আছে।
“হেই অর্ষা।”
…চলবে
#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_২৫
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
তৃতীয় ব্যক্তির কণ্ঠস্বরে চমকে তাকালো অর্ষা এবং নবাব। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হেঁটে আসা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে নবাবের চোয়াল শক্ত হলো। অন্যদিকে অর্ষা দুই কদম এগিয়ে গিয়ে গেল। অবাক-খুশি হয়ে জানতে চাইলো, “আরে আসিফ! আমি তো ভাবলাম তুমি চলে গেছো।”
একটু বেশি ফর্সা এবং স্বাস্থ্যের অধিকারী আসিফ শরীর দুলিয়ে বলে উঠলো, “আমি তো প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
“ওহ।”
“বাসায় যাবে না?”
“হ্যাঁ, তা যাবো কিন্তু বৃষ্টি…” অর্ষার আমতাআমতা করার মাঝে আসিফ বলে উঠলো, “ডিয়ার, আমি আছি না? কাম উইথ মি।”
এতক্ষণ ধরে নবাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবটা দেখলো চুপটি করে। এখন অর্ষার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সে আসিফের সাথেই যাবে। নবাব গত এক সপ্তাহ ধরেই অর্ষা প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠেছে। বিষয়টা সে মিষ্টিকেও জানিয়ে ছিল, “এই আপু, অর্ষাকে দেখলে আমার রাগ লাগে।”
“কেন ভাই?”
“ওর আচরণে হয়ত।”
“তাহলে কী করতে চাও এখন?”
“জানি না। আসলে এখনও কিছু ভাবিনি।” সেদিন নবাব দ্বিধায় ভুগছিল কিন্তু আজ এই মূহুর্তে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, “এমন মেয়ের সাথে আর কোনও সম্পর্ক নয়।”
বাইরে চকচকে রোদ কিন্তু মনের আকাশে গুড় মুড় করছে ধূসর মেঘ। ঘরময় গরমের ছোড়াছুড়িতে পাখার বাতাস যেন গায়ে পৌঁছানোর আগেই মিইয়ে যাচ্ছে। মোটামুটি গোছানো কক্ষের এক পাশে পাতা কাঠের বিছানায় শরীর এলিয়ে আছে নবাব। বালিশের ওপরে ডান হাত তার ওপরে মাথা রেখে ভাবছে সে। সাদা চোখে তাকিয়ে সে মনে মনে কথা বলছে, “আজকে অর্ষা নাচতে নাচতে আসিফের সাথে চলে গেল। আসিফকে পেয়ে আমার কথা একদম ভুলে গেছে। রাগে যে আমি পিছন থেকে চলে এসেছি সেটাও দেখেনি। ওর মতো মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করাও ঠিক নয়।” ছোট্ট একটা নিশ্বাসে চোখ বুজে দিতেই পাশের ফোনটা বেজে উঠলো।
গেম খেলার জন্য মায়ের ফোনটা নিয়ে এসেছিল নবাব কিন্তু একটুও খেলতে ইচ্ছে করেনি তার। তাই বালিশের পাশে ফেলে রেখে চিন্তায় ডুব দিয়েছিল। সব ভাবনা এবার ঝেড়ে ফেলে যখন ফোনটা হাতে নিলো নবাব, তখন নিজের অজান্তেই ঠোঁট প্রসারিত হয়ে নড়ে উঠলো, “মিষ্টি।”
কল রিসিভ করতেই নবাব শুনতে পেল, “ঘুমোচ্ছো না-কি গেম খেলছো?”
“একটাও না।”
“মন খারাপ?” নবাব বেশ স্বাভাবিক গলায় এবং হাসিমুখে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার প্রচণ্ড মন খারাপ টের পেয়ে গেল মিষ্টি। এড়ানোর চেষ্টা না করে নবাব মিনমিনে গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কে বলেছে তোমায়?”
“আমার মন বলেছে। এই দেখো না, এখন ফোন করলাম। এমন দুপুরে কখনও দেখেছো আমায় তোমাকে কল করতে?”
“তুমি না অনেক ভালো মিষ্টি আপু।” বলতে গিয়ে হঠাৎ চাপা কান্নায় গলা ভারী হলো নবাবের। মিষ্টি সেটা টের না পাক এমনটা চেয়েছিল নবাব। কিন্তু কন্ঠস্বর তার মনের অবস্থা মিষ্টিকে জানান দিতে সে জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে ভাই?”
নবাব চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “কিছু হয়নি। তবে আমি অর্ষার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাই না।”
“কেন?” অবাক হলো মিষ্টি।
“কোনও কারণ নেই আপু। তবে যোগাযোগের কোনেও ইচ্ছে নেই আমার। তাছাড়া ও নিজের লাইফে অনেক খুশি। অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে ওর। বড় হয়ে আবার সিনেমায় কাজ করার শখ আছে। ওর এমন চাকচিক্যময় জীবনে আমার কোনও ভূমিকা নেই। তাই জন্যে যোগাযোগ বন্ধ করা।”
“ভালোবাসতে ওকে?” মিষ্টির গলায় সহানুভূতির সুর।
একটু সময় নিলেও বেশ শক্ত গলায় জবাব দিলো নবাব, “বোধহয় না।”
“বোধহয় কেন? তুমি নিশ্চিত করে জানো না বুঝি, তুমি ওকে ভালোবাসো কি না?”
“আসলে আপু, আজকে আমি উপলব্ধি করলাম আমি এখনও ভালোবাসার মানেই জানি না। বুঝি না ভালোবাসা কাকে বলে? তবে অর্ষার প্রতি হয়ত আমার কখনও ভালোবাসা ছিল না। আমি ওকে কখনও বলেও দেখিনি ভালোবাসার কথা। ওকে ভালো লাগতো, ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগতো তার মানে এইসব আমার ভালো লাগা ছিল, ভালোবাসা নয়।”
“বাহ! ভালোই তো বলতে শিখে গেছো দেখছি। তা হুট করে এত বড় কবে থেকে হয়ে গেল।”
নরম গলায় জবাব দিলো নবাব, “যবে থেকে তুমি আমার জীবনে এলে।”
“কিহ!” বিস্মিত হলো মিষ্টি।
“হ্যাঁ আপু, সত্যি বলছি। তোমার সাথে কথা বললে নিজেকে কখনও ছোট মনে হয় না, বয়সে বড়ই মনে হয়। তাছাড়া তোমার সাথে রোজ রোজ কথা না বললে খুব খারাপ লাগে আমার। আর তুমি যে আমার এত খবর নাও। মন খারাপ হলেও বুঝে যাও অথচ তোমাকে বলতে হয় না এমনটা না মা ছাড়া কেউ বুঝে না। বাবার সাথে তো তেমন কথা হয় না। জানোই তো বাবা কাজ নিয়ে থাকেন আর দাদী তো অসুস্থ থাকেন বেশিরভাগ। তাছাড়া উনাকে আমার খুব একটা পছন্দ নয়।” শেষ বাক্যে নবাবের কন্ঠে বিরক্ত ফুটে উঠলো।
“এভাবে বলতে হয় না ভাই।”
“জানি আপু, কিন্তু সত্যিটাই বললাম। আর এটাও সত্যি যে মা এবং তুমি ছাড়া আমার তেমন কোনো বন্ধু নেই।”
“হুম, তা তো জানি। একটা কথা বলবো?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলো।” আগ্রহ প্রকাশ করলো নবাব।
“দেখো, ভালোবাসা কাকে বলে আমিও জানি না। এসব নিয়ে তোমার সাথে আলোচনা করার বয়সও হয়নি তোমার। তবে এতটুকুই বলবো তোমার বয়স এখন কম। তাই তোমার চোখে এখন রঙিন চশমা আর এই চশমা পড়া চোখ যা দেখবে তাই ভালো লাগবে। কিন্তু এই হাজারও ভালো লাগার ভিড়ে যেই মেয়ে তোমার হৃদয়ে স্থান করে নিবে, যে তোমার শত কষ্টের মাঝে এক চিলতে হাসির কারণ হবে, যাকে চাইলেও ভুলতে পারবে না; বুঝে নিবে সে-ই ছিল তোমার ভালোবাসা।” মিষ্টির প্রতিটা কথা নবাব খুব মন দিয়ে শুনলো আর অনুভবও করলো, “হ্যাঁ, এটাই তো ভালোবাসা আর আমি এমন ভালোবাসাই চাই।”
স্কুলে পা রাখতে গিয়েই অর্ষাকে দেখতে পেল নবাব। আসিফের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর হেসে হেসে লুটিয়ে পড়ছে। এমন দৃশ্যে নবাবের হাতের মুঠো শক্ত হলো। কিন্তু সারারাত ধরে সে যা ভেবেছে, সেটা মনে পড়তেই নিজেকে শান্ত করলো। ধীরে ধীরে অর্ষার কাছে এসে ডাকলো, “অর্ষা?”
ফিরে তাকালো অর্ষা কিন্তু নবাবকে দেখে ওর মুখের হাসিটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো একটু একটু করে মিইয়ে গেল। কী যেন ভেবে হঠাৎ-ই হারিয়ে যাওয়া হাসিটা টেনে এনে ঠোঁটের কোণে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কখন এলে?”
আঁড়চোখে আসিফকে দেখে গম্ভীর গলায় নবাব বললো, “তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে।”
“তো বলো।”
“এখানে নয়।” নবাব ইতস্তত করতেই অর্ষা এবং আসিফ দুইজনেই সেটা বুঝতে পারলো আর তাই আসিফ নিজেই চলে যাওয়ার চিন্তা করলো, “অর্ষা, তোমরা কথা বলো। আমি যাচ্ছি।”
“ওকে।” অর্ষা জবাব দিতেই আসিফ দ্রুত পায়ে চলে গেল। সামনে পা বাড়িয়ে নবাব বললো, “চলো।”
চলতে চলতে অর্ষা জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে এমন লাগছে কেন নবাব? আর ইউ ওকে?”
কাঠ গলায় নবাব জবাব দিলো, “আমি এসব কিছু শেষ করতে চাইছি।”
“কোন সব?” বুঝতে পারলো না অর্ষা।
জবাব দিতে দাঁড়ালো নবাব, “এত বিস্তারিত বলার মতো কিছু নেই। আজকের পর তুমি আমাকে কখনও কল বা ম্যাসেজ করবে না এমনকি স্কুলেও কথা বলার চেষ্টা করবে না।”
“কেন?” স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো অর্ষা। কিন্তু নবাব অবাক হলো ওর স্বাভাবিক কন্ঠে কারণ নবাব ভেবেছিল অর্ষা অবাক হবে। অর্ষা যেহেতু অবাক হয়নি তাই নবাব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা বললো, “সেটা তো তোমার জানার কথা, তাই না? নিজে থেকে প্রেমপত্র দিলে আমাকে অথচ বন্ধু বলে পরিচয় করাও সবার কাছে। আবার ঐ আসিফের সাথে…” বলতে গিয়ে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো নবাব।
অর্ষা হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে সবটা শুনে বললো, “তোমার কাছ থেকে এটা আমি আশা করিনি নবাব। তোমাকে আমি ভালো ভেবেছিলাম কিন্তু তুমি এমন নিচ…” অর্ষার কথার নবাব থামিয়ে দিলো, “ওয়েট, ওয়েট, কী বললে তুমি? আমি নিচ? সিরিয়াসলি অর্ষা? আমাকে নিচ বলতে তোমার মুখে বাঁধেনি? তুমি কি ভেবেছো আমি বাচ্চা? তোমার এই স্কুলে হঠাৎ আসার কারণ আমি জানি না।” হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলো। ওকে হাসতে দেখে চমকে গেল অর্ষা। আশেপাশের ছাত্রছাত্রীরা তাদের কৌতূহলী চোখে দেখছে বলে অর্ষা মাথা নুইয়ে নিলো।
অর্ষা দিকে এগিয়ে এসে হিসহিসিয়ে নবাব বললো, “নাঈমের সাথে যে প্রেমপ্রীতি করতে আর সেই জন্য তোমাকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে, এসব আমার অজানা নয়। নেহাতই তোমার বাবা বড় লোক বলে আগের স্কুলের প্রিন্সিপাল বিষয়টা চেপে গেছে। এতসব কান্ড করে তুমি আসছো নবাবের সাথে প্রেম করতে?”
ছলছল চোখে অর্ষা তাকিয়ে নবাবকে বুঝানোর চেষ্টা করলো, “বাট নবাব, আই রিয়েলি লাভ ইউ।”
নবাব বুঝতে পারছে অর্ষা নাটক করছে। তাই সে এসবে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলো, “তোমার মতো মেয়েরাই মেয়ে জাতিকে কলঙ্কিত করছে। তোমাদের কাছে ছেলেদের মন খেলনা হয়ে গেছে। ইচ্ছে হলো খেললে এরপর ছুঁড়ে ফেলে দিলে। তোমার দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।… ভবিষ্যতে তোমার এই নোংরা চেহারা আমাকে দেখাতে এলে আমি এসিড ছুঁড়ে মারবো, মনে রেখো।” সেদিন অর্ষাকে পিছনে ফেলে হাঁটতে গিয়ে নবাব অনুভব করেছিল, “অর্ষা এবং মিষ্টি আপু দুইজনেই মেয়ে জাতি অথচ আকাশ-পাতাল ব্যবধান। মিষ্টি আপুকে নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগে। আচ্ছা, এই ভালো লাগাটা কি শুধুই ভালো লাগা?” ঐদিনের প্রশ্ন আজকে মনের খাতায় ভেসে উঠতে হেসে ফেললো নবাব৷ আয়নাতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে জবাব দিলো, “নাহ, ভালো লাগা যদিও শুধু ভালো লাগাই হতে পারে কিন্তু এর স্থায়ীত্ব বৃদ্ধি পেলেই সেটা চট করে ভালোবাসায়ও পরিণত হতে পারে।”
দরজার শব্দ হতেই ওয়াশরুমের দিকে তাকালো নবাব। ভেজা মুখে তোয়ালে চালিয়ে দৃষ্টি চঞ্চল করছে মিষ্টি। ওর চেহারায় এখন রক্তিম আভা ছড়ানো রয়েছে অর্থাৎ এখনও লজ্জায় আবদ্ধ হয়ে আছে। আর সেটা বুঝতে পেরে নবাব নিজের মনে কিঞ্চিৎ হেসে নিলো।
মিষ্টি ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে রুমের দিকে যেতে নিলে নবাব ডেকে উঠলো, “এই মিষ্টি?” নবাবের কন্ঠে এমন একটা তীব্রতা ভেসে উঠলো যে মূহুর্তেই মিষ্টির হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পেল এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু লজ্জার জালে মন জড়িয়ে থাকলে সাধারণ কথাবার্তায়ও ভয়ংকর লজ্জা লাগে।
…চলবে